#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৭
আরিয়ান বিমর্ষ চেহারায় বসে আছে। মাথায় হাত দিয়ে তার নিজের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। যত খুশি হয়ে বাসায় এসেছিলো, দরজা দিয়ে ঢুকতেই সব খুশি উধাও হয়ে গিয়েছে।
পাশেই স্নেহা আর লুৎফা বেগম দাঁড়িয়ে আছে। তারা একজন আরেকজনের দিকে কিছুক্ষন পর পর তাকাচ্ছে। স্নেহাকে ভয় পাওয়া অবস্থায় দেখা গেল। লুৎফা বেগম স্নেহার এমন ভয়ের দৃষ্টি দেখে চোখ দিয়ে আশ্বাস দিল যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যা করার তিনি নিজেই করে নিবেন।
লুৎফা বেগম দৌড়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। এরপর আবারও অস্তির চিত্তে হাতে একটা কাগজ নিয়ে হাজির হলো।
‘দেখ বাবা, দেখ।’
লুৎফা বেগমের হাত থেকে এগিয়ে দেওয়া কাগজটার দিকে আরিয়ান এক ফলক তাকালো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। লুৎফা বেগম ইশারা দিয়ে কাগজটা নিতে বলতেই আরিয়ান কাগজটা নিল।
দুই হাতে কাগজটা ধরে দৃষ্টি দিতেই সে স্তব্ধ হয়ে গেল।
‘আরে, এটা এটা তো ডিভোর্স পেপার!’
লুৎফা বেগম যেন এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি মুখটাকে কাঁদো কাঁদো করে বলে উঠলেন,
‘হু সেটাই আর কী। নিচে দেখ।’
লুৎফা বেগমের কথা অনুসারে আরিয়ান নিচের দিকে তাকাতেই আরোহীর সাইন দেখে আরও একবার শক খেল। আরোহীর সাইন জ্বলজ্বল করছে। আরিয়ানের মনে হচ্ছে ওই একটা সাইনই যেন আরিয়ানের চোখের দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে । ‘আরু, আরু আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে!’ বিড়বিড় করে আওড়ালো। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে আরোহী তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। সে দ্রুত পদে উঠে ড্রয়ইং রুম থেকে ঘরের প্রতিটা রুমে আবার গেল। আনাচে-কানাচে সব জায়গায় খুজলো। ঘরে আরোহীর কোনো ছায়াও পেল না। আরিয়ানকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। তার বিশ্বাস আরোহী এখানেই আছে আর থাকবে। আরোহীর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ও কই যাবে! আরিয়ান দ্রুত সব রুম খুঁজেও যখন আরোহীকে পেল না তখন ড্রয়ইং রুমে এসে আবারও ডিভোর্সের কাগজটা নিয়ে সে ধপ করে বসে পড়লো।
আরিয়ানের এই অবস্থা দেখে স্নেহা লুৎফা বেগমকে ইশারা করলো। আগুনে ঘি ঢালার সময় এখনই।
লুৎফা বেগম ইশারা দিয়ে স্নেহাকে আস্বস্ত করলেন।
‘জানিস বাপ্, ঐদিন সকালে উঠে আমার আর স্নেহার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটি ডিভোর্স এর এই পেপারটি ছুঁড়ে মেরে বলেছিলো তুই যেন সাইন করে দিস। তারপর রুমে গিয়ে আমাদের সামনে সজোরে দরজা আটকে দিয়েছিল। আমাদের কিছু বলারও সুযোগ দিল না। আমরা কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি, তারপর স্নেহা সেই পেপারটা নিয়ে দেখলো সেটা ডিভোর্স পেপার আর সেখানে মেয়েটির সাইন। দেখেছিস? তার মানে মেয়েটি অনেক আগে থেকেই ডিভোর্সের বন্দোবস্ত করে রেখেছে। একদিনে কী আর এই সব করা সম্ভব!’
হরহর করে সব একনাগাড়ে বলে থামলো লুৎফা বেগম। তার বলা শেষেই তিনি আরিয়ানের দিকে তাকালেন যে তার রিঅ্যাকশন কেমন!
আরিয়ান সব শুনে মাথা চেপে বসে পড়লো। এমন জানলে সে জীবনেও ঐদিন অফিসের কাজে যেত না। এমন কেন লাগছে তার! ঐদিন আরোহীর ‘বিদায়’ বলার ধরণ আর সে-শব্দটা শুনে আরিয়ান কিছু সময়ের জন্য থমকে গিয়েছিল। আরোহী কোনোবার আরিয়ান বাইরে গেলে ‘বিদায়’ শব্দটা বলতো না, অন্য কোনো কিছু বলে বিদায় দিতো। সেদিনের কথাটি শুনে আরিয়ানের অন্য রকম লাগলেও পরে অফিসের বসের কল চলে আসায় দ্রুত পদে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। তাই আর কোনো কিছু বলার সুযোগ পায়নি। আরিয়ান নিজের মাথার চুলগুলো আরও জোরে টেনে ধরলো। সেদিনই বোঝা উচিত ছিল তার। কোথায় খুজবে সে এখন আরোহীকে! এমন কেন লাগছে তার। বুঁকের কোথাও জানি ভীষণ খালি খালি লাগছে। এতদিন মনে করেছিল, আরোহীর প্রতি তার আর কোনো মায়া নেই কিন্তু এই বিয়েটা করার পর থেকে বুঝছে আরোহী তার মনের কত্ত গভীরে রয়েছে। কিভাবে থাকবে সে আরোহীকে ছাড়া!
———–
আরোহী রান্নাঘরে আমেনা আহমেদের সাথে হাতে হাতে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছিলো। তিনি আরোহীকে গল্পঃ বলতে বলতে রান্না করছিল। তার ছেলে, ছেলের বউ এর গল্পঃ বলে বলে স্মৃতিস্মরণ করছিলো।
‘আমার নিহান অনেক জেদি একটা ছেলে। কোনো কিছু তার চাই মানেই চাই। মিথিলাকেও সেভাবেই বিয়ে করেছিল। মিথিলা বিয়ে হওয়ার পর পর তাদের প্রেম কাহিনীটা প্রায় সময় আমাকে বলে বলে হাসতো। মূলত মিথিলাই তাদের সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।’ বলেই আমেনা আহমেদ তেলে পেঁয়াজ-মরীচ ছেড়ে দিলেন। এরপর সেখানে মশলা-পাতি দিয়ে নাড়তে নাড়তে আবারো বলা শুরু করেন,
‘জানো? মিথিলা না-কি নিহানকে প্রথম প্রথম প্রচুর বিরক্ত করতো। আমার নিহানকে না-কি প্রথম দেখেই তার মনে এক অন্য রকম অনুভূতি হয়। কী জানি একটা শব্দ বলতো মিথিলা। কাশ না-কি কী একটা জানি!’
‘ক্রাশ!’ আরোহী আমেনা আহমেদের কথার ধরণ দেখে হেসে ভুল শুধরে দিতেই উনি আবারো বলে উঠলেন,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ ঐটা। নিহানও মেডিকেলের ছাত্র ছিল কিন্তু মিথিলাদের থেকে সিনিয়র।’
‘তার মানে মিথিলা আপুও ডাক্তারি পড়েছিলেন!’ আরোহী আমেনা আহমেদের কথার মাঝে প্রশ্নঃ করলো।
‘হ্যাঁ, সেই সুবাদেই তাদের দেখা। তাদের বলতে মূলত মিথিলা প্রথম সেখানেই দেখেছিল নিহানকে। এরপর থেকে না-কি টানা এক বছর নিহানকে দেখতো। এর পরের বছর থেকে নিহানের পেছনে ঘুরঘুর করা শুরু করেছিল। নিহান প্রথম প্রথম না-কি অনেক রেগে যেত। একবার কী হয়েছে জানো?’
আরোহীর এদের প্রেম-কাহিনীর শুরুটাতে ভীষণ আকর্ষণ বোধ করছিল। তাই সেও প্রতিউত্তরে জিজ্ঞেস করলো যে কী হয়েছে!
‘নিহানের পেছনে বেশি ঘুরঘুর করতো তাই সে মিথিলার আচরণে সহ্য করতে না পেরে থা’প্প’ড় মারতে গিয়েছিল।’
‘কী বলেন! তারপর! মেরেছে না-কি!’
‘না আবার মারেনি। আমার ছেলে মেয়েদের কাছে কম ঘেঁষতো আর কোনো মেয়ে ওর পাশে ঘেঁষতে চাইলেও রেগে যেত আর মেয়েদেরকে সম্মানও করতো প্রচুর কিন্তু মিথিলার এরূপ আচরণে টানা দেড়বছর অতিষ্ট হয়ে মারতে গিয়েছিল। মিথিলা অবশ্য বুঝে গিয়েছিল যে নিহান কোনোদিনও মেয়ের গায়ে হাত তুলবে না হয়ত ভয় লাগাচ্ছে। যখন ভয় লাগানোর পরও মিথিলা ভয় পেলো না তখন নিহান বুঝে নিয়েছিল যে এই মেয়ে তাকে সহজে ছাড়বে না। এরপরের এক মাস ভালোই কাটলো তাদের দুজনের। নিহানের ডাক্তারি পড়া শেষে চাকরি নিয়েই মিথিলাকে পাঁচমাস পর একেবারে বউ রূপে বাসায় এনেছিল।’
আরোহী এদের প্রণয়ের কাহিনী শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে গেল। কত্ত কষ্টে মিথিলা সুখের সন্ধান পেল! কিন্তু সেই সুখ তার কপালে বেশিদিন সইলো না। নিয়তি এতো নিষ্ঠুরও হয়! সেই মেয়েটা সুখের সময়ে’ই হারিয়ে গেল, একেবারের জন্য চলে যেতে হলো। নিজের সবচেয়ে সুখ যার মধ্যে নিহিত, সেই বাচ্চাটাকেই দেখে যেতে পারলো না! আরোহীর হুট্ করে একটা ইচ্ছে হলো। যদি তার এই প্রাণটার বিনিময়ে হলেও মিথিলা বেঁচে থাকতো! তাহলে হয়ত একটা সুখের সংসার বেঁচে থাকতো।
হঠাৎ এমন সময় রুহানকে দৌড়ে আসতে দেখে আরোহী ফিরে তাকাতেই দেখলো রুহান হাতে মোবাইল নিয়ে আরোহীর দিকে তাক করে বলে উঠল,
‘বাবাই, বাবাই। আমার নতুন আন্টিকে দেখবে তুমি!এই দেখো!’
আরোহী স্ক্রিনে দৃষ্টি দিতেই দেখতে পেল ওই পাশের মানুষটা নিচের দিকে তাকিয়ে কী একটা যেন লিখছে। আরোহী বুঝতে পারলো ইনিই হয়ত নিহান হয়ত ছেলের সাথেও কথা বলছে আর নিজের কাজও করছে।
আমেনা আহমেদ রুহানের কথা শুনে দ্রুত এগিয়ে এসে রুহানের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে নিল। বিপরীত পাশের মানুষটিকে কিছু একটা করতে দেখে তিনি রেগে যাওয়া কণ্ঠে বলে উঠল,
‘এই সারাক্ষন খালি এগুলো কী করিস!’
আমেনা আহমেদের কণ্ঠস্বর পেতেই মানুষটি তার সামনের কাগজপত্র সরিয়ে স্ক্রিনে দৃষ্টি দিয়ে হাসলো।
‘আর বলো না মা। আরেকটা সার্জারি পড়ে গিয়েছে, কিছু কাজ করছিলাম। কেমন আছো তুমি আর বাবা কেমন আছে!’
‘হু ভালোই। ফিরবি কখন!’
‘কয়েকদিনের মধ্যে ফিরবো। বাবাকে দেখাও দেখি! রুহান জ্বালাচ্ছে না-কি!’
‘তোকে বলছিলাম না! আরোহী আসার পর থেকে তো আর তেমন জ্বালায় না। একদম লক্ষী ছেলে হয়ে গিয়েছে।’
আমেনা আহমেদ কথা বলতে বলতে মোবাইল নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওইপাশ থেকে আর কী বললো সেটা শোনা গেল না। আরোহী মলিন শ্বাস ফেলল। এতক্ষন পাশে ছিল বিধায় সে স্ক্রিনে দেখেছিল মানুষটাকে। হুটহাট রুহান এমন কাজ করে ফেলে না! আরেকটু হলেই তার প্রাণটাই হয়ত চলে যেত ভয়ে। এইবার বুঝতে পারলো রুহান কার মতো হয়েছে! ছেলেটা পুরোই বাবার মতো হয়েছে। ফর্সা, গুলগাল চেহারা। আরোহী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মানুষটাও হয়ত বুকে এক আকাশ সমান দুঃখ রেখে পরিবারের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলছে! মানুষ উপরে দেখাই একরকম আর ভেতরে অন্য রকম!
#চলবে ইন শা আল্লাহ।