কাঁটাকম্পাস পর্ব-১৪+১৫

0
413

#কাঁটাকম্পাস #পর্ব১৪

#আরশিয়া_জান্নাত

১৪

জাওয়াদ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছে। আর মনে মনে নানান কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। পুরুষদের জীবনে সুখশান্তি নির্ভর করে তার জীবনসঙ্গীর উপর। একটা নারী চাইলেই যেমন সংসার সুখের স্বর্গ বানাতে পারে তেমনি যন্ত্রণাময় জাহান্নাম বানাতে পারে।

জাওয়াদের মনে সবসময় ভয় হয়। মেয়েদের অতিরিক্ত চাহিদা, অকৃতজ্ঞ মনোভাব, সবকিছু তে সমান অধিকার সমান অধিকার বলে চেঁচানো। প্রতিটা সেক্টরে প্রতিযোগী মনোভাব যেন পুরুষেরা ওদের শত্রু, ওদেরকে হারিয়ে জিততে পারলেই শান্তি। জাওয়াদের এই নারী বিদ্বেষী মনোভাব ভীষণ তীব্র। ওর কাছে নারী মানে এক আতংকের নাম। সে নিজেকে বুঝ দেয় তার মা-চাচি কিংবা বোন আর দাদীও নারী। ওরা তো খারাপ না। এখনো অনেক মেয়ে আছে যারা খুব ভালো। কয়েকজনের জন্য সবাইকে খারাপ ভাবা ঠিক না। সাবাও তো এডুকেটেড মেয়ে। সে তো ওদের ঘর ভাগ করেনি। সবার সঙ্গে মিলেমিশে আছে। সবাই তো নিপা কিংবা রুবিনা মামির মতো না। এখনো অনেক মেয়ে আছে যারা স্বামীকেই সব ভাবে, ভালোবেসে সংসারকে আগলে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে।

কিন্তু সেই পজিটিভ যুক্তি বেশিক্ষণ টিকে না। চারপাশে নেগেটিভ এক্সাম্পল গুলো এতোটাই প্রকট হচ্ছে, জাওয়াদ চাইলেও ভরসা করতে পারেনা ওর জীবনে ভালো কেউ এসেছে…

বেলকনির গ্লাস আটকে জাওয়াদ রুমে প্রবেশ করতেই নজর যায় ঘুমন্ত আরওয়ার দিকে। সে ধীর পায়ে বেডের একপাশে বসে আরওয়ার দিকে তাকায়। গোলাপী রঙের ছোট্ট মুখখানি, চিবুকে থাকা গাঢ় কালো তিলটা তার চেহারার মাধুর্যতা বহুগুণ বাড়িয়েছে ! ঘনকালো চুলগুলো চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এতো অগোছালো ওর ঘুম, ঘুমের মধ্যে যেন সে যুদ্ধ করে! আরওয়ার চোখের মণি সাধারণ মণির চেয়ে একটু বড় বড়। ও যখন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে মনে হয় গরুর চোখের মতো মায়াবী!
জাওয়াদ কথাটা ভেবেই মৃদু হাসলো। আরওয়া যদি শুনতো ওর চোখকে গরুর চোখের সাথে তুলনা করেছে তবে এতোক্ষণে পানিপথের যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিতো।

জাওয়াদ ওর এলোচুল সরিয়ে ধীর গলায় বললো, “তোমাকে নিয়ে আমি ভীষণ কনফিউজড জানো? মাঝেমধ্যে মনে হয় তুমি খারাপ না। মুখে যাই বলো মনের দিক দিয়ে হয়তো ভালো। আবার মনে হয় তুমি খুব সাংঘাতিক। নিজেকে যেমন ক্ষতবিক্ষত করতে পারো অন্যকেও করতে ২মিনিট লাগবে না! আমার এই বিড়ম্বনা পরিত্রাণের উপায় কি বিচ্ছেদ? নাকি অন্য কোনো সমাধান আছে বুঝতে পারছি না…”

আরওয়া ঘুমের মধ্যেই হেসে উঠলো হাসতে হাসতে বললো, ওহ স্যার আপনি এতো মজার। হাসতে হাসতে আমার পেটব্যথা করছে।

জাওয়াদ ভালোমতো খেয়াল করে বুঝলো আরওয়া ওকে বলেনি, ঘুমের মধ্যেই কথা বলছে। সে আপনমনে ই বলতে লাগলো,

“সারাদিন বকবক করে পোষায় না ম্যাডামের, ঘুমের মধ্যেও চালিয়ে যেতে হবে! চ্যাটারবক্স একটা!!”

মাঝরাতে আরওয়ার পানির তেষ্টায় ঘুম ভেঙে যায়। সে পানি পান করে চুপচাপ বসে রইলো। “আহ! স্বপ্নটা বেশিই ভয়ঙ্কর ছিল। দৌড়াতে দৌড়াতে পুরা ঘাম ছুটে গেছে। এসির পাওয়ার কি কমে গেছে? এতো গরম লাগছে কেন?”

এসির রিমোট খুঁজতে খুঁজতে বিরক্ত হয়ে ফের বিছানায় শুয়ে পড়লো সে। পাশে জাওয়াদ আরাম করে ঘুমাচ্ছে আর সে জেগে আছে। নাহ জাওয়াদের এতো সুখ তো সহ্য হচ্ছে না।
“এখন কি উনাকে তুলে ঝগড়া করবো? কয়টা বাজে ঘুম ভাঙলে কি খুব রেগে যাবে?”
অনেক চিন্তাভাবনা শেষে আরওয়া চুপচাপ ঘুমানোর সিদ্ধান্ত নিলো। মনে মনে বলল,
“থাক বেচারা সারাদিন কত পরিশ্রম করে রাতে একটু ঘুমাক বরং”

কিন্তু ওর মন কি এতো সহজে মানে? হঠাৎ আরওয়ার মাথায় একটা দুষ্ট বুদ্ধি এলো। শয়তানী মার্কা হাসি দিয়ে ব্যাগ থেকে মার্কার পেনটা বের করে বলল, “আমি খুব বোর হচ্ছি খন্দকার সাহেব। লেট মি ইনজয়!”

“আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে

শাখে শাখে পাখি ডাকে

কত শোভা চারিপাশে

আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে….”

আরওয়া মনের সুখে জোর গলায় ব্যাগ গোছাতে গোছাতে গান গাইছে। জাওয়াদ চোখ কচলে উঠে বললো, “আরওয়া তোমার ভাঙা রেকর্ডারের বন্ধ করবে?”

“আমার গান কে আপনি ভাঙ্গা রেকর্ডার বললেন?”

“তুমি গান গাইছিলে নাকি বক্তৃতার মতো লাইন আওড়াচ্ছিলে? এটাকে গান বললে গানেরও অপমান হবে।নেক্সট টাইম কোনো গান গাওয়ার আগে গানটা শুনে ভালোমতো চর্চা করিও।”

আরওয়া রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললো, “মানুষ মনের সুখ প্রকাশ করতে গান গায়। তাছাড়া আমি কোনো মিউজিক কম্পিটিশনে যাচ্ছি না যে আমাকে লিরিক মুখস্থ করে সুরে সুরে গাওয়া শিখতে হবে।”

“মনের সুখ প্রকাশ করার ইচ্ছে হলে ছাদে কিংবা লনে যাও না। আমি ঘুমাচ্ছি চোখে পড়ছে না?”

“দেখুন এমনিতেও আপনার ঘুম থেকে উঠার সময় হয়ে গেছে। আমিতো ভোর থেকে গান গাইছি না। সময়জ্ঞান আমার আছে। আমার গান আপনার জন্য এলার্মের মতো কাজ করেছে বুঝলেন। আপনি এখন উঠে পড়ুন বেশি ঘুমানো স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না।”

“তুমি ব্যাগ প্যাক করছো যে? চলে যাচ্ছ নাকি?”

“চলে গেলে আপনি অনেক খুশি হবেন। আপনাকে খুশি করতে আমার বয়েই গেছে!”

“তা তো জানিই। তাহলে কোথাও বেড়াতে যাচ্ছ?”

“আম্মু বলেনি আপনাকে?”

“কি?”

“আমাকে বাসায় দিয়ে আসার কথা ছিল না!”

“কই আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি।”

“বলতে ভুলে গেছে হয়তো। সমস্যা নেই এখন বলে দিবে। আপনি রেডি হয়ে নিন।”

জাওয়াদ উঠে ওয়াশরুমের আয়নায় নিজেকে দেখে চমকে উঠে। দরজা খুলে বললো, “আরওয়া এসব তুমি করেছ তাই না?”

আরওয়া ইনোসেন্ট ফেইস করে বলল, “আমি কেন করতে যাবো? দেখুন গিয়ে রাতে কোনো ভূত এসে করে দিয়ে গেছে।”

“হ্যাঁ ভূতেরা ক্লাসের সিআর তো, ওদেরও ব্যাগে মার্কার পেন নিয়ে ঘুরতে হয়!”
বলেই সে দরজা আটকে ফ্রেশ হয়ে নিলো। মনে মনে বললো, “বাচ্চা মেয়ে একটা!”

আরওয়া মুখ ভার করে বললো, “ধুররর রাগলো না!”

ডাইনিং এ সবাই ব্রেকফাস্ট করতে বসতেই জোবায়ের সাহেব বললেন, “আয়েশা আজ নাইওর যাচ্ছো?”

“জ্বি দাদাসাহেব।”

“বেশ তো! কিছু দিন বেড়িয়ে আসো। তোমার পরিবারের সবাইকে আমার সালাম দিও। জাওয়াদ?”

“জ্বি।”

“তুমি আয়েশাকে পৌঁছে দিবে। শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় কখনোই খালি হাতে যাবে না। আবার গেইটে নামিয়ে দিয়ে চলে এসো না। ভেতরে যাবে সবার সাথে কুশল বিনিময় করবে। প্রয়োজন হলে থাকবে। মনে থাকবে?”

“জ্বি দাদাসাহেব।”

নাহিয়ান ফোঁড়ন কেটে বললো, “ইটস নট ফেয়ার দাদাসাহেব। আপনি জাওয়াদকে একদম লাইন বাই লাইন সব শিখিয়ে দিচ্ছেন। অথচ আমাকে এসব বলেন নি। এটা তো ঠিক না। আপনার উপর আমাদের সবার সমান অধিকার আছে। আপনার সম্পত্তি যেমন উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা সবাই সমানভাগে পাবো, আপনার জ্ঞানও সমান পাওয়ার অধিকার আছে। আপনি আমার বেলা এসব বলেননি কেন?”

জোবায়ের সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, “তুমি তোমার স্ত্রীকে কোনোদিন ভার্সিটির গেইটে নামিয়ে চলে গেছ? ভেতর অবধি যাও নি এমন কোনো দিন ছিল?”

নাহিয়ান ডানে বাঁয়ে মাথা নেড়ে বললো, “কিন্তু এটার সাথে ওটার কি কানেকশন?”

“কানেকশন আছে। মানুষ স্বভাবত যা করে তাকে তা সবসময় শিখিয়ে দিতে হয়না। কিন্তু যে ব্যতিক্রম হয় তাকে ধরে ধরে সব শেখাতে হয়।”

“ওহ আচ্ছা! আপনি ভাবছেন জাওয়াদ আরওয়াকে ওদের গেইটে নামিয়ে দিয়ে চলে আসবে হেহেহে!! কি রে তুই আসলেই এমন করতি নাকি?”( জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে)

জাওয়াদ মনে মনে ভাবছিল, “ও আসলেই এমন করতো। একই শহরেই তো আরওয়াদের বাসা, ভেতর অবধি যাওয়ার দরকার কি?”

আরওয়া মনে মনে বললো, “ওহো দাদাসাহেব এখন তো মনে হচ্ছে আপনার উচিত ছিল উনাকে রোমান্স করাও শিখিয়ে দেওয়া। এ যে রোবট, কমান্ড না দেওয়া অবধি কোনো কাজই করবে বলে মনে হয় না!”

আরওয়া রুমে এসে গড়াগড়ি খেয়ে হাসতে লাগলো। জাওয়াদ ওর পেছনেই আসায় ওর হাসি দেখে বললো, “কি ব্যাপার তোমার কি মৃগীরোগ আছে? এমন গড়াগড়ি খাচ্ছ কেন?”

আরওয়া ভ্রু কুঁচকে বললো, “মৃগীরোগী দেখেছেন কখনো? ওটার সাথে এটার কোনদিক মিল আছে?”

জাওয়াদ কাভার্ড থেকে শার্ট প্যান্ট বের করে বললো, “কয়দিনের জন্য যাচ্ছ?”

“কেন মিস করবেন বুঝি?”

“শান্তিতে কতদিন ঘুমানো যাবে তার হিসাব করবো!”

“এমনভাবে বলছেন যেন আমার জন্য রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেন না! শুনুন শুধু আমি বলেই এমন নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছেন। হ*র্নি কোনো মেয়ে হলে এতোদিনে আপনাকে…”

“আমার তো মাঝেমধ্যে মনে হয় তুমি এলাকার বখাটে গুন্ডা! তোমার চাহনি কথা বলার ধরন সুবিধার না।
বিয়ের আগে গলির মুখে বসে ছেলেদের টিজ করতে বুঝি?”

আরওয়া হাত দিয়ে নিজের চুল ঠিক করে বললো, “বখাটে হলে তো ভালোই হতো, আপনাকে জোর করে রে*ই*প করে ফেলতাম। আচ্ছা ছেলেদের কে রে*ই*প করা যায়? উমম ভালো আইডিয়া দিলেন‌ তো গুগল করতে হবে এই বিষয়ে।”

“তুমি গুগলে এসব সার্চ দিবে! সিরিয়াসলি?”

“হোয়াই নট? অজানা কিছু জানতে হলে গুগল ছাড়া কে আছে?”

জাওয়াদ হঠাৎ ওর দিকে কদম বাড়ালো। আরওয়া শুরু তে স্থির হয়ে থাকলেও ওর এগোনো দেখে ধীরে ধীরে পেছাতে লাগলো। জাওয়াদ ওর দিকে এগোতে এগোতে একদম দেয়ালের দিকে নিয়ে গেল। দেয়ালে পিঠ ঠেকতেই আরওয়া জোর গলায় বললো, “কি হয়েছে আপনার? এমন এগিয়ে আসছেন কেন?”

জাওয়াদ বাঁকা হেসে বললো, ‘এখনো‌ তো কিছু ই করলাম না ওমনি হাওয়া ফুঁসস? এমন টিকটিকির মতো কলিজা নিয়ে এতো বড় কাজ করবে?”

আরওয়া ওকে চমকে দিয়ে ওর গলা জড়িয়ে আদুরে গলায় বললো, “একদিন বলেছি না প্রতিপক্ষ কে কখনো দূর্বল ভাববেন না? কখন যে কে কি করে বসে আপনি জানেন না!”

জাওয়াদ ওর কোমর জড়িয়ে কাছে এনে বললো, “তোমার সাহসের প্রশংসা করতে হয়! আগুন নিয়ে খেলতে ভয় করেনা?”

“যদি বলি আপনি আমার বর বলেই সাহসটা দৃঢ় আছে? আগুন নেভানোর পানি হিসেবেই তো আমাদের সৃষ্টি!”

জাওয়াদ ওর কপালে থেকে চুল সরিয়ে কানে গুজে ফিসফিস করে বললো, “সাহস যদি দৃঢ়ই হতো এমন কাঁপছো কেন? ভয় নাকি আবেগ হুম?”

আরওয়া ওর চোখে চোখ রেখে গাঢ় গলায় বললো, “আমি রোবট নই। আমি রক্ত মাংসে গড়া মানুষ। আপনার স্পর্শে আমার আবেগ প্রখর হবে এটা কি স্বাভাবিক নয়?”

জাওয়াদ ওর কোমড় ছেড়ে দিয়ে দূরত্ব বাড়ালো। আরওয়া ওর দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। মনে মনে বললো, “গুড লাক আরওয়া!”

বলেই জাওয়াদের ঘাড় ধরে কাছে টেনেই ওর ঠোঁটের মাঝে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। জাওয়াদ শুরু তে রেসপন্স না করলেও ধীরে ধীরে গভীর চুম্বনে ডুবতে শুরু করলো…..

চলবে,,,

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব১৫

#আরশিয়া_জান্নাত

করিমুন্নেসা চুপচাপ বসে আছেন। আরওয়া তার সামনে বসেই যাঁতি দিয়ে সুপারি কাটছে।

“তো কি সিদ্ধান্ত নিলি? জামাইয়ের ভাত খাইবি নাকি চলি আইবি?”

আরওয়া মলিন গলায় বললো, “দাদীজান আমার উনাকে অনেক ভালো লাগে। উনি যখন রাগী রাগী গলায় কথা বলে কিংবা বিরক্ত স্বরে ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, তখনো আমার অনেক ভালো লাগে। আমি বহুবার ভেবেছি চলে আসবো, কিন্তু চলে আসতে মন চায় না। আমার মনে হয় উনার আশেপাশে থাকাটাও শান্তির। এসবের কোনো লজিক আছে বলো? আমি এমন বোকা বোকা চিন্তা ভাবনা করছি কিভাবে? উনি আমাকে ভালোবাসে না, এটা জানা সত্ত্বেও আমি শাবানার রোল প্লে করছি কিভাবে?”

করিমুন্নেসা নাতনির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “বুবু মাইয়াগো মন গলতে সময় বেশি লাগেনা। শাবানারে নিয়া যতোই মজা করোস না ক্যান হেতি সত্যিকার বাঙালি নারীর উপমা আছিল। তখনের যুগে আমরা ভাবতাম স্বামীই সব। হে মারুক কাটুক জলে ভাসাইয়া দেক, তবুও হেই পরম আপনজন। তারে কষ্ট দিলে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও মিলতো না। তুই ও তো এই জাতেরই মাইয়া, যতোই আধুনিকতা আসুক এই বীজ মনে ঠিকই গাঁথি আছে।”

“সব হয়েছে তোমার জন্য। তোমার সাথে বসে বসে আগের দিনের বাংলা সিনেমা দেখে ‌আমার এই হাল হইছে।”

“আর কি মনে হয় হুনবিনি? আর তুন লাগে হেতে ঠিকই তোরে পছন্দ করে।”

“পজিটিভ বলিও না, এমনিতেই উনার প্রতি দূর্বল হয়ে আছি। তুমি আরো পজিটিভ বললে আমার আমি মিথ্যে স্বপ্ন দেখতে শুরু করবো।‌শেষটা ভিন্ন হলে মানতে বেশি কষ্ট হবে।”

“এতো নিরাশ হইছ না বুবু। আল্লাহ চাইলে সব সম্ভব।”

আরওয়া ফোনের দিকে তাকিয়ে নিরাশ হয়ে বললো, “এখন পর্যন্ত ১বার কল দেয়নাই। আমি না থাকায় সুখেই আছে। মনে মনে হয়তো ভাবছে ভালোই হয়েছে আপদ বিদায় হলো!”

“তুই কল দে?”

“নাহ আমি দিবো না।”

“ক্যান? দিলে কি আন্নের গাত ফোস্কা ফইরবোনি? এরোই ইগিন করিচ্চা, জামাইয়ের ভাত খাওন এতো সোজা না। ”

“তুমি খালি আমাকে বলো, উনারে কিছু বলো না কেন?”

“আর রক্ত কে? তুই না হেতে?”

“হুহ!”

“ভেঙ্গাই লাভ নাই। কল দে হেতেরে। হেতে যতো দূরে যাইবো তুই ততো কাছে যাইবি। তুই কিল্লেই ছাড় দিবি? বেডাইত রে ছাড়ি দিলে বিপথগামী হয়। তুই হেতের বৌ,হেতের উপর তোর যেমন হক আছে, তোর উপর হেতেরো হক আছে। বুইজ্জত্তি আর কতা?”

অগত্যা আরওয়া জাওয়াদকে কল করলো। তিনবার রিং পড়ার পর জাওয়াদ কল রিসিভ করে বললো, “হুম আরওয়া বলো।”

“কেমন আছেন?”

“ভালো তুমি?”

“ভালো। কি করছিলেন?”

“অফিসে। হঠাৎ কল দিলে যে? কোনো কাজ ছিল?”

“নাহ। এমনিই আপনার খোঁজখবর নিতে কল‌ দিলাম।”

“তোমাকে দিয়ে আসছি যে ৮ ঘন্টা ও হয় নি!”

আরওয়া ফট করে ফোন কেটে বললো, “দাদীজান আমি আসছি যে ১দিনো হয়নাই!!”

করিমুন্নেসা হোহো করে হেসে উঠলেন। আরওয়া নিজের কপাল চাপড়ে বললো, “উফ উফ আমি আসলেই বলদি!”

জাওয়াদ ফোনের দিকে তাকিয়ে বললো, “এটা কি হলো? মেয়েটা আমাকে মিস করছিলো নাকি?!”

“অন্যের শেখানো বুলি আওড়ালে তোতাপাখি হওয়া যায়। মানুষ না!”

“হঠাৎ এই কথা বললে কেন?”

জহির সাহেব দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন, “আমাদের ছেলেকে দেখে কি কিছু বুঝতে পারো রোকেয়া? ও আদেশ মানতে মানতে এমন মেরুদন্ডহীন হয়েছে নিজ বুদ্ধি তে কিছু করার সাহস করেনা। আমি কতবার চেয়েছি এই অবস্থার পরিবর্তন করতে। কিন্তু বাবার জেদের সামনে কিছু করতে পারলাম না। আমার মাঝেমধ্যে নিজেকে অপরাধী মনে হয়…”

রোকেয়া তার কাঁধে হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “এতে তোমার দোষ নেই। আব্বার মনে হয়েছে উনি ওকে সঠিকভাবে মানুষ করতে পারবেন। তাই ওর সবকিছুতে তিনি একচ্ছত্রভাবে শাসন করেছেন।”

“এর পেছনে কোনো না কোনোভাবে আমিই দায়ী। আমার অন্যান্য ভাই-বোনের তুলনায় আমি একটু বেশি স্বাধীনচেতা ছিলাম। উনার মতে আমি উচ্ছন্নে গেছি! আমার এগ্রিকালচার নিয়ে পড়াশোনা করা উনার কখনোই পছন্দ ছিল‌না। উনি আমার জীবনের কোনোকিছুতেই মনমর্জি চালাতে পারেন নি। হয়তো সেই ক্ষোভটা জাওয়াদকে দিয়ে মিটিয়েছেন। খেয়াল করে দেখো অন্য কারো বেলা উনার এতো খবরদারি চলেনা যতোটা ওর বেলা চলে। বিজনেসের ক্ষেত্রেও ওকে টেনেছে…”

“তুমি অযথাই এসব ভেবে মন খারাপ করছো। বাবা-মা কখনো খারাপ চায় না।”

“হাসালে রোকেয়া! বাবা-মাও মানুষ। আর কোনো মানুষ ভুলের উর্ধ্বে নয়।
আমি একটা কথা বিশ্বাস করি জানো, ইতিহাস ঘাটলে ও এটাই পাবে।বাবা ভোগবিলাস বেশি করলে সন্তানকে অভাবে পড়তে হয়। আবার বাবা অভাবে বাস করলে সন্তান ভোগবিলাস করতে পারে। অর্থাৎ এক প্রজন্ম সুখ করবে আরেক প্রজন্ম দুঃখ করবে। এভাবেই চলছে পরম্পরা…”

“তোমার কথা ফেলতে পারছিনা, কিন্তু এখন কি কিছু করার আছে বলো? যা হবার তা তো হয়েই গেছে। ”

“আই উইশ আমি তখন কোনো স্টেপ নিতাম!”

অফিস থেকে ফিরে জাওয়াদ কফি মেকার অন করলো। জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে পান করতে করতে ভাবতে লাগলো ও অফিস থেকে এলেই আরওয়া রোজ পানি এগিয়ে দেয়। হাসিমুখে কিছুক্ষণ কথা বলে। অন্য সময়ের তুলনায় বেশ পরিপাটি থাকে। মেয়েটা আসলেই সাংসারিক, এইসব খুঁটিনাটি বিষয় খুব সচেতনভাবে পালন করে।

জাওয়াদ ওর পড়ার টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বইখাতা সব কোনোরকম একপাশে ঠেসে রেখেছে। কয়দিনের পরীক্ষায় সবকিছু ই উলোটপালোট করে রাখা। জাওয়াদ ফ্রেশ হয়ে এসে ওর টেবিলে গোছাতে লাগলো। সে অগোছালো কোনোকিছু পছন্দ করেনা। অথচ তার‌ নসীবে ওটাই জুটেছে। ও বরাবরই নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখে। সিকোয়েন্স এর নড়চড় ওর পছন্দ না। যেটা যেভাবে রাখে ওভাবেই যেন থাকে সেদিকে তার সতর্ক দৃষ্টি থাকে। টেবিলের সব গোছগাছ এর মাঝে মগে কফি ঢেলে তাতে চুমুক দিতে দিতে আরওয়ার কালো ডায়েরিতে নজর গেল। বিনা অনুমতিতে অন্যের ব্যক্তিগত ডায়েরি পড়া ঠিক না। জাওয়াদের সেটা পড়ার কৌতুহল জাগলেও কঠোরভাবে দমন করলো।

টেবিলের উপর থাকা তাদের বিয়ের ছবির ফ্রেমটা হাতে নিয়ে ভাবতে লাগলো কত দ্রুত সময় চলে যায়।
“আচ্ছা ওকে কি একবার কল করা উচিত? ঐ সময় হুট করে কল কেটে দিয়েছিল আর তো কথা হয় নি। ও কি ফোনকলের অপেক্ষা করছে? নাহ, কল দিলে পরে যদি ভাবে আমি মিস করছি? লেগ পুল করতে ছাড়বেনা যে দস্যি মেয়ে!”

হিয়ার অনবরত কলে বিরক্তিতে ঘুম ভাঙ্গে পাপিয়ার। রুক্ষ স্বরে বলে, কি রে ভাই সাতসকালে এতো কল দিতে হয় তোর? মেজাজ টাই খারাপ করে দেস।

হিয়া বিচলিত কন্ঠে বললো,” স্যরি দোস্ত আমি জানি সকলে তোর ঘুম ভাঙলে মেজাজ খারাপ হয়। কিন্তু ঘটনা টা এতোই সিরিয়াস কল না করে পারলাম না।”

“কি হয়েছে? ”

“দোস্ত সামিয়া পালাইছে।”

“সামিয়া পালাইছে মানে?”

“রিজভী ওরে ৩০হাজার টাকা দিলো না ? ঐ টাকা নিয়ে অন্য ছেলের সাথে পালাইছে।”

“মানে কি! ও না রিজভী কে ভালোবাসে? এখানে অন্য ছেলে আসছে কোত্থেকে!”

“সেটাই তো। হলে একদম হৈ চৈ পড়ে গেছে। সামিয়া খালি রিজভী থেকেই টাকা নেয়নাই, এখানের আরো কিছু মেয়ের থেকেও নিছে। ও যে এমন পগারপার হবে কেউ কল্পনাই করেনাই। কি একটা অবস্থা! রিজভীর কি হাল এখন কে জানে।”

“শা*লী কু*ত্তি। এর মতিগতি যে সুবিধার না আগেই বুঝছিলাম। প্রেম করবি একটার লগে আর পালাবি আরেকটার লগে মা*দা*রী!”

“ও ভাই তুই এতো গালি দিচ্ছোস কিভাবে? আমি তো জানতাম ই না তুই গালি পারোস।”

“তখন দেওয়ার প্রয়োজন পড়েনাই তাই দি নাই। যাই হোক রিজভী জানে এগুলো?”

“জানিনা। ”

“ঠিকই আছে, ওর সাথে এমনই হওয়া উচিত।আমার থেকে ১০ হাজার নিছে বলে সামিয়ার বাবা অনেক অসুস্থ তাই ইমার্জেন্সি ৩০ হাজার লাগবে। এই তার অসুখ! হারামী মাইয়া,গোল্ড ডিগার একটা! ওর নামে কেইস করা উচিত।”

“তুই ক্যাম্পাসে চলে আয়। আমার রিজভীর জন্য টেনশন লাগতেছে। ওয় তো পুরাই ক্রেজি। সব শুনে কেমন রিয়েক্ট করবে কে জানে।”

“তুই টেনশন নিস না। যেমন কর্ম তেমন ফল। কাউকে অন্ধবিশ্বাস করতে নাই, তাইলে সে অন্ধ প্রমাণ করে চলে যায়।ওর উচিত শিক্ষার দরকার ছিল।”

“ঠিক বলছোস।”

“আচ্ছা আমি আসলে বাকি কথা হবে। রাখছি।”

“তাড়াতাড়ি চলে আসিস।”

“হুম বায়”

“বায়।”

ফোন রেখে পাপিয়া আরো কিছুক্ষণ রিজভী কে গালিগালাজ করলো। নাহ পেছনে বলে মজা লাগছে না, ওর সামনে বসে ওর মুখের উপর গালি দিতে পারলে শান্তি লাগতো।

জাওয়াদ ভেবেছিল আজ পুরো বিছানায় একা রাজত্ব করে আরামের ঘুম হবে। কিন্তু দেখা গেল সে এক কাতেই রাত কভার করেছে। ও এমনভাবে ঘুমাচ্ছিল যেন অপরপাশে আরওয়া ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মধ্যেই হাত পা ছড়িয়ে যুদ্ধ করা মেয়েটা আজ নেই। রাতে কতবার যে ওকে ঠিক করে দিতে হয়! কখনো গায়ের উপর পা তুলে দিতো তো কখনো কোলবালিশ ভেবে জড়িয়ে ধরতো। অল্পদিনেই কেমন এক অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে সে!

” আহ! এই অসহ্যকর মেয়েটা থেকেও শান্তি দেয়নি, গিয়ে ও শান্তি দিচ্ছে না। ঘুমের মধ‌্যেও মাথা থেকে সরছে না কেন? স্ট্রেইঞ্জ!”

জাওয়াদ আর ঘুমালো না। উঠে ফ্রেশ হয়ে জগিং করতে বেরিয়ে গেল।

আরওয়া ঘুমের ঘোরে বললো, “কোলবালিশ টা বেশি নরম হয়ে গেছে। ভাল্লাগে না ধুরর..”

বলেই লাথি মেরে সেটা নীচে ফেলে দিলো।বালিশ থেকে মাথা সরিয়ে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ফের গভীর ঘুমে তলিয়ে পড়লো।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে