#কাঁটাকম্পাস
#আরশিয়া_জান্নাত
“দেখুন আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি। এই বিয়েতে আমার মত ছিল না, বলতে গেলে অনেক টা বাধ্য হয়েই আমি আপনাকে বিয়ে করেছি। এই বিয়ে আমি মানি না। আপনি আমার কাছে সামাজিকভাবে স্ত্রীর মর্যাদা পেলেও ব্যক্তিগতভাবে সেটা পাবেন না….”
কথাগুলো বলেই শ্বাস ফেলল জাওয়াদ। তার কথা শুনে ঘোমটা তুলে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো আরওয়া। রূঢ় কন্ঠে বলে উঠলো, আপনি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন? এই যুগে এসে আদিম যুগের কিচ্ছা শোনাচ্ছেন? এখন জোর করে মেয়েদের ই বিয়ে হয়না আর আপনার মতো ধামড়া লোকের বিয়ে হয়ে গেল? এটা বললেই আমি বিশ্বাস করবো?
বিশ্বাস করা না করা আপনার বিষয়। আমি আমার কথা জানিয়ে রাখলাম ব্যস!
আপনার ঘোড়ার ডিমের মনগড়া কথা শুনতে আমার বয়েই গেছে!
আপনার এটা মানতে সমস্যা হলে বলে দিন ডিভোর্স দিয়ে দিবো। এই বিয়েটা এমনিতেও বেশিদিন টেকার কথা না
ওয়েট এ মিনিট! আপনার মাথায় কি সমস্যা আছে? আমার বাবা এতো টাকা খরচা করে অনুষ্ঠান করলো, আপনার বাড়ির শ’খানেক বরযাত্রী খাওয়ালো। আর আমি আপনার মতো আহাম্মকের কথা শুনে সেসব জলে ভাসিয়ে দিবো? তাছাড়া বিয়ের মাত্র কয়েকঘন্টায় ডিভোর্স দেওয়ার মুরোদ যার আছে সে কবুল বলতে অস্বীকার করার মুরোদ রাখেনি কেন?
আপনি হাইপার হয়ে গেছেন। আপনাকে দেখে যতোটা নম্রভদ্র মনে হয়েছিল আপনার ব্যবহার ততোটাই খারাপ!
হাহাহা আপনি বোধহয় বাংলা সিনেমা বেশি দেখতেন। তাই ভেবেছেন রাজ্জাকের মতো এসে বলবেন এই বিয়ে আমি মানি না আর আমি নম্রভদ্র শাবানার মতো চুপচাপ সেটা মেনে নিয়ে মনের দুঃখে গান গাইবো, আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই??
স্যরি?
ইউ শুড বি স্যরি!
আপনার সঙ্গে কথা বলাই ভুল আসলে!
এই দাঁড়ান কোথায় যাচ্ছেন?
যেখানেই যাচ্ছি আপনাকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই!
আলবাৎ বাধ্য। এই ঘর ছেড়ে এক পাও যদি এগোন আমি চিৎকার করে পুরো বাড়ির লোক একত্রিত করবো। আমার গলা সম্পর্কে আপনার আইডিয়া নেই, প্যারেড কমান্ডার হিসেবে ৩বার মেডেল জিতেছি।
জাওয়াদ দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ঘরভর্তি মেহমানদের সামনে মানসম্মান নষ্ট করার দুঃসাহস ওর নেই। তাছাড়া ওর দাদা সাহেব যদি জানতে পারে ওকে আস্ত রাখবেনা। তাই সে চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়লো।
আরওয়া চারদিকে চেয়ে বলল, আহারে স্টার জলসার মতো এ ঘরে সোফা নেই যে বেচারা ঘুমাবে! ইশ আগেই বুদ্ধি করে সেটা যোগাড় রাখতেন, কি যে করেন না আপনি।
জাওয়াদ অগ্নিদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। আরওয়া সেটা তোয়াক্কাই করলো না। বিছানা ছেড়ে উঠে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গয়না খুলতে খুলতে বলল, দাদীজান অযথাই কত কি শিখিয়ে দিলো। সে যদি জানতো তার নাতজামাই বাসরঘরে ঢুকে সালাম দেওয়ার বদলে বিয়ে মানিনা বলবে তবে হয়তো অন্য কিছু শিখিয়ে দিতো। আহা এতো টাকার মেকাপ ওয়েস্ট গেল…
জাওয়াদ মনে মনে ভাবতে লাগলো এই মেয়ে এতো হিসাবী? সবকিছু টাকা দিয়ে হিসাব করছে। এ কেমন মেয়েরে বাবা?!
এবার বলি তাদের পরিচয় টা। ফারাজ খন্দকার জাওয়াদ পেশায় একজন ব্যবসায়ী। ফ্যামিলি বিজনেসে তার মোটেও আগ্রহ না থাকলেও দাদার আদেশে জয়েন করেছে বছরখানেক আগে। ২ভাই আর একবোনের মধ্যে জাওয়াদ বড়, বড় ছেলেমেয়েরা স্বভাবতই বোকা হয়। তার উপর কড়াশাসন পেলে তো কথাই নেই! জাওয়াদের দাদা জোবায়ের খন্দকার বেশ রাগী ও বিচক্ষণ মানুষ। তার কথার বাইরে কথা বলবে এমন কেউ এই পরিবারে নেই। তিনি যদি বলেন সূর্য পশ্চিম দিকে উঠে, সবাইকে সেটাই মানতে হবে। উনার তিন ছেলে আর ২মেয়ের মধ্যে জাওয়াদের বাবা জহির রায়হান ঠিক তার উল্টো চরিত্রের। হাসিখুশি প্রাণবন্ত লোকটা কিভাবে এমন বদমেজাজি লোকের ছেলে হলো এ নিয়ে জাওয়াদের মতো অনেকের মনে প্রশ্ন।
তবে এমন একগুঁয়ে দাদার নাতি হবার সাইড ইফেক্ট হলো নিজের মতামত রাখা তো দূর মতামত ভাবাটাও ওদের কাছে দুঃসাহসিকতা। যে ছেলের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে দাদার মতের বাইরে কিছু ই ঘটেনি, তার বিয়েটা নিজের মর্জিতে হবে এ ভাবা বিলাসীতা বৈ কিছুই না।তবুও সে চেষ্টা করেছিল বিয়ের আগে একবার হলেও কথাটা পাত্রীর কানে তুলতে। কিন্তু নড়বড়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে সেটা আর হয়ে উঠেনি। বহুকষ্টে যা একটু প্রকাশ করলো আরওয়ার রিয়েকশন দেখে ভেতরটা ভীষণ তেতো হয়ে উঠলো বটে! নাহ এই জীবনে ও আর সুখী হবে না…
আয়েশা সিদ্দীকা আরওয়া বাবা মায়ের অতি আদরের সন্তান। সে বেশ চঞ্চল ও স্বাধীনচেতা মেয়ে। পড়াশোনা থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সে নিজের মর্জিমতোন চলেছে। জীবনটা তার কাছে একটা এক্সপেরিমেন্ট ব্যতীত কিছুই না। এই জীবনকে অযথা ওয়েস্ট করার মানেই হয় না। সে চায় জীবনটা উপভোগ করতে, এডভেঞ্চারিং ঘটনায় মুখোরিত রাখতে। তার দাদীজান করিমুন্নেসা নাতনির উচ্ছাসিত জোয়ারে লাগাম টানতেই বিয়ের ব্যবস্থা করেন। এতে অবশ্য তার দ্বিমত ছিল না। বিয়ে মানে আরেক এডভেঞ্চারিং ঘটনা। এর প্রতিটি পরতে পরতে আছে রোমহর্ষক ঘটনাবলি। তাই অনেক উৎসাহ নিয়েই সে বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে।
।
বিয়ের ভারি সাজ ঘষেমেজে তুলে লাগেজ থেকে কাপড় বের করে আরওয়া ওয়াশরুমে গেল ড্রেস চেঞ্জ করতে। বেরিয়ে দেখে জাওয়াদ সেই আগের মতোই হেড ডাউন করে চেয়ারে বসে আছে। আরওয়া তুড়ি বাজিয়ে বললো, ও হ্যালো সারারাত এভাবে বসে ঘুমানোর প্ল্যান করেছেন নাকি?
জাওয়াদ মাথা তুলে বললো, আপনার সমস্যা কি? আপনার কাজ আপনি করুন না, আমাকে অযথা বিরক্ত করছেন কেন?
ওমা আপনাকে বিরক্ত করবো না তো কাকে করবো? দশটা না পাঁচটা না একটামাত্র স্বামী!
দেখুন মিস আরওয়া আপনি অযথাই এসব করছেন, জোর করে কিছু হয় না। আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না। আমার মনে আপনার জন্য কোনো অনুভূতি নেই। আপনাকে আমি নিজের স্ত্রী ভাবতে পারছিনা..
কেন পারছেন না? আপনি কি পুরুষ নন নাকি মনে মনে নিজেকে শরীফা ভাবেন?
মানে কি! আমি কখন বললাম আমি পুরুষ নই?
না মানে বিয়ের রাতে এমন সুন্দরী বউকে যে উপেক্ষা করে সে হয় মহাপুরুষ নাহয় নাপুরুষ!
আই মিন হি…..
স্টপ ইট! আপনার মাইন্ড এতো চিপ মাই গড!
উফ কান গেল আমার, আরে মিয়া চিল্লাইয়া কি মার্কেট ফাওন যাইবো? খামোখা চিল্লাইয়েন না তো।
আপনি ঘুমাতে যান তো। আপনার সঙ্গে কথা বলে আমার মাথা ব্যথা করতেছে। অসহ্যকর!
আরওয়া হাই তুলে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, মাথা ব্যথা তো করবেই। যেসব আজেবাজে বুদ্ধি নিয়ে ঘুরেন ব্রেইন বেচারা হাইপার না হয়ে থাকবে কিভাবে?
জাওয়াদ ক্রুর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। যেন সে পারলে চোখ দিয়েই এই মেয়েকে ভষ্ম করে দিবে। আরওয়া চেয়ার টেনে বসে কৌতুহলী গলায় বললো, আচ্ছা একটা কথা বলুন আপনার লাভ এফেয়ার আছে? বিয়ে মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন কেন?
আমি আমার ব্যক্তিগত কথা শেয়ার করতে পছন্দ করি না।
আরেব্বাস! আপনি দেখি ভালোই বেকুব। বিয়ে মানে বোঝেন নাকি আন্দাজে কবুল বলেই খালাস? আমাকে যদি না বলেন আমি বুঝবো কিভাবে?
আপনি আমাকে সেই কখন থেকে যা তা বলছেন। আপনার কি মিনিমাম ভদ্রতা জানা নেই?
জানা তো অনেক কিছুই ছিল। আপনার বেলা সেসব প্রয়োগ করা ওয়েস্ট ছাড়া কিছুই না। এমনিতেই আমার অনেক অপচয় হয়ে গেছে, আর খরচ করতে সাহস পাচ্ছি না।
জাওয়াদ উঠে বললো, ওকে ফাইন। আপনার যা ইচ্ছে করুন হু কেয়ার্স।
আরওয়া বিছানায় সাজানো ফুলগুলোর দিকে চেয়ে আফসোস করে বললো, আহারে আমার বিয়ের ফুলগুলো…
।
পরদিন সকালে নাশতা খাওয়ার পর জোবায়ের সাহেব বাজার থেকে বিশাল বড় একটা রুই মাছ কিনে আনলেন। রেওয়াজ অনুযায়ী নতুন বৌকে এই মাছ কাটতে হবে। আরওয়া বড়বড় চোখ করে মাছটার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে তার দাদীশাশুড়ি সালমা বেগম বললেন, নাতবৌ মাছ দেইখা ডরাইছো? ভয় পাইও না তুমি খালি মাছোর মুড়োডা কুটবা, তোমার শাশুড়ি তোমারে সাহায্য করবো।
আরওয়া মনে মনে বলল, এই মাছ কুটতে গেলে বটি না ভাঙলেই হয়! এতো বড় মাছ আমি আলগাবো কেমনে….
ওর অবস্থা দেখে জাওয়াদের ঠোঁটের কোণে পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠলো। একদম ঠিক হয়েছে, এবার মাছ কুটতে না পেরে লজ্জায় পড়ুক ঝগড়ুটে টা। সবার সামনে ভালোই জব্দ হবে।
আরওয়া জাওয়াদের চেহারা দেখে রাগে গা টা জ্বলে গেল। এই ব্যাটা নিশ্চয়ই মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছে। কোনো ব্যাপার না মনু আমিও তোমারে দেখাবো আরওয়া কোন চিজ। মাছ কাটা কোনো ব্যাপার হলো!
শাড়ি সামলে মাছ কুটতে বসতেই সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়ালো। এদের মধ্যে কেউ কেউ ফোনে ভিডিও করতে শুরু করেছে।আরওয়া মনে মনে দোয়াদূরুদ পড়ে মাছটা দুই হাতে তুললো। দাদাশ্বশুড়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, বাজারে সবচেয়ে বড় মাছটাই আপনার আনতে হলো দাদাসাহেব?
তারপর সেটা ধীরে ধীরে কাটা শেষ করলো শাশুড়ির সাহায্যে। সবাই বেশ হৈ হুল্লোড় করে পরিবেশ টা উৎসবমুখর করে তুলেছে।আরওয়া বিজয়ের হাসি দিয়ে মাছ কুটে উঠলো। জাওয়াদ মুখ পাংশু করে সরে গেল।
চলবে….