কাঁটাকম্পাস পর্ব-৪০+৪১

0
357

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪০

#আরশিয়া_জান্নাত

৪০

কক্সবাজার পৌছানোর পর জাওয়াদ আর আরওয়ার আরেকদফা ঝগড়া লেগেছে। জাওয়াদ বলছে, সেন্টমার্টিন যাবে, আরওয়া বলছে, না আজকে এখানেই থাকতে হবে। দুজনের কেউই কাউকে ছাড় দিতে ইচ্ছুক না। আরওয়া এখানে সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে তাই সেন্টমার্টিন যাওয়ার প্রশ্নই উঠেনা, একইভাবে জাওয়াদ সেন্টমার্টিনে প্ল্যান করেছে এখানে থাকার প্রশ্নই উঠেনা।
তাদের এই ঝগড়া চরম মাত্রায় পৌঁছানোর আগেই সাম্য উপস্থিত হলো। আরওয়া তাকে দেখেই বলল, “সাম্য ভাইয়া আপনার বসকে বলে দিন সবকিছু উনার মর্জিমতো হবেনা। আমি যা বলছি তা মানতে হবে”

জাওয়াদ বলল,”বললেই হলো? ওর মর্জিমতোই তো সব হয়েছে। যখন আসতে বলেছি তখন আসেনি। পরে এসে কীভাবে বলছে আমার মর্জিমতো সব হয়!”

“আগে হোক বা পরে আমি উনার কথামতোই তো চলি তাই না? একটা দিন আমার কথায় চললে কী হয়?”

“এমন দিনে চাইবে কেন যেদিন রাজী হওয়া কঠিন?”

“আমি এতো কথা শুনতে চাই না। আমরা আজকে এখানেই থাকবো।”

“সবসময় জিদ ভালো লাগেনা, বলেছি না আজ ওখানে থাকবো।”

সাম্য ওদের তর্ক থামিয়ে বলল,”আমি জানতাম আপনাদের এই প্রবলেম টা হবে। তাই আমি সে অনুযায়ী টাইম সেট করে রেখেছি। ম্যাম লাঞ্চটা আপনারা এখানে করুন আর ডিনার ওখানে করবেন। প্লিজ একটু কো-অপারেট করুন।”

আরওয়া আর কথা বাড়ালো না, রুমে গিয়ে তৈরী হতে শুরু করলো।

জাওয়াদ সাম্যর দিকে তাকিয়ে বলল,” তুমি আমাকে বলো নি কেন আরওয়া এখানে প্ল্যান করছে?”

“ম্যাম আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল, আমি বললে কীভাবে হবে!”

“হাহ! ডেস্টিনেশন এক জায়গায় মেলালেই তো হতো। তুমি দুই জায়গায় দুটো রাখলে কেন?”

“আপনারা দুজনেই দুই জায়গা সিলেক্ট করেছেন, আবার বলেছেন সিক্রেট রাখতে। আমি আর কী করব?”

জাওয়াদ ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,” ও যদি ভাবে আমি ভুলে গেছি, ওরটা দেখে মনে পড়েছে তাই পরে আমি এরেঞ্জ করেছি? আমি লাস্ট হয়ে গেলাম না?”

“ম্যাম তেমনটা ভাববেন না। আপনি নিশ্চিত থাকুন। স্যার আপনার জন্য কিছু অর্ডার করবো?”

“হুম অরেঞ্জ জুস অর্ডার করো।”

আরওয়া রেডি হয়ে ফোন চেক করে দেখলো অনেকেই তাদের উইশ করেছে। একটা মেয়ে এসে দরজায় নক করে বলল,” ম্যাম আপনার কি কোনো সাহায্য লাগবে?”

আরওয়া মাথা নেড়ে বললো,”ধন্যবাদ। আমার হয়ে গেছে।”

“ওকে ম্যাম!”

আরওয়া রুম থেকে বেরিয়ে সাম্যকে কল দিয়ে বলল,” ভাইয়া সব এরেঞ্জ করেছেন তো? গিফট যেটা আনতে বলেছিলাম ওটা এনেছিলেন?”

“ইয়েস ম্যাম। চিন্তা করবেন না, আপনি তৈরী হয়ে চলে আসুন সব আপনার কথামতোই হয়েছে।”

সাম্য জাওয়াদকে বলল, “স্যার ম্যাম আসছেন…”

জাওয়াদ পেছন ফিরে তাকায়, আরওয়ার পড়নে জাওয়াদের ফেভারিট স্কাই ব্লু কালারের শাড়ি, চুলগুলো খুব সুন্দর করে সেট করা, কানে গলায় ম্যাচিং করা অর্নামেন্টস। জাওয়াদ জাগতিক সব ভুলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আরওয়ার দিকে।

“কেমন লাগছে আমাকে?”

“ভালো”

“শুধুই ভালো?”

“নাহ, অনেক ভালো!”

আরওয়া মুচকি হেসে বলল,”হ্যাপি এনিভার্সেরি ডিয়ার জামাই!”

“১বছর হয়ে গেল নাকি? আহ তোমাকে সহ্য করার ৩৬৫ দিন!!”

“৩৬৬ দিন মনে নেই লিপ ইয়ার ছিল..”

“ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ!”

সাম্য ফুলের তোড়া এগিয়ে বলল, “আপনাদের দুজনকে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা।”

“থ্যাংক ইউ ভাইয়া।”

“ইনজয় ইউর লাঞ্চ”

আরওয়া হাসিমুখে জাওয়াদের দিকে তাকালো, জাওয়াদ আর ও একসঙ্গে কেক কেটে একে অপরকে খাইয়ে দিলো‌। সময়টা তাদের স্মৃতির বাক্সে সুন্দর মূহূর্ত হিসেবে জমা পড়েছে বলা বাহুল্য।

পাপিয়া ফলমূল নিয়ে রিজভীদের বাসায় উপস্থিত হয়েছে। তাকে দেখে রিজভীর মা সানজিদা আহমেদ আপ্লুত গলায় বললেন,” আরেহ পাপিয়া যে। কেমন আছ মা? ”

“আস্সালামু আলাইকুম আন্টি। ভালো আছি, আপনি ভালো তো?”

“ওয়ালাইকুমুস্সালাম। আলহামদুলিল্লাহ! তোমাদের তো দেখাই যায় না, কতদিন পর এলে বলো তো?”

“আসলে আন্টি ব্যস্ত থাকি তো, আসাই হয় না। গতকাল রিজভী বলল আপনি অসুস্থ তাই দেখতে চলে এলাম।”

“ভালো করেছ মা,আমি অনেক খুশি হয়েছি। দাঁড়িয়ে কেন বসো না।”

“আপনার শরীর এখন কেমন? ডাক্তার কী বলল?”

“ডাক্তাররা কত কথাই বলে। ওদের কথায় চলতে গেলে মরার আগেঈ মরে যেতে হবে।”

“এটি কি বলেন‌ আন্টি। উনারা তো ভালোর জন্যই বলে।”

“ভালো‌ না ছাই। চিনি খাওয়া যাবেনা, তেল মশলা খাওয়া যাবেনা, এই খাওয়া যাবে না ঐ খাওয়া যাবেনা। সব যদি নিষেধ করে তো খাবো টা কী?আমাদের বাপ দাদারা শেষ বয়স অবদি ইচ্ছেমতোন খেয়েদেয়ে গেছেন। তাদের এতো রোগবালাই ছিল না। যখন যা ইচ্ছে করেছে পেট ভরে খেয়েছে। কোনো আফসোস রেখে যায়নি। আর আমরা এতো বেছে বেছে জীবনযাপন করেও ৫০ পেরোতে পারিনা। শরীরটা রোগের আস্তানা হয়ে যায়।”

“তখনের সাথে এখনের তুলনা দিলে চলে আন্টি? উনারা সবকিছু ফ্রেশ পেয়েছিলেন, পরিবেশ ও এতো দূষণ ছিল না। এখন তো সবকিছুতেই ভেজাল। পানি যে খাচ্ছেন ওটাও ১০০% নিরাপদ কি না সন্দেহ থেকেই যায়”

“ঠিক বলেছ। আমি ভাবি আগামী প্রজন্মের না জানি আরো কত রোগবালাই হবে! দেখো অবস্থা তোমাকে খালি মুখে বসিয়ে রেখেছি। রোকসানা এই রোকসানা আমার মেয়ের জন্য নাস্তাপানির ব্যবস্থা কর।”

“আন্টি ব্যস্ত হবেন না। আমি সময় নিয়ে এসেছি। আজ সারাদিন আপনার সঙ্গেই থাকবো।”

সানজিদা আহমেদ খুশি হয়ে বললেন,”তাহলে তো অনেক ভালো। অনেকদিন পর কাউকে পেলাম সুখ দুখের গল্প করতে।”

কোহিনূর বেগম খাটের একপাশে বসে কেঁদেই যাচ্ছেন। এতোদিন পর সাবা কনসিভ করেছিল, তাও সব শেষ হয়ে গেল। ওদিকে কুহুর বিয়ে ঠিকঠাক হবার কথা হয়েও ঝুলে আছে। তার ছেলেমেয়ের সাথেই কেন সব অঘটন ঘটে? আল্লাহ তাদের কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন তিনিই ভালো জানেন!

রোকেয়া জা-কে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু কিছুতেই তিনি শান্ত হচ্ছেন না। কান্নার বেগ যেন আরো বেড়েই যাচ্ছে। রোকেয়া বললেন, “ভাবি আপনি এতো ভেঙে পড়লে চলে? ছেলেমেয়ে দুটো আরো ভেঙে পড়বে, ওদের দিকে চেয়ে হলেও শক্ত হোন।”

“আর কত শক্ত থাকবো বল? আমার ছেলেটার ওয়ারিস কি আসবেনা? তোর ভাসুর তো এবার কোনোরকম গেছে, পরের বার এসেও যদি দেখে বৌমার কোল খালি কী ভাবছিস চুপ করে বসে থাকবে? কতদিন তাকে দমিয়ে রাখবে? কুহুর সাথের সবাই বাচ্চা মা হয়ে গেছে। আর ওর এখনো বিয়েই হলোনা। আত্মীয়স্বজনরা পেছনে কত কথা বলে কানে আসেনা বুঝি! আমার ছেলেমেয়ে দুটোই সবার সমালোচনার মূল বিষয়। আমি মা হয়ে কত সহ্য করবো বল?”

“আল্লাহর উপর ভরসা রাখো ভাবি। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর মানুষের কাজ ই হচ্ছে অন্যের সংসার নিয়ে চর্চা করা। ওসব কানে তুলতে আছে? তুমি অতো ভেবো না তো।”

“কুহুর জন্য তোর পাপিয়ার ও বিয়ে হচ্ছেনা।বয়স তো থেমে থাকছে না। তুই এক কাজ করিস বোন পাপিয়ার জন্য ছেলে দেখা শুরু কর। আমর বদ মেয়ের আশায় আশায় ওকেও অন্যের সমালোচনার পাত্রী বানাইস না। কি সুন্দর সব ঠিকঠাক করা ছিল, ওরা এসে ওকে আংটি পড়িয়ে যাবে। জা*নো*য়ার টা কি করছে আল্লাহই ভালো জানে, সব শেষ। ওরে আমার নিজের মেয়ে বলতেও অসহ্য লাগে।”

“ছোট মানুষ বুঝতে পারেনাই। এতো রেগে থাকিও না।”

“ছোট না ছাই। ওর বয়সের মেয়েরা পুরো সংসার সামলিয়ে ৫জনের সাথে ভাত খায়। আর ও! ওর কথা ভাবতে গেলেও আমার প্রেশার বেড়ে যায়। এই মেয়েকে কোনদিন আমি কি করে বসি…”

কুহু পার্কের বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে আছে। ইশরাক ওর দিকে চেয়ে নিরবতা ভাঙলো। স্বাভাবিক গলায় বলল,”মূর্তির মতো বসে আছ কেন? কী বলতে ডেকেছ বলো?”

কুহু সাথে সাথে জবাব দিলো না, আরো কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো, “দেখো আমি অনেক ভেবে দেখেছি, আমার জন্য অনেক সমস্যা হয়ে গেছে। আমি বিয়েটা ভাঙার জন্য সেদিন ঐরকম আচারণ করেছিলাম এটা আন্টি কিছুতেই মানতে চাইছেনা। আমার মনে হয় বিয়েতে মত না দেওয়ার পেছনে এটাই শুধু কারণ নয়। আমি মানছি আমার ভুল‌ ছিল, তবে তুমিও একটু ভেবে বলো এই ভুল কি এতোটাই বড় ছিল যে উনি একদমই মত দিতে চাইছেন না? এখানে অন্য কারণ ও আছে।”

“তুমি বলতে চাইছো আমার মায়ের তোমার সাথে শত্রুতা আছে? উনি এই বিয়ে না দিতেই বাহানা করছেন?”

“তুমি হাইপার হয়োনা প্লিজ। লজিক্যালি ভাবো। আমি সেদিন অতোটাও ডিপ কিছু করিনি যা দেখে কেউ ৩৬০° এঙ্গেলে উল্টে যাবে। যে কেউ যদি ভালোভাবে ভেবে দেখে সহজেই বুঝতে পারবে আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে এমন করেছি। মানুষ যত খারাপ হোক গেস্ট আসলে খারাপ আচারণ করে না। হোক সেটা সামনে বা পেছনে। সেখানে আমি বলতে গেলে ড্রইং রুমের পেছনেই তেমন করেছিলাম। এইটুকু অবজার্ভ করলেও তো বোঝার কথা সবটা প্রি-প্ল্যানড ছিল!”

ইশরাক কুহুর যুক্তি ফেলতে পারলো না। সতিই কী এখানে অন্য কোনো রিজন আছে নাকি ওর ওভারথিংক?

চলবে..

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪১

#আরশিয়া_জান্নাত

৪১

সমুদ্র মহান আল্লাহর একটা রহস্যময় সৃষ্টি। এই বিশাল জলরাশিতে কত বৈচিত্রময় সৌন্দর্যই না লুকিয়ে আছে। মাথার উপরে নীল আকাশ, সাগরের ঢেউ, অদূরেই উড়তে থাকা গাংচিলের ঝাঁক। সব মিলিয়ে সেন্টমার্টিন যাওয়ার পথটা অপার্থিব সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা দেয়। আরওয়া জাহাজের রেলিং ধরে প্রকৃতির অপরূপ মহিমা উপভোগ করছে। বাতাসে তার শাড়ির আঁচল উড়ছে, চুলগুলো এলোমেলো হবার আগেই সে ক্লিপ বেঁধে ফেলেছিল। নয়তো এই উথাল পাতাল বাতাসে মাথাটা কাকের বাসা হতে সময় লাগতো না! জাওয়াদ সাম্যর সাথে কথা বলে আরওয়ার পাশে এসে দাঁড়ায়। সূর্য প্রায় পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম আভা যখন পানিতে ছড়িয়ে পড়ে মনে হয় এটা আমাদের চিরচেনা জগত নয়, এ এক অন্য জগত। দূর দূরান্ত অবধি কেবল পানি আর পানি।

“কেমন লাগছে?”

“অসম্ভব সুন্দর! আমি আগে কখনো সেন্টমার্টিন যাই নি। তাই খুব এক্সাইটেড লাগছে!”

“আশা করি ওখানে গেলে আরো বেশি ভালো লাগবে। রাতে সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্য অনেকগুণ বেড়ে যায়!”

“ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং আমার তো এই জাহাজ থেকে নামতেই ইচ্ছে করছে না। আমি ভেবেছিলাম পানিতে অনেক ভয় লাগবে,,,”

“আমার প্ল্যান ছিল এখানে সময় কাটানোর কিন্তু এখানকার বর্তমান অবস্থা শুনে রিস্ক নিতে চাইছি না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার আসবো কেমন?”

“আচ্ছা!”

“আরওয়া শোনো?”

“হুম?”

“পৃথিবীটা খুব সুন্দর তাই না?”

“হ্যাঁ। অনেক অনেক সুন্দর!”

“জানো পুরনো একটা বিশ্বাস আছে, সাগরের মাঝে নাকি মিথ্যে বলতে নেই।”

“বললে কী হয়?”

“বললে ঐ মিথ্যার জন্য অন্যরাও শাস্তি পায়, ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে। এরকম কিছু আর কি!”

“ওহ! এখন বোধহয় তেমন হয় না। মানুষ তো এখন অনেক মিথ্যেবাদী হয়ে গেছে,,,”

“হুম হয়তো। দাদী বলেন শেষ জামানায় আল্লাহ সুতা ছেড়ে দিয়েছেন। মানুষ কত সীমালঙ্ঘন করতে পারে তা দেখার জন্য। তাই তো পাপ হারে আযাব আসছেনা। যাই হোক কথাটা শুরু করেছিলাম যেজন্য সেটাই বলা হলো‌না।”

আরওয়া ওর দিকে তাকিয়ে বললো,” বলুন কি বলবেন?”

জাওয়াদ ওর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।চোখেমুখে অন্যরকম উজ্জ্বলতা দৃশ্যমান। আরওয়া ওর হাবভাব দেখে মনে মনে ভাবলো আজ বুঝি জনাব মনের কথা মুখে প্রকাশ করবে!
জাওয়াদ ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,”আরওয়া তুমি ভীষণ মায়াবী মেয়ে। সবসময় এমন প্রাণোচ্ছল আর হাসিখুশি থেকো।”

“হাহ! আপনি আমার ধারণার বাইরের মানুষ।আমি চাইলেও আপনাকে নিয়ে সঠিক গেস করতে পারবোনা।”

“এই কথা কেন বললে?”

“এমনিই বলেছি। আচ্ছা আমি কি আপনাকে বলেছি আপনি আমার কয় নাম্বার ভালোবাসা?”

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে বললো, “এখানেও নাম্বারিং আছে?”

“অবশ্যই। জীবন ছোট হলেও ঘটনাবহুল। এই ঘটনাবহুল জীবনে কত কী ঘটে !!”

“আচ্ছা! তা আমার পূর্বেও আরো অনেকে ছিল না কি?”

“সবমিলিয়ে দেখলাম আপনি অনেক দেরীতে এসেছেন।”

জাওয়াদের চেহারার রং বদলে গেল যেন। সে হালকা হেসে বলল, ” ঐসব রাখো। শুনতে চাইছি না আপাতত।”

আরওয়া ওর কাছে ঘেষে দাঁড়ালো। বাহু আঁকড়ে বললো, “আপনি এতো কিউট কেন বলুন তো? আমার তো ইচ্ছে করে আপনাকে কোথাও লুকিয়ে রাখি!”

“কিউট বলে লাভ কী? তোমার মনে তো আরো অনেকে আছে। কোন একটা স্যারও তো ছিল না?!”

আরওয়া জিভ কেটে মাথা নেড়ে বলল, “উহু উহু ভুল বুঝছেন। ঐ স্যার আমাকে লাইক করতো আমি না। আমি তো আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম বিয়ের পর বরের সাথে প্রেম করবো। সেই হবে আমার ফার্স্ট লাভ। অন্য কাউকে চান্স দেওয়ার ফুরসত কই! বিশ্বাস না হলে রুমাইসা কিংবা দাদীজানকে জিজ্ঞাসা করবেন। ওরা সবাই জানে আমি কত জামাইপাগল ছিলাম।”

জাওয়াদ ওর কথা শুনে হাসতে লাগলো। “বিয়ের আগেই কেউ জামাই পাগল হয়?”

“আলবাৎ হয়। ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গীকে কেন্দ্র করে কল্পনা করা কঠিন‌ নাকি?”

“তাই না!”

“হুম।”

আরওয়া গোলাপ ফুলের পাপড়ি ছিড়ে হার্টশেইপ বানালো, তার মাঝে আচড় কেটে লিখলো A+J। জাওয়াদ ওর বাচ্চামো দেখে মুচকি হাসলো। আরওয়া ওকে ডেকে বললো, “এ বছর ডাবল সেলিব্রেশন হচ্ছে। ব্যাপারটা মজাদার!”

জাওয়াদ ওকে টেনে তুলে বলল, ” বাচ্চাদের মতো বালি নিয়ে খেলা শুরু করে দিলে! দিনে কী করবা?””

আরওয়া হাত ঝেড়ে বলল,” দিনেই দেখবেন।”

সে দেখবো সমস্যা নেই। এখন চলো।”

রেড কার্পেট এর উপর জাওয়াদ ও আরওয়া একসঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। চারদিকে ফুল ও লাইট দিয়ে খুব সুন্দর ডেকোরেশন করা। জাওয়াদ চেয়ার টেনে আরওয়াকে বসিয়ে নিজে অপর চেয়ারে বসলো। একজন‌ এসে জাওয়াদকে ফুল ও গিফট দিয়ে যেতেই জাওয়াদ সেসব আরওয়াকে দিয়ে বললো, “তোমার সাথে শুরু হওয়া এই পথচলা দীর্ঘ হোক। হ্যাপি এনিভার্সেরি ডিয়ার!”

“থ্যাঙ্ক ইউ। আপনার উইশ পূরণ হোক।”

জাওয়াদ পকেট থেকে রিং বের করে বলল,”তোমার আফসোস ছিল আমাদের বিয়ের সময় আমি কেন তোমায় রিং পড়াই নি। আজ সেই আফসোস দূর করার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করছি। উইল ইউ গিভ মি ইউর হ্যান্ড?”

আরওয়া আনন্দচিত্তে হাত বাড়িয়ে দিলো। জাওয়াদ ওর হাতের অনামিকায় রিং পড়িয়ে চুমু খেলো।

“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এতো সুন্দর মুহূর্ত উপহার দেওয়ার জন্য।”

জাওয়াদ ওর প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে বলল, “ইটস মাই প্লেজার।”

খাওয়া শেষে তারা বীচে বসে সাগরের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলো। জাওয়াদের বুকে মাথা রেখে সেই মুহূর্তে আরওয়ার মনে হলো সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে….

জোবায়ের সাহেব ড্রইং রুমে বসে আছেন। তার আদেশে পরিবারের অন্য সদস্যরাও সমাবেত হয়েছেন সেখানে। কুহু জানে এই জরুরী বৈঠক তাকে কেন্দ্র করেই বসেছে। তাই সে মনে মনে দোয়া দুরূদ পড়ে যাচ্ছে। জোবায়ের সাহেব থমথমে গলায় বললেন, ” কুহু একটা সত্যি কথা বলো। বিয়ে নিয়ে তোমার মতামত কী? তোমার কি পছন্দের কেউ আছে? কিংবা অন্য কোনো কারণ আছে যার কারণে তুমি বিয়ে করতে আগ্রহী নও? থাকলে দ্রুত কনফেস করো।”

কুহু নতমুখে বসে রইলো। জোবায়ের সাহেব ওর দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেললেন। পুনরায় বললেন,”তুমি যদি বিয়ে করতে আগ্রহী না হও বলে দাও। আমরা অযথা মানসম্মান খোয়াতে পাত্রপক্ষ আনতে ইচ্ছুক নই। তুমি তোমার মনমর্জিমতো আচারণ করে তাদের হটানোর চেয়ে শ্রেয় আমরা তোমার বদলে পাপিয়ার বিয়ের ব্যাপারে মনোযোগ দেই। দয়া করে এখন অন্তত মুখে কুলুপ এটে রেখো না। তুমি সেদিন কি করেছ আমি জানি না, তবে এইটুকু বুঝেছি যা করেছ মোটেই ভালো করো নি। খন্দকার বাড়ির মেয়েদের নাম খারাপ করে কী লাভ হলো বলবে? তুমি এ বাড়ির বড় মেয়ে হয়ে যদি এমন আচারণ করো অন্যদের অবস্থা কী হবে বুঝতে পারছো?”

কোহিনূর বেগম বিনয়ী গলায় বললেন,”আব্বা ওকে মাফ করে দিন। ঝোকের বশে ভুল করে ফেলেছে। আর করবে না…”

জোবায়ের সাহেব রুক্ষ গলায় বললেন,”বৌ মা ওর হয়ে তুমি জবাব দিবেনা। তোমাকেও প্রশ্ন করা হবে। ধৈর্য ধরে বসো। আমি সবাইকে অযথা ডাকিনি। এখানে আজ সবাইকেই প্রশ্ন করা হবে। শেষ অবদি অপেক্ষা করো। একে অন্যের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবেনা।”

আরওয়া জাওয়াদকে ফিসফিস করে বলল,”আপনাদের এখানে জরুরী বৈঠক এতো সিরিয়াসলি হয়! কেমন গা ছমছমে অবস্থা!”

জাওয়াদ বললো,”ভয় পেয়ো না শেষের সমাধানটা এতোটাও ভীতিকর হয় না।”

“কী ব্যাপার জবাব দিচ্ছো না কেন?”

কুহু বলল, “দাদা সাহেব আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি না বুঝেই ওরকম আচারণ করে ফেলেছি। সত্যি বলতে তখন এই প্রপোজাল টা আমার ভালো লাগেনি। কিন্তু পরে ভালো লেগেছে। আপনি কী অনুগ্রহ করে এখানেই কথা ফাইনাল করবেন?”

ওর কথা শুনে কোহিনূরের হিচকি উঠে গেল। রোকেয়া তাকে পানি এগিয়ে দিলেন। জোবায়ের সাহেব ওর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,”তোমার মা কী তোমাকে ছেলে সম্পর্কে কিছু বলে নি? ওদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড বা বায়োডাটা ও ছবি কি তুমি দেখো নি? তখন কী দেখে অপছন্দ হয়েছিল আর তারা আসার পর কি দেখে পছন্দ হয়ে গেল সব ডিটেইলসে বলো।”

কুহু নাহিয়ানের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। নাহিয়ান বোনের অবস্থা দেখে মিটমিটিয়ে হাসছে। কুহুর মনে হলো নাহিয়ান ওর ভাই না। ও নিশ্চয়ই কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান। তাই তো বোনের এমন বিপদের দিনে ভাই হয়ে শত্রুর মতো হাসছে।

সালমা বেগম বললেন, “থাক না এসব কথা। কাগজপত্রে দেখা আর বাস্তবে দেখায় পার্থক্য আছে না? শুরুতে হয়তো মনে ধরেনাই। পরে ভালো লাগছে। এখন নাতনি যখন সরাসরি বলছেই ওর এই বিয়েতে মত আছে আপনি এইদিকেই ফোকাস দেন না।”

“এটা তো হাতের মোয়া না? ছেলের মা এই বিয়েতে মত দেয়নাই। তার একটাই কথা এমন মেয়েকে তিনি ছেলের বৌ করবেন‌না। বুঝতেছ তুমি ঘটনা কত গভীরে ঘটেছে। এ বাড়িতে আসার আগ অবদি যারা বিয়ের ডেট ফাইনাল করার কথা বলছিল এখানে পা রাখতেই সব চেইঞ্জ। এখন কোন মুখে ও বলতেছে এই বিয়েতে ও রাজি!”

নাহিয়ান বললো,” দাদা সাহেব হাইপার হবেন না। দেখুন ইশরাকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, ও কুহুকে পছন্দ করেছে এবং এই বিয়েতে আগ্রহী। এখন কুহুও বলছে ওর অমত নেই। আমার মনে হয় এখানে যে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে তা মিটমাট করলেই উভয়পক্ষের ভালো হয়। একটা ছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিয়ে ভেঙে দেওয়া ঠিক হবে না। প্রয়োজনে আমি আন্টির সঙ্গে কথা বলবো। আশা করি উনি আমাদের নিরাশ করবেন‌না।”

“বড় বৌমা তুমি কী বলো?”

“আব্বা ভুল যখন আমরা করেছি খেসারত তো আমাদেরই দিতে হবে। তবে আপনার মাথা নত হয় এমন কোনো কাজ করতে আমি ইচ্ছুক নই। আপনি যা ভালো বুঝবেন তাই করা হোক।”

“সেটা দেখা যাবে। আপাতত কুহুর শাস্তির কথা বলি। ও যে অন্যায় করেছে ওর উপযুক্ত শাস্তি পাওয়া আবশ্যক। আশা করি এ নিয়ে কারো দ্বিরুক্তি থাকবে না।”

কুহু মাথা নেড়ে বললো,”আপনি যে শাস্তি দিবেন আমি মেনে নিবো।

“বেশ! তুমি আগামী ৭দিন সংসারের যাবতীয় সব কাজ করবে। অর্থাৎ তোমার মা চাচীরা যা করে তুমি সেসব করবা। যদি এই সাতদিনের মধ্যে একদিনও হেরফের হয় তবে পুনরায় ১ম দিন থেকে কাউন্ট করা হবে।”

কুহু মনে মনে বলল, “এ আর কঠিন কী? এটা তো খুব সোজা!” তাই সে সম্মতি জানিয়ে বলল, “জ্বি আচ্ছা।”

সাবা তার বাবার বাসায় গেছে আজ ৮দিন হতে চলল। ওর মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি। দিনরাত মেয়েটা এককোণে বসে আলট্রার ছবিটা বুকে জড়িয়ে
কান্নাকাটি করে। তার মা-বাবা মেয়ের এমন অবস্থা দেখে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায় না। তারা নাহিয়ানকে ফোন করে সবটা বলে। নাহিয়ান কি করবে বুঝে পায় না। মেয়েটা এমনিতেই এই দিকে দূর্বল। তার উপর এবার সন্তান হারানোর বেদনা জুড়ে বসেছে। ওকে সামলানো কতটা কঠিন বলা বাহুল্য। নাহিয়ান বসে বসে ভাবতে থাকে, সেদিনের এতো সুন্দর স্বপ্নটা সত্যি হয়েও কেন হলো না? হঠাৎ তার দৃষ্টি যায় টেবিলের উপর থাকা কাগজের দিকে। এতিমখানার ফান্ডে ডোনেশন করার বিজ্ঞাপনটা দেখে গভীর ভাবনায় পড়ে যায়। “আচ্ছা স্বপ্নটার ইঙ্গিত এইদিকে ছিল না তো?”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে