কাঁটাকম্পাস পর্ব-২৬+২৭

0
357

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব২৬

#আরশিয়া_জান্নাত

সাবা সবার জন্য বিকালের নাস্তা বানাচ্ছে, তাকে আরওয়া ও রাহেলা সাহায্য করছে। নাহিয়ানের আজ নাইট শিফটে ডিউটি। তাই সে এখন বাসায় নিজের রুমে বসে টুকটাক স্টাডি করছে। সাবা মূলত তার আবদার রাখতেই এই সময়ে রান্নাঘরে ঢুকেছে।

সালমা বাইরের ঘরে বসে আপনমনে যিকির করছেন। এমন সময় কোহিনুর বললেন, “আম্মা আপনার সঙ্গে একটা জরুরী কথা বলার ছিল।”

“কি কথা বড় বৌ?”

“আম্মা এখানে না, আপনার ঘরে চলেন।”

সালমা উঠে নিজের ঘরের দিকে গেলেন। কোহিনুর দরজা আটকে ধীর গলায় বলল, “আম্মা আপনার বড় ছেলে কি শুরু করেছে জানেন?”

“না বললে জানবো কিভাবে? কি করছে?”

“উনি নাহিয়ানের জন্য মেয়ে দেখছেন। লোকও ঠিক করেছেন পাত্রী দেখতে….”

“এটা কি কথা! ওর বউ থাকতে আবার বিয়ে কেন?”

“ওদের বাচ্চা হচ্ছেনা বলে উনি এসব পাগলামী শুরু করেছেন। আম্মা আপনিই বলেন নাহিয়ান যদি এসব শুনে ও কি শান্ত থাকবে? আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছেনা আমি কি করবো?”

সালমা বিরক্তস্বরে বললেন, “মেয়ের বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে বিবাহিত ছেলেরে আবার বিয়ে করানোর ফন্দি আটতেছে। ওদের বিয়ে হইছে কয় বছর হইছে! মানুষের বিয়ের ১০/১৫ বছর পর ও বাচ্চা হয়। আল্লাহ চাইলে ৮০ বছরেও ছেলের বাপ হওয়া যায়। আমাদের নবী ইব্রাহীম (আ), যাকারিয়া (আ) শেষ বয়সে ছেলের বাবা হয় নাই? এত অধের্য হবার কি আছে?”

কোহিনুর মাথা নেড়ে শাশুড়ির কথায় সম্মতি জানালেন। সালমা বললেন, “আমার ছেলে বিদেশ থাকতে থাকতে মন পাথর হয়ে গেছে। তুমি এ নিয়ে চিন্তা করো না। আমি ওরে বুঝাই বলবো ঘরে অযথা অশান্তি করার কোনো দরকার নাই।”

“কিন্তু আম্মা উনি যদি না শুনতে চায়?”

“ও শুনবে না ওর ঘাড় শুনবে।”

নাহিয়ান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসার ঘরে গেল।সাবাকে না দেখে বুঝলো মহারাণী এখনো কিচেনেই আছেন।

“বলি আর কত ক্ষণ লাগবে আপনার? এতো সময় তো বিয়ে বাড়ির বাবুর্চির ও লাগেনা…”

“এই তো হয়ে গেছে আর একটু…”

নাহিয়ান বসার ঘরে বসে টিভি অন করলো। কুহু আর পাপিয়া গল্প করতে করতে সেখানে উপস্থিত হতেই নাহিয়ান বলল, “কি রে গাট্টবাট্টু কি খবর তোদের?”

কুহু বললো, “ভাইয়া গাট্টুবাট্টু ছেলেদের নাম। আমরা ছেলে না!”

“উপমাগত তো মিল আছে ওতেই চলবে।”

পাপিয়া বলল, “ভাইয়া তোমাদের হসপিটালে আমার একটা ফ্রেন্ড যাবে। ওকে একটু দেখিও তো।”

“দেখলাম সমস্যা কি! শুধু ভিজিট ঠিকঠাক দিলেই চলবে।”

কুহু– “ছোটবেলায় তো ঠিকই কম্পোজিশন লিখতি ফ্রিতে চিকিৎসা করবি। বড় হয়ে ভিজিট নিয়ে চিন্তা করিস কেন?”

নাহিয়ান–“ছোটবেলায় আমরা কত কথাই বলি। সব কি পালন করি?”

পাপিয়া– “ভাইরে ভাই তুই এতো হিসাবি? এমনভাবে বলছিস যেন ও তোকে ভিজিট না দিয়ে ফ্রিতে চেকাপ করাতে যাবে। যা আমি ওকে বলে দিবো যেন এক টাকাও কম না দেয়।”

নাহিয়ান– ” এই তো এবার গিয়ে বোনের মতো কথা বললি। দেখ ভাই আমি গরীব সরিব মানুষ, রুগি দেখে যে ক’টা টাকা পাই তা দিয়েই তো কোনোরকম সংসার চালাই। আমার সাধ থাকলেও সাধ্য নাই।”

কুহু— “হইছে আর গলা শুকাইস না ভাই। দিনদিন হাড়কিপ্টে হয়ে যাচ্ছিস!”

সাবা ট্রে হাতে প্রবেশ করে বললো, “কে হাড়কিপ্টে হয়ে গেছে?”

কুহু–“কে আবার আমাদের ডাক্তার সাহেব।”

নাহিয়ান–” দেখেছ বউ আমাকে একা পেয়ে তোমার এই জংলি ননদ দু’টো কিসব অপবাদ দিচ্ছে?”

কুহু–“জানো ভাবি তোমার বর এতো হিসাবী হয়েছে রুগি দেখার আগে ভিজিটের চিন্তা করে।”

সাবা– “কি আর করবে তেমন রুগী আসেনা তো তার চেম্বারে। ভাগ্যক্রমে যে কয়টা আসে তাদের থেকে বেশি করে আদায় করতে চায়।”

নাহিয়ান মুখ ভোতা করে বললো, “এটা কি হলো? তুমি আমার পক্ষ না নিয়ে উল্টো ওদের সাথে দল পাকালে? এই দিন দেখার জন্য আমি তোমাকে এত ভালোবেসেছি? এ ধরণী দ্বিধা হও আমি ঢুকে যাই…..”

কুহু আর পাপিয়া হেহে করে হাসতে লাগলো। সাবা বললো, “তুমি নাট্যকলায় ভর্তি হলে আরো বেশি ভালো হতো। এতো অভিনয় পারো। দেখি নাও খেয়ে দেখো সব ঠিকঠাক হয়েছে কিনা।”

” নাহ এতো অপমান শেষে আমার গলা দিয়ে আর খাবার নামবে না। তোমরাই খাও।”

সাবা ওর সামনে নাস্তার প্লেট ধরে দাঁড়ালো। নাহিয়ান ভয়ে ভয়ে প্লেটটা হাতে নিয়ে বললো, “আমি নেহাতই অবলা প্রাণি বলে তোমরা সবাই আমায় চেপে বসো। এ ঠিক না; এ ঘোরতর অন্যায়।”

কুহু– “বল যে ভাবির রান্না খাওয়া মিস করতে চাস না। অথচ ভান করছিস বাধ্য হয়ে নিলি।”

নাহিয়ান ওর ঝুটি টেনে বলল, ” তুই বেশি পেকে গেছিস। তোরে যে কেন এখনো বিদায় করতে পারলাম না!!”

“ভাইয়া তুই সবসময় এমন করিস। জানিস ঝুটি টান দিলে পুরো চুলটাই এলোমেলো হয়ে যায়?”

“আমি জানবো কিভাবে আমি কি ঝুটি বাধি নাকি? ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে আনা মেয়ের কত ঢং; দেখো!”

“তোকে ডাস্টবিন থেকে এনেছে আমাকে না।”

“আমি আগে হয়েছি তুই না। আমার এখনো মনে আছে তোকে যখন এনেছিল তোর গা থেকে ময়লার গন্ধ আসছিল। কতদিন আমি তোকে কোলে তুলিনি গন্ধের কারণে। আমার তো মনে হয় এখনো তোর থেকে সেই স্মেলটা বেরোয়…”

দাদাসাহেব সেখানে আসার আগ অবদি তাদের এই ঝগড়া চলতে থাকলো।

আরওয়া জাওয়াদের জন্য খাবার নিয়ে নিজেদের রুমে ঢুকে দেখে জাওয়াদ ফ্লোরে শুয়ে আছে। ওকে এমন অবস্থায় দেখে সে দ্রুত ওর কাছে গিয়ে বললো, ‘এই আপনার কি হয়েছে মেঝেতে শুয়ে আছেন কেন? আপনি ঠিক আছেন?”

জাওয়াদ ওকে টেনে বুকের মাঝে নিয়ে বললো, “এতোক্ষণ কোথায় ছিলে? তোমার বরটা যে ঘরে একা বসে আছে মাথায় নেই?”

আরওয়া উঠার চেষ্টা করে বললো, “আপনি তো কাজ করছিলেন, ল্যাপটপে ঢুকলে আপনার হুশ থাকে?”

“এই মেয়ে এতো নড়চড় করছো কেন? চুপটি করে শুয়ে থাকো তো।”

“আপনি বিছানায় না শুয়ে নীচে শুয়ে আছেন কেন তা বলুন আগে?”

“আমার এলোন লাগলে আমি ফ্লোরে শুয়ে থাকি। এটা আমার ছোটবেলার অভ্যাস!”

আরওয়া ভ্রু কুঁচকে বললো, “এ কেমন অদ্ভুত অভ্যাস! আর একা লাগছিল কেন? আমরা সবাই তো আছিই?”

জাওয়াদ দু’হাত প্রসারিত করে বললো, “একা মানেই একলা বসে থাকা বোঝায় না। কোলাহলে মানুষ আরো বেশি একা হয়। সেটা তুমি বুঝবেনা।”

আরওয়া উঠে হাঁটু উঁচু করে বসলো, হাঁটুতে চিবুক রেখে বললো, “এখানে অন্যদের চেয়ে আপনি একটু আলাদা।”

জাওয়াদ উঠে আরওয়ার গা ঘেঁষে বসে বলল, “তোমার কাকে পছন্দ? অন্যদের নাকি আমাকে?”

আরওয়া হেসে বললো, “বিপরীত চার্জে আকর্ষণ বেশি থাকে। আমি যেহেতু ওদের মতোই তাই আমার আপনাকে অধিক পছন্দ;”

জাওয়াদ ওর কথা শুনে মুচকি হাসলো।

“আরওয়া জানো?”

“হুম?”

“হয়তো আমি ক্রমান্বয়ে তোমার প্রেমে পড়ছি…”

“আহারে! আপনার প্রেমিকার কি হবে তাহলে?”

“সেটাই তো ভাবছি! আমায় খু*ন না করে
ফেলে!!”

আরওয়া ওর কাধে মাথা এলিয়ে হাসতে লাগলো। জাওয়াদ বললো, “আমার মাঝেমাঝে কি মনে হয় জানো?”

“কি মনে হয়?”

“তোমার মাথার স্ক্রুটা আর খুঁজে পাবোনা।”

“সমস্যা নেই আপনার থেকে দু’টো ধার নিয়ে লাগিয়ে নিবো।”

“তাহলে আমার কি হবে?”

“বোকা হয়ে যাবেন। শুনেন নি প্রেমে পড়লে বুদ্ধিমান রা বোকা আর বোকারা বুদ্ধিমান হয়ে যায়! আপনার সেই দশা হবে আর কি। হেহেহে”

জাওয়াদ নিজের মাথা চুলকে বললো, ” তবে কি আমি সত্যিই বোকা হয়ে যাচ্ছি?!”

চলবে,,,

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব২৭

#আরশিয়া_জান্নাত

২৭

কুহু বই পড়া বাদ দিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। শরৎচন্দ্রের “গৃহদাহ” উপন্যাসটা অর্ধেক পড়ে মাথাটা টগবগ করছে। সে এখন বাইরে না গেলে কিছুতেই হবে না। পার্স আর ফোন হাতে নিয়ে সে ঐ অবস্থাতেই বেরিয়ে পড়লো। সময় তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা। ঢাকা শহরে এটা তেমন রাত না বললেই চলে। কুহু গাড়ি থেকে নেমে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। পছন্দসই খাবার অর্ডার করে টোকেন নিয়ে একদম মাঝখানের টেবিলটায় গিয়ে বসলো। মাঝখানে বসা যদিও ওর পছন্দ না। তবে এই মুহূর্তে অধিক কোলাহোল ই পারবে ওর মনোযোগ বিচ্যুত করতে। চারদিকে সবাই যার যার মতো গল্প করে যাচ্ছে, কুহু সেসব গল্পের অংশবিশেষ ভালোই মন দিয়ে শুনছে। হঠাৎ একটু দূরে একজনকে দেখে তার চোখ আটকে যায়। সে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই মানুষটার দিকে। মাঝারি গড়নের হেলদি একটা ছেলে। বেশ তৃপ্তির সাথে বিগ বাইট দিয়ে ফাইভ লেয়ারের বার্গার খাচ্ছে। কেউ খাওয়ার সময় তাকিয়ে থাকা ঠিক না কিন্তু কুহুর দৃশ্যটা দেখতে দারুণ লাগছে। তার ফুড রেডি হতেই সে কাউন্টার থেকে খাবার নিয়ে নিজের সিটে না বসে ঐ ছেলের সামনে গিয়ে বলল, “ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আমি কি এখানে বসতে পারি?”

ছেলেটা মুখের খাবার শেষ করে বললো,”স্যরি? এখানে তো আরো অনেক সিট খালি আছে।আপনার এখানে বসতে হবে কেন?

কুহু অনুরোধের স্বরে বলল, “প্লিজ মানা করবেন না। আমি ভেবেছিলাম একা একা ফুড ইনজয় করবো। কিন্তু এখানে সবাইকে ফ্রেন্ডস ফ্যামিলির সঙ্গে দেখে নিজেকে অরফান লাগছে। আপনিই একমাত্র একা আছেন তাই ভাবলাম এখানেই বসি!”

বলেই সে উত্তরের আশা না করেই বসে গেল অপজিট চেয়ারে।

ছেলেটা একটু ভড়কে গেলই যেন। মনে মনে বিরক্ত ও হলো বোধহয়। কুহু ফিশ ফিঙ্গার খেতে খেতে বললো, “আপনি থেমে গেলেন কেন? খাওয়া শুরু করুন। বাই দ্য ওয়ে আমি রোদেলা আপনি?”

“ভল্লা।”

“ভল্লা?”

“হ্যাঁ। কেন নামটা সুন্দর না?”

“এই নামটা এই প্রথম শুনেছি তো তাই আর কি! আচ্ছা আপনি কি ডিস্টার্ব ফীল করছেন? এমন নাকমুখ কুঁচকে আছেন যে!”

“নাহ তেমন নয়। এমন এক্সপেরিয়েন্স আগে হয় নি তো তাই হয়তো এমন দেখাচ্ছে।”

বলেই সে হাতের ইশারায় ওয়েটার কে ডেকে বললো বাকিটা প্যাক করে দিতে। কুহু বুঝতে পারলো সে তার উপস্থিতি পছন্দ করেনি। হয়তো সে আয়েশ করে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে প্রতিটা কণা উপভোগ করতে চাচ্ছিল। কুহু উড়ে এসে বাগড়া দিয়েছে। কুহু ওয়েটার কে বলল, “ভাইয়া প্যাক করতে হবে না। আপনি যেতে পারেন।” তারপর সামনে তাকিয়ে বললো,” স্যরি ফর ডিস্টার্বিং। ইনজয় ইউর ফুড।”

বলেই উঠে চলে গেল। ভল্লা নামক লোকটা সেটা বিশেষ গায়ে মাখলো না। বরং খুশিমনেই খাওয়ায় মনোনিবেশ করলো। কুহু দূরের টেবিলে বসে ব্যাক ক্যামেরায় সেটা ভিডিও করতে লাগলো। ফোনের দিকে তাকিয়ে হেসে নিজের খাবার খেতে লাগলো। “খাওয়ার সময় কাউকে দেখতে এতো কিউট লাগে! ওয়েএএ ইচ্ছে তো করছে ফুলকো লুচির মতো গাল দুটো টেনে দিতে…..”

আরওয়া ভার্সিটির জন্য তৈরি হয়ে বইপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিল তখন জাওয়াদ ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,” এই টাইটা বেঁধে দাও তো।”

আরওয়া ত্যাড়া গলায় বললো, “কে যেন বলেছিল “আমার কাজ আমি নিজে করতে পছন্দ করি।” ??”

“সবকিছু মুখস্ত করে রেখেছ নাকি?”

“অফকোর্স! এতো সহজে ভুলবো নাকি? আমার জীবনের প্রথম বাসর বরবাদ করেছেন, প্রথম চুমু বরবাদ করেছেন। আপনার কথা ভোলা এতো সোজা?”

জাওয়াদ ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, ” মাথা ভর্তি আমায় নিয়ে ঘুরলে পড়া রাখবে কোথায়?”

“পড়া পড়ার জায়গায় স্বামী স্বামীর জায়গায়। মেয়েদের স্মৃতিশক্তি এসব ক্ষেত্রে খুব প্রখর হয় বুঝলেন? সো বি কেয়ারফুল!”

জাওয়াদ আলতো হাতে ওর চুল সরিয়ে কাধে নাক ঘষে আদুরে গলায় বললো, “সকাল সকাল মেজাজ এতো গরম হয়ে আছে কেন? আমি কি কিছু করেছি?”

আরওয়ার রাগ নিভে আসতে চাইলেও সে নাক ফুলিয়ে বললো, ” আমি আপনাকে ভুল নাম দিয়েছিলাম। আপনি রোবট না। রোবট রা সব মনে রাখে।”

জাওয়াদ মাথা চুলকে বললো,”আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। খুলে বলবা তো কি হয়েছে? না বললে বুঝবো কি ভাবে?”

“নতুন করে আর কি হবে। যা দূর্ঘটনা হবার তা তো ৬ মাস আগেই হয়েছে। আমিই বলদি, এক্সপেক্টেশন রেখে বসে আছি।”

বলেই হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।জাওয়াদ বোকার মতো চেয়ে রইলো, ঘটনা কি হলো। একটু টাই বাধতে বলায় এতো কথা শুনিয়ে দিলো মেয়েটা!

গাড়িতে বসেও আরওয়া কোনো কথা বললো না। জাওয়াদ এটা সেটা জিজ্ঞাসা করলেও বিশেষ উত্তর দিলো না। অফিসে বসে জাওয়াদ ভাবতে লাগলো কাল সে কি কি করেছে, কোন আচারণে আরওয়া এমন রেগে আছে সম্ভাব্য কারণসমূহ চিহ্নিত করতে। কিন্তু না বহু ভেবেও তেমন কিছু উদ্ধার করতে পারলো না। বিরক্ত হয়ে নিজের কপাল নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছে করছে।

সাম্য তার অস্বাভাবিক অবস্থা পরোখ করে বলল, ” স্যার আপনি ঠিক আছেন? আপনাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। কোনো সমস্যা?”

জাওয়াদ কপাল ঘষে বললো, “আচ্ছা সাম্য মেয়েদের সম্পর্কে তোমার আইডিয়া কেমন? আই মিন তাদের হাবভাব বুঝতে পারো?”

সাম্য ঘাড় নেড়ে বললো, “এত বছর একসঙ্গে থেকে আমার ছোটবোনের মনমেজাজ ই বুঝতে পারলাম না স্যার। অন্যদের টা আর কি বুঝবো। ওদের ফিচারটাই খুব ক্রিটিক্যাল; এক আল্লাহ ছাড়া কেউ বুঝবেনা।”

“একদম ঠিক বলেছ”

জাওয়াদ মনে মনে রিপিট করতে লাগল আরওয়া ওকে বলেছে রোবটরা সব মনে রাখে, আবার বলল সে এক্সপেক্টেশন রেখেছিল। নাহ সব ক’টা কথা আগপিছ করেও বিশেষ কিনারা করা যাচ্ছে না।

রিজভী ক্যান্টিনে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। ওদের মধ্যে একজন টেবিল চাপড়ে গান গাইছে, আরেকজন তার সাথে গলা মেলাচ্ছে। কিছুদিন পরেই তারা মাস্টার্স শেষ করে বেরিয়ে যাবে। রিজভীর বাবা অবশ্য ঠিক করে রেখেছেন ছেলেকে তার বিজনেসে নিবেন। কিন্তু রিজভীর মাথায় অন্য প্ল্যান। সে অলরেডি কাগজপত্র ঠিকঠাক করে ফেলেছে, মাস্টার্স দিয়েই ফরেন চলে যাবে। সামিয়ার স্মৃতি ভুলতে হলে তাকে চেনা গন্ডি পেরিয়ে অনেক দূরে যেতে হবে।

পাপিয়া নোটস তুলতে তুলতে বলল, “যাক ফাইনালি তোর বিয়ের দাওয়াত মিললো। এবার খুশিমনে স্বামি সংসার নিয়ে বিজি থাকবি।”

হিয়া বলল,”আব্বু চাচ্ছিল আমি জব করি। এতোবছর খরচা করে পড়াশোনা করিয়েছে। কিছুটা হলেও ফিন্যান্সিয়াল সাপোর্ট আশা করেছিল বোধহয়।”

“জব করতে চাইলে বিয়ের পর ও তো করতে পারবি। সবসময় তো ভালো প্রপোজাল আসেনা। ”

“পারবো না রে। উনি বলেছেন জব করা উনার পছন্দ না। তাদের সংসারে কোনো কিছুর অভাব নেই। উনারা এমন মেয়ে চায় যে মন দিয়ে সংসারটা আগলে রাখবে। এমনটা সরাসরিই বলেছিল।”

“এটা খারাপ না কিন্তু। তবে তোদের পারিবারিক অবস্থা অনুযায়ী আঙ্কেলের অবর্তমানে তুইই বলতে গেলে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তোর বাকি দুই ভাইবোন তো এখনো মাধ্যমিক পেরোলো না। আঙ্কেলের এক্সপেক্টেশন কে দোষ দিতে পারি না।”

“দোষ আমিও দেই না। আমি জানি মধ্যবিত্তদের সীমাবদ্ধতা অনেক। আমার জায়গায় যদি ছেলে হতো আব্বুর মাথার উপর থেকে বোঝা কিছুটা হলেও কমতো। তিনি হয়তো ছেলে মেয়ের মাঝে তফাতটা মানতে চান নি। আশা রেখেছিলেন এখনের যুগে এসে অন্তত তার মেয়ে এমন ছেলে বিয়ে করতে চাইবেনা যে জব করা এলাউ করবেনা।”

“মন খারাপ করিস না। মানুষ ১০০% পায় না। এখানে উনাদের অন্য ডিমান্ড নেই, বিয়ের সকল খরচাও তারা বহন করছে। বলতে গেলে তোর জন্য পারফেক্ট প্রপোজাল। তুই সবসময় টেনশন করতি বিয়ের খরচা দিতে গিয়ে আঙ্কেলের না সমস্যা হোক। আল্লাহ তোর মনের আশা পূরণ করেছে। আমার দাদী বলেন রিজিক এর ব্যবস্থা আল্লাহ আগেই করে রাখেন। আমরা অযথাই টেনশন করি। দেখা গেল তোর ইনকাম বাদেও তোদের সংসার ভালোই কাটবে। তোর ভাই-বোন, মা-বাবার রিজিক অনুযায়ী বরকত আসবেই।”

“জানি না। নিজেকে কেমন স্বার্থপর লাগছে। আমাদের বাসার সবাই অবশ্য এই বিয়ে নিয়ে খুব খুশি। দেখি আল্লাহ ভাগ্যে কি রেখেছেন।”

“যা হবে ভালোই হবে। চিন্তা করিস না।”

“তোর নোট তোলা শেষ? আমাকে আবার শপিং এ যেতে হবে। উনারা আজকে বিয়ের শপিং করবেন বললো।”

“এই তো আরেকটু..”

হিয়া আনমনে মাথার উপরের জারুল গাছটায় চেয়ে রইলো।

ভার্সিটি থেকে বাসায় না ফিরে আরওয়া নিজেদের বাসায় গেল। তাকে দেখে করিমুন্নেসা আপ্লুত স্বরে বললো, ” সকাল থেইকা তোর লাই বই রইছি। কতক্ষণছ আইবি আর আই তোর ফচন্দের ছড়া ফিডা খাওয়ামু।”

আরওয়া দাদীর পাশ ঘেষে দু’হাতে গলা জড়িয়ে বসে রইলো। করিমুন্নেসা নাতনির মন খারাপ টের পেয়ে বললেন, “কি হইছে বু এন বেজার হই আছত ক্যান? হেতের লগে আবার কাইজ্জা কইরছত ক্যান?”

“দাদীজান, উনি আমাকে উইশ করেনাই। হয়তো জানেও না আজকে আমার বার্থডে। মানুষ এত কেয়ারলেস হয় বলো?”

“হেতে কি তোর স্কুল কলেজের মাস্টর নি? তোর জন্মনিবন্ধন কার্ড লই বই আছে? এরে হুন, তোগো নোয়া বিয়া হইছে, এহনো ভালামতো একজন আরেকজন রে জানোস নাই, চিনোস নাই। হেতে দেখগই জানেও না তোর জন্মদিন কবে। ইগিন লই মন খারাপ করিচ্চা। যে জানেনা তারে জানাইতে হয়, তার উপর গোস্সা করা মানায় না বুবু!”

“মানুষ যাকে ভালোবাসে তার পছন্দ অপছন্দ, বিশেষ দিন এসব মনে রাখেনা? বা জানার চেষ্টা করে না? উনি কেন এমন দাদীজান? উনি আমাকে ভালোবাসেনা কেন? আমি কি ভালোবাসার যোগ্য না?”

করিমুন্নেসা তার পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” ধৈর্য ধর বোইন, ধীরে ধীরে সব ঠিক হইবো। দেইখবি একদিন হেতে তোর লাই এমুন বেদিশা হইবো তুই কূল পাইতি নো।”

“তুমি সবসময় পজেটিভ কথা বলো। জীবনে এতো ভালোও ঘটেনা। আর এই বদলোকের বেলা তো না ই….”

“হাছা নি? হেতে বুঝি পরিবর্তন হয় নো?”

“হয়েছে তো, একটুখানি!”

শিরিন বাটিতে করে পিঠা এনে বললো, “আম্মা নেন আপনার নাতনিকে পিঠা খাওয়ান।”

করিমুন্নেসা চামচ কেটে আরওয়াকে পিঠা খাইয়ে দিতে দিতে বলল, “বৌমা তোমার মেয়ের জামাইরে কল দাও। বলো আজ রাতে আমাদের সাথে খাবে।”

“আচ্ছা”

আরওয়া গাল ফুলিয়ে বললো,” আমার জন্য তৈরি করা মজার খাবারগুলোতে ঐ লোকে ভাগ বসাবে? তুমি তাকে আসতে বলতেছ কেন?”

শিরিন চোখ গরম করে বলল, “এসব কি কথা আয়েশা? ঐ লোক আবার কি? নিজের স্বামীকে কেউ এভাবে সম্বোধন করে?”

“তো কি বলবো আমার পরাণের সোয়ামি? হুহ তোমরা আমায় ধরেবেঁধে একটা রোবটের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছ। নেহাতই সে দেখতে ভালো বলে চুপচাপ মেনে নিয়েছি। নয়তো কবেই চলে আসতাম!”

” আজকের দিনে এমন গাল ফুলিয়ে না রেখে তোর রুমে যা। তোর জন্য কি গিফট রাখা আছে দেখে আয়।”

“আব্বু কখন আসবে আম্মু?”

“চলে আসবে একটু পরেই। আমাদেরকে বলে গেছে তোকে যেন বলি রেডি হয়ে থাকতে। আসবার সময় কেক আনবে।”

“চকলেট কেক আনতে বলেছ তো?”

“ঐটা মিস যাবে?”

আরওয়া মুহূর্তেই খুশি হয়ে গেল। আনন্দিত গলায় বললো, ” দাদীজান তুমি বসো আমি তৈরি হয়ে আসি।”

বলেই সে নিজের রুমের দিকে গেল। শিরিন বলল, “আম্মা জামাইকে কি বলবো আজকে যে ওর জন্মদিন?”

“তুমি না বলে বরং শোয়েব রে বলো ও যেন ওর দুলাভাইরে বলে গিফট নিয়ে আসতে।”

“কিছু মনে করে যদি?”

“না বললে যে বোমা রেডি হবে তার সামনে এটা কিছু না। বরং দেখবা তারই বড় উপকার হবে।”

“আচ্ছা তাহলে আগে আসার কথা বলি। পরে শোয়েবকে দিয়ে কল করাবো।”

“হুম তাই করো।”

চলবে..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে