কাঁটাকম্পাস পর্ব-৪২+৪৩

0
366

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪২

#আরশিয়া_জান্নাত

৪২

রুমাইসা ক্যাফেতে খাবার অর্ডার করে টোকেন নিয়ে এসে বসলো। ফোনে গেইম প্লে করে খাবারের অপেক্ষা করার মতো বিরক্তিকর কাজটা এভয়েড করতেই এই কারসাজি। এই ক্যাফের বার্গার তার অনেক পছন্দ বলেই সে নিয়মিত এখানে আসে, এখানে ফুড রেডি হতে বেশ সময় লাগে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে এখানে আরাম হলেও একা এলে একটুও ভালো লাগেনা। অবশ্য এখন একা না এসেও উপায় কী, আরওয়া এখন সংসারী মেয়ে। বিয়ের পর খুব কমই তারা একসঙ্গে অফটাইমে বের হয়। রুমাইসা তাই নিজেকে নিজেই সময় দেয়। একা একাই বেরিয়ে পড়ে, পিজ্জা খায়, মুভি দেখে। মাঝেমধ্যে বেরিয়ে পড়ে শহরের সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলো দেখতে।

“এক্সকিউজ মি?”

রুমাইসা ফোন থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বললো, “বলুন”

“কি গেইম খেলছেন?”

“COC”

“টাউনহল কত?”

“12”

“বাহ! তবে এখনো এটা কেউ খেলে নাকি?”

“ওয়েট এ মিনিট”

রুমাইসা দারুণ একটা ভিলেজ পেয়ে, তাই সৈন্য সামন্ত নিয়ে এট্যাক করলো সেই ভিলেজে। স্ট্রং স্পেল ফেলে এয়ার ডিফেন্স আধমরা করে আর্চার আর উইজার্ড দিয়ে একপাশ ঘিরে ড্রাগন ছেড়ে দিলো। জায়ন্ট দিয়ে ডিফেন্সগুলো ভেঙে গুড়িয়ে দিলো মুহুর্তেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো গ্রামটা তছনছ হয়ে থ্রি স্টার ক্লেইম করে রুমাইসা সামনে তাকালো, সাম্য ভেবেছিল ওকে দেখে রুমাইসা চমকাবে। কিন্তু তার ভাবনা গুড়ে বালি। রুমাইসা বলল, “আপনার জব কি চলে গেছে নাকি? কাজকর্ম ফেলে আমাকে ফলো করছেন কেন?”

সাম্য ওর টোকেনটা দেখে বলল, “আপনার ফুড রেডি হয়ে গেছে।”

রুমাইসা উঠে গিয়ে নিজের ফুড রিসিভ করলো। এসে দেখে ওর টেবিলের উপর একটা লাল গোলাপ আর কার্ড রেখে সাম্য চলে গেছে। রুমাইসা বার্গারে বিগ বাইট দিয়ে বলল, “গোবলিন একটা! আসবে দেখবে তারপর ফুল রেখে চোরের মতো পালিয়ে যাবে,, যত্তসব ন্যাকা!”

জহির সাহেব চা মুখে দিয়ে বললেন,”আমাকে তুমি তিতা করলার মতো ভালোবাসো মানছি, তাই বলে চায়ে বেশি লিকার দিয়ে সেই তেতো ছড়িয়ে দিতে হবে! এক কণা চিনিও বোধ হয় দাও নি এতে?”

রোকেয়া উনার সামনে বসতে বসতে বললেন, ওসব আমায় বলে লাভ নেই, বড় রাজকুমারী রান্নাঘরে পা রেখেছেন। এখন এসব টুকটাক ঘটনা তো ঘটবেই!”

কুহু চিনির বাটি নিয়ে এসে বলল,”মেঝ আব্বু চা খেয়ো না। চিনি দিতে একদম ভুলে গেছি। দাঁড়াও চিনি গুলে দেই”

জহির সাহেব বললেন, “তুই কী এখন সবার ঘরে গিয়ে গিয়ে এমন চিনি দিয়ে আসছিস?”

“হু! চিনির পট সবার আগে রেখেছি অথচ এটা দিতেই ভুলে গেছি। কী একটা অবস্থা! আচ্ছা যাই ভাইয়ারটায় চিনি দিয়ে আসি।”

বলেই কুহু যেমন দ্রুত এসেছিল তেমনি দ্রুত চলে গেল। জহির সাহেব বললেন,” শাস্তিটা সহজ ভেবেছিলাম, কিন্তু ওকে দেখে মনে হচ্ছে এটা ওর জন্য কঠিন ই হবে!”

“বড়ভাবি তো অনেক খুশি হয়েছেন। রান্নাবান্নায় ওর একটুও আগ্রহ নেই। এখন যদি কিছু শিখে আর কী!”

“আজ দুপুরে কী ও রান্না করবে? তোমরা না থাকো শেফ কেউও নেই?”

“হুম ও রান্না করবে। আর শেফ থাকলে আর লাভ কী? ওকে সাহায্য করতে লাকি থাকবে তাও শর্ত হলো রান্নায় কিছু বলে দিবেনা। ও নিজের বুদ্ধিতে করবে।”

“এটা ঠিক হলো না। না দেখিয়ে না শিখিয়ে এরকম ছেড়ে দিলে হয় নাকি? তোমরা সুযোগে আমার মেয়েটাকে খাটিয়ে মারার পায়তারা করছো।”

“তাও ওর ভাগ্য ভালো বাপের বাড়িতেই এই ফীল পাচ্ছে। পরের বাড়ির রান্নাঘর যদি জীবনের প্রথম হতো অবস্থা আরো খারাপ হতো।”

“তাও ঠিক!”

নাহিয়ান টাই বাঁধতে বাঁধতে বলল,”আমি তোর ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমতো শঙ্কিত। এমন ছেলে চুজ করেছিস যে খেতে ভালোবাসে, অথচ নিজে সামান্য চা টা ও করতে পারিসনা। তোদের সংসারে অন্যকিছু নিয়ে ঝগড়া হবে কী রান্নার জন্যই না গৃহযুদ্ধ লেগে যায়!”

কুহু টেবিলের উপর চায়ের কাপ রেখে বললো, “বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে একটা শেফ দিয়ে দিস। তাহলেই হলো!”

“যৌতুক দেওয়া এবং নেওয়া সমান অপরাধ। সো এসব মিথ্যে আশায় বাসা বাঁধিস না, সময় থাকতে থাকতে নিজেই শিখে নে।”

“শোন ভাইয়া এটা ডিজিট্যাল যুগ, ইউটিউবে রান্নাল টিউটেরিয়ালের অভাব নেই। মানুষ এখন ঘরে বসেই কত রকম রান্না শিখে ফেলছে। এ আর কঠিন কী? এতো তাড়াহুড়ার কিছু নেই!”

“এসব ভেবে ভেবে ২৫ এ পা দিলি! এখনো তোর শেখার বয়স হলো‌না? তোর চেয়ে ছোট আরওয়া এখন দিব্যি সংসার করছে, রান্নার হাত ও চমৎকার আর তুই!”

“তুলনা দিস না, তুলনা ভালো লাগেনা।”

“সত্যি সবসময় তিতাই লাগে। যাক যার যার বুঝ দাঁড়ি কাটি রাখে মোচ।”

আরওয়া আয়নায় পেছনে ল্যাপটপে বিজি থাকা জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে চুল আচড়াচ্ছে। জাওয়াদ বলল, “এরকম হা করে চেয়ে না থেকে কি বলবে বলে ফেলো।”

আরওয়া ওর দিকে ফিরে বলল,”আমি হা করে চেয়ে আছি?”

“হা করো‌নি, তবে এক ধ্যানে তাকিয়ে তো আছ নাকি!”

“আমার বরের দিকে আমি তাকাবো না তো কে তাকাবে? যদিও সে তার ল্যাপটপ ব্যতীত কিছুই চোখে দেখে না…”

জাওয়াদ ল্যাপটপ রেখে উঠে কফি মেকার অন করলো। আরওয়ার সামনে গিয়ে বসে বলল, ” আমার কাজকে এতো হিংসা করো তুমি? ”

“অবশ্যই করি। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত অফিস করে এসেও যদি ল্যাপটপেই মুখ গুজে রাখেন হিংসা করা কী অস্বাভাবিক হবে? আপনার উচিত বাসায় যতক্ষণ থাকেন আমার দিকে তাকিয়ে থাকা।”

জাওয়াদ ওর চুলের ভাজে হাত গলিয়ে বললো,”তোমার শ্যাম্পুর ঘ্রাণটা তো খুব সুন্দর!”

“দেখেছেন কাজ থেকে মন সরলেই বৌয়ের কত কী নজরে আসে?”

“তোমার নাকটা আরেকটু উঁচু হলে সুন্দর লাগতো, এখন খানিকটা বোঁচা লাগে।”

“মোটেই না। আমার নাক ঠিক ই আছে।”

“আয়নায় ভালো মতো দেখো বুঝতে পারবা। এই তোমার মাথায় উকুন ও আছে দেখছি! আয়হায় তাই তো বলি আমার মাথায় কি চুলকায়। তোমার থেকে আমার মাথাতেও উকুন চলে এলো নাকি?”

“যার চুল আছে, তার উকুন থাকবেই। এতে এতো নাক ছিটকানোর কী আছে? উকুন হলো চুলের শোভা বুঝলেন!”

“বলছে তোমারে!”

“আপনি যান তো কাজ করেন,,”

“ওমা কেন? তুমি না বললে তোমাকে দেখতে? এখন কাজ করবো কেন?”

“দেখতে বলেছিলাম দোষ ধরতে না।”

জাওয়াদ হাসি আটকে বলল,” মনোযোগ দিয়ে তাকালে যা চোখে পড়ে তা বলা কী অন্যায়?”

আরওয়া চুলে ক্লিপ আটকে বললো, “ন্যায় অন্যায় দিয়ে আমার কাজ কী? আপনি যান তো আপনার কাজ করুন।”

জাওয়াদ ওর নাক টেনে বলল, “রোজ এভাবে নাক টানবে বুঝছো!”

আরওয়া নাক ফুলিয়ে বলল,”আপনি একটা তেলাপোকা! অসহ্য অসহ্য অসহ্য।”

জাওয়াদ ওর হাত ধরে কাছে টেনে বলল,”এই অসহ্যকর লোকটাকেই পুরো জীবন সহ্য করতে হবে তোমার। কী দুঃখ!”

আরওয়া ওর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,”হাত ছাড়ুন, আমি বাইরে যাবো।”

“আমি একবার হাত ছাড়লে কিন্তু ২য় বার ধরি না।”

আরওয়া ওর চোখের দিকে চেয়ে রইলো। জাওয়াদ ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল, “এভাবে চেয়ো না মেয়ে, তোমার অগ্নিদৃষ্টিতে আমি ভষ্ম হয়ে যাবো…”

আরওয়া ওর হাতে জোরে কামড় দিয়ে বলল,” আপনাকে আমি একটুও ভালোবাসি না। এক বিন্দু ও না…”

জাওয়াদ হেসে বলল, “Thanks for another love bite. Now I can return it…”

বলেই সে আরওয়ার গলায় গভীর চুমু খেলো। সেই চুমুতে আরওয়া ব্যথা অনুভব করলেও কোনো শব্দ করলো‌না। বরং দুহাতে জাওয়াদের পিঠ খামচে ধরে গাঢ় গলায় বলল, “Love me like you do….”

সানজিদা বেগম নিজের ঘরে বসে কি যেন ভাবছিলেন, ইশরাক দরজায় নক করে বলল, “মা আসবো?”

“আসো”

“কি করছিলে? একা বসে আছ যে?”

“এমনিই বসে আছি। কিছু বলবে?”

ইশরাক মায়ের পায়ের কাছে বসে বলল, “তোমার কী মন খারাপ?”

“নারে বাবা, মন খারাপ হবে কেন? ও বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল, উনারা আসতে চাইছেন আমাদের সাথে কথাবার্তা বলতে।”

“বাবা কী বললেন?”

“বলেছে যেন আসে।”

“তুমি সেজন্য রাগ করেছ?”

“নাহ! আমি কেন রাগ করবো? উনার ছেলের বিয়ে উনি যার সাথে ইচ্ছে করাক। আমি বলার কে? তাছাড়া তুমি তো কুহুকে পছন্দ করো,মিয়াবিবি রাজী তো কেয়া করেগা কাজী?”

“মা, কুহুকে তুমি একবার সুযোগ দিয়ে দেখো, দেখবা তোমার ভুল ভেঙে যাবে। ওর কর্মকান্ড একটু অন্যরকম হলেও মনের দিক থেকে ও খারাপ না।”

“দেখ বাবা, তোর জীবন তুই কার সঙ্গে কাটাবি সেটা তোর ব্যাপার। সুখে থাকলে আমরা দেখে সুখ পাবো, অসুখী হলে কষ্ট পাবো এইটুকুই! এখন আমরা যদি তোর মতের বাইরে কিছু করি আজীবন দোষারোপ করে যাবি, তোর মনে হবে আমরা তোকে তোর পছন্দের মানুষ দেই নি। অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম কিছু মানুষ নিজের বুদ্ধিতে ফকির হলেও আনন্দ পায়। তবুও পরের বুদ্ধিতে চলতে চায় না। তুই তাদের দলে। আমার আর কিছু বলার নেই।”

ইশরাক মায়ের রুম থেকে নিরাশ হয়েই বের হলো। ওর মা পুরো ব্যাপারটা ওর উপর ছেড়ে দিয়ে মাইন্ডগেইম শুরু করেছেন সেটা বুঝতে তার বাকী রইলো না। ইশরাক নিজের ঘরে গিয়ে কুহুকে কল দিলো। পরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনে পড়লো কুহুদের বাসায় সবাই এই সময়ে ডিনার করে। ওর সঙ্গে মিট করা দরকার।

চলবে,,

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪৩

#আরশিয়া_জান্নাত

“আমি বুঝতে পারছি না আমার কী করা উচিত। সবকিছু ঠিকঠাক হয়েও সব বেঠিক হয়ে গেছে। মা এখন সবটা আমার উপর ছেড়ে দিয়ে আমার মানসিক চাপ আরো বাড়িয়ে দিলেন। আমি
এখন কী করবো?”

কুহু লেকে ঢিল ছুঁড়ে বলল,”উনাকে কনভিন্স করা ছেড়ে দাও। তোমাদের যখন মনে হচ্ছে আমি ভুল অপশন দ্যান লিভ মি।”

“তুমি আমার সিচুয়েশন বুঝতেছ না, উল্টো রাগ করতেছো!”

“আমি রাগ করে বলছি না। প্র্যাক্টিক্যালি বলছি। দেখো আমাদের এখনো অফিশিয়ালি কিছু হয়নি, তাই এখানে তোমার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। কিন্তু বিয়ে বা আংটিবদলের পর কিছু ঘটলে কৈফিয়ত দিতে হবে। ধরো তুমি তোমার মায়ের এগেইনস্টে গিয়ে আমাকে বিয়ে করলে, তারপর কী হবে? বিয়ে করার পর পান থেকে চুন খসলেই তোমার মনে হবে তোমার মায়ের ধারণাই ঠিক ছিল। আর তোমার মা ও শুরু থেকেই আমার প্রতি নেগেটিভ ধারণা নিয়ে থাকবেন। আমাকে চাইলেও মন থেকে এক্সেপ্ট করতে পারবেন না।”

“তুমি ওভারথিংক করছো কুহু!”

“ওভার থিংক বলো আর যাই বলো আমি আমার ফিউচার গেস করতে পারছি। তোমার আর প্রেশার নিতে হবে না। তুমি এমনিতেও আমার প্রতি আগ্রহী ছিলেনা। আমিই জোর করে তোমার লাইফে এন্ট্রি করেছিলাম। সো প্যারা নাই চিল। একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নাও‌। আমি আর তোমাকে বিয়ের জন্য বিরক্ত করবোনা।”

“কুহু লিসেন টু মি। আমাকে কিছু বলার সুযোগ দাও,,,”

কুহু উঠে বললো, “ইশরাক! তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাসতে কনফিডেন্ট থাকতে আমাকে নিয়ে। সবটা তোমার উপর ছেড়ে দেওয়াতে দ্বিধায় পড়তে না, বরং আমাকে শক্ত হাতে ধরে দেখিয়ে দিতে আমি ভুল‌ নই। অথবা
তোমার মনের কোথাও না কোথাও আমাকে হারানোর ভয় থাকতো। কিন্তু তোমার চোখে আমি সেটা দেখছি না, বরং দেখছি আমাকে চুজ করতে তুমি ভয় পাচ্ছ! যাক যা হয় ভালোর জন্যই হয়। গুড বায়!”

কুহু পেছনে না ফিরেই এগিয়ে গেল। দুচোখ বেয়ে পানি পড়লেও মোছার জন্য হাত তুললো না পাছে যদি ইশরাক বুঝে ফেলে! কুহু গাড়িতে বসে বললো,”চাচা গাজীপুর চলেন। রানি আন্টির বাসায় যাবো।”

ইশরাক রেস্টুরেন্টে গিয়ে এক্সট্রিম স্পাইসি নাগা অর্ডার দিলো। দুইটা বাইট দিতেই ঝালে তার জিভ জ্বলে উঠে, তবুও সে থামে না। চোখমুখ লাল করে দুইটা লেগপিস সাবাড় করে। ওয়েটার তাকে মিল্কশেক অফার করলেও ও নেয় না। বরং টিস্যু দিয়ে অনবরত চোখ নাক মুছতে থাকে। চোখের পানি নাকি দুঃখ কমায়, তবে ওর কমছে না কেন?

সাবা মন খারাপ করে বলল,”আমার ই দোষ‌ হয়েছে। সেদিন তোমাকে যদি না আটকাতাম, তাহলে আজকে কুহুর এই অবস্থা হতো না।”

পাপিয়া ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,” মন খারাপ করো না ভাবি। আপু আপুর ভুলের শাস্তি পেয়েছে। ও সবসময় সবকিছু লাইটলি নেয় বলেই এই অবস্থা। তুমি কেন নিজেকে দোষ দিচ্ছ। অন্যের বিয়েতে বাগড়া দিতো বলেই নিজের বিয়েতে ভেজালে পড়ছে।”

“পাপিয়া শত হলেও ও আমাদের বোন। ওর সাথে এমন ঘটনা ঘটুক আমরা কেউই চাইবোনা। আচ্ছাআমি কী একবার কথা বলবো আন্টির সাথে? মিসআন্ডার্স্ট্যান্ডিং টা দূর করা উচিত।”

“সেদিন দাদা সাহেব গিয়েছিল, আন্টি নাকি সামনেই আসেননি। আমার মনে হয় আন্টি শুরু থেকেই এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না, এখন একটা বাহানা পেয়ে বেঁকে বসেছেন।”

” এভাবে বলো না, কার মনে কী আছে আমরা জানি না। অনুমান করা ঠিক না।”

“এখন কী মনে হয়, এই বিয়ে আর হবে?”

“দুই পক্ষের অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে আশা‌ নেই!”

“ভাইয়া কী বলে?”

“সে বলে, ‘হচ্ছে না যখন বাদ দাও। অযথা জোরাজুরি করে লাভ কী?’ এরকম বললে হয় বলো? ওরা দুজনকে দুজন ভালোবাসে, সামান্য কারণে বিচ্ছেদ হয়ে যাবে!”

পাপিয়া শ্বাস ফেলে বলল,”কী আর করার?”

আরওয়া হাসিহাসি মুখ করে জাওয়াদের সামনে দাঁড়ালো। জাওয়াদ শার্টের টাই বাঁধতে বাঁধতে বলল, “কী ব্যাপার সকাল সকাল এতো খুশি কেন?”

আরওয়া ওর সামনে বসে বললো, “আজকে আব্বুরা আসবেন। মাত্রই ফোন করে বললেন। আজ আর আমি ভার্সিটি যাবো‌না।”

“ওহ আচ্ছা সেজন্য এতো খুশি!”

“হুম, দাদী বললেন আপনি আজ দুপুরে লাঞ্চটা যেন বাসায় করেন”

“চেষ্টা করবো আসার।”

আরওয়া আলমিরা খুলে বললো, “কোন শাড়িটা পড়ি বলুন তো?”

“যেটা ক্যারি করতে সহজ হবে সেটা পড়ো।”

“রেড পড়বো?”

“নাহ!”

“এশ?”

“নাহ”

“তাহলে সী গ্রিন টা পড়ি?”

“নাহ!”

“পার্পেল?”

“নাহ”

“তাহলে আপনিই বলে দিন না কোনটা পড়বো।”

“পড়ো না যেটা আরামদায়ক!”

আরওয়া কোমরে দু’হাত রেখে ভ্রু কুঁচকে বলল, “যেটাই বলছি না বলছেন, আবার সিলেক্ট ও করে দিচ্ছেন না। সমস্যা কী আপনার?”

জাওয়াদ চুলে ব্রাশ করে বলল,”আমি তোমার ভালোর জন্যই বলেছি, আসলেই লোকের ভালো করতে নেই। গ্রাম বাংলায় একটা প্রবাদ আছে না, “খাইতে কইলে মাইরতে উডে” এটাই সত্যি!”

আরওয়া বলল,”আমি আকাশী ছাড়া যেই কালার ই বলবো আপনি না বলে যাবেন, এটা আমার বোঝা হয়ে গেছে!”

জাওয়াদ ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে চিবুক রেখে বললো, “এটা বোঝো যখন অন্য কালার বলো কেন হুম?”

“তাই বলে অন্য কোনোটা পড়বো না?”

জাওয়াদ ওর কানের কাছে নাক ঘষে ফিসফিস করে বলল,”ডার্ক কালারে তোমাকে বেশি আকর্ষণীয় লাগে। তাই বলি লাইট কিছু পড়ো।”

আরওয়া আহ্লাদি গলায় বলল, “আপনি ও না কি যে বলেন!”

জাওয়াদ লেভেন্ডার কালারের একটা শাড়ি নিয়ে বললো,”এটা পড়ো। এই কালারটাও অনেক সুন্দর!”

“আচ্ছা।”

আরওয়ার বাবা-মা ও দাদী একটু আগে জাওয়াদদের বাড়ি এসেছে। তাদের পেয়ে বাড়ির সবাই আতিথেয়তায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আরওয়া তো খুশিতে একবার কিচেনে যাচ্ছে তো একবার ড্রইং রুমে আসছে। শ্বশুড়বাড়িতে বাবারবাড়ির লোক আসলে স্বভাবতই মেয়েদের মন আনন্দে ভরে যায়। আরওয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। তার ছোটাছুটি দেখে রোকেয়া বললেন, “আরেহ তুই এতো ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? আমরা সবাই আছি তো, তুই যা উনাদের সঙ্গে গল্প কর।”

শিরিন বললো,” আপা ও করুক সমস্যা নেই। মেয়েকে এমন সংসারী দেখে আমাদের ভালো লাগছে। ওর রান্না আপনাদের পছন্দ হয় তো?”

পাপিয়া বলল,” আমার ভাবীদের রান্না অনেক মজা। ওটা নিয়ে কারো কমপ্লেইনকরার স্কোপ নেই। এক ভাবী বাঙালী রান্নায় এক্সপারৃট তো আরেক ভাবী চাইনিজে। বলতে পারেন আমরা একদম লাকি ফ্যামিলি মেম্বার!”

ওর কথা শুনে কোহিনূর বললো,” একদম ঠিক কথা।”

করিমুন্নেসা নাতনিকে পাশে বসিয়ে আদর করে বললেন, “তোর লাই কদিন‌ ধরি আর যে ফরান ফরের। তোর বায়েরে কইলাম মাইয়াগারে কদিনের লাই লই আয়। হেতে সময়ই পায় না। আইজ এক্কেরে ধরি বান্ধি লই আইছি।”

আরওয়া দাদীর গলা জড়িয়ে বলল, ” দেখো দাদীজান উনি এই আংটিটা দিয়েছে। সুন্দর না?”

“তোর আইশ মিটছে তাইলে। হেতে তোরে আংটি পড়াইছে!”

“হুম। জানো আমরা সেন্টমার্টিনে অনেক মজা করেছি। সাগরপাড় অনেক সুন্দর। ঐখানে কত সুন্দর সুন্দর পাথর! আমার ফিরতেই মন চাইছিল না।”

করিমুন্নেসা নাতনীর চোখেমুখে আনন্দ দেখে মনে মনে বললেন “আল্লাহ তোরে এমনই সুখী রাখুক।”

আমিন সাহেব বললেন, “ভাইসাহেব আমরা একটা বিশেষ কারণে আজকে এসেছি। আসলে কয়েকদিন পর আয়েশার ফুফাতো বোনের বিয়ে। আপা আপনাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছেন। আম্মা বলছিলেন আপনাদের মত থাকলে হলুদের আগের দিন আমরা সবাই একসঙ্গে দৌলতপুর যাবো।”

জহির সাহেব বললেন, “এটা তো অনেক ভালো সংবাদ। অনেক বছর হয়েছে গ্রামের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান দেখি না।আমি অবশ্যই আপনাদের সঙ্গে যাবো।”

পাপিয়া বলল,” আমিও যাবো। আমি কখনোই দেখিনি।”

রোকেয়া বললেন,” আব্বা অনুমতি দিলে আমরা সবাই নিশ্চয়ই যাবো।”

করিমুন্নেসা বললেন,” গ্রামের বাড়ি বলে ভয় পাইও না। ওদের বাড়িঘর সব শহরের মতোই। থাকা খাওয়ায় কোনো অসুবিধা হবেনা।”

আরওয়া বললো,” আমার তো ভেবেই আনন্দ হচ্ছে, সবাই একসঙ্গে বিয়েতে যাবো অনেক মজা হবে।”

“দোস্ত একটা কথা বল তো, ভাইয়ার পিএ মানুষটা কেমন?”

“সাম্য ভাইয়ার কথা বলছিস? উনি অনেক ভালো ফ্যামিলি ম্যান, উনার বাবা মারা যাওয়ার পর উনিই সংসারের হাল ধরেছেন। শুনেছি লাইফে অনেক স্ট্রাগল করে এই অবধি এসেছেন, তোর ভাইয়ার তো বলতে গেলে উনি ডান হাত!”

“ওহ আচ্ছা! তা উনার গফ আছে বা এক্স?”

“মনে হয় না। কেন বল তো?”

“ক্যারেক্টার কেমন মনে হয়?”

“যতটুকু দেখলাম খারাপ না।”

“তুই আর‌ দেখলি কই, অফিসে ভালো ইমেজ ধরে রাখলেই কী মানুষ ভালো হয়ে যায়? এমনো তো হতে পারে উনি মেয়েবাজ ছেলে, সুন্দরী মেয়ে দেখলে লাইন মারার ট্রায় করে, ফলো করে সবসময়। ফুল চিরকুট লিখে রেখে যায়। বলদা বলদা লুক নিয়ে মেয়ে পটানোর ট্রায় করে!”

আরওয়া হেসে বলল, “এটা খারাপ নাকি? বিয়ের বয়স হয়েছে যখন মেয়ে দেখবে না? সিঙ্গেল লাইফ লিড করবে নাকী? এখনই তো মেয়ে পটানোর উপযুক্ত সময়”

“হোয়াট ইফ একটা মেয়ে না, অনেক মেয়ে হয়।”

“টোপ ফেলে রাখছে আর কি যেই টোপ গিলবে তাকেই বিয়ে করবে।”

রুমাইসা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “ওহ আচ্ছা!”

আরওয়া ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “সাম্য ভাইয়া যদি তোকে প্রপোজ করে রিজেক্ট করিস না। সে সত্যিই দারুণ মানুষ। তোকে হ্যাপি রাখবে।”

ওর কথা শুনে রুমাইসার নাকেমুখে উঠে কাশতে লাগলো। আরওয়া ওর পিঠ চাপড়ে বললো,” বি কেয়ারফুল দোস্ত।”

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে