কাঁটাকম্পাস পর্ব-৪+৫

0
432

#কাঁটাকম্পাস #পর্ব৪

#আরশিয়া_জান্নাত

নিজের বাড়িতে উপস্থিত হবার খানিকবাদেই করিমুন্নেসা নাতনিকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। দরজা আটকে বসতেই আরওয়া ফোঁড়ন কেটে বলল, বুড়ি তোমার তো ভালোই লোভ নাতনির বাসরঘরের কিচ্ছা শোনার! লজ্জা নাই একটুও লজ্জা নাই

করিমুন্নেসা ওর গাল টেনে বলল, এরে তোর মশকরা বাদ দি আরে অন হাছা করি ক ঘটনা কি?

আরওয়া দাদীর পানের বাটা কোলে তুলে পান সাজাতে সাজাতে বলল, দাদীজান উনি আমাকে বলেছেন এই বিয়ে তিনি মানেন না। আমাকে উনি বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছেন। আমাকে স্ত্রীর মর্যাদা উনি দিতে পারবেন না।

পুরো ঘটনা শুনে করিমুন্নেসা হোহো করে হেসে উঠলেন। তার হাসির তোপে আরওয়াও হাসতে লাগলো।
বহুকষ্টে হাসি থামিয়ে আরওয়া বলল, আল্লাহ দাদীজান থামো। আমার পেট ব্যথা করতেছে।

করিমুন্নেসা হাসি থামিয়ে বললেন, আস্তাগফিরুল্লাহ। আল্লাহ মাফ করো, এতো হাসোন ভালা না।

তোমার ঘটনা বুঝি না। তুমি এমন হাসতেছো কেন? আমার একটা মাত্র স্বামী সে আমারে মেনে নিবেনা বললো‌। আর তুমি দাদী হয়ে এই ঘটনা শুনে হাসতেছ? কোথায় ভাবছি তুমি আমারে জড়াই ধরে মরাকান্না জুড়ে দিবা!

আর কথা রাখ, আগে ক হেতের কোনো ফেমিকা টেমিকা আছে নি? হেতে কিল্লাই তোরে বৌ মাইনতো নো জিগ্গাস নো?

জিজ্ঞাসা করছি তো। বলে যে উনি উনার ব্যক্তিগত কথা কাউকে বলেনা। লে হালুয়া!

করিমুন্নেসা কিছুক্ষণ চুপ থেকে কি যেন ভাবলেন। তারপর হাসিমুখে বললেন, বুবু সবে তো বিয়ে হইছে। এখনি কোনো সিদ্ধান্ত নেওন ঠিক হইতো নো। বিয়ার আগে মানুষের মনে কত কী থাকে, বিয়ের পর সেসব বদলাই যায়। তাকদীরে যে থাকে সে ব্যতীত যতোজনই আসুক যাক কাম হয়না। তুই আগে কোগা মাস সংসার কর, দেখ হেতের মন বদলায় নি। আই এমন কতো মাইনষেরে দেখছি। বিয়ার পর সব ঠিক হই যায়। জামাই বৌয়ের মিল মোহাব্বত হইতে টাইম লাগেনা।

দাদীজান, তোমাকে আগে থেকেই বলে দিচ্ছি। আমার যদি মনে হয় এই বিয়েতে কোনো আশা নেই। তবে চলে আসতে আমি ২বার ভাববো না।তখন কিন্তু আমারে যাই বলো কাজ হবেনা। তোমার কথায় আমি নাচতে নাচতে বিয়েতে বসেছি, ভালো একটা ছেলে আনতে পারলা না।

তোরে আর মনের কতা কই হুন। শুরুতে মিডা ভালা নো, মিডা জিনিসের মধু হবরে শেষ হই যায়। শুরুতে যা তিতা হয় শেষে সেডাই মিডা ফড়ে। আল্লাহ দিলে তোগো বংশের মাইয়ারা স্বামীসোহাগী হয়। তুইও হইবি চাইস।

দরজায় কড়াঘাত পড়তেই আরওয়া দরজা খুলে দিলো, আরওয়ার মা শিরিন হড়বড় করে বললেন, একি আরওয়া তুই জামাইকে একা ফেলে এখানে দরজা আটকে বসে আছিস? সে কি ভাবছে বল তো?

উনি কিছুই ভাবছেন না বরং…

আরওয়াকে থামিয়ে ওর দাদী বললো, বৌ আই হেতিরে এনে আইনছি। দেখি আয়েশা চল দেখি তোর জামাই গোসসা কইচ্ছে নি।

আরওয়াকে নিয়ে তিনি দ্রুত বসার ঘরে গেলেন, পথে ফিসফিস করে বললেন এই ব্যাপারে এখন কাউকে কিছু না বলতে।

জাওয়াদ চুপচাপ সোফায় বসে আছে। তার সামনে বাহারি পদের নাস্তা দেওয়া হয়েছে। ছোটবড় বেশ কয়েকজন ছেলেমেয়ে তাকে ঘিরে বসে আছে। সবাই তাকে মিষ্টি নিতে বললেও সে কিছুই নিচ্ছে না। আরওয়ার ছোটবোন সোহা বললো, ভাইয়া আপনি কিছু ই নিচ্ছেন না কেন? এই পিঠাটা খেয়ে দেখেন অনেক মজা!

জাওয়াদ ভদ্রতার খাতিরে ওর বাড়িয়ে দেওয়া ফুলসুন্দরী পিঠাটা নিলো। পিঠাটা খেয়ে মনে হলো ব্যাটারটা মিষ্টি না হয়ে নোনতা হলে আরো বেশি মজা লাগতো। আরওয়া আসতেই রাতুল বললো, আপু এদিকে আয় তাড়াতাড়ি, দুলাভাই তো তোকে ছাড়া কিছুই খাচ্ছে না। কোথায় ছিলি এতোক্ষণ।

আরওয়া বলল, তোরা এতোজন থাকতে উনি না খেয়ে বসে আছে কিভাবে? ছি ছি রাতুল আমাদের বাড়ির মানসম্মান ডুবিয়ে দিলি দেখছি! তোরা সব জনে জনে এসে একটা একটা আইটেম খাইয়ে যা,নয়তো পরে আমাকে খোঁটা দিয়ে বলবে খালিমুখে বসিয়ে রেখেছি!

ওর কথা শুনে, সবাই এক এক প্লেট থেকে এক এক আইটেম জাওয়াদকে খাওয়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমে গেল। জাওয়াদ বেচারা না পারছে খেতে না পারছে ওদের বাঁধা দিতে। যতবার না বলেছে পাশ থেকে আরওয়া উস্কে দিয়ে বলছে, তোদের দুলাভাই হ্যাঁ বলতে লজ্জা পায়। তার হ্যাঁ মানে না, না মানে হ্যাঁ। তোরা খাওয়াতে থাক।

জাওয়াদ কটমট করে আরওয়ার দিকে তাকালো। শেষে না পারতে উঠে বললো, প্লিজ আর পারছি না আমায় মাফ করো।

বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে জাওয়াদ মনে মনে আরওয়াকে বকতে লাগলো। এই মেয়ের জন্য আজ ওর পেট ফেটে যাচ্ছে। খাবার না দিয়ে মানুষকে শাস্তি দেওয়া হয় এমন অনেক দেখেছে, কিন্তু খাবার খাইয়েও যে শাস্তি দেওয়া যায় তা এই প্রথম নিজে ভোগ করলো। তাও ভাগ্য ভালো আরওয়া এখনো রুমে আসে নি।এই মেয়ে তো আবার তাকে বিছানায় শান্তিতে শুয়ে থাকতে দেখা সহ্য করতে পারেনা।

একটু বাদেই আরওয়া রুমে ঢুকলো। মিষ্টি স্বরে বললো, ওগো শুনছেন। ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি?

জাওয়াদ জবাব দিলো না, মটকা মেরে পড়ে রইলো। আরওয়া ওর মাথার কাছে বসে বললো, আমি জানি আপনি ঘুমান নি। আপনার জন্য একটু গরম পানি এনেছি, খেয়ে নিন খাবার হজমে সাহায্য করবে।

জাওয়াদ উঠে বললো, জুতা মেরে গরুদান করতে এলেন?

ছি ছি কি যে বলেন না আপনি! ওরা আপনাকে এতো ভালোবেসে আপ্যায়ন করলো আর আপনি কি না ভুল বুঝলেন।

আমাকে যন্ত্রণা দিয়ে খুব মজা পাচ্ছেন তাই না?

আপনি পানিটা খেয়ে রেস্ট করুন।

আরওয়া দাঁড়ান।

জ্বি?

আপনি চাইলে থেকে যেতে পারেন। আমি আগামীকাল ফেরার সময় আপনাকে নিতে চাইছি না।

আপনি না চাইলেও কি? বিয়ে করেছি কি বাপের বাড়ি পড়ে থাকতে?

তার মানে আমার শর্তে আপনি রাজী?

কোন শর্ত?

আমার থেকে স্ত্রীর মর্যাদা পাবেন না…

সলিড রিজন বলুন, তারপর ভেবে দেখবো।

জাওয়াদ পানি পান করে অবজ্ঞার স্বরে বললো, সেটা বললেও আপনি বুঝবেন না। আর আমি বলতেও ইচ্ছুক নই।

আরওয়া ভীষণ ক্ষেপে গেল, সবসময় এতো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে বলা তার মোটেও পছন্দ না। বুঝিয়ে বললে কে না বোঝে, সে কি গাবেট নাকি যে বুঝবে না?
জাওয়াদের কলার চেপে কাছে এনে বললো, নিজেকে নিজে আপনি কি ভাবেন হ্যাঁ? সবজান্তা সমীপেষু? আপনি ব্যতিত আর কারো মাথায় বুদ্ধি নেই? গাঁয়ে জোর‌ নেই?

ঘটনার আকস্মিকতায় জাওয়াদ হকচকিয়ে গেল। আরওয়া হঠাৎ এতো নিকটে চলে আসবে সে কল্পনাই করেনি। রাগের চোটে আরওয়ার নাকের পাটা হালকা ফুলে উঠছে, ঠোঁট জোড়া কেঁপে কেঁপে উঠছে, চোখেমুখে তীব্র ভৎসনা প্রতীয়মান।
জাওয়াদ ওর চোখের দিকে চেয়ে শান্তস্বরে বললো, রাগ নিয়ন্ত্রণ করুন। অতিরিক্ত রাগ মানুষের ক্ষতি বৈ ভালো কিছু বয়ে আনে না।

অন্যকে নীতিবাক্য বলা সহজ। নিজে করা কঠিন। আমার রাগ ক্ষতি বয়ে আনে তাই তো বেশ‌ তবে ক্ষতিসাধন করেই দম ফেলি কি বলেন?

জাওয়াদ ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি তে তাকাতেই আরওয়া তার গলায় খুব জোরে কামড় বসালো। জাওয়াদ ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে মৃদু চিৎকার করে বললো, এ কেমন হিংস্রতা আরওয়া? আপনার মাথায় আসলেই সমস্যা আছে! কি রাক্ষুসে দাঁত আপনার, উফফ জ্বলছে।

আরওয়া কারো ঋণ রাখেনা। তাকে যা দিবেন তাই ফেরত পাবেন। হোক সেটা ঘৃণা কিংবা ভালোবাসা!

জাওয়াদ গলায় হাত দিয়ে দেখলো রক্ত ঝরে ভীষণ জ্বলছে। সহ্যের সীমা পেরিয়ে রাগের পারদ আপনা আপনি বেড়ে গেল। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে আরওয়ার মাথার পেছনে এক হাত দিয়ে টেনে তাদের মাঝের দূরত্ব ঘুচিয়ে ঠোঁটজোড়া দখল করলো, আরেক হাতে শক্ত করে কোমর খামচে ধরলো আক্রোশে। আরওয়া ছোটার জন্য মোচড়ামুচড়ি করলেও জাওয়াদের বলিষ্ঠ বন্ধনী থেকে ছুটতে পারলো না। জাওয়াদের তীব্র চুম্বনে তার দম বন্ধ হবার উপক্রম। বেশ খানিকক্ষণ পর জাওয়াদের রাগ পড়তেই সে তাকে ছেড়ে দিলো। আরওয়া ঠোঁটে হাত চেপে দেয়ালে ঠেস দিয়ে ফ্লোরে বসে জোরে জোরে‌ শ্বাস ফেলতে লাগলো। আরেকটু হলে বোধহয় শ্বাসরোধেই মরে যেত!

জাওয়াদ বাঁকা হেসে বললো, নেক্সট টাইম কিছু করবার আগে ১০০বার ভেবে নিবে প্রতিক্রিয়া সহ্য করবার ক্ষমতা আছে কি না!

আরওয়া আর্তনাদ করে বললো, আপনি একটা খারাপ লোক। আমার ইজ্জত লুট করে ফেললেন কেন!

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে বললো, ভাঙবে তবুও মচকাবে না!

বলেই সে বেরিয়ে গেল। আরওয়া বিলাপের সুরে বলতে লাগলো, আমার প্রথম চুমুটা নষ্ট করে দিলো রে। বজ্জাত লোক আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা সব এভাবে বরবাদ করে দিলো। কত স্বপ্ন ছিল আমার ভালোবাসাময়ী চুমু হবে। এ আমার কি সর্বনাশ হলো রে, আমার সব স্বপ্ন শেষ করে দিলো রে…..

আমিনুল ইসলাম চিন্তিত গলায় বললেন, আম্মা ঘটনা কি হয়েছে জানেন‌ কিছু? জাওয়াদ হঠাৎ কাউকে কিছু না বলে চলে গেল কেন? আরওয়া কি আপনাকে কিছু বলেছে? ওদের মধ্যে কোনো ঝামেলা হয় নি তো?

করিমুন্নেসা পান চিবুতে চিবুতে বলল, দেখো বাবা এটা ওদের মিয়া বিবির মামলা। আমি জানবো কিভাবে? কাল রাতে খাওয়ার সময় ও তো সব ঠিকঠাক ই ছিল। হঠাৎ কি হলো কে জানে?

আম্মা আরওয়া খুব দুষ্ট প্রকৃতির মেয়ে। ও স্বামী সংসারের মর্ম বুঝবে কি না কে জানে। আমি কত করে বলেছি ওর গ্র্যাজুয়েট টা আগে হোক তারপর বিয়ের কথা ভাববো। আপনি তো শুনলেন না।

শুন আমিন ওর বয়সের মেয়েরা ৩বাচ্চার মা হয়ে স্বামীসংসার ও সামলায়। ২১ বছরের মাইয়ারে ছোডো ভাবোস কেমনে? ছেলেমেয়ে সাবালক হলে বিয়ে দেওয়া বাপ মায়ের ফরজ।

কিন্তু ওর মধ্যে ম্যাচিওরিটি নাই। আমি নিশ্চিত ও এমন কিছু করেছে যার কারণে জামাই রাগ করে বেরিয়ে গেছে।

জাওয়াদকে প্রবেশ করতে দেখে আমিনুল ইসলাম কাছে গিয়ে বললেন, কোথায় গিয়েছিলে বাবা? কোনো সমস্যা হয়েছে?

জাওয়াদ বিনীত ভঙ্গিতে বললো, আমি খুব দুঃখিত আঙ্কেল। কাল রাতে একটা আর্জেন্ট কাজে চলে যেতে হয়েছিল। আপনারা ঘুমিয়ে পড়েছিলেন বলে জানিয়ে যেতে পারিনি।

আমিনুল ইসলাম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আরেহ না না এটা কোনো ব্যাপার না। আসো ভেতরে আসো।

করিমুন্নেসা বললেন, নাতজামাই আংকেল ডাকো ক্যান শ্বশুড়রে কেউ আংকেল ডাকে? আব্বা ডাকো।

আমিন বললো, আহা মা থাক না ওর ইচ্ছে হলে ডাকবে পরে।

ইচ্ছা অনিচ্ছার কি আছে? সম্পর্ক যখন হইছে পালন করতে হইবো না? বিয়ে খালি ছেলে মেয়ের মধ্যে হয় না। ওদের মাধ্যমে দুইটা পরিবার ও এক হয়। আমি কি ভুল বলছি?

জাওয়াদ বললো, না দাদী আপনি সঠিক বলেছেন। আচ্ছা আব্বা আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে আমরা আজ বিকেলে ই ফিরতে চাই।

ঠিক আছে বাবা, আমি আপত্তি করবো না। তবে আরো একটাদিন থাকলে ভালো লাগতো।

আসলে আমাকে কাল সকালে চট্টগ্রাম যেতে হবে। হঠাৎ একটা কাজ পড়ে গেছে, পরে দরকার হয় আবার আসবো।

আচ্ছা বেশ!

জাওয়াদ উপরে যাওয়ার সাহস পেল না। আরওয়া তাকে কি না কি ভাবছে এই অস্বস্তি তে কাল রাতে সে বেরিয়ে গিয়েছিল। এখানে থাকলে ঘুরেফিরে ওর সামনেই পড়তে হবে, একা যে বাসায় ফিরবে সে পথও নেই। তাই কোনোরকম বাহানা দিয়ে এখান বেরিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে। চট্টগ্রামে কয়েকদিনের জন্য পগারপার হবার সব বন্দোবস্ত সে করে এসেছে, দাদাসাহেব ও দ্বিমত করতে পারবেন না। আপাতত কিছু দিন আরওয়া থেকে দূরে দূরেই থাকা যাবে ভাবতেই শান্তি লাগছে।

চলবে,,

#কাঁটাকম্পাস #পর্ব৫

#আরশিয়া_জান্নাত

নাহিয়ান বাটার দেওয়া ব্রেডে আধা চামচ চিনি ছড়িয়ে দিয়ে এক কামড় খেয়ে বললো, দাদাসাহেব আমি বলি কি জাওয়াদের যখন চিটাগং যেতেই হবে তো আরওয়াকেও সাথে নিয়ে যাক। ওখানে অনেক সুন্দর সুন্দর ট্যুরিস্ট স্পট আছে। কাজও হবে আবার বেড়ানোও হবে।

সালমা তার কথায় সায় দিয়ে বললো, নাহিয়ান ঠিকই বলছে। ওর বুদ্ধি আমার পছন্দ হইছে, আপনি ওরে বলেন যাতে নতুন বৌরে সাথে করে নিয়ে যায়।

জোবায়ের সাহেব চিনি ছাড়া চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, প্রথম কথা হলো ডাক্তার হয়ে যদি চিনির মায়া ছাড়তে না পারে সে অন্যকে নিষেধাজ্ঞা দিবে কিভাবে?

নাহিয়ান আরেকটাতে চিনি দিতে দিতে বললো, দাদাসাহেব ডায়বেটিস আমার দুইপক্ষের গুষ্টিতেই আছে। তার মানে আগে পরে আমার হবেই! তখন তো আপনার মতোই চিনি ছাড়া চলতে হবে।সেই দূর্বিষহ ভবিষ্যৎ এর চিনির ঘাটতি এখনি পূরণ করছি। অন্তত বয়সকালে বলতে পারবো ‘একদা মনের সুখে উদরপূর্তি করিয়া চিনি খাইতে পারতুম!’

নাহিয়ানের মা চোখ গরম করে ছেলের দিকে তাকালেন। এই পরিবারে একমাত্র নাহিয়ান ই পারে দাদার সামনে যা ইচ্ছা তা বলে ফেলতে। ওর আবার অতো ভয় ডর নেই।

Prevention is better than cure, যাইহোক ২য় কথা বলি। জাওয়াদ যাবে কাজে, ওকে বেশিরভাগ সময় অফিসেই থাকতে হবে। সেখানে নওয়াবিকে পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা দেখছি না। ও শখ করে গেল আর সারাদিন হোটেলরুমে একা পড়ে রইলো, এরচেয়ে ভালো হয় ও এখানে থাকুক।

নাহিয়ান ফিসফিস করে দাদীকে বলল,দাদী আমাকে একটা সত্যি কথা বলবা, তোমার ৩ছেলে ২মেয়ে হলো কিভাবে? আমার দাদার যেই রসকষহীন মানসিকতা। তোমার অতীত ভেবে আমার বড় মায়া লাগে গো…

সালমা আফসোসের সুরে বললেন, আর বলিস না ভাই। সারাজীবন এই কাজ কাজ কইরা শেষ করছে। না নিজে ঘুরতে গেছে, না কাউরে যাইতে দিতে চায়!

জোবায়ের সাহেব গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন, তোমরা যা বলছো আমার মনে হয় না এখানে কেউ সেসব না শুনে আছে। অযথা চোরের মতো ফিসফিস করা বাদ দাও।

আমি কি ভুল কিছু বলেছি? যদি আমার কথায় একরত্তি ভুল দেখাইতে পারেন তবে আমি এই মুখে তালা দিলাম। আর যদি না পারেন তবে ওদেরকে যাওয়ার অনুমতি দেন। নতুন বিয়ে হইছে এমন জামাই বৌরে কেউ আলাদা করে? ওদের রূহ ও আপনারে বদদোয়া দিবো।

আচ্ছা ঠিক আছে, ও নিতে চায় তো নিবে।

নাহ জাওয়াদ রে আপনি আদেশ‌ দিবেন যাতে নিয়ে যায়। সবকিছু তো আদেশ দিয়ে করান এটার বেলা ওর উপর ছাড়বেন কেন?

কথাটা যে কিঞ্চিৎ খোঁচা দিয়ে বলেছে সালমা জোবায়ের সাহেব খুব ভালোই বুঝেছেন। বিয়ের ব্যাপারে তিনি বহুবার বলেছিলেন নাতির মতামত নিতে, সংসার ও করবে অন্য কেউ না। ওর মতামত অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু জোবায়ের সাহেব সেটা কানে তোলেন নি। তার অগাধ বিশ্বাস জাওয়াদ এর জন্য তিনি যা সিলেক্ট করবেন তার চেয়ে বেস্ট আর কিছু হবেনা।

ব্রেকফাস্ট সেরে নাহিয়ান হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হবার সময় জাওয়াদ আর আরওয়া বাড়িতে প্রবেশ করে। নাহিয়ান জাওয়াদের কানে কানে বলে গেল, তোর সুবিধা করে দিয়ে গেলাম। ট্রিট হিসাবে কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়াইস।

জাওয়াদ ওর কথার আগামাথা কিছুই বুঝলোনা। জোবায়ের সাহেব বললেন, জাওয়াদ রওয়ানা দিবে কখন?

এই তো দুপুরের দিকে বের হবো।

রফিককে বলে ছিলে?

জ্বি।

আচ্ছা, তাহলে নওয়াবিকে সাথে করে আল্লাহর নাম নিয়ে রওয়ানা হয়ে যেও।

কার কথা বলছেন দাদাসাহেব আরো কেউ যাবে নাকি আমার সাথে?

সালমা হেসে বলল, নতুন বৌরে আমাদের গ্রামে নওয়াবি বলে পাগল। তোর দাদাভাই তোর বউকে সাথে নিতে বলেছে।

জাওয়াদের কপালে সূক্ষ্ম ঘামের রেখা দেখা দিলো। যার থেকে পালাতে এতো কিছু তাকেই সাথে নিতে হবে! এ কেমন নসীব তার?

দাদাসাহেব ওখানে উনাকে নেওয়া টা কি উচিত হবে!

জোবায়ের সাহেব আদেশের স্বরে বললেন, চট্টগ্রাম খুব সুন্দর শহর। ওখানে নিয়ে যাও কাজ শেষে কক্সবাজার ও ঘুরে এসো। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিনোদন রাখার ও দরকার আছে।

কিন্তু..

কোনো কিন্তু না। যা বলছি তাই করো। যাও ওকে বলো জামাকাপড় গুছিয়ে নিতে।

জাওয়াদ মুখ ভার করে নিজের ঘরে গেলো।

হ্যালো সাম্য।

জ্বি স্যার বলুন।

তোমাকে এখুনি কিছু একটা করে আমার চিটাগং যাওয়া ক্যানসেল করতে হবে।

কিন্তু স্যার আপনি ই তো চেয়েছিলেন আমি যেন জরুরি কাজ দেখিয়ে ওখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করি। আমি ইতোমধ্যে বড় স্যারকে অনেকগুলো রিজন দেখিয়ে ফেলেছি। এখন হুট করে কি এক্সকিউজ দিবো?

সেটা তোমার মাথাব্যথা। আমি যা বলছি দ্রুত করো। আমার পিএ হয়ে এইটুকু হ্যান্ডেল করতে পারবেনা!

সাম্য চিন্তিত ভঙ্গিতে ফোন রেখে দিলো। এখন কিভাবে এতোগুলো কাজ পোস্টপোন্ডের বাহানা দেওয়া যায়! সাম্যর মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে চাকরি ছেড়ে বনবাসে চলে যেতে। তার ছোটফুফু ঠিকই বলে বড়লোকে আর পাগলে সমান। তাদের মতিগতি বোঝা এই দুনিয়ায় সবচেয়ে কঠিন কাজ।
ফোন রেখে পিছু ফিরতেই দেখে আরওয়া ওর দিকে তাকিয়ে আছে। তার মানে ও সব শুনে ফেলেছে!

আরওয়া টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছে বলল, আপনাকে যতোটা চালাক ভেবেছিলাম আপনি ততোটাও চালাক না। কেমন সব বোকা বোকা কাজকর্ম করেন! আপনার চেয়ে টিকটকারদের মাথায় ভালো আইডিয়া থাকে।

জাওয়াদ ডোন্ট কেয়ার মুড নিয়ে বললো, যার যেমন টেস্ট!

কি বললেন?

আমি আস্তে কিছু বলি নি, কানে শুনতে না পেলে ডাক্তার দেখান।

মিচকা শয়তানের মতো মিনমিনে গলায় না বললেই তো শুনতে পেতাম।

মিচকা শয়তান বুঝি আপনার বফ লাগে? তার সব বৈশিষ্ট্য মুখস্থ?

বৈশিষ্ট্য জানতে বফ হওয়া লাগে নাকি? যে কেউ এমনিই বলে দিতে পারবে।

মোটেও না। কোনো কিছু নিয়ে বলতে হলে হয় তার সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখতে হয় অথবা নিজেই তেমন চিন্তা লালন করে। অর্থাৎ সে নিজেই সেটা!

এই অপশন বাদেও আরো অনেক অপশন আছে সেটা বোধহয় আপনি জানেন না!

এক মহৎ ব্যক্তি বলেছেন মূর্খ ও নারী এই দুই ক্যাটাগরীর মানুষের সঙ্গে তর্ক না করতে।

হা হা হা সো ফানি! কে সেই মহৎ ব্যক্তি সক্রেটিস ফারাজ? নাকি স্যার আইজ্যাক জাওয়াদ?

যেই বলেছে ভুল বলেনি।

আরওয়া ভেংচি কেটে লাগেজ থেকে কাপড় বের করতে লাগলো।

এই পাপিতা দাঁড়া…

তোকে কতবার বলেছি পাপিতা না ডাকতে।আমার নাম পাপিয়া। এটা ডাকতে না চাইলে শেহেরিন ডাকবি।

তোর একটা নামও এমন আছে যেটা ডেকে শান্তি পাবো? শেহেরিন খন্দকার পাপিয়া। বাবারে বলতে গেলেও দাঁত ভাঙ্গে।

পাপিতা বলতে দাঁত ভাঙ্গেনা ?

নাহ, পাপিতা অর্থ পেঁপে। যেহেতু পেঁপে খুব সফট হয় তাই ওটা উচ্চারণ করতে দাঁত ভাঙ্গেনা।

আরআইপি লজিক!!

কই যাচ্ছোস?

বাসায় আর কই যাবো?

চল ক্যাফেতে বসি, যা গরম পড়ছে। গলা শুকাই একদম কাঠ হয়ে গেছে।

তোর জিরাফের মতো গলা কাঠ তো হইবোই।

আমার হাইট নিয়ে তোর এতো হিংসা! এইটুকু শরীরে এতো হিংসা কেমনে জমাস ভাই?

শোন রিজভী তোর সঙ্গে ঝগড়া করার মুড নাই। ফাল্গুনের ভ্যাপসা গরমে এমনিই জান যায় যায় অবস্থা। হুদাই প্যাঁচাল পাড়িস না তো।

তাইতো বললাম চল ক্যাফেতে বসি, এসির হাওয়ায় বসে ঠান্ডা লাচ্ছি খেলে মাথা শরীর ও মন দুটোই চাঙ্গা হয়ে যাবে।

পাপিয়া ভ্রু উঁচিয়ে বললো,ঘটনা কি বল তো আজকে হঠাৎ এতো খাতির রহস্য কি?

আরেহ তুইও না কার্লপ্রিট মাইন্ডের! আমার মতো সহজসরল ছেলের মনে তোর মতো অতো প্যাঁচ নাই বুঝলি! সাদামনে একটা কথা বললাম আর তুই টেনেহিঁচড়ে কোথায় নিতে চাইছিস!

পাপিয়া আর কিছু না ভেবেই ভার্সিটির পাশের ক্যাফেতে ঢুকলো। দুইটা লাচ্ছি অর্ডার করে রিজভী কলার পিছিয়ে বসলো।
পাপিয়া ফোনে গেইম খেলায় মগ্ন হতেই রিজভী বললো, তোর দাদার বুদ্ধি আছে মাইরি। এমন কাঠফাঁটা রোদের দিনে নাতি বিয়ে করাইছে!

পাপিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো, রোদের সাথে বিয়ের কি সম্পর্ক?

তো কিসের সাথে সম্পর্কিত হবে?

আমাদের দেশে তো উইন্টার বিয়ের সীজন।

ধুর বেকুবনী। তোর কি ধারণা শীতকাল বিয়ের জন্য বেস্ট?

অবশ্যই।

তুই আসলেই বেকুব। যাক বাদ দে।

লাচ্ছি খাওয়া শেষে বিল দেখে পাপিয়ার চক্ষুচড়কগাছ। সে তেতে বললো, ২টা লাচ্ছির বিল ২৫০০৳ কিভাবে হয়? আপনাদের হিসাবে সমস্যা হয়েছে।

ওয়েটার বয় বললো, নাহ ম্যাম আমাদের হিসাব ঠিকই আছে। আপনি রিসিট টা চেক করলেই বুঝতে পারবেন।

পাপিয়া রিসিট চেক করে দেখলো অনেকগুলো আইটেম অর্ডার করা হয়েছে। ও সরু দৃষ্টিতে রিজভীর দিকে তাকাতেই রিজভী বললো, এতো কিপ্টামী করিস না। তোর বাপ ভাইয়ের আয়ের সামনে এটা খুব সামান্য। হাতের ময়লা ভেবে দিয়ে দে।

পাপিয়া বিল পে করে বললো, ঐ সামিয়ারে খাওয়াইছিলি আবার না? আমিও তো বলি এতো তোষামোদ কেন! হালা ছেঁচড়।

ছিঃ পাপিয়া, আমি না তোর বেস্টফ্রেন্ড?আমাকে এভাবে বললে মানায়?

তুই আমার কোন জন্মের বেস্টফ্রেন্ড? মীরজাফর একটা! এমন খাদক গফ জুটাস কেন যার জন্য পকেট ফাঁকা হয়? প্রতিমাসে কয় হাজার ঢালোস এর পিছে?

বেশি না মাত্র ৩০ যায়। ভাগ্য ভালো হলে কোনো কোনো মাসে ২০…

সিরিয়াসলি ম্যান! ৩০হাজার যায়? তোর বাপের সব টাকা দেখি এই মেয়েই খাচ্ছে।

ভালোবাসার মানুষের পেছনে খরচা গেলেও গাঁয়ে লাগেনা। এই টাকাটা আমার ফি হিসাবে কেটে নিচ্ছি।

মানে? কিসের ফি?

ওমা আমার মতো হ্যান্ডসাম ছেলের সাথে বসে লাচ্ছি খেলি এটার একটা বিল আছে না?

পাপিয়া বিরক্ত স্বরে বললো, আর যদি আমি তোর ফাঁদে পা দেই তো আমি জুতা খাই!

আমার একজোড়া ছিড়া জুতা আছে, লাগলে জানাইস।

পাপিয়া গটগট করে বেরিয়ে গেল।

ধীরে ধীরে সব মেহমানরা চলে গেছে, বাড়িটা এখন ফাঁকা বললেই চলে। সন্ধ্যায় নাস্তা খাওয়ার পর সবাই যার যার ঘরে চলে যায়।এ সময় সালমা বেগম কোরআন হাদীস নিয়েই ব্যস্ত হয়ে যান। বড় চাচী ভিডিও কলে উনার আত্মীয়স্বজনের সাথে খোশগল্প করেন। আরওয়া একা বসে বোরিং সময় পার করছে। পাপিয়া কুহু পড়াশোনা করছে, সাবাও কেডি দেখছে। তাই বলতে গেলে একমাত্র ও ই বেকার এখন! বসার ঘরে এসে দেখে তার শাশুড়ি আর রাহেলা খালা মনোযোগ দিয়ে হিন্দি সিরিয়াল দেখছে। রাহেলা চিপস চিবুতেই রোকেয়া বললেন,আস্তে চাবাস না। মনোযোগ নষ্ট হচ্ছে আমার!
রাহেলা হা করে টিভির স্ক্রিনে চেয়ে মাথা দুলালো। আরওয়া তাদের দেখে মনে মনে বললো, এই ঘরেও শিরিন প্রোম্যাক্স আছে দেখছি, হাহ!

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে