#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৩
আরিয়ান মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেইন দরজার দিকে পা বাড়াতে নিতেই আবার পেছন ফিরে গেস্ট রুমের দরজার দিকে এক ফলক তাকালো। বিয়ের পর এরকম অফিসের কাজে আরিয়ান আরোহীকে বলা ছাড়া কোনোবার যায়নি। সে পেছন ফিরে গেস্ট রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। পরপর কয়েকবার ডাক দিয়েও ভেতর থেকে কোনো সাড়া-শব্দ আসলো না।
আরিয়ান মলিন দৃষ্টিতে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। তার এইবার আরোহীকে বলা ছাড়া না যেতে একরকম খালি খালি লাগছে।
কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকার পরও যখন দরজা খোলার কোনো শব্দ পেল না তখন আরিয়ান ভাবলো – হয়ত আরোহী দরজা খুলতে অনিচ্ছুক তাই শুকনো মুখে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সামনের দিকে পা বাড়ালো। এক পা অগ্রসর হতেই পেছন থেকে দরজা খোলার শব্দ হলো। সে দ্রুত ফিরে পেছনে তাকাতেই আরোহীর শুকনো মুখ আক্ষীযুগলে ভেসে উঠল। আরিয়ান শান্ত দৃষ্টিতে আরোহীর দিকে এক ফলক তাকালো। মনে হচ্ছে যেন কত যুগ যুগ ধরে এই মানুষটিকে দেখেনি।
সে পূর্ণ দৃষ্টি দিল আরোহীর দিকে। এক রাতেই চেহারার এমন হাল কেন মেয়েটার! মাত্র এক রাতেই মেয়েটা পাল্টে গেছে মনে হচ্ছে। সে সমবেদনা প্রকাশ করার পূর্বেই আরোহী তাড়া দিল।
আরিয়ান বুঝতে পারলো আরোহী তার সাথে কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করছে না।
‘আসলে কাল রাতে তাড়াহুড়োর মধ্যে আর ক্লান্তি ভর করাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই আর কথা বলা হয়নি। তুমি তো হয়ত রাতে খাওনি। এখন খেয়ে নিও।’
আরিয়ানের কথা শুনে আরোহী মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসলো। মায়া দেখাচ্ছে হয়ত! এতক্ষন সে আরিয়ানের দরজা নক করার আওয়াজ শুনেছিল, তবুও সে ইচ্ছে করে দরজা খুলেনি। খোলার ইচ্ছে হয়নি কিন্তু কেন জানি শেষ পর্যন্ত ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। এই মানুষটা হাজার হলেও আরোহীর ভালোবাসা। এই পৃথিবীতে তার একমাত্র আপন-জন। এই মানুষটাকে কিভাবে সে অগ্রাহ্য করবে! চেহারাটা শেষবারের মতো দেখার লোভটা আরোহী সামলাতে পারলো না। তাই তো সে ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে সব ভুলে দরজা খুলেছিল।
আরিয়ান আরোহীর চাহনি দেখে বুঝতে পারলো আরোহী এসবে কথা বলতে অনিচ্ছুক। তাই সে আর কথা বাড়ালো না। সে এক ফলক আরোহীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,
‘আমি অফিসের কাজে শহরের বাইরে যাচ্ছি। তাই ভাবলাম, তোমাকেও বলে যাই। তুমি এই বাড়িতে থাকতে পারো।’
আরোহী নিচের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরিয়ানের দিকে তাকালো। আরিয়ানের শেষ কথাটা তার কানে বাজছে। ‘থাকতে পারো!’ আরোহী বিড়বিড় করে মনের মধ্যে লাইনটা আওড়ালো। তার মানে, আরিয়ানও বুঝে গিয়েছে বুঝি যে এই সংসার এখন আর আরোহীর নাই, এই ঘরে এখন আর আরোহীর অধিকার নেই। আরোহীর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তাই হয়ত আরিয়ান কথাটা বললো। আরিয়ান এতোদিনেও আরোহীকে চিনে নিতে পারলো না। এতো কিছুর পরেও আরোহী নিজের সম্মান খুইয়ে এখানে থাকবে সেটা আরিয়ান ভাবলো কী করে! হয়ত আরোহীর যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট খুটি নেই বলেই বললো কিন্তু আরোহী অতো নরম নই। মেয়ে মানেই স্বামীর বাড়ি থেকে সব মুখ বুজে সহ্য করবে তা নয়। এতদিন ছিল বলে এখনও যে থাকবে তা নয়। এতদিন এই বাড়িটা তার নিজের সংসার ছিল তাই মুখ বুজে পড়ে রয়েছিল কিন্তু এখন আর নেই। এখন সে অধিকার আর নেই। এখন এই সংসারে আর পড়ে থেকে কী হবে! এখানে অন্যের সংসারে বোঝা হয়ে পড়ে থাকার চেয়ে মানুষের বাসায় কাজ করে খাওয়া ঢের ভালো।
আরোহী সব ভেবে শুকনো হেসে মাথা তুলে আরিয়ানের দিকে চোখ তুলে তাকালো। শান্ত, নির্জীব তার চাহনি। আরোহীর এই চাহনির দিকে দৃষ্টি দিতেই আরিয়ানের বুক কেঁপে উঠল। মনে হচ্ছে, মেয়েটি এই চাহনি দিয়ে নীরবে অনেক কিছু বলে যাচ্ছে কিন্তু আরিয়ান বুঝে উঠতে পারছে না। আরিয়ান মনে করলো আরোহী হয়ত জবাব দিতে চাচ্ছে না তাই সে লুৎফা বেগম আর স্নেহার দিকে তাকিয়ে ‘আসছি’ বলে পেছন ফিরে চলে যেতে উদ্যত হতেই আরোহীর শান্ত বাক্য কর্ণগোচর হতেই আরিয়ানের পা থেমে গেল।
‘দোয়া করি, আপনার বাকি পথ সফল হোক। ভালো থাকবেন। বিদায়।’
পকেটে মুঠোফোনটা বেজে উঠতেই নিস্তব্ধ পরিবেশটাতে ঝংকার তুলে মুহূর্তের মধ্যে ভারী করে তুলল। আরিয়ান দ্রুত ‘যাচ্ছি’ বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। আরিয়ানের যাওয়ার দিকে আরোহী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। যতক্ষণ না আরিয়ান চোখের আড়াল না হয় ততক্ষন তাকিয়ে রইল। আরিয়ানের মানব ছায়া পুরোপুরি চোখের আড়াল হতেই আরোহী তার ঝাঁপসা দৃষ্টিতে আরিয়ানের গমন পথ দিয়ে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উঠল।
‘আমার সাথে আপনার আর দেখা না হোক। আমার সাথে আপনার এটাই হয়ত শেষ দেখা। এই জীবনে আমার ছায়াও যেন আপনার উপর আর না পড়ুক।’
আরোহী আপন মনেই কথাগুলো দুইবার বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো। চোখের অশ্রু মুছে সে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। এতক্ষনে খেয়াল করলো, দুই নারী মূর্তি অগ্নিরূপ ধারণ করে তারই দিকে চেয়ে আছে।
‘মুখপুরী, আমার পোলাটারে এমনি এতদিন তো খাইয়া বইসাছিলি। কোনোমতে যারো বিয়া করাইলাম তুই এমন কইরা কথা বলছিলি ক্যান! নিজে তো একটা বংশের বাতি দিতে পারোস নাই। যাওয়ার সময়ও পোলাটারে তোর ট্যাঁরা কথা শুনাইলি! এমনি তো আছোস অন্যের সংসারে পড়ে, লজ্জা-শরম করে না তোর!’
আরোহী বিনিময়ে কোনো জবাব দেওয়ার প্রয়োজন-বোধ মনে করলো না। সে জানতো যে তার শাশুড়ি এমনই করবে। লুৎফা বেগমের এই কাজগুলো সে বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছে। আরিয়ান সারাদিন অফিস শেষে ফিরতেই কৈশোলে আরোহীর ব্যাপারে কান-পড়া দিতো কিন্তু যদি আরিয়ান বাসায় থাকতো তখন হাজার চেয়েও আরোহীর বিরুদ্ধে নিতে পারতো না কিন্তু তিনি আশা ছাড়তো না। এক বছরে আরোহীর তার শাশুড়ির এমন কাজে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। আগে এসব চুপচাপ শুনতো কিন্তু এখন আর শোনার কোনো মানে হয় না।
আরোহী চুপচাপ কোনো বাক্য ব্যায় না করে স্নেহা আর লুৎফা বেগমের মুখের উপর দরজা আটকে দিল। তা দেখেই লুৎফা বেগম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। আগুনে ঘি ঢালার জন্য স্নেহা বলে উঠল,
‘দেখলে তো খালা! উপস মা! দেখলে! কেমন মেয়ে, গুরুজনের মুখের উপর কীভাবে দরজা আটকে দিচ্ছে! এমন মেয়েকে তুমি আরও বৌমা বলতে!’
‘আমার পোলা আসুক। এর একটা বিহিত আমি করবোই।’
এরপর আর কোনো সাড়া-শব্দ শোনা গেল না। আরোহী বুঝতে পারলো, লুৎফা বেগম হয়ত রেগে হনহন করে প্রস্থান করেছে। স্নেহার কোনো সাড়া শব্দ শোনা যায়নি। তার কাজ তো হাসিল হয়ে গিয়েছে -শাশুড়িকে আরোহীর ব্যাপারে কান পড়া দেওয়া। সেটা আজ এইমূহুতে না হয় এতটুকুই থাক, সেজন্যই বুঝি আর কোনো জবাব দেয়নি।
আরোহী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সবকিছুর পরেও এই সংসারের মায়া সে ছাড়তে পারছে না। কীভাবে থাকবে এতদিনের মায়া মুছে! কার কাছে বুঝাবে সে তার দুঃখের কথা! এই মুহূর্তে আশ্রমের খালাকে তার ভীষণ করে মনে পড়ছে। খালাকে মনে পড়ায় আরোহী নিজের প্রতিই তাচ্ছিল্য হাসলো।
মানব জাতি বড়োই নিষ্ঠুর। সুখে থাকতে কাউকে খুঁজে না। সুখের সময় মানুষ সব সুখ শুধুমাত্র নিজের সাথেই ভাগাভাগি করে নিজেই উপভোগ করে কিন্তু দুঃখের সময়ই সবাইকে মনে পড়ে। দুঃখ পেলেই অসময়ে আগলে রাখা মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে যায় অথচ এর আগে তেমন একটা মনেই পড়ে না। যার প্রমান, আরোহী নিজেই। আশ্রমের খালাটাও তো আরোহীকে ভীষণ মায়া করতো কিন্তু আরিয়ানের সাথে বিয়ে হওয়ার পর থেকেই আরোহী ভুলে বসেছিল। অবশ্য, ভুলে নয়। সময়ের ব্যাবধানে ভুলতে বসেছিল। এখনও হয়ত মনে তেমন একটা পড়তো না যদি না আরোহীর এই দুঃখের সময়টা না আসতো! মানুষ বড়োই নিষ্ঠুর!
#চলবে ইন শা আল্লাহ।