কাঁটাকম্পাস পর্ব-১৬+১৭

0
400

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব১৬

#আরশিয়া_জান্নাত

আরওয়ার মা শিরিন নানান পদের তরকারি রান্না করে টেবিলে সাজাচ্ছেন। উনার রান্নার সুখ্যাতির কারণে দু’দিন পরপর মেহমান আসেন। বেশিরভাগ ই খুঁজে দাওয়াত নেওয়া মানুষ। শিরিন ও মনের সুখে তাদের অনেক আপ্যায়ন করেন। কিন্তু এই জিনিসটা করিমুন্নেসার একদম পছন্দ না। কোনো উপলক্ষ ছাড়া প্রতিমাসে ২, ৩বার এতো টাকা খরচা করে মেহমানদারি করার দরকার কি? লোকে তোষামোদ করে পরের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে খেতে পছন্দ করে।

কিন্তু আরওয়ার বাবা-মা দুজনেই উল্টোটা ভাবেন। আমিনুল ইসলাম মাকে বোঝান, আল্লাহ যখন খুশি হন তখন ৩জিনিস পাঠান। ১)মেহমান ২) কন্যাসন্তান ৩) বৃষ্টি।

করিমুন্নেসা সাময়িক চুপ হলেও তার ফোঁড়ন কাটা চলতেই থাকে। আরওয়া ডাইনিং এর অবস্থা দেখেই বুঝলো আজ আবার মেহমান আসবে হয়তো। তাই সে আর এদিকে না থেকে তেতলায় মেজ চাচার ওখানে চলে গেল। মেজ চাচার মেয়ে রূপন্তী ক্লাস থ্রীতে পড়ে। ও দেখতে ভীষণ কিউট। আরওয়াকে দেখে রুপন্তী খুশি তে গদগদ হয়ে বললো, “আরু আপু আসো আমার রুমে। জানো আব্বু আমার জন্য বার্বি ডলের ছবি আঁকা ব্যাগ কিনেছে। পিংক কালারের। আমার স্কুলের সব ফ্রেন্ডরা বলেছে ব্যাগটা অনেক সুন্দর।”

“ওয়াও! ব্যাগটা আসলেই অনেক সুন্দর। রূপ আমাকে ব্যাগ টা দিয়ে দাও না? এতো সুন্দর ব্যাগ আমি আগে দেখিনি।”

“কিন্তু তুমি তো বড়। তুমি এই ব্যাগ নিয়ে ভার্সিটি তে গেলে সবাই হাসবে না?”

“হাসবে কেন?”

“আইরা আপু বলছিল উনি এখন বড় হয়ে গেছে। তাই সবকিছু বড়দের মতো কিনবে। কলেজে বার্বি ডলের ব্যাগ নিলে সবাই উনাকে বাচ্চা বলে ক্ষেপাবে। তোমাকেও ক্ষ্যাপাবে না?”

“তাও ঠিক। কিন্তু তাই বলে পছন্দের জিনিস ব্যবহার করা বন্ধ করে দেওয়া কি উচিত?”

রূপন্তি গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। আসলেই তো এটা কি উচিত?

আরওয়ার মেজ চাচী রাইসা বেলের শরবত এনে বলল, ” শুনেছিস মুকিম নাকি বিয়ে করে বৌ নিয়ে এসেছে?”

“কি বলো! বড় ফুফু মেনে নিছে?”

রাইসা হেসে বলল, ” তোর কি মনে হয় উনি এতো সহজে মানবেন? সেদিনো যে বড় বড় কথা বলছিলেন। উনার ছেলে এই উনার ছেলে ঐ। এবার দিলো তো ছেলে মুখে চুনকালি মেখে!”

“মুকিম ভাইয়াকে দেখে তো মনে হতো না উনি এমন কিছু করতে পারে!”

” শোন, যাদের দেখলে মনে হয় ভাজা মাছ উলটে খেতে জানে না। তারা শুধু মাছ না মাছের কাঁটা ও চিবিয়ে হজম করে ফেলে।”

“তাও ঠিক বলছো।”

“আমার বোনের মেয়ের জন্য বলেছিলাম আর কত বড়াই করে বলেছে, চেনাজানার মধ্যে ছেলে বিয়ে করাবে না। এখন কি হলো? ছেলে তো বলতে গেলে ঘরের মেয়েকেই বিয়ে করে আনলো।”

“কাকে এনেছে? ”

“কাকে আর ওর ফুফাতো বোন সাদিয়াকে। অনেক দিনের সম্পর্ক ছিল বলে।”

আরওয়া চোখ বড় বড় করে বলল, “কি সাংঘাতিক! মানুষ কে আসলেই বাইরে থেকে বিচার করা যায় না।”

জাওয়াদ লাঞ্চ শেষে তার ছোট মামাকে কল করলো। ভদ্রলোক এখন বলতে গেলে নেটওয়ার্কের বাইরে আছেন। কল দিলেও ভালোমতো সিগন্যাল পাওয়া যায় না সেখানে। দুপুরের দিকে সে উপজেলার ওখানে আসেন তাই এই সময়টাতেই খোঁজ খবর নেওয়া লাগে।

“হ্যালো মামু?”

“হ্যাঁ বল।”

“তুমি ঠিক আছ তো? ঐখানে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো?”

“আমি ঠিক আছি, চিন্তার কিছু নেই। ওদিকে সবাই ভালো তো?”

“হুম।”

“কানাডা থেকে কল করেছে?”

“হ্যাঁ মামী কল করেছিলো। বললো তোমাকে লাইনে পাচ্ছে না। কোথায় আছ খোঁজখবর নিলো।”

“ওহ।”

“তুমি কবে ফিরবে?”

” দেরি আছে। লাঞ্চ করেছিস?”

“হ্যাঁ। তুমি?”

“করেছি। জানিস আজ মেন্যু কি ছিল?”

“কি?”

” শোল মাছের ঝোল, কাঁচা কলার ভর্তা, ডাল দিয়ে পাট শাক।”

“এসবে তোমার হলো?”

“হয়েছে মানে দৌড়েছে। মাটির চুলার রান্না দারুণ টেস্ট। তুই আসবি নাকি?”

” নাহ; আপাতত একটা প্রজেক্ট নিয়ে বিজি আছি।”

“প্রজেক্ট একটার পর একটা আসতেই থাকবে। সেসবে আটকে থাকলে লাইফ ইনজয় করতে পারবি না। সুযোগ পেলেই বেড়িয়ে পড়বি। সাগর,পাহাড়, নদী যা পারিস দেখে আসবি। এই পৃথিবীটা সুন্দর করে সৃষ্টি করেছে মানুষের জন্য। মানুষ দেখবে না তো কে দেখবে?”

জাওয়াদ মুচকি হাসলো। তার মামার গলা বেশ প্রফুল্ল শোনাচ্ছে। সে তার সলো ট্রিপ সত্যিই বেশ ইনজয় করছে!

রুমাইসা চিপস খেতে খেতে বলল, “আমি তোদের রহস্য বুঝি না। তুই বলিস ভাইয়া এই বিয়ে মানে না। আবার দেখি ভাইয়া জেলাস ফীল করে। সেদিন আমাদের সব কয়টা ফ্রেন্ডকে ট্রিট দিলো, ফ্রেন্ড সার্কেলে কে কে আছে বোঝার জন্য। সবচেয়ে মজার পয়েন্ট হলো তুই উনাকে বলেছিলি বিয়ে না মানার সলিড রিজন বললেই তুই চলে আসবি। উনি তারপরো তোকে কিছু বলছে না। আজিব না?”

আরওয়া শোয়া থেকে উঠে বসে বললো, “এই লোকের কান্ডকারখানা সবই আজীব। আমি তো এসব ভাবতে বসলেও হাইপার হয়ে যাই। আমার তো মনে হয় এর গলায় একটা দরজা আছে। মনের কথা বলবার বেলা ঐ দরজা বন্ধ হয়ে যায়।”

“তবে উনার কেইসটা যে প্রেমঘটিত না এটা সিওর থাক। এখানে অন্য কোনো কারণ আছে।”

আরওয়ার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। কৌতুহলী গলায় বললো, “তুই এতো সিওর হয়ে কিভাবে বলছিস? যুক্তি কি শুনি?”

রুমাইসা কোল্ড ড্রিংকে চুমুক দিয়ে জ্ঞানী ব্যক্তির মতো বললো, ” প্রথমত বলি উনার যদি গফ থাকতো এতো দিনে তুই কিছুটা হলেও টের পেতি। তার যে লাইফস্টাইল বললি আমার মনে হয় না কোনো মেয়ে এখানে এক্সিস্ট করে। তারপরো যদি ধরতে যাই তার গফ আছে তাহলে সে তোকে যেকোনো উপায়ে বিদায় করতে চাইতো। তোর দেওয়া শর্ত লুফে নিতে দু’বার ভাবতো না।”

“তোর কথায় লজিক আছে!”

“এখন বের করার ট্রায় কর আসল ঘটনা কি।”

“শার্লক হোমস কে মিস করছি!”

রুমাইসা ওর পিঠ চাপড়ে বললো, “তুই পারবি দোস্ত, চিন্তা করিস না”

শিরিন বেগম দরজায় নক করে বললো, আরওয়া দরজা খোল। জামাই আসছে..

আরওয়া চমকে বললো, “কি ব্যাপার না বলে হঠাৎ কেন এলো?”

রুমাইসা ফোন হাতে নিয়ে বলল, “তোরে মিস করতেছে আর কি। তাই চলে আসছে তোর সাথে ঝগড়া করতে। যা গিয়ে চুলাচুলি শুরু কর। আমি লাইভ ভিডিও আপলোড করবো।”

আরওয়া ঘটঘট করে রুম থেকে বেরিয়ে নীচে গেল।

জাওয়াদ সোফায় বসে করিমুন্নেসার সঙ্গে কথা বলছে। তখনই আরওয়া এসে বললো, “আপনি এখানে?”

করিমুন্নেসা নাতনির দিকে ক্রুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, ” সালাম দি ভালাবুরা খবর এনা নিবি। এরে আই তোরে ইগিন নি শিখাইছি?”

জাওয়াদ বাঁকা হেসে আরওয়ার দিকে তাকালো। যেন তাকে বকা খেতে দেখে তার ভীষণ আনন্দ লাগছে।

আরওয়া ওর হাসি দেখে ঠাস করে ফ্লোরে বসে তার পা ধরে ফেলল। জাওয়াদ বিস্মিত দৃষ্টি তে ওর দিকে চেয়ে আছে। আরওয়া ওর পায়ে‌ ধরে কয়েকবার সালাম করে টেনে টেনে বললো, ও আর পরাণের সোয়ামি গো আসসালামুয়ালাইকুম, আন্নে ক্যান আছেন? আন্নের‌ লাই আর যে ফরান পইচ্ছে! আন্নেরে যদি আর কইলজাডা খুলি দেখাইতে ফাইরতাম তো দেইখতেন। ইগ্গো আন্নে এরুম হুগাই গ্যাছেন কা? আন্নেরে বুঝি আর শোকে ধইচ্ছে? আহাইরে আর পরাণের সোয়ামি!!”

জাওয়াদ ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া গলায় বলল, “আরওয়া উঠো। এরকম পায়ে ধরে বসে থাকতে হবে না, প্লিজ উঠো।”

“ওমা এটা কি বলেন? আমার দশটা না পাঁচটা না একটামাত্র স্বামী। আমি তার পায়ে থাকি বা মাথায় থাকি এখানে কোনো নিষেধাজ্ঞা জারি করা যাবেনা!”

জাওয়াদ বিব্রত চেহারায় করিমুন্নেসার দিকে তাকালো। করিমুন্নেসা নাতনির অভিনয় দেখে নিজেও ভড়কে গেছেন। তিনি হাঁ করে আরওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আরওয়া জাওয়াদের পা ধরেই দাদীকে বললো, “দাদীজান হাঁ করে থাকিও না। মশা ঢুকে যাবে। আমি তোমাকে আর ছোট হতে দিবো না। স্বামীর খেদমতকারী বেস্ট নারী হয়ে দেখাবো। সবাই বলবে করিমুন্নেসার‌ নাতনী সেরা”

রুমাইসা আর শিরিন দোতলা থেকে ওর কর্মকাণ্ড দেখে হাসতে লাগলো।‌ এই মেয়ে শুধরাবে না!

জাওয়াদ আরওয়ার ঘরে বসে চারদিকে চোখ বুলালো। আরওয়া ওর জন্য কফি করে এনে বললো, আমাকে মিস করছিলেন বুঝি?

জাওয়াদ কফির মগটা নিয়ে বললো, তোমাকে মিস করার মতো কিছু ই ঘটেনি। আমি এসেছি তোমার খোঁজখবর নিতে। ইটস কাইন্ড অফ ফর্মাল ডিউটি!

আরওয়া ওর মুখোমুখি চেয়ারে বসে বলল, “ওহ আচ্ছা! তো খোঁজখবর নিয়ে চলে গেলেন না কেন?”

“বড়রা সবাই এতো করে বললো তাই ভদ্রতা রক্ষার্থে রয়ে গেছি।”

“বুঝলাম”

জাওয়াদ কফিতে লম্বা চুমুক দিলো। আরওয়া ওর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আছে। এই অস্বস্তি এড়াতেই সে কফিতে মনোনিবেশ করেছে। আরওয়া চোখ সরু করে বললো, “আপনার কান দুটো এমন লাল হয়ে আছে কেন? এসির পাওয়ার কমাবো?”

“নাহ ঠিক আছে। ধন্যবাদ”

“ফর্মালিটি দেখাতে হবেনা। আমি ভাইয়ার টিশার্ট আর ট্রাউজার এনে দিচ্ছি। আপনি ফ্রেশ‌ হয়ে নিন।”

“আরওয়া ওসব লাগবেনা, রফিক চাচাকে পাঠিয়েছি, উনি কিছু ক্ষণের মধ্যে ই সব নিয়ে আসবেন।”

“ওকে”

“তো ভালো আছো তো? রুমাইসা কি চলে গেছে?”

“হুম। হ্যাঁ ও চলে গেছে। ”

“আচ্ছা। তুমি কি আরো কিছু দিন থাকবে?”

“কেন?”

“এমনি জিজ্ঞাসা করছি।”

“আপনি চাইলে আপনার সঙ্গে ব্যাক করবো। নয়তো করবোনা।”

“আমি না আসলেও কি এই সিদ্ধান্ত থাকতো?”

“সিদ্ধান্ত না, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা।”

“তোমার কন্ঠে আঞ্চলিক ভাষা কিউট লাগে! আমি যদিও সবটা বুঝিনি। কিন্তু গেস করতে পেরেছি অর্থটা কি ছিল”

“দাদীজানের বাবার বাড়ি নোয়াখালী তে। উনার কাছ থেকে শুনে শুনে শিখেছি! ”

“ওহ আচ্ছা!”

“আপনার জন্য ডিনার রেডি করতে বলবো? এখন খাবেন নাকি দেরি করবেন? আজ বোধহয় অফিস থেকে তাড়াতাড়ি এসেছেন!”

জাওয়াদ বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। ঘুমে তার চোখ জ্বালাপোড়া করছে। কফি পান করেও ঘুমের ভাব কাটছেনা। সে চোখ বন্ধ করে বললো, “আমার বিশেষ ক্ষিদে নেই। ঘুমিয়ে পড়লে ডেকো না।”

আরওয়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, “আপনি কি ঘুমানোর জন‌্য আমাদের এখানে এলেন!”

জাওয়াদ কোনো জবাব দিলো না। দ্রুতই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। আরওয়া ওর গায়ে চাদর টেনে দিয়ে চুলে হাত গলিয়ে বললো, “আপনার প্রেম যে কি দারুন হবে ভাবতেই উচ্ছাসিত হয়ে যাই। কিন্তু এই ভেবেও অশান্তি লাগে সেই সৌভাগ্য কার হবে!”

চলবে…

#কাঁটাকম্পাস #পর্ব১৭

#আরশিয়া_জান্নাত

১৭

“ছেলেটা সত্যিই না খেয়ে ঘুমিয়ে গেল! তুই বলতি সব তো তৈরিই ছিল ওকে না হয় আগে আগে খাইয়ে দিতাম।”

“আম্মু এতো চিন্তা করো না। উনি যদি রাতে উঠেন আমি খাবার গরম করে দিবো। এখন ঘুমাচ্ছে যখন ঘুমাক।”

শিরিন আফসোস করতে করতে নিজের ঘরে গেলেন। করিমুন্নেসা পান মুখে তুলে বললেন, “তুই ভাত খাস না ক্যান? হেতে যদি আর না উডে তুই কি খালিফেডে থাইকবি নি?”

আরওয়া দাদীর পাশে বসে বললো, “উনি উঠবেই। রুটিনের বাইরে ঘুমালে বেশিক্ষণ ঘুম হয়না। এখন আমি খেয়ে ফেললে উনি একা খেতে অস্বস্তি বোধ করতে পারে। ”

“তোর যা খুশি কর। আই যাইয়ের ঘুমাইতে।”

রাত প্রায় ১টা বাজে। সবাই খাওয়া দাওয়া করে ১১টায় ই যার যার ঘরে চলে গেছে। আরওয়া কিছুক্ষণ টিভি দেখে নিজের ঘরে এসে বসলো‌। ডিম লাইটের নীলাভ আলোয় জাওয়াদকে ভালোই দেখা যাচ্ছে। আরওয়া হাতমুখ ধুয়ে এসে স্কিন কেয়ার নিলো। তার ঘুমাতে সচরাচর দেরি না হলেও আজ সে লেট করছে। জাওয়াদ ঘুমিয়েছে প্রায় ৪ঘন্টা হতে চলল। একবার কি ডেকে দেখা উচিত? পরে শেষ রাতে খিদে পায় যদি?

“এই! এই যে শুনছেন? উঠুন”

জাওয়াদ ঘুম জড়ানো গলায় বলল,”কি হয়েছে এমন ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছ কেন?”

“আমি ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছি?”

“ইয়েস অফকোর্স।”

“এইজন্যই বলে লোকের ভালো করতে নেই। মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ প্রাণি”

জাওয়াদ ওর কথা শুনেছে কি না বোঝা গেল‌ না। আরওয়া ওর বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলল, শুনছেন? উঠে খাবার টা অন্তত খেয়ে নিন। এতো বড় রাত না খেয়ে থাকবেন?

জাওয়াদের কোনো হোলদোল নেই। আরওয়া বিরক্তিস্বরে বলল, “খুব তো বলেছে আমি না থাকলে আরামে ঘুমাবে। এই তার আরামের নমুনা! এমনভাবে ঘুমাচ্ছে যেন কয়রাত চোর পাহারা দিয়েছে।”

জাওয়াদ আচমকা ওকে টেনে পাশে শুইয়ে দিয়ে বলল, ”
কেউ ঘুমালে চুপচাপ তাকে ঘুমাতে দিতে হয়। তা না করে কানের কাছে এতো কথা বলে কেউ? ঘুমাও তো চুপ করে।”

“যা বলছি তা করুন আগে। আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে। উঠে ক’টা ভাত খেয়ে আমাকে উদ্ধার করুন।”

জাওয়াদ সাথে সাথে চোখ মেলে চাইলো। উঠে বিস্মিত গলায় বললো, “তুমি আমার জন্য অপেক্ষা করছিলে?”

“না; ভুতের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ”

জাওয়াদ কিছুক্ষণ আরওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। আরওয়া ঘুমে প্রায় নিভে আসা চোখে বলল, “প্লিজ তাড়াতাড়ি উঠেন ঘুমে আমার চোখ ফেটে যাচ্ছে!
আমি খাবার গরম করতে যাচ্ছি জলদি আসুন।”

জাওয়াদ আর দেরি করলো না। দ্রুত উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো। আরওয়া খাবার গরম করে ডাইনিং টেবিলের উপর রাখলো। জাওয়াদের প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে বললো, “আপনি কি অসুস্থ? আপনাকে আমি এই কয় মাসে একদিনো অসময়ে ঘুমাতে দেখি নি,তাই জিজ্ঞাসা করলাম।”

“না, আমি ঠিক আছি। তুমি নিচ্ছো না যে?”

আরওয়া নিজের প্লেটে খাবার নিলো। কিন্তু তার খাওয়ার মুড আর রইলোনা। সে খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলো। জাওয়াদের পাতে এটা ওটা তুলে দিতে দিতে টুকটাক বাসার সবার খোঁজখবর নিলো।

জাওয়াদ ওর প্লেটের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললো, “খাবার নষ্ট করা ঠিক না। খাচ্ছ না কেন?”

“এমনিতেই। ডোন্ট ওয়ারি এগুলো ওয়েস্ট করবোনা গেইটের সামনে কুকুর আছে, ওকে দিয়ে দিবো।”

“তাহলে মিথ্যে বলেছিলে কেন? তোমার না খুব খিদে পেয়েছিল?”

“মিথ্যে বলিনি। খিদেও পেয়েছে ঘুম ও পেয়েছে। এই দুই প্রতিযোগীর মধ্যে ঘুম বিজয়ী হয়েছে। তাই খিদে মন খারাপ করে চলে গেছে।”

” তোমার খেয়ে নেওয়া উচিত ছিল। অযথা না খেয়ে বসেছিলে কেন? ”

“শাবানা আন্টির জীবন যাপন করছি যখন, তাকেই ফলো করার চেষ্টা করলাম। এতে যদি রাজ্জাক সাহেবের মন গলে! হেহে…”

জাওয়াদ ওর খোঁচা টা হজম করে বললো, “তুমি না উনার মতো অবলা নও? তবে এসব করার কি দরকার? যাই হোক চুপচাপ খাবারটা শেষ করো। এতো তালবাহানা শুনতে চাইছি না।”

আরওয়া ওর দিকে নিজের প্লেট বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “খাইয়ে দিন তাহলে খাবো।”

“আমি খাইয়ে দিবো কেন? তোমার হাত নেই?”

” আমি বলেছি তাই দিবেন। আমি আপনার কথামতো খাবো যদি আপনিও আমার কথামতো খাইয়ে দিন। হিসাব একদম বরাবর।”

জাওয়াদের মেজাজ টাই বিগড়ে গেল, সে রাগীস্বরে বলল, “সবকিছু তে হিসাব বরাবর হতে হয়? কমবেশি হলে তোমাদের নারীবাদী চেতনায় ফোস্কা পড়ে তাই না?”

আরওয়া সাথে সাথে উঠে ওর মাথায় ফু দিয়ে বলল, “কুল কুল। এতো হাইপার হওয়ার কি আছে? হিসাবনিকাশ বাদ আপনাকে খাইয়ে দিতে হবেনা। আপনি শান্ত হয়ে খাবার শেষ করুন প্লিজ।”

আরওয়া ঝাঁপসা চোখে চুপচাপ ভাত খেতে লাগলো। ওরই ভুল হয়েছে, অযথাই ভুল মানুষের কাছে আবদার রেখেছে।‌ ওর আরো সচেতন হবার দরকার ছিল। জাওয়াদ জোরে জোরে শ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করলো; শান্ত গলায় বললো, “আ’ম স্যরি!”

আরওয়া তার প্রত্যুত্তর করলো না। এখানে অযথা রাতবিরেতে সিন ক্রিয়েট করার কোনো মানে হয় না।

নাহিয়ান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে চিৎকার করে সাবাকে ডাকছে। সাবা ওর জন্য ফ্রুটস নিয়ে আসছিল, ওর চিৎকার শুনে রুমে ঢুকে বিরক্ত গলায় বললো, “একটু ধৈর্য ধরা গেল না? আমি তো আসছিই!”

নাহিয়ান গলায় টাই ঝুলিয়ে বললো, “তোমাকে বলি না আমি যতক্ষণ বাসায় থাকি আমার আশেপাশে থাকতে? এসব আনা নেওয়ার জন্য সার্ভেন্ট তো আছে নাকি?”

সাবা ওর মুখে আপেলের টুকরো দিয়ে টাই বাঁধতে বাঁধতে বললো, “এসব ছোটখাটো কাজে অন্যকে বলতে আমার ভালো লাগে না। তাছাড়া তোমার জন্য কাজ করতে আমার ভালো লাগে।”

নাহিয়ান ওর কোমর জড়িয়ে বললো, “তুমি এতো লক্ষি কেন বলোতো? তোমার কথায় আমার মনপ্রাণ একদম জুড়িয়ে যায়!”

“আমি লক্ষি না গো! আমার বরটা আমায় বেশি ভালোবাসে। তাই সে আমার সবকিছু তেই ভালোটা খুঁজে পায়।”

“এটা বুঝো তুমি?”

“বুঝবো না কেন?”

“বুঝলে তো তোমার উচিত আমাকে আরো বেশি বেশি ভালোবাসা। দূরে সরো কেন?”

সাবা ওর চুল আঁচড়ে বললো, “সারাক্ষণ কাছে থাকলে দাম কমে যায় যদি? কিছু দূরত্ব আছে বলেই কাছে আসা স্বর্গীয় হয়ে উঠে!”

“এসব কাব্যিক লজিক আমি মানি না। আমি মনে করি, নিউক্লিয়াস থেকে ইলেকট্রনের দূরত্ব বাড়লেই আকর্ষণ শক্তি হ্রাস পায়। তাই তোমার উচিত আমার কাছে থাকা প্রথম অরবিটে তীব্র আকর্ষণে থাকা ইলেকট্রনের মতো।”

“যদি আমাতে ঘাটতি থাকে, অষ্টক পূরণ করতে সরে যেতে হয়?”

নাহিয়া ওর কোমড় ছেড়ে দিলো। রুষ্ট গলায় বললো, “তোমাকে আমার অষ্টক পূর্ণ করতে হবেনা। সরে যাওয়ার চিন্তা মাথায়ও যদি আনো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা মাথায় রেখো”

সাবা ওকে জড়িয়ে ধরে মান ভাঙানোর সুরে বলল, “আহা! সোনা রাগ করেনা। আমি তো মজা করেছি। তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার সাধ্যি কি আমার আছে বলো? আমি নিজেই তো ম…..”

“সাবা প্লিজ! আমার ভালো লাগে না। এসব আজেবাজে কথা মুখে এনো না তো।”

“আচ্ছা আচ্ছা স্যরি। আর বলবোনা। দেখি এবার একটু হাসো।”

নাহিয়ান গাল ফুলিয়ে বললো, “শুধু জড়িয়ে ধরে মান ভাঙবেনা। অন্য কিছু করো তারপর ভেবে দেখবো।”

সাবা ওর কথা শুনে হাসতে লাগলো, “একে বলে জাতে মাতাল তালে ঠিক।”

“সে তুমি যাই বলো আমি কানে তুলছি না।”

“আচ্ছা যাও, আজ রাতে তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে।”

“কি সারপ্রাইজ?”

“বলে দিলে আর সারপ্রাইজ থাকবে?”

“হাহ! ইচ্ছে করে এমন করো। জানো তর সইতে পারিনা। এমনিই হসপিটাল যেতে মন চায় না, তার উপর এমন সাসপেন্স তৈরি করলে। এতো লম্বা দিন কাটবে কখন!!”

“যাও তো এখন দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

নাহিয়ান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললো, “বৌ আসলেই দেরি হয়ে যাচ্ছে। যাই হুম, ঠিকমতো লাঞ্চ করে নিও।”

বলেই কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে পড়লো। সাবা পেছন থেকে বললো, “সাবধানে যেও।”

কুহু ডিভানে শুয়ে বইয়ে ডুবে আছে, পাশেই পাপিয়া তেঁতুলের আচার খাচ্ছে আর টকের শব্দ করছে।‌ কুহু ভ্রু কুঁচকে বললো, “পাপ্পি তুই ইচ্ছে করে আমার সামনে বসে তেঁতুল খাচ্ছিস তাই না? দেখছিস না বই পড়ছি?”

“তোর বই তুই পড় না আমি কি চিল্লাচিল্লি করছি? তোর জন্য কি এখন খেতেও পারবো না?”

“খাওয়ার আছে অন্য ঘরে গিয়ে খা না। টক জিনিসের লোভ দেখিয়ে মনোযোগ কাড়ছিস কেন?’

“তোর মনোযোগের দরকার পড়েছে তাঈ মনোযোগ কাড়ছি। তুই তো বইয়ে ডুব দিলে শেষ না হওয়া অবদি বেরই হতে চাস না।”

“তোর ঐ রিজভীর ঘটনা রিপিটেডলি শোনার বা এই সম্পর্কে কোনো কিছু বলার ইচ্ছা কিংবা সময় আমার‌ নেই। তুই অযথা আমার মাথা খাইস না।”

“এই আপু এমন করে বলিস কেন? আমার কি দশ বারোটা বোন আছে? তোকে না বললে কাকে বলবো?”

“ভুল বললি আমি ছাড়া ও তোর আরো অনেক বোন আছে। এসব তেলমারা কথা বলিস না।”

“আপু তুই কেমন? আজ আমি তোর মায়ের পেটের বোন হলে এমন বলতে পারতি? আমি কি তোকে চাচাতো বোন ভাবি?”

“আহহহহ! এই মেয়ে আমারে মরলেও শান্তি দিবেনা। কবরের সামনে এসে বলবে, আপু সল্যুশন দাও”

পাপিয়া আদুরে গলায় বললো, “আল্লাহ তোকে দীর্ঘজীবী করুন।”

আরওয়া কাল রাত থেকে মুখ ভার করে আছে। সকালে ব্রেকফাস্ট করার সময় ও বিশেষ কথা বলেনি। জাওয়াদের নিজের উপর নিজেরই বিরক্ত লাগছে। কি দরকার ছিল ওমন রিয়েক্ট করার। ও তো নিজের রাগ কাউকে দেখায় না।
অথচ আরওয়ার বেলা কেন যে ওভার রিয়েক্ট করে ফেলে! বেচারী একটু আবদার করেছিল রাখলে কি খুব ক্ষতি হতো? সে নিজেও কি করবে ও যখন সমতার হিসাব কষলো চট করে মাথায় আগুন লেগে গেছে। আরওয়া হিসাব বরাবর না করে বলতে পারতো, ওয়াইফ হিসেবে আবদার করছি। তাহলে কি সে খাইয়ে দিতো না?
আচ্ছা সে কি আসলেই দিতো? আরওয়া তো কত কি চায়, সে কি দেয়? ওর কত প্রশ্নের উত্তরও তো ঠিকঠাক দেয়নি। এই বিয়ে না মানার কারণ ও তো খোলাসা করে বলেনি। তবে আজ কোন মুখে ওর কথার ভুল ধরে নিজেকে জাস্টিফাই করছে?
“নাহ নাহ এখানে ভুল আরওয়ার না। ভুল আমার নিজের। আমার নিজেকে কন্ট্রোল করা উচিত ছিল।”
বলেই সে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে