কাঁচ কাটা হীরে পর্ব-০৭

0
747

#ধারাবাহিক গল্প
#কাঁচ কাটা হীরে
পর্ব-সাত
মাহবুবা বিথী

আমরা দুটি মাত্র ভাইবোন ছিলাম। এবং দু,জনেই লেখাপড়ায় ছোটোবেলা থেকে বেশ ভালোছিলাম। এবং বেশ বাধ্যগত ছিলাম। সেই কারনে কোনোদিন বাবা মায়ের কাছে কখনও বকাঝকা শুনতে হয়নি। আমি খাওয়া নিয়ে মায়ের কাছে মাঝে মাঝে বকা খেয়েছি। ঠিকমতো খেতে চাইতাম না। আমি খেতে না চাইলে বাবা বাসায় থাকলে আমাকে খাইয়ে দিতেন। এদিকে বাবা হাই অফিসিয়ালী জব করাতে আমাদের লাইফস্টাইলে অনেক বৈচিত্র ছিলো। প্রতিবছর পিকনিকে যেতাম। আবার যখন জেলাশহরে ছিলাম তখন প্রায় নানা অনুষ্ঠানে অংশ নিতাম। আমি ছোটোবেলা থেকে কবিতা আবৃত্তি ছবি আঁকা প্রবন্ধ লেখাতে ফার্স্ট পুরুস্কার পেতাম। পাশাপাশি গান শিখতাম। জীবনে ভোগ বিলাসের বাহার না থাকলেও খুবই সচ্ছল ছিলাম। বাবা মা ভাই এমনকি আত্মীয়স্বজন সহ খুব সুখের সংসার ছিলো আমাদের। বাবা মায়ের সাথে বন্ডিংটা খুব ভালো ছিলো। সেই কারনে আমার বাবা মায়ের সংসারে ভালোবাসার অভাব ছিলো না।
তবে আমি যখন একটু বড় হতে থাকলাম মা আমাকে মাঝে মাঝে বলতেন,”সায়মা মানুষের জীবন অনেকটা নদীর মতোন। নদী কখনও উত্তাল আবার কখন স্রোতহীন হয়ে পড়ে। জীবনটাও সেরকম”। মায়ের মুখে এ কথা শুনে আমি একটু অবাক হতাম। আসলে জীবনেতো কখনও কষ্ট দেখিনি, তাই বুঝিনি কষ্টের স্রোতে যে অনেক সময় বুকের পাড়গুলো ভেঙ্গে যায়। যার যায় একমাত্র সেই বুঝে এর যন্ত্রণা। আমার সাথে আহসানের ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পর আমার জীবনের সময়গুলো কঠিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে পার হতে লাগলো। প্রথমে আমাকে শুনতে হতো আমি এক অপয়া সন্তান। যে সন্তান নিজের বাবা মায়ের বিপক্ষে গিয়ে বিয়ে করলো এবং নিজের সুখের জন্য বাবা মাকে বেদনার মহাসমূদ্রে নিক্ষেপ করলো। তারউপর সেই সংসারও আমি ধরে রাখতে পারলাম না। আমার আত্মীয়স্বজনের ধারণা আমি লেখাপড়ায় ভালো হলে কি হবে আমার তো সংসার করে খাওয়ার যোগ্যতা নাই। নিত্য এসব কথা শুনতে হতো। শাশুড়ী মা পাশে থাকাতে এই কথাগুলোর ডালপালা তেমন বিস্তার হওয়ার সুযোগ পেতো না। উনার সামনে এ ধরনের প্রসঙ্গ উঠলে উনি প্রবলভাবে এর প্রতিবাদ করতেন। উনিই সবাইকে বলতেন আমার বৌমা এতোটাই ভালো যে আমার কুলাঙ্গার ছেলেকে ফালাইয়া আসতে আমার একটুও কষ্ট হয়নি। সুতরাং আপনারা আমার সোনার বৌমার নিন্দে করবেন না। অনেক পূন্যে এরকম বৌমা পাওয়া যায়। এভাবে আমাকে আগলে রাখতেন। যেমন মামুনকে স্কুলে আনা নেওয়া উনিই করতেন। যাতে আমাকে মানুষের নেগেটিভ কথার তোপের মাঝে পড়তে না হয়। শাশুড়ী মা আনা নেওয়া করতেন বিধায় ছেলের স্কুলের গার্ডিয়ানদের তরফ থেকে তেমন কোনো নোংরা কথা আমার কান অব্দি আসতো না। সে সময় এই বিষয়গুলো মেনে নিতে আমার কষ্ট হতো।কতরাত নির্ঘুম কাটিয়েছি। চোখের নিচে অনেক বড় ডার্ক সার্কেল পড়েছিলো। আমাকে দেখলে তখন সবাই জিজ্ঞাসা করতো আমার কোনো অসুখ করেছে কিনা?
প্রথম প্রথম মামুনেরও ওর বাবার জন্য কষ্ট হতো। ও তখন খুব ছোটো। স্কুলে ওর বন্ধুদের ওদের বাবারা সকালে দিয়ে যেতো। ছুটির পর ওদের মায়েরা এসে নিয়ে যেতো। কিন্তু ওর তো বাবা নেই আবার আমিও ছুটির সময় স্কুল থেকে আনতে যেতাম না। এসব বিষয় নিয়ে ওর খুব অভিমান ছিলো। তবে বড় হওয়ার পর যখন বুঝতে শিখেছে তখন আর অভিমান করতো না। আমি ওকে কখনও ওর বাবা সম্পর্কে কোনো কিছুই বলিনি। যতটুকু ও জেনেছে সেটা শাশুড়ী মা ওকে বলেছে। আসলে আমি কখনও চাইনি ও ওর বাবার প্রতি নেগেটিভ ধারণা নিয়ে বড় হোক। কারণ এই বিষয়গুলো চাইল্ড সাইকোলজিতে অনেক প্রেসার পড়ে। কারণ আমাকে তো কোর্টে যেতে হতো। ও তো বাসায় একাই থাকতো। যদিও ওর দাদী আর নানা ওকে সময় দিতো। কিন্তু বয়স্ক মানুষ বিধায় দুজনেই লাঞ্চের পর ঘুমিয়ে পড়তো। ঐ মুহুর্তে ওকে একাকী সময় কাটাতে হতো। যাই হোক সেই কঠিন দিনগুলো পার করে ছেলে আমার আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে।
এদিকে আমার মা এভাবে চলে যাওয়াতে আমার ভিতরে কষ্টের ঝড় বইতে থাকে। মায়ের অসুস্থার জন্য নিজেকে দায়ী মনে হতো। আমার এই কষ্ট আর অনুশোচনাকে লাঘব করার জন্য বাবার সংসারটা মায়ের অবর্তমানে আমিই আগলে রেখেছিলাম। যতদিন বাবা বেঁচে ছিলেন তার সেবা যত্নের ত্রুটি আমি করিনি। আহসানের বিশ্বাস ঘাতকতা, আমার অনুশোচনা সর্বোপরি মামুনের কথা চিন্তা করে আমার আর বিয়ে করার ইচ্ছা হয়নি।
—–মামনি, জেনিফারের কোনো খবর জানো?
——পৃথিবীটা গোল। এইজন্য কোনো খবর এখানে চাপা থাকে না। গড়াতে গড়াতে একসময় ঠিক তোমার কানে চলে আসবে। আমিও ওর খবর পেলাম আমার বন্ধু রাসেলের কাছ থেকে। রাসেলের মুক্ত আকাশ নামে একটা এনজিও সংস্থা আছে।দেশে আসার পর সেখানেই জেনিফারের ঠাঁই হয়।

ওতো বরাবরই উচ্ছৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত। যখন ভার্সিটিতে পড়তাম তখনও শুনতাম ও বিভিন্ন ছাত্রনেতাদের সাথে ডেটিং করে বেড়ায়। প্রায় নাকি কক্সবাজারে ঘুরতে যেতো। আমি অবশ্য সহজ সরল মনের মানুষ ছিলাম তাই ওর সম্পর্কে এই কথাগুলোকে রিউমার হিসাবে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু এখন ওর সম্পর্কে সব কিছুই বিশ্বাস হয়। আমার ভাবতে অবাক লাগে জেনিফারের চারিত্রিক বিষয়টা আহসানের জানা ছিলো। অথচ জেনিফার যখন ইংল্যান্ডে আসলো তখন ওর ঐ ঘটনাগুলো আহসান কি করে ভুলে গেল? কথায় আছে না পিপীলিকার পাখা উড়ে মরিবার তরে। আহসানের অবস্থাটাও সে রকম হয়েছে।
আহসানের সাথে ডিভোর্স হওয়ার পর ও এক ইংরেজের সাথে লিভটুগেদার শুরু করে। ও ভেবেছিলো যেভাবে আহসান কিংবা ওর এক্স হাসব্যান্ডকে ভাঙ্গিয়ে খেয়েছে ঐ ইংরেজকেও সেভাবে ভাঙ্গিয়ে খাবে। কিন্তু লোকে বলে না বৃটিশের বুদ্ধি। ঐ বৃটিশ ওকে দিয়ে বাড়ির সমস্ত কাজ করাতো। তারউপর সংসারের খরচও অর্ধেক চাপিয়ে দেয়। জেনিফারও ভেবেছিলো ঐ বৃটিশ ওকে বিয়ে করে সিটিজেন পাইয়ে দিবে। কিন্তু জেনিফারের ধারণাকে মিথ্যা প্রমানিত করে ছ,মাসের মাথায় একদিন রাতে ওর স্বজাতি এক নারী ঘরে নিয়ে আসে ঐ বৃটিশ। আর জেনিফারকে বাসা থেকে বের করে দেয়। জেনিফার সিটিজেনের লোভে সংসারের অর্ধেক খরচও বহন করেছিলো। ছ,মাস ধরে হাতির খোরাক যোগাতে গিয়ে ওর সব সঞ্চয় নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিলো। সেই কারনে নাকি ঐ বৃটিশ ওকে বাসা থেকে বের করে দেয়। কিন্তু কথায় আছে না কেউ যখন কাউকে ঠকিয়ে ভাবে সে অনেক লাভবান হয়েছে আদতে কিন্তু সে নিজের ক্ষতিটাই করলো। জেনিফারের ভাগ্যেও তাই ঘটলো। এরপরে জেনিফারের কাহিনী আরোও কঠিন। সহায় সম্বল হারিয়ে ও নানা রকম অড জব করতে থাকে। সাথে সাথে ওর শরীরও খারাপ হতে থাকে। প্রায় ওর জ্বর হয়। সেই সাথে গলা ব্যথা পেট খারাপ হতে থাকে। যে দোকানে ও ক্লিনিং এর কাজ করতো ওরাই নাকি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জানা যায় ওর এইডস হয়েছে। আসলে ঐ ইংরেজের শরীর থেকে ওর শরীরে এইডসের জীবানুর বিস্তার ঘটেছে। এরপর জেনিফারকে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দেশে আসার পর ও ওর বাবার বাড়িতে উঠতে পারেনি। কারণ ওরা ভেবেছিলো জেনিফারের কারনে ওরাও যদি এইডসে আক্রান্ত হয় সেই কারনে ওর বাবার বাড়িতে জায়গা হয়নি। একবার ভাবো সেদিন ওকে কতোটা কঠিন সময় পার করতে হয়েছে। ওর এই অসুস্থতার খবর আমাদের বন্ধু মহলে ছড়িয়ে পড়লে রাসেল সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। রাসেলের এনজিও “মুক্ত আকাশ” এ এইডস রোগীদের পুনর্বাসিত করা হয়। ও আমাকে একদিকে নিঃস্ব করতে গিয়ে ও সব দিক থেকে এমনভাবে নিঃস্ব হলো যা ও স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবেনি।
চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে