কাঁটাকম্পাস পর্ব-২৮+২৯

0
372

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব২৮

#আরশিয়া_জান্নাত

২৮

আমিন সাহেব মেয়ের পছন্দের ফ্লেভারের কেক নিয়ে বাসায় ফিরে দেখলেন আরওয়া বসার ঘরে ভ্রু কুঁচকে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবাকে দেখে আরওয়ার মুখ স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। আমিন সাহেব মেয়েকে এক হাতে জড়িয়ে বললেন, “জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা মামণি।”

“থ্যাঙ্ক ইউ আব্বু।”

“গিফট পছন্দ হয়েছে!”

“অনেক!”

“যাক শান্তি। দেখ এবার কেকটা পছন্দ হয় কি না।”
আরওয়া কেকের বক্স নিয়ে চলে যেতেই তিনি বললেন,”বুঝলে বাবা আমার মেয়ের মনমতো জিনিস খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন। অনেক ভেবেচিন্তে ডিসাইড করতে হয়। তা দাঁড়িয়ে কেন বসো না?”

জাওয়াদ ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে সোফায় বসে বললো, “আপনি ভালো আছেন তো?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমাদের বাসায় সবাই কেমন আছেন?”

“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।”

“আচ্ছা তুমি বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। যা গরম পড়ছে এবার! ”

আরওয়া ফিরে বললো, “আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দেন নি এখনো!”

“কি জবাব দিবো?”

“আপনার তো রাতে আসার কথা ছিল এখন এলেন কেন?”

“আমার শ্বশুড়বাড়িতে আমি যখন ইচ্ছা তখন আসবো। তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে কেন?”

“অবশ্যই করতে হবে। আমার জন্যই এটা আপনার শ্বশুড়বাড়ি হয়েছে। আমাকে উত্তর দিবেন না তো কাকে দিবেন?”

“ঝগড়া করো না তো। আমি এমনিতেই খুব টায়ার্ড। ফ্রেশ হবো, রুমে এসো।”

আরওয়া লেবুর শরবত নিয়ে রুমে গেল। জাওয়াদ ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে লাগলো। আরওয়া ওর দিকে শরবত এগিয়ে দিলে জাওয়াদ সেটা নিয়ে বলল, “তুমি সারাক্ষণ এতো কথা বলো, নিজের বার্থডের কথা একবারও বলোনি কেন? সকালবেলা গাল ফুলিয়ে না রেখে যদি বলে দিতে বেশি সমস্যা হতো? প্রথম বছর জানতে শুনতে সময় লাগেনা বলো?”

“আমার বায়োডাটা দেখার সময় আপনি খেয়াল করেন নি আমি জানবো কিভাবে? মানুষ তার পছন্দের মানুষের ছোটখাটো বিষয়ও নজরে রাখে। আর আপনি তো চোখের সামনে থাকা জিনিস ও দেখতে পান না।”

“তুমি খুব ঝগড়ুটে আরওয়া!”

“হ্যাঁ এখন সব দোষ আরওয়ার। আপনি তো একদম ভালো মানুষ।”

“অবশ্যই এখানে আমার কোনো ফল্ট নেই। এমন না আমাদের বিয়ে হয়েছে বছর খানেক হয়ে গেছে, আর আমি প্রতিবছর ভুলে যাই। তাছাড়া তোমার বোঝা উচিত আমি তোমার উপর শুরুতে ইন্টারেস্টেড ছিলাম না, না আমি এই বিয়েটা নিয়ে সিরিয়াস ছিলাম। তো তোমার বায়োডাটা দেখার সময় জাস্ট এডুকেশন সেক্টরটাই মন দিয়ে দেখেছি। এখন যদি সেটাকে কেন্দ্র করে ঝগড়া করতে থাকো তবে সেটা সম্পূর্ণ তোমার ইমম্যাচিওরিটি। আমার এখানে কিছু বলার নেই!”

“হ্যাঁ সেটাই, আমারই ইমম্যাচিওরিটি।”

জাওয়াদ গ্লাসটা টেবিলে রেখে ওর সামনে দাঁড়ালো, দু’হাত কাঁধে রেখে নরম গলায় বলল, “আমি চেষ্টা করবো এসব ছোটখাটো ব্যাপার মনে রাখার। তুমি আর রেগে থেকো না প্লিজ।”

আরওয়া তার কথায় শান্ত হয়ে বলল, ” আমার গিফট কোথায়?”

জাওয়াদ নিজের দিকে ইশারা করে বললো, “জলজ্যান্ত গিফট দাঁড়িয়ে আছে এটা কি যথেষ্ট নয়?”

আরওয়া ভেংচি কেটে বলল, “ঢং!”

“ঢং হবে কেন! ফারাজ খন্দকার জাওয়াদকে গিফট হিসেবে পাওয়া চাট্টিখানি কথা না ম্যাম!”

আরওয়া ওর গলা জড়িয়ে বলল, “তাই নাহ?”

“বিশ্বাস হয় না?”

“অবশ্যই হয়।”

জাওয়াদ মুচকি হেসে ওর কপালে চুমু খেলো। তারপর আরওয়াকে আয়নার সামনে ঘুরিয়ে পকেট থেকে ডায়মন্ডের পেন্ডেন্টযুক্ত চেইনটা বের করে গলায় পড়িয়ে দিলো। কাঁধে চিবুক রেখে বলল, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! আল্লাহ তোমাকে অনেক সুখী করুক। পছন্দ হয়েছে?”

“হুম অনেক সুন্দর হয়েছে। থ্যাঙ্কস!”

” শুকনো থ্যাঙ্কসে কাজ হবে না।”

“আজকে ডিনারে অনেক আইটেম করা হয়েছে, বিনিময়ে ওসব খেয়ে যাবেন। কেমন?”

জাওয়াদ ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “ঐটা তো কিছু না আনলেও খেতে পারতাম। দিস ইজ নট ফেয়ার আরওয়া!”

“আমি জাতিসংঘের সচিব না, ফেয়ার আনফেয়ার দিয়ে আমার কাজ নেই।”

“আচ্ছা মেয়ে তো তুমি। আমাকে সবসময় বলতে আনরোমান্টিক ক্ষ্যাত! নিজে কি হুম? বরকে স্বেচ্ছায় আদর করেছ কোনোদিন?”

“করিনি?”

“নাহ, একবারও না। বিশ্বাস না হলে নিজেই ভেবে দেখো।”

আরওয়া সত্যি সত্যিই ভাবতে লাগলো কখনোই কি ও কিছু করেনি!!

পাপিয়ার আজ মন ভীষণ খারাপ। ক্যাম্পাসে আসার পর থেকে একা একা ঘুরছে। হিয়াকে ছাড়া ক্লাস করতে একটুও ভালো লাগছে না। এমন না ওর আর কোনো ফ্রেন্ড নেই। তবে হিয়ার সাথেই তার সখ্যতা বেশি। কেন যে ওর বিয়ে হয়ে গেল, সাথে সাথে চলেও গেল চাঁদপুরে। ফাইনাল পরীক্ষার সময় শুধু আসবে হয় তো। পাপিয়া অসহায়ের মতো এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলো। রিজভী ওর মাথায় টোকা দিয়ে বলল,” কিরে এমন অসহায় নারীর মতো মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন? জামাই মরে গেছে নাকি?”

“সবসময় অলুক্ষণে কথা বলিস না তো। জামাই আসলোই না এখনো তুই কি না তাকে মেরেই ফেলছিস?”

“বাব্বাহ জামাইয়ের জন্য এতো দরদ ?”

“অবশ্যই। জামাইয়ের জন্য দরদ হবে না তো কি তোর জন্য হবে! পুরো পৃথিবীতে একটা মাত্র জামাই হবে আমার তার ভ্যালু বেশি হবেনা?”

“তোর কথা শুনে আমি পুরা কেন্দে দিয়েছি!”

“নাটক করিস না রিজভী। এমনিই মেজাজ খারাপ লাগতেছে।”

“কি হইছে? তোর সাথেরটার বিয়ে হয়ে গেছে বলে দুঃখে আছস?”

“হুম…”

“আহারে। তো তুই ও বিয়ে করে ফেল। বসে আছিস কেন?”

“করবো তো আগে কুহু আপুর বিয়ে হোক। তারপর আমার সিরিয়াল।”

“তোর কুহু আপুর কাহিনী বুঝি না। এ বিয়ে করে না ক্যান?”

“আপু মনমতো ছেলে পায় না। উনার কোরিয়ান ছেলে পছন্দ।”

” এখন সব মেয়ের ই ওদের পছন্দ। তাই বলে কি সবাই ঐদেশে চলে গেছে নাকি? দেখবি তোর বোন এমন ছেলেরে বিয়ে করবে যে কোরিয়ার উল্টা ভার্সন। গোপাল ভাড়ের উত্তরসূরী টাইপ বাঙালি পুরুষ!!”

“আমার সেটা মনে হয় না। কত ভালো ভালো ছেলে দেখছে পাত্তাই দেয়নাই।”

“তাহলে তো ১০০% নিশ্চিত থাক। যারা বেশি বাছে তাদের কপালে পছন্দের বিপরীত জুটে।”

“তুই খুব নেতিবাচক। মানুষ জীবনসঙ্গী রুচি অনুযায়ী খু্ঁজতেই পারে। এটাকে খারাপ ভাবিস কেন? সারাজীবন যার সঙ্গে জীবন কাটাবে তাকে যদি পছন্দই না হয় চলে?”

“আমি বলছি না বাছাই করা খারাপ। তবে অতিরিক্ত করলে শেষটা ভালো হয় না। যাই হোক সেতিরে নিয়ে ঝগড়া করতে চাইছি না। চল ক্যাফেতে যাই, গরমে জান যাচ্ছেগা আমার।”

“হ্যাঁ আমি পাগল তো তোর সাথে ক্যাফেতে যাবো আর তুই সামিয়ার বিলটাও আমার কাধে তুলে দিবি….. বলেই পাপিয়া জিভ কাটলো।

রিজভীর হাসিমুখ মুহূর্তেই বদলে গেল, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “সামিয়া!”

পাপিয়া প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো, “তোর ইউকে যাওয়া কনফার্ম হলো?”

“মোটামুটি কনফার্ম। বাবা ভেজাল না করলে এ বছরই হয়তো চলে যাবো ইনশাআল্লাহ!”

“তোরা সবাই চলে যা, ঢাকায় আমার আর কেউ থাকিস না।”

“তোর হাবিগুষ্টি সব ঢাকাতেই আছে। এমন ভং ধরিস যেন একা পড়ে থাকবি!”

“ফ্রেন্ড তো হাতে গণা কয়েকজন ই। তার মধ্যে বেস্ট দুজন ই চলে যাচ্ছিস!”

“ধুরর পাগলী রুলায়েগা কেয়া?”

“নাহ তুই থাকতে থাকতেই বিয়ে করে ফেলতে হবে। নয়তো সত্যিই আমি একা থেকে থেকে বেঁকা হয়ে যাবো।”

“করে ফেল। সামনে বর্ষা আসছে। এসময় বিয়ে করা আরাম!”

“তুই হালা বাক্কা শেয়ানা। সব ঋতুতেই বেনিফিট খুঁজে পাস। গরমে ভালো, বর্ষায় ভালো, শীতে ভালো। সবটাতেই তোর ভালো লাগে!”

“যা সত্যি তাই তো বলি। বিয়ে সব ঋতুতেই জোশ। আমার কি দোষ?”

“হ তোর জন্য! তুই ও করে ফেল। ”

“আমি আর বিয়ে করবো না রে। চিরকুমার থেকে যাবো।”

“ধুরর, ভুল মানুষের জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া বোকামী। এসব অহেতুক চিন্তা মাথায় আনিস না।”

রিজভী ম্লান হাসলো, জবাব দিলো না।

রোকেয়া বিছানায় এমন জোরে ঝাট দিচ্ছে যেন এই বিছানার তোশকের সাথে তার জন্মের শত্রুতা। জহির সাহেব পেপার এর ফাঁক দিয়ে স্ত্রীর মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছেন। এখন উঠে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও সমস্যা, তাই চুপচাপ পেপার পড়ার ভান করেই বসে রইলো। রোকেয়া নিজেই তার সামনে এসে বললেন, “তোমার কাছে পেপার পড়াই সবচেয়ে জরুরি তাই না? বড় ভাইজানকে দেখেছ? কয়দিনের জন্য দেশে ফিরেন, তাও বড় ভাবিকে নিয়ে কত জায়গায় যায়। শপিং করে আনন্দ করে। উনি এমনিতে সবার সামনে খিটখিট করলেও বৌকে ঠিকই ভালোবাসে। ছোট ভাই ও তার বৌকে কত কি কিনে দেয়, প্রতি মাসে ২/৩ বার বাচ্চাদের‌ নিয়ে কতখানে যায়। আর তুমি একই ছাদের নীচে থেকেও একটা দিন আমায় বেড়াতে নিলে না। কিছু বললে বলো বুড়ো হয়ে গেছি। ওদের দেখো একজন তোমার বড় আরেকজন তোমার ছোট। দুই ক্যাটাগরিই দেখিয়ে গেল শখ আহ্লাদের বয়স থাকে না…”

জহির সাহেব কি উত্তর দিবেন বুঝতে পারলেন না। মাথা নাড়িয়ে বললেন, “তোমার কথা একদম ২৪ ক্যারেট খাঁটি। এখানে কোনো খাঁদ নেই। আমিই মিডেলে হয়ে ভেজালে পড়েছি। না বড় ভাই হতে পারলাম না ছোট।”

“সেন্টিমেন্টার এট্যাক করতে এসোনা খবরদার। আমি বলেই তোমার সংসার করছি, অন্য কোনো…..”

“অন্য কোনো মেয়ে হলে কবেই চলে যেত। তোমার এসব গোয়ার্তুমি সহ্য করে এতো বছর সংসার করতো না। আমারই পোড়া কপাল। কত ভালো ভালো সমন্ধ এসেছিল। সেসব বাদ দিয়ে কেন যে তোমাকে দেখে মাত্রই পছন্দ করতে গেলাম। সবই নিয়তি। কথায় বলে না “হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ!” চোখের কথা শোনাই কাল হলো।”

“আমাকে শেষ করতে না দিয়ে তুমি এসব বললে কেন?”

” দেখো তুমি এমনিতেই এতক্ষণ বিছানা ঝেড়ে হয়রান হয়ে গেছ। এখন আবার চেচিয়ে এতো কথা বলতে কষ্ট হবে ভেবে আমিই বলে দিলাম। যত যাই হোক তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী না? তোমার কষ্ট কমানো আমার ফরজ না?”

“মন ভোলানো কথাতেই আছ।”

” ঐটাই যে সম্পদ জনাবা। নয়তো এতো সুন্দরী রমণীকে ঘরনী করে রাখার সাধ্য আমার মতো অধমের ছিল?”

রোকেয়ার রাগ যে পড়ে গেছে তার চেহারা দেখেই বোঝা গেল। তবুও শক্ত গলায় বললো, অতো কথা জানিনা, “আজ আমায় নিয়ে বের না হলে খবর আছে।”

“যথা আজ্ঞা মহারানী”

চলবে,,,,

#কাঁটাকম্পাস #পর্ব২৯

#আরশিয়া_জান্নাত

২৯

ক্লাস শেষে আরওয়া রুমাইসার সাথে গল্প করতে করতে গেইটে এসে দেখে জাওয়াদ গাড়ির সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পড়নে সি গ্রিণ কালার ফর্মাল শার্ট বরাবরের মতো ইন করা, চুলগুলো বেশ সুন্দর করে গোছানো, রোমশ হাতে এশ কালার ওয়াচটা স্বগর্ভে বসে আছে‌। চোখে সানগ্লাস থাকায় দৃষ্টি বোঝা গেল না। আরওয়া দূর থেকে তাকে দেখে মুগ্ধ হলো। মনে মনে বলল, “আল্লাহুম্মা বারিকলাহু। মাশাআল্লাহ আমার বরটা দেখতে এতো দারুণ! কোনো ডাইনির বদনজর না লাগুক।”

রুমাইসা ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল, “ভাই তুই এমনভাবে তোর জামাইয়ের দিকে তাকাই আছস যেন আজকে প্রথম দেখলি! ”

“দোস্ত তুই বিয়ে করলে বুঝবি, জামাইয়ের দিকে তাকাই থাকতেও শান্তি।”

“আমি তোরেই এমন দেখছি। আচ্ছা তুই যা, আমি লাইব্রেরিতে যাবো। আল্লাহ হাফিজ।”

“আল্লাহ হাফিজ”

আরওয়া জাওয়াদের দিকে তাকিয়েই মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেল। আজ সকালেও তো একসঙ্গে বেরিয়েছে কই তখন তো এতো চোখে পড়েনি, নাকি এমন রৌদ্রজ্জ্বল দিনে দূর থেকে দেখায় বেশি আকর্ষণীয় লাগছে?

আরওয়ার চাহনি দেখে জাওয়াদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। সে এগিয়ে ওর কাছে যেতেই আরওয়া কিসব বিড়বিড় করে ওর গায়ে ফুঁ দিয়ে বললো, ‘আমার সাথে থাকা ক্বারিন জ্বিনের ও নজর না লাগুক।”

“আই নো আমি দেখতে অনেক হ্যান্ডসাম, তাই বলে এমন চোখ দিয়ে স্ক্যান করবে! লজ্জা নেই মেয়ে?”

” অন্য কাউকে না নিজের একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষকে দেখছি; লজ্জার কি আছে?”

“কথায় তোমায় হারাতে পারবো না। গাড়িতে উঠো।”

গাড়ির দরজা খুলে আরওয়াকে বসালো। তারপর নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে বলল, “লাঞ্চ করেছিলে ঠিকমতো?”

“হুম। আপনি?”

“হ্যাঁ”

আরওয়া রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললো,”কোথায় যাচ্ছি?”

“যাচ্ছি যেকোনো একটা জায়গায়..”

“বেড়াতে নিচ্ছেন? সিরিয়াসলি?”

“এমনভাবে বলছো যেন আমি কখনো বেড়াতে নিই না?”

“না তা নয়, তবে সচরাচর নেন না তো তাই প্রতিবারই প্রথমবারের মতো এক্সাইটমেন্ট কাজ করে।”

“আচ্ছা!”

মেইন শহর পেরিয়ে অনেকটা দূরেই গাড়ি চলছে। আরওয়া বহুক্ষণ জেগে থাকলেও একটা সময় সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। জাওয়াদ ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো। কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানোর পর মৃদুস্বরে আরওয়াকে ডেকে তুলতেই আরওয়া বললো, “আমরা এখন কোথায়?”

বেরিয়ে এসো। দেখো কোথায় এসেছি।

আরওয়া বের হয়ে দেখলো চারদিকে সবুজ সমারোহ। আরওয়ার চোখ জুড়িয়ে গেল এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করে। জাওয়াদ গাড়ির চাবিটা গার্ডকে দিয়ে আরওয়ার হাত ধরে ভেতরে প্রবেশ করলো। বাহারি গাছপালায় ঘেরা সাদা রঙের একতলা একটা বাড়ি। বাড়িতে প্রবেশ করার আগে ঘাট বাঁধানো বিশাল দিঘী। আরওয়া চারদিক দেখে দেখে এগোতে লাগলো। বাড়ির ভেতর থেকে একজন মধ্যবয়স্কা নারী বেরিয়ে এসে বললেন, “বাবা তুই আসছোস? পথে কোনো অসুবিধা হয় নি তো?”

“আস্সালামু আলাইকুম ফুফু। কেমন আছেন?”

“ওয়ালাইকুমুস্সালাম। ভালো আছি বাবা। এটা তোর বউ? মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর।”

আরওয়া তাকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করল। তিনি তাদের ভেতরে নিয়ে বললেন, “তোমরা হাতমুখ ধুয়ে নাও। আমি তোমাদের নাস্তাপানির আয়োজন করি।”

আরওয়া কৌতুহলীগলায় বলল, “উনি কে? আর আমরা এখানে এসেছি কেন?”

“উনি ফাতেমা ফুফু। দাদাসাহেবের ভাতিজী। উনার ছেলেমেয়ে সবাই বলতে গেলে ফরেনে থাকে। উনি একাই এখানে থাকেন। যদিও অনেকবার বলা হয়েছিল উনার বড় মেয়ের ওখানে থাকতে কিন্তু ফুফু এই বাড়ির মায়া ছাড়তে পারেন না। তাই আমরা সুযোগ পেলেই উনাকে এসে দেখে যাই।”

“ওহ আচ্ছা। অবশ্য যে সুন্দর জায়গা আমি হলে আমিও কোথাও যেতাম না।”

“তাই?”

“হুম”

“আচ্ছা তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও আমি একটু আসছি।”

“কোথায় যাচ্ছেন?”

“দেখে আসতে সব ঠিকঠাক আছে কি না।”

“আচ্ছা”

জাওয়াদ চলে যাওয়ার পর আরওয়া হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। ফাতেমা বাহারি পদের নাস্তা টেবিলে সাজিয়ে বললেন, “বৌ এদিকে আসো।”

“ইয়া আল্লাহ! ফুপী আপনি এতো আয়োজন করতে গেলেন কেন?”

“শোনো মেয়ের কথা! বেশি কিছু আর করতে পারলাম কই। শরীরে যখন বল ছিল আরো কত কি করতাম। এখন তো আগের মতো কিছুই করতে পারিনা, মলি,পলি সাহায্য করায় যা একটু করেছি। কই রে তোরা এদিকে আয়। দেখে যা তোদের ভাবিকে।”

দুটো কিশোরী মেয়ে লাজুক ভঙ্গিতে আরওয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো। ফাতেমা বললেন,” বুঝলে বৌ এই বুড়ো বয়সে ওরাই আমার লাঠি। দুটো বোন মিলে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে রাখে। তোমাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছে বলে চুপ করে আছে। একটু থাকলে বুঝবে কি করে ওরা।”

আরওয়া ওদের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করলো। জাওয়াদ এসে বলল, ” ফুফু তুমি আমাদের জানালে না কেন উত্তর পাশের দেয়ালটায় মেরামত করানো লাগবে? আর এখানে চোর এসেছিল সেটাও তো বলোনি? আমি এখানে সিসি ক্যামেরা সেট করানোর ব্যবস্থা করছি। সিকিউরিটি তে আরো দুজন লোক রাখছি।”

“তুই অযথাই এতো উত্তেজিত হচ্ছিস। আমার পরে এখানে আর কেউ এসে থাকবেনা। এতো কিছু ঠিক করে লাভ কি?”

“এটা কেমন কথা! তুমি তো আছ, তোমার নিরাপত্তা নিয়ে ভাববো না?”

“ওসব রাখ, দেখি খেতে বস।”

জাওয়াদ চেয়ারে বসে বলল, “কি রে তোরা আজ এত চুপচাপ? ওকে দেখে ভদ্র হয়ে গেলি? আরেহ ও তোদেরই দলের লোক।”

পলি বলল– “ভাইয়া নতুন ভাবির সামনে এমন বলিও না।”

“আচ্ছা যা কিছু বলছি না। শুধু এবার বাদড়ামী না করলেই হলো। আয় তোরাও বস। ফুফু বসো না”

সবাই একসঙ্গে খেতে খেতে গল্প করতে লাগলো।

কুহু লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে বাসার দিকে যাচ্ছিল। রোডসাইডের ফুডকার্টে নজর যেতেই দেখে সেদিনের ঐ লোকটা গরম গরম লুচি আর চিকেন চাপ খাচ্ছে। কুহু হাত নাড়িয়ে খানিকটা জোরেই বলল, “হেই ভল্লা!”

লোকটা ফিরেও তাকালো না অন্যদের সঙ্গে গল্প করতে করতে খেতে লাগল। কুহু সামনে এসে বলল, “কি ব্যাপার ভল্লা সাহেব কতবার ডাকছি রেসপন্স করছেন না কেন?”

সে ভ্রু উঁচিয়ে বললো,”স্যরি? আপনাকে ঠিক চিনলাম না?”

“আরেহ ঐ যে ঐদিন রেস্টুরেন্টে দেখা হয়েছিল, আপনি বিগ সাইজের বার্গার খাচ্ছিলেন মনে নেই?”

“কি জানি ভাই, আমি তো কতখানেই খেতে যাই। কয়টা মনে রাখবো।”

“আচ্ছা মনে না রাখেন আপনিই বলুন আপনার সঙ্গে আলাপ না হলে কি আমি আপনার নাম জানতাম?”

তার পাশে থাকা একটা ছেলে বললো, “কি নাম বললেন শুনি?”

“কেন ভল্লা!”

“ভল্লা?”

বলেই সবাই হেহে করে হেসে উঠলো। “এটা আবার কেমন নাম?”

“কেন উনিই তো বললেন অবশ্য আমারও মনে হয়েছিল এটা কেমন নাম! পরে ভাবলাম বাবা মায়ের ইচ্ছের তো অভাব নেই। শখ করে কত আজগুবি নাম ই না তারা রাখেন। যেমন আমারটাই দেখেন কোকিল ডাকা দিনে হয়েছি বলে আমার নাম রেখে দিলো কুহু। আবার আমাদের এক স্যারের নাম ফকির, এক ম্যামের নাম পেয়ারা! এরকমই হয়তো উনাকে ছোটবেলায় ভল্লা কামড়েছে তাই উনার নাম ভল্লা।”

তার কথা শুনে উপস্থিত সবাই বেশ মজা পেলো। কিন্তু ভল্লা ছদ্মনামের লোকটার বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।

একটা মেয়ে কোনোমতে হাসি চেপে বলল, ” তোমার লজিক বুঝলাম আপু। কিন্তু ওর নাম ভল্লা না। ওর নাম হলো ইশরাক। তুমি ওকে এই ফানি নামে আর ডেকো না।”

“নাইস নেইম! থ্যাঙ্কস আপু। আপনারা কি আশেপাশে কোথাও জব করেন নাকি?”

“হ্যাঁ এই যে সামনের বিল্ডিংটা দেখছো ওখানেই আমরা জব করি। ব্রেকে এসেছি নাস্তা খেতে। তুমিও জয়েন করো?”

“না আপু ঠিক আছে।”

কুহু ইশরাক থেকে এমন বলাটা আশা করছিল কিন্তু সে তাকে নিরাশ করলো। কুহু বলল, ” এটা কি খেতে খুব মজা? আমি এতো কথা বললাম আপনার মনোযোগই সরলো না?”

ইশরাক বলল, “অচেনা কারো সঙ্গে কথা বলার চেয়ে তেল মশলার কম্বিনেশন পারফেক্ট হলো কি না তা যাচাই করা বেশি ভালো।”

“আপনি ফুড ব্লগ করেন নাকি? চ্যানেলের নাম কি?”

“আমি ফুড লাভার ফুড ব্লগার নই।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং। মামা আমাকেও সেইম প্ল্যাটার দিন তো। আমিও খেয়ে দেখি কেমন মজা।”

অন্যরা একে অপরের দিকে চোখের ইশারায় হাসতে লাগলো।

“এই শোনো”

“হুম বলো?”

“তুমি আজান দিতে পারো?”

“কেন?”

“বলো‌না। আজান পুরো টা মুখস্ত আছে?”

“হুম পারি তো।”

“শোনাও তো…”

নাহিয়ান কাজ রেখে সাবার দিকে ফিরে বলল,” হঠাৎ আজান এর কথা আসছে কেন কি হয়েছে?”

“আমি একটা পাকিস্তানি ড্রামায় দেখেছি ওদের যখন বেবি হলো নায়ক তার বাচ্চার কানের কাছে আজান দিচ্ছিল। দৃশ্যটা এতো সুন্দর আর মনোরম। আমার চোখে পানি চলে এসেছে। এই শোনো আমাদের যখন বাবু হবে তুমি ওকে কোলে তুলে প্রথমেই ওর কানের কাছে আজান দিবে কেমন?”

নাহিয়ান ওর দিকে স্নেহার্দ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,”এটা তোয়ার বলে দিতে হবে পাখি? আমি অবশ্যই সেটা করবো।”

সাবা উঠে ওর কোলে বসে গলা জড়িয়ে বলল, “আমাদের কবে বাচ্চা হবে নাহিয়ান? কবে আমরা ছোট্ট ঐটুকুন পুতুলকে বুকে নিবো? আদরে আহ্লাদে প্রাণ জুড়াবো? আল্লাহকে বলো না তাড়াতাড়ি আমার কোল যেন আলো করে দেয়…..”

সাবার চোখ দিয়ে নিরবেই পানি ঝরতে থাকে। নাহিয়ান ওকে বুকে চেপে বলে,” এতো অধৈর্য হয়োনা। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাকে সন্তানের জননী করবে। ইনশাআল্লাহ!”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে