#ধারাবাহিক গল্প
#কাঁচ কাটা হীরে
পর্ব-ছয়
মাহবুবা বিথী
আমি আগেই বলেছি জেনিফার অনেক ধুর্ত। এবারও তার ব্যাতিক্রম হয়নি। পর মুহুর্তে নিজেকে সামলে খুব স্বাভাবিক ভাবে বললো,
—–তুমি যে আজকে আসবে চিঠিতে জানালেই পারতে? আমি আর আহসান তোমাকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্টে যেতাম?
—–হুম,তা বেশ বলেছো। তাহলে তো নিজের চোখে তোমাদের কুকীর্তিগুলো দেখতে পেতাম না।
—–আসলে তুমি যা ভাবছো তা নয়। আহসানকে এতোটা ড্রিংক করতে আমি নিষেধ করেছিলাম। তোমার জন্য ডিপ্রেসড হয়ে ড্রিংক করেছে। যারফলে ও টাল সামলাতে পারছিলো না বলে আমার গায়ে ভর দিয়ে এসেছে।
জেনিফারের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে সাথে সাথে আহসান বললো,
——বিয়ের পর তোমাকে আর মামুনকে ছেড়ে আমি কখনও থাকিনি। তাই এই লোড টা নিতে পারছিলাম না? এই কারনে একটু ড্রিংক বেশী করে ফেলেছি।
——ভালোই উন্নতি হয়েছে তোমার। কি অবলীলায় মিথ্যা বলে যাচ্ছো! আসলে বলবে নাই বা কেন? পঁচা আমের সাথে থাকতে থাকতে তুমিও পঁচে গিয়েছো। এতোদিন আসছো ইংল্যান্ডে আমি তোমাকে কোনোদিন ড্রিংক করতে দেখিনি। অথচ একমাসও হয়নি আমি দেশে গিয়েছি এতেই ড্রিংক করা শিখে গিয়েছো। আরো কিকি যে করেছো কে জানে?
এবার জেনিফার শয়তানটা বলতে লাগলো
—–আমার হালকা পাতলা ড্রিংক করার অভ্যাস আছে। এই অভ্যাসটা হয়েছে আমার এক্স হাসব্যান্ডের কারনে। ও খেতো তাই আমাকে ওকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য খেতে হতো। এভাবে খেতে খেতে আমার অভ্যাস হয়ে গেছে। তাই মাঝে মাঝে একটু না খেলে হয় না। খালাম্মা বাসায় থাকায় আমি বারে গিয়ে একটু ড্রিংক করি। আহসান যে কখনও ড্রিংক করেনি তা আমার জানা ছিলো না। আমি ভেবেছি ওরও আমার মতো অল্প বিস্তর ড্রিংক করার অভ্যাস আছে। তাই আমি ড্রিংক করার সময় ওকেও অফার করি।
——আর ও সুড়সুড় করে তোমার কথামতো গিলতে থাকে। কথায় আছে না চোরের স্বাক্ষী গাঁটকাটা। তোমাদের অবস্থা হয়েছে সে রকম। মানুষ যে কতটা নির্লজ্জ আর বেহায়া হতে পারে তোমাদের না দেখলে মনে হয় আমার জানা হতো না। আর তুমি তো এখন ছাড়া গরু। নিজের হাসব্যান্ডকে ছিঁবড়ে বানিয়ে ডিভোর্স দিয়ে এসেছো। অথচ আমার কাছে এ কথাটা তুমি লুকিয়েছো। কারণ তোমার উদ্দ্যেশ্য খারাপ ছিলো। এখন এসে তুমি আহসানের কাঁধে চেপে বসেছো। অথচ এই আহসানকে তুমি পায়ে দলে একদিন চলে গিয়েছিলে। যাইহোক আমার ক্ষতি আর কতটুকু করতে পারলে? তোমরা নিজেরাই নিজেদের ক্ষতি করেছো। কারণ তোমরা ব্যাভিচারিনী। এই পাপের শাস্তি তোমাদেরকে একদিন না একদিন পেতেই হবে।
এরপর আমি আহসানের দিকে তাকিয়ে বলি,
——সম্পর্ক টিকে থাকে ভালোবাসা আর বিশ্বাসের ভিতের উপর। সেই ভীত যখন নড়ে যায় তখন সম্পর্কটাও ভেঙ্গে যায়। তোমার সাথে আমার পক্ষে আর থাকা সম্ভব না। তোমার মতো বিশ্বাসঘাতক বেঈমানের সাথে আর একদিনও নয়। আমি আমার পরিবারের অমতে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম। আসলে আমার বাবার চোখ তো জহুরীর চোখ। উনি তোমাকে ঠিক চিনতে পেরেছেন। আর এটা নিশ্চয় তোমার জানা আছে, কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হয় না।তোমার অবস্থা হয়েছে সেরকম। আমি যতদিন ইংল্যান্ডে আছি তুমি আর জেনিফার কেউ আমার সামনে আসবে না। আমি এখানকার কাজ গুটিয়ে খুব শীঘ্রই দেশে চলে যাবো।
এমনসময় আমার শ্বাশুড়ী মা এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
——বৌমা আমাকে এই পাপিষ্টাদের কাছে ফেলে রেখে যেও না। আমাকেও তোমার সাথে নিয়ে চলো। আমি আহসানকে আজ থেকে ত্যাজ্য করেদিলাম।
আহসান কঁকিয়ে উঠে বললো,
—–মা তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না?
——খবরদার ঐ পাপমুখে তুই আমাকে কখনও মা ডাকবি না। আজ থেকে আমি জানবো আমার ছেলে মরে গেছে।
এই কথাগুলো বলে আমি ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলাম। এরপর আমি আর আমার শাশুড়ী মা দুজনেই নিজ নিজ রুমে ঢুকে দরজা লক করে দিলাম। সে রাতে আমার আর ঘুম আসেনি। আহসানের সামনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো আমি বলেছি বটে তবে আমার ভিতরটা ভেঙ্গে দুমড়ে মুঁচড়ে গিয়েছিলো। আমি সেদিন সারারাত কেঁদেছিলাম। এক অসীম শুন্যতায় আমার রাতের প্রহরগুলো সেদিন কেটে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো এটা যেন একটা দুঃস্বপ্ন। রাত ফুরোলেই এই দুঃস্বপ্নের রেশ কেটে যাবে। ইংল্যান্ডে আমার শুভাকাঙ্খীরা আমাকে বলেছিলো ওর প্রতি হোম ভায়োল্যান্সের অভিযোগ দায়ের করতে। কিন্তু আমি সেসবের কিছুই করিনি। আমার ভাগ্যের ফয়সালা আল্লাহপাকের উপর ছেড়ে দিয়েছিলাম।
মাসখানিকপর সব গুছিয়ে নিয়ে আমার শাশুড়ী মাকে সাথে নিয়ে ঢাকায় চলে আসি।
——এরপর মামনি তোমার সাথে আহসান আঙ্কেলের আর যোগাযোগ হয়নি?
——না আমি আর যোগাযোগ করিনি। তবে জেনিফার যখন ওকে আস্তাকুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো তখন আমার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলো।
—–উনার সাথে কি জেনিফারের বিয়ে হয়েছিলো?
——হুম,বিয়ে হয়েছিলো। কিন্তু ওদের বিয়েটাও টিকেনি। আসলে জেনিফার তো ওকে ভালেবেসে বিয়ে করেনি। জেনিফারের লন্ডনে গিয়ে একটা আশ্রয়ের দরকার ছিলো। পড়াশোনার ক্ষেত্রে বরাবর ও লবডঙ্কা। আবার অন্যদিক থেকে প্রচন্ড লোভী আর উচ্চাভিলাসী। ও স্টুডেন্ট ভিসায় লন্ডনে গিয়েছে। এরপর আহসানের কাঁধে ভর করেছে। এদিকে আহসান ওকে ভালেবাসেনি। ওর প্রতি ছিলো মোহ। তাই বিয়ের দুদিন পর থেকেই যখন মোহ কেটে যায় তখনি ওদের সাথে খিটিমিটি শুরু হয়। কারণ ওর সন্তান, ওর মা সবাই তো ওকে প্রত্যাখান করেছে। এদিকে আবার জেনিফারের আকাশ সমান চাহিদা। ওর বারে যেতে হয়, ক্যাসিনোতে যেতে হয়। এসবের অর্থের যোগানতো আহসানকে দিতে হতো। আবার সংসারের কাজকর্ম করতে চাইতো না জেনিফার। এসব নিয়ে প্রায় নাকি অশান্তি হতো। আহসান একসময় এসব অশান্তি সহ্য করতে না পেরে একদিন জেনিফারের গায়ে হাত তোলে। জেনিফার অমনি পুলিশ কল করে যারফলে যা হবার তাই হলো। পুলিশ এসে আহসানকে এ্যারেস্ট করে নিয়ে যায়। আহসানের চাকরি চলে যায়। ওর নামে মামলা হয়। কয়েক বছরের সাজা হয়। অবশেষে ওকে জেলখানায় বন্দীজীবন কাটাতে হয়। মানুষের যখন অধঃপতন শুরু হয় তখন ওরা বুঝতে পারে না। মরিচিকার মতো তারা অধঃপতনের দিকে ধাবিত হয়। আহসানের অবস্থাও তাই হয়েছে।
—–মামুনের দাদী কি পরে আপনার কাছ থেকে চলে গিয়েছিলো?
—–চলে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি উনাকে যেতে দেইনি। যারফলে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত উনি আমার কাছেই ছিলেন।
——ছেলেকে দেখতে চাইতেন না?
——না, মামুনকে ভীষণ আদর করতেন। আমি বুঝতাম মামুনের মাঝে সে নিজের ছেলেকে খুঁজে নিতো। আমি উনার মতো এরকম শক্ত মানুষ দেখিনী। তার ছেলে যে আমার সাথে অন্যায় করেছে এটার শাস্তি সে ছেলেকে এভাবে দিয়েছে। কয়েক বছর জেল খাটার পর আহসান দেশে ফিরে আসে। তারপর আমার শাশুড়ী মায়ের সাথে দেখা করতে চায়। কিন্তু উনি দেখা করেননি। তবে আমার কাছে উনি খুব সম্মানে ছিলেন। মামুনকে বুকে নিয়ে যখন দেশে ফিরে আসি আমার মা আমার এই পরিনতি মেনে নিতে পারেননি। আমার এই অবস্থার জন্য উনি নিজেকে দায়ী করেছিলেন। ভেবেছিলেন আমি যদি উনার অসুস্থতার খবর শুনে এভাবে ছুটে না আসতাম তাহলে হয়তো আমার সংসারটা ভাঙ্গতো না। কিন্তু আমি আম্মার সাথে একমত নই। যারফলে এই আঘাত সইতে না পেরে আমার মা দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। এমনিতেই আমার আম্মার হার্টের অবস্থা ভালো ছিলো না। আমার এই অবস্থা মাকে খুব আহত করেছিলো।
এদিকে আমি উনাকে পেয়ে আমার মায়ের শোকটা দ্রুত সামলাতে পারি। আমার বাবাও উনাকে খুব সম্মান করতেন। নিজের বোনের মতো ব্যবহার করতেন।
চলবে