কাঁটাকম্পাস পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
387

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৩৪

#আরশিয়া_জান্নাত

পাপিয়া তাদের ক্যাম্পাসের ক্যাফেটেরিয়ায় একা বসে আছে। এখানে বসে তারা কত মজার সময় কাটিয়েছে, বন্ধুদের সাথে হাসি আড্ডায় অনেকটা সময় এখানে কেটে যেত। অথচ এখন এখানে আসাই হয় না। এমবিএ করার পর সবাই যার যার ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। হিয়া তো চাঁদপুরে শ্বশুরবাড়িতে সেই যে গেল আর আসেনি। রিজভীও ইউকে। অন্যদের সাথেও বিশেষ যোগাযোগ নেই। পাপিয়া সবাইকে মিস করলে এখানে চলে আসে। বসে পুরনো স্মৃতি আওড়ায়। এখানে চারদিকে তাদেরই অতীতের প্রতিচ্ছবি ঘুরে বেড়ায়। মুখগুলো ভিন্ন হলেও চিত্রগুলো ভিন্ন হয় না। সময় কত দ্রুত চলে যায়, এই তো সেদিন প্রথম এই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল। তারপর ৫ বছর যেন চোখের পলকেই শেষ হয়ে গেছে। জবে জয়েন করার ও এক বছর হতে চলল। সবকিছু কত দ্রুতই না হচ্ছে!

পাপিয়া কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে উঠার জন্য প্রস্তুত হতেই পাশের টেবিল থেকে ভেসে, “দোস্ত তুই না আমার পরাণের দোস্ত। বিশ্বাস কর আমি আগামী মাসে পকেটমানি পাওয়া মাত্রই ফেরত দিয়ে দিমু, মানসম্মান বাঁচা…”

“তুই সবসময় এমন করোস। এই পঙ্গপালদেরকে না খাওয়ালে তোর ইজ্জত যায় কেন? যত্তসব।”

পাপিয়ার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। “রিজভী! কই রে তুই? তোকে অনেক মিস করি….”

কুহু পার্কের বেঞ্চিতে বসে আইসক্রিম খাচ্ছে, ওর পাশেই ইশরাক বসা। আপাতত সে নিজের আইসক্রিম খাওয়া বাদ দিয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। কুহু ওর দিকে না তাকিয়েই বলল, “এমন হাবলুর মতো চেয়ে থেকো না। যে টেম্পারেচর তোমার আইসক্রিম গলে পড়বে।”

ইশরাক নড়েচড়ে বলল, “তুমি এমন গা হিম করা নিউজ বলে চুপচাপ আইসক্রিম খাচ্ছ কিভাবে!”

“লোহাকে লোহা কাটে জানো? তেমনি ঠাণ্ডা ঠাণ্ডাকে কাটে। সিম্পল!”

“লজিক আছে।”

“তোমরা বাসায় আসবে কবে?”

“আপু ঢাকায় আসলেই।”

“আপু ঢাকায় আসবে কবে?”

“বলেছে তো এই মাসে আসবে। দেখি।”

কুহু ওর দিকে ক্রুর দৃষ্টি দিয়ে বলল,”শোনো আমার যদি অন্য অন্য কোথাও বিয়ে ফিক্সড হয়ে যায়, ভেবো না আমি কেঁদেকেটে বালিশ ভেজাবো। সরাসরি তোমায় খু*ন করে ফেলব মাথায় রেখো।”

কুহুর কথা শুনে ইশরাক কাশতে কাশতে বললো, “এখানে আমার অপরাধ কি? আমাকে খু*ন করবে কেন?”

“তোমার অপরাধ নেই বলছো? আমি সেই কবে তোমাকে বলেছিলাম বাসায় আসো। কথাবার্তা আগাও, কিন্তু না তোমার আরো সময় চাই। তোমার সময় হতে হতে আমার চুল সব সাদা হয়ে যাবে, তবুও তোমার সময় হবেনা।”

“তোমার দাদাসাহেব সত্যিই ছেলে ঠিক করেছেন? তুমি মজা করছো না তো?”

“আমার চেহারা দেখে কি সেটা মনে হচ্ছে?”

ইশরাক মাথা নেড়ে বলল,” না। তবে তোমার চেহারা সবসময়ই সিরিয়াস থাকে। তাই বুঝতে পারছি না ঘটনা সত্যি কি না।”

কুহু উঠে বলল, “বিশ্বাস না করলে নাই। তুমি থাকো আমি যাচ্ছি।”

ইশরাক আইসক্রিম শেষ করে পটটা ডাস্টবিনে ফেলল। হাসিমুখে কুহুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “বায়োডাটা না পড়ে ফেলে রাখার অভ্যাস তোমার যাবে না,পাগলী একটা!”

নাহিয়ান হসপিটাল থেকে ফিরে রুমে আসতেই দেখে সাবা ওয়াশরুমের দেয়ালে চোখ বুজে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে দ্রুতপদে তার কাছে গিয়ে বলল,” এই সাবা কি হয়েছে তোমার চেহারা এমন লাগছে কেন?”

সাবা উত্তর দেওয়ার আগে আবার বমির বেগ আসে। নাহিয়ান তার মাথা ধরে রাখে পরম যত্নে। যা গরম পড়ছে নিশ্চয়ই পেটে খাবার সহ্য হচ্ছেনা, তাই সব উগড়ে দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর তাকে ফ্রেশ করিয়ে বিছানায় বসিয়ে ইন্টারকমে কল করে শরবত আনতে বলল।

“তোমার হঠাৎ এতো শরীর খারাপ হলো কিভাবে? সকালেও তো সুস্থ দেখে গেলাম, কি খেয়েছ এর মাঝে?”

“তেমন কিছু খাই নি। এমনি বমি বমি ভাব পাচ্ছিল।”

“আচ্ছা, তুমি রেস্ট করো। আমি ফ্রেশ হয়ে‌ নি”

“নাহিয়ান শোনো?”

“হুম?”

” আমার ২টা সাইকেল মিস গেছে।”

“তোমার তো রেগুলার হয় না।”

“হ্যাঁ কিন্তু আমার মন বলছে…”

নাহিয়ান ওর দীপ্তচোখে চেয়ে ম্লান হাসলো। এটা তার জন্য আজ নতুন ঘটনা নয়। প্রায়ই সাবা এরকম আশা বুনে, ৩য় মাসে আশাহত হয়।
সে ওর মাথায় পরম স্নেহে হাত রেখে বলল, “তোমার ধারণা সত্যি হোক!”

সাবা হেসে সম্মতি দিলো।

রুমাইসা ফুচকা গালে তুলে বলল, “রাজীব স্যার বিয়ে করছে শুনছোস?”

“কবে? শুনিনাই তো!”

“গত শুক্রবার হয়তো। ইনস্টাতে ছবি আপ করলো দেখলাম। বেচারা তোকে কত পছন্দ করতো। তুই তো পাত্তাই দিলি না।”

“ধুরর! স্যার-ছাত্রীর বিয়ে আমার কাছে লেইম লাগে। আমার মতে অবিবাহিত কম বয়সীদের ভার্সিটিতে টিচার হিসেবে অ্যাপয়েন্ট করা উচিত না। আমি সরকার হলে এই নিয়ম জারি করতাম।”

“এটা তোর ভুল ভাবনা। কোনো মেয়ের বাবা বেকার ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়?এমনিতেই দেশে বেকারত্বের হার যেই এর মধ্যে তোর নিয়ম জারি হলে শেষ।”

“এভাবে তো ভেবে দেখি নি! তবে দোস্ত যাই বলোস না কেন, পড়ানোর সময় স্যার যদি তোকে ছাত্রী কম প্রেমিকা বেশি ভাবে তাহলে স্টুডেন্ট হিসেবে ক্ষতি বৈ লাভ হবেনা। উনার ব্যক্তিত্ব উন্নত করা প্রয়োজন ছিল। শিক্ষকতা খুব শ্রদ্ধেয় পেশা বুঝলি!”

“সবাই এতো নীতিকথা মানলে প্রেম হবে কিভাবে? হেহে””

আরওয়া ওর হাসিতে যোগ দিলো। রুমাইসা হাসি থামিয়ে বলল, “তোর জামাইটা শান্তি দিলো না। চলে আসছে তোরে নিতে!”

আরওয়া পেছন ফিরে দেখে জাওয়াদের গাড়ি এসেছে। তবে জাওয়াদ এর বদলে সাম্য গাড়ি থেকে ওর কাছে এসে বলল, “ম্যাম স্যার একটা জরুরি কাজে আটকা পড়েছে বলে আমাকে পাঠালেন। আপনি কি এখন উঠবেন নাকি আরো কিছুক্ষণ সময় লাগবে?”

রুমাইসা ভ্রু কুঁচকে ফুচকা গালে তুলল। সাম্য এক নজর ওর দিকে চেয়ে বলল, “আমি নাহয় অপেক্ষা করছি আপনি খাওয়া শেষ করুন।”

“সাম্য ভাইয়া আপনিও জয়েন করুন? এখানের ফুচকা অনেক টেস্টি। নাহয় মিন্ট লেমন জুস খাবেন?”

“না না ম্যাম ঠিক আছে, থ্যাঙ্কস।”

রুমাইসা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,” তোর রোবট বরের পিএ ও রোবট বুঝলি। এসব খাবার তারা খেতে পারবে না।”

খোঁচাটা হজম করে সাম্য ভদ্রতাসূচক হাসি দিলো। আরওয়া বলল, “ভাইয়া, আপনি ওকে ভুল প্রমাণ করে দিন তো, বসুন প্লিজ। মামা আরেক প্লেট ফুচকা দিন তো।”

সাম্য সানগ্লাস না খুলেই বসে পড়লো সামনের চেয়ারে। আর মন দিয়ে দেখতে লাগলো পিঞ্চ কাটা রমণীকে।

রুমাইসা স্ট্রতে ঠোঁট চেপে চুমক দিয়ে বলল, “সানগ্লাস চোখে রেখে মেয়ে দেখা ওল্ড ট্রিক্স। নতুন কিছু ট্রায় করুন।”

সাম্য থতমত খেয়ে সানগ্লাস খুলে বলল,”আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।”

আরওয়া রুমাইসাকে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, “এমন করছিস কেন? ভাইয়া এমনিতেই আনইজি ফিল করছে।”

“ওকে ফাইন কিছু বলছি না আর। এই মুখে কুলুপ আটলাম।”

সাম্য চুপচাপ খাওয়ায় মন দিলো। এই মুহূর্তে কিছু বলা মানেই ব্ল্যান্ডার হয়ে যাবে। তার চেয়ে মানে মানে কেটে পড়া ভালো। তবে এ কথা বলতেই হয় মেয়েটার চেহারাটা ভীষণ মায়াবী! তাকিয়ে থাকতেও আরাম লাগে টাইপ। ধুরর কি সব ভাবছে সে। ছি ছি ছি…

অফিস থেকে ফিরে জাওয়াদ বলল, “আরওয়া ৫মিনিট সময় দিচ্ছি আর্লি রেডি হও।”

আরওয়া পড়ার টেবিল থেকে উঠে বলল,” কি হয়েছে এতো তাড়াহুড়া কেন? কোথায় যাবেন?”

“এতো কথা বলার সময় নেই তো। হারি আপ!”

আরওয়া কাভার্ড থেকে ড্রেস বের করে চটজলদি চেইঞ্জ করে তৈরি হয়ে নিলো। জাওয়াদ ওকে দেখে বললো, “শাড়ি পড়লে ভালো হতো, থাক এটাতেও খারাপ লাগছে না। চলো।”

আরওয়া গাড়িতে বসে বলল, “এখন তো বলুন কোথায় যাচ্ছি?”

“আমার এক ফ্রেন্ড এর বিয়ে আজকে। আমি একদম ভুলে গেছি। যদি এটেন্ড না করি আমাকে ও মেরেই ফেলবে। তোমাকে নিয়ে গেলে বলতে পারবো বউ মেকাপ করতে টাইম লেগেছে তাই লেট হলো!”

আরওয়া চোখ সরু করে বললো,”আপনি এতো শেয়ানা! বউ এর নাম দিয়ে নিজের দোষ লুকাবেন?”

“ট্রাস্ট মি ও যদি ডেঞ্জারাস না হতো এই পন্থা অবলম্বন করতাম না। ও নাহয় সত্যি সত্যিই বিয়ের আসর থেকে উঠে এসে আমাকে মারবে।”

“হেহেহে আপনার এমন বন্ধুও আছে? অবিশ্বাস্য!!”

“স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড তো হিসাব নিকাশ করে হয় না। ওরা সবসময় অবিশ্বাস্য লেভেলের হয়।”

“রাইট! কিন্তু আমি যে বেশি সিম্পল হয়ে এসেছি। বিয়েতে কেউ এমন যায়?”

“সবাই তো হেভি মেকাপে যাবে, সেখানে তুমি সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস হবা! মিস্টার ফারাজ খন্দকার জাওয়াদের ওয়াইফ বলে কথা, যেভাবেই যাও না কেন ট্রেন্ড হয়ে যাবে!”

“ইশ কি কনফিডেন্ট!!”

“ওভারএক্টিং হয়ে গেল?”

আরওয়া হেসে বলল, “মাঝেমধ্যে একটু আধটু বাড়িয়ে বলাই যায়। ব্যাপার না।”

স্টেজে যাওয়ার পর অয়ন জাওয়াদকে জড়িয়ে ধরে বললো, “এখানের রেড কার্পেট তোলার সময় আসতি, এতো তাড়াতাড়ি আসলি কিভাবে?”

“ঢাকায় যে জ্যাম জানিস তো।”

“বাহানা দিস না আমি সিওর তুই ভুলে গেছিলি, স্কুলে আসার আগের মতো ৫মিনিটে রেডি হয়ে এসেছিস তাই না!”

“আরেহ না কি যে বলোস? এখন কি আগের দিন আছে।”

“যাক এসেছিস এতেই আমি অনেক খুশি।”

ছবি তোলার পর ওরা ফুড সেকশনে গেল। জাওয়াদ চেয়ারে হেলান দিয়ে শ্বাস ফেলে বলল, “সেই বাঁচা বেঁচেছি! ভাগ্যিস সাম্য মনে করিয়ে দিয়েছে।‌”

“হুম সেটাই। এই খুশিতে সাম্য ভাইয়াকে গিফট দিবেন।”

“এখানে দোষ ও কিন্তু ওর। ও আমার পিএ হয়ে এতো কেয়ারলেস হলো কেন? আমার সব ইভেন্ট ওর মুখস্থ থাকার কথা! আজকাল কি হয়েছে কে জানে, কেমন এবসেন্ট মাইন্ডে থাকে। আগে তো এমন ছিল না।”

“হয়তো গফের সাথে ঝগড়া চলছে তাই এমন করছে।”

“সাম্যর গফ আছে নাকি!”

“নেই?”

“আই ডোন্ট নো!”

“আহারে বেচারা! এমন এক বসের আন্ডারে জব করে লাভ এফেয়ারে জড়ানোর সময় টুকু পায় না। সো স্যাড!”

জাওয়াদ চোখ ছোটছোট করে বলল, “আমি কি ওকে ধরে রেখেছি? আমার ফল্ট কোথায়?”

“আমি কি বলেছি আপনি দোষী? আপনি তো‌ নির্দোষ। কথাটা বলার সময় আমার বিবেকে কাজ করে নাই আবেগে কাজ করেছে…”

বলেই আরওয়া হাসতে লাগলো। জাওয়াদ ওর হাসি দেখে বলল, “স্ট্রেইঞ্জ! এখানে হাসির কি আছে?”

“হাসতে কারণ লাগে নাকি? আরওয়া এমনিতেই হেহে হিহি করে।”

জাওয়াদ মনে মনে বলল, “সো কিউট!”

চলবে…

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৩৫

#আরশিয়া_জান্নাত

“আমি বুঝি না তোমরা সবসময় এমন কেন করো? ছেলেপক্ষ আসতে চাইলেই সবাই লাফিয়ে উঠো, যেন পারলে প্রথম সাক্ষাতেই কাবিন ফাইনাল!”

কোহিনূর বেগম বোতাম এর শেষ ফোঁড় দিয়ে বললেন, “তোর কথামতো চলতে গেলে তুই তো বুড়ি হবিই সাথে ছোটবোনটাকেও বুড়ি বানাবি। পাপিয়ার জন্য আসা প্রপোজাল গুলোও দেখা যাচ্ছেনা তোর জন্য। তোর মেজ চাচারা নেহাতই ভালো মানুষ বলে এখনো চুপচাপ আছেন। অন্য কেউ হলে…”

“আম্মু বিয়ের সিকোয়েন্স বলে কিছু নাই। যার যখন ইচ্ছে সে তখন বিয়ে করে ফেলবে। বড় ছোট এসব মানা ঠিক না। ওর জন্য ভালো প্রপোজাল আসলে ওকে দিয়ে দাও। আমার অপেক্ষা করার কি আছে!”

“আমরা জয়েন্ট ফ‌্যামিলিতে থাকি, চাচাতো ভাইবোনের মধ্যে আপন ভাইবোনের মতোই সিরিয়াল হয়। তোরা পড়াশোনা করতে চেয়েছিস পড়িয়েছি। তুই গ্র্যাজুয়েট হলি, এমএসসি করলি তারপরো তোকে কিছু বলেছি? প্রেশার দিয়েছি? আর কত স্পেস দিবো তুই ই বল?”

“তুমি জানো কোরিয়ান মেয়েরা….”

“খবরদার কুহু ঐ ভিনদেশী দের তুলনা টানবি না। ওদের কালচার আমাদের চেয়ে ভিন্ন।‌এটা তোকে মানতেই হবে।”

কুহু বিরক্তস্বরে বললো,” আমি আগেই বলেছিলাম আমাকে বাইরের দেশে এপ্লাই করতে দাও। তোমাদের এইসব আমার ভাল্লাগেনা। ধুরর।”

কুহু চলে যেতেই কোহিনূর ভেংচি কেটে বললো,” দেখবো তো এবার কিভাবে বিয়ে না করে থাকিস। বজ্জত মাইয়া, সারাক্ষণ তোর বই না হয় সিরিজ দেখা ছুটাচ্ছি!”

সাবার অবস্থা এবার সত্যিই বিশেষ সুবিধার না। যাই খাচ্ছে বমি করে উগড়ে দিচ্ছে। তার মনে হয় খাবার সব বিস্বাদ, একটুও টেস্ট নেই। সাবা ক্ষুধা নিবারণের জন্য নাকমুখ কুঁচকে কোনোমতে দু’টো মুখে দিলেই দ্বিগুণ হারে বেরিয়ে গিয়ে তাকে কাহিল বানায়। কোহিনূর রীতিমতো ওর জন্য টেনশনে পড়ে গেছে। ওদিকে নাহিয়ান ক্যাম্পিং এর জন্য ঢাকার বাইরে গেছে। ওর অবস্থা বেগতিক দেখে নাহিয়ানের হসপিটালেই নিয়ে গেলেন তিনি। বেশকিছু টেস্ট করিয়ে সাবাকে নিয়ে বাসায় ফিরলেন। সালমা তাকে দেখে বললেন,”বড় বৌ, কি বললো ডাক্তার?”

“তারিন ছিল না আম্মা। ও ফোনে কিছু টেস্ট করাতে বলছে ঐগুলো করিয়ে আসছি। রিপোর্ট আসলে বলা যাবে। চিন্তা করবেন না।”

“মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। এত দূর্বল হয়ে গেছে। বললেই কি আর চিন্তা না করে থাকা যায়? আচ্ছা তুমি যাও রেস্ট নাও।”

আরওয়া ছাদে বসে হাওয়া খাচ্ছে। তার সঙ্গে পাপিয়াও আছে‌। পাপিয়া বললো,”নতুন ভাবি আমার কি মনে হয় জানো? এবার আমরা সত্যিই ফুপী হবো।”

“কি বলো আপু? ভাবির অবস্থা দেখে সবাই যেখানে টেনশনে আছে তুমি ভাবছো ফুপী হবা!”

“ভাবির শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে মানছি, তবে লক্ষণ কিন্তু এইদিকেই পয়েন্ট করছে। যদি এটা সত্যি হয় ওদের আর কোনো অপূর্ণতা থাকবেনা।”

“আল্লাহ তোমার ধারণা সত্যি প্রমাণ করুক।”

পাপিয়ার ফোনে জরুরি কল আসায় সে ওখান থেকে সরে নীচে চলে আসে। আরওয়া চোখ মেলে চায় দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের দিকে। দূরদূরান্তে বড় বড় দালানকোঠা ব্যতিত কিছুই চোখে পড়েনা। যান্ত্রিক এই শহরে সবাই ছুটছে তো ছুটছেই। কোথাও অবসর নেই, এক মুঠো ফুরসত নেই নিরবতা অবলম্বন করার। আরওয়াই বুঝি একমাত্র বেকার মানুষ। ফোনে জাওয়াদের নাম্বারটা ভেসে উঠতেই আরওয়ার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে, আনন্দের ঝলক ছড়িয়ে পড়ে বদনে। মোলায়েম কন্ঠে বলে উঠে,”আস্সালামু আলাইকুম।”

“ওয়ালাইকুমুস্সালাম। কোথায় আছেন ম্যাম? রুমে দেখছি না যে!”

“ছাদে আছি। দাঁড়ান আসছি..”

“নাহ আসতে হবেনা বসুন,আমিই আসছি।”

“আচ্ছা!”

আরওয়া টেবিলে থাকা গ্লাসে আইস কিউব দিয়ে তাতে তরমুজের জুস ঢালল। জাওয়াদ ছাদে এসে চেয়ারে বসল। আরওয়া তার দিকে গ্লাস এগিয়ে বলল, “আপনি দিনদিন এমন গ্লো করছেন কেন? আপনার রূপের রহস্য কী?”

জাওয়াদ হেসে বলল, “তুমি কী উল্টোটা শুনতে চাইছো?”

“উল্টোটা শুনতে চাইবো কেন? আমার যেটা মনে হলো সেটাই বললাম। বউয়ের ভালোবাসা পেয়ে পেয়ে আপনি আরো সুন্দর হয়ে যাচ্ছেন। এটা কি ভুল বললাম? বিশ্বাস না হলে আয়নায় দেখুন।”

“হুম এটা ঠিক! আমার মিসেস আমাকে প্রচুর ভালোবাসে, আজকাল অনেকেই এটা কানাঘুষা করে শুনি।”

“তাই না?”

“হুম। এই শোনো, কক্সবাজার যাবে? ওখান থেকে সেন্ট মার্টিন ও ঘুরে আসবো। কি বলো?”

“যেতে পারলে মন্দ হয় না। কিন্তু এখন কি যাওয়া ঠিক হবে?”

“কেন এখন কি হয়েছে আবার?”

“বাসায় কত ইভেন্ট আছে। আপুকে দেখতে আসবে, সাবা ভাবির শরীরও ভালো নেই। দাদাসাহেবের হাবভাব দেখে তো মনে হচ্ছে কুহু আপু্র বিয়ে প্রায় কনফার্ম। এখন এমন প্ল্যান করা কি ঠিক হবে?”

“এতোকিছু ভাবতে গেলে কখনোই বের হতে পারবানা। একটার পর একটা লেগেই থাকবে।”

“রেগে যাচ্ছেন কেন? আমাদের সবকিছু বুঝেশুনে প্ল্যান করা উচিত না?”

জাওয়াদ উঠে বলল, “এজ ইউর উইশ! বলে রাখছি যেসবকে তুমি বড় কিছু ভাবছো ওসব আমার কর্মক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলেনা। এমন নয় আমি চিটাগং না গিয়ে থাকবো। আমাকে কাজটাই আগে দেখতে হয়, এটাই আমার উপর ধার্য করা থাকে। আমি তোমাকে জাস্ট সেই সফরের সঙ্গী করতে চেয়েছি,তুমি যেতে না চাইলে ইটস ওকে!”

“আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। এখন আমি কক্সবাজার যাবো শুনলে অন্যরা কি ভাববে বলুন তো? আমি এ বাড়ির বউ, আমার কিছু দায়িত্ব আছেনা?”

জাওয়াদ নিজের চুলে হাত চালিয়ে বলল, “আমি জোর করছি না। তোমার যা ইচ্ছা করো।”

ফোন বের করে সাম্যকে কল করে বলল,”দুটো টিকিট ক্যানসেল করো। আমি একাই যাবো। জাস্ট টাইমে প্রেজেন্ট থাকবে।”

“স্যার কক্সবাজার রুম বুক করলাম যে ওটাও কি ক্যানসেল করে দিবো?”

“সেটাও বলে দিতে হবে? কাজে যাচ্ছি যখন কাজই করবো, কক্সবাজার আনন্দভ্রমণ করতে যাবে কেন? তোমার ইচ্ছে হলে তুমি যাবে আর সাগরের পানিতে তা ধিন ধিন করে নাচবে। যত্তসব!”

সাম্য মুখ কালো করে বলল,”স্যরি স্যার। আমার আরো বুঝদার হওয়া উচিত ছিল।”

জাওয়াদ ফোন রেখে ছাদ থেকে নেমে গেল। আরওয়া ওর দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে বলল,”পাগলে ক্ষেপছে রে। আজ তোর‌ নিস্তার নাই।”

নিজের ঘরের দিকে এগুতেই রোকেয়া দৌড়ে এসে বলল, “আরওয়া কি হয়েছে রে ফারাজ এতো রেগে আছে কেন?”

“তিনি কি করলেন আবার?”

“আমাকে এসে বলতেছে সিরিয়াল দেখে দেখে আমার মাথা একদম গেছে। আমি নাকি তোকে আদর্শ বউ বানানোর প্রতিযোগীতায় নাম লিখিয়েছি। তোকে সবার মন জয় করার জন্য প্রেশার দিচ্ছি। আরো কত কি বলে গেল আমাকে। আমি আগামাথা কিছুই বুঝলাম না। এই বাপবেটার সবকিছু আমার সিরিয়ালে এসেই কেন থামে? আজিব!”

“ওহো আম্মু, রিল্যাক্স! জানো তো উনি কেমন। মন খারাপ করো না তো।”

“মন খারাপ করি কি আর সাধে? ব্যাগপত্র গুছিয়ে কোথায় চলে যাচ্ছে কে জানে। তুই গিয়ে ওকে থামা তো মা। আমি আর পারি না এদের নিয়ে।”

আরওয়া কাচুমাচু গলায় বলল,”আম্মু আমি এখন রুমে গেলে আমাকে যদি কাঁচা খেয়ে ফেলে! যেমন হাইপার হয়ে গেছে আমার তো ভয় লাগতেছে।”

“ঘটনা কী খুলে বল তো?”

“উনি মেবি চিটাগং যাবেন কাজে। আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল কক্সবাজার যাবো কি না। আমি বললাম বাসায় তো অনেক ইভেন্ট আছে, এখন যাওয়া পসিবল না। ব্যস অমনি ক্ষেপেছে।”

রোকেয়া মাথা নেড়ে বলল, “পুরুষমানুষ এসব বুঝবেনা। শ্বশুড়বাড়িতে আমাদের কে যে কতদিক বিবেচনা করে পা ফেলতে হয় এটা বোঝার ক্ষমতা ওদের নেই। ছেলেটা এমন একরোখা যে কিছু বলাও যায় না। আচ্ছা তুই দাঁড়া আমি আম্মাকে বলে দেখি উনি কি বলেন। ”

আরওয়া হু বলে দোয়া ইউনুস পড়ে নিজের রুমে গেল। জাওয়াদ নিজের লাগেজ গুছিয়ে একপাশে দাঁড় করিয়ে ল্যাপটপ ব্যাগে রাখছে। কোথায় ভেবেছিল তাদের ম্যারেজ এনিভার্সেরিতে জাহাজে করে সেন্টমার্টিন যাবে, আরওয়ার সাথে দারুণ কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করবে, বারবিকিউ পার্টিসহ আরও কত কি করবে। সব পরিকল্পনা ধূলিসাৎ হয়ে গেল। মেয়েটার মাথাতেই যেন নেই দু’দিন পর তাদের বিয়ের ১বছর পূর্ণ হবে। অথচ ও যদি ভুলে যেত কত মেজাজ ই না দেখাতো। মেয়েমানুষের মন বোঝা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ।

“এই শুনছেন?”

“আমি কালা না, কি বলবে বলে ফেলো।”

“আপনি এমন গলায় কথা বললে আমার মন খারাপ হয়, পেট মোচড়ায়। দেখুন কেমন ঘুটঘুট শব্দ তুলছে!”

“এসব কথা ছাড়ো প্লিজ। আমি এখন এসব শুনতে ইচ্ছুক নই।”

আরওয়া ওর গা ঘেসে একপাশে দাঁড়িয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,”এতো রাগ করে না সোনা। আপনি আমার ১০টা না ৫টা না একটমাত্র স্বামী। আপনি এমন রাগ করলে মানায় হুম?”

জাওয়াদ ওর হাত ছাড়িয়ে বলল, “ন্যাকামো করো না আরওয়া। আমার হাতে সময় নেই। তুমি থাকো তোমার পারিবারিক কার্যকলাপ নিয়ে। আমি তো নিষেধ করছি না। এখন অযথা এসব নাটকের প্রয়োজনীয়তা দেখছি না।”

আরওয়া ওকে জড়িয়ে ধরে বুকে নাক ঘষে বলল, “ভালোবাসি তো।”

“তোহ আমি কি করবো?”

“ভালোবাসির প্রত্যুত্তরে ভালোবাসি বলতে হয়।”

“এসব ফাউ কথা।”

আরওয়া ওর বুকে চিবুক রেখে মাথা উঁচিয়ে বলল, “এই?”

“হুম।”

“শান্ত হবেন না?”

“আমাকে অশান্ত ভাবার মতো কিছু করেছি?”

আরওয়া জবাব দিলো না। চুপচাপ জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। জাওয়াদ ওকে আগলে নিলো না বলে অভিমানে চোখ ভরে আসলো। খানিকবাদে বুকের মাঝে ভেজা অনুভব করলেও জাওয়াদ কোনো শব্দ করলো না। যাওয়ার আগে শুধু বলল, ” স্বামী দিয়েই স্বামীর পরিবার আসে। তাদেরকে প্রায়োরটি লিস্টের শুরুতে রেখে স্বামীকে নীচে রাখলে শেষে দুটোই হারাবে,,”

এইটুকু যথেষ্ট ছিল তার মনের আকাশে গাঢ় আধার নামার…

নাহিয়ান ক্যাম্পের তাবুতে বসে কেটলী থেকে গরম চা ঢাললো। শরীর প্রায় ছেড়ে আসছে একটু রেস্ট না নিলে আর হচ্ছে না। পকেট হাতড়ে ফোন বের করে সাবাকে কল দিয়ে চায়ে চুমুক দিলো। ৪বার রিং পড়তেই অপরপাশের মানুষটা ফোন রিসিভ করলো। তার গলার স্বরে মহান আল্লাহ কি রহমত ঢেলে দিয়েছেন তিনিই ভালো জানেন, শুনলেই মনপ্রাণ জুড়িয়ে আসে।

“কেমন আছ এখন? শরীর ঠিক আছে?”

“আমার জন্য চিন্তা করো না, আমি ঠিক আছি। তোমার ক্যাম্পিং কেমন যাচ্ছে?”

“ভালোই তবে জান বেরিয়ে যাচ্ছে এখানে। এত গরম!”

“এসিতে থেকে থেকে অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। সাধারণ তাপমাত্রাও অনেক বেশি মনে হয়। তার উপর তুমি যেখানে আছ ওখানে গরম আরো বেশি। একটু কেয়ারফুল থেকো।”

“হুম। শোনো তারিন কল করেছিল, ও তোমাকে দেখতে পারেনি বলে সরি বলছিল। কাল তোমাকে হসপিটাল যেতে হবেনা। ও রিপোর্টগুলো নিয়ে বাসায় যাবে বলেছে। তুমি আপাতত পানিজাতীয় খাবার কন্টিনিউ করো কেমন?”

“আচ্ছা।”

“আর হ্যাঁ পেঁপে এভয়েড করবে। আমি রিস্ক নিতে চাইছি না…”

সাবা মুচকি হেসে বললো,”আমাকে না বলো অথচ তুমি নিজেও আশা রাখছো!”

“আমরা আশাতেই বাসা বাঁধি পাখি। ওটাই আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা। আচ্ছা রাখছি, পরে কথা হবে। নিজের খেয়াল রেখো কেমন?”

“তুমিও নিজের খেয়াল রেখো। আর গরম বেশি লাগলে একটু গা মুছে নিও। আরাম লাগবে।”

“আচ্ছা। বায়”

“বায়”

চলবে,,,

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৩৬

#আরশিয়া_জান্নাত

আরওয়া বেলকনীর এককোণে হাঁটুতে মাথা রেখে বসে আছে। জাওয়াদ নিষ্ঠুর পুরুষ এ তো তার জানা কথা। তবুও কেন তার বলা বাক্যে বুকটা ভেঙে যায়? অসহনীয় যন্ত্রণায় চোখের পানি বাঁধা মানেনা। আরওয়া উঠে ওয়াশরুমে যায় চোখেমুখে পানি ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে আসে। রোকেয়া শাশুড়ির সঙ্গে শলাপরামর্শ করে বলেন, “আরওয়া কালকে তো কুহুকে দেখতে আসবে, তাই ফারাজের ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারছি না। তোরা পরে একসময় নাহয় গিয়ে বেরিয়ে আসিস।”

“চিন্তার কিছু নেই আম্মু, উনি চলে গেছেন।”

রোকেয়া ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “মন খারাপ করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”

জাওয়াদের গাড়ি চলছে আপনগতিতে। সে শেষ মুহূর্তেও আশা করেছিল আরওয়া ওর সঙ্গে আসবে। কিন্তু ওর ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। জাওয়াদ নিজের বুকের মাঝখানটায় হাত দিয়ে দেখলো ভেজা অংশটা এখনো সম্পূর্ণ শুকায়নি। সে জানলা গলিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। আর ভাবতে লাগলো আরওয়া কেমন ফুঁপিয়ে কান্না করছিল। ভাবতেই বুকটা কেমন ভার হয়ে আসে। সে কেন যে মেয়েটাকে এতো কষ্ট দিয়ে ফেলে। আসবার সময় যা বলে এসেছে এতে নিশ্চয়ই ও আরো কয়েক দফা কান্নাকাটি করবে। ধুরর ভালো লাগেনা।
তানভীরের কলে তার ধ্যান ভাঙ্গে। সে রিসিভ করে ফোন কানে তুলতেই তানভীর বলে,”কি রে কেমন আছিস?”

“আলহামদুলিল্লাহ, তুই কেমন আছিস?”

“আছি ভালো। কোথায় আছিস?”

“চিটাগং যাচ্ছি, অন দ্য ওয়ে। কেন?”

“ওহ! ভেবেছিলাম আড্ডা দিবো তোর সাথে। তা আর হলো না।”

“পরে আসিস সময় করে।”

“হুম। আচ্ছা শোন আমাদের ভার্সিটিতে রিইউনিয়ন প্রোগ্রাম হবে। তুই যাবি? অনেকেই আসবে শুনলাম। কত বছর পর সবাই একত্রিত হবো, তুই না বলিস না!”

“ডেট ফিক্সড হয়েছে?”

“খুব সম্ভবত এই মাসেই হবে। ডেট ফিক্সড হলে তোকে জানাবো। অবশ্যই থাকবি।”

“ওকে।”

“আচ্ছা রাখি তাহলে ঢাকায় ফিরলে নক দিস”

“ওকে, বায়”

“বায়”

নাহিয়ান আজ সকালে ঢাকায় ফিরেছে। এসেই কোহিনূর বেগমকে বললো, “আম্মু চটজলদি কিছু খাইয়ে দাও আমি এখন ঘুমাবো, কখন উঠি ঠিক নেই। আমি ভীষণ টায়ার্ড!”

“তুই ফ্রেশ হয়ে নে আমি তোর ঘরেই খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে যত ঘুম ঘুমানোর ঘুমিয়ে নে, বিকালে পাত্রপক্ষ আসার সময় কিন্তু উপস্থিত চাই।”

“ঐটা তো থাকবোই। শাকচুন্নিকে বিদায় করার টেনশন আমারো আছে। ঐটা তোমায় ভাবতে হবেনা।”

কুহু আপেল কাটতে কাটতে বলল,”তোর ঐ সুখ এতো সহজে আসতে দিবো ভাবছিস? আমি তোর ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙে না খাওয়া অবদি নড়ছি না।”

“তো এখন কি করছিস?”

“বাপের টা খাচ্ছি, তোর না!”

“কথার কি ছিরি দেখো। আমি যেন এ সংসারে কোনো টাকাপয়সা দেই না। দেখলে আম্মু কেমন নাফরমানী কথা!”

“ওর কথা বাদ দে, ও কত কথাই বলে। তুই যা তো ঘরে যা।”

কুহু বললো,”আম্মু তুমি যতোই বলো তোমার ছেলে এখান থেকে নড়বেনা। ওর বউকে ছাড়ো দেখবে সুরসুর করে চলে গেছে।”

নাহিয়ান ওর মাথায় গাট্টি মেরে বললো, “এতক্ষণে ভালো কথা বললি। হ্যাঁ আম্মু আমার বউ কে দিয়ে দাও আমি চলে যাই।”

“ভাইয়া! ভালো কথা বললে কেউ এতো জোরে মারে। তুই এতো খারাপ!”

কোহিনূর বিরক্তস্বরে বলল,”বৌমা যাও তো ওর সাথে। নয়তো এখানে ওরা রণক্ষেত্র বানিয়ে ছাড়বে। ক’টা দিন শান্তিতেই ছিলাম।”

নাহিয়ান নায়ক জসীমের মতো ইমোশনাল লুক এনে বললো,”আম্মু এটা তুমি বলতে পারলে? আমাকে তুমি অশান্তির কারণ বললে। হে আল্লাহ! এই দিন ও দেখতে হলো আমার? এ পরিবারে আমায় কেউ ভালোবাসেনা…..”

সাবা ওকে টেনে বের করে বলল,”চলো তো তুমি, অযথা আর চিৎকার চেঁচামেচি করোনা।”

নাহিয়ান রুমে এসেই সাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,”আহ! কত্তদিন পর বৌটাকে বুকে পেলাম গো। শান্তি!”

সাবা ওর হাতে চুমু খেয়ে বললো,” অনেক কষ্ট হয়েছে ওখানে না? তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”

নাহিয়ান ওর গালে হাত রেখে বলল,”এ কয়দিনে এ কি হাল হলো তোমার? শরীর এতো খারাপ কেন?”

“চিন্তা করো না। এখন ঠিক আছি।”

“সাবা, আমার কাছে তোমার সুস্থতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তুমি সুস্থ থাকো, আমার পাশে থাকো ওতেই আমি শান্তি। অন্য কোনোকিছু আমি চাই না।”

“এরকম বলিও না। এরকম বললে যদি যে আসবে ভাবছি সে চলে যায়?”

নাহিয়ান ওর কথা শুনে বলল,” তোমার কীসব ভাবনা! যে আসার সে আসবেই আমার কথায় কি আসে যায়?”

“আমি তেমন ভাবিনা। আমাদের নিয়তের উপর অনেককিছু ডিপেন্ড করে। যাই হোক তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি বিছানা ঠিক করে দিচ্ছি, খেয়েই ঘুম দিও।”

নাহিয়ান মাথা নেড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

জোবায়ের সাহেব একটা আংটির বক্স বের করে বললেন,”দেখো তো পছন্দ হয় কি না?”

সালমা আংটিটা হাতে নিয়ে পরোখ করে বললেন,”সুন্দর তো অনেক! কার জন্য নিলেন?”

জোবায়ের সাহেবের চোখেমুখে আনন্দের ঝলক, দেখা গেল। তিনি প্রসন্নস্বরে বললেন,
“গড়াতে দিয়েছিলাম নাতজামাইয়ের জন্য। আজকে হয়তো পড়ানোর লোক পেয়ে যাবো।”

“আমি জানি আপনি ভালোটাই আনবেন। তবে আমার অনুরোধ ওদের পছন্দ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলবেন না। ওরা সবাই আপনাকে ভয় পায়, সম্মান করে। ওদের মতামত রাখার জায়গা দিবেন।”

জোবায়ের স্ত্রীর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। তার চেহারার ভাবভঙ্গি বদলে গেছে মুহূর্তেই। তিনি ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, “সব সময় তোমার এটা বলতে হয় সালমা? আমার নিয়ম কি তুমি জানো না? আমি বলেছি না মেয়েদের বেলা আমি জোর করি না। তবুও কেন তোমার প্রতিবার এই কথা বলা লাগে? তোমার কি মনে হয় এটা বললে নিজেকে খুব মহান দেখায়?”

সালমা নির্লিপ্ত গলায় বললেন,” আপনাকে মনে করিয়ে দেওয়া স্ত্রী হিসেবে আমার দায়িত্ব। আমি চাইনা আপনি অহংকারবশত কখনো ভুল করে বসেন। শয়তান কখন কাকে কিভাবে ভুল পথে নিয়ে যায় কেউ বলতে পারেনা। নিজেকে সবসময় সঠিক ভাবা ঠিক না, আমাদের জ্ঞানের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এটা ভুলে গেলে চলবে না।”

জোবায়ের সাহেব শান্তশিষ্ট স্বভাবের স্ত্রীর কথার জবাব খুঁজে পেলেন না, তাই নিরবে প্রস্থান করলেন।

পাপিয়া সালাদের প্লেট নিয়ে কুহুর ঘরে ঢুকলো। আশা করেছিল আজকেও দেখবে কুহু বই পড়ছে। কিন্তু না তার ধারণা ভুল করে দিয়ে কুহু মেকাপ করতে বসে গেছে। পাপিয়া বলল,” তোকে কেউ সম্পূর্ণ চিনে বললেও ভুল হবে। প্রতিবার তুই সেটা প্রমাণ করবি!”

“ঘটনা সেটা না। গতবার মেকাপ না করার পেছনে রিজন ছিল যেন পছন্দ না করে। কিন্তু ঐ ট্রিক্স কাজে লাগেনাই। তাই এবার মেকাপ করে সেকেন্ড এক্সপেরিমেন্ট করবো। দেখি আজকেও পছন্দ করে কি না!”

পাপিয়া হেসে বললো,” ও তুই যত ট্রিক্স ই এপ্লাই করিস না কেন, তোকে সবাই পছন্দ করবেই।”

“এতো কনফিডেন্স?”

“হুম। আমাদের দেশে বিয়ের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষের কিছু কমন ফ্যাক্ট আছে। মেয়েপক্ষ চায় একটা স্টাবলিশড সিম্পল ফ্যামিলিতে মেয়ে বিয়ে দিতে। ছেলের ইনকাম এর পাশাপাশি তার পারিবারিক ইনকাম ও মাথায় রাখা হয়। অনেকে ভাবে মেয়ের বেলা বুঝি এটা দেখে না। ঘটনা কিন্তু ঠিক না। হ্যাঁ মেয়েদের সৌন্দর্য মূখ্য তবে পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড ও গৌণ নয়। সেদিক দিয়ে বিচার করলে তোকে রিজেক্ট করার প্রশ্নই আসে না।”

কুহু মেকাপ করা বন্ধ করে দিয়ে পাপিয়ার দিকে তাকালো। রুক্ষ গলায় বলল, “তাহলে শুধু আমাকে কেন তোকেও কেউ রিজেক্ট করবে না। তুই কথাটা এভাবে বলছিস কেন? আমি যদি খন্দকার পরিবারের না হতাম আমাকে কি কেউ পছন্দ করতো না?”

“আমি সেটা বুঝাই নি আপু। আমি বলতে চাইছি যে মাপকাঠিটা সমাজে অবধারিত করা আছে তাতে তুই উপরেই আছিস। এখন তুই মেকাপ কর বা না কর ডাজন্ট ম্যাটার!”

কুহু বায়োডাটার খাম টা বাস্কেটে ফেলে বলল,” তাহলে একটা গেইম প্লে করি চল। আমি এমন সব আচারণ করবো যেন ওরা আমায় পছন্দ না করে। তারপর বোঝা যাবে ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ম্যাটার করে কি না?”

“এসব করার কোনো দরকার নেই। দাদাসাহেব এই প্রপোজালটা নিয়ে খুব আগ্রহী। অযথা ভেজাল করিস না…”

তবে কুহু এসব কানে তুলল বলে মনে হচ্ছে না।

আরওয়া ফোন নিয়ে দ্বিধায় আছে। একবার চাইছে কল করে খোঁজখবর নিতে পরক্ষণেই মনে হচ্ছে ও কেন কল দিবে? উনিও তো দিচ্ছেনা। বহু ভেবে সাম্যকে কল করাই বেটার মনে হলো। যেই ভাবা সেই কাজ, কল করলো সাম্যর নাম্বারে, বেশ কয়েকবার রিং হবার পর কর রিসিব হতেই সে বলল,

“হ্যালো সাম্য ভাইয়া? আপনারা ঠিক মতো পৌঁছেছিলেন তো?

“আপনার সাম্য ভাইয়া ঠিকঠাক পৌঁছেছে। আর কিছু?”

জাওয়াদের গলা শুনে আরওয়া ভীষণ ভড়কে গেল, শক্ত গলায় বলল,”উনার ফোন আপনার কাছে কেন? বস হয়েছেন বলে কি উনার মিনিমাম প্রাইভেসী নেই!”

“আমার পিএ কে আমি কীভাবে ট্রিট করবো তা তোমার থেকে জানতে চাইছি না। অন ডিউটিতে ওকে কল করে ডিস্টার্ব করছো কেন?”

“আমি ডিস্টার্ব করছি না। খোঁজখবর নিতে কল করেছি।”

“সাম্য কি দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্টার? নাকি খবর ফেরি করে বেড়ায়?”

“সেটা আপনার না জানলেও চলবে। ভাইয়াকে ফোন‌ দিন আমার কথা আছে উনার সঙ্গে।”

জাওয়াদ দাঁতে দাঁত চেপে সাম্যর দিকে ফোন বাড়িয়ে দিলো। সাম্য ওর চেহারা দেখে ভয়ে ভয়ে ফোনটা কানে তুলতেই আরওয়া বলল,” ভাইয়া আপনারা ঠিকমতো পৌঁছেছেন বুঝেছি। ওখানে ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করবেন আর আপনার বসকে দেখেশুনে রাখবেন। শীত তো শেষ ফাগুনের আগুন তো লেগেছে চারদিকে, উনার মেজাজের আগুন মিলে যেন তাপদাহ না হয় সেই দায়িত্ব আপনার। রাখছি। আল্লাহ হাফিজ। ”

জাওয়াদ বিড়বিড় করে বললো,” ফাগুন এসেছে মাথায় আছে, অথচ ফাগুনেই যে বিয়ে হয়েছিল মাথায় নেই। গাবেট একটা! আমাকে ফোন‌ না করে আমার পিএ কে ফোন করা। সব হিসাব রেখো আরওয়া। সবকিছু শোধ নেওয়া হবে!”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে