#কাঁটাকম্পাস #পর্ব৩০
#আরশিয়া_জান্নাত
পাপিয়া বিভিন্ন কোম্পানিতে সিভি জমা দিয়েছিল। সেই সুবাদে কাল তার একটা ইন্টারভিউ আছে। তারই প্রিপারেশন নিতে বইপত্র নিয়ে বসেছে। দরজায় টোকার শব্দ শুনে সে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে তার ছোট ভাই জাহিদ দাঁড়িয়ে আছে।
“ভেতরে আয়।”
“আপু কি করছিস?”
“কাল ইন্টারভিউ আছে, তার জন্য টুকটাক পড়ছি। কিছু বলবি?”
“হ্যাঁ। আচ্ছা বলতো পৃথিবী আহ্নিক গতি যদি সামহাও কমে যায় তাহলে কি সময়ের উপর কোনো প্রভাব পড়বে?”
“হ্যাঁ পড়ে তো। আহ্নিক গতি কমলে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়বে। অর্থাৎ সময় ধীরে যাবে”
“তার মানে যদি আহ্নিক গতি বাড়ে তাহলে সময় দ্রুত যাবে?”
“হুম।”
“আপু আমি দুইটা আর্টিকেল পড়েছি। একটায় দেখলাম চীনের থ্রি গর্জেস বাঁধের জন্য পৃথিবীর আহ্নিক গতি কিছুটা কমে গেছে। আবার আরেক জায়গায় পড়লাম পৃথিবীর আহ্নিক গতি বেড়ে গেছে, এখন পৃথিবী নিজ অক্ষে ঘুরতে ২৪ ঘন্টা লাগছে না। কোনটা সত্যি?!”
“দুটোই সত্যি। সময় দ্রুত যাচ্ছে তবে পরিমাণটা এখন পর্যন্ত খুব সামান্য। চীনের বাঁধ গতি কমানোতে প্রভাব ফেলছে এটাও সত্যি। তবে আজকে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা করতে পারবোনা। ”
“তোরা সবাই খুব বিজি থাকিস। আমার একদম ভালো লাগেনা!”
“তোর স্কুল বন্ধ নাকি? পড়ালেখা নাই?”
“পড়াশোনা করতে গিয়ে ই তো এসব মাথায় এলো। আচ্ছা আপু ধর এই পৃথিবীতে টিকে থাকার আর কোনো উপায় রইলো না। সবাই দলে দলে মঙ্গল গ্রহে চলে যাচ্ছে। তুই কি করবি?”
“কি করবো আর সবার সাথে আমিও চলে যাবো।”
“কিন্তু আমি যাবো না।”
“কেন? তুই এখানে সার্ভাইব করতে পারবি নাকি!”
জাহিদ হেসে বলল,”ভেরি সিম্পল আপু সবাই যদি অন্য গ্রহে চলে যায় এই গ্রহ একদম ঠিক হয়ে যাবে। হ্যাঁ শুরুতে অনেক সমস্যা হবে তবে
কয়েক মাসের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। দূষণ করার মানুষ ই যখন থাকবেনা তখন আর ধ্বংস করবে কে? চারদিকে নতুন গাছপালা গজাবে, ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস সব নষ্ট হয়ে যাবে, গাছপালা বৃদ্ধির ফলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও ঠিক হয়ে যাবে। আমার তো মনে হয় কয়েক বছরও লাগবেনা সব ঠিকঠাক হতে। তাই সবাই চলে গেলেও আমি থেকে যাবো।”
পাপিয়া ওর কথা শুনে বিস্মিত হয়ে গেল। ওর চিন্তাভাবনা এই ছোট্ট বয়সেই এমন আলাদা। সামনে কি করবে কে জানে! হয়তো ভবিষ্যতে নাসার বিজ্ঞানী বা গবেষক হয়ে গেল; বলা যায় না!!
গাছ থেকে ডাব পাড়া মাত্র সাথে সাথেই দা দিয়ে কেটে আরওয়াকে দিলো মফিজ ।
“আম্মিজান খেয়ে দেখেন, এই গাছের ডাব খুবই মিষ্টি। এমন মিষ্টি পানি কোথাও আর পাবেন না”
পলি একটা গ্লাস এনে ডাবটা উপুড় করে পানিটা নিয়ে আরওয়াকে দিলো। আরওয়া প্রথম চুমুক দিয়েই বললো, “উমম অনেক ইয়ামি। চাচা আমি কি আরেকটা পেতে পারি?”
“এটা বলতে হয় আম্মীজান। এই খানে যতগুলি দেখছেন সব তো আপনাদের জন্যই। যত ইচ্ছে খান। আমি আরো কাটতেছি দাঁড়ান।”
আরওয়া খুশি মনেই ডাবের পানি খেতে খেতে জাওয়াদের কাছে গেল। জাওয়াদ ছাদে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে।
“এই ডাবের পানি খাবেন? অনেক মিষ্টি আর ঠান্ডা। মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায় টাইপ।”
বলেই সে আরেক চুমুক খেল। জাওয়াদ কাজ রেখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। আরওয়া বুঝলো জাওয়াদেরও খেতে ইচ্ছে করছে। সে তার গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “নিন খান। আরো কয়েক গ্লাস আছে। আপনি বললে নিয়ে আসবো।”
জাওয়াদ ল্যাপটপ একপাশে রেখে আরওয়াকে বললো, “এদিকে এসো।”
“কেন?”
“আসতে বলেছি আসবে। এতো প্রশ্ন কেন?”
আরওয়া ওর পাশে বসে বলল, “আপনি ডাব খাবেন না? আমি পুরোটা খেয়ে ফেলি?”
“খাও”
“আমি খেয়েছি বলে এখান থেকে খাবেন না যে? আলাদা গ্লাসে আনবো?”
জাওয়াদ অন্যদিকে চেয়ে বাঁকা হাসলো, আরওয়া সেই হাসির অর্থ বুঝবার আগেই সে তার ঠোঁটজোড়া দখল করে নিলো।
কিছুক্ষণ পর আরওয়া সরে গিয়ে নিজের ঠোঁট চেপে বললো, “এটা কি হলো? এরকম হুটহাট কেউ চুমু খায়?”
“তো কি বলেকয়ে খায় নাকি? তাছাড়া তুমি বারবার বলছিলে খাওয়ার জন্য….”
“আমি ডাবের পানি খেতে বলেছিলাম আমাকে না।”
“ঐ একটা হলেই হলো।”
“আপনি খুব…..”
“রোমান্টিক তাই না?”
” নাহ। বেশরম”
“ভেবে বলছো তো?”
” এখানে ভাবার কি আছে? ঠিকই তো বলেছি।”
“রোমান্টিক এর খাঁটি বাংলা এটাই গো। এখন তুমি যাই বলো আমি গায়ে মাখছি না। বউয়ের কাছে সভ্য লাজুক হয়ে থাকলে প্রেম ভালোবাসা আর হয়না বুঝলে!”
আরওয়া ভেংচি কেটে ওখান থেকে চলে গেল। জাওয়াদ হেসে মনে মনে বলল, “বউকে চুমু খেলে সত্যিই স্ট্রেস কমে যায়!”
।
দেখতে দেখতে বছর ঘুরে রোজার মাস চলে এসেছে। সবাই মিলে সাহরি আর ইফতার করার মাঝে এক অন্যরকম আনন্দ। প্রতিবছর রমজান মাসে খন্দকারদের পক্ষ থেকে ইফতারের আয়োজন বেশ বড় করে করা হয়। এ সময় নির্দিষ্ট স্থানে পথচারী, মুসাফির সহ যেকোনো শ্রেণির রোজাদারের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করা তাদের রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন নিম্নে দু’শো লোক সেখানে তৃপ্তি ভরে ইফতার করে। নিয়ম মাফিক বাড়ির ছেলেরা একেকদিন একেকজন গিয়ে সব তদারকি করে সেখানেই ইফতার করে।
আজ নাহিয়ানের পালা আসায় সাবা বললো, “শুনছো আমি বলি কি আজকের ইফতারটা আমি তৈরি করবো। রোজাদারদের ইফতার করালে তো অনেক সোয়াব হয় তাই না? আল্লাহ যদি এই উছিলায় আমায় সন্তান দান করেন….”
“ওখানে অনেক মানুষ হয়, এই গরমে তুমি এতো রান্না কিভাবে করবে?”
“আমি একটা আইটেম হলেও করি প্লিজ নাহিয়ান মানা করো না।”
“সাবা আমি বুঝতে পারি তোমার মনের অবস্থা। কিন্তু…”
“আমি একা করবো না তো। শেফরা তো আছেন ই।”
“তোমার যা ইচ্ছে করে করো।”
“আজকে আমি একটা এতিমখানার অনেকগুলো বাচ্চাকে ওখানে আসতে বলেছি। তুমি ওদের পেট ভরে ইফতার করাবে।”
“আচ্ছা!”
“থ্যাংক ইউ!”
নাহিয়ান হেসে বললো,” তুমি অনেক কিউট সাবা। তোমাকে এমনি এমনি এতো ভালোবাসি না আমি!”
সাবা উত্তরে কেবল হাসলো।
আরওয়া ফ্লোরে শুয়ে একটু পর পর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। উহু এতো গরম গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কখন ইফতারের সময় হবে। জাওয়াদ অফিস থেকে ফিরে আরওয়াকে এমন দেখে বলল, “বেশি কষ্ট হচ্ছে?”
“নাহ, প্রথম দিকে একটু কষ্ট হয়ই। ধীরে ধীরে আবার অভ্যাস হয়ে যাবে।”
জাওয়াদ শার্ট পাল্টে বলল, “বাইরে যা গরম সে অনুযায়ী কষ্ট কম ই লাগছে। রোজাদারদের উপর আল্লাহর বিশেষ রহমত থাকে এই গরমে সেটা আবারো টের পেলাম।”
“হুম ঠিক বলেছেন।”
জাওয়াদ আরওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,” উঠে এসো। বিছানায় শুয়ে রেস্ট নাও। আসরের নামাজ পড়েছ?”
“হুম। না আর রেস্ট নিবো না। আমি এখন কোরআন পড়বো। পাপিয়া আপু আমার চেয়ে এক পারা এগিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ব্যালেন্স করতে হবে..”
“তোমাদের কম্পিটিশন হচ্ছে নাকি?”
“হুম, দাদীজান বলেছেন সবাইকে ২৬ রোজার মধ্যে খতম দিতে।”
“ওহ, কিন্তু তাড়াহুড়ো করে পড়া ঠিক না। কোরআন অর্থ বুঝে ধীরে সুস্থে পড়তে হয়।”
“ওরকম পড়তে গেলে শেষ হবেনা তো।”
“আচ্ছা পড়ো তবে সময় পেলে অর্থ বুঝে পড়বে কেমন?”
“হুম আচ্ছা।”
জাওয়াদ ওর কপালে চুমু দিয়ে মৃদু হাসলো।
ইফতারের পর কুহু ইশরাকের ফোনে কল দিলো। বরাবরের মতোই সে প্রথমবারে রিসিভ করলো না। ৭ম বার ডায়াল করার পর রিসিভ করে বিরক্ত গলায় বললো,” কেউ যখন কল রিসিভ করে না বুঝতে হয় সে বিজি আছে। একটানা এতোবার কল করা লাগে?”
কুহুর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। সে প্রফুল্ল গলায় বলল, “জানেন তো রিসিভ না করে পারবেন না, তবে প্রথমবারে রিসিভ করলেই হয়। আপনিও বিরক্ত হলেন না আমারো কষ্ট করা লাগলো না।”
“কেন ফোন করেছেন তা বলুন?”
“কোথায় আছেন এখন?”
“অফিসেই কেন?”
“ছুটির পর দেখা হবে তাহলে। আমি আপনার অফিসের সামনে আসছি।”
ফোন রেখে ইশরাক তার কলিগ শাহানার কাছে গেল। ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তুই আমাকে শান্তি দিলি না শানু! কি দরকার ছিল ওকে আমার সব ডিটেইলস দেওয়ার? ”
শাহানা কম্পিউটারে টাইপ করতে করতে বলল,” মেয়েটা দেখতে শুনতে খারাপ না। তাছাড়া সে তোমার প্রতি খুব আগ্রহী। আমার মনে হয় এবার তোমার বিয়েটা করে ফেলা উচিত। বয়স তো কম হচ্ছেনা,,,”
“তাই বলে সম্পূর্ণ অচেনা একটা মেয়েকে বিশ্বাস করবো?”
“কেউই জন্ম থেকে চেনা হয় না। তুমি তো ওকে চেনানোর সুযোগ ই দিচ্ছ না। তোমার লাইফের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্ট হচ্ছে খাওয়া। আর ও তোমার খাওয়া দেখেই পছন্দ করেছে। এটা তো তোমার জন্য প্লাস পয়েন্ট। তাও এমন করো কেন বুঝি না!”
“বেশি কৌতুহলী মানুষ আমার ভয় লাগে। এদের আগ্রহ আসতেও সময় লাগেনা যেতেও সময় লাগেনা।”
“কুহু কে আমার সেরকম লাগছেনা। ও বেশ ম্যাচিওর মেয়ে। ওরা ষোড়শীর মতো আবেগে প্রেমে পড়েনা। যখন পড়ে বুঝতে হবে সত্যিই মনে ধরেছে। তুমি এটলিস্ট সুযোগ দিয়ে দেখতে পারো…”
ইশরাক মাথা চুলকে ভাবতে লাগলো, “দিবে নাকি একটা সুযোগ?”
চলবে…
#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৩১
#আরশিয়া_জান্নাত
৩১
জোবায়ের সাহেব ইজি চেয়ারে বসে কি নিয়ে যেন গভীর চিন্তা করছেন। তার বড় মেয়ে সাবিহা দরজায় নক করে বলল,”আব্বা আসবো?”
“হ্যাঁ আয়।”
“আব্বা আপনার কি বেশি টায়ার্ড লাগছে? শুয়ে রেস্ট নিন। ইফতারের এখনো দেরি আছে তো।”
“সমস্যা নেই। আসরের পর শুয়ে থাকা ভালো না,স্বাস্থ্য নষ্ট হয়। কিছু বলবি?”
“আসলে আব্বা আপনার জামাই একটা পাত্র দেখেছে। ছেলে দেখতে শুনতে খারাপ না।ওদের পরিবারও ঠিকঠাক আছে। উনার ইচ্ছে ঈদের পরপরই মাইশার বিয়েটা সেরে ফেলার। আপনি কি বলেন?”
“ছেলের খোঁজখবর নাও ভালোমতো। তারপর বিয়ের চিন্তা। বিয়েতে তড়িগড়ি করা ভালো না। সারাজীবন যে সম্পর্ক বয়ে বেড়াতে হবে তার বুনিয়াদ মজবুত হওয়া চাই।”
“আমি কিছু বললে উনি বলেন আমরা বেশি বুঝি বলেই ঘরে ২টা উপযুক্ত মেয়ে এখনো ফেলে রেখেছি। বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারছি না। আব্বা কুহুর বিয়ের ব্যাপারে আপনারা সিরিয়াস হচ্ছেন না কেন? ওর পরে তো পাপিয়াও আছে। বয়স তো থেমে থাকছেনা কারো। ”
জোবায়ের সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, “তুমি মাইশার বিষয়ে আর কিছু বলবেনা। ওর মেয়েকে ও যেখানে মন চায় বিয়ে দিক। ওর বুঝ ওর কাছেই থাক। যে স্ত্রীকে সামান্য কথায়ও বাপের বাড়ি নিয়ে খোঁটা দেয় তার সঙ্গে তর্ক করা অহেতুক। আমি তোমাকে শুরুতেই বলেছিলাম এই ছেলে তোমার জন্য ভালো হবেনা….”
সাবিহার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। সাবিহার অবনত মুখ দেখে জোবায়ের সাহেবের ভাবান্তর হলো না। তিনি ফের বললেন,” আমি আমার জীবনে শিক্ষা একবারই নিই। বারবার এক ভুল করা মানুষ আমি নই। আমার বাড়ির ছেলেমেয়েদের বিয়ে আমি অনেক ভেবেচিন্তে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ভাগ্যের লেখা বদলানো যায় না। যা হবার তা হবেই। ইয়াকুব (আঃ) যেমন তার পুত্রদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “যদিও আমি তোমাদের যে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছি, তা ভাগ্যলিপি খণ্ডন করতে পারবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তা রোধ করার ক্ষমতা কারো নেই।”
আমিও তার মতোই সতর্কতা অবলম্বন করছি মাত্র।”
সাবিহা মাথা নেড়ে বাবার কথায় সমর্থন জানিয়ে বললেন,” আব্বা আপনি একবার খোঁজখবর নিয়ে দেখবেন? ও তো আপনারও নাতনী। ওর উপর আপনারও অধিকার আছে তাই না?”
“দাদার মতো নানার দাম নেই সাবু। যদি থাকতো তোমার স্বামী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাকে অবশ্যই জানাতো। সরাসরি বিয়ের দাওয়াত দেওয়ার অপেক্ষা করতো না। তুমি মেয়ের মা বলেই ভালোমন্দের চিন্তা করে আমাকে জানালে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এখানে আমার মতামতের মূল্য হবেনা। তাই আমি বলবো তুমিও এই বিষয়ে আর মাতামাতি করো না।”
“কিন্তু আব্বা..”
“আর কোনো কিন্তু না। আল্লাহর কাছে দোয়া করো যা হবে ভালোর জন্যই হবে।”
সাবিহা নিরবে প্রস্থান করলো। সালমা মেয়ের চোখে পানি দেখে ভেতরে এসে বললো,” কি ব্যাপার সাবুর কি হইছে? ও কান্না করতে করতে গেল কেন?”
“মেয়েটা বয়সেই বড় হয়েছে বুঝলে সালমা, স্বভাব বৈশিষ্ট্যে এখনো সেই ছোট্ট খুকী রয়ে গেছে। অথচ জীবনের চরম সিদ্ধান্তের বেলা এই ছোট্ট খুকিটাই কি দুঃসাহসিকতাই না দেখিয়েছল!!”
“আপনি এখনো এ কথা নিয়ে ওর উপর রাগ?”
“নাহ রাগ হবো কেন? কুমারি আর বিধবা মেয়েকে তাদের সিদ্ধান্তের বাইরে বিয়ে দেওয়া যায় না। ওর পথ ও ধরেছে আমি রাগ করার কে?”
“আপনি এ বাড়ির ছেলেদের বেলা এই ছাড় দেন না, মেয়েদের বেলাই দেন। এটা কি ঠিক?”
“হাহাহা তুমি সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পিছু হটো না। ঠিকই খোঁচা টা জায়গা মতো বসিয়ে দিলে..”
“ভুল বললাম?”
“না ভুল বলোনি। তবে একটা কথা কি জানো সালমা সংসারে মেয়েরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বলে না, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। কথাটা একদম সত্যি। তাই পরের ঘরের মেয়ে আনার সময় আমি কোনো ছাড় দিতে চাই না। হয়তো মেয়েদের বেলাও এটা করতাম যদি না হাদিসে নিষিদ্ধ থাকতো। নয়তো আমার এত আদরের বড় মেয়ে সাবুকে এমন ছেলের কাছে বিয়ে দিতাম!”
“বড় জামাই আবার কিছু করছে? ও কি এই জীবনে ঠিক হবেনা?”
“কিছু মানুষ কখনোই বদলায় না।”
“ওকে পাঁচ রকম করেও মন পাইলাম না। মেয়েকে সুখী করতে কত কি করেছি। যখন যা চেয়েছে দিয়েছি। তাও ও বাড়িতে আমার মেয়ে একটু সম্মান পায়নি। ওর নসীবই খারাপ আসলে…”
“ওসব বাদ দাও। এখন ওসব শুনতে ইচ্ছে করছেনা।”
সালমা আর কিছু বললোনা, কিন্তু চোখ দিয়ে পানি ঠিকই পড়তে লাগলো।
জাওয়াদের মনমেজাজ একদম খারাপ হয়ে আছে। আজকের মিটিংটা ওর জীবনের সবচেয়ে জঘন্য মিটিং ছিল। টেন্ডার টা হাতের নাগালে এসে একটুর জন্য ফসকে গেল। ভাবতেই গা’টা জ্বলুনি দিয়ে উঠছে। বিক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়েই সে নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এসেছে রফিক বা সাম্যর অপেক্ষা করেনি। রাগটা আরো বাড়িয়ে দিতেই বুঝি রাস্তায় এতো লম্বা জ্যাম বেঁধেছে। ইফতারটা না আজ রাস্তাতেই করা লাগে! কথা ছিল মিটিং সাকসেসফুল হলে ওখানেই সবার সঙ্গে ইফতার করবে। কিন্তু সেটা আর হলো না। এখন মাঝরাস্তায় গাড়িতে বসে থাকা ছাড়া আর উপায় নেই।
আরওয়া সাবার পাশে বসে বললো, “ভাবি আজকে ভাইয়াও বাসায় ইফতার করবে না?”
“নাহ”
“আজকে বাসায় এতো গেস্ট অথচ ঘরের ছেলেরাই নেই।”
” ভাইয়াকে মিস করছো বুঝি?”
“তা করছি একটু,,,”
“চিন্তা করোনা সন্ধ্যায় চলে আসবে।”
রোকেয়া হন্তদন্ত হয়ে কিচেনে ঢুকে বলল, “রাহেলা দুলাইভাইয়ের জন্য রুহাফজার মিল্ক শেক করেছিস?”
“হুম মেঝ ভাবি করছি তো।”
“গোলাপজল দিছোস?”
“আইত্তেরি ভুইলাই গেছি। খাড়ান এখনি দিতাছি।”
“সাবা কাবাব বানানো শেষ?”
“হুম সেই কখন..”
“আরওয়া তুই কি বানিয়েছিস দেখি?”
“আমি সবচেয়ে কঠিন আইটেম করেছি আম্মু। তবে আমি সিওর খাওয়ার পর সবাই বলবা সেই হইছে!”
“কি আইটেম শুনি?”
আরওয়া স্বগর্বে বলল, “আমি ক্যারামেল পুডিং বানিয়েছি।”
সাবা আর রাহেলা ওর কথা শুনে ঠোঁট চেপে হাসতে লাগলো। রোকেয়া ওর দিকে তাকিয়ে বলল,”আমার বৌমা টা কি কঠিন রেসিপিই না তৈরি করেছে! তোরা কেউ পারবি এতো কঠিন রান্না করতে?”
সাবা হেসে মাথা নাড়ালো। আরওয়া বললো, “আম্মু দেখো এটা বানানো এতোটাও কঠিন না, ক্যারামেল টা ঠিকঠাক করতে পারলেই সব সহজ…”
“হয়েছে বাবা আমি বুঝেছি এই কঠিন রান্না করার জন্য তোকে অনেক ধন্যবাদ। এখন চল সবাই, ইফতারের সময় হয়ে আসছে।”
সবাই ডাইনিং এ ইফতার সামনে নিয়ে মোনাজাত ধরেছে। এই মুহূর্তে রোজাদার যা দোয়া করে আল্লাহ তায়ালা সেটা পূরণ করেন। তাই সবাই এই সময়টায় নিজেদের মনের যত ইচ্ছে আছে সব এই সময়টায় মোনাজাতে চেয়ে থাকে। সাবার অবশ্য একটাই চাওয়া ওর কোল আলো করে একটা সন্তান আসুক। তার এই মোনাজাতে কুহু, কোহিনূর সহ পরিবারের অনেক সদস্যই অংশীদার হয়। সবার চাওয়া এই একটা পয়েন্টে এসে ঠিকই মিলে যায়। জোবায়ের সাহেব নিজের পুরো পরিবারের দিকে চেয়ে মুচকি হাসেন। আর মনে মনে বলেন, “ওদের সবাইকে মাফ করে দাও আল্লাহ। ওরা যেন মিলেমিশে সুখে শান্তিতে বাস করে।”
জাওয়াদ বাসায় ফিরেছে প্রায় ২ ঘন্টা পর। রাস্তায় পানি আর বিস্কিট দিয়ে রোজা ভেঙেছে। কথায় বলে যেদিন খারাপ হয় সবদিকেই হয়। বাসায় ঢুকে সবাইকে হাসি ঠাট্টা করতে দেখে ওর মন আরো ক্ষিপ্ত হয়। এদের এতো হেহে হিহি আসে কোত্থেকে কে জানে!
ওকে এরকম গম্ভীর মুখে কথা না বলে চলে যাওয়াটা সবার চোখেই পড়ে। রোকেয়া কি একটা আন্দাজ করে আরওয়াকে বলে, “আরওয়া ওর জন্য খাবার আর শরবত নিয়ে যা তো মা।”
আরওয়া শাশুড়ির কথামতো সেসব নিয়ে রুমে যায়। রুমে ঢুকে দেখে জাওয়াদ চুপচাপ বসে আছে। আরওয়া হাসিমুখে খাবারগুলো টেবিলে রেখে বলল,”ফ্রেশ হয়ে খাবার গুলো খেয়ে নিন?”
জাওয়াদ কোনো উত্তর দিলো না। আরওয়া ওর পাশে বসে বললো, “মুড অফ কেন? কিছু হয়েছে?”
“এতো কথা বলো কেন? চুপ করে থাকা যায় না?”
জাওয়াদের ধমক শুনে আরওয়া চুপ হয়ে গেল। জাওয়াদ উঠে ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলো। মাথায় পানি ঢেলে উযু করে মাগরিবের নামাযের কাযা পড়লো। আরওয়া এককোণে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। অন্য সময় এভাবে বকা দিলো ও হয়তো এতোক্ষণে কেঁদেকেটে এক করে ফেলতো। কিন্তু আজ সেটা করছে না। এখন রুম থেকে সরে গেলে যদি জাওয়াদ আর না খায়, তাই আর নড়ছেও না। জাওয়াদ নামায শেষ করে উঠে আরওয়ার দিকে তাকালো। আরওয়া ওর শান্ত চাহনী দেখে সাহস করে কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, “এতো রাগ করে না জনাব শান্ত হয়ে যান তো।”
জাওয়াদ নিরবে তার আলিঙ্গন অনুভব করতে লাগলো। ধীরে ধীরে সব অশান্তি যেন প্রশমিত হয়ে যাচ্ছে।
“ইফতার করেন নি তাই না? দেখি চলুন আগে খেয়ে নিবেন।”
জাওয়াদ ওর চিবুক তুলে বলল, “এগুলো কিভাবে পারো বলো তো? কোথায় শিখেছ এই ফর্মূলাগুলো?”
“কোথায় যেন পড়েছিলাম “One hug can fix everything.” সেটাই এপ্লাই করলাম।”
“ভেরি স্মার্ট!”
আরওয়া তাকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে বললো, “আই নো। নিন শুরু করুন।”
জাওয়াদ হেসে খেতে শুরু করলো। আরওয়াও তার রাজ্যের গল্প খুলে বসলো। সাপোর্টিভ জীবনসঙ্গী সাথে থাকা মন্দ না, বরং শান্তির ই বটে!
।
রিজভীর কল দেখে পাপিয়া হাতের কাজ রেখে ফোন নিয়ে বসলো।
“হেই পাপিতা কি খবর? কেমন আছিস?”
“ভালো তুই?”
“ভালো। বাসায় সবাই ভালো তো?”
“হুম সবাই ভালো। তোর কথা বল। ওখানে সব ঠিকঠাক তো?”
” হ্যাঁ ঠিকঠাক ই তবে সাহরী আর ইফতারে খুব মন খারাপ লাগে। সবাইকে মিস করি অনেক।”
“স্বাভাবিক। এখানে কেউ নেই বললেও অনেকে আছে। উৎসবমুখোর পরিবেশ আছে। ওখানে তোর একা লাগবে স্বাভাবিক।”
“আমি ভুল করেছি রে,বিয়ে করে বৌ সাথে করে আসা উচিত ছিল। আমার এক ফ্রেন্ড স্পাউজ নিয়ে এসেছে। ওর রান্না খাওয়ার প্যারা নাই আর এলোন ও কম লাগে। আমিই ভেজালে পড়ছি।”
“তুই তো বিয়েই করবি না বলছিলি। এখন উল্টা সুর কেন?”
“এখনো মত বদলায় নি পরিস্থিতির স্বীকার। তোকে নিয়ে আসা উচিত ছিল রে। তোর রান্নার হাত যদিও বেশি সুবিধার না বাট আমার চেয়ে বেটার এটা সত্যি।”
“এহহ শখ কত!”
“শপিং করলি?”
” হুম। তুই?”
“নাহ। করার দরকার পড়বেনা। আসবার সময় যা এনেছি সব পড়া হয়নি। নতুন আছে। ”
“তাও ঠিক।”
“আচ্ছা শোন।”
“বল?”
“আমার এখানে একটা ফ্রেন্ড হয়েছে। ব্রিটিশ ছেলে বাট মুসলিম। ওর ইচ্ছে বাংলাদেশী মেয়ে বিয়ে করার। তোর জন্য দেখবো নাকি?”
“বিদেশী ছেলের প্রতি আমার ইন্টারেস্ট নাই।”
“কুহুর জন্য?”
“আপু এখন বিদেশী খোঁজেনা রে। একটা পেটুক ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।”
“বলিস কি রে চিকনাচাকনা কোরিয়ান পোলা বাদ দিয়ে সরাসরি ভোজনরসিক! দেখেছিস আমার কথা ফলেছে..”
“সম্পূর্ণ ফলেনাই। ঐ ভাইয়া ভোজনরসিক হলেও গোপাল ভাড়ের মতো না দেখতে। লম্বা চওড়া সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। আপু তো এই ছেলেকে বাদে কাউকেই বিয়ে করবেনা বলে পণ নিয়েছে।”
“তো সমস্যা কোথায় সবাই রাজী হয়ে যা।”
“সমস্যা হলো ছেলেই তো রাজী হয়নি এখনো!”
” কি বলোস! কুহুকে রিজেক্ট করে এমন ছেলেও আছে?”
” আপু তো বলে ইশরাক ভাইয়া ফুড থেকে চোখ সরালে তো আপুকে দেখতো! হেহেহে….”
“হাহাহা। খুব দারুণ জিনিস মিস করছি রে। আমি ঢাকায় থাকলে সিওর তার সঙ্গে মিট করতাম”
“যদি ওদের ঠিকঠাক হয় মনে হয়না বাসায় কেউ আপত্তি করবে।”
“তোদের হিটলারের ভরসা নাই। সে কখন বেঁকে বসে।”
“বসবেনা। কুহু আপু পাক্কা খেলোয়াড় বুঝলি। সব ইনফরমেশন কালেক্ট করেছে। বলতে গেলে ও একদম কোমরে গামছা বেঁধে নেমেছে। জাস্ট ইশরাক ভাইয়ের হ্যাঁ বলার অপেক্ষা!”
“তুই এমন বড় বোন পেয়েও চালাক হতে পারলি না!”
“আমি বোকা না! যা আছি এনাফ ফর মি”
“ঘোড়ার ডিম! এই বুদ্ধি নিয়ে সংসার করতে পারবি না। না না ভুল হয়েছে। বোকা মেয়েরা বউ হিসেবে জোস। এদেরকে ইচ্ছামতো নাচানো যায়।”
পাপিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুই আসলেই বদ।”
রিজভী হেহে করে হাসতে লাগলো।
চলবে….