#কাঁটাকম্পাস_পর্ব১২
#আরশিয়া_জান্নাত
“কি ব্যাপার আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”
“চলো তোমার ক্যাম্পাস দেখবো আজকে।”
“এখানে দেখার কি আছে?”
“তুমি কি চাইছো না আমি ভেতরে যাই?”
“নাহ চাইছি না।”
“কেন রহস্য কি?”
“আপনি এখন গেলে আমার সব ফ্রেন্ডরা আপনাকে ঘিরে ধরবে। অযথা হৈ চৈ এর দরকার নেই। তাছাড়া আপনার অফিসে লেট হবে।”
“জাওয়াদ সানগ্লাস টা চোখে পড়ে বাঁকা হেসে বললো, নো ওয়ারিস। আমি সামলে নিবো।”
আরওয়া ভ্রু কুঁচকে বললো, “আপনি চাইছেন টা কি? আমার বন্ধু-বান্ধব দেখে আপনার কাজ কি?”
জাওয়াদ হালকা নুইয়ে ওর কানের কাছে বললো, “তুমি কি ভয় পাচ্ছ আরওয়া? তোমার সিক্রেট কিছু জেনে যাবো ভাবছো?”
“হেহেহে জোক্স অফ দ্য ডে! শুনুন আমি খোলা বইয়ের মতো যার ইচ্ছা সে পড়ে নিতে পারে। আমার এমন কোনো সিক্রেট নেই যা সামনে এলে বিব্রতবোধ করতে হবে।”
“ওয়াহ! এতো কনফিডেন্স।”
“ইয়েস।”
“যাদের বাইরে থেকে দেখতে খোলা বই মনে হয়, তাদের সিক্রেট আরো বেশি থাকে। লোকে ভাবে আরেহ এ তো সব বলেই দেয় এর আর গোপন কিছু নেই। কিন্তু সত্যিটা ঠিক তার উল্টো”
আরওয়া ওর চোখের দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে রইলো। মৃদু হেসে বলল, “বই পড়ে পড়ে ব্রেইনটা ভালোই শার্প করেছেন।”
“মাশাআল্লাহ বলো। নজর লাগবে।”
“আসুন থুতু দেই নজর না লাগুক!”
জাওয়াদ ভার্সিটির গেইটের দিকে এগোতেই আরওয়া তার পেছনে আসতে লাগলো। কিছুদূর এগিয়ে জাওয়াদ থেমে গেল। আরওয়া ওর কাছাকাছি এসে বললো, কি ব্যাপার থামলেন কেন?
“তুমি যেভাবে টরটয়েজের মতো হাঁটছো; না দাঁড়িয়ে উপায় কি?”
“আমার অতো লম্বা লম্বা পা নেই যে দু’কদমে ১কিলোমিটার এগিয়ে যাবো!”
জাওয়াদ বিদ্রুপ করে বললো, “তোমার জন্য রোলার সুজ কিনতে হবে দেখছি। নয়তো তাল মেলাতে পারবে না।”
আরওয়া গাল ফুলিয়ে বললো, ” দ্রুতগতি নিয়ে বড়াই করা ভালো না। Slow and steady wins the race.”
“তোমার মুখটা যত চলে সেরকম পা চললে তো হতোই। যাই হোক চলো এবার।”
জাওয়াদ মুখে তিক্ততা দেখালেও নিজের গতি কমিয়ে সে আরওয়ার পাশাপাশিই চলতে লাগলো।
আরওয়ার বেস্টফ্রেন্ড রুমাইসা ওকে দেখেই হাত নেড়ে ইশারা দিলো। আরওয়া ওর দিকেই অগ্রসর হলো। রুমাইসা জাওয়াদকে খেয়াল না করেই বললো, কি রে আজ এতো লেট করলি যে?
ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছে।
ওহোও আজকাল রাতজাগা হচ্ছে বুঝি? তোর রোবটটা মানুষ হচ্ছে তাহলে!
আরওয়া ওর বেনুনী টেনে পেছনে ইশারা করলো। রুমাইসা ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো কি?
আরওয়া পেছনে পয়েন্ট করলো। রুমাইসা পেছনে দেখে জাওয়াদ দাঁড়িয়ে আছে। ও চিৎকার করে বললো, “আরেহ ভাইয়া! আপনি এখানে? হোয়াট এ প্লেজেন্ট সারপ্রাইজ!”
ওর চিৎকারে আরওয়া কানে হাত চেপে বললো, “তোর গলা এমনিতেই ২মাইল দূর থেকে শোনা যায়। এতো জোরে চিল্লানোর কি দরকার ছিল”
“আরেহ খুশি তে চিল্লাই ফেলছি। আমার একমাত্র বেস্টফ্রেন্ডের জামাই বলে কথা। একটু খুশি হমু না?”
জাওয়াদ ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে বললো, এখানে ক্যান্টিন কোথায় চলো সবাই বসি। তোমাদের অন্য ফ্রেন্ডদেরো ডাকো।
আপনি একটু দাঁড়ান আমি অন্যদের খবর দিচ্ছি।
রুমাইসা চলে যেতেই আরওয়া বলল, আপনি কি এখন গ্রেট দুলাভাইয়ের মতো ওদের ট্রিট দেওয়ার প্ল্যান করছেন?
করলে কি খুব অসুবিধা হবে?
কেন করবেন? হেই আপনি কি আমার প্রেমে পড়েছেন নাকি? আপনার লক্ষণ তো সুবিধার না।
মোটেও তেমন নয়। অহেতুক ভাবনা রাখো তো।
আরওয়া দুষ্টুমি মার্কা হাসি দিয়ে বললো, আসলে আপনার দোষ নাই, এমন সুন্দরী বউ থাকলে প্রেমে না পড়ে উপায় আছে। বলতে লজ্জা লাগলে থাক বলতে হবেনা..
You’re unbelievable!
।
সামিয়া হ্যান্ড মিররে নিজের মেকাপ চেক করে বললো, কি বলবে বলেছিলে, এখন বলো?
রিজভী ওর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে এতোক্ষণ চেয়েছিল। ওর কথায় নড়েচড়ে বললো, আসলে কিছু সমস্যা হয়ে গেছে, টাকাটা ম্যানেজ করতে পারিনাই। কিছু দিন পরে দিলে হবেনা?
সামিয়া ওর হাত মুঠোয় নিয়ে বললো, ওহ বাবু এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে এতো আপসেট হয়েছিলে! তোমার চেহারা দেখে তো আমি ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।
নাহ আসলে তুমি চেয়েছ আমি দিতে পারছি না তাই একটু আনইজি লাগছিল।
টেনশনের কিছু নেই। তোমার ফোন থেকে সিম খুলে নাও তো।
কেন?
তোমার ফোনটা দিয়ে টাকা ম্যানেজ করবো। তুমি যখন দিবে তখন ঋণ শোধ করে আবার ফেরত নিবো। বন্দক টাইপ আর কি!
তোমার টাকাটা এতো প্রয়োজন!
না হলে কি তোমায় বলতাম সোনা?
রিজভী হাসলো। হেসে বললো, তাহলে তোমার ফোনটা দিয়ে আরো বেশি টাকা ধার পাবে। আমার টার চেয়ে তোমার টা দামি বেশি।
এটা আমি কিভাবে দিবো, তোমার গিফট করা কোনোকিছু কি আমি কাউকে দিতে পারি? তুমি জানো না তোমার প্রতিটা গিফট আমি কত যত্নে তুলে রাখি?
রিজভী কাঁচের জানালা ভেদ করে দূরের ব্যস্ত রাস্তার দিকে চেয়ে রইলো। পৃথিবীতে নানারকম অত্যাচার আছে। তবে সবচেয়ে বড় অত্যাচার হলো ভালোবাসার মানুষ থেকে পাওয়া অত্যাচার। না বলা যায়; না সওয়া যায়!
কুহু আর পাপিয়া শপিং করতে এসেছে। শপিং মলে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি শেষে পাপিয়া বললো, ধুরর কিছু ই পছন্দ হচ্ছে না তোর। অর কত দোকান ঘুরবো?
তুই এতো অধৈর্যশীল কেন? সবেই তো এলাম। ঘুরেঘুরে যাচাই বাছাই করে কেনাকাটা না করলে লস খেতে হয়।
তোর সবসময় এমন করা লাগে। সামান্য লিপস্টিকের শেড খুঁজতেই ২ঘন্টা শেষ।
লিপস্টিকের শেড কে সামান্য বলছিস? তুই জানিস এটা কত ইম্পর্ট্যান্ট? একটু ১৯/২০ হলেই সাজটাই বরবাদ।
তুই তোর পছন্দের ব্র্যান্ডের শেডকোড মনে রাখলেই পারিস। এতো কষ্ট করে খোঁজা লাগেনা।
আইডিয়া ভালো তবে আমার এতো টাইম নাই লিখে লিখে লিস্ট করে ঘোরার।
হ্যাঁ তোর আজাইরা ঘুরতে সময় আছে, লিস্ট করতে সময়নাই। যত্তসব!
ইশ এতো রাগ করিস কেন? তুই আমার বোন না? আমার সাথে ঘুরবি না তো কার সাথে ঘুরবি?
ঢং তোর।
আচ্ছা চল তোকে বার্গার খাওয়াবো। তবুও রাগ করিস না।
তুই আরো কয়েক ঘণ্টা ঘুরবি তাই না? এজন্য বার্গার অফার করছিস?
তুই আমায় কতো বুঝিস! সো সুইট অফ ইউ।
জীবন আমারে কতবার শিক্ষা দেয়। আমি তবুও কেন যে সব ভুলে আবার একই ভুল করি! ইয়া আল্লাহ!!!!
এই পাপিয়া দেখ দেখ ঐটা রিজভী না?
হ্যাঁ রিজভীই তো।
ওর সাথের মেয়েটাই সামিয়া?
হুম।
মেয়ের মেকাপ সেন্স ভালো। ফিনিশিং ভালোই দিয়েছে।
তুই দূর থেকে ওর মেকাপ স্কিল বুঝে ফেললি,হ্যাটস অফ!
চল গিয়ে কথা বলি?
নাহ, রিজভী রে চিনোস না এখন আমাদের কে দেখলে সব বিল আমাদের ঘাড়ে ফেলবে।
যাহ তুই ও না কি বলোস! ওর বাপের টাকার অভাব আছে নাকি? ও কেন এমন করবে?
ওর বাপের টাকার অভাব নাই তবে ওর আছে। হাত খরচা তো সব এই ডাইনির পেছনেই উড়ায়। মাস শেষ হবার আগেই ফকির হয়। আঙ্কেল ও জোস! নির্দিষ্ট এমাউন্টের উপর ১টাকাও দেয় না।
ওরা যদি একে অপরের জন্য পারফেক্ট হয় তবে টাকাপয়সা ম্যাটার করেনা। গফের পেছনে টাকা উড়ানো খারাপ নাকি? তুই একটু বেশিই ন্যারো মাইন্ডের।
পাপিয়া মিল্কশেকের স্ট্র মুখে দিয়ে অন্যদিকে চেয়ে হাঁটতে লাগলো। সে কি আসলেই বেশি ন্যারো মাইন্ডেড?
।
আরওয়ার ঘুম থেকে উঠে বসতেই পাশে চেয়ে দেখে জাওয়াদ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে বিরবির করে বললো, জামাই এতো সুন্দর হয়ে লাভ কি হলো বলুন তো? মনভরে একটু দেখাও যায় না ছোঁয়াও যায় না! এই নিষ্ঠুর লোকের চেহারা এতো সুন্দর করে না বানালেও পারতে আল্লাহ!
জাওয়াদের যখন ঘুম ভাঙ্গল সে চোখ মেলেই দেখে আরওয়া ওর মুখের উপর ঝুঁকে বসে আছে। ফোলাফোলা চোখ দুটো পরম মুগ্ধতায় তার দিকে মনোনিবেশ করে আছে। জাওয়াদের এই প্রথম মনে হলো আরওয়া দেখতে খুব সুন্দর। ওর ফর্সা মুখটায় কোমলতা যেন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ঘুমের প্রভাবেই কি এতো মোহনীয় লাগছে নাকি আসলেই সে দেখতে এমন?
” ঘুমন্ত মানুষের উপর কেউ এভাবে ঝুঁকে বসে থাকে! এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছো!”
আরওয়া হাই তুলে বললো, আমি মনোযোগ দিয়ে দেখছিলাম কে বললো? আমি তো ভাবছিলাম।
কি ভাবছিলে?
ভাবছিলাম আপনি আসলেই ওর মতো।
কার মতো!
কতগুলো বিড়াল আছে না? দেখতে অনেক সুন্দর, দেখলেই কেমন আদর আদর লাগে। ইচ্ছে করে কোলে তুলে কিছুক্ষণ কচলাই। কিন্তু ওদের ধরতে গেলেই রেগে যায়, খামচি দিতে চায়। যদিও আপনার মতো ধামড়া লোককে আমার কোলে তোলার ইচ্ছে নেই…
জাওয়াদ বিরক্তস্বরে বললো, ভাষায় কিসব শব্দ ব্যবহার করো!
হুহ! আসছে আমার সভ্য ভাষাবিদ!
তো তুমি আমার দিকে এমন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে এইটা ভাবছিলে! আজিব!
দেখুন দেখুন আমি একদম ঠিক ভেবেছি। আপনিও তাকানোতে রেগে যাচ্ছেন। ওদের দিকেও বেশিক্ষণ তাকালে ওরা রেগে যায়। একদম সেইম টু সেইম এটিটিউড..
তুমি উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করো নাকি প্রাণি নিয়ে? বিড়াল গবেষক আরওয়া!
আসলে আমার কিউরিসিটি বেশি তো। তাই এবনরমাল কিছু দেখলেই পর্যবেক্ষণ করতে আরম্ভ করি। এখন হোক সেটা উদ্ভিদ কিংবা জিদ্দি বিড়াল টাইপ মানুষ!
তোমার যতসব আজগুবি চিন্তা ভাবনা।
জাওয়াদ অফিসের জন্য তৈরি হবার সময় আরওয়া দুহাত পেছনে রেখে আবদারের স্বরে বললো, এই শুনুন, আজকে আমি আপনার টাই বেঁধে দেই?
জাওয়াদ শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে বললো, নো থ্যাঙ্কস আমি নিজের কাজ নিজে করতে পছন্দ করি।
দিন না একটু বেঁধে দেই, প্লিজ প্লিজ প্লিজ?
জাওয়াদ পেছন ফিরে আরওয়ার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, মতলবটা কি তোমার? আজ সকাল সকাল কি শুরু করেছ?
আরওয়া ভাবুক গলায় বললো, আমি অনেক ভেবে দেখলাম আপনার থাকায় আমার বিশেষ কোনো লাভ হচ্ছে না। তাই ভাবছি টাইয়ের প্যাঁচে ফেলে আপনাকে উপরে পাঠিয়ে দিলেই ভালো হয়।
আরওয়া যেভাবে মাথা ডান কাতে ফেলে হাতের ভঙ্গি করে দেখালো মনে হচ্ছে সত্যিই ওর হাতের টাইয়ের মাঝে জাওয়াদের গলা ফাঁস খেয়ে ঝুলে আছে! জাওয়াদ সেটা কল্পনা করতেই খুকখুক করে কেশে উঠলো। নিজেকে সামলে বললো, পাগল নাকি তুমি?
আরওয়া ড্রেসিং টেবিল থেকে ইয়ার রিং নিয়ে কানে পড়তে পড়তে বললো, আপনার সাথে থেকে কেউ স্বাভাবিক থাকতে পারে? তাছাড়া আমার আগে থেকে স্ক্রু ঢিলা ছিল এখন তো খুলে পড়ে গেছে বোধহয়! দ্রুত না খুঁজলে আর পাওয়াই যাবে না। হেহেহে
উফফ তোমার সাথে কথা বলা মানে ই সময় নষ্ট করা।
আপনার সময়নষ্ট হচ্ছে কই? রোমান্স করার সময় তো বেঁচে গেছে, ওটায় কাটাকাটি করে নিন। হিসেব করে দেখবেন সব ব্যালেন্সেই আছে। যাই হোক আমার অনেক তাড়া আছে, আজকে একটু আর্লি বের হতে হবে। লেট করা যাবেনা।
বলেই লাজুক হাসি দিয়ে চলে গেল। জাওয়াদ ওর ভাবভঙ্গি কিছু ই বুঝলোনা।
“এই মেয়ে ক্লাসে যাওয়ার কথা বলতেই এমন লাজুক হাসলো কেন? কার জন্য এই লাজুকতা?কই কাল তো তেমন কোনো ছেলেকে দেখলাম না। আহহ এই মেয়ে আমাকে পাগল বানিয়ে ফেলবে!!”
চলবে,
#কাঁটাকম্পাস #পর্ব১৩
#আরশিয়া_জান্নাত
নাহিয়ান রাউন্ড শেষ করে সাবার কেবিনে ঢুকলো। মুচকি হেসে বললো, আয়হায় আমার বউটাকে পেশেন্টের ড্রেসেও কি সুন্দর লাগে! মাশাআল্লাহ।
সাবা ম্লান হেসে বললো, তোমার সবসময় বাড়িয়ে বলা লাগে।
উহু আমি ১রতিও বাড়িয়ে বলছি না।
তাই?
হুম একদম তাই। এখন কেমন লাগছে? কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? ব্যথা করছে?
সেলাইয়ে ব্যথা করছে একটু।
কিছু দিন একটু কষ্ট করতে হবে, অপ্রয়োজনে নড়াচড়া করো না কেমন?
আম্মু কি চলে গেছেন?
নাহ, মেজোআম্মু আসছিল খাবার নিয়ে। তার সঙ্গে ক্যান্টিনে আছেন।
ওহ। আচ্ছা নাহিয়ান এবার কি আমরা বেবি নিতে পারবো? ও আসবে তো?
নাহিয়ান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,যদি আল্লাহ চায় সে আসবে। না আসলেও বুঝে নিবে এটা আমাদের পরীক্ষা।
সাবা চোখের কার্নিশ গড়িয়ে জল পড়লো। কাঁপা গলায় বললো, বেশি শখের জিনিসের খুঁত বেশি থাকে। আমাকে তুমি বেশি ভালোবাসো তো তাই আমার মাঝে অনেক সমস্যা। আমি তোমাকে একটা বাচ্চা দিতে পারলাম না!
সাবা এসব কি ধরনের কথা? বাচ্চা কি মানুষ বানায়? এটা আল্লাহর দেওয়া একটা নেয়ামত। সবাই এই নেয়ামত পায়না। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কিংবা হযরত জাকারিয়া (আঃ) উনারা জীবনের শেষ দিকে সন্তান লাভ করেছিলেন। আমাদের জীবন তো এখনো পড়েই আছে। ধৈর্য ধরো না। উনি চাইলে সব হবে।
সাবা অপরপাশে ফিরে কাঁদতে লাগলো। নাহিয়ান ওর বাহুর উপর মাথা রেখে স্নেহার্দ্র গলায় বললো, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি সাবা। তোমার দোষগুণ মিলেই তোমাকে ভালোবাসি। আমার কাছে তুমিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কেন এতো কষ্ট পাচ্ছ পাখি? আমি আছি তো…
রিজভী অনেক টা কাঁচুমাচু করে বললো, পাপিতা একটু এদিকে আসবি?
পাপিয়া বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বললো, যা বলার বলে ফেল উঠতে পারবো না।
তুই এমন রেগে রেগে কথা বলছিস কেন?
আমি রেগে নেই। আসলে কেউ যখন দোষ করে তখন তার এমনিই মনে হয় অপরজন রেগে আছে।
রিজভী প্রফুল্ল স্বরে বলল, তার মানে তুই রেগে নেই? ওটা জাস্ট আমার মনের ভাবনা। যাক বাঁচা গেল!
পাপিয়া আগের হালেই বসে আছে। রিজভীকে সে নখেদর্পনে চিনে। এর মতো বেহায়া পৃথিবীতে ২য় আর একটাও নেই, থাকলেও পাপিয়া তাকে চিনেনা। চিনতে চায় ও না। তার লাইফে এই একটা বেহায়া ই যথেষ্ট বিরক্তির!
রিজভী ওর জমিয়ে রাখা খোসা ছাড়ানো বাদাম মুঠোয় করে মুখে তুলে চিবুতে চিবুতে বলল, তুই আসলেই জোশ। তোর মতো বেস্টফ্রেন্ড পাওয়া আমার সাত কপালের ভাগ্য।
আমি এতোক্ষণ ধরে খোসা ছাড়াচ্ছি একটা বাদাম ও খাইনি। আর তুই এক পলকে মুঠোয় করে গালে ভরলি!
তোকে আমি কোটি টাকার একটা লেসেন দিলাম। জমিয়ে রাখার প্রবণতা মোটেই ভালো নয়। লাইফে যাই পাবি হোক সেটা টাকা, ঘোরার সুযোগ কিংবা আনন্দ তখনই সেটা লুফে নিবি। পরে করবি ভেবে তুলে রাখবি না। পৃথিবীতে একদল সম্পদের পাহাড় গড়ে যায় কিন্তু ভোগ করতে পারেনা, এর আগেই দুনিয়া ছেড়ে চলে যায়। আরেকদল উত্তরাধিকার সূত্রে সেই সম্পদ ভোগ করে মজা নেয়। কি বুঝলি?
পাপিয়া ওর দিকে চেয়ে বললো, ভালো বলছেন ভাই, আপনি তো মহান বুদ্ধিজীবী। ক্ল্যাপ হবে।
I know I know! যাক তোকে এতো বড় শিক্ষা দিলাম এখন ফি দে।
আমি তো তোকে বলি নাই শিক্ষা দিতে। তাছাড়া এতো গুলো বাদাম যে সাবাড় করলি ঐটা কম?
অকৃতজ্ঞ নারী! আমি উদারমনা বলে তোর গোস্তাখি মাফ করলাম।
তোর কাছে মাফ চাইছে কে? দিনেদুপুরে স্বপ্নবিলাস করিস না তো। দূরে যা।
রিজভী একটু নরম হয়ে বললো, দোস্ত তুই তো আমার সোলম্যাট। আমার আত্মার আত্মীয়। আমার কত্ত কাছের, বিপদের বন্ধু। তোকে আমি কত্ত ভালোবাসি রে। তুই যদি দেখতি আমার মনটা! তোর জন্য কত দোয়া আসে এই মন থেকে।
খবরদার বলতেছি তেল মারিস না। তোর মিথ্যা ফাঁদে আমি পা ফেলবো না।
পাপিতা তোকে আমি কত আদর করে পাপিতা বানিয়েছি। আমি চাইলেই তোর নাম পাপী বলতে পারতাম। কিন্তু না আমি তোকে সফট এন্ড সুইট পাপিতা ডাকি। আমার এইসব ভালো দিক কি তোর চোখে পড়ে না? আমাকে কি না তুই শিকারী ভাবিস! কোথায় আমি তোকে আগলে রাখতে চাইছি, আর তুই!!!
পাপিয়া ঘাস থেকে উঠে জাভা ঝাড়লো,ব্যাগ কাঁধে তুলে বললো, কয় টাকা লাগবে?
ছি ছি আমি তোর কাছে টাকার চাইতে এসব বলি নি। আমাকে কি ভাবিস তুই হু?
নাটক না করে বলে ফেল। তোর নাটক আমার ভালোই জানা আছে।
রিজভী মাথা চুলকে বললো, ২৫হাজার লাগবে। তুই ১০ দিলেই হবে বাকিটা অন্য কারো থেকে যোগাড় করবো। আর তুই চিন্তা করিস না, আমি তোর সব ঋণ শোধ করবো।
পাপিয়া কটমট করে বললো, সামিয়াকে ২৫হাজার টাকা দিবি! এই মেয়ের কি আক্কল নাই? ও কি জানেনা তুই এখনো স্টুডেন্ট। তোর কাছে এতো টাকা কোত্থেকে আসবে? আর ওই বা এতো টাকা দিয়ে করে টা কি!
এভাবে বলিস না দোস্ত। ওর খুব প্রয়োজন না হলে কি খুঁজতো নাকি? তুই দিতে পারবি না? হিয়ার কাছে পাবো মনে হয়? অবশ্য আমি আরো কয়েকজনকে বলে রাখছি, তুই হচ্ছোস লাইফজ্যাকেট। কোথাও না পেলে তুই একমাত্র ভরসা।
আমার ঠেকা পড়েনাই তোরে টাকা দিতে। দূরে যা তো।
রিজভী মুখ মলিন করে করুণ গলায় বললো, আজ অভাবে পড়তেই নিষ্ঠুর রূপ দেখাচ্ছিস? এই তোর বন্ধুত্ব। ছোটো বেলায় কতবার লিখছোস A friend in need is a friend indeed অথচ প্রয়োগের বেলা পিছিয়ে যাচ্ছিস?
পাপিয়া ডোন্ট কেয়ার মুডে বললো, ছোটবেলায় কত কি লিখছি শিখছি, জীবনে প্রয়োগ করি কয়টা? ওসব ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে লাভ নাই। তোর ঐ নাদান গফের জন্য আমি ১টাকাও দিবো না তোকে।
নাদান বললি কেন? তুই সবসময় ওকে হেয় করে কথা বলোস। এটা ঠিক না। ও আমার গফ ওকে রেসপেক্ট করোস না ভালো বাট ডিসরেসপেক্ট করবি না প্লিজ!
পাপিয়া আর কোনো কথা বললোনা। ভেতরের রাগ দমিয়ে প্রস্থান করলো।
।
আম্মু আসবো?
আয়।
কি করছিলে?
আমার কাজ কি একটা? তোর বাবার রোজ কিছু না কিছু সেলাই করতে হয় আমাকে। আজ বোতাম ছিঁড়ে তো কাল সেলাই ছুটে যায়। পেয়েছে তো একটা দর্জি বউ। তাই রোজ তার সেলাই করানো লাগে। তোর পরীক্ষা শেষ?
হুম আজকে শেষ হলো।
বেশ তো।
দ
আম্মু উনাকে বলো না আমাকে বাসায় দিয়ে আসতে। কতদিন হলো যাই না।
রোকেয়া বেগম দাঁত দিয়ে সুতা কেটে বললেন, একটু আগেই বেয়াইন কল করেছিলো, তোকে পাঠানোর কথা বললো। আমি ফারাজ কে বলবো তোকে নিয়ে যেতে।
আরওয়া শাশুড়ির গলা জড়িয়ে বললো, থ্যাঙ্ক ইউ আম্মু।
রোকেয়া হেসে বলল, ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।
আরওয়া খুশিমনে নাচতে নাচতে রুমে গিয়ে ব্যাগপত্র গোছাতে লাগলো।
জাওয়াদ মিটিং শেষে ছাদের ওয়েটিং স্পেসে গিয়ে বসলো। মিটিং টা আশানুরূপ ভালো হয় নি। তাই মনমেজাজ খানিকটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। ফোনে তার ছোট মামা মিজানুর রহমানের কল দেখে ওর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। হাসিমুখে কল রিসিভ করেই বললো, আসসালামু আলাইকুম মামু কেমন আছ?
ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?
ভালো আছি।
কোথায় আছিস, অফিসে?
হুম আর কোথায় থাকবো!
তাও কথা। কিন্তু কেবিনে তো তোকে দেখা যাচ্ছে না। অফিসের নাম করে কোথায় বসে আছিস হু?
জাওয়াদ চমকে বলল, মামু তুমি ঢাকায় এসেছ? সত্যি??
মিজান সাহেব হেসে বললেন, তো কা মিথ্যা বলছি রে পাগলা? ছুটে আয় ফাস্ট!
জাওয়াদ এক প্রকার পাগলা ঘোড়ার মতোই দৌড়ে ছুটে গেল মামার কাছে। এই মানুষটা তার কত প্রিয় সে তা বলে প্রকাশ করতে পারবেনা। জাওয়াদের জীবনে যদি কখনো প্রিয়জনের লিস্ট করতে হয় সবার প্রথমে থাকবে ছোঠ মামা। মিজান সাহেব ও কম না, এই ভাগ্নে কে অন্য সবার চেয়ে বেশি স্নেহ করেন।
মিজান সাহেব জাওয়াদের কেবিনে বসে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন, জাওয়াদ দৌড়ে এসে হাঁপাতে লাগলো। মিজান সাহেব বললেন, ৫মিনিট ৩৩ সেকেন্ড লাগলো তোর আসতে।
জাওয়াদ তাকে জড়িয়ে ধরে বললো, মামু কত্তদিন পরে এলে?
মিজান সাহেব ভাগ্নের পিঠ চাপড়ে বললেন, বেশি না মাত্র ৫ বছর ৩মাস ১০দিন ১৩ ঘন্টা ৪৬মিনিট ৩৪ সেকেন্ড পর এসেছি।
জাওয়াদ মামার কথা শুনে হাসতে লাগলো। নাহ এই মানুষটা একটুও বদলায় নি।
জাওয়াদ ইন্টারকমে কল করে লাঞ্চ পাঠাতে বললো। তারপর হাসিমুখে বললো, কানাডা থেকে আজকেই এলে?
হুম। ঢাকায় ল্যান্ড করেই তোকে দেখতে চলে এসেছি। এখনো আপাকেও বলিনি আসবো।
ভালো করেছ। সবাই অনেক সারপ্রাইজ হবে।
তারপর কি অবস্থা তোর?
এইতো ভালোই।
ভালো তো দেখছি না, জোবায়ের খন্দকারের কার্বন কপি বনে গেছিস। সারাক্ষণ অফিসেই থাকিস! সপ্তাহে ১দিন ছুটি নেস তো নাকি উনার মতো শুক্রবারেও দুপুর থেকে অফিস করিস?
জাওয়াদ হেসে বললো,এখন রুলস বদলেছে। সপ্তাহে একদিন বন্ধ থাকে।
ওহ আচ্ছা!
সানজেনা, মাহিম কেমন আছে? ওদেরকে আনলেনা?
নাহ, এবার সলো ট্রিপে এসেছি। তাছাড়া ওদের কারোই বাংলাদেশে আসার ইচ্ছে ও নেই। রুবিনা ওদেরকে বাংলাদেশ সম্পর্কে কি বলেছে কে জানে ওরা ভুলেও আসতে চায় না।
জাওয়াদ প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, ভালোই হয়েছে তুমি একা এসেছ। আমি তোমার সঙ্গে সিলেট যাবো। অনেকদিন বেড়াতে যাই না। এবার কিন্তু পুরো সিলেট ঘুরবো। রেডি থাকো।
এখন না। আমি আগে কিছু দিন কুষ্টিয়ায় থাকবো।
কুষ্টিয়ায়?
হুম।
মামু কিছু হয়েছে?
মিজান সাহেব উদাস কন্ঠে বললেন, আমার বিদেশি কালচার কোনোকালেই ভালো লাগেনি। অথচ আমাকে পরবাসী হয়ে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। সানজেনা আর মাহিম তো ওখানেই জন্মালো। বলতে গেলে ওরা আর কখনোই এখানে আসবেনা। ওখানেই সব সেটেলড হবে। এখানে এসেও হতাশ লাগছে। আধুনিকতার ছোঁয়া চারদিকে লেগে গেছে। ঢাকা শহর আগের মতো নেই। আমি এমন একটা জায়গায় যেতে চাই যেখানে এখনো মাটির তাজা খুশবু পাওয়া যায়, গরু ছাগলের আবাদি আছে, গরুর গাড়ি চলে। যান্ত্রিক কোলাহল নেই। কিছু দিন আমি গ্রামবাংলার অকৃত্রিম সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাই। আমার কি মনে হয় জানিস আমার ফুসফুস ভর্তি যন্ত্রপাতির গ্যাস। আমার অক্সিজেন লাগবে। আর সেটা একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলে পাওয়া যাবে।
জাওয়াদ চুপচাপ মামার দিকে তাকিয়ে রইলো। মিজান সাহেবের চোখেমুখে কেমন হতাশার ছাপ। অথচ এদেশের বেশিরভাগ মানুষ বলতে গেলে ড্রিম কান্ট্রি বলতে ইউরোপ কান্ট্রি বোঝে। সেখানে সিটিজেনশিপ প্রাপ্ত মানুষ টা কি নিদারুন মন খারাপ নিয়ে পরিবারকে রেখে একাই ফিরে এসেছেন ক’টা দিন মনভরে শ্বাস নিতে!
চলবে….