কাঁচের সংসার পর্ব-১১

0
1641

#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১১

পরেরদিন আরোহী গুছগাছ হয়ে আমেনা আহমেদের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে বেরিয়ে গেল চাকরির উদ্দেশ্যে। মূলত চাকরিটা বড়ো-সরো নয়। এটা একটা বড়ো শপিংমলে সেলসম্যানের কাজ। তবুও আরোহীর চাই-ই চাই।
যথাস্থানে পৌঁছে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সার্টিফিকেট দেখাতেই উনারা আরোহীকে বিনা শর্তে চাকরিটা দিয়ে দিল। চাকরিটা পেতেই আরোহী আগে শুকরিয়া আদায় করে নিল। যাক এতো মানুষের ভিড়ে ভালো মানুষও অর্ধেক আছেন, নাহলে আজ এতো দ্রুত চাকরিটা পাওয়া আরোহী কোনোকালেই ভাবেনি।
পরেরদিন থেকে জয়েন্ করার কথা। আরোহী ভাবলো বাসায় গিয়ে আমেনা আহমেদকে বলে আরেকটা ছোটোখাটো ঘরে সে উঠবে। বাসা ঠিক করেই আশ্রমের খালার সাথে কথা বলবে। বাসায় উঠার কথার মাঝে আরেকটা নতুন চিন্তার উদয় হলো। তার কাছে তো এখন কোনো টাকা নেই, বাসায় উঠবে কী করে! অন্তত একমাস গেলেই টাকা পাবে তখনই তো বাসার সব গুছিয়ে নিতে পারবে। আরোহীর মন খারাপ হলো। আরও একমাস কী ওই বাড়িতে বোঝা হয়ে পড়ে থাকতে হবে। অবশ্য উনারা অনেক ভালো মনের মানুষ, আরোহীর উপর একবারও বিরক্ত হয়নি উল্টো আরোহী অন্য বাসায় উঠার কথা বললে বিরক্ত হয় কিন্তু এখন যাই হয়ে যাক না কেন আরোহীর বাসাটা থেকে চলে আসা উচিত। আরোহীর অসময়ে ইনারা না থাকলে আজ আরোহী কোথায় থাকতো তা সে নিজেও ভেবে পায় না। ইনারা তাকে এতদিন বিনা কারণে বিনা স্বার্থে রেখেছে তাতেই আরোহী ঋণী। আজ-কাল নিজের আপনজনরা খবর নেয় না অথচ ইনারা! মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে ইনারা। ইনাদের ঋণ হয়ত কখনো শোধ হবে না।

আরোহী গাড়িতে বসে আছে। লাল সিগন্যাল পড়েছে। এই একটা সিগন্যালেই সব গাড়ি থেমে আছে। হয়ত এমন কোনো সিগন্যাল জীবনে এসেও জীবনকে চিরতরে থামিয়ে দিয়ে যায়। শুধু এটাই পার্থক্য যে এই সিগন্যালের পর সবুজ সিগন্যাল আসে। লাল সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থামা চুপচাপ গাড়িগুলো হঠাৎ-ই চলতে শুরু করে। আর জীবনে এই লাল সিগন্যালের পর সবুজ সিগন্যালের মতো আর কোনো সুযোগ আসে না। জীবন এতো বৈচিত্রময়।

আরিয়ান গাড়ির ভেতর বসে আছে। দীর্ঘক্ষন যাবৎ লাল সিগন্যাল। ঢাকা-শহরের এই বিষয়টি তার মোটেও পছন্দ নয়। আধ-ঘন্টার রাস্তা যেতে এক-ঘন্টা পেরিয়ে যায়। এটা এখন একটা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। চারদিকে ব্যস্ত শহরের কোলাহল-ধ্বনি।
আরিয়ান বিরক্ত দৃষ্টিতে জানালার কাঁচ গলিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিল। আচমকা দৃষ্টি আটকে গেল বিপরীত পাশের একটা গাড়ির দিকে। গাড়ির ভেতর মলিন চেহারার অধিকারিণী সেই মেয়ের দিকে দৃষ্টি আটকে রইল। দীর্ঘ কতদিন পর! আরিয়ান মনে করার চেষ্টা করলো। প্রায় একমাস পর সেই চিরচেনা মুখটি দেখতে পাচ্ছে। খুব পরিচিত সেই মুখ। জানালার বাইরে মলিন দৃষ্টি দিয়ে আছে আরোহী। বুঁকের কোথাও জানি তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব হচ্ছে আরিয়ানের। তার দৃষ্টি এখনো ওই গাড়িটির দিকে।

আরোহী মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। আরিয়ানের বুক কাঁপছে। আরোহীকে একটু ছুঁয়ে দেওয়ার জেদ চেপেছে মনে। যদি পারতো! এমন কেন লাগছে তার! ‘আরু, আরু’ করে আপনমনেই বিড়বিড় করে উঠল আরিয়ান। নিজেকে পাগলপ্রায় মনে হচ্ছে। কত্তদিন পর! এই চেহারাটি দেখার জন্য কত ছটপটই না করেছিল এতদিন। এতদিনে বুঝতে পারলো আরিয়ান যে এই মেয়েটির মধ্যেই তার সব তৃষ্ণা।

আরিয়ান মাঝরাস্তাতেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। তার গন্তব্য বিপরীত পাশের গাড়িটি। সে গাড়িটির দিকে এগিয়ে যেতে নিতেই তার বুক ধড়ফড় করে উঠল। বুঁকের কোথাও অস্তির অস্তির লাগছে। আরিয়ান কাঁপা কাঁপা পায়ে কয়েক কদম পা বাড়াতেই ঠিক সে-সময় লাল সিগন্যালের বদলে সবুজ সিগন্যাল জ্বলে উঠল। সব গাড়ি হুড়মুড়িয়ে চলে যাচ্ছে। আরিয়ান আর পা বাড়াতে পারলো না। অন্য গাড়িগুলোর সাথে সাথে আরোহীর গাড়িটাও চোখের পলকেই চলে গেল। আরিয়ান দ্রুত গাড়িতে উঠতেই আরোহীর ওই গাড়িটা নিমিষের মধ্যে মিলিয়ে গেল। সে মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলো। আরোহীকে আবারও হারিয়ে ফেলল সে। ‘না, আমি ঠিকই খুঁজে নিবে। আমার আরু এখানেই আছে।’ আপনমনেই বিড়বিড় করে বলে উঠল আরিয়ান।

————
বাসায় ফিরেই আরোহী রুম থেকে বেরিয়ে রুহানকে কোলে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। আমেনা আহমেদ কড়ায়তে কী যেন ভাজছিলেন। আরোহীর অস্তিত্ব অনুভব করতে পেরে চুলোর কড়ায়ে ঢাকনা দিয়ে হাসিমুখে আরোহীর দিকে ফিরলো।

‘তোর ইচ্ছে পূর্ণ হলো হয়েছে?’

আরোহী হেসে আমেনা আহমেদকে জড়িয়ে ধরলো। আজ তার খুশির দিন। হোক না কোনো ছোটোখাটো চাকরি। তবুও একটা চাকরি তো। সে তো আরামসে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে।
আমেনা আহমেদও মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলো। অবশেষে মেয়েটার মুখে রাজ্যের খুশি দেখা গেল।

‘জয়েন কখন!’
‘কাল’ বলেই আরোহী আমেনা আহমেদের দিকে তাকিয়ে উসকুশ করতে লাগলো। তা দেখে আমেনা আহমেদ আরোহীর মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাস দিল।

‘কী কিছু বলবি, মা?’

‘বলছি কী খালা। এইবার তো চাকরি পেয়ে গিয়েছি।’

‘হু, তো!’

‘সেটা দিয়েই তো আমি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো। বলছি কী, যদি আরেকটা বাসায়…’ আরোহী মিনমিনিয়ে বলে উঠল।

‘এসব কী বলিস! জীবন কাটিয়ে দিবি মানে কী! তোর জীবন তো এখনো পড়ে আছে। আর আরেকটা বাসা বলতে। এটা কী তোর বাসা নয়!’

‘কিন্তু…’

‘কোনো কিন্তু নয়। তুই আমাকে খালা দেখেছিস তো? মন থেকে ডাকলে এই কথা বলতি না।’

আরোহী কীভাবে বুঝাবে ভেবে পাচ্ছে না। এই মানুষটা তাকে বেশি ভালোবাসে সেটা বুঝতে পারছে কিন্তু এভাবে এমন একটা মেয়েকে নিজের ঘরে আশ্রয় দিচ্ছে!

‘খালা, তুমি বুঝতে পারছো না। আমার আরেকটা বাসায় যাওয়া দরকার। অন্তত নিজের জন্য হলেও। তোমরা আমাকে মেয়ের মতো করেই বিনা স্বার্থে অনেক করেছো সেজন্য আমি আজীবন ঋণী থাকবো কিন্তু তাই বলে সুযোগকে সবসময় ব্যবহার করবো!’

আরোহীর কথায় আমেনা আহমেদ কিছু সময় নিয়ে কী যেন ভাবলেন। এরপর মাথা উঁচু করে আরোহীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

‘আচ্ছা, বিকেলে গিয়ে আমরা একসাথে বাড়ি দেখে আসবো, ঠিক আছে?’ বলেই তিনি সবজি কাটতে নিতেই আরোহী আগ-বাড়িয়ে নিয়ে নিল।

বিকালে আরোহী আর আমেনা আহমেদ দুইজনে গিয়ে একটা বাসা দেখে আসলো। মূলত আমেনা আহমেদ নিজেই আরোহীকে সেই বাসায় নিয়ে গিয়েছিলো। বাসার মালিক আমেনা আহমেদের পরিচিত তাই বিনা কথায় আরোহীকে বাসা ভাড়া দিয়ে দিয়েছে কিন্তু অন্যরা আরোহী একা মেয়ে মানুষ থাকবে বলতেই সোজা মুখের উপর না করে দিয়েছিল। তাই আমেনা আহমেদ নিজের পরিচিত বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। বাসা বলতে দুইটা ছোট্ট রুম। তা দিয়ে আরোহী ভালোভাবেই চলে যাবে। আমেনা আহমেদ একমাসের বাসা ভাড়া অগ্রিম দিয়ে এসেছিলো। আর কিছু টুকটাক জিনিসও কিনে রেখে এসে বাসার পথে রওনা দিল।

———-

আরিয়ান আজ সারাদিন রুমের দরজা আটকে চুপচাপ বসে আছে। তার অস্তির অস্তির লাগছে। আরোহীকে পায়ে ঠেলে বড্ড বড়ো ভুল করে ফেলেছে সে। এই জীবনের প্রথম আরোহীর প্রতিই তার সব অনুভূতি এসেছিলো কিন্তু সেই মেয়েটিকেই মায়ের কথায় দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো। কিভাবে আবার ফিরে পাবে তাকে!

গভীর নিস্তব্ধ রাত। চারদিকে নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে। আরোহী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শান্ত দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কোলা এলোমেলো লম্বা চুলগুলো ক্ষনে ক্ষনে হাওয়ায় উড়ছে। কপালের উপর অবাধ্য চুলগুলো এসে লুটোপুটি খাচ্ছে, আরোহীর সরাতে ইচ্ছে করলো না। পরনের শাড়ির আঁচল দমকা হাওয়ায় এলোমেলো ভাবে উড়ছে। আরোহীর দৃষ্টি শান্ত।

নিহানের আজ বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হলো। অবশ্য রাত হয়েছে না সে নিজেই করেছে। তার ডিউটি অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়। মাঝে মাঝেই দেরি হয় কিন্তু সে প্রতিদিনই মা-বাবাকে বুঝ দেয় যে ডিউটি ছিল। মূলত সে রাস্তার ধারের ব্রিজে দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে রই। সেই ব্রিজটা মিথিলার প্ৰিয় ছিল। মাঝে মাঝে গভীর রাতে সে বায়না ধরতো যেন তাকে ওই ব্রিজের ধারে নিয়ে যায় আর তারা দুজন একাকী সময় সে ব্রিজে কাটাতে পারে। মিথিলা কান পেতে শান্ত নদীর পানির কুলকুল শব্দ উপভোগ করতো সাথে জোর করে নিহানকেও শুনাতো কিন্তু নিহানের কোনোকালেই পছন্দ ছিল না। মিথিলা চলে যাওয়ার পরে নিহানও মন দিয়ে শুনে। কোনোকালেই এই জায়গাটা তার পছন্দ ছিল না কিন্তু মিথিলা চলে যাওয়ার পর সে এই জায়গার মায়ায় গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে।

বাসার কাছে এসে নিহানের গাড়ি থামতেই সে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। বাসার দিকে পা বাড়াতে নিতেই উপরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য মনস্ক আরোহীর দিকে চোখ পড়লো। নিহান নিজেই ভাবনায় মশগুল হলো, এতো রাত জাগে মেয়েটা! সে মলিন শ্বাস ফেলল। এই পৃথিবীতে একেক জনের কষ্টের প্রকাশ একেকরকম। নিহান এক ফলক আরোহীর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে