#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৩২
#আরশিয়া_জান্নাত
৩২
জাওয়াদ কখনোই ঈদে শপিং এ যায় না। ওর মা-বোন ই বলতে গেলে ওর যাবতীয় সবকিছু কেনাকাটা করে কিংবা সাম্য সবটা হ্যান্ডেল করে। এবার ঈদেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অফিস শেষে জাওয়াদ সাম্যকে শপিং মলের দিকে গাড়ি নিতে বলায় সাম্য তাই অবাকই হলো বটে। সাম্যর জানামতে ও বাড়ির সবার কেনাকাটা প্রায় শেষ। তবে শপিং এ কেন যেতে চাইছে কে জানে!
জাওয়াদ গাড়ি থেকে নেমে মলে ঢুকলো। চারদিকে মানুষ গিজগিজ করছে। সবার হাতেই শপিং ব্যাগ, সাথে পরিবার পরিজন। কারো কারো চেহারায় ক্লান্তির রেশ। জাওয়াদ ঘুরে ঘুরে চারদিক দেখে একটা দোকানে ঢুকলো। শাড়ির দোকান দেখে সাম্যর গেস করতে অসুবিধা হলোনা জাওয়াদ কেন এখানে এসেছে। বেশ কিছু শাড়ি দেখার পর তার মাথা নষ্ট হয়ে গেল। কোন শাড়িটা বেশি সুন্দর কে জানে, সবগুলোই তো একই লাগছে! জাওয়াদ নেড়েচেড়ে দেখেই যাচ্ছে, শপের স্টাফরা আচল মেলে মেলে সব দেখাচ্ছে। ২৫টা শাড়ি দেখার পর জাওয়াদ বলল, “হয়েছে এবার থামুন। আর দেখাতে হবে না।”
“স্যার একটাও পছন্দ হয় নি?”
জাওয়াদ কপাল চুলকে বললো,” সব কয়টা প্যাক করে দিন।”
সাম্য বললো,” স্যার একটা দোকান থেকে নেওয়ার কি আছে? আরো কয়েকটা দোকান ঘুরে দেখি? ভালো কালেকশন থাকতে পারে।”
“ওরা সবাই এরকম পড়ে পড়ে দেখাবে? দরকার নেই তাহলে, ইটস লুকিং সো উইয়ার্ড! এরচেয়ে এক দোকান থেকে সব নিয়ে যাই এটাই শর্টকার্ট।”
“ওকে স্যার”
“শোনো এখান থেকে ১২টা শাড়ি সেপারেট করো। দাদীদের জন্য ২টা সিলেক্ট করো। আর বাকি ১০টা অন্য সদস্যদের জন্য। বাকি সবগুলো আরওয়ার জন্য।”
সাম্য হেসে বলল, “আপনি চেইঞ্জ হয়ে গেছেন স্যার! পজিটিভ চেইঞ্জ।”
ওদেরকে প্যাক করতে বলে জাওয়াদ দোকানের বাইরে এসে দাঁড়ালো। একটা ড্রেস এর উপর তার চোখ আটকেছে। এই ড্রেসটায় আরওয়াকে দারুণ মানাবে বলেই মনে হচ্ছে। সে আর ২য়বার ভাবলো না। ড্রেসটাও নিয়ে নিলো। গাড়িতে বসে জাওয়াদ ভাবতে লাগলো আরওয়া নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবে। ওর হাসিমুখ কল্পনা করতেও আরাম লাগছে। তবে এটা বলতেই হবে শপিং করা খুব কঠিন হাহ!
নাহিয়ান নিজের কেবিনে থাকা সোফায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে। এইটুকু জায়গায় ওর বিশেষ সুবিধা না হলেও অভ্যাস হয়ে গেছে। রাত ১টায় একটা ওটি আছে। কতক্ষণ লাগবে হিসাব নেই। তাই একটু ঘুমিয়ে নেওয়াই উত্তম। এই স্বল্প পরিসরের ঘুমের মধ্যে নাহিয়ান খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলো। সে একটি বাগানে নরম ঘাসের উপর হেঁটে যাচ্ছে। চারদিকে নানারকম ফুলের সৌরভ, মৃদু বাতাস। স্বপ্নটা এতো জীবন্ত যে ও পায়ের তলায় ঘাসের স্পর্শও অনুভব করতে পারছে। সে খানিকটা এগোতেই খেয়াল করলো এই বাগানের ফুল গাছে ফুলের বদলে ছোট শিশুরা ফুটে আছে। সবাই দেখতে ভীষণ সুন্দর আর মায়াবী। নাহিয়ান কাছে গিয়ে দেখে ওরা চোখ বুঝে ঘুমিয়ে আছে। নাহিয়ান বলে, “আমাকে একটা ফুল দেবে? আমি সাবাকে দিবো। ও বাচ্চার জন্য খুব মন খারাপ করে। এখান থেকে একটা বাচ্চা দাও প্লিজ। বিনিময়ে যা চাইবে দিবো….”
ওখানকার এক মালি উত্তরে বলল, “এখানে ফুল শুধু দেখতে পারবেন ছিড়তে পারবেন না। ছিড়লে ওরা মরে যাবে।”
নাহিয়ান মন খারাপ করে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,” নাহ ওরা বেঁচে থাকুক। আমি ছিড়বো না।”
তখনই একটা ফুল নিজে নিজেই ঝরে পড়ে। নাহিয়ান আর্তনাদ করে বলল, “আল্লাহ এখন কি এটা মরে যাবে? এতো সুন্দর বাচ্চাটা মরে যাবে!”
মালি হেসে বলল, “নাহ। এটা আপনার জন্যই ঝরেছে। ওকে নিয়ে যান। অনেক যত্ন করে রাখবেন, সবাই এই রত্নের মালিক হয় না। সন্তান পাওয়া অনেক সৌভাগ্যের। সবাই সন্তান পায় না। যারা পায় তারা ঠিকঠাক যত্ন করতে পারেনা। আশা করি আপনি তাদের মত হবেন না।”
নাহিয়ান খুশিতে কেঁদে ফেলল, বাচ্চাটাকে যত্নে কোলে তুলে বলল, ” আমি অন্যদের মতো হবোনা। আমার সাবা ওকে খুব যত্নে রাখবে, খুব আদরে রাখবে। আমি জানি ও পৃথিবীর বেস্ট মা হবে।”
বলেই অঝরে কাঁদতে লাগলো। নাহিয়ানের মনপ্রাণ আনন্দে ভরপুর হয়ে গেছে। সে দ্রুত সাবার কাছে যেতে চাইছে, বলতে চাইছে দেখো আমি কি এনেছি তোমার জন্য!!
ঘুম ভাঙার পর নাহিয়ান বহুক্ষণ চুপচাপ বসেছিল, স্বপ্নটা যদি সত্যি হতো কত ভালোইনা হতো?
।
ইশরাক মেন্যু চেক করে বলল, “এখানের লেমন গার্লিক বাটার চিকেন অনেক জোস। টেস্ট করবেন?”
“আপনি যখন বলছেন তার মানে সত্যিই মজা। টেস্ট করাই যায়।”
“নাহ কুহু এরকম ব্লাইন্ড হলে চলবে না। আপনার উচিত চোখ কান খোলা রেখে যাচাই করা। অন্ধ বিশ্বাস মানুষকে অন্ধ বানিয়ে দেয়।”
কুহু মৃদু হেসে বলল,”আচ্ছা!”
খাবার অর্ডার করে ইশরাক বললো, “সরাসরিই কথা বলি, দেখুন আমি জানি আপনি লাস্ট ছয়/সাত মাস আমার সম্পর্কে অনেক ইনফরমেশনই কালেক্ট করেছেন। এন্ড আপনি আকারে ইঙ্গিতে নিজের আগ্রহের কথাও বলেছেন।”
“হ্যাঁ। শুরুতেই বলে দেই আমি এখন প্রেম করার বয়সে নেই। আপনি রাজী হলে সরাসরি বিয়ের ব্যাপারেই রাজী হতে হবে।”
ইশরাক খুকখুক করে কেশে উঠলো। কুহু ওকে পানি এগিয়ে দিলো। ইশরাক পানি পান করে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,”আপনি এমন বোল্ড হবেন আশা করি নি। যাই হোক, আমি চাইছিলাম কিছুদিন দেখি, কথাবার্তা বলি তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিলাম।”
কুহু পেছনে হেলান দিয়ে বসে বলল,”It’s been 7months. আপনি এতো লেট লতিফ হলে তো সমস্যা। বেসিক জানাশোনা তো হয়েছেই। বাকিটা বিয়ের পর জানলেও হবে। আপনি হ্যাঁ বললে আমি বাসায় জানাবো।”
“বেশি তাড়াহুড়ো হয়ে গেল না?”
“মোটেই না। ওটা আপনার ফল্ট। খাওয়ার ফাঁকে যদি একটুও তাকাতেন এতোদিনে জানাশোনা হয়ে যেত। এনিওয়ে রোজার ঈদ বাপের এখানে করবো,তবে কুরবানি টা আপনার ওখানেই করতে চাইছি।”
ইশরাক কুহুর দিকে হা করে চেয়ে রইলো। কুহু হেসে বললো,”আমার চেহারা অনেক সুন্দর তাই না? হাসলে ডিম্পল ও পড়ে দেখুন..”
আরওয়া জাওয়াদের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বললো, “আপনি এতো শাড়ি এনেছেন আমার জন্য সিরিয়াসলি! আমি শাড়ি পড়ি?”
জাওয়াদ শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল, ” পড়ো না তো কি হয়েছে এখন থেকে পড়বে।”
“আপনার শপিং করার থাকলে আমাকে বলতেন আমিও যেতাম। একই ডিজাইনের ২/৩ কালার আনলেন কিভাবে! দোকানদার আপনাকে বোকা পেয়ে সব গছিয়ে দিয়েছে।”
“তুমি আচ্ছা মেয়ে তো! তোমার হাজবেন্ড তোমার জন্য শপিং করেছে কোথায় তুমি খুশি হবে তা না, শুধু দোষ খুঁজে যাচ্ছ!”
আরওয়া জোরে শ্বাস নিয়ে ছাড়ল। নিজের মাথায় হালকা চাপড় মেরে বললো, “রিল্যাক্স আরওয়া রিল্যাক্স। এই যন্ত্রমানব তোর জন্য এনেছে এটাই অনেক। কুল….”
“এই তুমি কি বিড়বিড় করছো?”
“কিছু না। থ্যাংকস ডিয়ার হাবি, এতো ভারী ভারী শাড়ি কিনে আনার জন্য। আপনার পছন্দ লা জওয়াব!”
জাওয়াদ তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলল,” এই তো গুড গার্ল।”
আরওয়া ওর গা ঘেষে দাঁড়িয়ে বলল, ” আপনি আপনার ব্যস্ততা একপাশে রেখে আমার জন্য সময় বের করেছেন এতেই আমি অনেক হ্যাপি।”
জাওয়াদ গাল বাড়িয়ে বললো, “রিওয়ার্ড দাও?”
আরওয়া ওর গালে চুমু এঁকে দিতেই জাওয়াদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।
“আরওয়া শোনো?”
“হুম?”
“তুমি কি টায়ার্ড?”
“নাহ কেন?”
জাওয়াদ নিজের আঙুলের ভাঁজে আরওয়ার আঙুল গলিয়ে গাঢ় গলায় বলল, “I wanna feel you deeply…”
লজ্জায় আরওয়ার মুখ লাল হয়ে গেল। চিবুক নামিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই জাওয়াদ তাকে কোলে তুলে বলল, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আরওয়া। আমার জীবনে থেকে যাওয়ার জন্য!”
আরওয়া ওর গাল ছুঁয়ে বললো, “প্রতিবার এটা বলতে হয় আপনার? এটা না বললে কি চলে না?”
“কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কিপ্টামী করা ঠিক না। আমি জানি আমি তোমার সঙ্গে যা করেছি তা অন্যায় ছিল। ঐ একটা বিশেষ রাত নষ্টের খেসারত হয়তো আজীবনেও পরিশোধ হবেনা।”
আরওয়া ওর ঘাড় টেনে একদম কাছে এনে বলল,”আমি অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে ইচ্ছুক না। আমি বর্তমানে বাঁচি। মনপ্রাণ উজাড় করে বাঁচি। আপনিও সেটা করুন না?”
জাওয়াদ ওর কপালে গভীর চুমু খেয়ে বলল, “আই উইল ট্রায় মায় বেস্ট!”
ভালোবাসার উষ্ণ ছোঁয়ায় দুটো প্রাণ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। চারদিকে যেন আনন্দের বর্ষণ বইছে। প্রেমোত্তাপে তনু ঘেমেনেয়ে একাকার করে উঠলেও কেউই কারো সান্নিধ্য ছাড়তে চাইছে না, গভীর থেকে গভীরতর স্পর্শে একে অপরকে পাগল বানানোর প্রতিযোগীতায় যেন নেমেছে তারা।
কতটা সময় পেরিয়েছে কে জানে। আরওয়া চাদর মুড়িয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। জাওয়াদ ওর চুলগুলো একপাশে সরিয়ে পিঠে মাথা রেখে বলল, “আরওয়া উঠো শাওয়ার নিয়ে নাও। একটু পরেই সাইরেন বাজবে।”
আরওয়া ঘুম জড়ানো গলায় বললো, “আরেকটু ঘুমাই না। আজ সাহরী করবোনা। পানি খেয়ে রোজা রেখে ফেলবো।”
জাওয়াদ উঠে বললো, ” উঠো বলছি। দিন অনেক লম্বা। পরে তোমারই কষ্ট হবে। উঠো না প্লিজ!”
আরওয়া কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,” আপনাকে একদম ভাল্লাগেনা। হুহ!”
জাওয়াদ ওর গাল টেনে বললো, “ভালো না লাগতেই এতো পাগলামী করলে ভালো লাগলে কি করতে হুম?”
আরওয়া বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে বলল, “আপনি এমন ঠোঁটকাটা কেন? উফফ একটুও লজ্জা নেই আপনার।”
“কেউ হুঁশ হারালে দোষ নেই। আমি মুখে বললেই দোষ।”
আরওয়া ওর মুখ চেপে বলল,” থামুন তো। আমি উঠে গেছি। আর বলতে হবেনা।”
জাওয়াদ হাসতে লাগলো।
।
ইউকে আসার পর রিজভী পাপিয়াকে সবচেয়ে বেশি মিস করে। যেখানেই কোনো ফ্রেন্ডস গ্রুপ দেখে ওর পাপিয়ার কথাই মনে পড়ে। মেয়েটা একটু বোকা হলেও অনেক কিউট। অনেক কেয়ারিং ও বটে। ওর দুঃসময়ে এই পৃথিবীতে আর কেউ থাকুক না থাকুক বাবা-মায়ের পর যদি কেউ থাকে সেটা অবশ্যই পাপিয়া। সামিয়ার সঙ্গে ওর দীর্ঘদিন সম্পর্ক থাকলেও মেয়েটা ওকে ততোটা কেয়ার করেনি বা ওর মনের কথা ততোটা জানেনি যতোটা পাপিয়া জেনেছে কিংবা প্রয়োজন ছাড়া টাইম স্পেন্ড করেছে।
ওর সাথে রিলেশনে যাওয়ার আগে অনেকেই ভাবতো পাপিয়াই বুঝি ওর গফ হবে। ফিউচারে তারা কাপল হবে এমন বাজিও কম ধরা হয়নি গ্রুপে।
হলে অবশ্য মন্দ হতো না। কিন্তু সত্যি বলতে রিজভী কখনো চায়নি এতো সুন্দর একটা ফ্রেন্ডশীপ ভিন্ন নামে রূপান্তরিত হোক। বন্ধুত্ব থেকে প্রেমে গড়ানো সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত কিছুই যদি না থাকে, কেবল প্রেমিকা না বন্ধুও হারায়। তাই রিজভী সবসময় একটা লাইন এঁকে রেখেছিল।
দূর দেশে এসে ওর মনেপ্রাণে একটাই রিয়েলাইজেশন এসেছে- পাপিয়া কে চুজ না করা ওর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। তবে এবার সে আর ভুল করবে না। পাপিয়ার সঙ্গেই বাকিটা জীবন কাটাবে। কিন্তু এটা বললে পাপিয়া যদি ওকে ভুল বুঝে? কিংবা এই ভেবে বসে গফ পালানোতে ঠেকায় পড়ে ওকে চাইছে? এটা সাময়িক মোহ!
তবে সে নিজেকে মুখ দেখাতে পারবে?
রিজভী মনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে হাঁপিয়ে উঠে। নাহ আপাতত শান্ত থাকাই শ্রেয়। আরো ক’টা দিন যাক তারপর নাহয় কিছু একটা ভাবা যাবে।
কালকে ঈদ। তাই বাড়ির সব মেয়েরা মেহেদি পড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মেহেদী আর্টিস্টরা এক এক করে সবাইকে মেহেদী লাগাচ্ছে, আর হাসি আড্ডায় চারদিকে হৈ হৈ রব। কোহিনূর আর রোকেয়া শেফদের কি কি আইটেম করা হবে তার লিস্ট করে দিয়ে মেহেদী উৎসবে যোগ দিলো। মিডিয়াম ভলিউমে বাজতে লাগলো সেই বিখ্যাত গান,
“ও মন রমজানের ঐ রোজা শেষে এলো খুশীর ঈদ….”
চলবে….
#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৩৩
#আরশিয়া_জান্নাত
নাহিয়ান বিরিয়ানি খেতে খেতে বসার ঘরে ঢুকলো। সাবার পাশে বসে বলল,”আহারে বেচারি দু’হাত ভর্তি মেহেদি দিয়ে বসে আছে। এখন চাইলেও এতো মজার বিরিয়ানি খেতে পারবে না।”
সাবা বলল, “তোমার খাওয়া তুমি খাওনা। আমি কি বলেছি আমি এখন খাবো?”
“রাত প্রায় ১২টা বাজে। এখন না খেলে কখন খাবে?”
“এক রাত না খেলে কিছু হয় না।”
“এখন না ৫মিনিটে রং হয়। তোমার মেহেদী দেখি শুকালোই না।”
“অর্গানিক মেহেদী দিয়েছি সারারাত রাখলে অনেক রং হবে।”
“তোমার হাতে এমনিতেও রং বেশি হবে। যাই হোক দেখি হা করো, আমি আবার এতো নির্দয় নই বৌকে উপোস ফেলে একা একা খাবো।”
কুহু বলল, ” তুই যে ডাইনিং ছেড়ে কেন এখানে খেতে এসেছিস এ আমরা সবাই আগে থেকেই জানি। এতো নাটক করার কি দরকার বুঝি না।”
“ও তুই বুঝবিও না শাকচুন্নি। সারাক্ষণ তো নাক উঁচু করে ঘুরিস কোথায় কার ব্যাপারে নাক গলানো যায় সেই খোঁজে।”
কুহু বলল, “আমার নাক খাড়া বলে তোর সবসময়ই বেশি জ্বলে!! হিংসুক একটা।”
“ইসসস, যেই না নাক তার!”
সাবা গালের খাবার শেষ করে বললো,” এই তুমি থামবে? কেন রাগাচ্ছ ওকে?”
“তুমিই বলো আমি কি ওকে কিছু বলেছিলাম? ও নিজেই তো আমাদের কথার মাঝে ঢুকলো। হে আল্লাহ এই জাদরেল মেয়ের এটাই যেন এ বাড়িতে শেষ ঈদ হয়। আগামী বছর ও যেন শ্বশুরবাড়ি থাকে। আমিন”’
কুহু ডোন্ট কেয়ার মুডে বললো, “আগামী বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করছিস কেন? বল যে কোরবানীর আগেই যেন চলে যাই। শাওয়াল মাসে হলে তো আরো জোস।”
নাহিয়ান ভ্রু নাচিয়ে বললো, ” কোন হাবলারে ফাঁদে ফেললি?”
“তোরে বলবো কেন? তুই তো পারলে আমার বাড়া ভাতে ছাই দিবি তোরে কিছুতেই বলবোনা।”
“তলে তলে এতো দূর? দাঁড়া আমি এখনি মাকে বলছি।”
“যা বল গিয়ে, হু কেয়ার্স?”
“দেখেছ সাবা, আমি ওর বড় ভাই অথচ আমাকে একটুও দাম দিচ্ছে না। আরেহ আমার মত ছাড়া তুই পার পাবি ভাবছিস? আমি না বললে কেউ রাজি হবে?”
“এহহ আসছে বড় টোটো কোম্পানীর ম্যানেজার। তার মত ছাড়া আমার বিয়ে হবে না উউউ”
“ভেংচি কেটে লাভ নেই কোকিলা বেহেন। আমার কাছেই তোরে আসতে হবে দেখিস।”
সাবাকে খাবার খাইয়ে দিয়ে নাহিয়ান চলে গেলে পাপিয়া বলল, “আপু তুই ভাইয়াকে রাগিয়ে কি ঠিক করলি? সত্যি সত্যিই যদি ভাইয়া বেঁকে বসে?”
কুহু হেসে বলল,” আমার মিষ্টি ভাবি আছে না?সে ই সব মিটমাট করে দিবে, কি বলো ভাবি?”
সাবা মুচকি হেসে সমর্থন জানিয়ে বলল, “তা সে রাজী হলো?”
“মনে তো হচ্ছে রাজীই, মুখে স্বীকার করা বাকী।”
পাপিয়া চারদিকে তাকিয়ে বলল, “নতুন ভাবি কোথায় গেল এখানেই না ছিল?”
কুহু– “হয়তো নিজের ঘরে গেছে।”
“দেখলাম ও না কেমন হলো তার ডিজাইনটা!”
সাবা বললো,” আবার আসবে হয়তো, নয়তো সকালে দেখিও।”
কুহু– “ঘুম এসে গেছে বোধ হয়, সে তো আবার রাত জাগতে পারে না।”
“হুম তাই হবে।”
সালমা বেগম সবার জন্য বড় বাটিতে করে বিরিয়ানি এনে বললেন, “সবাই লাইন ধরে বস। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
কুহু পাপিয়া ও তাদের অন্য কাজিনরা দৌড়ে দাদীর কাছে গেল, প্রতিবছর এমনি হয়। চাঁদরাতে মেহেদী পড়ার পর দাদী তাদের মুখে তুলে খাইয়ে দেন। এতোক্ষণ সবাই তার অপেক্ষাতেই ছিল।
আরওয়া দু’হাত মেলে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। বিছানায় শোয়া এই মুহূর্তে রিস্কি। ওর যে ঘুম পরে হাতের মেহেদী সব বিছানার চাদরেই রয়ে যাবে, হাতে আর থাকবে না। জাওয়াদ রুমে এসে তাকে এমন অবস্থায় দেখে ফোন বের করে ছবি তুললো। তখনই দরজায় একজন এসে নক করে বলল, ” স্যার আরওয়া ম্যাম ডিনার করেন নি। তাই উনার জন্য খাবার পাঠিয়েছেন।”
“আচ্ছা আমাকে দাও।”
জাওয়াদ খাবার নিয়ে টেবিলের উপর রেখে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
“আরওয়া এই আরওয়া উঠো,,এভাবে বসে বসে কেউ ঘুমায়? দেখি উঠে বিছানায় ঘুমাও”
আরওয়া হাত দিয়ে চোখ কচলাতে নিলে জাওয়াদ তাকে থামিয়ে বলে,” এই হাতে মেহেদী তো। কি করছো?”
“উপস স্যরি। আপনি কখন এসেছেন? এতো তাড়াতাড়ি সকাল হয়ে গেছে নাকি?”
“নাহ। সকাল হয় নি। দেখি উঠো কুলি করে খাবার খেয়ে নাও।”
“খাবো না এখন, ঘুমাবো।”
“তুমি এমন কেন আরওয়া? জানো ১১টার পর জেগে থাকতে পারোনা, আগে আগে খেয়ে নিবা না?”
“আপনি আমাকে বকা দিচ্ছেন কেন? চাঁদরাতে কেউ বকা দেয়? সবাই আনন্দ করছিল, তাই খাওয়ার কথা ভুলে গেছি। তাছাড়া অনেক নাস্তা খেয়েছি তো বেশি খিদে নেই।”
জাওয়াদ প্লেট হাতে নিয়ে বলল, “আর কোনো কথা শুনতে চাইছি না। আমি খাইয়ে দিচ্ছি চুপচাপ খেয়ে ঘুমাবে। কোনো বাহানা শুনতে চাইছি না।”
জাওয়াদের গুরুগম্ভীর গলা শুনে আরওয়ার চোখ থেকে ঘুম চলে গেল। সে গুডগার্লের মতো চেয়ারে বসে জাওয়াদের হাতে খেতে লাগলো। জাওয়াদ গাম্ভির্যতা ধরে রেখে পুরো খাবার শেষ করেই দম নিলো।
।
ঈদের নামায পড়তে বাড়ির সব ছেলেরা ঈদগাহে গেছে। এদিকে বাড়ির অন্য সদস্যরা গোসল সেড়ে নতুন জামা পড়ে সেজেগুজে একদম তৈরি। নামায শেষে ফিরলেই সালামি আদায়ের ধুম পড়বে। তারপর সবাই বেরিয়ে যাবে চেনাজানা সকলের বাসায় বেড়াতে।
জোবায়ের সাহেব নামাজ শেষে সবাইকে নিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে গিয়ে কবর জিয়ারত করলেন। তারপর বাড়ি ফিরে সোফায় বসতেই এক এক করে সবাই তার কদমবুসি করলো। তিনিও হাসিমুখে সবাইকে সালামি দিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা জানালেন।
আরওয়া রুমে এসে বলল, “এই শুনুন?”
“হুম বলো?”
“আপনি আমাকে সালামি দিবেন না?”
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “এতোজন থেকে সালামি পেয়েও হলো না?”
“হুহ! আপনি এতো কিপ্টে কেন? সবাই কত সুন্দর করে তাদের ওয়াইফকে সালামি দেয়। এমনকি দাদাসাহেব ও দাদীকে দিলেন। আর আপনি কেমন ভ্রু কুঁচকে আছেন যেন আপনার হৃদপিন্ড চেয়েছি!”
“সালাম না করে সালামি চাইলে এমনি তো হবে। তুমি যদি সালাম করে বলতে জনাব আমার সালামি? তবে কি না দিয়ে থাকতাম?”
আরওয়া মাথায় ঘোমটা দিয়ে বললো, “আস্সালামু আলাইকুম জনাব। ঈদ মোবারক।”
“ওয়ালাইকুমুস্সালাম। ঈদ মোবারক। এবার কোলাকুলি করো?”
“কোলাকুলিও করতে হবে!”
“অবশ্যই।”
“হুহ আপনার যত রুলস!”
জাওয়াদ ওকে জড়িয়ে বললো,”আল্লাহ তোমায় শত সন্তানের জননী করুক।”
“এই এই এটা কি হলো? এটা কেমন দোয়া?”
“এটা সবচেয়ে দামি দোয়া বুঝলে। এখন ৩টা সন্তান পাওয়াও কঠিন হয়ে যায় সেখানে তুমি শত সন্তানের জননী হবে। সো ব্লেসিং! তোমার তো খুশি হওয়া উচিত!”
“আপনি পাগল? এতো বাচ্চা হলে আমি বাঁচবো?!”
“আচ্ছা যাও ৫০ জন হোক।”
“নাহ!!”
“২৫?”
“উহু”
“সর্বনিম্ন ১২ তো হবেই। আর কমানো যাবে না।”
“আল্লাহ! এমন একটা ভালো দিনে আপনি এমন দোয়া করছেন? কবুল হয়ে যায় যদি?”
জাওয়াদ ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,” কবুল হলে আমি এতিমখানায় কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়াবো।”
“থাক থাক আমাকে সালামি দিতে হবে না। আপনি এমনিই থাকুন, এমন দোয়াও করে দিতে হবে না…আমি ঠিক আছি।”
জাওয়াদ ওর কথায় হাসতে লাগলো। আরওয়া নাক ফুলিয়ে বলল,” আপনি খুব চালাক!”
জাওয়াদ পকেট থেকে খাম বের করে বললো, “বেগম, এই নিন আপনার সালামি!”
আরওয়ার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। হাত বাড়িয়ে খামটা নিতে গেলে জাওয়াদ ওর হাত ধরে বলল,”বাহ খুব সুন্দর রং হয়েছে তো!”
আরওয়া বলল,” আমি তো জানতাম ই আমার হাতের মেহেদিতে সবসময় রং ভালো হয়। দাদীজান বলতো আমার বর আমাকে অনেক ভালোবাসবে।”
“তাহলে স্বীকার করলে তোমার বর তোমাকে বেশি ভালোবাসে?”
“কি জানি, মুখে তো একবারও বলেনি। মনে মনে বাসে কি না সে ই ভালো জানে!”
“সবসময় মুখে বলাটাই কি মুখ্য? তোমার মন কি বলে?”
আরওয়া ওর গলা জড়িয়ে চুলে হাত গলিয়ে বললো, “আমার মনে বলে সে আমাকে একটুও ভালোবাসে না।”
জাওয়াদ ওর কোমড় খামচে কাছে টেনে বললো, “ঠিকই বলে। তোমাকে সে একটুও ভালোবাসেনা। এক কণাও না।”
আরওয়া চোখ বন্ধ করে ব্যথা হজম করে বলল, “আপনার ভালোবাসা সবসময় ব্যথাময় হয়। কখনো বুকের মাঝখানে ব্যথা দেয় তো কখনো শরীরে..মজার ব্যাপার হলো আমি এই ব্যথাতুর অনুভূতিতেই আপনার তীব্র ভালোবাসা খুঁজে পাই। মুখে আপনি যাই বলুন না কেন আই ডোন্ট কেয়ার!”
জাওয়াদ ওর কথা শুনে এক মুহূর্তও বিলম্ব করলো না। তীব্র আবেগে পাপড়ির ন্যায় কোমল অধরে নিজের পুরুষালি অধর মিশিয়ে প্রেয়সীর অমৃত সুধা পান করতে লাগলো। এই সময়টা না ফুরাক, এই অকৃত্রিম অনুভূতি কখনোই অম্লান না হোক…..
চলবে,,,