কাঁটাকম্পাস পর্ব-২+৩

0
483

#কাঁটাকম্পাস #পর্ব২

#আরশিয়া_জান্নাত

ছাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে জাওয়াদ দূরের আকাশের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। এই মুহূর্তে তার বাসায় থাকতে অসহ্য লাগছে, অফিসে যাবে সেই পথ ও নেই। বিয়ে উপলক্ষে ১সপ্তাহ তার অফিস যাওয়া বন্ধ। গতকাল রাতে চেয়ারে বসে ঘুমানোর ফলে ঘাড় আর পিঠ খুব ব্যথা করছে। হঠাৎ তার কাঁধে হাত রেখে বড় চাচার ছেলে নাহিয়ান বলল,

কি রে এখানে একা দাঁড়িয়ে কি করছিস?

এমনিই হাওয়া খেতে এসেছি। তোর আজ ডিউটি নেই?

আজ নাইটে ডিউটি পড়েছে, আপাতত ওটি না পড়লে হসপিটাল গিয়ে কাজ নেই।

ওহ।

হানিমুনে কোথায় যাবি ঠিক করলি কিছু?

নাহ।

তুই না আসলেই নিরামিষ। ছুটি আছে যখন এখনি ঘুরে আয়। তোর যে বর্ণচোরা স্বভাব, পরে দাদাসাহেব থেকে ছুটি নিতেও পারবি না যেতেও পারবিনা কোথাও।

না গেলেও আফসোস হবে না। আমি বুঝি না হানিমুনে যাওয়ার দরকার কি? সবাই অযথাই একটা ট্রেন্ড বানিয়ে ফেলেছে!

কি বলোস তুই এগুলা? এমন জনবসতিতে মনমতো রোমান্স করা যায়? সময়ের কাজ সময়ে করতে হয় বুঝলি। এখন নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে, একে অপরের যতো কাছে থাকবি ততোই তো জানবি চিনবি। সম্পর্কের ভীত মজবুত হবে। আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো মেয়েরা এসব অনেক পছন্দ করে। এরেঞ্জ ম্যারেজের এসবই তো মজা!

জাওয়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, নাহিয়ান তোর কি মনে হয় না বিয়ে ব্যাপারটা যতোটা ফ্যান্টাস্টিক মনে হয় অতোটাও ফ্যান্টাস্টিক নয়?

বেশি চিন্তাভাবনা করা ঠিক না। লাইফ লিড করতে হয় জিরো এক্সপেক্টেশন রেখে। যা স্বভাবত করণীয় তাই করে যা। জীবনচক্র যেমন চলে তুইও সেভাবেই চলবি। এখানে প্রশ্নবিদ্ধ করাটা মস্তিষ্কের চাপ সৃষ্টি ছাড়া কিছুই নয়। বিয়ে করার প্রয়োজন আছে, হোক সেটা শারীরিক কি মানসিক। প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন তুই যদি ভাবিস এটা আহামরি কিছু নয়, তবে বলবো সেটা ভুল ভাবনা। এটা আহামরির চেয়ে ও ডেঞ্জারাস!!

জাওয়াদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো নাহিয়ানের দিকে। নাহিয়ান চোখ টিপে বললো, এখানে যেমন বৌয়ের মেজাজ খারাপ করা যন্ত্রণা আছে তেমনি ঘাম ঝরানো সুখ ও আছে!

জাওয়াদ বিব্রতবোধ করলো। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, চল নীচে যাই। চা খাওয়ার তেষ্টা পেয়েছে।

নাহিয়ান শয়তানী মার্কা হাসি দিয়ে ওর পিঠে কিল বসিয়ে বললো,বললেই চলে বৌকে দেখার তেষ্টা পেয়েছে। হেহেহে

জাওয়াদ আর কথা বাড়ালো না। এই ছেলের যেই মুখ আবার কি কথা বেফাঁস বলে ফেলবে ভরসা নেই।
নীচে ফিরতেই নাহিয়ান বললো, মেজোআম্মু চা কি পাবো এখন?

নাহিয়ানের স্ত্রী সাবা বললো, বাসায় থাকলেই একটু পরপর চায়ের আবদার করতে হয়? এমনিতেই চুলার ধার থেকে সরার ফুরসত পাই না তার উপর চায়ের আবদার!

আহা সাবা এভাবে বলিস না। ছেলেটা কি সবসময় বাসায় থাকে? যখন থাকে একটু আবদার করে আর কি।

নাহিয়ান হেসে বললো, এজন্য তোমাকে এতো ভালোবাসী মেজোআম্মু। তুমি না থাকলে আমার যে কি হতো ভাবতেই আৎকে উঠি,যে জল্লাদ জুটেছে কপালে…

এই কি বললে তুমি আমি জল্লাদ?

আমি কখন বললাম তুমি জল্লাদ?

এখন কি বললে তাহলে?

তোমার নাম উল্লেখ করেছি নাকি?

আমাকে কি তোমার বোকা মনে হয়? কাকে উদ্দেশ্য করেছ যেকেউ বুঝতে পারবে।

আহা তোরা থামবি? এই নাহিয়ান যা তো যা এখান থেকে। আমি চা করে পাঠিয়ে দিচ্ছি তবুও থাম তোরা।

জাওয়াদ সোফায় বসে তাদের খুনসুটি শুনছিল। এ বাসায় এসব নিত্য ঘটনা। নাহিয়ানের কাজ ই হচ্ছে সারাক্ষণ ওর বৌকে খোঁচানো। যতক্ষণ বাসায় থাকে একটু পরপর সাবাকে ক্ষ্যাপাবে আর হেহে করে হাসবে। জাওয়াদ ভেবে পায়না এসব বাচ্চামির মানে কি। এতো বড় ডাক্তার হয়ে ঘরে এমন খোঁচাখুঁচি করা মানায়? অবশ্য এই বাসার সবার কর্মকান্ডই জাওয়াদের কাছে অহেতুক মনে হয়। এই সবের মাঝে নতুন আরেকজন এসেছে, বোঝাই যাচ্ছে নয়া পাগলের আমদানি ঘটেছে!
জাওয়াদ চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলো, নাহ আপাতত আশেপাশে তাকে দেখা যাচ্ছে না। ভালোই হয়েছে।

এই নিন আপনার চা।

আরওয়ার গলা শুনে চমকে উঠলো জাওয়াদ। কথায় বলে যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যা হয়। জাওয়াদ চেহারায় গাম্ভীর্য ফুটিয়ে চায়ের কাপ নিতে হাত বাড়ালো। আরওয়া হাত সরিয়ে বললো, এমন মুখ ভার করে নিলে তো দিবো না।

জাওয়াদ কাটকাট গলায় বললো, আমি তো আপনাকে চা দিতে বলিনি।বাসায় আরো অনেকে আছে, তাদের কেউ দিয়ে দিবে।

বেশ তবে তাদের অপেক্ষা করুন। বলেই আরওয়া আয়েশ করে বসে চায়ে চুমুক দিলো।

এই নতুন ভাবি তুমি এখানে, আর আমি তোমাকে পুরো বাড়ি খুঁজে ফেলেছি। তাড়াতাড়ি চলো আমার সাথে।

কোথায় যেতে হবে বলবে তো?

আরেহ আমরা সবাই গানের আসর বসিয়েছি চলো না।

আরওয়াকে নিয়ে পাপিয়া চলে গেল। জাওয়াদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

দোতলার ঘরে সব মেয়েরা জড়ো হয়েছে। সেখানে মুড়ি চানাচুর মাখা, চিপস, নুডুলস সহ নানারকম নাস্তার বন্দোবস্ত করা। আরওয়াকে দেখে কুহু বলল, ভাবী তাড়াতাড়ি এসো। তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম আমরা। নে এবার গানের কলি শুরু কর।
সবাইকে দুই দলে ভাগ করে দিয়ে চললো গানের লড়াই। দুটো মেয়ে একসঙ্গে হলেই হাসির শব্দে টেকা যায় না আর সেখানে ২০/২৫ জন মেয়ের আসর বসেছে। হাসিগানের শব্দে দোতলার ঘরটা মুখিয়ে উঠেছিল। কিন্তু যেই খবর এলো দাদাসাহেবের গাড়ি ঢুকেছে অমনি সব কোলাহল বন্ধ। সবাই এমনভাবে মুখ বন্ধ করেছে যেন এই ঘরে কেউই নেই! আরওয়া ভীষণ অবাক হলো এমন কান্ড দেখে। একটু আগেই যাদের শোরগোলে মাথা ছিড়ে যাচ্ছিল তারা সবাই এমন চুপ হয়ে গেল!

আরওয়া ফিসফিস করে বললো, কি ব্যাপার বলো তো সবাই এমন চুপ হয়ে গেল‌ কেন?

পাপিয়া আরো ধীর গলায় বললো, দাদাসাহেব বলেন মেয়েদের গলার স্বর ঘরের বাইরে যাওয়া ঠিক না। তাই সবাই চুপ হয়ে গেছে।

তোমরা সবাই উনাকে অনেক ভয় পাও তাই না?

হুম অনেক!

আরওয়ার শাশুড়ি রোকেয়া বেগম এসে বলল,বৌ মা একটু এসো তো আমার সঙ্গে।

আরওয়া শাশুড়ির পেছন পেছন গেল। রোকেয়া তাকে নিজের ঘরে নিয়ে বললো, কাল তো তোমাদের বৌভাত। এই শাড়ি গয়নাগুলো কালকের জন্য।

আচ্ছা।

তোমার কোনো অসুবিধা হলে আমাকে বলবে। এখন তুমিও এই পরিবারের সদস্য। তোমার প্রতি আমাদের যেমন দায়িত্ব কর্তব্য আছে তোমারও আছে। তুমি এখন আর কেবল মেয়ে নও, এই বাড়ির বউও। তোমার উপর অনেক দায়িত্ব আসবে, সেসব তোমাকে সঠিকভাবে পালন করতে হবে। জানো তো তোমার শ্বশুররা ৩ভাই ২বোন। বড় ভাইজান ইতালি থাকেন। উনি বিয়েতে আসতে পারেন নি। পরে সময় করে আসবেন হয়তো। ছোট ভাই চাকরিসূত্রে তার পরিবারসমেত চট্টগ্রাম থাকেন। দেখা যায় সারাবছর এই বাড়ি ফাঁকাই থাকে, একেকজন একেক কাজে একেক জায়গায় থাকে। এখন এতো মানুষ দেখে ঘাবড়ে যেও না যেন।

না না মা মানুষ দেখে আমার অভ্যাস আছে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি এসবে অস্বস্তি বোধ করছি না।

তাহলে তো ভালোই।

কিছুক্ষণ নিরব থেকে রোকেয়া বেগম বললেন, বউমা একটা কথা জিজ্ঞেস করি কিছু মনে করো না।

জ্বি মা করুন।

তিনি খানিকটা ইতস্তত বোধ করে বললেন, ফারাজ তোমার সঙ্গে কথা বলেছিল তো? আসলে ও সচরাচর কথা বলে না। তাই জিজ্ঞাসা করলাম। একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের ছেলে তো…

কথা একদমই বলেননি তা নয়। তবে যা বলেছেন তার চেয়ে না বলাই শ্রেয় ছিল।

যেমন?

উমম যেমন ধরুন একটা দরজা বহুক্ষণ যাবৎ বন্ধ ছিল।আমরা অধীর আগ্রহ নিয়ে দরজাটা খোলার অপেক্ষা করলাম। কিন্তু যখন দরজা খুললো ভেতরের দিকে পরোখ করে মনে হলো দরজা বন্ধ থাকাই ভালো ছিল!

সেটা তো বুঝেছি, কিন্তু তুমি এমনটা বললে কেন? ও কি তোমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেছে?

নাহ, উনি বোধহয় কথা বলতে পছন্দ করেন না। তাই বললাম আর কি।

প্রথম প্রথম মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করো না।

আচ্ছা!

রাতের খাওয়া শেষে জাওয়াদ রুমে ঢুকতেই দেখে আরওয়া চেয়ারে বসে টেবিলের উপর কিসব লিখছে। জাওয়াদ ওয়াশরুমে ঢুকে ভাবতে লাগলো কিভাবে আরওয়াকে ইগ্নোর করে রাতে শান্তিতে বিছানায় ঘুমানো যায়। এই মেয়েকে ভরসা করার সাহস তার হচ্ছে না। আবার চেয়ারে বসে ঘুমানোও সম্ভব না। বাসায় অনেক গেস্ট থাকায় এক্সট্রা তোশক বালিশও বুক হয়ে আছে। তাই হাতে আর কোনো অপশন নেই। জাওয়াদ মনে মনে ভাবলো, ওর বাড়ি ওর বিছানা। ও ঘুমাতেই পারে। ওকে বাঁধা দিবে কে? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হয় আরওয়া যদি ঘুমের মধ্যে কিছু করে বসে….না না ও ওরকম মেয়ে না হয়তো। আমি অযথাই ভয় পাচ্ছি!

মনকে অনেকরকম সান্ত্বনা দিয়ে অবশেষে সে বের হলো। বিছানার দিকে এগোতেই আরওয়া বললো, ডানপাশে শুবেন, আমি বা’পাশ ছাড়া শুতে পারি না।

আমি বা’পাশে শুয়ে অভ্যস্ত!

অভ্যাস বদলান। আমি আপনার বাসায় এসেছি, হাজবেন্ড হিসেবে আমার সুবিধা অসুবিধা দেখার দায়িত্ব আপনার তাই না?

আপনার বাসায় আপনি কন্যা হিসেবে এমন অনেককিছুই করেছেন, যা শ্বশুরবাড়িতে করা যায় না। বিয়ের পর অনেককিছুই বদলাতে হয়।
কম্প্রোমাইজ করতে হয়।

বিয়ে কি আমি একা করেছি? আপনি করেন নি? কম্প্রোমাইজ আমি একা করবো কেন? আপনি ও করুন না।

করছি না বলছেন? আমার রুমে আমি আমার ছোট ভাইকে পর্যন্ত থাকতে এলাউ করিনা। সেখানে আপনি আছেন। এটা কি আমার কম্প্রোমাইজ নয়?

ওমা আপনার বিয়ে করা বউ আপনার ঘরে থাকবে না তো কই থাকবে? এমনভাবে বলছেন যেন এ ঘরে থাকতে দিয়ে বড় উপকার করেছেন!

আমি বলিনি উপকার করেছি।বলতে চাইছি এটা আমার জন্য কম্প্রোমাইজ ই! যেটায় আমি অভ্যস্ত না সেটায় মানিয়ে নিচ্ছি। তবে আপনি কেন পাশ বদল করতে পারবেন না?

এহহ, আমি আমার আরামের বিছানা ছেড়ে অন্য একজনের বিছানায় ঘুমাতে এসেছি এটা কম মনে হয় আপনার? আপনি কেবল একজন কে জায়গা দিলেন, আর আমি পুরো জায়গাটাই দিয়ে এসেছি। আমার তুলনায় আপনার টা খুব কম বুঝলেন?

বেশ‌ তো এতো কিছু যখন বদলে এসেছেন আপনি তো গ্রেট। এই সামান্য ডান বাম নিয়ে আপনার বিশেষ আপত্তি হবার কথা নয়। গুড নাইট হ্যাভ এ ব্যাড ড্রিমস!

আরওয়া হা হয়ে চেয়ে রইল। জাওয়াদ বা পাশে শুয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আহ এক রাতে তার পিঠ গেল। নিজের বিছানার চেয়ে আরামদায়ক স্থান এই পৃথিবীতে আর কোথাও নেই….

চলবে,

#কাঁটাকম্পাস #পর্ব৩

#আরশিয়া_জান্নাত

চোখেমুখে পানির উপস্থিতি টের পেতেই লাফ দিয়ে উঠলো জাওয়াদ। সামনে তাকিয়ে দেখে আরওয়া লাল বালতি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁচা ঘুম ভাঙায় জাওয়াদ একটু সময় নিলো পরিস্থিতি বুঝতে। তারপর নিজের গায়ের দিকে তাকিয়ে বুঝলো আরওয়া তার গায়ে পুরো বালতির পানিটা ঢেলেছে। রাগে ওর শরীর থরথর করে কাঁপতে লাগলো, চিৎকার করে বলল, এসবের মানে কি? আপনার মাথায় সমস্যা আছে? এভাবে কেউ ঘুমন্ত মানুষের গায়ে পানি ঢালে?

আপনি আমার কথা শোনেননি তাই এমন করেছি। যা আমার হয়নি তা আর কারো হবে না। এখন বেশি করে ঘুমান বামপাশে!

জাওয়াদ উঠে আরওয়ার বাহু ধরে দেওয়ালের সাথে চেপে রাগীস্বরে বলল, আপনার সাহস কি করে হয় আমার সঙ্গে এসব করার? এতো স্পর্ধা আপনার!

আরওয়া ওকে ধাক্কা দিয়ে সরানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু পুরুষালি জোরের সঙ্গে পেরে উঠলো না। জাওয়াদ আরো শক্ত করে চেপে ধরে বললো, সবকিছু জোর করে হয় না কথাটা মাথায় ঢোকে না? আমার সামনে আপনার জোর কতোটা তুচ্ছ ইউ কান্ট ইমাজিন!

আরওয়া তেঁতে বলল, প্রতিদ্বন্দ্বীকে কখনো দূর্বল ভাবতে নেই। কে কখন কোনদিক দিক দিয়ে ঘায়েল করবে বলা যায় না।

জাওয়াদ ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল, আমি যা ভাবতাম ঠিক ভাবতাম। আপনার থেকে এসবই আশা করা যায়।

তারপর কাভার্ড থেকে কাপড় বের করে ওয়াশরুমে ঢুকে চেইঞ্জ করলো। আর একমুহূর্তও রুমে না থেকে হনহন করে বেরিয়ে গেল। আরওয়া হাতের দিকে চেয়ে দেখে দুই হাতের বাহু লালচে হয়ে গেছে। এতো জোরে খামচে ধরেছে দানবটা, রক্ত বের হয় নি এই ঢের! পিঠেও বেশ ব্যথা পেয়েছে সে। তবে ব্যথার চেয়ে আনন্দ টাই বেশি হচ্ছে। এখন বুঝবে ব্যাটা আরওয়ার সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়া অতো সোজা না।

ভেজা চাদরটা সরিয়ে অন্য একটা চাদর মেলে দিয়ে সে বেশ আরাম করেই শুয়ে পড়লো। জাওয়াদ কোথায় গেছে তা ভাবতে গিয়ে সময় নষ্ট করলো না।

জাওয়াদ একটার পর একটা সিগারেট ফুঁকেই যাচ্ছে। মেজাজ কোনোমতেই ঠান্ডা হচ্ছে না।ঘুমে চোখও জ্বালাপোড়া করছে। বাড়িতে এতো গুলো ঘর পড়ে আছে, অথচ তাকে ছাদে দাঁড়িয়ে রাত কাটাতে হচ্ছে। আরওয়া মেয়েটা একদম মাত্রাতিরিক্ত অভদ্র আর বেয়াদব। ওর মধ্যে মিনিমাম কমনসেন্স নেই। ১দিনেই মেয়েটা ওর জীবন জাহান্নাম করে দিয়েছে। ও তো জানতোই এখনের যুগের মেয়েরা ভালো হয় না। এদের মধ্যে শুধু জেতার লোভ। পুরুষদের সঙ্গে সবকিছুতে টেক্কা দেওয়ার প্রবণতা। এমন উড়নচন্ডী মেয়েকে দাদাসাহেব কি দেখে যে পছন্দ করেছেন তার মাথায় ঢুকে না। জাওয়াদ নীচে গিয়ে স্টাডি রুমে দরজা লক করে শুয়ে পড়লো। আপাতত ঐ ঘরে কেউ আসার কথা নয়। তাই সোফায় গা এলিয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে হারাতে সময় লাগলো না।

করিমুন্নেসা নাতনিকে পরোখ করে বললেন, কি লো হতীন তোর সোয়ামী তোরে আদর সোহাগ করে নো? কোনো পরিবর্তন ই দেখতাছি না!

আরওয়া দাদীর গলা জড়িয়ে বলল, তোমার সাথে বাড়ি ফিরে যা বলার বলবো। একটু সবুর রাখো।

করিমুন্নেসা চিন্তিত স্বরে বললেন, ২রাইতেই কাইজ্জা বাঁধাইছোস বুবু? হাচা কইরা ক কি গ্যাঞ্জাম লাগাইছোস? এরে আই তোরে কতাগিন কতা বুঝাইছি। কিচ্ছু বুঝি মাথাত ঢুকাসসো?

আরওয়া প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, বাকীরা আসেনাই? তুমি একাই কোমর দুলাই দুলাই চলে আসছো?

তুই বহুত শেয়ানা বইতালি, আর কতা ঘুরাইচচা। খাড়া আই তোর জামাইরে বুলাইয়ের। হেতেই কইবো যা কওয়ার।

দাদী দাদী শুনো আমার কথা। বলছি তো তোমারে সব বলমু, এখানে হাঙ্গামা করিও না।আগে বাসায় ফিরি তারপর তুমি যা ভালো বুঝবা তাই হবে।

অগত্যা করিমুন্নেসা থামলেন।তবে মুখে হাসির রেশ বদলে থমথমে ভাবটাই দৃশ্যমান হলো।

পাপিয়া তোর ভাইয়া কোথায় জানিস?

না মা আমি একবারো ভাইয়াকে দেখিনি।

সকালে নাস্তাও করলো না। কোথায় গেল ছেলেটা? এদিকে ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন এসে গেছে।

ছোটমা নতুন ভাবীকে জিজ্ঞাসা করে দেখবো?

দেখ কি বলে,ফোনও ধরছে না। কি যে করেনা ও! যা দ্রুত খবর‌ নে কই আছে।

পাপিয়া একটু এগোতেই দেখে জাওয়াদ এদিকেই আসছে। ও হাঁফ ছেড়ে বললো, ভাইয়া তুমি কোথায় ছিলা? সবাই তোমার খোঁজ করছিল। ফোন কই তোমার? অন্তত কল তো ধরবা!

ফোন সাইলেন্ট ছিল, তাই খেয়াল করিনি। কেন খুঁজছে সবাই?

ওমা! এটা কোনো কথা হলো? আজ তোমাদের বৌভাত না? একটু পরেই সবাই চলে আসবে আর তুমি এখনো সকালের নাস্তাও করো নি।

পাপ্পি মা কইরে?

রান্নাঘরে আছে। কেন?

মা কে বল আমি উনার ঘরে আছি। দ্রুত যেন ঘরে যায়। আমার জরুরি কথা আছে।

আচ্ছা।

জাওয়াদ তার মায়ের ঘরে গিয়ে বসলো। মনে মনে গুছিয়ে নিতে লাগলো কিভাবে সবটা বলা যায়।
রোকেয়া হন্তদন্ত হয়ে রুমে এসে বললো, ফারাজ তুই এতোক্ষণ কই ছিলি? এমন অনুষ্ঠানের দিনে বাড়ির ছেলেরা এতো কেয়ারলেস হলে চলে?

মা তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে, একটু বসবে তো।

জরুরি কথা পরেও শোনা যাবে, আমি তো কোথাও চলে যাচ্ছি না। এখন এমনিই অনেক দেরি হয়ে গেছে। তুই ওসব বাদ দিয়ে দ্রুত নাস্তা করে নে। তোর শ্বশুরবাড়ি থেকে অলরেডি সবাই আসতে শুরু করে দিয়েছে। উফফ আমার যত জ্বালা সবাইকে ঠেলে ঠেলে সব করাতে হয়। আরওয়া রেডি হলো কি না কে জানে, একটু পরেই মেহমানরা আসতে শুরু করবে। তোদের আবার বিকেলের আগেই ও বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। ঝটপট কর তো বাবা!

জাওয়াদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রোকেয়া যেমন ঝড়ের গতিতে এসেছিল তেমনি ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল।

সাবা এশ কালারের শাড়ি পড়ে সাজগোজ করছিল তখন নাহিয়ান এসে বললো, আয়হায় সাবা তুমি এটা কি শাড়ি পড়লা?

কেন কি হয়েছে?

এমনিতেই শাড়ি পড়লে তোমাকে বিবাহিতা লাগে, তার উপর এশ কালার পড়ছো। এখন তো পুরা খালাম্মা লাগতেছে।

সাবা ঠোঁটে লিপস্টিক দিতে দিতে বলল, বিবাহিতা নারী কে বিবাহিতা লাগবে না তো কি লাগবে? আর আমার বোনদের মেয়েরা এমনিও আমাকে খালামণি ডাকে। তো কি হয়েছে?

নাহিয়ান ওর কাঁধে চিবুক রেখে কোমর জড়িয়ে বললো, এই মেয়ে রাগছো না কেন আজ হুম?

সাবা নিজের কাজ রেখে নাহিয়ানের দিকে ফিরে গলা জড়িয়ে বলল, তোমার ফর্মুলাগুলো পুরনো হয়ে যাচ্ছে বুঝলে! নতুন কিছু ট্রায় করো।

হাহ! কোনদিন বলে বসো বরটাই পুরোনো হয়ে গেছে?

সে যেদিন পুরোনো হবে সেদিন তো আমিও পুরোনো হবো। সমানে সমান!

নাহিয়ান ওর হাতের চুড়িগুলো নেড়েচেড়ে বলল, আজকে অনুষ্ঠান শেষ করে বের হবে আমার সঙ্গে?

তোমার না ওটি আছে?

সাবেরকে হ্যান্ডওভার করেছি। অনেকদিন তোমার সঙ্গে কোথাও যাওয়া হয়না। ভাবলাম আজ যাই।

তোমার ইচ্ছার কোনো ঠিকঠিকানা নাই। কখন যে কোন ভুত চাপে।

সেই ভুতের আছর বুঝি বিরক্ত করে?

নাহ উচ্ছাসিত করে, আপ্লুত করে।

নাহিয়ানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।

আকাশী রঙের কাতান শাড়ির সঙ্গে বেশ সুন্দর জরোয়ার গয়না। কুহু সুনিপুণভাবে মেকাপ দিয়ে আরওয়াকে সাজিয়ে দিলো। পাপিয়া বললো, আপুনী তুই নতুন ভাবিকে কি সুন্দর সাজিয়েছিস। ভাইয়া তো আজকে চোখ ফেরাতে ই পারবেনা।

তখনই জাওয়াদ রেডি হতে রুমে এসেছিল। ওদের কথা শুনে মনের অজান্তেই আয়নায় নজর চলে যায়। কেউ দেখার আগেই চোখ ফিরিয়ে নেয়। কুহু তাকে দেখে বললো, এই ভাইয়া এদিকে আয়। দেখ তোর বউকে কেমন সাজিয়েছি। পছন্দ হয়?

পাপিয়া ভাইকে টেনে এনে বলল, ভাইয়া দেখো ভাবিকে ভীষণ মিষ্টি লাগছে না দেখতে? তোমার ফেভারিট কালার শাড়ি বেশ মানিয়েছে না বলো?

কুহু বললো, আমার কিন্তু ভালো সম্মানী চাই। এতো যত্ন করে সাজিয়েছি খালি হাতে বসবো না।

জাওয়াদ গম্ভীরস্বরে বললো, তোর ভাবিকে তুই সাজিয়েছিস আমি কেন খরচা দিবো? বেশি লাগলে যাকে সাজিয়েছিস তার থেকে নে।

আরওয়া এবার সরাসরি তাকালো তার দিকে। কুহু আর পাপিয়া দুজনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে মুখ টিপে হাসলো। আরওয়া ঝট করে উঠে জাওয়াদের একদম নিকটে গিয়ে দাঁড়ালো। জাওয়াদ সতর্ক দৃষ্টিতে ওর মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছে। আরওয়া ওর গলা জড়িয়ে ধরতেই সে অস্বস্তিতে পড়ে গেল। এই মেয়ে করছে টা কি ঘরে যে আরো দুজন আছে ওর কি হুশ নেই!
ওর এই বেখেয়ালের সুযোগে আরওয়া ওর পকেট থেকে ওয়ালেট টা নিয়ে হাজার টাকার ক’টা নোট নিয়ে ফেলল। কুহু শিষ বাজিয়ে বললো, ওয়াও ভাবি তু সি গ্রেট হো!!

আরওয়া ওদের হাতে টাকা তুলে দিয়ে বললো, কিছু মানুষ টাকা শুধু আয় করতেই জানে ব্যয় করতে জানে না বুঝলে! তাদের থেকে কৌশলে উসুল করতে হয়।

কুহু আর পাপিয়া টাকা নিয়ে নাচতে নাচতে চলে গেল। জাওয়াদ কিছু না বলে গোল্ডেন কালার পাঞ্জাবি বের করলো। আরওয়া উচ্ছাসিত গলায় বললো, ওয়াও গোল্ডেন কালার পাঞ্জাবি পড়লে ছেলেদের যা লাগে না! সেরা একদম সেরা।

জাওয়াদ সাথে সাথে সেটা রেখে সাদা রঙের পাঞ্জাবি নিলো। আরওয়ার পছন্দের কালার ও কিছু তেই পড়বেনা কিছুতেই না। আরওয়া মনে মনে হাসতে লাগলো। বিরবির করে বলল, ঘুঘু ফাঁদে পা দিয়েছে….

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে