কাঁচ কাটা হীরে পর্ব-০৯

0
755

#ধারাবাহিক গল্প
#কাঁচ কাটা হীরে
পর্ব-নয়
মাহবুবা বিথী

এরপর থেকে প্রায় ছুটির দিনে আমাদের বাসায় উনি নাতিকে নিয়ে বেড়াতে আসতেন। আমার শাশুড়ীমায়ের সাথে যেমন উনার গভীর সুসম্পর্ক তৈরী হলো তেমনি উনার নাতি মাসুমের সাথে আমার ছেলে মামুনের মধ্যে ও বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। সেজন্য উনারা বাসায় বেড়াতে আসলে আমারও ভালো লাগতো। যতক্ষণ ঐ খালাম্মা থাকতেন মামুনের সময়টা মাসুমের সাথে খেলাধুলা হাসি আনন্দে কেটে যেতো।

এরমাঝে হাইকোর্টে আমাদের ল,ইয়ারদের একটা পূর্ণমিলনীর অণুষ্ঠান ছিলো। আমি সেদিন বেশ সাজুগুজু করে কোর্টে গিয়েছিলাম। হঠাৎ ছ,ফিটের মতো লম্বা মেদহীন শরীর কালো স্যুট পড়া এক সুদর্শন ভদ্রলোক আমার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
——আমার যদি কোনো ভুল না হয় আপনি ব্যারিস্টার সায়মা রহমান?
——হুম,কিন্তু আমি তো আপনাকে ঠিক চিনতে পারলাম না?
—–আমার মা আপনার খুব ভক্ত। আমার ছেলে আবার আপনার ছেলের ভক্ত। সেই কারনে ওদের মুখে আপনার কথা এতো শুনেছি যে আমিও আপনার ভক্ত হয়ে গিয়েছি।
আমিও ভদ্রতার খাতিরে বললাম,
—–ও—ও আপনি মাসুমের আব্বু। খালাম্মার কাছে শুনেছিলাম আপনি হাইকোর্টে প্রাকটিস করেন।খালাম্মাও অনেক ভালোমানুষ। আর আপনার ছেলেও খুব মিশুক প্রকৃতির। আমার ছেলের সাথে আসলেই ওর ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে।
প্রথম দেখায় ভদ্রলোককে আমার বেশ ভালোই লাগলো। উনিও খুব মিশুক প্রকৃতির। আমি তখনও জানতাম না মাসুমের মা যে বেঁচে নেই। আমার শাশুড়ী মা আমাকে বলেননি। হয়তো ইচ্ছে করেই বলেননি। সেদিন ভদ্রলোকের সাথে আমার অনেক আলাপ হয়। তখনি জানলাম উনার স্ত্রী বেঁচে নেই। মাসুমের মুখটা সেই মুহুর্তে আমার মনে পড়লো। ছেলেটার জন্য আমি একধরনের মায়া অনুভব করলাম। আমি তখনও বুঝিনি ভদ্রলোক আলাপ করার ছলে আমাকে পাত্রী হিসাবে দেখে গেলেন। এরপর থেকে প্রায় উনার সাথে আমার দেখা হতে লাগলো। উনিও যেহেতু হাইকোর্টে প্রাকটিস করেন সেহেতু আমাদের প্রায় দেখা হতো। সেই সুবাদে আমাদের মধ্যেও বন্ধুত্বের বন্ধন তৈরী হলো। কিছুদিনের মধ্যে আমরা আপনি থেকে তুমিতে চলে আসলাম। তাছাড়া উনিও সাথীহারা মানুষ আর আমিও পোড় খাওয়া তাই দু,জন দুজনের কাছে নিজেদের কষ্টগুলো মাঝে মাঝে শেয়ার করতাম। আস্তে আস্তে ভদ্রলোকের প্রতি আমি একধরনের টান অনুভব করতে লাগলাম। সেই টানটা কাউকে পাশে পাবার অনুভূতী। মনে হতো কেউ একজন আমার সমব্যথি হয়ে আমার জীবনে আসুক। কিন্তু ভার্সিটিতে পড়ার সময় আহসানের প্রতি ভালোবাসার টানটা ছিলো বাঁধভাঙ্গা জোয়ারের মতো। তখন আমার অনুভবটা এমন হয়েছিলো যে কোনো মুল্যে আমি আহসানকে চাই। সেই কারনে বাবা মায়ের এতো আদর স্নেহকে অগ্রাহ্য করে ওর হাতটা ধরেছিলাম। এই ভদ্রলোকটার প্রতি অনুভবটা সেরকম নয়। তবে পাশে থাকলে নিজেকে খুব হালকা লাগে। এই টানটা হতে প্রায় দু,বছর সময় লেগে যায়। ঐ ভদ্রলোকের নাম রাফসান।
আমার এই অনুভূতী শাশুড়ী মা টের পেয়েছিলেন। তাই এক চৈতালী বিকালে উনি আমাকে জানালেন,”রাফসান আমাকে বউ করে নিতে চায়”। আমিও সেই দায়টা শাশুড়ী মায়ের উপর ছেড়ে দিয়ে বলেছিলাম,
“মা আপনি যা ভালো বুঝেন তাই করেন”।
উনি আলহামদুলিল্লাহ বলে কোমর বেঁধে এই কাজে নেমে পড়লেন। বিয়ের তারিখ ঠিক হলো। পহেলা বৈশাখে আমাদের বিয়ে হবে। কেনাকাটা শুরু হলো। বিয়ের আয়োজনের ব্যস্ততার সাথে আমার কোর্টের ব্যস্ততার ভীড়ে এই কয়দিন মামুনের খোঁজ একদম নিতে পারিনি। এরমাঝে এক ঘটনা ঘটে। মামুন সে সময় ক্লাস ফাইভে পড়ে। একটু বড় হয়ে যাওয়াতে ওকে আমি আলাদা রুম দিয়ে দেই। বিশেষ করে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়াতে এই সিদ্ধাম্ত নেই। আমার রুমের একদম পাশের রুমেই ওর থাকার ব্যবস্থা করা হয়। বিয়ের দু,দিন আগে ইউরিনের চাপে আমার মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। আমি ওয়াশরুমে যাই। ফ্রেস হয়ে এসে বিছানায় বসি। এমন সময় কার যেন কান্নার আওয়াজ পাই। মামুনের রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখি, রুমে আলো জ্বলছে। শব্দটা ঐ রুম থেকেই আসছে। ওকে আলাদা রুম দিলেও আমি দরজা লক করতে নিষেধ করেছি। ভেজানো দরজাটা ঠেলে একটু ফাঁক করে উঁকি মেরে দেখি, মামুন বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে কাঁদছে। ওকে এভাবে কাঁদতে দেখে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। আসলে গত পনেরোদিন আমি ওর কোনো খবর রাখতে পারিনি। ভিতরে ঢুকে বিছানায় ওর পাশে গিয়ে বসলাম। পিঠে আলতো করে হাত রেখে বললাম,
—–কি হয়েছে বাবা আমার? এভাবে কাঁদছো কেন?
মামুন আমার হাতের আলতো স্পর্শ পেয়ে বিছানা থেকে উঠে বসলো। এবং আমাকে জড়িয়ে ধরে আবার কাঁদতে লাগলো।
আমি ওকে জড়িয়ে ধরে বললাম,
—–বাবা এভাবে কাঁদলে তো কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। তোমাকে তো সমস্যার কথাটা বলতে হবে?
তারপর চোখের জল মুছে আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—–আমি রাফসান আঙ্কেলকে কিছুতেই বাবা বলতে পারবো না। আর তোমাকে আমি কারো সাথে শেয়ার করতে পারবো না। মাসুমকে আমি বন্ধু ভাবি। কিন্তু ও তোমাকে মা ডাকুক এটা আমি চাই না।
——কেন বাবা? রাফসান আঙ্কেলতো তোমাকে অনেক ভালোবাসে।
—–এই পৃথিবীতে তুমি আর দাদীমা ছাড়া আমি কারো ভালোবাসা চাই না। মা আমার তো বাবা নেই। আমি তোমাকে হারাতে পারবো না।
এই কথাগুলো বলে মামুন আবার কাঁদতে লাগলো। আমি ওকে অনেক বোঝাতে চাইলাম। কিন্তু ও কিছুতেই আমার কথা মানতে চাইলো না। বরং ঐ রাতে ছেলেটার কাঁপিয়ে জ্বর আসলো। আমার নিজেকে দোষী মনে হতে লাগলো। একটানা সাতদিন জ্বরে ভুগে মামুন সুস্থ হলো। আমিও আমার বিয়ের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসলাম। এতো সুন্দর করে একটি সম্পর্ক তৈরী করে দিতে ভুমিকা রাখলেন অথচ শেষ পর্যন্ত সেই সম্পর্কটা সফলতার মুখ দেখলো না এতে আমার শাশুড়ী মা একটু কষ্ট পেয়েছিলেন। তবে আমার মনে হলো অনেক বড় বিপদ থেকে আমি বেঁচে গেছি। নিজের সুখ চাইতে গিয়ে হয়তো আমার ছেলেটাকে হারিয়ে ফেলতে হতো। আমি যখন মামুনকে বললাম,
——তুই ছাড়া আমার জীবনে আমি আর কাউকে আনবো না।
ও খুশীতে আত্মহারা হয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে বললো,
——-আমি জানতাম, তুমি আমার কথা ফেলতে পারবে না। আম্মু জানো,আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে আছে। ওর নাম রাফিয়া। ওর বাবা মারা যাবার পর ওর মায়ের আর এক জায়গায় বিয়ে হয়। ও কিন্তু ওর দাদুবাড়িতে থেকে যায়। ওকে ওর নতুন বাবা নিতে চায় না। মাঝে মাঝে ও মায়ের কাছে বেড়াতে যায়। ওর মায়ের জন্য ওর খুব মন খারাপ থাকে। এটা দেখার পর আমি কিছুতেই তোমাকে ছাড়তে চাইছিলাম না। মনে মনে আমারও ভীষণ ভয় হতে থাকে আমিও যদি তোমাকে হারিয়ে ফেলি?
বিয়ের সমন্ধ নাকচ করাতে রাফসান খুব মন খারাপ করেছিলো। পরে যখন মামুনের কথা বুঝিয়ে বলেছি মেনে নিয়েছে। অনুরোধে ঢেঁকি গিলেছে মাত্র। মামুন যখন এসএসসি পরীক্ষা দেয় তখন আমার শাশুড়ী মা মারা গেলেন। তারপর থেকে শুরু হলো আমাদের মা ছেলের একলা জীবন। মাঝে মাঝে আমি আর মামুন বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যেতাম। ও যত বড় হতে থাকে ততই আমাদের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে।
তবে মামুন যখন এইচএসসি পরীক্ষা দেয় তখন আমাকে বিয়ে করতে বলেছিলো। আর ছোটোবেলায় এই আচরণ করার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলো। ততদিনে আমার ছেলেকে কেন্দ্র করে আমার পৃথিবীটা গড়ে উঠেছে। নতুনকরে আমার পৃথিবীতে কাউকে ঢোকার অনুমতি দিতে ইচ্ছে হলো না। মনে হতো এই তো বেশ আছি।
——মামনি, মামুনের পৃথিবীটাও তোমাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তোমার একলা জীবনের সংগ্রামের কথা আমাদের রিলেশনের শুরুতে আমাকে জানিয়ে দিয়েছে। আর সাথে সাথে এটাও বলেছে আমি যেন তোমাকে কোনোদিন কষ্ট না দেই। তোমাকে কষ্ট দিলে ও আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না।
——তোমার রাগ হয়নি আমার উপর? এটা মনে হয়নি, এই মহিলা তার ছেলেকে আঁচলবন্দী করে রেখেছে?
—–না মামনি,বরং মনে হয়েছে তুমি অনেক ত্যাগী মা। যে ছেলের কথা চিন্তা করে নিজের সমস্ত সুখ বিসর্জন দিয়েছে। আর মামুনকে দেখে মনে হয়েছে যে নিজের মাকে এতো ভালোবাসে সে তার সন্তানের মাকেও ভালোবাসতে পারবে। মামনি, আহসান আঙ্কেলের কোনো খোঁজ পেয়েছিলো? মামুন তোমার কথা আমার কাছে শেয়ার করতে পছন্দ করতো কিন্তু আহসান আঙ্কেলের ব্যাপারে কোনো কিছু আমাকে কোনোদিন জানাতে চাইতো না। এমনকি রাফসান আঙ্কেলের ঘটনাটাও আমাকে বলেছে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে