#কাঁটাকম্পাস #পর্ব২০
#আরশিয়া_জান্নাত
সালমা বাগানের সামনে এসে দেখলেন তার মেজ ছেলে জহির রোজকার মতো আপনমনে কথা বলে বলে গাছে পানি ঢালছে। তিনি হেসে ছেলের দিকে এগিয়ে গেলেন। মৃদু গলায় বললেন, “হ্যাঁ রে জহির তোর গাছগুলো উত্তর দেয়?”
“দেয় না বলছো? দিচ্ছে তো।”
“কিভাবে শুনিস? ওরা তো শব্দ করেনা!”
“শব্দ দিয়ে কি সবসময় যোগাযোগ করতে হয় মা? বিনা শব্দে কি মনের কথা জানা যায় না? বলা যায় না?”
সালমা শ্বেতপাথরের বেঞ্চিতে বসে বললেন, “শব্দের তাৎপর্য অনেক বেশি। বিনা শব্দে মনের কথা সবাই বুঝতে পারে না। সর্বোচ্চ আন্দাজ করতে পারে। কিন্তু আন্দাজ করে কি সব হয়?”
” জটিল করে ভাবলে সবই কঠিন। সবকিছু তে যুক্তি খুঁজতে গেলে জটিলতা আসে। শব্দের তাৎপর্য অনেক এ আমি মানি বলেই ওদের সঙ্গে কথা বলি।”
“তোর গবেষণার কি খবর? কোনো ফলাফল কি এলো?”
“সময় লাগবে।”
“ওহ!”
“শুনলাম বড় ভাইজান দেশে ফিরবেন?”
“আমি ও শুনেছি। কুহুর বিয়ে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছে হয়তো।”
“ভালো।”
জাওয়াদ মিটিং শেষে ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত হয়ে গেছে। দীর্ঘ সফর শেষে একটুও রেস্ট করার ফুরসত পায়নি বেচারা। মনে মনে ঠিক করেছে রুমে ফিরেই হট শাওয়ার নিয়ে লম্বা ঘুম দিবে। সাম্য আধমরা হয়ে গাড়িতে হেলান দিয়ে পড়ে আছে। ক্লান্তিতে তার চোখ বুজে আসছে। এই যন্ত্রমানবের পাল্লায় পড়ে ওর জীবনের আরাম আয়েশ সব নাই হয়ে গেছে। মানুষ কতোটা অমানবিক হলে ১০/১২ ঘন্টা জার্নি শেষে ল্যান্ড করেই মিটিং জয়েন করে? শুধু মাত্র চাকরির বাজার খারাপ বলে সে ধৈর্য ধরে পড়ে আছে। নয়তো কবেই ছেড়ে দিতো!
“সাম্য? তুমি কি বসে বসে ঘুমাচ্ছ নাকি?”
“নাহ স্যার। জেগেই আছি।”
“ওহ! আচ্ছা শোনো এখানের ট্যুরিস্ট স্পট সম্পর্কে ইনফরমেশন কালেক্ট করো। প্রয়োজনে মিস্টার ইয়োশির হেল্প নিও।”
“ওকে স্যার।”
জাওয়াদ রুমে ঢুকে দেখে আরওয়া বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে দেখেই হাসিমুখে বললো, “আপনার কাজ শেষ হলো?”
“আজকের জন্য শেষ। ডিনার করেছ?”
“নাহ।”
“অর্ডার করে দাও। আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি।”
“আচ্ছা।”
ডিনার সাজিয়ে আরওয়া চুপচাপ বসে রইলো। ওর পেটের ভেতর কথারা দৌড়াদৌড়ি করছে। জীবনের এই প্রথম সে এতোক্ষণ চুপ থেকেছে। জাওয়াদ বেরিয়ে আসতেই আরওয়া বলল, “আপনার উচিত ছিল আমার জন্য একটা পার্টনার আনা। সাম্য ভাইয়ার ওয়াইফ নেই? উনাকে আনলেও তো হতো। আমি তো একদিনেই বোর হয়ে গেছি!”
জাওয়াদ টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বললো, “সাম্য আনমেরিড। তুমি বললে আমার গফকে আনতে পারি। ও তোমার সঙ্গ দিবে…”
আরওয়া জাওয়াদের জন্য প্লেট সাজিয়ে বলল, “আপনি এই মাইন্ডগেইম বন্ধ করুন। আপনার এই কল্পিত চরিত্রকে বারবার টেনেহিঁচড়ে সামনে আনতে হবেনা।”
“মাইন্ডগেইম মনে হচ্ছে কেন?”
“ভেরি সিম্পল। এতোদিন যার কথা মুখ দিয়ে বের হয়নি। হুট করে সে পয়দা হলো কোত্থেকে?শুনুন মেয়েদের সম্পর্কে আপনার আইকিউ খুবই লো যা বুঝলাম!”
“তুমি মনকে সান্তনা দিচ্ছ দাও সমস্যা নেই। আমি বুঝতে পারছি তোমার মানতে অসুবিধা হচ্ছে।”
“আপনি যা ভেবে আনন্দ পান। খাওয়ার সময় আপাতত ঐসব টপিক তুলতে চাইনা।”
জাওয়াদ মুচকি হেসে চেয়ারে বসলো। নিজের প্লেট থেকে খাবার তুলে আরওয়ার দিকে বাড়াতেই আরওয়া ভুত দেখার মতো চমকে উঠতেই জাওয়াদ বলল,” এমন চোখ বড় বড় করে না তাকিয়ে হাঁ করো।”
আরওয়া বিস্মিত গলায় বললো,”আপনি হঠাৎ আমাকে খাইয়ে দিচ্ছেন কেন? আপনি ঠিক আছেন তো?”
জাওয়াদ ওর মুখে খাবার তুলে দিয়ে বললো, “তোমার সংযম দেখে আনন্দিত হয়েছি। এটা তার ছোট্ট অভ্যর্থনা!”
আরওয়া ভেংচি কেটে বললো, ” এহহ আসছে বড় শাহেনশাহ!”
“আরওয়া শোনো!”
“হুম?”
“আমি সত্যিই দুঃখিত।”
“আপনার দুঃখিত হওয়াই উচিত!”
“কেন বলেছি তা না শুনেই?”
“শোনা লাগবে কেন? আপনার সব কাজ ই তো স্যরি বলার মতো।”
জাওয়াদ চোখ সরু করে বলল, “এই মেয়ে তুমি কি পাগল!”
“আগেই তো বলেছি মাথার স্ক্রু ঢিলা ছিলো, আপনাকে বিয়ে করার পর খুলে পড়ে গেছে।”
“ওহ এই ব্যাপার! তা স্ক্রু খুঁজে পাওয়ার উপায় আছে?”
“আছে তবে আপনাকে বলবোনা।”
“কেন? আমাকে বললে কি সমস্যা?”
আরওয়া ওর চোখের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। জাওয়াদের কাছে মনে হলো আরওয়ার চোখের গভীরতায় হারানো খুব সহজ। তবে সাঁতরে উঠা সহজ নয়। আরওয়া দৃঢ় গলায় বললো,”এমন জনের সাহায্য চাই না, যে হাত ধরার আগেই ছেড়ে দিতে চায়। এমনিতেই যে অভ্যাস গড়ে উঠছে, তা কাটাতে জীবন পার হয় কি না সন্দেহে আছি।”
জাওয়াদ আর কিছু বললো না। নিরবে খাওয়া শেষ করলো।
।
বারান্দার দরজা খোলা থাকায় জানালার সাদা পর্দাগুলো বাতাসে উড়ছে। নাহিয়ান একমনে তার প্রিয়তমার দিকে চেয়ে আছে। রতিক্রিয়া শেষে মেয়েটা কি পরম নির্ভরতায় ওর বাহু আঁকড়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে! নাহিয়ান ওর চুলে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেলো। ডানহাতে টেনে ওকে বুকের মাঝে নিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বলল, “আই উইশ আমি তোমাকে আমার বুকের পিঞ্জরে যত্ন করে রেখে দিতে পারতাম।”
নাহিয়ানের চোখের কার্নিশ বেয়ে উষ্ণ নোনাজল গড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীতে সবাই সবদিকে পরিপূর্ণ তা পায় না। এই চরম সত্যিটা যত তাড়াতাড়ি তারা মেনে নিবে ততোই ওদের জন্য মঙ্গল।
ভোরের আলো চোখে পড়তেই জাওয়াদের ঘুম ভাঙে। উঠে জানালার পর্দা টেনে দিয়ে ফের শুতে এসেই চোখ যায় আরওয়ার দিকে।বেডের অর্ধেকেরও বেশি জায়গা দখল করে রেখেও তার মন ভরেনি। সে সরতেই পুরোটা দখল করে নিয়েছে। জাওয়াদ আলতো হাতে ওকে সরিয়ে শুয়ে পড়লো। সাথে সাথেই আরওয়া তার গায়ে পা তুলে দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। জাওয়াদ ওকে সরতে বললেও ও রেসপন্স করলোনা। বহুকষ্টে তাকে সরিয়ে দিতেই আরওয়া ঘুমের মধ্যে ঠোঁট উল্টে কাঁদতে লাগলো। নাক টেনে টেনে বললো, “বাস্তবেও ধরতে দেন না, স্বপ্নেও ধরতে দেন না। আপনি আমাকে এতো অপছন্দ করেন কেন?”
“আরওয়া, এই আরওয়া! উঠো; উঠো বলছি।”
আরওয়া উঠে বলল,”হুম কি হয়েছে?”
“কান্না করছো কেন?”
“কিসের কান্না?”
“খারাপ স্বপ্ন দেখছিলে?”
আরওয়া উঠে বসে পড়লো, ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি। ঢুলুঢুলু চোখে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো, “ডিস্টার্ব করার জন্য স্যরি। আপনি আরাম করে ঘুমান।”
“কোথায় যাচ্ছ?”
আরওয়া জবাব না দিয়ে সোফায় শুয়ে মুহূর্তেই ঘুমিয়ে পড়লো।
জাওয়াদ ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সে আর ঘুমালোনা। আরওয়াকে কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
।
এখন এপ্রিল মাস, বাংলাদেশের মতো জাপানেও বসন্তকাল। বসন্তকালে তাদের দেশে চেরি ফুলের মেলা বসে। কাকতালীয় ভাবে ভালো সময়েই তারা এসেছে ভেবে আরওয়া বেশ আনন্দিত বোধ করে। একটু আগেই তারা উয়েনো পার্কে এসেছে। চারদিকে গোলাপি রাঙা চেরি ফুল ঝরছে,দলে দলে সবাই পিকনিক করতে এসেছে বলে আজ বেশ ভিড় সেখানে। জাওয়াদ আরওয়ার পেছন পেছন হাঁটছে দেখে আরওয়া দাঁড়িয়ে গেল। পেছন ফিরে বলল, “শুনুন? এই সুন্দর রাস্তাটায় আমি যদি আপনার হাত ধরে হাঁটতে চাই রাগ করবেন?”
জাওয়াদ ওর কথার জবাব দিলো না। এগিয়ে এসে ওর পাশে দাঁড়ালো। আরওয়া সম্মতি পেয়ে খুশিমনে ওর বাহু জড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। বাতাসে ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো করে ফুল ঝরছে, যেন তাদের অভ্যর্থনা জানাতেই প্রকৃতির এই কারসাজি।
বেশ খানিকক্ষণ হাঁটার পর একটা বেঞ্চিতে বসে আরওয়া বললো, “একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“করো”
” কথাটা এখন অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। তবে কৌতুহল দমন করতে পারছি না বলেই জিজ্ঞাসা করতে চাইছি। রেগে যাবেন না প্লিজ!”
“শুনি কি প্রশ্ন?”
“আপনি কি নারীবিদ্বেষী? আই মিন কোনো ব্যাড মেমোরিজ আছে কি না…”
জাওয়াদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ” আমাদের পরিবারে নারীর সংখ্যা বেশি। আমি তাদেরকে অনেক ভালোবাসি। তাই নিজেকে ১০০ভাগ নারীবিদ্বেষী মানতে আমি নারাজ। তবে হ্যাঁ বিদ্বেষ আছে এটা অস্বীকার করবোনা।”
“এর পেছনে ও নিশ্চয়ই কারণ আছে তাই না?”
জাওয়াদ ওর দিকে এক পলক তাকালো। তারপর বলতে লাগলো, “আমি তখন ক্লাস এইটে পড়ি। পরীক্ষা শেষে নানুবাড়ি সিলেটে বেড়াতে যাই। তখন অবশ্য আমার রুটিন ই ছিল এটা, বন্ধ পেলেই সিলেটে চলে যাওয়া। আমার ছোটমামা ছিল আমার ভ্রমণের সঙ্গী। তার সঙ্গে আমি অনেক জায়গায় ঘুরেছি। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতিগুলোর অংশীদার তিনি। তো সেবার যখন গেছি মামা তখন সবেই বিয়ে করেছে। আমি ভেবেছিলাম ছোটমামা বুঝি আগের মতোই আমাকে নিয়ে এখানে ওখানে বেড়াতে যাবে। কিন্তু আমার ধারণা ভুল প্রমাণ হলো। মামা ভীষণ বদলে গেছেন। আমি একা একাই বাড়ির আশেপাশের চা বাগানে ঘুরতাম, চেনাজানা পথে ঘুরে বেড়াতে অসুবিধা হতো না। তবে খারাপ লাগতো। আমার মাথায় তখন ঢুকে গেল বিয়ে হলেই মানুষের অন্যান্য সম্পর্ক বদলে যায়। তবুও মনকে বুঝ দিলাম এসব স্বাভাবিক। এতো মন খারাপের কিছু নেই। কিন্তু ধীরে ধীরে যতোবড় হতে থাকি, বুঝতে পারি ছোটমামী ভীষণ বদমেজাজি। উনার কথার খেলাপ হলেই অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে দ্বিধা করেন না। ছোটমামা যতো চাইতেন কোলাহল না করতে ততোই কোলাহল বাড়তো। তাদের ঝগড়াবিবাদ এমন পর্যায়ে চলে যেতো মাঝেমধ্যে তিনি জিনিসপত্র ভেঙেচুরে একাকর করে ফেলতেন। এখন বাসায় মেহমান থাকুক কি একা সেসব তিনি তোয়াক্কা ই করতেন না। আমি চেয়ে দেখতাম আমার মামা কেমন অসহায়ের মতো লজ্জিত মুখে আমার দিকে চেয়ে থাকতো। ফ্যামিলিতে ঝামেলা এড়াতে ছোটমামা মামীকে নিয়ে সেপারেট হয়ে গেলেন। আমি শুরুতে কয়েকবার তাদের ওখানে গেলেও ছোটমামীর এইসব উগ্রতা হজম করতে পারতাম না। উনি সবার সঙ্গে ভালো কথা বললেও মামার সঙ্গে কেন জানি খারাপ ব্যবহার করতেন। সবসময় হেয় প্রতিপন্ন করে কি মজা পেতেন আমি জানিনা। উনাদের মধ্যে আসল সমস্যা কি ছিল তাও আমি জানি না। বলা বাহুল্য প্রিয় মানুষের এমন হাল দেখে আমার মনের অবস্থা কি হতো!”
“উনাদের মধ্যে কি সবসময় ঝগড়াবিবাদ লেগে থাকতো? বনিবনা হচ্ছিল না যখন উনারা সেপারেট হলেন না কেন?
“জানি না। সত্যি বলতে আমি এই বিষয়ে মামার সাথে আলোচনা করতেও পছন্দ করতাম না। ”
“ওহ! কিন্তু সবাই তো এক না, আপনার পরিবারকেই দেখুন উনারা সবাই কি ওমন?”
“সবাই সম্পূর্ণ তেমন না হলেও কিছু ক্ষেত্রে মিল তুমিও পাবে। মেয়েরা অকৃতজ্ঞ হয়। ওরা অল্পতে যেমন তুষ্ট হয় তেমনি অল্পতেই রুষ্ট হয়ে যায়!”
“নারী পুরুষের সমান অধিকারও আপনার পছন্দ না; তাই না?
“একটা কথা কি জানো নারী পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। কিছুক্ষেত্রে নারীদের যেই ক্ষমতা আছে পুরুষের নেই, আবার পুরুষের যেই ক্ষমতা আছে নারীর নেই। সবাই যার যার জায়গায় বেস্ট। কিন্তু বর্তমানে চারদিকে যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা গড়ে উঠেছে, সবকিছু তে সমান অধিকার চেয়ে চেয়ে নারীরা যেভাবে উগ্র হয়ে উঠে ওটা আমার ভালো লাগেনা। এককথায় অসহ্য লাগে। আমাকে তোমার ব্যাকডেটেড লাগতে পারে, কিংবা ভাবতে পারো আমি ভুল ধারণায় আছি। এতে আমার কিছু বলার নেই। আমি নিজের ধারণাকে জাস্টিফাই করতে উদাহরণ টানতে চাই না। শুধু এইটুকু ই বলবো ওরা নিজেরাই নিজেদের ছোট করছে। রঙিন চশমা চোখে পড়ে ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে। এতে বাহ্যিকভাবে ওরা সফল হলেও সত্যিকার অর্থে ওরা ব্যর্থতার দিকেই অগ্রসর হচ্ছে।”
“পরিবর্তন কে মেনে নিন। যুগের বিপরীত স্রোতে ভাসা সহজ না। মানছি আপনার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু এ নিয়ে কথা বললে আপনাকে কেউ আস্ত রাখবে না।”
“হাহাহা! তা যা বলেছো। শাহবাগে আন্দোলন করে আমাকে টেনেহিঁচড়ে মাটিতে ফেলবে। খেয়াল করলে দেখবে আরওয়া ওরা কিন্তু আসল কাজের বেলা এগিয়ে আসেনা। ওদের যত প্রতিবাদ সব পোশাক নিয়ে! অথচ একটা সময় ছিল যখন নারীরা পোশাক পড়ার অধিকার চেয়ে জীবন দিয়েছে। বাংলার ইতিহাস ঘাটলেই পেয়ে যাবে। যাই হোক অনেক কথা বলে ফেললাম। এসব নিতান্তই আমার ভাবনা। কাউন্টার এট্যাক করতে এসো না প্লিজ।”
আরওয়া হেসে বলল, “যারা করবার তারা থেমে থাকবে না।”
চলবে,,
#কাঁটাকম্পাস #পর্ব২১
#আরশিয়া_জান্নাত
আরওয়া গার্ডেনের বেঞ্চিতে বসে ভাবছিল জাওয়াদের কথা। গতকাল তার বলা কথাগুলো একদিকে যেমন ভয় সৃষ্টি করেছে তেমনি প্রশান্তিও এনেছে। আরওয়া এক প্রকার নিশ্চিত ই হলো যেন জাওয়াদের জীবনে ২য় কোনো নারী নেই। সে অযথাই সেদিন ওসব বলেছিল। প্রতিটা মানুষের জীবনে এমন অনেক ঘটনা থাকে যা তার চিন্তাভাবনায় খুব গভীর প্রভাব ফেলে। আমরা অনেক সময় বুঝতে পারি তো অনেক সময় বুঝতে পারিনা। বিয়ে নিয়ে আজকাল চারপাশে যে বিভীষিকাময় চিত্র প্রচার করা হয়; তারপরও কোনো মানুষ সত্যিকার অর্থে বিয়ে করতে রাজি হবে না।হয়তো পারিপার্শ্বিক দিক বিবেচনা করে বা জৈবিক তাড়নায় এখনো বিয়েটা করে। তবে সুদূর ভবিষ্যতে এই গুরুদায়িত্ব নেওয়া সম্পর্কের চেয়ে একা থাকা সহজতর হবে। তাছাড়া সামাজিক মূল্যবোধ যে হারে অবক্ষয় হচ্ছে; জৈবিক চাহিদা মেটাতে বিয়ে করা তখন অহেতুক ভাবনা ব্যতিত কিছুই মনে হবেনা।
এর পেছনেও যে গভীর ষড়যন্ত্র আছে বলার অপেক্ষা রাখেনা।
সকালে ব্রেকফাস্ট করে জাওয়াদ কোথায় বেরিয়েছে আরওয়া জানেনা। সে যখন ঘুম থেকে উঠেছে, বেডসাইডে কেবল একটা চিরকুট পেয়েছিল। যাতে লেখা ছিল, “ব্রেকফাস্ট করে নিও।” আরওয়ার মনে হয় কথাটা সে মেসেজেও বলতে পারতো কিংবা কল দিয়ে। চিরকুট লেখার দরকার ছিল না। কিন্তু এই প্রক্রিয়া টা মনোরম সুন্দর! প্রযুক্তির সহজতর জীবনধারায় এইসব ছোটোখাটো ব্যাপারগুলো মনের মধ্যে ভিন্ন অনুভূতির সঞ্চার ঘটায়। মানুষ টা ২০সেকেন্ডেরও কম সময় ব্যয় করে মেসেজ টাইপ করার চেয়ে কলম হাতে নিয়ে লিখেছে; এটাই যেন আরওয়ার আনন্দের অন্যতম কারণ।
ফোনে কল আসতেই আরওয়ার ধ্যান ভাঙ্গে।”মাশাআল্লাহ! দীর্ঘজীবন লাভ করুন”
বলেই কলটা রিসিভ করে সে,”আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কোথায় আছ?”
“গার্ডেনে। আপনি কি চলে এসেছেন?”
“নাহ, আমি মাত্র ই বের হলাম। লাঞ্চে কি খাবে? এখানকার ফুড ট্রায় করবা?”
“হ্যাঁ। আপনি কি আমাকে নিতে আসবেন নাকি গাড়ি পাঠাবেন?”
“আমি আসবো। তুমি রেডি থেকো।”
আরওয়া প্রফুল্ল গলায় বললো, “আচ্ছা।”
দ্রুত নিজের রুমে গিয়ে তৈরি হতে শুরু করলো। জাওয়াদ রুমে ফিরেই টেবিলের উপর টিউলিপ ফুলের তোড়া রাখলো। আরওয়া ফুলের তোড়া টা হাতে নিয়ে বললো, “ফুল কেউ টেবিলের উপর রেখে দেয় না। এটা হাতে দিতে হয়।”
“তুমি ভুল ভাবছো। এটা আমি তোমার জন্য আনিনি। মি. সিঞ্জো এটা আমাকে দিলেন তাই এনে রেখেছি।”
আরওয়ার ইচ্ছে হলো নিজের কপাল চাপড়ে দেওয়ার। সে কিভাবে আশা করলো জাওয়াদ তার জন্য ফুল আনবে? বলদি বলদি বলদি! সে আসলেই এক নম্বর বলদি!
জাওয়াদ ফ্রেশ হয়ে এসে বলল, “মুখটা এমন বাংলার পাঁচ করে রেখেছ কেন? কি হয়েছে?”
আরওয়া গাল ফুলিয়ে বলল, “কিছু হয়নি। চলুন কোথায় যাবেন। আমার খিদে পেয়েছে।”
জাওয়ার ওর গালে মৃদু চাপ দিয়ে বললো, “ফুলকো লুচির মতো গাল ফোলাও যখন অনেক কিউট লাগে!”
আরওয়া নিজের গাল ঘষে বললো, “তাই বলে এমন চেপে ধরবেন?”
“লাগলো বুঝি?”
“নাহ ঢং করছি!”
“আশ্চর্য হবো না।”
“কি বললেন? আমি ঢং করি?”
“আমি এটা কখন বললাম? তুমি নিজেই তো নিজেকে বেস্ট চেনো।”
“কথার প্যাঁচ দিবেন না। আপনি ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে আমাকে ঢঙ্গী বলেছেন”
জাওয়াদ চুলে ব্রাশ করতে করতে বললো, “আমি ঘুরিয়ে প্যাঁচিয়ে বলিনি। একদম সহজ বাংলায় তোমার কথার সমর্থন করেছি।”
আরওয়া হাত দুটো তুলে আঁচড় কাটার ভঙ্গি করে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “মাঝেমধ্যে তো ইচ্ছে করে আপনাকে…”
“Don’t say u wanna kiss me!”
আরওয়া মুখ ঝুলিয়ে বললো,” সিরিয়াসলি ম্যান! আপনার এটা মনে হয়?”
“আমার মনে করতে হবে কেন? তোমার ভাবভঙ্গি তো স্পষ্ট সেটাই বলে। আমার তো মষে হয় তোমার স্বপ্নে আমি আর ভার্জিন নই!”
“আস্তাগফিরুল্লাহ! কি বলেন আপনি এসব?”
জাওয়াদ বাঁকা হেসে বললো, “যা সত্যি তাই বলছি। ঘুমের মধ্যে তুমি যা বলো, ওসব যদি সত্যি হয় তবে আমার ধারণা বিন্দুমাত্র ভুল নয়।”
আরওয়া জাওয়াদের কথা শুনে হা হয়ে গেল। এই লোক বলে কি এসব!!!!
রাহেলাকে সবজি কাটতে বলে রোকেয়া চুলায় মাছ ভাজতে লাগলেন। তার বড় জা কোহিনুর চিকেন মেরিনেট করে রাখছেন। এমন সময় নাহিয়ান এসে বললো,”আম্মু তোমরা এতোদিনে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে। তোমার মেয়েকে বিদায় করার ফয়সালা কে আমি সাধুবাদ জানাই।”
“তুই আবার ওর সাথে ঝগড়া করে এসেছিস তাই না?”
“আমাকে তোমার ঝগড়ুটে মনে হয়? আমি সিধাসাদা মনের মানুষ। ওসব ঝগড়াবিবাদ আমার দ্বারা কখনো হয়?”
“আহাগো সোনাগো আমার সিধাসাদা মনের ছেলে! তোকে আমি গর্ভে ধরেছি নাকি তুই আমায়? আমাকে চেনাতে আসিস না, আমি আমার ছেলেমেয়ে কে হাঁড়ে হাঁড়ে চিনি।”
নাহিয়ান রোকেয়ার আঁচল ধরে আদুরে ভঙ্গিতে বললো, ” দেখেছো মেজ আম্মু তোমার বড়ভাবী কিসব অপবাদ দিচ্ছে আমার নামে? তুমি প্রতিবাদ করবে না?”
রোকেয়া ভাজা ইলিশ প্লেটে তুলতে তুলতে বললেন, ” এটা কিন্তু ঠিক না ভাবী, মানছি ও একটু খোঁচাতে ভালোবাসে। তার মানে এই না ওর মনে প্যাঁচ আছে। ছেলে আমার সহজ-সরল ই বটে!”
“তোর কাছে ও এখনো সেই ছোট্ট খোকা! দেখিস না সুযোগ পেলেই কেমন ছোটবেলার মতো রান্নাঘরে ছুটে আসে।”
নাহিয়ান ফোঁড়ন কেটে বলল,”কিছু পুড়ে যাওয়ার গন্ধ পাচ্ছি মনে হয়!”
“বদ ছেলে দিবো এক চড়, মাকে এমন বলতে আছে?”
“ওকে তুই রেখে দে রে রুকু। আমার এই দস্যি ছেলে চাই না। তুই বরং জাওয়াদকে আমায় দিয়ে দে।”
রোকেয়া পিরিচে একটা মাছ নিয়ে নাহিয়ানের দিকে এগিয়ে বললো, “কে জানে ওরা কি হালে আছে! ছেলেটার পাগলামি কবে যে ঠিক হবে!”
“তুমি চিন্তা করো না মেজ আম্মু। এবার ফিরলে দেখবে সব ঠিকঠাক।”
“তাই যেন হয়!”
।
রেস্তোরাঁয় বসে মেনুকার্ড হাতে নিয়ে জাওয়াদ বলল, “ঝাল খেতে পারো?”
“মোটামুটি,কেন?”
“স্পাইসি রামেন ট্রায় করবেন?”
“বেশি ঝাল হবে?”
“তা তো হবেই!”
“না থাক। এতো ঝাল খাবোনা।”
“সিওর?”
“লোভ হচ্ছে তবে সাহসে কুলাচ্ছে না।”
“না চাইলে থাক। দেখো কি খেতে চাও।”
আরওয়া নিজের পছন্দসই খাবার সিলেক্ট করলে জাওয়াদ সেসব অর্ডার দিলো। আরওয়া কৌতূহলী গলায় বলল, “শুনেছি এখানে একটা টেম্পল আছে। উমম মেইঞ্জি জিঙ্গু মেইবি নাম! ওখানে বেড়াতে নিয়ে যাবেন প্লিজ?”
“বিশেষত্ব শুনি?”
“রোমান্টিক ব্যাপার, আপনি বুঝবেন বললে?”
“আমাকে তোমার আনরোমান্টিক মনে হয়?”
“অবশ্যই!”
জাওয়াদ চোখ ছোট করে আরওয়ার দিকে তাকালো। আরওয়া ডোন্ট কেয়ার মুডে বলল, “সত্যিকে মেনে নেওয়ার মতো সাহসী হয়ে উঠুন।যা সত্যি তা দিনের আলোর মতো সত্যি। ওটাকে ঢেকে রাখা সম্ভব নয়।”
“ঠিক আছে সত্যবাদী আরওয়া ম্যাম! মেনে নিলাম আপনার চোখে এটা ধ্রুব সত্যি।”
“আমার চোখেই কেবল? অন্যদের চোখে বুঝি ভিন্ন?”
জাওয়াদ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, “যেটা জিজ্ঞাসা করলাম ওটাই তো বললে না?”
“ওহ হ্যাঁ, ঐ টেম্পল টা মূলত সম্রাট মেইজি ও তার স্ত্রীকে উৎসর্গ করে নির্মাণ করা হয়েছে। ওখানে নাকি লোকেরা নিজেদের ইচ্ছা কাঠের বোর্ডে লিখে গাছে ঝুলিয়ে দেয়। আমার কাছে ব্যাপারটা খুব রোমান্টিক মনে হলো তাই আর কি!”
“ওহ আচ্ছা! তোমার ইচ্ছে যখন তখন যাবো সমস্যা নেই।”
“থ্যাঙ্কস..”
“ওয়েলকাম”
খাওয়া শেষে ওরা অনেকটা পথ হেঁটে ঘুরে বেড়ালো। স্থানীয় মার্কেট থেকে টুকটাক কেনেকাটাও করলো। সবশেষে যখন হোটেলে ফিরলো রাত প্রায় ৯টা বেজে গেছে। হোটেলে এসে দেখে সাম্য অসহায়ের মতো এককোণে বসে কফি পান করছে। আরওয়া হাসিমুখে বললো,”সাম্য ভাইয়া আপনার জন্য আমি একটা গিফট এনেছি। দেখুন তো পছন্দ হয় কি না?”
সাম্য জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে জাওয়াদের দিকে তাকালো। জাওয়াদ নিতে বললে ও গিফটের প্যাকেট টা নিয়ে বলল, “আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ম্যাম!”
জাওয়াদ লিফটে ঢুকেই বললো, “তুমি সবার জন্য গিফট নিলে আমার জন্য কিছু নিলে না যে?”
” আপনার জন্য কি গিফট নিবো আইডিয়া নেই। তাই নিলাম না।”
“আমি তো সাথে ছিলাম, জিজ্ঞাসা করতে পারতে?”
“সেটাই তো আপনি তো সাথে ছিলেন, চাইলেই নিজের পছন্দমতো কিনে নিতে পারতেন। যেহেতু কিছু ই কিনেননি তার মানে আপনার পছন্দের কিছু সেখানে ছিল না!”
জাওয়াদ বিরক্তস্বরে বলল, “অবিবেচক মেয়ে একটা!”
রুমে ঢুকতেই জাওয়াদের চক্ষুচড়কগাছ। পুরো রুম লাল গোলাপের পাপড়ি দিয়ে সাজানো।চারদিকে সুগন্ধি মোমবাতি আর টেবিলে শ্যাম্পেইন রাখা। জাওয়াদ দরজায় গিয়ে রুম নাম্বার চেক করে দেখলো ওরা ভুল করে অন্য কারো রুমে ঢুকে গেল কি না। আরওয়া ওর পেছনে এসে বললো, “কি ব্যাপার ভেতরে না গিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
“আমআদের রুম এক্সচেঞ্জ হয়েছে বোধহয়। দাঁড়া ও আমি রিসিপশনে কল দেই।”
আরওয়া ওর ফোন কেড়ে নিয়ে বললো, “রুম এক্সচেঞ্জ হয়নি। আমি ই বলেছিলাম ডেকোরেট করতে।”
বলেই সে ভেতরে ঢুকে গেল। জাওয়াদ ওর পিছু পিছু ভেতরে ঢুকে বলল, “হঠাৎ এমন ডেকোরেশন এর কারণ কি?”
“হানিমুন হানিমুন ফিল পাওয়ার জন্য! আমার তো একটুও মনে হচ্ছে না হানিমুনে এসেছি। তাই ওনাদের বললাম একটু ফুল পাতা দিয়ে সাজিয়ে দিন। বড় উপকার হবে। উনারা দেখি অনেক দয়াশীল, শুধু ফুলপাতা দেয়নাই আরো অনেককিছু দিয়েই সাজিয়েছে। আহা! আমি তো কৃতজ্ঞ হয়ে গেলাম তাদের প্রতি।”
জাওয়াদ ওর দিকে বিস্মিত চোখে চেয়ে রইলো।
চলবে…