#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৯
ব্যালকনির এক কিনারে প্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আরোহী। চুল-গুলো এলোমেলো হয়ে বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে উড়ছে। ক্ষনে ক্ষনে শীতল হাওয়া জানান দিচ্ছে, আজ প্রচন্ড ঠান্ডা পড়বে। আরোহী শীতের প্রকোপে কেঁপে কেঁপে উঠছে কিন্তু এই মুহূর্তে ব্যালকনি ছেড়ে যেতে তার মোটেই ইচ্ছে করছে না। তার মলিন দৃষ্টি দূরের উক গাছের দিকে। সেখানে দুইটা পাখি কী সুন্দর করে একে অপরের সাথে সুখ-দুঃখের গল্পঃ করছে। এদের কিচির-মিচির ডাকে যেন সব অনুভব করতে পারছে আরোহী। এমন কোনো দৃশ্য চোখে পড়লেই আরোহীর চোখ ভিজে উঠে। আরিয়ানের কথা মাঝে মাঝে বড্ড মনে পড়ে। কেমন আছে মানুষটা! হয়ত ভীষণ সুখে আছে নতুন বউকে নিয়ে! আচ্ছা আরোহীর সাজানো সংসার স্নেহা কী আবার নতুন করে সাঝিয়েছে! আরিয়ান আরোহীর সব অধিকার হয়ত স্নেহাকে দিয়ে দিয়েছে এতদিনে। আচ্ছা, আরিয়ান বাড়ি ফিরে আরোহীকে কী খুঁজেনি! আরোহীর মনে সাথে সাথে বার্তা এলো,’খুঁজলে কী আর তুই এখানে আসিস এখন!’ আরোহী মানতে চাইলো না কথাটা। তার মস্তিষ্ক বলে উঠল যে আরোহী তো একটা বাসায় পড়ে আছে সারাদিন, এত্তো বড়ো শহরে তাকে খুঁজলেও পাবে কই, হয়ত একটু হলেও খুজবে কিন্তু মন মানতে চাইল না। আরিয়ান একটু মন দিয়ে খুঁজলেই হয়ত আরোহীর নিশানা পেতো। এক বছরে কী আরোহীর প্রতি আরিয়ানের একটুও মায়া বসেনি! সেই মধুর দিনগুলো ভীষণ রকম স্মরণ করছে আরোহী। আজ তার শাশুড়ি লুৎফা বেগম যদি আমেনা আহমেদের মতো হতো তাহলে হয়ত আরোহী আজ আগের জায়গায় সুখে থাকতো। কেন মানুষ একেকজন একেকরকম হয়! সবাই ভালো হতে পারে না! সবাই একরকম ভালো হলে হয়ত এই নিষ্ঠুর দুনিয়াটা পাল্টে যেতে দুই মিনিট সময় নিতো না!
ভোর ফুটতে শুরু করেছে। চারদিকে আস্তে আস্তে কোলাহল বাড়ছে। সকালে ভোর ফোটার সময় এই স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে লাগলে ভীষণ ভালো লাগে। রাতে তেমন একটা ঘুম না হওয়ায় সকাল সকাল উঠে গোসল সেড়ে নিয়েছে। লম্বা চুল বেয়ে বেয়ে পানি চুপসে চুপসে পড়ছে। পরনের শাড়ি কোমরের দিকে ভিজে যাচ্ছে কিন্তু সেদিকে আরোহীর খেয়াল নেই। পুব আকাশে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। দেখতে দেখতে চারদিকে সূর্যের কিরণ তির্যক ভাবে ছড়িয়ে পড়লো। আস্তে আস্তে নীরব রাস্তাটা কোলাহলে ভরে এলো। কেউ কেউ চাকরিতে যাচ্ছে আবার কেউ কেউ বাচ্চা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। একেকজনের উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন আরোহী রাস্তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সূর্যের দিকে তাকালো। ছোটবেলায় আশ্রমের খেলার সঙ্গীদের সাথে খেলতে খেলতে হঠাৎ আরোহীর একটা ইচ্ছে জাগতো। সে বলে উঠতো,’এই চল, আমরা একটা খেলা করি যে আমাদের মধ্যে কে কতক্ষন সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে!’ আরোহীর কথায় সবাই রাজি হতো। সূর্যের দিকে কিছুক্ষন তাকাতেই সবার চোখ দিয়ে পানি পড়ে অনেকে চোখ বন্ধ করে ফেলতো। তেমন সময় খালা দৌড়ে এসে বলতো,’এসব খেলা কী শিখিয়েছে!’ খালার কথায় সবাই আরোহীর দিকে ইশারা করলে তিনি আরোহীর পাশে এসে মাথায় একটা ছোট চাপর মেরে বলতো,’এসব ভালো না। চোখ নস্ট হয়ে যাবে।’ আরোহী তখন অবুঝের মতো বলে উঠতো,’খালা চোখ দিয়ে পানি পড়লে ভালো লাগে আমার। নাক-মুখ লাল হয়ে যাওয়া, চোখ ফুলে যাওয়া। সুন্দর না?’
তখন খালা আরোহীর কথায় তার দিকে তাকিয়ে থাকতো আর বলতো,
‘একদিন বড়ো হয়ে এসব আর ভালো লাগবে না। সুন্দরের কথা আর মাথায়ও থাকবে না।’
আরোহী কিছু বুঝে উঠতে পারতো না তখন । শুধু অবুঝের দৃষ্টিতে খালার দিকে তাকিয়ে থাকতো।
আরোহী আর বেশিক্ষন সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। চোখ দিয়ে অশ্রু বেরিয়ে গেছে। সে দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেলল। এরপর আবার চোখ খুলতেই আশপাশ অন্যরকম লাগলো। আজ অনেকদিন পর সেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আসলেই খালার কথায় সঠিক। একটা সময়ের পর সৌন্দর্যের আর কোনো মূল্য থাকে না। আসল তো কপাল।
আরোহী রুমে এলো। আজ রুহান এলো না একবারও। কী জানি হয়ত বাবাকে কাছে পেয়ে। এমনি এতদিন প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সোজা আরোহীর কাছে এসে তার কোলে উঠে যেত। আরোহী মুখ ধুয়ে ফ্রেশ করে খাবার খাইয়ে দিলেই খেত কিন্তু আজ আসলো না। আরোহীর হঠাৎ খারাপ লাগা কাজ করতেই সে তাচ্ছিল্য হাসলো। দুইদিনে একটু সুখ পেয়েছে বুঝি একেবারের জন্য সুখটা নিজের হয়ে গেল সেটা ভাবলো কী করে! আরোহী তো পর। হয়ত রুহান তাকে দুইদিনে নিঃসন্তানের সুখটা পূর্ণ করেছিল কিন্তু তা তো একেবারের জন্য নয়!
আরোহী আর কিছু না ভেবে ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানির ঝাপ্টা দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে সিঁড়ির ধাপে পা বাড়াতে নিতেই বিপরীত রুমের দরজার দিকে চোখ যেতেই কালকে রাতের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল।
কাল রাতে যখন মানুষটা এলোমেলো ক্লান্ত পায়ে দরজা খুলে বাসায় ঢুকে তখন অন্ধকারের মাঝে আরোহী ভালোভাবে মুখ দেখেনি। সে ভেবেই নিয়েছিল চোর। এক মুহূর্তও মাথায় আসেনি যে চোর কিভাবে ভদ্র পোশাকে গাড়ি নিয়ে আসবে!
যখন একবার চোর উচ্চারণ করলো ঠিক ওই সময়ে নিহানের দৃষ্টি আরোহীর দিকে পড়লো। অন্ধকার বিধায় কেউ কারো চেহারা তেমন একটা দেখেনি।
মানুষটা ভ্রু-কুঁচকে এগিয়ে এসে আরোহীকে প্রশ্ন ছুড়লো,’কে আপনি!’
‘আআরোহী ‘ সে কোনোমতেই উচ্চারণ করলো। আরোহীর নাম শুনে নিহান নামক মানুষটা চমকালো না। হয়ত আমেনা আহমেদের কাছ থেকে শুনে চিনে নিয়েছে।
‘আমি নিহান, চোর নয়!’ আরোহীর ভাবনার মধ্যেই নিহান নামক মানুষটা আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল।
এদিকে আরোহী লজ্জায় মাথা নুয়ে ফেলল। শেষপর্যন্ত বাড়ির ছেলেকে কিনা চোর বানিয়ে ফেলল!
রাতের ঘটনাটা মনে করেই আরোহী হেসে দিল। কী এক লজ্জাকর পরিস্তিতি!
———–
আরিয়ানের দিন এখন শুরু হয় তিক্ততায় ঘেরা। আজও ব্যতিক্রম নয়। অ্যালার্ম এর কান-ফাটা শব্দে কপাল কুঁচকে সে উঠে বসলো। বসা অবস্থায় কিছু সময় দু-কান চেপে ধরলো। প্রতিদিন প্রতিদিন মাথার পাশে অ্যালার্মের তীব্র ঝাঁঝালো শব্দে মাথা ব্যথা উঠে যায় কিন্তু কিছুই করার নেই। স্নেহার সাথে এই অ্যালার্ম নিয়ে প্রতিদিন ঝগড়া হয়। মেয়েটা বিয়ের আগে ছিল একরকম আর বিয়ের পর আরেকরকম হয়ে গেল। বিয়ের আগে এখানে বেড়াতে আসলে অনেক তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে আরোহীর আগে নাস্তা বানিয়ে ফেলতো কিন্তু এখন আরিয়ানের অফিসের টাইম হয়ে গেলেও ঘুম থেকে উঠে না। আরও অ্যালের্মের শব্দে বিরক্ত হয়ে বলে অ্যালার্মটা যাতে আরিয়ানের একদম পাশে রাখে। স্নেহার ঘুমে যাতে ডিসটার্ব না হয়। আজও এর ব্যতিক্রম নয়। অথচ আরোহী থাকাকালীন আরিয়ানের কোনোদিন অ্যালার্ম এর প্রয়োজন পড়েনি। আরোহী সকাল সকাল উঠে নাস্তা বানিয়ে আরিয়ানের কাছে আধঘন্টা আগে এসে হাজির হতো এরপর আস্তে আস্তে ডাকতো। সে জানতো আরিয়ানের মাইগ্রেন আছে, হুট্ করে বেশি আওয়াজ করে ডাকলে মাইগ্রেনের ব্যথা উঠতে পারে তাই আস্তে আস্তে ডাকতো কিন্তু এখন এসব অতীত। সময়ের সাথে সাথে সব বদলে গেছে। এখন আরিয়ানের নিত্যসঙ্গী মাইগ্রেন।
আরিয়ান মাথা ধরে উঠে দাঁড়ালো। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে রুমে এসেও স্নেহাকে ঘুমিয়ে দেখলো। আরিয়ান চুপচাপ তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। ড্রয়ইং রুমে আসতেই দেখলো রান্নাঘর থেকে টুংটাং আওয়াজ আসছে। আরিয়ান এগিয়ে গেল।
রান্নাঘরে মাকে কাজ করতে দেখে একটা মলিন শ্বাস ফেলল। এখন এসব সবসময় চলে। স্নেহা বেলা বারোটায় উঠে নাস্তা সেড়ে আবারও রুমে চলে যায়। সব কাজ লুৎফা বেগনকেই করতে হয়। এই বৃদ্ধ বয়সে এসব আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় কাজ করতে তার শরীর সয় না।
#চলবে ইনশাআল্লাহ।