কাঁটাকম্পাস পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0
352

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪৪

#আরশিয়া_জান্নাত

“আচ্ছা সাবা একটা কথা বলি, রাগ করবে না তো?”

“কী কথা শুনি আগে?”

“আগে বলো রিয়েক্ট না করে বোঝার চেষ্টা করবে?”

“কী হয়েছে নাহিয়ান? সিরিয়াস কিছু?”

“কিছুটা সিরিয়াস ই বলা যায়।”

“ভণিতা করোনা প্লিজ। বলো ঘটনা কী?”

নাহিয়ান ওর হাতটা মুঠোয় নিয়ে বললো,” দেখো পৃথিবীতে এমন অনেক কাপল আছে যাদের বেবী হয়না। ওরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে বেবী‌ নেয় বা এডপ্ট করে,,,”

“তুমি তাহলে আশা ছেড়ে দিচ্ছ নাহিয়ান? আমি বাচ্চা জন্ম দিতে পারবোনা এটা মেনে নিচ্ছ? তাই বিকল্প পথ খুঁজছো?”

নাহিয়ান ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,”না পাখি আমাকে ভুল বুঝো না। আমি সেটা বুঝাই নি।”

সাবা চোখের পানি মুছে বলল,”শোনো নাহিয়ান, তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। তুমি বাচ্চাদের অনেক পছন্দ করো, তোমার নিজের একটা সন্তান হবে এমন আশা করা অস্বাভাবিক না। আমি তোমার ইচ্ছাপূরণে অক্ষম এটা তুমি রিয়েলাইজ করেছ। আমি বলি কী অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করো না, বাবাকে তুমি ভালো করেই চেনো। উনি কখনোই চাইবেনা তার পরিবারে বাইরের কেউ আসুক।”

“সাবা সারোগেসি পদ্ধতিতেও অনেকে বাচ্চা নিচ্ছে। এটায় তো সমস্যা নেই! তোমার আমার অংশ মিলেই ও বেড়ে উঠবে,,,”

“এতো কষ্ট করার কী দরকার নাহিয়ান? তোমার কাছে আরো সহজ উপায় আছে। তুমি বরং আরেকটা বিয়ে করে ফেলো।”

নাহিয়ান বিস্ময়ে ওর হাত ছেড়ে দিলো। ধরা গলায় বললো,” তুমি এটা বলতে পারলে সাবা? আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি সেটা জেনেও এমন কথা বলতে পারলে!”

সাবা কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল, “আমি অনেক ভেবেচিন্তেই কথাটা বলেছি। ভালোবাসা ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই সুন্দর ফেয়ারওয়েল হওয়া ভালো। এতে সম্পর্কের সৌন্দর্য অটুট থাকে।”

নাহিয়ান টেবিলের উপর থাকা পানির জগটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। রাগান্বিত গলায় বলল,”আমি তোমাকে বলেছিলাম সাবা আমাকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা মাথাতেও এনো না। আমার কাছে তোমার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। কিন্তু তুমি আমার কথাটা না বুঝে অন্য টপিক নিয়ে এলে।”

সাবা চুপচাপ বসে রইলো। কোনো কথা বললোনা। নাহিয়ান সবকিছু ভেঙেচুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ও চলে যেতেই সাবা কান্নায় ভেঙে পড়লো। জীবনটা কেন এতো কঠিন তার? একটা সন্তান দিতে আল্লাহ কেন এতো পরীক্ষা নিচ্ছে?

ভাঙচুরের শব্দ শুনে আরওয়া দৌড়ে সাবার ঘরে এলো। সাবার কাছে গিয়ে বিচলিত গলায় বলল, “ভাবি কি হয়েছে? এসব কীভাবে ভাঙলো!”

সাবা ওকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো। কান্নামাখা কন্ঠে বলল,”আরওয়া মা হওয়া এতো কঠিন কেন বলতে পারো? আমি কেন মা হতে পারছি না…”

আরওয়া ওর পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”ভাবি এতো অধৈর্য হয়োনা। আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী। উনি নিশ্চয়ই ভালো কিছু ভেবে রেখেছেন। ভরসা রাখো।”

“কিছু ভালো হবেনা, কিছু না। এই পৃথিবীতে সবাই সুখী হয়না….”

আরওয়া সাবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো কথা পেলো না।

ইশরাক আজ ৭দিন ধরে বাসায় খাওয়া দাওয়া করেনা। সকালে অফিস যায় তো রাত করে বাড়ি ফেরে। ওর জন্য খাবার যেভাবে রাখা হয় সেভাভেই পড়ে থাকে, ছুঁয়েও দেখেনা। নিসা ওর মায়ের কাছে গিয়ে বলল,”মা রোজ রোজ এতো খাবার নষ্ট করা ঠিক না। তুমি ভাইয়াকে কিছু বলছো না কেন?”

সানজিদা আহমেদ গাছে পানি দিতে দিতে বললেন,”আজ থেকে আর খাবার রাখিস না, বাইরের খাবার পছন্দ যখন বাইরেই খেয়ে আসুক। খাবার নষ্ট করে পাপের ভাগী হবার ইচ্ছে নাই আমার।”

“তোমার মনে হয় ও বাইরে খাচ্ছে! এমন নয়তো রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে?”

“ও রাগ করে আর যাই করুক খাওয়া বন্ধ করেনা।”

নিসা রেলিং এ হেলান দিয়ে বললো, “মা একটা কথা বলি শোনো, জীবনের ধারাবাহিকতা আটকে রাখা যায় না। মানুষ প্রথমে সন্তান হিসেবে বড় হয়, তারপর স্বামী/স্ত্রীরূপে–বাবা/মা–শ্বশুড়/শাশুড়ি—দাদা/দাদী। এই ধারাবাহিকতা চলতেই থাকে। মা-বাবা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এই কথা সত্যি, তবে এই ক্রমবর্ধমান জীবনকে তারা যদি বাধাগ্রস্ত করে কিংবা অধিকার হারানোর ভয়ে আটকে রাখার চেষ্টা করে তবে সন্তানের মনে সম্মানের জায়গাটা আর থাকে না।”

“এসব কথা তুই আমাকে বলছিস কেন? আমি তো বলেছিই যার যেখানে খুশি বিয়ে করুক আমার বলার কিছু নেই।”

“তুমি এভাবে ছেড়ে দিয়ে ব্যাপারটা আরো জটিল করেছ। আচ্ছা মা সত্যি করে বলো তো কুহু আপুর জায়গায় যদি সেইম কাজ সোনিয়া আপু করতো তুমি কী দোষ ধরতে? বিয়েতে অমত দিতে নাকী ভাইঝির দুষ্টমি ভেবে এড়িয়ে যেতে?”

সানজিদা বেগম তেতে উঠে বললেন, “তোর যত কুটনৈতিক চিন্তা। আমার ভাইঝি মোটেও এমন করতো না। ওর মধ্যে পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা আছে। ও কখনোই এতো অভদ্র আচারণ করতো না।”

“করতো না মানলাম। তবে কুহু আপুর দিকটাও ভাবো, উনি ভাইয়াকে ভালোবাসে। নিজের ভালোবাসার মানুষের বদলে অন্য কাউকে বিয়ে করতে না চাওয়াটা কী অন্যায়? উনি যদি জানতেন আমরা কে তবে কখনোই কী এইসব করতেন? ”

“তুই কুহুর হয়ে ওকালতি করছিস কেন? ইশরাক তোকে কত টাকা দিয়েছে ওর হয়ে ওকালতি করতে?”

নিসা হেসে বললো,”আমার ভাইয়ের দুঃখ তুমি দেখেও না দেখার ভান করতে পারতেছ। আমি পারতেছি না। ওর চেহারা দেখলে আমি কেন যে কারোরই মায়া লাগবে, টাকাপয়সার বিনিময় আশা না করেই তোমার কাছে অনুরোধ নিয়ে আসবে।”

সানজিদা পানির পট রেখে মেয়ের দিকে তাকালেন, রুক্ষ গলায় বললেন,”আমাকে ভিলেন বানানো বন্ধ কর। তোদের সবার যখন ঐ মেয়ে এতো পছন্দ যা গিয়ে নিয়ে আয়। আমার কোনো আপত্তি নেই।”

নিসা মায়ের গলা জড়িয়ে বললো,” তুমি রেগে থাকিও না মা। একটু নরম হয়ে ভেবে দেখোনা। ভুল তো মানুষ ই করে তাই না? সব ভুলের শাস্তি কি দিতে হয়? কিছু ভুল ক্ষমা করে বড়রা ২য় বার সুযোগ দিলেই তো ছোটরা শোধরাতে পারে। তুমি আজ ভাইয়াকে হাসিমুখে বলবে, কুহুকে তোর পছন্দ তো, যা ওকেই আমি বৌ করে ঘরে তুলবো। তবুও দেবদাসের মতো ঘুরে বেড়ানো বন্ধ কর!”

সানজিদা আহমেদ বেশ সময় নিয়ে মেয়ের কথাগুলি ভাবলেন। “তবে কী একবার সুযোগ দেওয়া উচিত?”

নাহিয়ান কোথায় গেছে কোনো খবর নেই। ফোন সুইচড অফ করে রাখা। হসপিটালে খবর নিয়ে জানা গেল সেখানেও যায় নি‌। চিন্তায় কারো মাথা কাজ করছেনা। কোহিনূর সাবাকে বকা দিতে দিতে বললেন,”কি দরকার ছিল ছেলেটাকে এসব বলার। ও তোমাকে বেশি ভালোবাসে বলে কষ্ট দিতে মজা লাগে তাই না? এখন খুশি তো?”

সালমা বেগম বললেন, “বড় বৌমা রাগের মাথায় উল্টাপাল্টা বকো না, পরে নিজেই কষ্ট পাবা। ছেলেটা কোথায় আছে আগে খোঁজখবর নাও। বিপদে অস্থির হতে নাই।”

“আম্মা আপনি এই অবস্থায় ও আমাকেই চুপ থাকতে বলছেন? সাবাকে আমরা কেউ কখনো কিছু বলেছি? আমরা তো ধৈর্য ধরে আছি, ছেলেটা ওর মনের অবস্থা বুঝে একাকিত্ব দূর করতে হয়তো কথাটা বলেছে। তাই বলে ও বিয়ের কথা তুলবে? ও কী দেখেনি ওর শ্বশুড় এ কথা বলেছিল বলে নাহিয়ান কতদিন ওর বাবার সাথে কথা বলেনি? এখনো ঠিকঠাক কল করে খবর নেয়না। সেখানে ও কীভাবে পারলো এমন করতে?”

“আহ মা তুমি ঘ্যানঘ্যান করা বন্ধ করবে? এমনিতেই সবাই টেনশনে আছি তোমার এসব শুনতেও বিরক্ত লাগছে। এই ভাবি চলো তো এখান থেকে, এখানে বসে বসে এসব শুনে লাভ নেই। ভাইয়াকে খোঁজ করার জন্য লোক গেছে। ইনশাআল্লাহ ভাইয়া চলে আসবে।‌”

কুহু একপ্রকার টেনেই সাবাকে নিয়ে গেল। পাপিয়া আর আরওয়াও তার সঙ্গে গেল।

জোবায়ের সাহেব ইজি চেয়ারে বসে রইলেন।‌ ছেলেটা কখনো এমন‌ করেনা, আজ কোথায় গিয়ে যে বসে আছে কে জানে‌,কোনো বিপদাপদ হলো না তো!

জাওয়াদ গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে গাছগাছালিতে ভরা ১০মিনিটের পথ অতিক্রম করলো। দিঘীর সিঁড়িগোড়ে নাহিয়ানকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তার আন্দাজ সঠিক হয়েছে তাহলে!
মিটিং শেষে নাহিয়ানের খবর শুনে সে আর অফিসে ফেরেনি, গাড়ি ঘুরিয়ে নিজে ড্রাইভ করে আন্দাজে এখানে এসেছে। ছোটবেলায় স্কুল শেষে তারা দুই ভাই প্রায়ই এখানে আসতো, ফুটবল খেলতো, মাঝেসাজে সাতারের প্রতিযোগীতা করতো। জায়গাটা যেন একটুও বদলায় নি। আগের মতোই নিরব ও মনোরম হয়ে আছে।

নাহিয়ান পায়ের শব্দ শুনে বললো, “আমি ভাবি নি তুই আসবি! অবশ্য তুই ছাড়া এই জায়গার খোঁজ আর কেউই জানেনা।”

জাওয়াদ ওর পাশে বসে বলল, “আমিও ভাবিনি এতো জায়গা থাকতে তুই এখানেই আসবি! আন্দাজের উপর ঢিল মেরে দেখি নিশানা সঠিক জায়গায় লেগে গেছে!”

নাহিয়ান দূরে ঢিল মারলো। জাওয়াদ উঠে কিছু নুড়ি পাথর কুড়িয়ে আনলো, নাহিয়ানের পাশে রেখে বললো, “ব্যাঙের মতো ঢিল ছোঁড় দেখি! ছোটবেলায় কত শিখতে চেয়েছি এটা। শিখালি না একবারও!”

“ছোটদের সবকিছু শিখতে নেই!”

“সবসময় এসব বলে লাভ নেই, তোর আমার বয়সের গ্যাপ কোনো গ্যাপই না! তুই ইচ্ছে করে বড় সাজার জন্য আমাকে শিখাস নাই।”

নাহিয়ান ওর কথা শুনে ম্লান হাসলো। দুহাত পিছিয়ে ভর দিয়ে আকাশে তাকিয়ে বলল, “ছোটবেলায় ভাবতাম কখন বড় হবো, সবাই মান্যিগন্যি করবে। বড় হবার কত তাড়া ছিল আমার। অথচ দেখ যখন বড় হয়ে গেছি মনে হচ্ছে কেন যে এতো তাড়াতাড়ি বড় হতে গেলাম!”

জাওয়াদ ভাইয়ের দিকে শান্তদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। নাহিয়ানকে সে আগে কখনো কাঁদতে দেখেনি, হাতে পায়ে ব্যথা পেয়ে র*ক্ত বের হলেও সে শক্ত গলায় বলতো “আরেহ এটা কোনো ব্যথা হলো? খেলতে গেলে কত কিছুই হয়। ছেলেমানুষের শরীর নরম হলে চলে?”

সবসময় যাকে বুঝদার বড়ভাই রূপে দেখে অভ্যস্ত, তাকে দূর্বল ও অসহায় দেখতে জাওয়াদের ভালো লাগছেনা। একদমই ভালো লাগছে না!

চলবে,,

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪৫

#আরশিয়া_জান্নাত

৪৫

“ওর সামনে খাবার দিয়ে বসে আছো কেন? দেখছো না ওর ডান হাত কেটে গেছে। ওকে খাইয়ে দাও।”

দাদী শাশুড়ির কথা শুনে সাবা নাহিয়ানে প্লেট নিতে হাত বাড়াতেই নাহিয়ান বলল, “মেঝ আম্মু অনেক দিন তোমার হাতে খাওয়া হয়না। আজকে খাওয়াবে?”

“কেন খাওয়াবো না, উঠে আয় আমিই খাইয়ে দিচ্ছি।”

সাবা খাবার নাড়াচাড়া করলেও মুখে তোলার আর জোর পেলো না। বুকের ভেতরের তান্ডব বাইরে প্রকাশ না পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেল পুরোটা সময়। পাপিয়া ওর হাতের উপর হাত রেখে ভরসা দিলো সব ঠিক হয়ে যাবে। জাওয়াদ আপন মনে খাবার খেয়ে যাচ্ছে। এখানে একমাত্র সে ই স্বাভাবিকভাবে ডিনার করছে, বাকি সবার দৃষ্টি নাহিয়ান আর সাবার দিকেই নিবদ্ধ। খাওয়া শেষে কুহু নিজের ঘরে না গিয়ে পাপিয়ার ঘরে গেল। ওর বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে বললো,” আজ আমি তোর রুমে ঘুমালে তোর কি কোনো সমস্যা হবে?”

“তোকে তো আমি প্রায়ই বলি আমার সাথে ঘুমাতে, আমার সমস্যা হবে কেন?”

কুহু ওর কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে বললো, “পাপ্পি লাইফে কখনো জীব মানে প্রাণ আছে এমন কোনো কিছুর প্রতি আসক্ত হবি না। সবসময় জড়বস্তুর প্রতি মায়া জমাবি। আমি আগেই ভালো ছিলাম। আমার সব আসক্তি জড়পদার্থকে কেন্দ্র করে ছিল। তখন আমার কোনো কষ্ট হয় নি, ইজি পিজি লাইফ! যেই মানুষের প্রতি মন বসলো জীবনটা জটিল হয়ে গেছে। তাই বড় বোন হিসেবে তোকে সাজেস্ট করবো Never fall in love with mortal creature!”

পাপিয়া ফোন চার্জে দিয়ে কুহুর পাশে বসলো। নরম গলায় বলল,”জীবনের পথ মসৃণ হয়না। এখানে উত্থান পতন থাকবে। জীবনে হাসি-কান্না, আশা-হতাশা আছে বলেই এটা সুন্দর, একঘেয়ে নয়। আমি জানি আমাদের পরিবারে এখন সময়টা ভালো যাচ্ছে না। তবে আশা রাখছি এটাও স্থায়ী হবেনা।”

” মানুষের জীবনে অনেক অপূর্ণতা থাকে, তবে এরমধ্যে সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা হলো একজন বিশেষ মানুষের ভালোবাসা না পাওয়া। কিন্তু তিক্ত হলেও সত্যি যে যেটা পেয়ে যায় ওটাকে আর মূল্যবান মনে করেনা। তখন মনে করে যা পাচ্ছেনা ঐটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল!”

“এটাই প্রেষণা। সন্তুষ্ট হয়ে গেলে মানুষ স্থির হয়ে যেত, মৃত্যু অবধি তার চাহিদা বদলাবে এটাই তো নিয়ম।”

“আচ্ছা পাপ্পি বল তো, বিয়ে টিকে থাকতে বাচ্চাই কি সব? এমনিতে দুটো মানুষ দুজনকে ভালোবেসে জীবন কাটিয়ে দিলে কী সমস্যা? মানছি বাচ্চা থাকা ব্লেসিং, ভবিষ্যৎ উত্তরসূরী রাখতে কে না চায়! কিন্তু এটাই সব না। ভাইয়া ভাবির জন্য আমার ভীষণ কষ্ট হয়। ওরা একে অপরকে কত ভালোবাসে। এইটুকুতেই কেন ওরা সুখী হতে পারেনা…”

“আপু তুই কাঁদছিস!”

কুহু চোখের কোণ চেপে বললো,”আরেহ না চোখে কি জানি পড়ছে!”

পাপিয়া ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,” মন খারাপ করিস না আপু। আল্লাহর কাছে দোয়া কর যেন সব ঠিক হয়ে যায়।”

নাহিয়ান বেলকনীতে দাঁড়িয়ে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। সাবা রুমে ঢুকে দেখে থাই গ্লাসের ওপারটা ধোয়াময় হয়ে আছে। নাহিয়ান এমনিতে স্মোকার নয়, তবে যখন ওর মনমেজাজ খুব খারাপ থাকে তখন ১প্যাকেট ও পোষায় না।

সাবা বেলকনীর দরজা খুলতেই কেশে উঠল, নাহিয়ান চেঁচিয়ে বললো, “তুমি এখানে কেন এলে, সিগারেটের ধোঁয়াকত ক্ষতিকর জানো না?”

“এটা ক্ষতিকর তুমি তো জানো?তারপরও‌ কেন খাচ্ছ?”

নাহিয়ান উত্তর না দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। সাবা ওর পিঠে মাথা ঠেঁকিয়ে বললো,”আমাকে ক্ষমা করো‌ নাহিয়ান। আমি খুব স্যরি! আমার নিজেকে আজকাল একটুও ভালো লাগেনা। মনে হয় আমি তোমার লাইফে বার্ডেন হয়ে আছি। বিশ্বাস করো তোমাকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্য আমার ছিল‌না। আমি কী করবো বলো, কতক্ষণ বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবো। নিজের অক্ষমতার বোঝা আমাকে ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ করে ফেলতেছে। আমি পারতেছি না স্বাভাবিক থাকতে, আমার জন্য তুমি নিজেকে কষ্ট দিও না প্লিজ!”

সাবা হিচকি তুলে কাঁদতে লাগলো। নাহিয়ান পেছন ঘুরে সাবাকে বুকে জড়িয়ে নিলো, মাথায় চুমু খেয়ে বললো,”কেঁদো না পাখি, তুমি জানো আমি তোমার কান্না সহ্য করতে পারিনা। প্লিজ থামো।”

“তুমি এতো ভালো কেন বলতে পারো? আমাকে বেশি ভালোবাসো বলেই আমার মাঝে এতো খুঁত। মা বলতেন শখের হাড়ির মাঝখানে কাঁচা হয়…”

“কেউই নিখুঁত না সাবা! আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমার চোখে তুমি এই পৃথিবীর সেরা নারী। তুমি আমাকে ওয়াদা করো আর কোনোদিন আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মাথায় ও আনবেনা, আর না আমাকে বিয়ে করতে বলবে। আমি তোমার সাথেই আমার জীবনের শেষ‌ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বাঁচতে চাই। আমার জন্য তুমি যথেষ্ট। আমার আর কিচ্ছু চাই না।”

সাবা মাথা নেড়ে বললো,”তুমিও কথা দাও আর কোনোদিন এরকম নিখোঁজ হবেনা। আর এই ছাইপাশ ভুলেও ছুঁবে না।”

নাহিয়ান ওকে শক্ত করে ধরে বললো,”কথাদিলাম…”

বেশ কিছুদিন পর,,,

ইশরাক ও তার পরিবারকে দেখে কোহিনূর ভীষণ অবাক ই হলেন বটে। তাদেরকে সাদরে সোফায় বসিয়ে তিনি লাকিকে বললেন, অন্যদের খবর দিতে। কুশল বিনিময় শেষে ইশরাকের বাবা ইমতিয়াজ আহমেদ বললেন, “আপা আজকে আমরা বিশেষ অনুরোধ নিয়ে এসেছি। দয়া করে আমাদের খালি হাতে ফিরিয়ে দিবেন না। কুহু মাকে আমরা আমাদের পুত্রবধূ হিসেবে ঘরে তুলতে চাই।”

কোহিনুর তার শ্বশুড় শাশুড়ির দিকে তাকালেন, জোবায়ের সাহেব ইশারায় সম্মতি দিতেই তিনি বললেন,”এ তো আমাদের জন্য পরম সৌভাগ্যের। আপনারা বসুন আমি মিষ্টির ব্যবস্থা করছি।”

নিসা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, “আন্টি ব্যস্ত হবেন না, আমরা মিষ্টি নিয়ে এসেছি। আজ বিয়ের ডেট ফাইনাল না করে আমরা যাবোনা!আঙ্কেল মিষ্টির প্যাকেটগুলো ওখানে রাখুন।”

কোহিনুরের খুশিতে চোখে পানি এসে গেল। অবশেষে সত্যিই কুহুর বিয়ে হবে! এতো আনন্দ হচ্ছে তার!

সানজিদা আহমেদ বিনীত গলায় বললেন, “চাচাজান গতবারের ব্যবহারের জন্য আমি খুব লজ্জিত। অনুগ্রহ করে আমাকে ক্ষমা করবেন। ”

“দেখো মা আমার নাতনির আচারণের পরিপ্রেক্ষিতে তুমি তেমন করেছ, এতে তোমার ভুল নেই। সব মা ই চায় তার ছেলেমেয়ের জীবনে ভালো কেউ আসুক। যা হয়েছে সব ভুলে যাও। পুরনো তিক্ততা ভুলে নতুন সম্পর্কের মিষ্টতা ছড়িয়ে পড়ুক এই কামনাই করি।”

কুহু দোতলায় দাঁড়িয়ে সব দেখছে, ইশরাক মাথা নীচু করে সবার মাঝে বসে আছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে কুহু ভেংচি কেটে বললো,”ঢং দেখলে আর বাঁচি না। এমনভাবে গাল লাল করে বসে আছে যেন সে নতুন বৌ, যত্তসব!”

“তুই না কেমন! এমন পরিস্থিতিতে লজ্জা পাওয়া স্বাভাবিক না?”

“আমার সাথে এই ১৪দিন যোগাযোগ রাখেনি, খোঁজখবর নেয়নি। এখন আসছে সরাসরি বিয়ের ডালা নিয়ে। কী ভেবেছে আমি ওকে বিয়ে করতে বসে আছি? তুই লিখে রাখ পাপ্পি ওর সাথে যদি আমার বিয়েও হয় ১৪দিন ধারেকাছেও ঘেষতে দিবোনা। ”

পাপিয়া হাই তুলে বললো,” দেখিস আবার ১৪দিন বলে ১ম রাতেই কনসিভ করে ফেলিস না!”

কুহু ওর দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” তোর মুখ এতো পাতলা হলো কীভাবে? বড় বোনকে কী বলোস এগুলো। ছি ছি ছি লাজলজ্জার মাথা খেয়ে ফেললি!”

পাপিয়া হেহে করে হাসতে লাগলো।

আজ কুহুর গায়ে হলুদ। খন্দকার বাড়িত আত্মীয়স্বজনদের সমাগমে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যদিও অনুষ্ঠান হবে নামকরা কমিউনিটি সেন্টারে, তবে যাবতীয় আচার অনুষ্ঠান বাসায় হওয়াতে ছোট বড় সকলের মাঝেই আনন্দের ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে। ইশরাকদের বাড়ি থেকে হলুদের ডালা আসার পর বড় ভাবি হিসেবে সাবা সেটা নিতে গেলেই মুরব্বিগোচের একজন চেচিয়ে উঠলো, “আয়হায় রে! সাবা এটা তুমি নিতেছ কেন? তুমি নিও না এটা, উফ তোমরা শহরের মেয়েরাও না কেমনজানি। কোনোকিছু বাছবিচার করো না বলেই এতো অমঙ্গল ঘটে। আরওয়া তুমি বরং ডালাটা নাও। এসব বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হয়।”

কথাটা শুনে সাবার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আরওয়া বিরক্ত গলায় বললো, “ইসলামে মঙ্গল অমঙ্গল বলে কিছু নেই। এসব কুসংস্কার কথাবার্তা। এসব অহেতুক কথা বলা বাদ দিন তো।”

“শোনো মেয়ে বড়দের মুখে মুখে তর্ক করতে এসোনা। বিয়ের আচার অনুষ্ঠানে বাজা মহিলাদের ছায়াও পড়তে দিতে নাই। নেহাতই ও কনের ভাবি, তাই বলে সব তো এড়ানো যায়না।”

“আপনার জানায় ভুল আছে। আমাদের উম্মুল মুমেনিনদের মধ্যে অনেকেই নিঃসন্তান ছিলেন, কই তাদেরকে তো কেউ কোনকিছু থেকে সরিয়ে রাখেনাই। তবে আপনি কোন সূত্রে এসব বানোয়াট নিয়ম জারি করছেন? আমাদের কথায় ও কাজে যদি কারো মনে কষ্ট এসে চোখে পানি পড়ে এর পাপ কত হয় জানেন?”

“এই মেয়ের চোয়া আছে! এখনের যুগের মাইয়াগো আর কিছু থাক নো থাক চোয়াডা ঠিকই আছে। যাক বাবা তোগো যা মন চায় কর। আমি আর কিছু বলতাম না। পরে তোরাই পস্তাবি! আমার কী?”

সাবা আরওয়াকে থামিয়ে বললো,” থাক না এসব তর্ক করোনা, মুরুব্বি মানুষ মেহমান হিসেবে এসেছেন। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তুমিই বরং এসব নাও। সমস্যা নেই”

“নাহ ভাবি এখন তুমি এই ছাড় দিলে চলবে না, আজ একজন বলেছে তার দেখাদেখি কাল আরো কয়েকজন বলবে। অজ্ঞতার চেয়ে খারাপ আর কিছু নেই। ওরা কোথা থেকে কিসব আজগুবি নিয়মকানুন বের করে আমাদের উপর চাপিয়ে দিবে আর আমরা সেসব মেনে চলবো? তুমি ধরো তো এসব। ”

সেই মহিলা মুখ ভার করে চলে গেলেন। সাবা ডালাটা নিয়ে কুহুর রুমে রেখে এককোণে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। সমাজের মানুষ এতো খারাপ কেন? তারা কেন বুঝতে চায়না ওদের কথা বুকের ভেতর কী কঠিন ক্ষত সৃষ্টি করে। আজ সাবাকে বাজা বলতেও বাঁধলো না ওদের! এতো তিরস্কার এতো অপমান!

ওদিকে সেই আত্মীয় গিয়ে রসিয়ে রসিয়ে আরওয়ার নামে সবার কাছে বদনাম করতে লাগলো,”মেয়েটার চেহারা যত সুন্দর হোক না কেন ভেতরটা অহঙ্কারে ভরা! নিজেরে নিজে কি একটা মনে করে। আমারে বলে আমি নাকি মূর্খ, কিছুই জানি না। দেখছেন অবস্থা? আমরা ১০জনের লগে খাই বই জীবন পার করি নো তো। হাওয়ায় হাওয়ায় আমাগো চুল সাদা হইছে। দুইদিনের মাইয়া আমারে হাদিসকালাম শিখায়!”

বিয়ে বাড়ির প্রৌঢ়া সমাজে আরওয়া বেয়াদব মেয়ে বলেই দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল।

চলবে…

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪৬

#আরশিয়া_জান্নাত

৪৬

পাপিয়ার মন একটুও ভালো নেই। কুহুর বিয়ে নিয়ে তার অনেক পরিকল্পনা ছিল, সেসব পূরণও হচ্ছে। কিন্তু বোন আজ চলে যাবে, এটা ভাবতেই মন খারাপ হয়ে আসছে। বাড়িতে এতো কোলাহোল, এতো আনন্দ তার মাঝেও একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস পরিবারের সবার মাঝেই বিরাজমান। পাপিয়া পায়ে বাম মালিশ করতে করতে সেসবই ভাবছে। গতকাল নাচানাচি করে পা একদম গেছে। সকালে মাত্র ২ঘন্টা ঘুম হয়েছে। বাচ্চাদের হাউকাউ এ কোথাও শান্তি পাওয়া যাচ্ছেনা। এ বাড়িতে এখন শুধু জাওয়াদের রুমটাই কোলাহলমুক্ত। ওর আশেপাশে ঘেষার সাহসও কেউ দেখায় না, বলতে গেলে ওকে এড়িয়েই চলে ছোটবড় সবাই। গুরুগম্ভীর চেহারার জন্য হোক বা ওর একদমই কথাবার্তা না বলে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই হোক ওকে বিরক্ত করার কথাও কারো মাথায় আসেনা। এতে অবশ্য জাওয়াদের সুবিধাই হয়েছে, এসব অহেতুক শোরগোল ওর কখনোই পছন্দ না। অন্য কেউ রুমে ঢুকে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করবে, বিছানা দখল করে বসে থাকবে এসব কল্পনা করতেও তার বিরক্ত লাগে।
আরওয়া ওর জন্য ব্রেকফাস্ট নিয়ে রুমে প্রবেশ করে বললো,”আম্মু বললো আপনি নাকি মানুষ দেখলে ডাইনিং এ যান না, তাই আমাকে দিয়ে খাবার পাঠালো।”

“সবাই খেয়েছে?”

“খাচ্ছে। আপনি খেয়ে নিন।”

“চলে যাচ্ছ নাকি?”

“কিছু বলবেন?”

“বসো আমার সামনে। আমি যতক্ষণ খাবো চুপচাপ বসে থাকবে।”

আরওয়া গ্লাসে পানি ঢেলে বললো,”একা খেতে ভালো লাগেনা? নীচে আসুন সবাই আছে তো।কত গল্প আর হাসাহাসি করছে।”

জাওয়াদ পরোটায় গোশত নিয়ে আরওয়ার মুখে তুলে বললো,”তোমার সঙ্গ চাইছি, অন্যদের না। আর ওদের আড্ডা মানেই অন্যদের নিয়ে গসিপ করা, কার কি হয়েছে, কে কী করেছে এসব নিয়ে দুনিয়ার বকবক। আমার এসব ভালো লাগেনা।”

“আচ্ছা!”

“আলমিরাতে একটা বক্স আছে নিয়ে আসো তো।”

আরওয়া উঠে বক্স আনলো। জাওয়াদ খেতে খেতে বললো,” কুহুর জন্য নিয়েছি। দেখো তো ওর পছন্দ হবে কী না?”

আরওয়া বক্স খুলে দেখলো খুব সুন্দর সোনার গহনা। ডিজাইনটা অনেক সুন্দর আর ইউনিক। “অনেক সুন্দর হয়েছে। আপু নিশ্চয়ই পছন্দ করবে।”

“আমি সেইম ডিজাইনের ৩টা গড়িয়েছি।”

“৩বোনের জন্য ৩টা তাই তো?”

“হুম। কুহু, পাপিয়া আর ছোট্ট রাইসার জন্য।”

“দারুণ কাজ করেছেন। ব্যাপারটা খুব সুন্দর!”

“ওদের পছন্দ হলেই হলো!”

“নিশ্চয়ই হবে। ভাই আদর করে দিচ্ছে পছন্দ হবেনা কেন? আপনার জন্য চা আনবো নাকি কফি খাবেন?”

“আপাতত কোনোটাই লাগবেনা। আমি এখন বের হবো।”

“কোথায় যাবেন? আপনার না ছুটি?”

“দাদাসাহেব বলেছেন উনার সঙ্গে যেতে, কুহুর বিয়ে উপলক্ষে দুপুরে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছেন।”

“কই এই বিষয়ে কিছু শুনলাম না তো! কোথায় খাওয়ানোর ব্যবস্থা হচ্ছে?”

“বাসায় সবাই জানেনা। দাদাসাহেব ব্যক্তিগতভাবে সেটা করছেন।”

আরওয়া মুচকি হেসে বলল,”আপনি আর দাদাসাহেব একদম একই রকম। আপনাদের ভেতরটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না!”

“সবার বুঝতে হবেনা, আমাদের জীবনসঙ্গীরা আমাদের বুঝলেই চলবে!”

কোহিনূর ব্যস্তগলায় বললেন,”সব জিনিসপত্র নিয়েছিস তো? শোন একদম লেট করবি না। ৮টায় বরযাত্রী আসবে তোরা ৭টার মধ্যে ওখানে উপস্থিত হবি। ওহ আরেকটা কথা কুহুর লাগেজগুলো লক করেছিস তো?”

পাপিয়া বলল,”বড় আম্মু এতো টেনশন করো না, আমরা আছি তো।”

কোহিনূর ওর চিবুক ছুঁয়ে আঙুলের ডগায় চুমু খেয়ে বলল,”তোরা আছিস বলে অনেকটা চিন্তামুক্ত আছি রে মা। আর শোনো আমার ছেলের বৌয়েরা, তোমরাও ভালোমতো সেজে নিবে কিন্তু। লোকে যেন বুঝতে না পারে কোনটা কনে কোনটা কনের ভাবি!”

তিনি চলে যেতেই রোকেয়া ছুটে আসলেন, কুহুকে বললেন, “কুহু ভাত কয়টা খেয়ে নিবি মা?”

“না মেঝ আম্মু এখন কিছু খাবোনা। আমার পেট ভরা আছে।”

“দেখিস কিন্তু অনেকক্ষণ ওখানে বসে থাকতে হবে।”

“সমস্যা নেই সত্যি বলছি!”

“আচ্ছা। ও সাবা তোমাকে নাহিয়ান খুঁজছিল, বের হবার আগে গিয়ে একবার দেখা করে আয় তো।”

ফাইজা বললো,” আমাদের নাহিয়ান ভাইয়া একটুও বদলায় নি। বিয়ের এতো বছর হয়ে গেলো এখনো সেই আগের মতোই বৌকে চোখে হারায়!”

“মাশাআল্লাহ বল। ওদের সম্পর্ক এমনি অটুট থাকুক সেই দোয়া করিস।”

“ইশ আমার নজর লাগেনা! তুমি যেভাবে বলছো যেন আমি নজর দিতে বসে আছি।”

“নজর কি বলে কয়ে লাগে? সুন্দর কিছু দেখলে আল্লাহর প্রশংসা করতে হয়, অথবা বলতে হয় আল্লাহুম্মা বারিকলাহু। এতে শয়তানের বদনজর আর লাগে না।”

ফাইজা বললো,” আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি। মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ! তোমার ভাই ভাবির সম্পর্কে কারো নজর না লাগুক। হ্যাপি তো!”

কুহু হেসে বললো, “হুম অনেক হ্যাপি!”

সাবা নাহিয়ানের কাছে গিয়ে বললো,” জনাবের কী আজ্ঞা শুনি? হঠাৎ জরুরি তলব ?”

নাহিয়ান ওর কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে বললো, “ভিটামিন বৌ এর অভাবে দৃষ্টিশক্তি দূর্বল হয়ে গেছে গো। কিছুই চোখে দেখতে পাচ্ছি না…”

“তুমিও না! কিসব যে বলো।”

“সত্যি কথার ভাত নেই বুঝলে। আমি সত্যি কথা বলি তো তাই আমাকে কেউ দাম দেয় না।”

“তা দাম দিতে কী লাগবে সোনার মোহর নাকি কড়ি?”

“অবুঝ বালিকা! সোনাদানায় কী আর দাম মেটে?”

“তবে কী চাই?”

“উমম হাজার দুয়েক চুমুতে আপাতত কিছুটা মিটবে!”

সাবা ভেংচি কেটে বললো,”এহহ আমার বয়েই গেছে! দেখি এখন ছাড়ো পার্লারে যাওয়ার জন্য সবাই বসে আছে। এমনিতেই সবাই হাসাহাসি করছিল, কী একটা অবস্থা!”

“আমার বৌকে আমি ডেকেছি এতে হাসাহাসির কী আছে? তাছাড়া আমি তো অকারণে ডাকিনি। আমার কারণটা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ!”

“হ্যাঁ এখন দেখেছ তো, চোখের দ্যুতি ফিরেছে নিশ্চয়ই, এবার যাই?”

“হুম যাও।”

রুমাইসা কোল্ড ড্রিংকে চুমুক দিয়ে স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছে, বধূবেশে কুহুকে অনেক বেশিই ভালো লাগছে। আরওয়া যদিও এতোক্ষণ ওর সাথে বসেছিল, কিন্তু বিয়ে পড়ানোর কার্যক্রম শুরু হতেই ও স্টেজের দিকে চলে গেছে। রুমাইসা বসে বসে ওদের কার্যকলাপ দেখছে। এমন সময় সাম্য গলা খাকারি দিয়ে বলল,”কেমন আছেন মিস রুমাইসা?”

“ভালো। আপনি?”

“জ্বি ভালো। ডিনার করেছেন?”

“নাহ। আরওয়ার সঙ্গে খাবো।”

“আচ্ছা!”

“কিছু বলবেন?”

সাম্য কপালের ঘাম মুছে বললো,” এখানে এসি বোধহয় কভার হচ্ছেনা।”

“এসির পাওয়ার ঠিকই আছে, আপনি নার্ভাস হয়ে যাওয়ায় এমন মনে হচ্ছে। কোল্ড ড্রিংক খাবেন?”

“ধন্যবাদ আমি ঠিক আছি।”

“দাঁড়িয়ে কেন বসুন না!”

সাম্য চেয়ারে বসে বলল,” আপনাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে!”

“তাই? থ্যাঙ্কস!”

সাম্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “রুমাইসা আপনার লাভ ম্যারেজ পছন্দ নাকি এরেঞ্জ?”

“লারেঞ্জ।”

“লারেঞ্জ?”

“হুম আধা লাভ আধা এরেঞ্জ!”

“মাই গুডনেস! আপনি তো নতুন শব্দ ক্রিয়েট করে ফেললেন।”

“এটা এখন ট্রেন্ড। দুটো শব্দকে মিক্সড করে একটা বানানো। বাই দ্য ওয়ে আপনার প্ল্যান কী আমাকে প্রপোজ করবেন নাকি বাসায় আসবেন?”

ওর কথা শুনে সাম্যর হিচকি উঠে গেল। রুমাইসা ওয়েটার থেকে পানি নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে বললো,” এতো অল্পতেই ভিমড়ি খেলে চলে? আমি তো এখনো আসল কথাই বলিনি।”

সাম্য কোনোমতে পানি খেয়ে বললো,” আসল কথা বলতে?”

রুমাইসা নিজের চুল ঠিক করে বললো,”ঐ টেবিলে আমার বাবা-মা আপনার পরিবারের সঙ্গে বসে আছেন। তাকিয়ে দেখুন তাদের দৃষ্টি এখানে। আপনি যদি এখন আমাকে কনভিন্স করতে পারেন তবে অফিশিয়ালি একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

সাম্য তাকিয়ে দেখলো ওর মা বোন হাসিহাসি মুখ করে ওর দিকে চেয়ে আছে ও এতক্ষণ এটা খেয়ালই করে নি!

কাজী সাহেব যখন পরিচয় বর্ণনা করে কবুল বলার কথা বললেন, তখন জাওয়াদ আরওয়ার পাশে দাঁড়িয়ে ধীর গলায় বললো, “আমাদের বিয়ের কথা ভাবছো বুঝি?”

“কীভাবে বুঝলেন?”

“আমিও সেটা ভাবছি তাই বললাম।”

“আপনি নিশ্চয়ই কাঁদো কাঁদো গলায় কবুল বলেছিলেন তাই না?”

“অবুঝ ছেলেরাই হেসে হেসে কবুল বলে! কারাগারে ঢোকার খবর জানলে কখনোই হাসতো না।”

আরওয়া নাক ফুলিয়ে বললো,” আপনি কারাবাসে আছেন বললেন? আমি আপনাকে কোনো পেইন দিয়েছি? আমার নামে এত বড় অপবাদ!”

“তোমার কথা বলি নি তো। তুমি তো গুড গার্ল!”

“ঢং”

জাওয়াদ অন্যদিকে ফিরে হেসে বললো,”এংরি বার্ড একটা!”

চলবে…

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪৭

#আরশিয়া_জান্নাত

৪৭

“আস্সালামু আলাইকুম আন্টি।”

“ওয়ালাইকুমুস্সালাম। কেমন আছ?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি ভালো তো?”

“আলহামদুলিল্লাহ!”

“আপনারা এসেছেন আমি অনেক খুশি হয়েছি। আঙ্কেল আসেননি?”

“হ্যাঁ এসেছে।”

“আচ্ছা আপনারা বসুন আমি আম্মুকে ডেকে আনছি।”

পাপিয়া রিজভীর মা-বোনকে বসিয়ে নিজের মাকে খুঁজতে গেল। যাওয়ার পূর্বে ওয়েটারকে বলে গেল উনাদের খেয়াল রাখতে।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষের পথে, একটু পরেই কনে বিদায় দেওয়া হবে। এই মুহূর্ত প্রতিটা মেয়ের জীবনে যতটা কষ্টের তার চেয়ে অধিক কষ্টের তার বাবা-মায়ের জন্য। কুহু ভেবেছিল তার বিয়ের দিন তার মায়ের চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবেনা। তিনি ওর বিয়ে নিয়ে গত কয়েকবছর যে পরিমাণ টেনশন করেছেন, আজ সেটা থেকে মুক্ত হয়ে নিশ্চয়ই খুশিতে গদগদ হয়ে মেয়েকে বিদায় করে বলবেন, “উফ আপদ বিদায় হলো!” কিন্তু না কোহিনূর মেয়েকে জড়িয়ে যে মরা কান্না জুড়েছিলেন তাতে উপস্থীত সবারই চোখে পানি আসতে বাধ্য হয়েছিল। মায়েরা যতই মেয়ের বিয়ে নিয়ে কথা শোনাক না কেন, বিয়ের দিন ঠিক হলে তাদেরই বেশি পুড়ে! বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কুহু চলেছে জীবনের নতুন এক অধ্যায়ে পাশে তার বহুকাঙ্ক্ষিত শখের পুরুষ। ইশরাক নিরবতা ভেঙে বললো,”কুহু মন খারাপ করো না। তোমার যখন ইচ্ছে হবে ওখানে যেতে পারবে। আমি মানা করবোনা। আর কেঁদো না প্লিজ!”

কুহু চোখের কোণে টিস্যু চেপে বসে রইলো। এতো কান্না কোত্থেকে আসছে কে জানে!

আরওয়া ক্লাসে বসে স্যারের লেকচার নোট করছে। রুমাইসা মনোযোগী ছাত্রীর মতো স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকলেও ওর মন এখন এখানে নেই।পেটের ভেতর কথাগুলো ঘুটঘুট করছে, আরওয়াকে না বলা অবধি সে শান্তি পাবেনা। আরওয়া আবার ক্লাসে কথা বলে পছন্দ করেনা। সে তো পারলে স্যারের সব কথা এ টু জেড খাতায় তুলে নিবে। রুমাইসা মনে মনে প্রার্থনা করছে ক্লাসটা দ্রুত শেষ হোক।

ক্লাস থেকে বেরিয়ে আরওয়া বলল,”চেহারা এমন বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছিস কেন?কী হয়েছে?”

“বিয়েতে কী পড়বো বুঝতেছিনা। একবার মনে হচ্ছে কাতান পড়ি, আবার মনে হচ্ছে জামদানি পড়ি, আবার লেহেঙ্গা পড়তেও মন চাইতেছে। আমি অনেক কনফিউজড!”

“এটা নিয়ে টেনশনের কী আছে? হলুদে জামদানি পড়িস, বিয়েতে কাতান রিসিপশনে লেহেঙ্গা! হয়ে গেল তো।”

” ধুরর তুই বুঝতেছোস না। বিয়েতে জামদানি পড়া এখন ট্রেন্ড। তাসনিয়া ফারিন কে দেখোস নাই কী সুন্দর লাগছিল! কুহু আপুকে কাতান শাড়িতে জোস লাগছে, দেখে ঐটা পড়তে মন চাইছে। পরে ইনস্টাতে লেহেঙ্গা দেখে….”

আরওয়া বিরক্ত গলায় বললো, “এখন একদিনে সব ট্রেন্ড ফলো করলে কেমনে হবে?”

“সেটাই তো!”

“সাম্য ভাইয়াকে বলেছিস?”

“নাহ।”

” এক কাজ কর এসব ট্রেন্ড বাদ দে, সাম্য ভাইয়ার কোনটা পছন্দ সেটা জিজ্ঞেস কর, সে অনুযায়ী সিলেক্ট কর। যত বেশি ঘাটবি তত কনফিউজড হয়ে যাবি। এর চেয়ে যার জন্য সাজছিস তার পছন্দকে গুরুত্ব দেয়া শ্রেয়!”

“সেটাই করতে হবে মনে হচ্ছে। তুই লাকি রে, তোকে এসব প্যারায় পড়তে হয়নাই।”

“এমনভাবে বলছিস যেন কয়েক যুগ আগে আমার বিয়ে হয়েছে। তখন এসব ছিল না!”

“সেটা বলিনাই। তবে তুই আমার মতো কনফিউজড তো ছিলি না।”

“হুম এটা ঠিক। এখন পরীক্ষায় ফোকাস কর, পরীকৃষার পর না বিয়ের ডেট ফিক্সড হলো?”

“এটাই বিরক্তিকর। পরীক্ষাটা মাঝখানে না টপকালে হতো না! বিয়ের পর পরীক্ষা হলে কী হতো!”

“আমারে বলোস আমি জামাই পাগল, এদিকে তুই তো বিয়ের আগেই সেটা হয়ে গেলি!”

রুমাইসা বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “লোকটাকে দেখলে একটু মায়াই লাগে। কেমন বলদা বলদা লুক নিয়ে তাকাই থাকে। সেজন্য একটু মায়া দেখাই আর কী এমনিতে কিছু না!”

“হইছে আর বুঝ দিতে হবেনা। আমরা খাই সুজি কিছু কিছু বুঝি!”

রোকেয়া বেশ কিছু কাপড় কিনে এনেছেন কাঁথা সেলাইয়ের জন্য। একটু পরেই সাহেরা নামে একজন আসতেই তিনি বললেন, “এখানে আস্তরসহ কাপড় দিচ্ছি, ৫০/৬০টা কাঁথা বানাবে। নকশি করে বানাবে ২০টা বাকিগুলো এমনি সেলাই করলেই হবে।”

“আন্টি আমনেগোর বাড়ির কারো বাচ্চা হইবো নাকি? হঠাৎ এতো খেতা সিলাইতে দিতাছেন?”

“সময় থাকতে থাকতে বানিয়ে নিচ্ছি, কার কখন সুখবর আসে বলা তো যাচ্ছেনা।”

“ওহ আইচ্ছা, বুদ্ধি ভালাই।”

“শোন তোর বোনের হাতের কাজ সুন্দর। ওরে বলিস নকশিগুলো যেন ও করে। যারেই দেই না কেন সবকয়টাই আদরের। তাই কাঁথাগুলো সুন্দর হতেই হবে।”

পাপিয়া মায়ের কান্ড দেখে বললো,”ওরে বাবা এ তো এলাহি কান্ড! তুমি কী সবার বাচ্চার জন্য কাঁথা সেলাই করতে বসছো?”

“এতো চিল্লাইস না। সবাই শুনলে আরেক কাহিনী শুরু হবে।”

পাপিয়া মায়ের কাছে বসে বললো,” সত্যি করে বলো তো আরওয়া ভাবীর সুখবর পাইছো?”

“আরেহ নাহ। এমনিই বানাই রাখতেছি।”

“ওহ। সাহেরা আপা আমার জন্য একটা বড় নকশী কাঁথা বানাবেন।”

“আমনে কাপড় ডা খালি দেন, বাকি সব আমার কাম। এমন সুন্দর ডিজাইন কইরা দিমু সবাই হা কইরা চাইয়া থাকবো।”

পাহাড়ের ঢল বেয়ে নেমে আসা বিশাল ঝর্ণার নীচে জাওয়াদ আর আরওয়া দাঁড়িয়ে আছে। পানি আর বাতাসের শব্দ মিলেমিশে অন্যরকম এক পরিবেশ। চারদিকে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ, গাছগাছালির সোঁতা গন্ধ। আরওয়া উল্লাসিত গলায় বললো,”আমার অনেক ইচ্ছে ছিল এমন ঝর্ণা সরাসরি দেখার। কী সুন্দর এটি!!”

জাওয়াদ মুচকি হেসে বললো,”তোমার পছন্দ হলেই স্বার্থক!”

আরওয়া এক কিনারায় বসে পানি নিয়ে খেলতে লাগলো। জাওয়াদ ওর দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আরওয়ার উচ্ছাসিত বাচ্চামো দেখতে আজকাল ওল ভালোই লাগে। মেয়েটা কখন যে ওর মনের অনেকটা অংশ দখল করে নিয়েছে কে জানে! জাওয়াদ শুরুতে ভেবেছিল এই বিয়েটা ১মাস ও টিকবে না, ও আরওয়াকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। তখন আরওয়াকে ওর ইমম্যাচিওর,ইরিটেটিং ক্যারেক্টার মনে তো। ওর অগোছালো স্বভাব, জিনিসপত্র এলোমেলো করার প্রবণতা, ঘুমের মধ্যে অস্থির অঙ্গিভঙ্গি সবই বিরক্তিকর লাগতো। অথচ সময়ের সাথে সাথে সব অভ্যেস হয়ে গেছে। আরওয়াও অনেকটা সংসারী হয়েছে, গুছিয়ে চলা শিখছে। গতিটা ধীর হলেও চেষ্টা করে যাচ্ছে এতেই জাওয়াদ খুশি। ঘুমের মাঝে ছটফট ভাবটা সম্পূর্ণ না কমলেও জাওয়াদের বুকে স্থির হয়ে থাকাটা ওকে স্বস্তি দেয়। আজকাল জাওয়াদের বরং কষ্ট হয় ওর সান্নিধ্য না পেলে। ও নাক ফুলিয়ে রেগে ঝগড়া না করলে মনে হয় দিনটা পূর্ণই হলো না।
আরওয়া ওর দিকে পানির ঝাপটা দিতে ধ্যান ভাঙ্গে তার, আরওয়া ভ্রূ উঁচিয়ে বলল,” কোথায় হারালেন?”

জাওয়াদ মুখ মুছে বলে,” এটা কী হলো? এভাবে কেউ পানি মারে!”

“তো কীভাবে মারে?”

“দাঁড়াও দেখাচ্ছি,,”

জাওয়াদকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে আরওয়া পেছাতে থাকে। হেসে বলে, “আমার ডেমো চাই না। আমি বুঝে গেছি….”

“এখন বললে তো হবে না। আমি ডেমো তো দিবোই। এমন পেছাচ্ছ কেন?”

“আপনি নিশ্চয়ই ডেঞ্জারাস কিছু করবেন, আপনাকে আমি ভালো মতো চিনি।”

“আরওয়া পিছিও না। স্থির হয়ে দাঁড়াও।”

আরওয়া মাথা নেড়ে না বলতে বলতে পেছালো। এলোমেলো পাথরের কিনারায় ব্যালেন্স করতে ওর কষ্ট হলেও স্থির হলোনা। জাওয়াদ ওকে আকড়ে ধরার জন্য এগোতে চাইলেও ও থামলো না। এক পর্যায়ে জাওয়াদ দাঁড়িয়ে বললো,” আরওয়া থামো,‌আর পিছিও না For God sake!”

আরওয়া খিলখিল করে হেসে বললো,”হুম আমি থেমে যাই আর আপনি ঝট করে ধরে ফেলুন। হবে না সেটা। আমি আর বোকা নেই!”

জাওয়াদ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আরওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো, আরওয়া পেছাতে পেছাতে অনেকটা দূর চলে গেছে। হঠাৎ পা পিছলে আরওয়া ঝিলে পড়ে গেল। পানিতে হাবুডুবু খেয়ে জাওয়াদকে ডাকতে লাগলো। জাওয়াদ ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পা কিছুতেই এগোচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে ওর একেকটা পায়ের ওজন কয়েক মণ হয়ে গেছে, সে কিছুতেই পা নাড়িয়ে এগোতে পারছে না। আরওয়া ওকে প্রাণেপনে চিৎকার করে ডেকেই যাচ্ছে আর বলছে, “আমি সাতার পারি না, আমাকে বাঁচান। জাওয়াদ আমাকে বাঁচান প্লিজ…”

হঠাৎ আরওয়া পেছনে তাকিয়ে দেখে বিশাল আকৃতির কুমির তার দিকে এগিয়ে আসছে। ভয়ে ওর আত্মা উড়ে যায় যেন। ও পানিতে ধাপাধাপি করে কিনারায় পৌঁছানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে‌। কিন্তু পানির স্রোতের সঙ্গে পেরে উঠে না। জাওয়াদ ওর কাছে এগিয়ে আসতে আসতে পুরো পানি রক্তে লাল হয়ে উঠে…

জাওয়াদ ঘুম থেকে উঠে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। চোখের কিনারা এখনো অশ্রুসিক্ত, ভয়ে তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। কাঁপা হাতে ল্যাম্প অন করে আরওয়াকে দেখে ওর মন শান্ত হলেও দুঃস্বপ্নের প্রভাব দূর হয় না। ও গ্লাস থেকে পানি পান করে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে। মানসপটে বারবার ভেসে উঠে সেই ভয়ানক দৃশ্য। জাওয়াদ আরওয়া কে তুলে বুকের মাঝে নেয়। গালে কপালে চুমু খেয়ে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ তুমি ঠিক আছ, তোমার কিচ্ছু হয় নি। ঐটা দুঃস্বপ্ন ছিল।”

আরওয়া মুখে পানির অস্তিত্ব টের পেয়ে জেগে উঠে, ওর চোখ মুছে দিয়ে ঘুমঘুম গলায় বলে, “কী হয়েছে? আপনি কাঁদছেন কেন? খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন?”

জাওয়াদ ওর হাতেরমুঠোয় চুমু দিয়ে বলে,”আরওয়া তুমি কখনো আমার কথা অমান্য করবে না। আমি না বললে ঐ পথে আর এগোবে না প্লিজ। তুমি সাবধানে থাকবে বুঝছো।তোমার লাইফে আমার চেয়ে বেস্ট অনেক ছেলে আসলেও আমার লাইফে তোমার মতো কেউ আসবেনা। আমার কাছে তুমি মূল্যবান। এটা মাথায় রেখো।”

আরওয়া ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,” খারাপ স্বপ্ন সত্যি হয় না। ঐগুলো আমাদের ভাবনার রিফ্লেক্ট। এতো পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই। যা দেখেছেন ভালো দেখেছেন। শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন তো। আমি আছি আপনার পাশে।”

জাওয়াদ শান্ত হলো না। বরং সেই রাতে তার গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো।

পাপিয়া জাহিদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বাসায় ফিরছিল। হঠাৎ তাদের গেইটে তাকিয়ে দেখে বেশ কয়েকটা গাড়ি এসেছে। জাহিদ বললো, “বাসায় কোনো মেহমান এলো নাকি?”

“কুহু আপুদের তো আজ আসার কথা না। তাহলে কে এলো?”

“চলো ভেতরে গিয়ে দেখি।”

পাপিয়া বাড়ির ভেতরে ঢুকে ভুত দেখার মতো চমকে যায়। তাদের ড্রইং রুমে রিজভী ও তার পরিবারের সবাই বসে আছে। রিজভী দেশে ফিরলো কবে! কই ওকে তো কিছু বলেনাই।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে