#ধারাবাহিক গল্প
#কাঁচ কাটা হীরে
পর্ব-আট
মাহবুবা বিথী
জেনিফার আমার সাথে অনেকবার দেখা করতে চেয়েছিলো। কিন্তু একদম ইচ্ছে হয়নি। আসলে কারো প্রতি মন একবার ভেঙ্গে গেলে তা আর কখনও জোড়া লাগে না। তাই জেনিফারের প্রতি আমার বোধশক্তি কাজ করতো না। হা,এটা ঠিক ওর উপর আমার অনেক ক্ষোভ ছিলো। কিন্তু ও অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আমি আর কোনো রাগ ক্ষোভ কিছুই রাখি নাই। রাসেল প্রায় আমার সাথে দেখা করতে কোর্টে আসতো। তখন ওর কাছে এইডস আক্রান্ত রোগীর জীবনের ঘটনাগুলো শুনতাম। এইডস হওয়ার কারনে ওরা এমনিতেই পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। খুবই নিঃসঙ্গ ওদের দিনগুলো কাটে। মাঝে মাঝে কথা প্রসঙ্গে রাসেল জেনিফারের কথাও বলতো। ওর মা বাবা ভাই বোন কেউ ওর সাথে দেখা করতে আসতে চাইতো না। এমনি জেনিফার তখনও বেঁচে কিন্তু ওর মা,বাবা আত্মীয় স্বজনের কাছে বলে বেড়াতো জেনিফার মারা গেছে। এ কথা জেনিফারের কানে আসলে ও অনেক কষ্ট পেয়েছিলো। তবে এরপর ও আর ওর বাবা মায়ের সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে নাই। জানো, নীলা আমি ভাবি, মানুষ যখন কারো প্রতি অন্যায় আচরণ করে তখন সে বুঝতে পারে না এই অন্যায় ওর উপর ফিরে আসতে পারে। কিন্তু যখন ফিরে আসে খুব নির্মমভাবেই ফিরে আসে।
জেনিফার খুব সৌন্দর্যসতেচন ছিলো। পুরুষকে বশ করার ক্ষেত্রে এটা ও অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতো। কিন্তু এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর ওর মাথার চুল পড়ে যায়। চেহারার লাবন্য কমে যায়। শরীর ও খুব শুকিয়ে যায়। ওর অবস্থা এমন হওয়াতে ও আয়নায় নিজের চেহারা দেখা বন্ধ করে দেয়। এরপর আস্তে আস্তে একদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ও মারা যাওয়ার আগে আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলো। সেখানে ও নিজেই বলেছে হিংসার বশবর্তী হয়ে ও আমার সাথে এই কাজটি করেছিলো। ও স্বীকার করেছে আহসান ওর প্রথম ভালোবাসা ছিলো। কিন্তু ভার্সিটিতে কালো তালিকাভুক্ত হওয়ায় ও আহসানের কাছ থেকে সরে আসে। তবে আহসান ওকে পছন্দ করতো কিনা সেটা ওর জানা ছিলো না। একদিন যাকে সে পায়ে দলে চলে গিয়েছিলো তার এরকম সুখীজীবন ও মেনে নিতে পারছিলো না। অথচ আহসানের সুখী গোছানো জীবনের সাথে যে আমার মতো একজন সারথী ছিলো তার কথা সে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো।তখন অলরেডী এক্স হাসব্যান্ডের সাথে ওর অশান্তি শুরু হয়ে গেছে। ওর এক্স হাসব্যান্ড নিজের সুবিধার জন্য জেনিফারকে খুব ব্যবহার করতো। প্রথম প্রথম জেনিফারের কাছে বিষয়টা অনেক চার্মিং ছিলো। কিন্তু একসময় ও খেয়াল করলো সেই সুবিধাগুলো ওর এক্সহাসব্যান্ড একাই ভোগ করতো। যেমন টেন্ডারবাজি, ব্যাবসায়িক ডিল এই প্রাপ্তিগুলোর কোনো ভাগ জেনিফার পেতো না। তখন ওর মনে হতো আহসানকে বাদ দিয়ে এই লোককে বিয়ে করে ও জীবনে বিরাট ভুল করেছে। যতদিন এই লোকের সাথে থাকবে এই ভুলের মাশুল ওকে বয়ে বেড়াতে হবে। কিন্তু এই লোককে ছেড়ে গেলে ওর একটা আশ্রয়ের প্রয়োজন হবে। তাই রিতার কাছে আমাদের ঠিকানা পেয়ে আহসানের সাথে যোগাযোগ শুরু করে।
অপরদিকে রিতার কাছে আহসানের সুখের কথা শুনার পর ও আরোও ক্রেজি হয়ে উঠে। তার সাথে যোগ হলো নিজের অসুখী জীবনের যন্ত্রণা। যারফলে ও একসময় হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ওর একটাই উদ্দেশ্যে থাকে আহসানের সাথে নিজেকে আবার জড়িয়ে ফেলতে হবে। ও বাংলাদেশ থেকে রিতার কাছে ঠিকানা নিয়ে আমাকে যেমন চিঠি পাঠিয়েছিলো তেমনি আহসানকেও চিঠি পাঠিয়েছিলো। তবে আহসানকে ও বলেছিলো ওর চিঠি পাঠানোর কথা যেন আমার কাছে গোপন রাখে। কারণ আমি হয়তো এটা স্বাভাবিকভাবে নাও নিতে পারি। জেনিফার ওর অসুখী জীবনের গল্প আহসানকে চিঠি মারফত জানাতে থাকে। আহসানও ওর প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে থাকে। এইভাবে ও একসময় আহসানকে নিজের আয়ত্বে আনে। কিন্তু আহসানকে বিয়ে করার পর ও বুঝেছিলো ওকে আহসান কখনও ভালোবাসেনি। ও শুধু আহসানের মোহ ছিলো। বিয়ের পর প্রতিমুহুর্তে আহসান ওকে আমার সাথে তুলনা করতে থাকে। তুলনা করাটা স্বাভাবিক ছিলো।কারণ আমি ছিলাম একজন গোছানো মানুষ আর অপরদিকে জেনিফার ছিলো উচ্ছৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত। তাই প্রতি মুহুর্তে কমপারিজনটা চলে আসতো। এই বিষয়টা ওর পক্ষে দিনের পর দিন মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। অপরদিকে আমাকে হারানোর পর আহসান বুঝেছিলো ও জীবনে কি হারিয়ে ফেলেছে? এই অনুশোচনায় ও সর্বদা দগ্ধ হতে থাকে। এবং এই রাগ গিয়ে পড়তো জেনিফারের উপর। এইজন্য আহসান প্রায় জেনিফারকে মারধর করে নিজের রাগ ঝাড়তো। যারফলে জেনিফার নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় পুলিশের সাহায্য নেয়। জেনিফারের কথা হচ্ছে ওর দোষ অবশ্যই আছে কিন্তু সেক্ষেত্রে আহসানের দোষও কোনো অংশে কম নয়। ওর কথা হচ্ছে ওতো মানুষ হিসাবে ভালো মানুষ ছিলো না। এটাতো আহসান জানতো। তারপরও কেন আহসান ওর পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে হীরা ফেলে কাঁচকে হাতে নিয়েছিলো? তাই পরিশেষে ও আমাকে বলেছিলো ওর এসব কথা শোনার পর ওকে ক্ষমা করার ইচ্ছে যদি আমার হয় তাহলে আমি ওকে যেন ক্ষমা করে দেই। এমনিতেই আমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছি। তারউপর এসব কথা শোনার পর রাগ আর ক্ষোভটাও ঝেড়ে ফেলি। জেনিফারের কারনে আমার হয়তো কিছুটা ক্ষতি হয়েছে কিন্তু সবচেয়ে বেশী ওর নিজের ক্ষতি হলো।
——মামনি দাদীমা বেঁচে থাকা অবস্থায় আহসান আঙ্কেলের সাথে আর দেখা হয়নি?
——হ্যা,হতো। আমার শাশুড়ী মা তো ওর দিকে ফিরেও তাকাতেন না। কিন্তু মা যখন মামুনকে নিয়ে স্কুলে যেতেন তখন আহসান ওদেরকে একপলক দেখার জন্য স্কুলের গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতো। কিন্তু তাও আমার শাশুড়ী কথা বলতেন না। মাঝে মাঝে বাবার সাথে কথা বলার জন্য মামুনের একটু ইচ্ছে হতো। কিন্তু আমার শাশুড়ী মা এ্যালাউ করতেন না। আমার শাশুড়ী মা আমার সাথে থাকাতে মামুনকে হ্যান্ডেল করা আমার পক্ষে সহজ হয়ে যায়। কারন ব্রোকেন পরিবারের সন্তানদের মানসিক অবস্থা এমনিতেই খুব ভঙ্গুর থাকে। কিন্তু শাশুড়ী মা আমাদের সাথে ছায়ার মতো থাকাতে মামুনও মানসিকদিক থেকে কিছুটা হলেও ভালো থাকতো। শাশুড়ী মা গ্রামে বড় হলেও মননে মানসিকতায় খুবই আধুনিক ছিলেন। সাজিদ যখন ইন্জিনিয়ার পাশ করে পিএইচডির স্কলারশিপ পায় তখন আমি সাজিদকে ওর পছন্দ করা পাত্রীর সাথে বিয়ে দিয়ে দেই। মা মারা যাবার বছর দুয়েকের মধ্যে বাবাও দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। বাবা মারা যাবার তিনবছর পর সাজিদের বিয়ে হয়। বাবা মা না থাকায় সাজিদের বিয়ের দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হয়। এরপর আমার শাশুড়ী আমার বিয়ের জন্য উতলা হন। উনার একটাই কথা উনিও যদি হঠাৎ করে মারা যান তাহলে আমার আপনার বলতে কেউ রইলো না। ঐ চিন্তায় উনি রাতে ঘুমাতে পর্যন্ত পারতেন না। আমি মাঝে মাঝে আহসানকে এই মায়ের সন্তান হিসাবে মেনে নিতে পারতাম না। এই স্বল্প শিক্ষিত মানুষটার মন মানসিকতা কতটা উন্নত ছিলো তা ধারণার বাইরে।
শুধু বিয়ের কথা বলে উনি দায় সারেননি। গোপনে আমার জন্য শাশুড়ী মা ঠিকই পাত্র যোগাড় করে ফেলেন। ঐ পাত্রের মায়ের সাথে আমার শাশুড়ী মায়ের যোগাযোগ হয় মামুনের স্কুলে। উনিও উনার নাতীকে নিয়ে স্কুলে আসতেন। মামুনের থেকে এক ক্লাস নীচে পড়তো। মামুন তখন থ্রীতে পড়তো। আর ঐ ছেলেটা ক্লাস টুতে পড়তে। ওর মা মারা গিয়েছিলো। এদিকে আমি এসবের কিছুই জানতাম না। তারপর এক ছুটির দিনে বিকেল বেলা ঐ মহিলা তার নাতিকে নিয়ে আমাদের বাসায় হাজির হন। ঐ ভদ্রলোকও হাইকোর্টে ওকালতি করেন। কিন্তু আমি তখনও বুঝতে পারিনি ঐ মহিলা যে আমাকে দেখতে এ বাড়িতে এসেছেন। আমার শাশুড়ী মা আমাকে বলেছিলেন উনি নাকি উনার বান্ধবী। বয়সে কাছাকাছি হওয়াতে আমিও তাই ভেবেছিলাম। উনাকে যথেস্ট আদর যত্ন করলাম। এবং উনার নাতির সাথে মামুনেরও ঐ টুকু সময়ের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো। ভদ্রমহিলা আমাকে খুবই পছন্দ করলেন।
চলবে