#কাঁটাকম্পাস #পর্ব১০
#আরশিয়া_জান্নাত
জোবায়ের সাহেব ব্যবসায়িক কাজে কিছু দিনের জন্য নারায়ণগঞ্জ গেছেন। তাই আরওয়ার বিষয়টা বাড়ির সদস্যদের মধ্যে এক প্রকার চাপা রয়ে যায়। জাওয়াদের বাবা-মা এবং দাদী বিষয়টা বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করলেও অন্যদের কাছে ধোঁয়াশা রয়ে যায়। রোকেয়া শাশুড়ির সাথে এই বিষয়ে কথা বলতে গিয়েও বলেন নি। কে জানে কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায়। জহির রায়হান বেশ মন দিয়ে পেপার পড়ার ভান ধরে স্ত্রীর অস্থিরতা লক্ষ্য করছেন। রোকেয়া কিছুক্ষণ পায়চারি করে বললো, শুনছো? ফারাজের সঙ্গে তোমার একবার কথা বলা কি উচিত না? একটা সম্পর্কে যখন জড়িয়ে গেছেই এটা মেনে নিয়ে অগ্রসর হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কেন সে অযথা জটিলতা সৃষ্টি করছে?
জহির সাহেব পেপার ভাঁজ করে টি-টেবিলে রাখলেন। স্ত্রীর দিকে চেয়ে বললেন, রোকেয়া ওর জীবনে সবচেয়ে কাছের মানুষ ওর ছোট মামা। তার বৈবাহিক জীবনের জটিলতা ও কতখানি বুঝেছে বা দেখেছে আমরা জানি না।তবে এইটুকু বোঝা যায় ওর মনে খুব নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তার পর যত বুঝদার হলো পারিপার্শ্বিক নানান টানপোড়েনে ওর মাথায় সেট হয়ে গেছে বিয়ে মানেই কঠিন কিছু। স্ত্রী নামক মানুষ টাকে ও ভয় পায়। এ কথা তো সে নিজে বহুবার বলেছেও।
আমি কি তখন ভেবেছি এটা এতো সিরিয়াস কিছু? মানুষের জীবনে কত কি হয়, কত ভয় ভীতি থাকে। সব কি সারাজীবন থাকে? তাছাড়া বাবার মুখের উপর কথা বলবে এমন দুঃসাহস এই বাড়ির কারো আছে?
হুম সেটাই আসল কথা।
আমি বলি কি তুমি ওকে একটু বুঝাও। বৌমার মনের উপর কি বয়ে যাচ্ছে আল্লাহ ছাড়া কেউ বুঝবেনা।
জহির সাহেব দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন, ঠিক বলেছ ওর সঙ্গে আমরা অন্যায় করেছি। আমাদের সচেতন হওয়া উচিত ছিল। আমি দেখি কথা বলে।
পাপিয়ার বান্ধবী হিয়া রাস্তার পাশে ভেলপুরি খেতে খেতে বলল, আমার কি মনে হয় জানোস সামিয়া রিজভী রে জাস্ট ইউজ করতেছে। ভালোটালো বাসতেছে না।
পাপিয়া বলল, ঐসব তুই আমি বলে লাভ আছে? রিজভী তো সামিয়া বলতে অজ্ঞান। ওয় কেমন মদন চিন্তা কর,এখনো তো নিজে কামাই করা শুরু করে নাই। অথচ হাজার হাজার টাকা খরচ করে গফ পালতেছে।
সামিয়াও একখান চিজ মাইরি। কেমন নাকে দড়ি ঝুলিয়ে ছেলেটাকে ঘোরাচ্ছে! আমরাই কিছু করতে পারলাম না। এমন একটা বফ জুটাইতে পারলে তো হইছিলো সেমিস্টার ফি জোগাড় করতে টিউশন করা লাগতো না!
তা যা বলছোস! আচ্ছা চল ক্লাসে যাই এখন আবার অন্যের সংসারের কাহিনী শোনা লাগবে।
হেহেহে নিজের সংসার নাই তো কি হইছে পরের সংসারের ইংলিশ ভার্সন পড়তে পড়তে জীবন শেষ করতেছি।
ভেলপুরির বিল দিয়ে ক্লাসে গিয়ে বসতেই রিজভী বললো, পাপিতা কই ছিলি রে তুই? তোরে আমি কত জায়গায় খুঁজছি।
যেখানেই ছিলাম তোর কাজ কি?
আরেহ আমি তোকে খালি কাজেই খুঁজি নাকি? তোর প্রতি আমার কনসার্ন আছে না? বাচ্চা মেয়ে পরে হারাই টারাই যাস যদি, তাই চোখে চোখে রাখি আর কি।
ওয়ে কত্ত ভালা পোলা! বেবি সিটার খুললেই পারোস বাচ্চাদের কেয়ার টেকার হবি।
তুই না ভালো বুঝোস না। এজন্য ই বলে মেয়েমানুষের ভালো করতে নাই।
তোর ভালোর দৌড় কতখানি জানা আছে। এখন হুদাই প্যাঁচাল পাড়িস না।
তুই সেদিনের জন্য এখনো রেগে আছস?
পকেট ফাঁকা কইরা জিগাইতে আসোস রাগ করে আছি কি না!
ছিঃ পাপিতা তোর এতো সংকীর্ণ মন। সামান্য ক’টা টাকার জন্য বন্ধুত্ব নিলামে তুললি। তোর থেকে এটা আশা করিনি। আমার খালাম্মা ঠিকই বলে বড়লোকের আত্মা থাকে না।
পাপিয়া ভেংচি কেটে বললো, সব আত্মা তোর কাছে থাকে। তাই তো?
তুই কি ইনডিরেক্টলি আমারে গরিব বুঝাইলি?
সামাঝদারো কে লিয়ে ইশারাহি কাফি হোতা হ্যায়..
তোর মতো হবার চেয়ে আত্মাওয়ালা গরিব হওয়া শ্রেয়। তোর জায়গায় আমি হলে ঐ টাকা গনায় ও রাখতাম না। ফকিরকে দান করছি ভেবে তুষ্ট হয়ে যেতাম।
শোন তোরে দেওয়ার চেয়ে ফকিরকে দেওয়া হাজারগুণ ভালো। সে অন্তত খেয়ে পড়ে দোয়া করবে। তুই তো অকৃতজ্ঞ।
রিজভী মিথ্যে রাগের ভান ধরে নিজের পকেটে হাত দিলো।ওয়ালেট বের করে বললো, এই মানিব্যাগে যতো টাকা আছে সব দিয়ে হলেও আমি তোর ঋণ শোধ করবো।
হিয়া ছোঁ মেরে ওর মানিব্যাগ নিয়ে চেক করে বললো, ওরে বাবা সামিয়া মেডামের ছবি রাখা!
এটা তো সামান্য। আমার বুকের পুরো ক্যানভাসেই তো ওর ছবি আঁকা।
শেক্সপিয়ারের উত্তরসূরী।
উত্তরসূরী আর হতে পারলাম কই।সে জনাব তো ১৮ বছরে বিয়ে করে সন্তানের বাপ হইছে আর আমি ২৪ বছরেও খোকা!
বাবু লাল চশমা কিনে দিবো?
হুপ বাবু ডাকবি না।
ঢং!
পাপিয়া বললো, আরে বুঝোস নাই বাবু কে ডাকে? তুই ডাকলে মাইন্ড খাইবো না?
রিজভী বললো, এইজন্যে তোরে এতো ভালোবাসি। কত বুঝদার তুই।
ছে!
।
আরওয়ার জ্বরের প্রকোপে প্রলাপ বকতে শুরু করেছে। ওর শব্দ শুনে জাওয়াদের ঘুম ভেঙ্গে গেল। কোনোমতে চোখ কচলে বেডসাইডের ল্যাম্প অন করতেই দেখে আরওয়া ঘুমের মধ্যেই বকবক করছে।
আরওয়া কি হয়েছে? বেশি খারাপ লাগছে?
আরওয়া মাথা নেড়ে বলল, আম্মু কোথায়। আম্মুকে ডাকো। আমার ভালো লাগছেনা আমি আম্মুর কাছে যাবো..
জাওয়াদ ওর কপালে হাত দিয়ে দেখলো ভালোই জ্বর এসেছে।
ঘড়ির কাঁটা ২টার ঘরে, জাওয়াদ খুব যত্ন করে পানিতে কাপড় ভিজিয়ে আরওয়ার কপালে জলপট্টি দিচ্ছে। ঘুমে তার চোখ জ্বালা করলেও চুপচাপ বসে আছে। হঠাৎ আরওয়া ওর হাত ধরে বললো, মায়া বাড়াচ্ছেন কেন? এটা না করলেও চলবে।
চুপ করে ঘুমানোর চেষ্টা করো।
আমি আপনার মতো চুপচাপ থাকতে পারি না।
ছাড়ুন আপনাকে আর করতে হবে না আমি নিজেই করবো।
আরওয়া সবসময় ত্যাড়ামি করতে হবে? অসুস্থ তুমি..
আমি ত্যাড়ামি করি না আপনি আমাকে ত্যাড়ামি করতে বাধ্য করেন। নয়তো আমি গুড গার্ল।
তাই নাকি?
হু। আব্বু বলে আমি এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়ে।
আর কি বলে?
অনেককিছুই বলে।
ওহ। কিছু খাবে?
হু পানি খাবো।
জাওয়াদ পানি এগিয়ে বললো, তুমি খুব রাগী তাই না? এরকম হাত কাঁটার রেকর্ড আর আছে?
পানি খেয়ে আরওয়া বললো, উহুম হাত কাঁটার দরকার ই পড়েনি।
এবার দরকার পড়েছিলো?
নাহ
তবে?
মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল।
আচ্ছা।
শুনুন?
হুম বলো
আপনার গফ কি খুব সুন্দরী?
হলে কি হবে?
আমার চেয়ে বেশি সুন্দর?
কি জানি?
তাও ঠিক আপনার জানার কথা না। আপনি তো তো আমাকে ঠিকঠাক দেখেন ই নি। তুলনা করবেন কিভাবে।
তুমি কি চাইছো তুলনা করি?
জানি না। বাদ দিন বলতে হবেনা।
আচ্ছা!
সুস্থ হবার পর আরওয়া চলে যাওয়ার কথা তুলবে এমনটাই ধারণা ছিল জাওয়াদের। কিন্তু আরওয়া তার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে মনের সুখে আগের মতোই থাকতে শুরু করলো। মেয়েটার মনে কি চলছে কে জানে!
আরওয়া গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে ভার্সিটির জন্য তৈরি হচ্ছে। জাওয়াদ আড়চোখে তার কার্যকলাপ দেখছে।
হঠাৎ আরওয়া ওর সামনে এসে বললো,দেখার হলে সরাসরি দেখুন এমন চোরের মতো আড়চোখে দেখছেন কেন?
কথাটা শুনে জাওয়াদ হকচকিয়ে বলল, চোররা আড়চোখে দেখে তোমাকে কে বলেছে?
বলতে হবে কেন এমনিতেই জানি।
ভুল কথা। গোয়েন্দা বা পুলিশরাও আড়চোখে দেখে।
সে যাই হোক আমাকে দেখার জন্য গোয়েন্দা পুলিশ বা চোর হতে হচ্ছে কেন? আমি জানি আমি সুন্দরী তাই বলে এমন করবেন!
তুমি সুন্দরী এটা কে বলেছে?
যেই বলেছে তাতে আপনার কি?
তাকে বলে দিও সে যেন চোখের ডাক্তার দেখায়।
কেন আমার রূপের আগুনে তার চোখের পাওয়ার কমে গেছে মনে হচ্ছে?
মাই গড এতো কনফিডেন্স!
ইয়েস।
ভালো।
আরওয়া হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে বললো, শুনুন আজকে আপনাকে নিতে আসতে হবে না। আমার ফ্রেন্ড আমাকে ড্রপ করে দিয়ে যাবে।
আচ্ছা।
দেখুন তো সব পারফেক্ট আছে কি না?
জাওয়াদ ওর দিকে তাকিয়ে বললো, ক্লাস করবে নাকি বিয়েতে যাবে? হঠাৎ এতো সাজগোজ?
আজকে ক্লাস বাঙ্ক করে বেড়াতে যাবো।
ওহ।
আপনি কখনো ক্লাস বাদ দিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলেন?
নাহ।
আপনার থেকে এটাই আশা করেছি। যাই হোক তাড়াতাড়ি চলুন লেট হচ্ছে আমার।
জাওয়াদ গাড়ির চাবি নিয়ে বের হলো। গাড়িতে আরওয়ার অস্থিরতা ছিল দেখার মতো। একটু পরপর কল আসছে, ও বারবার আয়না দেখছে। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে ও বুঝি কোনো ছেলের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে। জাওয়াদ নিজের স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে জিজ্ঞাসাও করতে পারছে না ঘটনা কি। আবার চুপচাপ হজমও করতে পারছেনা। সে নিরবে ড্রাইভ করে যাচ্ছে। হঠাৎ আরওয়া বললো, এখানে এখানে গাড়ি থামান।
জাওয়াদ গাড়ি থামিয়ে আশেপাশে তাকালো। কই কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না। আরওয়া গাড়ি থেকে নেমে বললো, আপনি চলে যান। এখান থেকে আমি একা যেতে পারবো।
ওরা কোথায় আছে বলো আমি ড্রপ করে দিচ্ছি সমস্যা নেই তো।
না ঠিকাছে। আপনি চলে যান। আল্লাহ হাফেজ।
বলেই আরওয়া রাস্তা পার করে চলে গেল। জাওয়াদ পেছন থেকে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো।
।
নাহিয়ান চুপচাপ ডক্টর তারিনের চেম্বারে বসে আছে। তারিন রিপোর্টগুলো চেক করে বললো, ওর ট্রিটমেন্ট শুরু করে দেওয়া উচিত। আর লেট করা ঠিক হবেনা।
অপারেশন করলেও তো এটা সম্পূর্ণ সলভ হবে না তাই না?
এটা অনেকটা ডায়বেটিস আর থাইরয়েড এর মতো। লাইফস্টাইল মেইনটেইন করলে কন্ট্রোলে থাকবে তবে সম্পূর্ণ ঠিক হবে সেই ভরসা দিতে পারছি না।
ওর বিএমআই তো পারফেক্ট আছে। না ওভার ওয়েট না থিন তারপরো এই জটিলতা কেন!
তারিন সান্ত্বনা দিয়ে বললো, এতো হতাশ হবার কিছু নেই। অসুখবিসুখ অনেক সময় বংশগতভাবে ও হয়। এটায় কারো হাত নেই।
ঠিক বলেছিস। আচ্ছা আমি ওকে নিয়ে আসবো। ওর অপারেশনের ব্যবস্থা কর।
নাহিয়ান বের হয়ে নিজের চেম্বারে ঢুকে সাবার ছবির দিকে তাকালো। এতো মায়াবী ওর মুখটা। যতোই দেখে ততোই মায়া লাগে। আল্লাহ যেন সব মায়া ওর মুখে ঢেলে দিয়েছেন। নাহিয়ান চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। তাদের বিয়ের প্রায় ৪ বছর হয়ে গেছে। কিন্তু সন্তান হয় নি। সমস্যা কার এটা খোলাসা করে ও সাবাকে বলেনা। ও চায়না সাবা কষ্ট পাক তাই সবসময় চেষ্টা করে সাবাকে হাসিখুশি রাখতে, অন্যসবে ভুলিয়ে রাখতে। কিন্তু মেয়েটা আজকাল বাচ্চা নেওয়ার বায়না করে। কোনোভাবে ই ভোলানো যায় না।
নাহিয়ান মনে মনে ঠিক করতে থাকে কিভাবে সাবাকে কনভিন্স করা যায়।
চলবে,,
#কাঁটাকম্পাস_পর্ব১১
#আরশিয়া_জান্নাত
বাবা আসবো?
এসো বৌমা এসো।
কি করছিলেন?
তেমন কিছু না। কিছু বলবে?
ভাবলাম আপনার সঙ্গে চা খেতে খেতে একটু গল্প করি।
ওহ এই ব্যাপার। আমার তো ভালো ই হয়।
আরওয়া টি-পট থেকে কাপে চা ঢেলে জহির সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলো। জহির সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন, বাহ দারুন! তা পড়াশোনা কেমন চলছে তোমার? সব ঠিকঠাক তো?
জ্বি ভালোই চলছে।
বৌমা তুমি সেদিন আমায় বলো নি কেন তুমি বোটানিতে পড়ছো? আমি কি না মায়ের কাছে মামা বাড়ির গল্প করছিলাম!
আপনার গাছ নিয়ে যে চিন্তাভাবনা আছে তা তো বইয়ে পাবোনা। ছোটবেলায় আব্বু বলতো কখনো বলবেনা জানো বা পারো। এতে অপরপাশের মানুষ তোমাকে আর বলতে চাইবেনা। শিখতে চাইলে বেশি বেশি শুনতে হবে, বলার সুযোগ দিতে হবে। আমি সেটা মেইনটেইন করার চেষ্টা করি সবসময়।
খুব ভালো বলেছে তোমার আব্বু। যে বলে সে সব জানে বা পারে তাকে আর কেউ শেখাতে চায় না। ভাবে সে তো পারেই ওকে আর কিছু শেখানো লাগবে না।
হ্যাঁ একদম।
জাওয়াদ অফিস থেকে ফিরেই গেইটের সিসিটিভি ফুটেজ চেক করলো।আরওয়াকে কে ড্রপ করে দিয়ে গেছে তা জানার কৌতুহল দমিয়ে রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না। আরওয়াকে সরাসরি জিজ্ঞাসা করবে সেরকম সহজ সম্পর্ক ও তাদের নেই। তাছাড়া ও কি না কি ভাবে। তাই বহুভেবে এটাই সহজ লেগেছে তার। কিন্তু সিসিটিভি তে দেখা গেল আরওয়া একাই গেইটের ভেতর প্রবেশ করেছে ওর আশেপাশে কোনো গাড়ি দেখার স্কোপ মিলল না।
জাওয়াদ বিরক্ত হয়ে ওর পিএ সাম্যকে কল করে বলল, সাম্য আমাদের গেইটের সামনে এমনভাবে সিসিক্যামেরা সেট করো যেন বাড়ির বাইরের রাস্তার দুই দিকের ১কিলোমিটার দূর অবধি সব দেখা যায়।
ওকে স্যার।
জাওয়াদ ফোন রেখে ল্যাপটপ খোলা রেখেই ফ্রেশ হতে চলে গেল। আরওয়া তখন মাত্র ই ওর জন্য জুস নিয়ে রুমে এসেছিল। ল্যাপটপে নিজের ফুটেজ দেখে ওর ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি মার্কা হাসি ফুটে উঠলো।
টেবিলের উপর থাকা মোবাইলে টেক্সট এলো, স্যার ক্যামেরা সেট করতে লোক পাঠিয়েছি। দ্রুত হয়ে যাবে।
আরওয়া ভ্রু কুঁচকে বললো, আবার কোথায় ক্যামেরা লাগাচ্ছে এই লোক টা!
দরজার আওয়াজ পেতেই ও দ্রুত টেবিলের সামনে থেকে সরে গেল। ভাব নিলো সবেই রুমে এসেছে।
আপনার জন্য ঠান্ডা ঠান্ডা অরেঞ্জ জুস ।
থ্যাঙ্কস। তা কেমন ঘুরে বেড়ালে আজকে?
দারুন বেড়িয়েছি, অনেক মজা হয়েছে।
ওহ। কোথায় গিয়েছিলে?
কেন বলবো?
বললে সমস্যা হলে বলো না।
সমস্যা কেন হবে? বলার কারণ জানলে বলবো কোথায় গিয়েছিলাম।
এমনিই জিজ্ঞাসা করা যাবে না নাকি? এখানে ও মারপ্যাঁচ লাগবে?
অবশ্যই যাবে। যদি সম্পর্কের হিসাব করি তাহলে আমার নিঃশ্বাসের হিসাব ও চাইলে আপনাকে দিবো। আমি আমার হাজবেন্ডের কাছে কিচ্ছু লুকাবো না, নট এ সিঙ্গেল পিস অফ মাই মাইন্ড।
বাব্বাহ!
বাব্বাহ বলার কি আছে। আমরা দুই আত্মা এক প্রাণ হতাম। সে কিছু লুকোবে না আমিও লুকাবো না।লোকের অনুকরণীয় আদর্শ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতাম!
আচ্ছা!
তো বলুন কি হিসেবে জানতে চাইছেন?
কোনোকিছু হিসেবে না। এমনি সৌজন্যমূলক।
ওকে।
আরওয়া ফুলদানি তে রাখা লাল গোলাপগুলো নেড়েচেড়ে বললো, ভিনেগার মেশানো পানি ফুলদানি তে রাখলে ফুলগুলো কিছুদিন তাজা থাকবে তাই না?
হতে পারে জানি না।
আমি তো পারলে এগুলো কে সারাজীবনের জন্য তাজা রেখে দিতাম। এই ফুলগুলো খুব স্পেশাল। আরেহ আইডিয়া আসছে। মমি করে রেখে দেওয়া যাবে তো! এতোক্ষণ বুদ্ধি টা আসেনি কেন।
বলেই আরওয়া মমি তৈরির সরঞ্জাম আনতে গেল। জাওয়াদ ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো, লাল গোলাপ তো রোজ কিনতে পাওয়া যায়। এটা মমি করে রাখার মতো দূর্লভ বস্তু তো নয়। হয়তো যে দিয়েছে সে সাধারণ নয় বলেই,,,
আরওয়া এসে বললো, এই এই আপনি ধরবেন না প্লিজ।
কেন আমি ধরলে কি এটা পচে যাবে?
না পুড়ে যাবে।
মানে!
বাংলা বুঝেন না?
নাহ বুঝি না। সহজ ভাষায় বলো কি বুঝাতে চাইছো। আমি ধরলে পুড়বে কেন আমি আগুন?
আমি কিছু বলে মার খাবো নাকি?
আরওয়া আমি তোমাকে মেরেছি! এসব কি অপবাদ দিচ্ছো?
মারেন নি, তবে হাবভাব তো এমন সুযোগ পেলে মেরে হাড়গোড় এক করে দিবেন বোঝাই যায়।
জাওয়াদ ওর কথায় বিমূঢ় হয়ে গেল। এই মেয়ে তো খুব জাঁদরেল। মিথ্যে নারীনির্যাতন কেইসে ফাঁসাতে ২বার ভাববে না।
জ্বি একদম ঠিক ভেবেছেন। আমি নারীনির্যাতন কেইস ভালোই সাজাতে পারবো।
।
অসময়ে নাহিয়ান কে দেখে সাবা চিন্তিত গলায় বললো, এই শরীর ঠিক আছে তোমার? হঠাৎ অসময়ে এলে যে?
নাহিয়ান শান্ত হয়ে সাবাকে জড়িয়ে ধরে রাখলো।
নাহিয়ান কি হয়েছে? তুমি ঠিক আছ? হসপিটালে কোনো সমস্যা হয়েছে? এই টেনশন হচ্ছে আমার কিছু তো বলো।
“For God sake hold your tongue
And let me love”
(John Donne)
সাবা চুপচাপ ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। বেশ কিছুক্ষণ পর নাহিয়ান সোজা হয়ে ওর মুখ আজলায় ভরে বললো, এই পৃথিবীতে বাবা-মায়ের পর যদি কেউ আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয় তবে সেটা তুমি। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি, এটা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করবা। আমার কাছে তোমার চেয়ে অন্য কোনোকিছু মূল্যবান নয়।
আমি জানি তো আমার বরের কাছে আমি যা কত দামী। আজ হঠাৎ এই কথা উঠছে কেন? কি হয়েছে?
শোনো সাবা আমি যে প্রফেশনে আছি রোজ অনেক ঘটনা ফেইস করা লাগে। আমাদের কাছে সুখী বা সুস্থ কেউ আসেনা। আল্লাহ কত রকম অসুখ দিয়েছেন আবার চিকিৎসা ও দিয়েছেন। তাই না?
হ্যাঁ।
অসুস্থতা কারো দূর্বলতা নয়। মাথা থাকলে ব্যথা হবেই।
হুম, তো এখন কি হয়েছে বলো না।
আমি কি তোমার বিষয়ে নিজের ইচ্ছামতো সিদ্ধান্ত নিতে পারি? সেই অধিকার কি আছে আমার?
সাবা হেসে বললো, কিসব যে বলো তুমি। আমার সবকিছু তে তোমার অধিকার আছে। এটা বলা লাগে?
আচ্ছা। তবে ভরসা রাখো আমার উপর।
বলেই নাহিয়ান ওকে সঙ্গে করে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো।
নাহিয়ানের মা কোহিনুর দোতলার বারান্দা থেকে ছেলে আর ছেলের বউকে যেতে দেখছেন, তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তিনি ঝাঁপসা চোখে দু’হাত তুলে বললেন, আল্লাহ তুমি ওদের সাহায্য করো। আমার বৌমাকে সহীহ সালামতে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করো।
সালমা তার কাঁধে হাত রেখে বললো, চিন্তা করো না বড় বৌ সব ঠিক হবে।
।
আরওয়ার মিডটার্ম চলে এসেছে। তাই সে রোজ ঘন্টাখানেক পড়াশোনা করছে। জাওয়াদ কাজ শেষ করে সামনে তাকিয়ে দেখে আরওয়া পড়ার টেবিলে ই বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।
আরওয়া? উঠে বিছানায় ঘুমাও এরকম চেয়ারে বসে ঘুমাচ্ছ কেন? আরওয়া..
উহুম ঘুমাচ্ছি না বইয়ের থেকে পড়া নিচ্ছি।
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে?
হ্যাঁ। বইয়ের উপর মাথা রেখে ঘুমালে বইয়ের সব পড়া অভিস্রবণ পদ্ধতিতে মাথায় ঢুকে যাবে।
সিরিয়াসলি!
ছোটো বেলায় শাকা লাকা বুম বুম দেখেননি? ঐখানে একটা পর্ব এমন ছিল, ছেলেটা বইয়ে কান পাতলেই পুরো বই রিড করে ফেলে। আমি ও সেই পদ্ধতি এপ্লাই করছি।
কাজ দেয়?
দিবে না কেন? অবশ্যই দেয়।
আরওয়া তুমি কি সিরিয়াস! নাকি মজা করছো?
আমি রাতবিরেতে আপনার সঙ্গে মজা করবো কেন। আপনি জানেন না আমাদের বিশ্বাস কতোটা ডেঞ্জারাস হয়? আপনি যা বিশ্বাস করবেন তাই ঘটবে। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও এই ফর্মুলা ইউজ করা হয়।
পজিটিভ থিংকিং এর পাওয়ার আছে জানি তাই বলে বইয়ে মাথা রেখে ঘুমালে পড়া মুখস্থ হয় এ তো পুরোই বাচ্চা টাইপ থিংকিং।
আপনাকে বিশ্বাস করতে বললো কে?
এই মেয়ে তোমার রেজাল্ট কেমন আসে? এইচএসসি তে সিজিপিএ কত ছিল?
আপনি আমার বায়োডাটা দেখেন নি? না দেখলেও সমস্যা নেই আপনার ডেস্কে আছে হয় তো। দেখে নিন।
জাওয়াদ ফাইলপত্র ঘেঁটে সত্যিই ওর বায়োডাটা বের করলো।
এই থিংকিং নিয়ে এতো ভালো রেজাল্ট করেছ কিভাবে? নাকি মেধাবী বলে অন্যকে বোকা বানাতে এমন মনগড়া গল্প বলো?
আরওয়া দু হাত মেলে আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলে বললো, কে বলে আপনি কম কথা বলেন? কত কোশ্চেন করেন আপনি উহ!
জাওয়াদ মুখ ভার করে বেলকনিতে চলে গেল। আরওয়া গালে হাত দিয়ে ওর দিকে চেয়ে বললো, ওয়েএএ আমার জামাইটা কত্ত কিউট। রাগ করলে ইচ্ছা করে গালটা টেনে দেই। হুহ!
এই শুনুন।
কি?
একটু শুনে যান জরুরি কথা আছে।
বলো শুনছি
আরেহ শুনুন না, না শুনলে চরম মিস।
জাওয়াদ ওর কাছে এসে বললো, হু বলো।
কানে কানে বলবো। কান পাতুন। এদিকে আসুন
শুনতে হবে না ধন্যবাদ।
হঘাড় ত্যাড়া একটা।
জাওয়াদ শুনেও না শোনার ভান ধরে বেলকনির দিকে অগ্রসর হলো। আরওয়া উঠে ওর টিশার্ট খামচে ধরে বললো, আমার কথা না শুনে চলে যাওয়া আপনার সবচেয়ে খারাপ অভ্যাস।
জাওয়াদ ওর হাত ছাড়িয়ে বললো, আর তোমার পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাঁধানো খারাপ অভ্যাস!
বেশ তো খারাপে খারাপে কাটাকাটি।
মানে?
আপনি আসলেই বুঝেননা নাকি বুঝেও বুঝেন না! এই মোটা মাথা নিয়ে বিজনেস করেন কিভাবে?
Don’t judge a book by it’s cover
Then let me read the book. I’ll judge after reading.
নিজের পাঠ্যবইয়ে আপাতত ফোকাস দাও।
আহারে জীবন! নিজের বাচ্চাদের পড়ানোর বয়সে নিজে পড়তেছি এটা কি কম নয়?
২১ বছর বয়সে নিজের বাচ্চা পড়ায় কেউ?
এটা আপনার কাছে কম মনে হচ্ছে? আমার গ্রামের এক বোন ১৩ বছরে পালিয়ে গেছিলো বফের সাথে। এখন ওর ২ টা ছেলে। বড়টার বয়স ৬ বছর ছোটটার ৪ বছর। ২০ বছরেই নিজের দুই বাচ্চাকে ও পড়ায়। আমার তো ২১ অনেক বেশিই।
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, তো আরো আগে বিয়ে করলে না কেন?
সবই কপাল, নয়তো এমন কাঁচা সবজি পাতে জুটে?
কি বললে তুমি আমি কাঁচা সবজি?
নাহ আপনি কাঁচা সবজি হবেন কেন? আপনি তো পুরা আইসক্রিম। দেখলেই লোভ লাগে।
তোমার মাথায় সমস্যা আছে, ঘুমাও তো।
আরওয়া হালকা শিষ বাজিয়ে বললো,ওয়েহোয়ে কোইই তো রোকলো,,,
জাওয়াদ আর কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পড়লো। এই মেয়ের ভাবভঙ্গি মোটেও সুবিধার না কেমন ইভটিজারদের মতো চাহনি! নাহ না ইভটিজার না ও তো রীতিমত এডামটিজার!
চলবে,,