#কাঁটাকম্পাস #পর্ব২২
#আরশিয়া_জান্নাত
২২
আরওয়া লাগেজ থেকে নিজের পছন্দমতো একটা শাড়ি বের করে পড়ে নিলো। তারপর বেশ মন দিয়ে মেকাপ করে ,চুল আঁচড়ে, ম্যাচিং গয়না পড়লো। সাজগোজ শেষে জাওয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “কেমন লাগছে? সব ঠিকঠাক তো?”
“হুম, ভালোই!”
“ভালোমতো দেখে বলুন, কোনো খামতি আছে কি না?”
জাওয়াদ একবার তাকিয়ে বললো, “ঠিকই তো আছে!”
“সিওর?”
এবার জাওয়াদ একটূ নড়েচড়ে বসলো, নাহ মেয়েটা যখন এভাবে বলছে তার মানে ঘাপলা আছে! সে মনোযোগ দিয়ে আরওয়ার দিকে তাকালো। সাদা রঙের শিফন শাড়িতে নীল অপরাজিতা ফুল ছাপা। কানে গলায় ম্যাচ করা নীল পাথরের গয়না। সাজ বলতে চোখে টানা করে আই লাইনার দেওয়া,আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, চুলগুলো খোঁপা করে রাখা।
পর্যবেক্ষণ শেষে জাওয়াদের মনে হলো এই কস্টিউমের সাথে খোলা চুলেই বেশি মানাতো।
“দেখা শেষ? পেলেন কিছু?”
জাওয়াদ দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বললো, “মেয়েদের সাজগোজের ব্যাপারে আমার ধারণা কম। তবে আপাতত মনে হচ্ছে তোমার চুল খোলা রাখলেই ভালো লাগবে!”
“তাই? বেশ তো খোঁপাটা খুলে দিন?”
“আমি?”
“হুম। পারবেন না?”
“পারবো,,”
আরওয়া তার দিকে পিঠ করে সামনে দাঁড়ালো। জাওয়াদ ওর খোঁপা খুলে দিয়ে চুলগুলো সারা পিঠময় ছড়িয়ে দিলো। আরওয়া মিষ্টি হেসে বলল, “ধন্যবাদ, নিন এখন আমার বেশকিছু ছবি তুলুন। অবশ্যই যেন ব্যাকগ্রাউন্ড পুরোটা আসে।”
“তুমি জাস্ট ছবি তুলতে এতো আয়োজন করলে?!”
“অবশ্যই! হানিমুনে এসেছি যে ডেমো রাখতে হবে না? এসব ডেকোরেশন তো আর বারবার হয় না! দেখি কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি ছবি তুলুন। সুন্দর করে তুলবেন, এঙ্গেল যেন ঠিকঠাক হয়।”
জাওয়াদ আরওয়ার ফোন নিয়ে বেশকিছু ছবি তুললো, আরওয়াও হাসিমুখে নানারকম পোজ দিয়ে যাচ্ছে।
“সিঙ্গেল অনেক তুলেছি, এবার আসুন কাপল ফটো তুলি। সেলফি নিন। একদম সুখী দম্পতির মতো ভান করবেন ওকে?”
আরওয়া ওর ক্লোজ হয়ে কাপলের মতো দাঁড়ালো, জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে বললো, “এসব করা কি খুব দরকার?”
“ওহো এতো কথা বলেন না আপনি! দিন আমিই সেলফি তুলছি, ভ্রু সোজা করুন হাসিহাসি মুখ করে ফোনের দিকে তাকান। প্লিজ ……”
আরওয়া ক্লিক করেই যাচ্ছে, হঠাৎ জাওয়াদ বাঁকা হেসে আরওয়ার গালে চুমু খেলো। আরওয়া চোখ বড় বড় করে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো,” এটা কি হলো? আপনি আমায় চুমু দিলেন কেন?”
“বা রে! তুমি একাই হানিমুনের ফিল নিবা? আমি নিবো না?”
আরওয়া ফোন রেখে তার চোখে চোখ রেখে বলল, “আমি কি আপনাকে একবারও বারণ করেছি?”
“বারণ করো নি বলছো?”
“অবশ্যই করি নি,,, ইনফ্যাক্ট সবসময় এগিয়ে এসেছি। যেমন আজ এলাম!”
জাওয়াদ ওর কপালে আঙ্গুল ছুঁইয়ে বললো, “তোমাকে এখন ভীষণ সুন্দর লাগছে!”
আরওয়া জাওয়াদের গলা জড়িয়ে আদুরে গলায় বললো, “সত্যি বলছেন?”
“হুম…তবে সমস্যা একটাই সমস্যা, সাদা রঙটা কেমন জানি ভুতুড়ে লাগে। মনে হচ্ছে তুমি পুরোনো কটেজে সাদা শাড়ি পড়ে ঘুরে বেড়ানো অতৃপ্ত আত্মা! ভাগ্যিস সবুজ পাতায় নীল অপরাজিতা টা আছে….”
“আপনি আমায় পেত্নি বোঝালেন?”
“আমি কিন্তু নাম বলি নি। তুমি নিজেই বললে।”
আরওয়া রেগে ক্ষুব্ধ হয়ে বললো,”ধুরর আপনার থেকে ভালো কিছু আশা করাই ভুল…”
বলেই সে সরে যেতে নিলো। জাওয়াদ হেঁচকা টানে তাকে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, “রাগ মানুষ কে ধ্বংস করে। তোমার মতো মোমের পুতুল হলে তো কথাই নেই। সেই তাপে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে ফেলে!”
আরওয়া ওর বাহুবন্ধন থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগলো। দৃঢ় গলায় বললো, “আপনি একটা বদ লোক, নিজেই আগুন লাগাবেন আবার নিজেই নীতিবাক্য বলতে আসবেন, ছাড়ুন আমাকে।”
জাওয়াদ হেসে বললো,”যে আগুন জ্বালায় সে ই আগুন নেভাতে পারে ম্যাম! তার থেকে দূরে সরলে হবে?”
“ঢং করবেন না বলে দিচ্ছি। আপনি সবসময় এমন করেন, মেজাজ খারাপ না করলে আপনার শান্তি হয় না। ”
রাগের চোটে আরওয়ার চোখে পানি চলে এসেছে। এটা কেমন অসহ্যকর ব্যাপার! দুঃখ পেলে চোখের পানি কন্ট্রোল করা গেলেও রাগের বেলা যায়না। চোখ যেন শত্রুতামি করে অঝোর ধারায় পড়তেই থাকে বিব্রত করতে। আরওয়া চাইছে না জাওয়াদ ওর কান্না দেখুক। নিজেকে ছিঁচকাদুনে প্রমাণ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ওর নেই।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে টের পেতেই জাওয়াদ দ্রুত ওর ঠোঁট জোড়া দখলে নিলো। লেলিহান আগুনে বরফ শীতল পানি পড়ার মতোই আরওয়ার রাগ ক্ষোভ দপ করে নিভে গেল। সে পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে অপার্থিব অনুভুতির জোয়ারে হারিয়ে গেল মুহুর্তেই। বাঘিনী কে বশে আনার উপায় জাওয়াদ সাহেব ভালোই রপ্ত করেছেন!
বেশকিছু সময় অতিবাহিত হবার পর জাওয়াদ ধীরে ধীরে তাকে ছেড়ে দিলো। আরওয়া সাথে সাথে ওর শার্টের কলার আঁকড়ে ধরলো। ওর আবেদনময়ী দৃষ্টির ভাষা বুঝতে জাওয়াদের সময় লাগলোনা। তবুও বাজিয়ে দেখতে বলল, ” কি?”
আরওয়া কাতরস্বরে বললো,”আমার ভালো লাগছে না। একদম ভালো লাগছেনা। আমি বোধহয় মরে যাবো….”
জাওয়াদ ওকে কোলে তুলে বললো, “কেন ভালো লাগছে না শুনি?”
“আপনি আমাকে ভালোবাসেন না কেন? কি হয় একটু ভালো বাসলে?”
জাওয়াদ তাকে বিছানায় শুইয়ে বললো,”তুমি একা ক্ষতবিক্ষত হও না আরওয়া, আমাকেও ক্ষতবিক্ষত করো। তোমাকে ভালোবাসলে আমার কি হবে বুঝতে পারছো?”
আরওয়া উঠে ওর শার্টের বোতাম খুলে বুকের মাঝখানে পয়েন্ট করে বললো, ” এই পাথরের বুকটায় আরওয়ার নামে ফুল ফুটুক। এই মনের সবটা জুড়ে কেবল আরওয়া থাকুক।”
জাওয়াদ মুঠোভর্তি গোলাপের পাপড়ি নিয়ে আরওয়ার মাথার উপর ধীরে ধীরে ফেলতে লাগলো। নরম পাপড়ির ছোঁয়ায় সে চোখ বুজে ফেলল, জাওয়াদ ওর মুখ আজলায় ভরে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “আমাকে বড্ড জ্বালাও তুমি! আমি ততোটাও পাথুরে নই যতোটা তুমি ভাবছো। এখন যা হবে তার দায়ভার সম্পূর্ণ তোমার,আমাকে কিন্তু পরে দোষারোপ করতে পারবে না…..”
“আপনাকে আমি দোষারোপ করবো কেন? আমি আপনার জন্য হালাল। আমার উপর আপনার পূর্ণ হক আছে। আপনার আহ্বানে সাড়া না দেওয়া বরং আমার জন্য পাপ হবে।”
“অনুমতি দিচ্ছো তাহলে?”
আরওয়া নিজের হাত দিয়ে ওর চোখ ঢেকে বললো, “আপনি এভাবে তাকাবেন না, আমার লজ্জা লাগছে। ”
।
জোবায়ের সাহেব পত্রিকার হেডলাইনগুলোয় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই তিনি অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। সালমা বেগম স্বামীর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাতের কাছে এগিয়ে রেখে বললেন, “কুহুর জন্য একটা সমন্ধ আসছে,ওর বড় মামা আনলো। আপনি অনুমতি দিলে উনাদের আসতে বলবো।”
“বায়োডাটা কই দেখি?”
সালমা বেগম তৈরিই ছিলেন, দ্রুত বায়োডাটা এগিয়ে দিলেন। জোবায়ের সাহেব মনোযোগ দিয়ে সবটা দেখলেন। তারপর বললেন, “আসতে বলো, দেখাসাক্ষাৎ করে দেখি। আল্লাহর হুকুম থাকলে হবে নাহয় হবেনা।”
সালমা হাসিমুখে বললেন, “হ্যাঁ সেটাই।”
জাওয়াদের বুকের মাঝে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে আরওয়া। নির্ঘুম রাত্রিযাপনে দুজনেই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। স্বর্গীয় সুখানুভূতিতে দেহমন তৃপ্ত হলেও চোখের পাতা এক হচ্ছে না কারোই। জাওয়াদ আলতোভাবে আরওয়ার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে আর সে মন দিয়ে
তার হৃদস্পন্দন শুনছে।
“ঘুমোবেন না?”
“এখন ঘুমালে মিটিং টা মিস হয়ে যাবে। তুমি বরং ঘুমাও।”
আরওয়া ওর বুকে নাক ঘষে বলল, “আজ না গেলে হয় না?”
“সেটাই ভাবছিলাম। কোনোভাবে পোস্টপন করা যায় কি না…”
“সাম্য ভাইয়া কে বলে দিন, এতো চিন্তা ভাবনার কি আছে?”
জাওয়াদ ওর কপালে চুমু খেয়ে বলল, ” দাদাসাহেবের কাজ ফেলে রাখতে সাহস হয় না।”
আরওয়া উঠে বসলো। দু’ হাতে চুলে ক্লিপ আটকে বললো, ” আমি সাম্য ভাইয়া কে নক করে বলছি, মিটিং টা বিকেলের দিকে করতে। আপনি এখন নিশ্চিন্তে ঘুমান।”
জাওয়াদ মুচকি হেসে বলল, “ঘড়ি দেখেছ? এখনো ভোর হয় নি। ওকে এখন নক করার মানে বোঝো? বোকা মেয়ে একটা!”
আরওয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জিভ কেটে বললো, “আসলেই তো! আমার কাছে তো মনে হয়েছে অনেক লম্বা সময় পার হয়ে গেছে। কিন্তু সময় তো খুব স্লো!!”
“তাই না?”
আরওয়া তার হাতটা টেনে নিজের গালে ছুঁইয়ে বলল, ” আই উইশ আপনার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো এমনিভাবে অনেক লম্বা হোক।”
পাপিয়া পাত্রের ছবি দেখে বলল, “আপু উনি তো দেখতে সেই! তোর পছন্দ হয়েছে? দুলাভাই হিসেবে আমার তো বেশ পছন্দ হয়েছে!”
কুহু বইপত্র গোছাতে গোছাতে বলল, “বেশি পছন্দ হলে বলে দে তোর জন্য দেখতে বলি।”
“তুই কেমন রে আপু! আমি কি বলেছি আমার জন্য পছন্দ হয়েছে?”
“তোর তো বফ নেই, পছন্দ করিস এমন ছেলেও নাই। আমি তোকে সাজেস্ট করতেই পারি। এমন কত ঘটনা আছে বড় বোনকে দেখতে এসে ছোটবোনকে পছন্দ করে। আগে থেকে মেন্টালি প্রিপেয়ার থাকা ভালো।”
পাপিয়া বিরক্তস্বরে বললো, “তোকে কিছু বলাই ভুল আমার।”
“পাপ্পি! যদি এমন হয় আমি বিয়ের দিন পালিয়ে গেছি। মানসম্মান রক্ষা করতে দাদাসাহেব তোকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিলো। তুই তখন কি করবি?”
“এই আপু তুই পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছিস না তো! খবরদার ওটা করিস না। আমি বলির পাঠা হতে পারবো না…”
“মন্দ কি ছেলে তো তোর ভালো ই লেগেছে?”
“নাহ একটুও ভালো লাগেনি। আর শোন দেখতে আসলেই বিয়ে হয় না। তোর পছন্দের কেউ থাকলে বড় ভাইয়াকে বল। ভাইয়া ঠিকই ব্যবস্থা নিবে। অযথা এডভেঞ্চারিং কিছু করার চিন্তা করিস না।”
“তুই খুব ভীতু রে পাপ্পি। এইটুকু তেই তোর হালুয়া টাইট হয়ে গেছে! সত্যি করে বল তো তুই আসলেই সিঙ্গেল? এমন ভয় তো মিঙ্গেল রা পায়, তুই পাচ্ছিস কেন? কারো সঙ্গে কমিটেড আছিস?”
“আরেহ না! তেমন নয়।”
“আমার তো মনে হচ্ছে না!!”
পাপিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো, “নিজেরটা আমার উপর চাপাইস না। তোর মনে শয়তানি চলতেছে বলে সবাইকে তেমন ভাবিস না।”
কুহু ওর কথা শুনে হেহে করে হাসতে লাগলো
চলবে,,,
#কাঁটাকম্পাস #পর্ব২৩
#আরশিয়া_জান্নাত
“বলছিলাম কি স্যার সত্যিই আপনি দেশে ফিরে আমাকে বের করে দিবেন?”
জাওয়াদ ফোনের দিকে চেয়ে থেকে ই বললো,” তোমার সঙ্গে রসিকতা করার মতো রিলেশন নিশ্চয়ই আমার নয়!”
“স্যার প্লিজ এমন করবেন না, আপনি তো জানেন আমি কত লয়্যাল এমপ্লয়। আমার এতো দিনের ডেডিকেশন দেখে একটু হলেও কনসিডার করুন প্লিজ!”
জাওয়াদ ওর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। সাম্য সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল। জাওয়াদের এই নিরব চাহনি সে প্রচুর ভয় পায়। মনে মনে ভাবতে থাকে কোথায় কোথায় সিভি জমা দিলে দ্রুত চাকরি মিলবে। ওকে অবাক করে দিয়ে জাওয়াদ বলল, “তোমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি, যদি কাজটা করে আমাকে স্যাটিসফাইড করতে পারো তবে…”
“আই উইল ট্রায় মাই বেস্ট, আপনি বলে তো দেখুন।”
” আরওয়ার জন্য একটা ভালো ডিনারের আয়োজন করো।”
“আপনি বলতে চাইছেন আপনাদের জন্য? আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি এই শহরের বেস্ট শেফদের হায়ার করবো। আজকে রাতের ডিনারটা ম্যাম কোনোদিন ভুলবেন না।”
“গুড লাক!”
আরওয়া রেজোর্টের ডাইনিং স্পেসে বসে কফি পান করছে। সামনের টেবিলে থাকা একটি বাচ্চা মেয়ে একটু পরপর ওর দিকে তাকায় আবার চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে ফেলে।
আরওয়া ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে। ওর ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে ভড়কে দিতে। কিন্তু সেটা করবার আগেই জাওয়াদ সেখানে উপস্থিত হলো। জাওয়াদ নিজের জন্য কফি অর্ডার করে কোচে হেলান দিয়ে বসলো।
“আপনার কাজ শেষ হতে আর কতদিন লাগবে?”
“এই তো আর ২/৩ দিন। কেন? ভালো লাগছেনা এখানে?”
“নাহ এমনিই জিজ্ঞাসা করলাম।”
“আচ্ছা!”
কফি পান শেষে জাওয়াদ বলল, “আরওয়া মিউজিয়াম পছন্দ করো?”
“করবো না কেন? যাবেন নাকি?”
“হুম। চলো যাই?”
“বেশ তো চলুন।”
টোকিও ন্যাশনাল মিউজিয়াম জাপানের প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নিদর্শন হয়ে আছে। জাপানিজরা তাদের অতীতের বিভিন্ন মিথ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এবং তাদের বর্তমান জীবনেও সেটার প্রভাব লক্ষণীয়। তাদের আচার অনুষ্ঠানগুলো সেটারই প্রমাণ দেয়। আধুনিক সভ্যতার সাথে অতীতের সভ্যতার মেলবন্ধনে জাপান হয়ে উঠেছে অনন্য। মিউজিয়াম পরিদর্শন করে জাওয়াদের কাছে এমনটাই মনে হলো। সেখান থেকে বেরিয়ে ওরা হালকা স্ন্যাক্স করলো। সাম্যর টেক্সট পেয়ে আরওয়াকে নিয়ে লোক্যাল ট্রান্সপোর্টে করেই নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতেই আরওয়া বলল, “আমরা কোথায় যাচ্ছি? গাড়িতে না উঠে বাসে উঠলেন যে?”
“গাড়িতে বোর লাগছিল তাই ভাবলাম লোক্যালে চড়ে দেখি!”
“ওহ আচ্ছা!”
“এই আরওয়া তুমি তো ডোরেমন পছন্দ করো তাই না?”
“আপনি কিভাবে জানলেন?!”
“তোমার রুমে ডোরেমনের ছবিযুক্ত অনেককিছুই দেখেছিলাম, তাই গেস করলাম আর কি!”
“হ্যাঁ আমি ডোরেমন অনেক পছন্দ করি। আই উইশ আমার একটা ডোরেমন থাকতো। যা চাইতাম তাই ওর পকেট থেকে বের করে দিতো!কি মজা হতো তাই না!”
“ওর কোন গ্যাজেটটা তোমার সবচেয়ে পছন্দ?”
“টাইম মেশিন! আমার কাছে টাইম মেশিন থাকলে সুযোগ পেলেই আমি অতীতে গিয়ে ঘুরে আসতাম। কত্ত মজা হতো!”
জাওয়াদ হেসে বললো, “তুমি আসলেই বাচ্চা! তা ডোরেমনের শহরে এসেছ ওদের বাসা দেখবে না?”
“ওদের বাসা সত্যিঈ আছে?”
“ট্যুরিস্টদের জন্য ওরকম করে তৈরি করা হয়েছে শুনেছিলাম। খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। তুমি চাইলে কাল ওখানে যাবো কেমন?”
“ওয়াও! আমি খুব এক্সাইটেড। সত্যি সত্যি ওদের বাসা দেখবো ভাবতেই আনন্দ লাগছে।”
রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করতেই তাদের ফুল দিয়ে স্বাগত জানানো হলো। আরওয়া অবাক হয়ে বলল, “এখানে কোনো অনুষ্ঠানে চলছে নাকি? হঠাৎ এতো ফুল দিলো যে?”
“তোমাকে বোধহয় উনাদের পছন্দ হয়েছে। তাই ফুল দিয়ে বরণ করলো।”
“এহহ! মজা করছেন আমার সঙ্গে!”
জাওয়াদ হাত বাড়িয়ে বললো, “চলো ভেতরে যাই?”
আরওয়া খুশিমনেই ওর বাহু জড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো। বাহারি ফুলে বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে রেস্টুরেন্ট টি, লন্ঠনের আলোয় চারদিকটা ভীষণ মায়াময় লাগছে। আরওয়া ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখতে লাগলো। এতো সুন্দর একটা রেস্টুরেন্টে একটা মানুষ ও নেই ভেবে খানিকটা অবাক ই হলো বটে। আফসোসের স্বরে বললো, “আপনি কি না জেনেই এই রেস্টুরেন্টে এলেন? এখানে বোধহয় খাবার বিশেষ সুবিধার না। দেখুন না এতো সুন্দর পরিবেশ অথচ একটা কাস্টমার ও নেই!”
জাওয়াদ ওর কথা শুনে বললো, “আসলেই তো ভুল চুজিং ছিল। চলো বেরিয়ে যাই?”
“নাহ! এটা সুন্দর। খাবার খেয়ে দেখি আগে এমনো হতে পারে খাবার খারাপ না!”
“না জেনেই ভরসা করা কি ঠিক হবে?”
“সবকিছু তো আগে থেকে জানা থাকেনা। দাদীজান বলেন, ধাক্কা না খেলে কেউ পাক্কা হয় না।”
“এখানে তোমার ধাক্কা খাওয়ার প্রয়োজন তো দেখছি না। অপশন অনেক আছে।”
আরওয়া ওর পেছনের দেয়ালটা পয়েন্ট করে বললো, “ঐ দেখুন…”
জাওয়াদ পেছনে ফিরে দেখলো খুব সুন্দর কার্ডে তাদের নাম লেখা।
“এটা আপনিই বুকিং করেছেন তাই না? অথচ এমন ভান করছেন যেন কিছুই জানেন না।”
জাওয়াদ উত্তরে কেবল হাসলো।
বেশ কয়েকজন শেফ নিয়ে ওখানকার ম্যানেজার উপস্থিত হলেন। জানালেন উনারাই আজ তাদের জন্য ডিনার প্রস্তুত করছে। তারপরই ওয়েটার এসে এক এক করে বিভিন্ন খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেল। জাওয়াদ চেয়ার টেনে তাকে বসিয়ে নিজেও অপর চেয়ারে বসলো। মৃদু সুরে বাজতে লাগলো জাপানের ঐতিহ্যবাহী গান। সময়টা দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠলো।
।
একটু পরেই কুহুকে দেখতে পাত্রপক্ষ আসবে। ওদের জন্য সোনারগাঁও হোটেল থেকে খাবার এসেছে, বাসায় ও বেশকিছু আইটেম করা হয়েছে। কোহিনুর এই সমন্ধটা নিয়ে ভীষণ এক্সাইটেড। তার মতে কুহুর জন্য এর চেয়ে ভালো পাত্র হয় না। তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে এসেছে বলেই এই বাড়তি আনন্দ কি না সেটা আপাতত বোঝা যাচ্ছে না। তবে এখানে বিয়ে হলে উনার ভাইয়ের ইমেজ সুন্দর হবে এমনটাই ধারণা তার।
পাপিয়া কুহুর রুমে বসে আছে। অন্য কোনো ওকেশনে কুহু ঘন্টা তিনেক আগে থেকেই সাজতে বসে গেলেও আজ তার হোলদোল নেই। সে আপনমনে হুমায়ূন আহমেদের “কুহক” বইটা পড়ছে।
“আপু তুই রেডি হবি না?”
“গল্পের ক্লাইমেক্সে আছি ডিস্টার্ব করিস না তো!”
“তুই এই সময়ে বই নিয়ে বসলি কেন? উঠ না। বড় আম্মু আমাকে বললো তোর হলো কি না দেখতে, উনারা আসার সময় হয়ে গেছে..”
কুহুর কোনো ভাবান্তর হলো না। সে বইয়ের ভেতরেই ডুবে রইলো। পাপিয়া বিরক্ত হয়ে ওর রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নিজের রুমে গিয়ে বসতেই ফোনে রিজভীর কল আসে।
“হ্যাঁ রিজভী বল..”
“আজ ভার্সিটি এলি না কেন?”
“বাসায় গেস্ট আসবে তাই যাই নি।”
“তুই কি এখনো ছোট খুকী আছিস? ছোটবেলায় গেস্ট আসলে আমরা স্কুল কামাই দিতাম আর তুই বড় হয়েও সেই ধারা অব্যাহত রাখছিস!”
“বড় হলে দায়িত্ব আরো বাড়ে ওসব তুই বুঝবি না।”
“তোদের বাসায় কামলা খাটার মতো কিছু তো নাই। তোদের বাসায় গেস্ট আসা মানেই অর্ধেক খাবার আসবে বাইরে থেকে আর অর্ধেক হবে তোদের বিখ্যাত শেফ দিয়ে! তারপরও যে ভাবে বললি যেন তুই সব করছিস!”
“এতো প্যাচাল পাড়ছিস কেন, আমাদের পরিবারে প্রথম মেয়েকে দেখতে আসছে বলে কথা। ছোট আব্বুরাও সকালে চলে এসেছেন। একটু পরেই ফুফুরাও আসবে হয় তো।”
“বাবারে এলাহী কান্ড!”
“হুহ তোদের ওখানে যেন হয় না?”
“ভাই আমাদের এতো ক্যাচাল নাই, আপুকে দেখতে আসছিল আর রেস্টুরেন্ট বুক করেছিল। যা করার ওরাই করেছে। আমরা জাস্ট আলাপ আলোচনা করেছি। এটাই সিম্পল ওয়ে।এখনো কেউ বাসায় এনে এতো প্যারা নেয়?”
“কিছু করার নেই, আমাদের এখানে এমনি হয়।”
“আচ্ছা কাল তাহলে আসিস। রাখছি।”
“ওকে বায়”
“ঐ পাপিতা দাঁড়া দাঁড়া…
“কি বল?”
“তুই আবার ওদের সামনে যাইস না..”
পাপিয়া বিরক্ত গলায় বললো, “তুই এখনো আগের দিনে আছিস যে একজনকে দেখতে এসে আরেকজনকে পছন্দ করে ফেলবে?”
“দেখ মামা যুগ বদলাইলেও খাসিলত বদলায় নাই। আমরা সবাই বেটার অপশন খুঁজি। যদিও কুহু আপু দেখতে তোর চেয়ে বেটার। কিন্তু কিছু আবাল আছে বুঝলি, যাদের চোখে তুইই আটকাবি।”
“বলছে তোরে।”
“আমার কথা অবহেলা করিস না। পরে পস্তাবি। বিয়ে কনফার্ম না হওয়া অবদি ঐদিকে পা মারাইস না…”
পাপিয়া ফোন রেখে দিলো। রিজভীর মাথায় আসলেই সমস্যা আছে। অথবা ওর চোখ নাই। কুহু আপুর গায়ের রং থেকে শুরু করে সবকিছুই বেস্ট। তাকে ফেলে ওর দিকে কেউ নজর দিবে এ ভাবাও বোকামি। যদিও সে দেখতে কোনো অংশে কম না। তবে কুহুর তুলনায় কমই!
।
জাওয়াদ ল্যাপটপে কিসব টাইপ করায় বিজি। আরওয়া তার সামনে অযথাই ঘুরঘুর করছে। নাহ এরকম চুপচাপ থাকা তার পক্ষে আর সম্ভব না। সে জাওয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “আপনার এই প্রেমিকাটা কে কিছুক্ষণের জন্য ছাড়বেন?”
“জরুরী কাজ করছি আরওয়া। ডিস্টার্ব করো না।”
“সারাদিন তো কাজই চলে আপনার। রাখুন না এটা, আমি বোর হচ্ছি।”
“ওয়েট আর অল্প।”
আরওয়া বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। বেকার জীবনযাপন করার চেয়ে কঠিন কাজ এই মুহূর্তে আর কিছুই মনে হচ্ছে না। জাওয়াদ ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরওয়ার দিকে তাকালো। আরওয়া মনমরা হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। জাওয়াদ উঠে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো, দু’হাতে কোমর জড়িয়ে বললো,” মন খারাপ করলে?”
“নাহ মন খুশি করেছি!”
“এটা আবার কেমন কথা?”
“এটা হলো আরওয়া কথা।”
“নাইস!”
“হুহ! উঠে এলেন কেন যান না যান ঐ রাক্ষসীকে কোলে নিয়ে বসে থাকেন। ও ই আপনার সবচেয়ে প্রিয়।”
“তুমি এতো হিংসুটে আরওয়া? ওটা জাস্ট একটা ডিভাইস…”
“সে যাই হোক আমার চেয়ে ওর প্রায়োরিটি ই বেশি এ আমি জানি তো।”
“ভুল জানো না। এটা সত্যিই।”
আরওয়া নাক ফুলিয়ে ওর হাত সরিয়ে বললো, “জানি তো আমি। ঘটাও করে বলতে হবে না। যন্ত্রমানবের কাছে যন্ত্রই সব হয়। আমিই অযথা রক্তে মাংসে গড়া মানুষ আপনার জীবনে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি।”
জাওয়াদ ওর নাক টেনে বললো, “রেগে গেলেই তোমার নাকটা এমন ফুলে উঠে না দেখতে একদম….”
“বলবেন না আমি শুনতে ইচ্ছুক না।”
“আরেহ শুনবা তো আগে।”
“আমি জানি আপনি এমন কিছুর সঙ্গে তুলনা করবেন যা শুনে আমার মেজাজ আরো বেশি খারাপ হবে!”
“তুমি দেখছি আমাকে ভালোই চিনেছ! কিন্তু না বললে তো হবেনা আমার। তুমি যখন রেগে নাক ফুলাও তোমাকে একদম ফণা তোলা সাপের মতোই লাগে।”
আরওয়া বিবর্ণমুখে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,”শেষে কি না ফণা তোলা সাপ! মানুষ তার ওয়াইফকে কত সুন্দর উপমা দেয় আর আপনি!”
“যখন যেটা মিলে সেটা বলবো না? আমি তো তখন রীতিমতো ভয়ে থাকি কখন আবার সেদিনের মতো ছোবল মারো।”
“মেজাজ খারাপ করলে শাস্তি তো পাবেনই।”
জাওয়াদ বাকা হেসে বলল,”মেজাজ খারাপ হলে যে শাস্তি দেয়, মেজাজ ভালো হলে সে নিরব থাকে কেন? এটা তো অন্যায়!”
“মানে?”
“মানে কাল তো তুমি খুব আনন্দিত ছিলে, রিওয়ার্ড তো পেলাম না! এটলিস্ট একটা চুমু তো ডিসার্ব করি নাকি?”
আরওয়া হা করে ওর দিকে চেয়ে রইলো রুষ্ট গলায় বলল, “আপনি তো ভালো ই লুচু, আগে তো বুঝি নি!”
জাওয়াদ ডোন্ট কেয়ার মুডে বলল, “বউয়ের সামনে সভ্য থাকলে প্রজন্ম আগায় না। লুচু হতেই হয়।”
“এহহ! এতো দিন তো ঠিকই রোবট ছিলেন। অনুভূতি এলো কবে?”
“অনুভূতি ছিলো না মানছি তবে রোবট নই। রোবট হলে তোমায় হুটহাট চুমু খেতাম না, এইটুকু বোঝা উচিত ছিল!”
“হুহ সবকটা তো রাগের বশেই ছিল আপনার।”
জাওয়াদ ওর মাথায় টোকা দিয়ে বলল, “বড় হও সোনা! তুমি এখনো অনেক পিচ্চি!”
আরওয়া নিজের মাথা ঘষে বলল, “আমি মোটেও পিচ্চি না….”
চলবে…
#কাঁটাকম্পাস_পর্ব২৪
#আরশিয়া_জান্নাত
২৪
বেশ সাদামাটা অবস্থায় কুহু পাত্রপক্ষের সামনে যায়। এতে অবশ্য তাদের সুবিধা ই হয়েছে। মেকাপের কৃত্রিম আস্তরণে আসল চেহারা বোঝার উপায় থাকেনা। কুহু দেখতে চমৎকার মেয়ে! এমনিতে ওর গায়ের রং ফর্সা না তবে বেশ পরিষ্কার। সে নিজের ত্বকের যত্নে একটুও ছাড় দেয় না। ও খাবার খেতে ভুলে যেতে পারে কিন্তু স্কিনকেয়ার করতে কখনোই ভুলে না। ৫ফুট ৪ইঞ্চি হাইটের ছিমছাম গড়নের বাঙালি মেয়ে, পিঠ অবদি ঝলমলে বাদামি রঙের চুল। এটা অবশ্য কৃত্রিম উপায়ে করা। তাকে দেখে বাইরের গেস্ট রা অবাক না হলেও বাসার সবাই বেশ অবাকই হলেন বটে! সে যাই হোক উনাদের কুহুকে পছন্দ না করার কোনো কারণ থাকে না। এক প্রকার পাকা কথা দিয়ে ই উনারা বিদায় নেন। কিন্তু জোবায়ের সাহেবের গম্ভীর চেহেরা দেখে বাড়ির কেউই আনন্দ প্রকাশের সাহস পায় না। তিনি থমথমে গলায় বললেন, “বড় বৌমা, তোমার ভাইকে বলবে নেক্সটবার যেন দেখেশুনে সম্বন্ধ আনে। এখানে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা ও মাথায় এনো না।”
তার ঐটুকু কথাই যথেষ্ট হয়ে যায় কোহিনুরের নাকের পানি চোখের পানি এক করতে। সবাই বুঝে নিলেন এখানে আর আশা নেই।
জোবায়ের সাহেব নিজের ঘরে যেতেই সালমাও তার পিছু পিছু আসেন। ধীর গলায় বললেন, “কি হয়েছে হঠাৎ আপনি একদম না করে দিলেন?”
জোবায়ের সাহেব ইজিচেয়ারে বসে বললেন, “বাহ্যিকভাবে কোনো কিছু যাচাই করো না। তুমি ছেলের চায়ের কাপ ধরা দেখেছ? ও মাদকসেবী এ আমি হলফ করে বলতে পারি। বিশ্বাস না হলে তোমার বড় ছেলেকে বলো খোঁজ নিতে। আমি বেঁচে থাকতে এই ছেলের সঙ্গে আমার নাতনিকে বিয়ে দিবো না। ছেলে গরীব হলেও চলে কিন্তু মাদকাসক্ত আর চরিত্রহীন হলে চলে না।”
সালমা আর কোনো কথা বললেন না চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন। কথাটা হাওয়ার গতিতে পুরো বাড়ি ছড়িয়ে গেল নাহিয়ানের বাবা নূর মোহাম্মদ রেগে অস্থির হয়ে উঠলেন সমন্ধির উপর। সাথে সাথে লোক লাগানো হলো ছেলের যাবতীয় খবরাখবর বের করতে। যদি এটা সত্যি হয় তবে কি ঘটবে বলা বাহুল্য!!
কিছু ক্ষণ আগেও যে বাড়িতে উৎসবের আমেজ ছিল এখন সেটা গোরস্থানে পরিণত হয়েছে। পাপিয়া মন খারাপ করে কুহুর ঘরে গেল। উদাস গলায় বলল, “যদি দাদাসাহেব এর ধারণা সত্যি হয় বড় মামাদের সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখতে দিবেনা বড় আব্বু! কি হবে তখন বুঝতে পারছিস আপু?”
“ভুল করলে ভুলের শাস্তি তো পেতেই হবে। এমনিতেই উনাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বিশেষ সুবিধার না। আম্মু এই সুযোগে নিজের ভাইয়ের একটা ভালো ইমেজ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। মামার উচিত ছিল ভালোমতো খোঁজখবর নিয়ে আগানো।”
“মানুষের ভেতর কি আছে তা কি বাইরে থেকে বলা যায় আপু? হয়তো মামা ভেবেছিলেন ছেলে ভালো ফার্মে জব করে, শিক্ষিত ও ধনী পরিবারে। আর কি চাই?! এখন ছেলের ভেতরের খবর কে জানবে?”
কুহু মোবাইল রেখে পাপিয়ার দিকে তাকালো। সিরিয়াস গলায় বলল, “পাপ্পি তুই এখনো অপরিপক্ক। বাইরের মানুষের হিসাবনিকাশ বুঝিস না। মানছি বাইরে থেকে মানুষ কে চেনা যায় না। তবে একতরফা অতো প্রশংসা করার কি দরকার ছিল? উনি যে পরিমাণ ভালো ভালো কথা বলে সময় নষ্ট করেছে ঐ সময়টায় লোক দিয়ে খোঁজখবর নিতে পারতেন না?
এখনের যুগে কারো ভেতরের খবর বের করতে গোয়েন্দা লাগে? বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে বসলেই অর্ধেক খবর পাওয়া যায় বুঝলি!”
“বড় আম্মু কান্নাকাটি করছে। তুই গিয়ে উনাকে সান্ত্বনা দিবি?”
কুহু হাই তুলে বলল,” ওটার জন্য বাড়িতে অনেক লোক আছে। তুই গিয়ে রাহেলা খালাকে বলিস আমার জন্য ফ্রুট সালাদ টা নিয়ে আসতে। আমি কিন্তু আজ রাতে ভাত খাবো। বলবি ভালো আইটেম গুলো যেন রাখে আমার জন্য।”
পাপিয়া মনে মনে বলল, “তুই আসলেই অদ্ভুত রে! এমন পরিস্থিতিতে ও কত স্বাভাবিক আছিস!”
আরওয়া শাওয়ার নিয়ে সাবার দেওয়া নাইটিটা পড়লো। বেচারি যখন এতো শখ করে দিয়েছে না পড়াটা অন্যায় হবে। চুলে টাওয়েল জড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বেশ আয়েশ করে ড্রেসিং টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে মুখে ক্রিম দিয়ে, হাতেপায়ে লোশন মাখলো। আজকের হাইকিং টা দারুণ ছিল। এতোক্ষণ খুব টায়ার্ড লাগলেও শাওয়ার নেওয়ার পর শান্তি লাগছে। ফেরার সময় দুজনেই ডিনার করে আসায় আপাতত বিশেষ খিদে নেই। এখন জাওয়াদ ফিরলেই আরাম করে ঘুম দিবে। জাওয়াদ যে কোথায় গেল কে জানে। একটু আসছি বলে যে বেরিয়েছে আধা ঘন্টা হয়ে গেল ফেরার নাম নেই। আরওয়া নিজের ফোন বের করে জাওয়াদকে কল করলো দু তিনবার রিং পড়তেই দরজা খোলার শব্দ এলো। আরওয়া ফোন কানে রেখেই পেছনে ফিরলো। জাওয়াদকে দেখে বললো, ” এই আপনার ২মিনিটে আসা?”
জাওয়াদ হাতে থাকা প্যাকেটগুলো রেখে বললো, “আর্লি ডিনার করে তো চলে এসেছি। রাতে যদি তোমার ক্ষুধা পায়? তাই হালকা কিছু নিয়ে এসেছি।”
আরওয়া ওর গলা জড়িয়ে আদুরে গলায় বললো,”ওওও সো কেয়ারিং জামাই!!!”
” তাই নাকি!”
“হুম অবশ্যই।”
“আচ্ছা তুমি বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”
“ওকে”
আরওয়া প্যাকেট থেকে খাবারগুলো বের করে টেবিলের উপর রাখলো। টাওয়েল সরিয়ে চুলগুলো মুছে বেলকনিতে সেটা মেলে দিয়ে আসলো। জাওয়াদ বের হয়ে হঠাৎ ওর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। টিপ্পনী কেটে বললো, “সকালের কথায় কাজ হয়েছে দেখছি। রিওয়ার্ড দিতে একদম তৈরি হয়ে বসে আছ,এমেজিং! এই না হলে আরওয়া!”
আরওয়া জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “মানে?”
জাওয়াদ ওর দিকে কদম এগিয়ে বললো, “সত্যিই বোঝো না নাকি বুঝেও না বোঝার ভান ধরো হুম? ”
আরওয়া পেছাতে পেছাতে বললো,”আপনি বাংলা সিনেমার গুন্ডাদের মতো এগিয়ে আসছেন কেন?”
জাওয়াদ থমকে বললো, “আমি বাংলা সিনেমার গুন্ডা?”
“ভাবভঙ্গি তো ওটাই। পুরাই মিশা সওদাগরের মতো।”
জাওয়াদ ভোঁতা মুখে বললো, “সিরিয়াসলি আরওয়া? আমাকে তোমার মিশা সওদাগর মনে হলো?”
“যখন যেটা মিলে সেটা বলবো না?”
জাওয়াদ আরওয়ার পিঞ্চটা বুঝতে পেরে বললো, তুমি এতো মিন! কথাটা ব্যাক না করে হজম করলে না।”
“আরওয়া ঋণ রাখেনা। যা পায় তা শোধ করেই দম ফেলে।”
জাওয়াদ আর কথা বাড়ালো না। জেগে উঠা অনুভূতি একপাশে সরিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। আরওয়া হঠাৎ কি মনে করে বেলকনিতে গিয়ে জাওয়াদকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো, পিঠে গাল ঠেকিয়ে বললো, ” রাগ করলেন”
“নাহ।”
“করেছেন, আপনার গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে।”
জাওয়াদ ওর দিকে ফিরে বললো, ” আমার রাগ করাটা অহেতুক জানি। আমি মজা করে বলেছিলাম তুমি সেটা ফেরত দিয়েছ। এটা স্বাভাবিক হয়তো। কিন্তু আমাকে প্রতিপক্ষ ভেবো না আরওয়া। আমার ভয় লাগে এটা!”
“ওভারথিংক করবেন না জনাব। সহজভাবে নিতে শিখুন এটা স্বাভাবিক মনে হবে। আমি জানি আপনার এই ফোবিয়া ওভারকাম করা সহজ না, আমরা চেষ্টা তো করতে পারি তাই না? খুঁত ধরা বা বৈশিষ্ট্য মিলিয়ে ফেলার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই দেখবেন সব ঠিকঠাক।”
“চেষ্টা করবো…”
“আমি ও চেষ্টা করবো আপনাকে রিভেঞ্জ টাইপ রিপ্লাই না করতে।”
জাওয়াদ মুচকি হেসে বলল, “আমাকে বোঝার জন্য ধন্যবাদ আরওয়া! আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ।”
আরওয়া দু হাত মেলে বলল, “কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ দিচ্ছি, আমায় ভালোবেসে পুষিয়ে দিন!”
জাওয়াদ ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “কত ভালোবাসা চাই তোমার শুনি?”
“যতোটা ভালোবাসলে অন্য কাউকে ভালোবাসার মতো জায়গা অবশিষ্ট থাকবেনা, ততোটা ভালোবাসুন।”
জাওয়াদ আলগোছে তাকে কোলে তুলে বলল,”ভায়োলেট কালার তোমার জন্য নিষিদ্ধ করা হলো। এই কালারটা জাস্ট আমার সামনে পড়বে। মনে থাকবে?”
“কেন এই কালারে আমাকে মানাচ্ছে না?”
জাওয়াদ ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,”মাথা নষ্ট করার মতো মানিয়েছে, আজ না আমি বেপরোয়া হয়ে যাই!!”
আরওয়া ওর টিশার্ট খামচে বললো, “উহু আজ নয় আজ নয়। আমি খুব টায়ার্ড।”
জাওয়াদ তার গলার ভাঁজে নাক ডুবিয়ে নেশাতুর গলায় বলল, “এই মেয়ে মাত্রই না বললে অনেক ভালোবাসা চাই? এখন মত বদলালে তো হবে না।”
বলেই পরম যত্নে সহস্র আদরে ভরিয়ে দিতে লাগলো। জাওয়াদের প্রেমের বর্ষণে ভিজে একাকার হতে লাগলো আরওয়া।
।
কাল সকালে ওরা বাংলাদেশে ফিরে যাবে। তাই
মিস্টার ইয়োশি আজ তাদের বাড়িতে জাওয়াদদের নিমন্ত্রণ করেছে। সাম্য তাদের জন্য বেশকিছু ফলমূল ও উপহার সামগ্রী কিনে গাড়িতে রেখেছে। জাওয়াদের মন জয় করতে এমন কিছু বাকি নেই যা সে করছেনা। এতে যদি অন্তত তার চাকরি টা বাঁচে! সাম্যর খুব পছন্দের শহর টোকিও। এখানে ঘুরছে ফিরছে ঠিকই কিন্তু মনটা অশান্তি তে আছে। আজ যদি এই টেনশন না থাকতো সেও মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে পারতো। তবে এইটুকু স্বস্তির ছোটবোনের পছন্দসই শপিং সে করতে পেরেছে।
চলবে,,