কাঁটাকম্পাস পর্ব-১৮+১৯

0
413

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব১৮

#আরশিয়া_জান্নাত

জোবায়ের সাহেব অফিসে এসে মাত্রই জাওয়াদকে তার কেবিনে ডাকলেন। আজ তাদের একটা জরুরী মিটিং আছে। সেই বিষয়ে কথা বলতেই মূলত জাওয়াদকে ডেকেছেন। পিয়নের খবর পেয়ে জাওয়াদ কালবিলম্ব না করেই দাদার কাছে গেল।

“আসসালামু আলাইকুম দাদাসাহেব, আসবো?”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম, হুম আসো।”

তাদের ম্যানেজার আলতাফ মাহমুদ বললেন, “আমি মিটিং এর এরেঞ্জমেন্ট দেখে আসছি।”

তিনি বের হয়ে যেতেই জোবায়ের সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে বললেন, “আজকের মিটিং টা শেষ করে আয়েশাকে নিয়ে আসবে। আজ রাতে ই তোমাদের ফ্লাইট।”

জাওয়াদ বিস্মিত স্বরে বলল, “আজ রাতেই ফ্লাইট বলতে? ”

“তুমি কি এই প্রজেক্ট রিড করো নি? তোমাকে এমনিতেও আজ জাপান যাওয়া লাগতো। তাই দু’জনের টিকিট করে ফেললাম। দু’জনে বেড়িয়ে আসো।”

“দাদাসাহেব বলছিলাম কি…”

” আমি তোমার লেইম এক্সকিউজ শুনতে ইচ্ছুক নই। খবরদার সাম্যকে কাজে লাগানোর ট্রায় করবে না। এবার তাহলে ওর সাথে সাথে তোমাকেও পাবনায় পাঠাবো।”

“এতো শহর থাকতে পাবনায় কেন?”

জোবায়ের সাহেব সামনে ঝুঁকে রাগীস্বরে বললেন, “তোমরা যাকে সাইক্রিয়ার্টিস্ট বলো আমরা তাকে পাগলের ডাক্তার বলি। আমার মতে তোমার জন্য পাবনার চেয়ে ভালো হসপিটাল আর কোথাও নেই।”

জাওয়াদ মুখ ভার করে বসে রইলো।‌ জোবায়ের সাহেব পেপার ওয়েট ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, “তোমরা ভাবো তোমরা খুব স্মার্ট। চাইলেই বড়দের চোখে ধূলো দিতে পারো। কিন্তু সত্যিটা ভিন্ন। হতে পারে প্রযুক্তিগত ভাবে তোমরা অনেককিছুই জানো, তোমাদের মডার্ন টেকনোলজির নলেজ ভালো। তার মানে এই না সিনিয়র সিটিজেনদের মাথায় কিছু নেই, তোমরা চাইলেই তাদের ধোঁকা দিতে পারো!”

“দাদাসাহেব, আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। তেমনটা নয় আসলে..”

“তুমি আয়েশাকে বিয়ে করতে রাজি ছিলে‌না। তোমার মতে আমি তোমাকে জোর করছ বিয়ে দিয়েছি। এ নিয়ে তোমার অনেক ক্ষোভ। কিন্তু একটা কথা বলবে জাওয়াদ? আয়েশার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে হলেও কি তোমার অভিমত এটাই হতো না? কোনো পার্থক্য কি থাকতো?”

জাওয়াদ মাথা নীচু করে রইলো, কোনো জবাব দিলো না।

জোবায়ের সাহেব ফের বললেন, ‘তোমার জীবনে বিশেষ কোনো নারী নেই এটা আমি ভালো করেই জানি। তোমার সমস্যা আয়েশাকে নিয়ে না, তোমার সমস্যা অন্য টা। আমি চাই তুমি সেটা ওভারকাম করো।

জাওয়াদের নতমুখ দেখে তার মনটা ভীষণ খারাপ হলো। তিনি নরম স্বরে বললেন, “জাওয়াদ তুমি আমার খুব পছন্দের নাতি। আমি তোমাকে নিজের ছায়া ভাবি। দেখো দাদুভাই, সংসারজীবন সহজ না তবে অতো কঠিনও না যতোটা কঠিন তুমি ভাবো। এই পবিত্র সম্পর্কে আল্লাহর রহমত থাকে, বরকত থাকে। আমি চাই তুমি এই সম্পর্কটাকে সুযোগ দাও।‌ একে অপরের পরিপূরক হও।”

আলতাফ মাহমুদ নক করে বললেন, “স্যার সবাই রেডি আপনারা কি জয়েন করবেন?”

জোবায়ের সাহেব গায়ে কোর্ট জড়িয়ে বললো,”যাও আসছি।”

জাওয়াদ উঠে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। “সে কি আসলেই ওভারথিংক করছে? ওর ভয়ভীতি টা কি এতোই অহেতুক? আরওয়া কি সত্যিই তাদের মতো হবে না?”

রিজভী ক্লাস শেষে নিরবেই বেরিয়ে গেল। আজকাল সে কারো সাথে ই বিশেষ বলে না। ওর মনে হয় সবাই বুঝি ওকে নিয়ে হাসাহাসি করছে।
ক্যাম্পাসে আসলেই সামিয়ার জন্য মনটা পুড়ে। বারবার মনে হয়, তার ভালোবাসায় কিসের খামতি ছিল? কেন সামিয়া ওকে এতো বড় ধোঁকা দিল? হে দিনের পর দিন ওর কথা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করেছে। ও যখন যা চেয়েছে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ওর জন্য বন্ধু দের কত খোঁচা হজম করেছে। ওর বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে তার সঙ্গে ঝগড়া করতেও দুইবার ভাবেনি। অথচ সামিয়া বিনিময়ে কি দিলো? নাহ এসব ভাবতে গেলেও বুকে অসহনীয় যন্ত্রণা হয়। নিজেকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বোকা বলে মানতেও ঘেন্না লাগে।

“এই রিজভী, দাঁড়া।”

পাপিয়ার ডাকে রিজভী দাঁড়িয়ে গেল। পাপিয়া ওর পিঠ চাপড়ে বললো, “কালা হয়ে গেছিস নাকি? কত জোরে জোরে ডাকছিলাম কানে শুনিস না?”

“কি বলবি বল?”

“আমার সাথে নীলক্ষেত চল। কিছু বই কেনা লাগবে।”

“হিয়া বা সাফিন কে বল যেতে। আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না।”

“ঢং করিস না তো। তোর ঢং দেখতে দেখতে বোর হয়ে গেছি। তোর আসলে শোকরানার নামাজ পড়া উচিত। বিয়ের আগেই সেতি আসল রূপ দেখাইছে। নয়তো কি করতি ভাব একবার?”

“তুই তো খুশিই হইছোস তাই না?”

“খুশি হবো না কেন? শোন রিজভী, মেয়েদের ভালোবাসা দামি শাড়ি-গয়না বা লাখ লাখ টাকার উপর ডিপেন্ড করে না। যাকে ওরা ভালোবাসে সে খালি পকেটের হলেও ভালোবাসে। সামিয়া যার সাথে পালাইছে ও তোর মতো ধনী পরিবারের ছেলে না। ইনফ্যাক্ট ওর আর্থিক অবস্থা সামিয়ার চেয়েও খারাপ। এটা কি যথেষ্ট না তোর চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর যে ও আসলে তোকে কখনোই ভালোবাসেনি? তারপরও তুই ওর জন্য মন খারাপ করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন?”

“ও হয়তো ভালোবাসেনি, কিন্তু আমি তো বেসেছিলাম। আমার জন্য এটা মেনে নেওয়া কি সহজ?”

“কোনো কিছুই কঠিন‌ নয়। সময় খুব ভালো প্রতিষেধক। এটা সব ক্ষত সারিয়ে দেয়। তোর উচিত বাস্তবতা মেনে নিয়ে মুভ অন করা। অনেকদিন তো অন্ধ হয়ে জীবনযাপন করেছিস। এবার চোখ মেলে চারদিকে তাকা। লাইফটা ইনজয় কর। এখন চল তো আমার সাথে। আমি তোর কত কথা রাখছি আমার কথা রাখতে তোর এতো অনীহা কেন?”

অতঃপর পাপিয়ার জোরাজুরিতে সে বাধ্য হয়ে নীলক্ষেতের উদ্দেশ্যে বের হলো।

“আর নাতনি কোনাইরে? এরে তুই বুঝি আইজ হারাদিন দুয়ার বান্ধি বই থাইবি? দুয়ার খোল”

করিমুন্নেসার ধাক্কাধাক্কি তে আরওয়া দরজা খুলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। কেঁদে কেটে তার চোখেমুখ ফুলে আছে। করিমুন্নেসা নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, কিয়া হইছে কইবি তো। এরুম করি কান্ধি রান্ধি এক কইরলে কি
সমাধা হইবো নি? দাদীরে ক চাইন কি হইছে?”
আরওয়া তার কোলে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো, “দাদীজান আমি আর ও বাড়ি তে যাবো না। উনি আমাকে একটুও ভালোবাসে না। আমাকে উনি দেখতেও পারে না। আমি উনাদের ওখানে আর যাবো না। তুমি আব্বুকে বলে দাও।”

“কাইল রাইতে ভাত খাইতে বই কাইজ্জা কইরছোত ক্যান?”

” নাহ! আমি ঝগড়া করিনাই সত্যি। উনি শুধু শুধু ই আমার উপর রেগে গেছে…”

পুরো ঘটনা শুনে করিমুন্নেসা বললেন, “হেতের মাথা গরম হইলো ক্যান এডাই তো বুইঝলাম না। কিন্তু বুবু
হেতে ক্ষমা চাইছে তোর কাছে এডা ভালা দিক। তোরে আর কল টল দিছেনি? গোস্সা ভাঙ্গাইতে কিছু করছে?”

“নাহ।”

“ও!”

“দেখছো তুমিও সব শুনে স্যাড হয়ে গেছ। এখন তুমি ই বলো আমি ওখানে আর কেন যাবো?
এই বিয়ের কোনো ভবিষ্যৎ নাই। আমি উনাকে ছাড়ি দিবো। উনি আমার থেকে মুক্তি চায় তো, মুক্তিই দিবো।”

করিমুন্নেসা কিছু বলার আগেই দেখেন দরজার সামনে জাওয়াদ দাঁড়িয়ে আছে। উনার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সালাম দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। আরওয়া দ্রুত চোখমুখ মুছে ঠিকঠাক হয়ে বসলো।

“আসো ভাই বসো। খাওয়া-দাওয়া করছো?”

“জ্বি খেয়েই এসেছি। আসলে দাদী আমি এসেছি আরওয়াকে নিতে। এখনি বের হতে হবে। হাতে সময় বেশি নেই।”

“হঠাৎ এতো তাড়াহুড়া কেন? বাড়ির সবাই ঠিকঠাক আছে তো? কোনো আপদ বিপদ হয় নাই তো?”

“নাহ নাহ সব ঠিক আছে, চিন্তিত হবেন না।”

আরওয়া দাদীকে ইশারা দিলো ও যে যাবেনা সেটা বলতে। কিন্তু করিমুন্নেসা সেটা না বলে বললেন, “তাহলে?”

“আসলে আমাকে অফিসের কাজে জাপান যেতে হবে। দাদাসাহেব বললেন ওকেও সঙ্গে নিতে…”

“তোমার বউ তো তোমার উপর রাগ করে আছে।দেখো তার রাগ ভাঙ্গিয়ে নিতে পারো কি না। আমি যাই তোমার জন্য নাস্তা পানির বন্দোবস্ত করি।”

বলেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। আরওয়া মনে মনে বললো, “দাদীজান তুমিও পল্টি নিলা। মনে রাইখো!”

জাওয়াদ কিছুক্ষণ আরওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কান্না করায় ওর নাক মুখ লাল হয়ে আছে, চোখগুলো ফুলে আছে। চুলগুলো এলোমেলো ভাবে খোঁপা করা‌। সকালে রুমটা যেমন দেখে গিয়ে ছিল এখনো তেমনি আছে। জাওয়াদ বালিশ ঠিক করে একপাশে রেখে ওর সামনে বসলো। নরমস্বরে বললো, “আরওয়া গতকালের জন্য আমি খুবই স্যরি। প্লিজ ফরগিভ মি!”

আরওয়া অভিমানে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। যেন সে জাওয়াদের কথা শুনতেই পায়নি।

জাওয়াদ ওর গালে হাত দিয়ে নিজের দিকে ফেরালো। “এই মেয়ে আমি কি বলছি শুনছো না কেন? বললাম না স্যরি?”

আরওয়া গাল ফুলিয়ে বললো, “এই আপনার স্যরি বলার নমুনা? এমন ধমকে ধমকে কেউ স্যরি বলে?”

” ধমকালাম কখন?”

” জোরে বলেছেন না?”

“জোরে বললেই ধমকানো হয়?”

“নয়তো কি?”

“আচ্ছা মানছি আমার ভুল হয়েছে। আবারও স্যরি বলছি।”

“আপনি স্যরি বললেও আমি আর ও বাড়ি যাবো না। আপনি যেটা চেয়েছেন ওটাই হবে। আপনি কাগজপত্র ঠিকঠাক করে পাঠিয়ে দিবেন আমি সাইন করে দিবো।”

“তুমি ভেবে বলছো তো?”

“হুম।”

“তার মানে তুমি আমার সঙ্গে যাবে না?”

“উহু”

জাওয়াদ তার হাতে থাকা শপিং ব্যাগ থেকে আরওয়ার জন্য আনা কয়েক প্রকার চকোলেট আর আইসক্রিম বের করে সামনে রাখলো।

“এসব কি খুশিতে দিচ্ছেন? আমি আর যাবো না বলায়?”

জাওয়াদ আনন্দিত গলায় বলল, “হ্যাঁ। এসব আমার গফ কিনে পাঠালো। বললো তোমাকে এসব দিয়ে বুঝিয়ে বললেই নাকি তুমি পথ থেকে সরে যাবে। এখন দেখছি এসবের দরকার ছিল না। তুমি তো আগে থেকেই রাজী হয়ে বসে আছ। নাও এগুলো রাখো। ভালোই হয়েছে বুঝলে টিকিট তো কাটাই আছে, তোমার বদলে ওকে নিয়েই বরং জাপান যাবো।”

আরওয়া মুহূর্তে ই রণমূর্তি ধারণ করলো। ওর কলার চেপে বললো, “আপনার সাহস তো কম না। আপনি ঘরে বউ রেখে প্রেমিকা নিয়ে ঘুরতে যাবেন! আমি আপনার নামে কেইস করবো। আপনাকে আমি….”

জাওয়াদ ওর হাত ছাড়িয়ে বললো, “বি প্র্যাক্টিক্যাল আরওয়া। আগে পরে ওকেই তো আমি বিয়ে করবো। তোমাকে ডিভোর্স দিতে অলমোস্ট ৭/৮ মাস বাকি। এতোদিন তো আর অপেক্ষা করতে পারি না। তাছাড়া সুযোগ যখন পেয়েছি কাজে লাগাবো না কেন? তুমি আর বাঁধ সেধো না, কেমন? গুড গার্লের মতো এসব খেয়েদেয়ে ঘুমাও। আমি যাই আমাকে আবার ব্যাগপ্যাক করতে হবে।”

আরওয়া দরজা আটকে সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “আমি আপনাকে অন্য মেয়ের সঙ্গে যেতে দিবো না। আমিই যাবো আপনার সঙ্গে। আপনি যদি আমার কথা না শোনেন আমি আমি এখনি দাদাসাহেব কে কল করবো….”

জাওয়াদ ওর কথা শুনে মনে মনে হাসতে লাগলো।

চলবে…

#কাঁটাকম্পাস #পর্ব১৯

#আরশিয়া_জান্নাত

“আম্মা, আপনার কি মনে হয় ওদের দুজনের সংসার টিকবে?”

শিরিনের কথা শুনে করিমুন্নেসা বললেন, “একজন চঞ্চল তো আরেকজন গম্ভীর। এইরকম জুটির সংসার আরো বেশি ভালো টিকে। খালি দোয়া করো আল্লাহ ওদের মনে একে অপরের জন্য যেন ভালোবাসা পয়দা করে দেন।”

আরওয়া গাড়ি তে বসে কিছুক্ষণ উশখুশ করলো। তারপর বললো, “আপনি তাহলে স্বীকার করলেন আপনার গফ আছে বলেই এই বিয়ে মানছেন না?”

জাওয়াদ ড্রাইভ করতে করতে বললো, “তুমি তো বলেছিলে সলিড রিজন বললে চলে যাবে। আজ কথার খেলাপ করলে কেন?”

“এটা মোটেও সলিড রিজন না! বিয়ের আগে যা ছিল ছিল, এখন বিয়ে হয়ে গেছে ঐসব পুরনো কথা বাদ দিয়ে দিন।”

“দিস ইজ নট ফেয়ার আরওয়া! তুমি আমার সাথে অন্যায় করছো।”

“ন্যায় অন্যায় পরিমাপ করার সময় নেই আমার। আপনি বিয়ের রাতে বললে একটা চান্স ছিল। এখন অনেক লেট হয়ে গেছে। আমার মত বদলে গেছে।”

জাওয়াদ গাড়ি থামিয়ে ওর দিকে তাকালো। আরওয়া চারদিকে চেয়ে বলল, “এমন নিরব জায়গায় গাড়ি থামালেন কেন?”

“তুমি কি ভয় পাচ্ছ তোমাকে এখানে মে*রে ফেলে রেখে যাবো?”

“নাহ!”

জাওয়াদ বাঁকা হেসে বললো, “মুখে না বললেও চেহারা তো হ্যাঁ বলছে!”

আরওয়া শক্ত গলায় বললো, “মোটেই না।”

জাওয়াদ ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, “মত বদলালে কেন মেয়ে? আমার প্রেমে পড়েছ বুঝি?”

আরওয়ার বুকের ভেতর শিরশির অনুভূত হলো। জাওয়াদের চোখে তাকাতেই মনে হলো, “আজ কিছু একটা ভিন্নতা তো আছেই। জাওয়াদের হাবভাব তো সুবিধার ঠেকছে না। এই লোক তাকে ফুঁসলিয়ে জাপান নিয়ে সরিয়ে ফেলার গভীর ষড়যন্ত্র করছে না তো?”

কুহু, পাপিয়া আর সাবা আরওয়াদের বেডরুমে বসে ওদের ব্যাগপ্যাকে সহায়তা করছে। কুহু বলল, “যাক অবশেষে তোমাদের হানিমুন হচ্ছে! আমি তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম।”

পাপিয়া বলল, ” এটা হানিমুন বললে ঠিক হবে? কাজেই তো যাচ্ছে!”

কুহু– ” শোন ভাইয়া থেকে এরচেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না। ও কাজের জন্য হলেও যে নতুন ভাবিকে সঙ্গে নিচ্ছে এই ঢের। কি বলো ভাবি?”

সাবা– “হুম একদম ঠিক। গতবার তোমার ভাইয়া কি সুন্দর চিটাগং এ পাঠানোর কথা দাদাসাহেবের কানে তুলেছিলেন। পরে কি হলো কে জানে যাওয়াই ক্যানসেল হয়ে গেছে!”

পাপিয়া– “যা হয় ভালোই হয়। এবার একেবারে জাপান চলে যাবে। দেশের পর্যটন কেন্দ্র গুলো সময় পেলেই ঘোরা যায়। তবে বাইরে তো সবসময় যাওয়া পরে না। কি বলো নতুন ভাবি?”

আরওয়া– ” মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে, বুঝতে পারছি না।”

সাবা আলগোছে একটা প্যাকেট আরওয়ার ব্যাগে রেখে দিলো। যাওয়ার সময় আরওয়ার কানে কানে বললো, “তোমার জন্য একটা দারুন নাইটি দিয়ে দিয়েছি। ওখানে গিয়ে আবার কোনো অঘটন ঘটিও না কেমন? Have a lovely honeymoon!”

আরওয়া মনে মনে বলল, ” আর হানিমুন। আমি তো যাচ্ছি যাতে উনার ঐ শাকচুন্নি টা যেতে না পারে।”

জাওয়াদ রুমে এসে বললো, “তোমার প্যাকিং শেষ?”

“হুম”

“খেয়েছ?”

“নাহ। আপনি?”

“আমি ফ্লাইটের আগে কিছু খাই না। তুমি খেয়ে নাও। আমরা ৯টায় বের হবো।”

আরওয়া ওকে পর্যবেক্ষণ করে বলল, “আপনি ঠিক আছেন?”

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমার কি হবে?”

“সে রিয়েক্ট করেনি? সবাই তো বলছে আমরা হানিমুনে যাচ্ছি। সেও নিশ্চয়ই এমনকিছু ভেবে কষ্ট পাচ্ছে; না?”

জাওয়াদের কথাটা স্মরণ হতেই বললো, ” ও হ্যাঁ! কষ্ট তো পাবেই। মেয়েরা মেয়েদের কে একটুও ভরসা করতে পারে না কি না! আমাকে বারবার বলে দিলো তোমার থেকে সেইফ থাকতে।আমি অবশ্য বলেছি তুমি ওমন না।”

“ওমন না মানে কেমন না?”

“বাদ দাও, শুনলে আবার কষ্ট পাবে। এমনিতেই অনেক চোখের পানি বের করেছ। একদিনে এতো কান্না করা ঠিক না। অল্প অল্প করে রোজ কান্না করা ভালো। এতে চোখও পরিষ্কার থাকবে শরীরের ও ক্ষতি হবেনা!”

আরওয়া নাক ফুলিয়ে বলল, “আপনার নাম জাওয়াদ না রেখে জাহেল রাখা উচিত ছিল।”

“মানুষ কতোটা ইমম্যাচিওর হলে এসব বলতে পারে? আমার বিজনেস স্কিলস সম্পর্কে তোমার আইডিয়া আছে আরওয়া? তুমি আমাকে জাহেল বলছো কিভাবে?”

“আপনার সঙ্গে কথা বলা মানেই ভালো মেজাজ খারাপ হওয়া। আপাতত আপনি মুখ বন্ধ রাখুন‌তো। ঝগড়া করার মুড আসলে আপনাকে ডেকে বলবো নে।”

জাওয়াদ বিরক্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

সাম্য জাওয়াদের লাগেজ ধরতেই জাওয়াদ কাটকাট গলায় বললো, “দাদাসাহেব খবর পেয়েছেন কিভাবে? নিশ্চয়ই তুমিই কোনো ব্ল্যান্ডার করেছ তাই না?”

সাম্য কাঁচুমাচু মুখে বললো, “স্যার আপনি প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি আমার বেস্ট ট্রায় করেছিলাম বিষয়টা যেন গোপন থাকে, কিন্তু বড় স্যার কিভাবে জেনে গেছেন আমি সত্যিই জানি না!”

“এখন মনে হচ্ছে একটা জব সার্কুলার এনাউন্স করতে হবে।”

“কিন্তু স্যার আপাতত কোনো‌ পোস্টেই তো লোক লাগবে না..”

“আমার পিএ-র পদ খালি হবে।”

বলেই জাওয়াদ ইমিগ্রেশনে এগিয়ে গেল। সাম্য কপাল চাপড়ে বললো, “জলে কুমির ডাঙায় বাঘ। আমার জান নিয়ে যত টানাটানি!”

আরওয়া সবাইকে বিদায় জানিয়ে ভেতরে আসতেই সাম্যর বিবর্ণ মুখ দেখে বলল, “আপনি ঠিক আছেন? আপনার চেহারা এমন ফ্যাকাসে লাগছে কেন?”

সাম্য অসহায়ের মতো হাসি দিলো।

কোহিনুর ফোনকল রেখে তার মেয়ের ঘরে গেলেন। কুহু তখন সবেই কেড্রামা নিয়ে বসেছিল। মাকে দেখে বললো, “আম্মু প্লিজ এখন আবার শুরু করো না। আমি অন এয়ার ড্রামা দেখছি। মিস করতে পারবোনা।”

কোহিনুর মেয়ের মাথায় গাট্টা মেরে বললো, “ফাজিল মেয়ে মায়ের চেয়ে তোর কাছে চাইনিজদের কিচকিচ ক্যাচক্যাচ বেশি দামী হয়ে গেল?”

কুহু মাথা ঘষে বলল, “আম্মু আমি চাইনিজ দের দেখি না। ওরা কোরিয়ান। কোরিয়ান আর চাইনিজ এক না।”

“পার্থক্য কি? দুইটাই মেয়েদের মতো দেখতে। ওদের মধ্যে কোনটা মেয়ে কোনটা ছেলে বোঝার উপায় আছে? এক হলেও কি না হলেও কি বলবে তো সেই আইশু ফাইশু!”

কুহু মুখ খিচে বললো, “আইশু ফাইশু বলে কোনো শব্দ কী এই পৃথিবীতে আছে? তুমি এইটা কই পাইলা বুঝিনা। যাও না তোমার না এসময়ে সবার সাথে কলে কথা বলতে হয়।কথা বলো গিয়ে, আমাকে জ্বালাচ্ছ কেন?”

“কথা বলতে গিয়ে ই তো তোর দরকার এলো। নয়তো তোকে গনায় ধরার বেকার সময় আছে আমার? দেখতো এই ছেলেটাকে। কেমন লাগে? তোর ঐ সাদা বিলাইদের চেয়ে এটা তো শতগুণে সুন্দর।”

কুহু ছবির দিকে না তাকিয়ে ই বললো, ” আমি এখানে বিয়ে করবোনা। আমার জন্য কোরিয়া থেকে ছেলে আনো। তবেই আমি এক পায়ে খাঁড়া!”

“কোরিয়া যাওয়া লাগে কেন তুই বললে তোর জন্য রাঙামাটি থেকে কাউকে ধরে আনি? ওদের মধ্যে কাউকে বিয়ে করে কিচক্যাচ করিস! এখন তো অনেক চাকমা মারমা মুসলমান হয়ে গেছে। এতে অন্তত তোর ধর্ম যাবেনা!”

“কোরিয়া তেও মুসলিম আছে। দাউদ কিম কে দেখছো?”

“উফফ তোর সাথে তর্ক করতে করতে আমার গাল ব্যথা হয়ে গেছে। তুই ছবিটা একবার দেখ।আমাদের দেশের ছেলেদের মতো সৌন্দর্য অন্য কোনো ছেলের মধ্যে পাবি? আরেহ কত বিদেশিনী ওদের জন্য দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে। আর তুই কিনা চামড়া ছিলা পল্টি মুরগির মতো চেহারা ছেলেদের জন্য আফসোস করিস! আমার ভাবতেই কষ্ট লাগে তোকে আমি জন্ম দিয়েছি।”

কুহু মায়ের দিকে শান্ত দৃষ্টি তে তাকিয়ে বললো, “তোমার চোখের পানি আলোর বেগ কে ও হার মানায়। ছবি আর বায়ো ডাটা দিয়ে যাও আমি দেখে বলবো।”

কোহিনুর বেগম খুশি তে গদগদ হয়ে বললেন, “আমি নিশ্চিত এই ছেলেকে তুই না বলতেই পারবি না। দেখে নিস। আমি যাই তোর মামাকে কল করে আরো খোঁজখবর নি।”

কুহু ল্যাপটপে মনোনিবেশ করলো।

সূর্যোদয়ের দেশ জাপান। এদেশের মানুষদের নম্রভদ্র আচারণ সম্পর্কে পুরো পৃথিবীতে খ্যাতি আছে। এমন একটি দেশে ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে আরওয়ার মন ভীষণ আনন্দিত। হানেদা এয়ারপোর্টে ল্যান্ডিং করার পর তাদেরকে রিসিভ করতে মিস্টার ইয়োশি এলেন। সাম্য তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করে জাওয়াদ এবং আরওয়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো। তিনি তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে গাড়িতে বসতে বললেন। জাপানের ব্যস্ততম শহর টোকিওতে গাড়ি চলছে। আরওয়া মন দিয়ে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। জাওয়াদ ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সাম্য এবং মি. ইয়োশির সঙ্গে আলাপচারিতায় মগ্ন হলো। আরওয়াকে হোটেল রুমে পৌঁছে দিয়ে জাওয়াদ মিটিং এ জয়েন করলো। আরওয়া বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে বলল, “রোবট একটা একটু রেস্ট না নিয়েই কাজে চলে গেল। এতোই যখন কাজ পছন্দ কাজকে বিয়ে করলেই পারতো। আমার তো ভাবতেই অবাক লাগে এতোসবের মাঝে প্রেম করার ফুরসত পাইলো কখন? এর গফ নিশ্চয়ই টাকার জন্যই এর সাথে প্রেম করছে।”

আরওয়া বাসায় ফোন করে পৌঁছানোর খবর দিয়ে শাওয়ার নিলো। ৮তলার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো আশেপাশের সবকিছু।

জাওয়াদের কল এলো প্রায় ২ঘন্টা পর। এরমধ্যে যদিও ওয়েটার এসে তাকে খাবার দিয়ে গিয়েছিল। আরওয়া খেয়েদেয়ে একচোট ঘুম ও দিয়ে ফেলেছে। জাওয়াদ কল করেই বলল,”খেয়েছিলে ঠিকমতো? কোনো সমস্যা হয়নি তো?”

“হুম খেয়েছি। আপনি কখন ফিরবেন?”

“আমার আরেকটু দেরি হবে। তুমি কি রেস্ট নিবে নাকি বের হতে চাও?”

” না আপনি আসলেই বের হবো।‌এখন বরং ঘুমাই।”

“আচ্ছা।”

“শুনুন?”

“হুম বলো?”

“আপনি রেস্ট নিবেন না? টায়ার্ড লাগছে না? খেয়েছিলেন?”

“এতোগুলো প্রশ্ন!”

“আপনি ফিরে উত্তর দিবেন,রাখছি।”

জাওয়াদ ফোনের দিকে চেয়ে দেখল আরওয়া কল কেটে দিয়েছে। ” এই মেয়ে আমার কথা না শুনেই ঠাসঠাস কল কাটে কিভাবে! স্ট্রেইঞ্জ!”

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে