#ধারাবাহিক গল্প
#কাঁচ কাটা হীরে
শেষ পর্ব
মাহবুবা বিথী
—–আমার শাশুড়ী মা বেঁচে থাকা অবস্থায় আমার সাথে ডিভোর্সের পর কোনোদিন উনি আহসানের সাথে কথা বলেননি। জেনিফারের সাথে আহসানের ঐ কাহিনী আমার শাশুড়ী মা মেনে নিতে পারেননি।তবে মৃত্যুর আগে আমায় বলেছিলেন, আমি যেন উনার মৃত্যুর খবর আহসানকে জানাই এবং ওকে যেন জানাজায় অংশ নিতে দেই। আর এটাও বলেছিলেন,উনি আহসানকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। আমিও শাশুড়ীর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। মামুনকে দিয়ে ওর বাবার কাছে শাশুড়ী মায়ের মৃত্যুর খবর জানিয়ে দেই। আহসান মায়ের সাথে কথা না বলতে পারার দায় আমার উপর চাপায়। বাস্তবে এই সিদ্ধান্ত শাশুড়ী মায়ের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত। এখানে আমার কোনো দায় নেই। জানাজাতে আহসান অংশ নিয়েছিলো। এরপর ও নিখোঁজ হয়ে যায়। আমি মাঝে মাঝে আমার বন্ধুবান্ধবদের কাছে ওর খবর জানতে চাইতাম। কেউই ওর কোনো খবর জানতো না। আমি ভাবতাম হয়তো সবার উপর অভিমান করে নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। আমি আসলে কোনো অনুভূতী থেকে ওর খোঁজ নিতাম না। এমনকি আমার সন্তানের বাবা হিসাবেও ওর প্রতি আমার কোনো ফিলিংস কাজ করতো না। জন্ম দিলেই তো আর বাবা মা হওয়া যায় না। বাবা মা হওয়ার জন্য যোগ্যতা থাকতে হয়। মামুনের জন্মের পর আহসান ওর প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করেনি। বরং ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করে বসলো। শুধু আমার শাশুড়ী মায়ের সন্তান হিসাবে আমি ওর খবর জানার চেষ্টা করতাম। শাশুড়ী মায়ের কথা মনে হলে ওর প্রতি একটা অদৃশ্য দায় অনুভব করতাম। মানুষটা যতদিন বেঁচে ছিলেন আমাকে বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন। আমি উনার জন্য তেমন কিছুই করতে পারিনি। অথচ উনি যতদিন বেঁচে ছিলেন আমাকে অকাতরে শুধু দিয়েই গেছেন। মামুনকে স্কুলে আনা নেওয়া উনিই করতেন। এমন নয় আমি উনাকে জোর করে করতে বলেছি। উনি হাসি মুখেই করতেন। আমার রান্নার লোক থাকা সত্বেও একটা তরকারী উনিই রান্না করতেন। মামুন কাজের খালার হাতে রান্না তরকারী খেতে পারতো না। বলার অপেক্ষা রাখে না উনার রান্নার হাত খুব ভালো ছিলো। এতো জায়গায় খেয়েছি কিন্তু উনার হাতের মতো রান্নার স্বাদ কোথাও পাইনি। আল্লাহপাক উনাকে যে রকম রান্নার হাত দিয়েছেন তেমনি ঈমানদারও বানিয়েছেন। কোনোদিন এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করতে দেখিনি।
কথায় আছে না রক্তকে কখনও আলাদা করা যায় না। এই সত্যটা আমি আবার নতুন করে উপলব্ধি করলাম। মামুন তখন ঢাকা মেডিকেলে ইন্টার্ণী করছে। সেদিন ওর নাইট ডিউটি ছিলো। রাত তখন বারোটা বাজে। রোড এক্সিডেন্টে মারাত্মক আহত এক মুমুর্ষ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। উনার রক্তের প্রয়োজন। রক্তের গ্রুপ “ও ” পজেটিভ। মামুনের রক্তের গ্রুপ “ও” পজেটিভ। মামুন পেশেন্টকে রক্ত দেওয়ার পর যখন পেশেন্টকে দেখতে ইমার্জেন্সিতে গেল তখন ওর অবাক হওয়ার পালা। যাকে ও রক্ত দিলো সে ওর জন্মদাতা। সুস্থ হওয়ার পর আহসান মামুনকে ঠিক চিনতে পেরেছিলো। মামুনকে জড়িয়ে ধরে নাকি অনেক কেঁদেছিলো। কিন্তু মামুনও আমার মতো। বাবার প্রতি ওর যে ভালোবাসার একটা মন ছিলো সেটা বহুআগেই অবহেলা অযন্তে মরে গিয়েছে। সুতরাং হাজার অশ্রুজলে ওতো আর ফিরে আসবে না। মামুনের অবস্থাটা হয়েছে সেরকম। মামুন ওকে কোনোদিন বাবা বলে ডাকতে পারেনি।
——আঙ্কেল এখন কোথায় আছেন?
——এরপর থেকে মামুনের তত্ত্বাবধানে একটা প্রবীন হাউসে আছে। মামুন ওর সমস্ত খরচ বহন করে। আমার ভালো লাগে মামুন যে নিজের মন থেকে এই দায়িত্বটা পালন করে যায়। জানো নীলা, প্রতিটি মানুষকে তার কর্মফল ভোগ করতে হয়। আহসানের জীবনটাতো এমন হওয়ার কথা ছিলো না। স্ত্রী পুত্র পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করার কথা। অথচ নিজে যেচে দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে। ও ছিলো একজন মেধাবী মানুষ। নিজের ভুলে এরকম ভবঘুরে জীবন কাটাতে হলো। কারো কাছে ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য হলো না।
এমন সময় ফজরের আযান শোনা যায়। আমাদের শাশুড়ী বৌমার গল্পের পরিসমাপ্তি টানতে হয়। তাই আমি নীলাকে বললাম,
—–আমার কারনে তোমার আজকের রাতের ঘুমটা নষ্ট হলো।
—–ঘুমের থেকে শিক্ষণীয় মুল্যবান তথ্য আমি জানতে পারলাম। ঘুম তো দিনে পুষিয়ে নেওয়া যাবে জীবনের এই কথাগুলো শোনা খুব দরকার। আমাকে এই কথাগুলো বলবার তোমার আজকে মুড ছিলো কিন্তু এর পরে হয়তো মুড নাও থাকতে পারে।
——চলো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। দু,জনে মিলে ফজরের সুমধুর আযান শুনি। তারপর পরমকরুনাময় আল্লাহপাকের কাছে মন খুলে প্রার্থনা করি। আযানের পর দোয়া কবুল হয়। তোমার বান্ধবীর থাকা খাওয়ার ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দাও।
আযান শেষ হওয়ার পর নীলা নামাজ পড়তে চলে গেল। আমি ভাবি মানুষ কতো নিপুনভাবে নিজের সাথে অভিনয় করে যায়। এই আমি তার বড় প্রমান। শুন্য দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে দেখি মেঘহীন নির্মল আকাশ। খুব সুন্দর। একটা শীতল বাতাসের স্পর্শ শরীরকে ছুঁয়ে দিচ্ছে। মানুষের জীবনটাও যখন মেঘহীন হয় তার অনুভূতীও হয় অপূর্ব। খুব ঝরঝরে হাসিআনন্দে পরিপূর্ণ একটা জীবন। যেখানে বিষাদের লেশমাত্র থাকে না। এরকম একটা জীবনই তো আমার চাওয়ার ছিলো। অথচ বিষাদের মেঘ আমার জীবনের আকাশে ছেয়ে রইলো।
এখন শরতকাল চলছে। কোথা থেকে শিউলীর ঘ্রাণ ভেসে আসছে। নীলা ভাবছে আমি হয়তো আহসানকে ভুলে থাকতে পেরেছি। কিন্তু বাস্তবে তো পারিনি। পারিনি বলেই রাফসানকে নিজের মনে জায়গা দিতে পারিনি। তবে আজ নিজের গুপ্ত কথার ভান্ডারটা নীলার কাছে খুলে দিতে পেরে খুব হালকা লাগছে। ও আসলে শুধু আমার বৌমা নয়। কখন যে নিজের অজান্তে আমার বন্ধু হয়ে গেছে আমি বুঝতেই পারিনি। কি অবলীলায় ওকে আমার নিজের একান্ত কথাগুলো আজ বলে ফেললাম। মামুন ব্রোকেন পরিবারের সন্তান। ব্রোকেন পরিবারের সন্তানগুলোর মাঝে একটা ইনসিকিওরটি থাকে। এই কারনে ওরা সবার সাথে সহজ হতে পারে না। অথচ নীলা আমার মামুনটাকে ঠিক মানিয়ে নিয়েছে। মেয়েটা সত্যি অনেক মায়াবী। মায়ার বাঁধনে ও আমাকে আর মামুনকে বেঁধে ফেলেছে। ওকে ভালো না বেসে পারা যায় না। নামাজের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে। ওয়াশরুমে গিয়ে অজু করে ফজরের নামাজটা পড়ে আবার বারান্দায় এসে বসলাম। নীলা দুকাপ চা নিয়ে এসে এক কাপ আমার হাতে দিয়ে বললো,
——মামনি, সকালের নাস্তা কি বানাবো?
——নাস্তা বানাতে হবে না। তুমি রেডী হয়ে নাও। ওতো তো সাতটায় প্লেন থেকে নামবে তাই না?
——হুম,
——-আমরা তার আগেই পৌঁছে যাবো। তারপর তোমার বান্ধবীকে নয়ে রেডিসনে যাবো। ওখানেই আমরা দু,জন তোমার বান্ধবীর সাথে ব্রেকফাস্ট করে নিবো। তোমার বান্ধবীর থাকার ব্যবস্থা ওখানেই করেছি। এরপর তুমি চাইলে ওর সাথে থাকতেই
পারো। তবে আমি চলে আসবো। মামুন তো এগারোটার দিকে আসবে। তোমাকে ওকে নিয়ে ভাবতে হবে না।
——মামনি, তুমি কখন এতোসব করলে?
——আমি তে মা তাইনা? আমাকে অনেক দিক ভাবতে হয়। তবে ও আমাদের বাসায় আসবে, তোমার সাথে সারাদিন সময় কাটাবে কিন্তু রাতে ওকে রেডিসনে থাকতে হবে। আমাদের বাসাতো খালি থাকে। কারণ তুমি স্কুলে যাও আমি কোর্টে যাই তবে মামুনের যেদিন নাইট থাকে ও শুধু বাসায় থাকে। বরং ও রেডিসনে থাকলে আমরা রিল্যাক্সে থাকতে পারবো।
নীলা ভীষণ খুশী হলো। ও হয়তো ভাবেইনি আমি এভাবে ওর বান্ধবীর থাকার ব্যবস্থা করবো। সবাই হয়তো জেনিফারের মতো নয়। কিন্তু সাবধান থাকাতো দোষের নয়। ও হাসিমুখ করে রেডী হতে আমার সামনে থেকে উঠে গেল। ওর হাসিমুখটা দেখে আমার প্রাণটাও জুড়িয়ে গেল। এটাই জীবন। এভাবেই জীবন তার নিজস্ব গতিতে বয়ে চলে।
সমাপ্ত।
দারুন একটা মোটিভেশনাল গল্প,,,,,, খুব ভালো লাগলো