#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৫+১৬
পথিব সকল পাপের মূল হচ্ছে লোভ। ভালো থাকার লোভে মানুষ কতকিছু করে। খারাপ কাজ করতেও পিছপা হয়না। আমি সুলতান রশীদ ফারুকীর একমাত্র পুত্র সুলতান ফারাবি ফারুকী। আমি বাবা মায়ের একমাত্র পুত্র সন্তান যদিও আমার আরেকটা বোন আছে। আমার বাবা বেশ প্রভাবশালী জমিদার ।।উত্তরাধিকারসূত্রে আমি বাবার সকল সম্পত্তির একমাত্র ওয়ারিশ। বোনের জন্য ছিল কিছু নগদ অর্থ আর বক্স বন্ধি স্বর্ণালঙ্কার। এটা নিয়ে বোন বা আমার কোনো অভিযোগ ছিল না। এটাইযে নিয়ম।।আমার বোন আঞ্জুমান ফারুকী যেনো আসমান থেকে নেমে আসা এক টুকরো চাঁদের কণা। প্রণাধিক প্রিয় ছিল আমার ভগ্নি। জলন্ত আগ্নি পিণ্ডের মতো ঝাঝালো ছিল ওর সৌন্দর্য। কন্ঠ ছিল ততধিক মধুর। আমাদের দু’ভাইবো মানুষ হয়েছিলাম কাজের মহিলা রহিমা খালার কাছে। আম্মা বহুকাল ইহজগৎ ছেড়েছেন। বাবা ছেলেমেয়ের মুখের দিকে তাঁকিয়ে আর দ্বিতীয় বিবাহের ঝামেলায় যাননি। ধীরে ধীরে আমরা দু’ভাইবোন বড় হলাম। বোনটা আমার থেকে বেশ ছোট। পরিণত বয়সের আগেই হঠাৎ বাবা আমার বিয়ে ঠিক করলেন উনার বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে। বাবার কথা আগ্রহ করার ক্ষমতা কোনকালেই আমার ছিল না। তাছাড়া বিয়ে করবো না বলার মাতো তেমন কোনো কারণও তখন হয়ে উঠেনি। নতুন বধূকে পেয়ে খুব একটা মন খারাপ হয়নি। লাজুক ভঙ্গিতে নব বধূকে বরণ করে নিয়েছিলাম নিজের বক্ষপিঞ্জরে। বেশ ভালোভাবেই চলছিল আমাদের দিনকাল। সারাক্ষণ বউয়ের দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসা সহসা দক্ষিণা দোলা দিতো হৃদয়ে।কিন্তু ভালো মূহুর্তগুলো চোখের নিমিষে পার হয়ে যায়। বাবা অসুস্থ হলেন,তাঁর জমিদারির ভার আমার উপরে এসে পড়লো। বিয়ের বছর খানিক হয়নি তখনও। খাজনা আদায় করতে আমাকে বিভিন্ন গ্রামগঞ্জে যাওয়া আসা লাগতে থাকলো। আমি দক্ষ হাতে সবটা সামলাতে থাকলাম। বাবা ভরসাস্থল পেয়ে সুস্থ হয়েও আর কাজকর্ম করলেন না। ছেড়ে দিলেন আমার হাতে। আমি একজন দক্ষ জমিদার বনে গেছি। কোন এক গ্রীষ্মকালের সকালবেলায় বাড়ি থেকে রওনা হলাম দূরের এক গঞ্জে। কয়েকদিনের সফর। সঙ্গে নিয়েছি লাঠিয়াল বাহিনী পালকী আর আমার একমাত্র বিশ্বস্ত কর্মচারী জাফরুল্লাহ শেখরকে। লোকটা আমার নায়েবের কাজ করতো। একদম খাস কর্মচারী যাকে বলে। যখন যা বলেছি প্রশ্ন ছাড়া হাজির করেছে। এমন ছেলেকে পেয়ে আমি সত্যিই সৌভাগ্যবান ছিলাম। যাইহোক টানা একদিন চলল আমাদের পালকী। রাতে তাবু ভিড়িয়ে নিলাম একটা পদ্ম দিঘি সামনে রেখে। যদিও সামান্য দুরুত্ব ছিল তবুও অসুবিধা কিছু হতো না। গ্রামের প্রথমেই পুকুরটা পড়েছে। ভাবলাম পানির অসুবিধা থেকে বাঁচতে এটাই আমাদের উপযুক্ত স্থান। সেদিন রাতটা বেশ ভালোভাবে পার করলাম। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি লাঠিয়াল বাহিনীকে পাঠিয়ে দিলাম গঞ্জের হাট থেকে খাবার কিনে আনতে। চাল ডাল এনে ওরা রান্না বসিয়ে দিলো। আমি তাবুতে থেকে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। জানিনা কিসের এত ছটফটানি। কোন সর্বনাশের ঈঙ্গিত। আমি তাবু থেকে বেরিয়ে আসলাম। হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে গেলাম পুকুরের কিনারে। হঠাৎ পানির ঝপঝপ তরঙ্গে আমার দৃষ্টি সেদিকে পতিত হলো। ক্ষণিকের জন্য আমি থমকে গেলাম। দৃষ্টি স্থির হলো। আকাশ থেকে নেমে আসা কোনো হুর পদ্ম দীঘির পানিতে নেমে এসেছে। আমি দিসা হারা পথিকের ন্যায় এলোমেলো পা ফেলে সেদিকে এগিয়ে চললাম। হৃদয় পুলকীত হলো মেয়ের রূপের বাহার দেখে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মেয়েটার সম্মুখীন গিয়ে উপস্থিত হলাম। মেয়েটা ততক্ষণে কন্ঠ অবধি পানিতে নিজেকে নিমজ্জিত করে ফেলেছে। ভেজা কাপড় আর দীর্ঘ কেশ পল্লব গায়ের সঙ্গে লেপ্টে আছে। অবশিষ্ট পোশাক পানিতে ভাসমান। মেয়েটা দু’হাতে শরীর ঢাকায় চেষ্টা করছে কিন্তু ব্যার্থ। দীঘির স্বচ্ছ কাচের ন্যায় পানিতে আমি ওর ঠিকরে পড়া রূপের যাদুতে ঘায়েল । মেয়েটার মিষ্টি কন্ঠস্বরে আমার ধ্যান ভাঙলো,
> কে আপনি? এখানে কোন সাহসে এসেছেন? জানেন না এই পুকুরের আশেপাশে পুরুষের আসা নিষেধ?
মেয়েটা একদমে কথাগুলো বলে থামলো। আমি ফিচেল হাসলাম। জমিদার ফারাবি ফারুকীকে আটকাবে এমন সাহস এই এলাকায় কার আছে? আমি জমিদার পুত্র নিজের সয়ং জমিদার। যা আমার পছন্দ যা আমি নিতে আগ্রহী সেটা শুধুই আমার। আমি উপলব্দি করলাম দীঘির পানিতে অবস্থান করা ওই জলপরি শুধু আমার সম্পত্তি। শুধুই আমার। ঘরে যে স্ত্রী আছে সেটা বেমালুম ভূলে গিয়ে এই রূপসীর প্রেমে আমি হাবুডুবু খেলাম। মনে হলো আমি মদ্যপান করেছি। এতো নেশা আগে কখনও বুঝিনি। একেই বলে হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। আমার সমস্ত ভাবনার অবসান ঘটিয়ে সামনের মেয়েটাকে বলে উঠলাম
> এহেন সময়ে তুমি দীঘিতে গোসল করছো মেয়ে? যদি পুরুষেরা আসে তখন? সমাজে মুখ দেখাতে পারবে? একঘরে করবে যে লোকে!
আমার প্রশ্ন শুনে মেয়েটা ভড়কে গেলো। নেত্র পল্লবে নেমে আসলো অশ্রুকণা। দীঘির পানিতে তা মিলেমিশে একাকার। আমি হাসলাম। এটাইতো চেয়েছিলাম আমি। আমাদের মুসলমান সমাজের মেয়েদের বাইরে গোসল করা তো দূর লেখাপড়া করার নিয়ম পযর্ন্ত নেই। উচ্চবিত্তরা খুব সখের বসে বাড়িতে মাস্টার রেখে শেখাতে পারে তবে সেটা খুব সৌখিন। বাংলা উপ্যাস বা গল্প আর আরবি জানতে পারলেই সে উচ্চতর শিক্ষিত মেয়ে। বিয়ের বাজারে এহেন মেয়ের দাম নেই বললেই চলে। মেয়েরা হবে পানির মতো স্বচ্ছ আর তরল । যেখানে রাখবে তেমনি চলতে হবে। যথেষ্ট কারণ আর পর্দা নিয়ে বাইরে যাওয়ায় যায়। কিন্তু এই মেয়েটা এত বাধা নিষেধ অবজ্ঞা করে কিভাবে দীঘিতে নেমেছে বুঝলাম না। কৌতূহল দমিয়ে রেখে বললাম,
> আমার কিছু প্রশ্নের উত্তর দিলে আমি চলে যাবো। তোমার বলার উপরে নির্ভর করছে আমার যাওয়াটা। যদি ঝটপট না বলো তাহলে এখুনি আমি লোকজন ডেকে তোমাকে দেখাবো।
মেয়েটা চরম ভয়ে মুখটা কুকড়ে ফেলেছে। মেয়েটার মুখ দেখে আমি পৈশাচিক আনন্দ পেলাম। ওই নেত্রের জ্বল শুধু আমার কারণে ঝরবে আর আমার কারণেই বিলুপ্ত হবে। মেয়েটা আমার কথার উত্তর দিতে বাধ্য। আমি দ্বিতীয়বার কিছু বলার আগেই মেয়েটা উত্তর দিলো,
> জ্বী বলুন?
আমি বাঁকা হেসে জিঞ্জাসা করলাম,
> নাম কি তোমার?
> চন্দ্রিমা প্রিয়জনেরা সবাই চন্দ্র বলেই ডাকে।
> বাবার নাম? এই গায়ের কার মেয়ে তুমি?
> আমার বাবা ফকির নিজাম উদ্দিন শেখ। উনি ফকির সন্যাসী মানুষ।
মেয়েটার কথা শুনে আমার হাসিটা আরও দীর্ঘ হলো। সামান্য নিজাম শেখকে হাতের মুঠোয় নিতে আমার তো বাম হাতের খেল। আমি আর অপেক্ষা করলাম না। উঠে আসার সময় বললাম,
> চন্দ্র তুমি আর কখনও খোলা দীঘির পানিতে ভিজতে আসবে না। তোমার জন্য কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলো।আমার চোখ ঝলসে গেছে তাঁর দায়ভার কে নিবে চন্দ্র? বাড়িতে যাও।
কথাটা বলে আমি পিছনে ফিরলাম না। দ্রুতগতিতে ফিরে এলাম নিজের তাবুতে। নায়েবকে ডেকে নিজের সর্বনাশের কাহিনি বর্ণনা করে বলে দিলাম, পদ্ম দীঘির পানিতে থাকা ওই ভেজা পদ্মটিকে আমার চাই। যেভাবেই হোক ওর বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাও। আমার কথা আগ্রহ করার সাধ্য ছিল না। প্রস্তাব নিয়ে তখনই বেরিয়ে পড়লো নায়েব। চন্দ্রের বাবা ফকির সন্যাসী মানুষ জমিদারের পুত্রের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার মতো সাহস ছিল না। গ্রহণ করে নিলেন। আমি পেয়ে গেলাম আমার হৃদয় পটভূমিতে বাসা বাঁধা নতুন পুষ্পকে। সেরাতে আমাদের বিয়ে হলো। ভোরবেলা চন্দ্র কে নিয়ে ফিরলাম কিন্তু ওকে নিজের বাস ভূমিতে তুলতে পারলাম না। জমিদার হওয়ার সুবাদে আমাদের বেশ কিছু মহল ছিল। আমার পছন্দসই এক মহলে ওকে নিয়ে উঠলাম। লাঠিয়াল বাহিনী আর নায়েব কে কঠোর ভাবে নিষেধ করলাম বাড়িতে গিয়ে পাঁচকান না করতে। আমি মেতে উঠলাম চন্দ্রকে নিয়ে। আমার হৃদয় বক্ষের রাণী। যাকে ছাড়া আমি নিশ্বাস নিতেও ভূলে যায়। প্রথম স্ত্রীর কন্দনরত পত্র বাবার আদেশ অবজ্ঞা করে আমি পড়ে থাকলাম চন্দ্রের কাছে। ওর রূপের যাদুতে ঝলসে তখন আমি দিসাহারা। তবে অনুধাবন করলাম এভাবে আর কতদিন? চন্দ্রের জন্য হলেও জমিদারিটা ধরতে হবে। ভালোভাবে বাঁচতে হলে টাকার প্রয়োজন। আমি ওকে রেখে ফিরে এলাম প্রথম স্ত্রীর কাছে। মেয়েটার হাসিখুশি মুখটা ততদিনে মলিন হয়েছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। আমাকে একান্তে পেয়েই লজ্জায় নেত্রদ্বয় বন্ধ করে শুনিয়ে দিলো আমাদের জমিদারিতে নতুন বংশধর আসতে চলেছে। কথাটা আমার কাছে কি যে বিষাদের ছিল সেটা যদি লিখে বোঝাতে পারতাম।আমার চোখের আগুনে মনে হলো সে ভস্মীভূত হয়ে যাবে। পায়ে ঠেলে বেরিয়ে আসলাম অনাগত সন্তানের মাকে। আমার চন্দ্র ছাড়া এমন অধিকার কারো হতে পারে মানতে পারলাম না। চলে এলাম চন্দ্রের কাছে। দীর্ঘদিন অতিবাহিত হলো। বাবা আর বোনের দীর্ঘ পত্রের ঘনঘটা লেগেই থাকলো। বোনের পত্রের প্রতিটা লাইন জুড়ে ছিল তাঁর ভাবিমায়ের বিষাদঘন চোখের পানির বর্ণনা। সেসব আমার হৃদয় কুঞ্জে কোনো চিহ্ন আঁকতে পারেনি। সুখের সমুদ্রে গা ভাসিয়ে চন্দ্রকে নিয়ে আমি চন্দ্র বিলাসে মেতে থাকি। চমৎকার মেয়ে ছিল চন্দ্র। সর্বদা সে আমাকে নতুন নতুন রূপে চমকে দিতো। আমি থমকে যেতাম। কিন্তু অচিরেই আমার সমস্ত সুখের অবসান ঘটিয়ে বাবা জেনে গেলেন সবটা। এসব কথা যে ঝড়ো হওয়ায় আগুনের ফুলকির মতো উড়ে বেড়ায়। ধামাচাপা দিতে পারলাম না। বাবা ছিলেন শক্ত ধাচের মানুষ। শক্ত হাতে জমিদারি সামলেছে। উনি পত্র আর লোক পাঠালেন আমার দুয়ারে। হুমকি দিলেন চন্দ্রকে ত্যাগ দিয়ে ফিরে যেতে। নয়তো চন্দ্রের ক্ষতি করতে উনি দু’বার ভাববেন না। আমি থমকে গেলাম। বাবা এক কথার মানুষ। যা ইচ্ছা করে বসবে। উপায়ন্তর না পেয়ে আমি চন্দ্রেকে আমার প্রথম স্ত্রীর কথা বলে দিলাম। চন্দ্র বিচক্ষণ মানুষ দক্ষ হাতে আমাকে সামলে নিলো। আমাকে বোঝালো। আমি চন্দ্রের জয় জয়কার করলাম। আহা এমন স্ত্রী পেয়ে আমি ধন্য। কিন্তু বাবাকে কি বলে বোঝাই? সেদিন রাতে চন্দ্রের কোলে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাঁকিয়ে চন্দ্র বিলাস করছিলাম। মনে শতশত ভয় আর অশান্তি দানা বেঁধেছে। সেই মূহুর্তে চন্দ্র আমাকে বলে বসলো,
> আমি জানতাম আপনি সেদিন সেই দীঘির পাড়ে আপনি আসবেন। আপনার হৃদয় বক্ষের এইখানটাতে হাত রাখার অধিকার দিবেন।
আমি চমকে উঠে জিঞ্জাসা করলাম,
> চন্দ্র হেয়ালি করো না। বুঝিয়ে বলো।
> আপনাকে দেখেছিলাম মোড়লের কাচারীতে কোনো একদিন। আমি থমকে গিয়েছিলাম। এমন সুদর্শন যুবককে পাওয়ার লোভ আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়ানোর সাহস করা যে বড্ড অন্যায়। কি করবো মাথায় কিছু আসছিল না। বাবা সন্যাসী মানুষ নানারকম বই আর মানুষের যাতায়াত ছিল বাড়িতে। কাকতলীয় ভাবে একটা বই আমার হাতে আসলো। আমি বইটা পড়তে শুরু করলাম। খুব আর্কষণ করেছিল বইটা আমাকে। কালো যাদুর বইটা। আমি শুরু করলাম সাধনা করা। বইয়ের নির্দেশ অনুযায়ী সব কিছু যখন শেষের পথে সেই সময়ে একজন লোক আমার নিকট উপস্থিত হলেন। জানিনা সে কে?কোনো মানুষ নাকি জ্বীন বা শয়তান! আমাকে একটা পাথর দিয়ে বললেন এই পাথর কোনো সাধারণ পাথর না। এর থেকে যা ইচ্ছা তাই পাওয়া যাবে। তবে এটার বিনিময়ে কিছু খোয়াতে হবে। এই পাথরের গুণে আমি আপনার উপস্থিতি আগেই টের পেয়েছিলাম। চাইতে হলো না কিছুই। উনি আরও বলেছিলেন পাথরের অভিশাপ কাটাতে হলে পাথর মানবির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সব কিছুই ধবংস হয় তেমনি এই পাথরও হবে। তখন জন্ম নিবেন সে।।আমি এখন অবধি কিছুই চাইনি। আপনি চাইতে পারেন। সব বিপদ কেটে যাবে।
চন্দ্রের কথা আমার বিশ্বাস হলো না। অদম্য কৌতূহল আমাকে পেয়ে বসলো। ওকে নিয়ে আসতে বললাম পাথরটা। ও নিয়ে আসলো। চেয়ে বসলাম নিজের যত ইচ্ছে চাওয়া পাওয়া ছিল। চন্দ্র আমার হাতে একটা কাগজ তুলে ধরলো। সেখানে লেখা ছিল আমার সকল চাওয়ার বিনিময়ে খোয়াতে হবে আমার বংশের সকল মেয়েদের কন্ঠের ভাষা। বছরের পর বছর জন্ম নিবে অপরূপা সুন্দরী কন্যা। তাদের রূপে ঝলসে যাবে যেকোনো যুবকের হৃদয় কিন্তু তাঁরা হবে বোবা বধির। কোনো যুবক ইচ্ছা করলেই তাদেরকে নিজের আয়ত্বে নিতে পারবে না। মানব নিষিদ্ধ মানবী হবে তাঁরা। আমি রাজি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম কিছু হবে না।
কিন্তু কাকতলীয়ভাবে পরদিন বাবা আসলেন আমার দুয়ারে। আমাকে আর চন্দ্রকে ফিরিয়ে নিতে। প্রথমে খুব খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু দ্বিতীয় খবরগুলো শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার প্রথম স্ত্রী সন্তান প্রসবকালে ইহ জগতের মায়া ত্যাগ করেছে। জন্ম নিয়েছে এক ছেলে। আমি প্রাণাধিক প্রিয় বোনটা হঠাৎ বাক শক্তি হারিয়ে ভেঙে পড়েছে। তাঁর মুখের মিষ্টি কন্ঠে ভাইজান ডাকটা শোনার সৌভাগ্য থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছি। আমি চমকে উঠলাম। কিন্তু চন্দ্র ছিল স্বাভাবিক। কি সর্বনাশীনির মোহ মায়ায় জড়িয়ে আমি নিজের ক্ষতি করেছি হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। বাড়িতে ফিরে ছুটে গিয়ে নিজের সন্তানকে জড়িয়ে ধরলাম। স্ত্রীর মুখটা দেখার সৌভাগ্য হলো না। বেচারী স্বামীর দেওয়া লাঞ্ছনা গঞ্জনা হৃদয়ে ধারণ করে পথিব মায়া ত্যাগ করেছে। কি যে কষ্ট হলো। হারিয়ে যাওয়ার পরেই আমি সেই রত্নের মূল্য বুঝতে পারলাম।। চন্দ্রকে দেখলেই তা হুড়মুড় করে বাড়তে থাকলো। বোনটা চুপসে গেছে।একদিন আত্মহত্যা করে বসলো। আমি চন্দ্রকে তাড়িয়ে দিতে পারিনি কারণ ততদিনে সুলতান বংশের অনাগত বংশধরের মা সে। দিন যেতে লাগলো আমার মধ্যে তিক্ততা বাড়লো। ছেলেকে বুকে নিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম। জন্ম নিলো আমার দুই রাজকন্যা। খুশী হওয়ার বদলে আমি হতাশ হলাম। ওদের কন্ঠ যে আমি জন্মের আগেই কেড়ে নিয়েছি। সহ্য করতে পারলাম না। সিদ্ধান্ত নিলাম এবার আমার পাপের শাস্তি পাওয়া উচিৎ। ভেঙে পড়া মন আর শরীর নিয়ে আমি এই পথিব জগতে থাকতে চাইনা। পাথরটা গহিন অরণ্যে সমাধিত করলাম। দরকার নেই ওই সর্বনাশিনী পথর আর চন্দ্রের মতো মেয়েকে। ও আমার কাছে বিষাক্ত। কত বছর এভাবে সকলের অভিশাপ কুড়াতে হবে আল্লাহ্ ভালো জানেন।
অধরা এই পযর্ন্ত এসে থামলো। ডাইরীতে লোকটার লেখা শেষ হয়েছে। পরবর্তী পৃষ্ঠাতে জুবায়েরের দাদুর লেখা। উনার বাবা সুইসাইড করেছিলেন। ডাইরীটা উনার সেই চন্দ্র মায়ের থেকে প্রাপ্ত ছিল। জুবায়েরের বাবারা দুই ভাই জমজ। দেখতে হুবহু এক। জমিদারদের আমল ছিল না তবে বেশ জমিজমা অর্থসম্পদ ছিল সুলতানদের কাছে। জুবায়েরের বাবা বেশ ভালো মানুষ ছিলেন অন্যটা ছিল বেয়াড়া। জুবায়েরের বাবা জার্মানিতে এসেছিলেন যুবক বয়সে। এখানে এসে ব্যবসা করতে শুরু করেন। অল্পদিনের মধ্যে ভালো উন্নতি করেন। বিয়ে করেন। আরেকজন তখন বুদ্ধি করতে থাকে কিভাবে ভাইকে সরিয়ে নিজে দখল নিবেন। তাছাড়া উনার ঘরে তখন জন্ম নিয়েছে দু জোড়া বোবা বধির কন্যা। সুলতান বংশের অভিশাপ আর অর্থের লোভেই উনি কালো যাদুর বইটা নিয়েছিলেন।। ডাইরীতে উল্লেখ নেই উনি কালো যাদু শুরু করেছেন। এটা খুঁজে নিতে হবে। হয়তো উনি এসব করে অধরার সম্পর্কে জেনেছেন। ।অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল ডাইরী পড়ে। মনে হচ্ছে কোনো রূপকথার গল্প পড়লত। মাথাটা ভনভন করে ঘুরছে। জুবায়ের এখনো ফিরে আসেনি। ওর জন্য চিন্তা হচ্ছে। অধরার ধ্যান ভাঙলো জুবায়েরের আগমনে। ছেলেটার চোখেমুখে রাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। ডান হাতের মুঠোয় চকচক করছে ধাঁরালো খঞ্জর। লোকটা ওর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে। অধরার সারা শরীর বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে গেলো। মনে হলো এখনো বুঝি জুবায়ের খঞ্জরটা নিয়ে ওর উপরে ঝাপিয়ে পড়বে।
চলবে
#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৬
অধরা ভয়ে পিছিয়ে আসলো। জুবায়ের ক্রমশ ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ছেলেটার হঠাৎ এমন পরিবর্তন নিয়ে ও বেশ চিন্তিত। মনে হলো আবার কিছু হয়ে যায়নি তো? কথাটা ভেবে ও ঢোক গিলল। কতবার নিষেধ করেছিল বাইরের কিছু না খেতে। এই পেটুক ছেলেটা হয়তো দুমদাম খেয়ে নিয়েছে। অধরার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। গুটিসুটি হয়ে বিছানার এক কোনে বসে পড়লো। জুবায়ের লাফ দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসতেই অধরা কেঁপে উঠলো। ভাবলো দৌড়ে পালিয়ে যাবে কিন্তু হলো না। ততক্ষণে জুবায়ের ওকে ঝট করে বিছানায় ফেলে দিয়ে ওর উপরে ঝাপিয়ে পড়েছে। অধরা ভয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলল। কয়েক মূহুর্ত পর হঠাৎ উষ্ণ অধরের ছোঁয়া ললাটে পেতেই অধরা চোখ খুলে ফেলল। জুবায়ের ওর মুখের দিকে তাঁকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। অধরার ভয়ানক মেজাজ খারাপ হলো। এমনিই ডাইরী পড়ে মাথা আউলে গেছে তার মধ্যে ছেলেটা এসে বেয়াদবি করছে। ফাজিল ছেলে। অধরা দাঁতে দাঁত চেপে ধরে উঠতে চাইলো কিন্তু জুবায়ের দিলো না। ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়েছে। ঝকঝকে খঞ্জরটা তুলে অধরার কপাল থেকে শুরু করে গল পযর্ন্ত আলতো ছোঁয়া দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> আমি ডাকাতি করতে এসেছি। ভালোবাসা দিবে কিনা বলো? অবশ্য বউ আমার, সেহেতু বউয়ের ভালোবাসা না দিলেও তা আমার। মোটকথা বউয়ের সব কিছু আমার ।
জুবায়েরের কথা শুনে অধরা জ্বলে উঠলো। সিরিয়াস সময়ে এই লোকটা এসেছে মজা করতে। অধরা এবার ঝাঝালো কন্ঠে বলল,
> জুহি আছে না ওর কাছে গিয়ে ডাকাতি করেন। বেচারীর প্রেমে পড়ে ছ্যাকা খেয়ে বাঁকা হয়ে গিয়েছিলেন। আপনাদের বংশে আছে তো বউ রেখে সুন্দরীদের পেছনে ছুটতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়া। পড়লাম আপনার গোষ্ঠীর এক প্রেমিকের কাহিনি। সব গুলো এক।
জুবায়ের খঞ্জর টা ফেলে দিয়ে উঠে বসলো। মুখটা করুন করে বলল,
> মৃত মানুষকে নিয়ে কিছু বলতে হয়না। তাছাড়া আমার জানিনা কি হয়েছিল তখন অদ্ভুত অদ্ভুত কাণ্ড করে ফেলতাম। সরি বউ।
অধরা উঠে বসলো। ওড়নাটা ঠিক করে বলল,
> ঠিক আছে ঠিক আছে। ওসব নিয়ে কোনো ঝামেলা করতে চাইনা। আপনার মাথায় সমস্যা সে আমি অজানা নেই। এবার ডাইরীটা দেখুন, এখান থেকে জেনেছি আপনাদের বংশে কহিনুরের ঝামেলাটা কিভাবে ঢুকেছিল। সবটা ছিল একটা মহিলার উচ্চ আকাঙ্ক্ষার ফল। উচ্চ আকাঙ্ক্ষা ভালো তবে নিয়মের বাইরে গিয়ে না। এই ভদ্রমহিলা একজন মানুষকে পাবার জন্য কালো যাদু করে ফেলল কি জঘন্য তাঁর মেন্টালিটি।
জুবায়ের ভ্রু কুচকে বলল,
> নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের আর্কষণ বেশি থাকে উনাকে খারাপ বলো না। আচ্ছা ডাইরী পেলে কিভাবে? বিস্তারিত বলবে কি লেখা আছে?
অধরা জুবায়েরকে মোটামুটি গুছিয়ে সবটা বলে দিলো। দাদু বলেছিল কাউকে না বলতে কিন্তু অধরা সেটা পারলো না। তাছাড়া জুবায়েরের থেকে লুকিয়ে রেখে বিশেষ কোনো সুবিধা হতো না। সব শুনে জুবায়েরের কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো। বলল,
> অনেক প্রশ্ন কিন্তু পরিস্কার হয়নি। তুমি ভাবো এখানে কহিনুরের জন্ম নিয়ে কোনো কথা উল্লেখ নেই। বলা হয়েছে পাথর মানবির কথা। ধরো কহিনুরের জন্ম কখন কিভাবে হবে, কিভাবে পাথরের ক্ষমতা ফিরবে কিছুই উল্লেখ নেই।
অধরা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল,
> মেয়েটার রক্তে পাথর প্রাণ ফিরে পাবে। এসব কালো যাদু খুবই ভয়ংকর জিনিস। সাহায্য করার নামে সব কিছু কেড়ে নিতে উস্তাদ। আপনাদের বংশের মেয়েদের জন্য খারাপ লাগছে। একটা বিষয় কিন্তু ক্লিয়ার হয়নি। ডাইরীতে লেখা ছিল মানব নিষিদ্ধ মানবি হবে তাঁরা। যদি মানব নিষিদ্ধ হয়ে থাকে তাহলে আপনার ফুপা কে? আপনার ফুপির কার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে? উনি মানুষ তো?
অধরা উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। সত্যি বলতে এই কথাটা ওর আগে মাথায় আসেনি। এখন হঠাৎ খেয়াল হলো। জুবায়ের ডাইরীটা নিয়ে সেই লাইনটা কয়েকবার উচ্চারণ করে বলল,
> এই ফুফাকে আমার বেশ সন্দেহজনক লাগে আগেই বলেছিলাম। আর যাইহোক ভদ্রলোক কিছুতেই মানুষ না। হয় জ্বীন নয়তো পিশাচ। নয়তো এই কহিনুরের সঙ্গে জড়িত কোনো রহস্যময় চরিত্র।
অধরা কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল,
> বাদ দিন পরে দেখা যাবে। আগে বলুন উকিলের সঙ্গে কথা হয়েছে?
> সব ঠিকঠাক আছে। নোটিশ পাঠানোর ব্যবস্থাও করেছি। আশাকরি কোনো ঝামেলা হবে না। ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলা জরুরী। ও হয়তো আমার মতো ভূল করেছে। আরমান ফারুকী যে আমাদের বাবা না এটা ও জানেনা।
অধরা বিরক্ত হলো জুবায়েরের কথা শুনে। নাক মুখ কুচকে বলল,
> একদম ওকে কিছু বলবেন না। ও না জানলেও অসুবিধা নেই। ক্ষতি আপনার হবে ওর না। আরমান ফারুকী ওকে বিশেষ কোনো কাজে ব্যবহার করছে তাই ওকে এতটা কদর করে। ও ওর মতোই থাক সময় হলে সব প্রকাশ পাবে। খেয়েছেন রাতে?
জুবায়ের ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়লো। মুখটা করুন করে বলল,
> তুমিই তো বললে তোমার হাতের খাবার ছাড়া খাওয়া যাবে না তাহলে এখন বলছো কেনো?
>অপেক্ষা করুন আমি যাচ্ছি। ধন্যবাদ কথা শোনার জন্য। বিপদ ঘাপটি মেরে আছে যখন তখন হামলে পড়বে। সাবধানের মার নেই।
জুবায়েরের চোখ বন্ধ করে বলল,
> বুঝলাম ম্যাম। তুমি দেখেছো আমার সঙ্গে থেকে তোমার কেমন বুদ্ধি বেড়েছে।
অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল। গুরুত্বপূর্ণ কথার মধ্যে কি সব বলছে। বিরক্ত হয়ে বলল,
> কেমন বুদ্ধি জানা আছে। আচ্ছা বলুন তো আপনার ভাইয়ের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়েছিল আমাদের বিয়ের মাস খানেক আগে। উনার ভাষায়, আমাকে দেখে উনার চোখের এন্টেনা নড়ে গিয়েছিল। ক্রাশ খেয়ে নিজে না বিয়ে করে আপনার সঙ্গে কেনো বিয়ে দিলেন? উনি নিজের বিয়ের প্রস্তাব দিতে পারতেন। প্রশ্ন জাগে না আপনার মনে?
অধরার কথা শুনে জুবায়েরের ভীষন মন খারাপ হলো রাগ ও হলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
>তোমার কি এখন আফসোস হচ্ছে? আমি বর হিসেবে দেখতে খারাপ নাকি তোমার অন্যকিছুতে সমস্যা? ভাইয়ের সঙ্গে তুমি জীবনে আর কথা বলবে না। আমার পছন্দ না তুমি বাইরের লোকদের সঙ্গে আলাপচারিতা করো।
> বোকা বোকা কথা বলবেন না। আমি বিষয়টাকে ওরকম ভাবে ভাবিনি। আমি শুধুমাত্র বলতে চেয়েছি লোকটা নিজের পছন্দের মেয়েকে কারণ ছাড়া হাতছাড়া কেনো করলেন? নিজেও বিয়ে করতে পারতেন। নিশ্চয়ই কারণ আছে? আপনার ভাইয়ের মধ্যে ঘাবলা আছে।
> ওকে নিয়ে কোনো কথা হবে না। আমার কিন্তু ভীষন ক্ষুধা পেয়েছে। খেতে দিবে নাকি বাইরে গিয়ে দুম করে খেয়ে আসবো?
অধরা বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে আসলো। এই ছেলেটা এতদিন বউয়ের সঙ্গে খারাপ খারাপ ব্যবহার করে এখন জেলাস ফিল করছে যেটা একদম বিরক্তিকর। রহস্য উদ্ধারে মন নেই আছে বউ হারিয়ে যাবে সেই চিন্তা নিয়ে। অধরা কথাগুলো বিড়বিড় করতে করতে রান্নাঘরে গিয়ে হাজির হলো। রাতের ডিনার রেডি হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। জুবায়েরকে হয়তো এখনই ডাকা হবে। অধরা একটা কাজের মেয়ের সাহায্য নিয়ে দ্রুত কয়েকটা রুটি আর ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে রান্না বসিয়ে দিলো। মাংস নেওয়ার সময় চিকেন নাকি সিউর হয়ে নিলো। এই বাড়ির যে অবস্থা দেখা গেলো ফ্রিজে চিকেনের বদলে মানুষের হাত পা রেখে দিয়েছে। কিছুই অস্বাভাবিক না। আধা ঘন্টার মধ্যে ওর রান্না শেষ হলো। দ্রুত খাবার নিয়ে উপরে আসার সময় দাদু ওর রাস্তা অবরোধ করে দাঁড়িয়ে পড়লো। অধরা চমকে উঠেছে তবে সেটা বুঝতে দিলো না। ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,
> কিছু বলবেন?
> বাড়িতে এতো লোকজন থাকতে তুমি রান্না করছো বিষয়টা ভাবাচ্ছে আমাকে।
অধরা ঢোক গিলে বলল,
> জানেন তো দাদু খুব সখ জেগেছে বরকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়াবো। বরের সেবাযত্ন করবো আম্মুরা যেমন করে আরকি। বাঙ্গালী মেয়েরা তো এমনিই করে তাইনা দাদু?
> বেশ ভালো কিন্তু কেমন জানি লাগছে। আচ্ছা যাও।
অধরা অনুমতি পেয়ে আর অপেক্ষা করলো না দ্রুত উপরে উঠে গেলো। অন্যদিকে রান্নাঘরের পাশ থেকে একজন ওর দিকে লাল লাল চোখে চোখে তাকিয়ে আছে সেটা ও দেখতে পেলো না।
☆☆☆☆☆☆☆☆
গভীর রাত, চারদিকে শুনশান নীরবতা বিরাজ করছে। পাশে জুবায়ের ঘুমিয়ে আছে। অধরার কিছুতেই ঘুম আসছে না। পেটের ডান সাইডে চিনচিন করে ব্যাথা করছে। একটু হাঁটতে পারলে হয়তো ভালো লাগবে। কথাটা ভেবে ও চুপচাপ জুবায়েরের পাশ থেকে উঠে আসলো। ছেলেটার ঘুম বেশ গভীর। অধরা দরজা খুঁলে বাইরে পা রাখতেই খেয়াল করলো বারান্দা ধরে কেউ এগিয়ে যাচ্ছে। পায়ের শব্দের সঙ্গে ঠুকঠাক আওয়াজ হচ্ছে। অধরা কৌতূহল দমিয়ে রাখতে না পেরে শব্দের উৎসের দিকে এগিয়ে গেলো। অজানা উত্তেজনাই শরীর মৃদু মৃদু কাঁপছে। অধরা খুব সাবধানে এগোতে থাকলো। দু’তালা বাড়ি, দোতলার কক্ষ গুলো এল আকৃতির লম্বা ভাবে তৈরী। দুপাশ দিয়েই বাইরে যাওয়ার সিঁড়ি। বাড়িটা যেমন অদ্ভুত তেমনি এই বাড়ির প্রতিটা সদস্যও কেমন অদ্ভুত। এখানে থাকা প্রতিটা মানুষের মধ্যে রহস্য খেলা করে। অধরা ভাবতে ভাবতে শেষ সীমান্তে পৌঁছে গেলো। সিঁড়ি ধরে বাইরে নেমেই অধরার চোখ চড়কগাছ। অনেকগুলো লোকজন বাইরে জড় হয়েছে। সকলের দৃষ্টি সামনের দিকে। আকাশে পূর্নিমা চাঁদের জোছনা পৃথিবীতে ঠিকরে পড়ছে। দূর থেকে মানুষগুলোর মুখগুলো ভালো স্পষ্ট না হয়ে কেমন আবছা দেখা যাচ্ছে। অধরা দ্রুতগতিতে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো। এখানে পিনপতন নিরবতা কেউ করো দিকে তাকাচ্ছে না। হঠাৎ ফ্যাচ ফ্যাচ কান্নার আওয়াজে ওর ঘোর কাটলো। সামনে তাঁকিয়ে দেখলো ওর মেঝো ননদ রুশনারা ফারুকী বসে আছে। ওকে ঘিরেই কিছু একটা চলছে। মেয়েটার গলাই মালা পাশের চেয়ারটা খালি। কি হচ্ছে এখানে কে জানে। অধরা কৌতূহলী হয়ে ভাবলো কাউকে জিঞ্জাসা করবে। পরিচিত কেউ নেই তাই সাহস পেলো না। এতগুলো অপরিচিত মানুষ এই বাড়িতে কিভাবে এলো? আশেপাশে দেখে এবার সামনের দিকে তাঁকিয়ে ঝটকা খেলো। রুশনারার এখন আর একা বসে নেই। ওর পাশে একজন অর্ধমানব বসে আছে। যার পায়ের দিকে মানুষের আকৃতি আর মাথার দিকটা পশুর। কি ভয়ংকর দৃশ্য। ভয়ে ওর বুকটা ধুক করে উঠলো। রুশনারা ভয়ে চুপসে আছে। এই অর্ধমানবটা নিজের মালাটা খুলে মেয়েটাকে পরিয়ে দিতেই মেয়েটা ছটফট করতে শুরু করলো। অধরা আর চুপ থাকতে পারলো না। চিৎকার করে বলে উঠলো,
> কি হচ্ছে হচ্ছে এখানে? মেয়েটাকে কষ্ট দিচ্ছো কেনো? এই লোকটা কে?
অধরা একদমে কথাগুলো বলে থামলো। সকলের দৃষ্টি এবার ওর উপরে পতিত হলো। অধরা খেয়াল করলো এখানে অবস্থানকারী সকলেই অর্ধমানবে রূপান্তরিত হয়েছে। ওরা এসে অধরাকে ঘিরে ধরলো। ক্রমশ অবস্থা পরিবর্তন হয়ে গেছে। অধরা ভয়ে গুটিয়ে গেলো। মনে হচ্ছে সবটা স্বপ্ন। প্রচণ্ড ভয়ে ওর বুক ঢিপঢিপ করছে। বেশিক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। ধপাস করে পড়ে গেলো।
☆☆☆☆☆☆☆
আলো ঝলমলে সোনালী দিনের সূচনা হয়ে রাতের আধারের সঙ্গে সকল অশুভ কালো ছায়া দূর হয়ে গেছে। চোখে আলোর রশ্মি পড়তেই অধরার ঘুম ভাঙলো। নড়াচড়া করে হামি ছেড়ে উঠে বসলো। মাথাটা কেমন ভার হয়ে আছে। বিছানা থেকে নামতে চাইলো কিন্তু হলো না। জুবায়েরের গায়ের নিচে ওর কাপড় অর্ধেক আটকা পড়েছে। অধরা কাপড় টেনে নিতেই জুবায়ের হন্তদন্ত হয়ে উঠে বসলো। চিন্তিত হয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> তুমি ঠিক আছো? শরীর ঠিক লাগছে? কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাতো? গতকাল রাতে তুমি বাইরের লেনে একা পড়ে ছিলে। ভাগ্য ভালো আমি পেছনে পেছনে গিয়েছিলাম। সারারাত টেনশনে আমি শেষ।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। গতকাল রাতের সবকথা ওর মনে পড়ে গেছে সেই সঙ্গে ভয় ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। অধরা ঢোক গিয়ে জুবায়েরকে সবটা খুলে বলল। জুবায়ের বিশ্বাস করলো কি ঠিক বোঝা গেলো না শুধু বলল ফ্রেস হয়ে নিতে। অধরা চুপচাপ ওয়াশরুমে ঢুকতেই জুবায়ের বেরিয়ে গেলো। অধরা বাইরে এসে ওকে পেলো না। ধীর পায়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালো। দোতলা থেকে নিচে তাকিয়ে দেখলো ডাইনিং রুমের সোফায় ছোটখাট একটা আড্ডা বসেছে। রুশনারার পাশে একজন সুদর্শন যুবক বসে আছে। দুজনের চেহারাই লাজুক হাসি। অধরা নেমে আসলো। ঘটনা কি জানার জন্য। ওকে নামতে দেখে দাদু সরে গিয়ে ওকে বসতে দিয়ে বলল,
> বসো দাদুভাই। তোমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই। এইটা আমার আরেকটা দাদুভাই। আমাদের রুশনারার জামাই গালিব। ওদের বিয়ে হয়েছে তবে অনুষ্ঠান করা হয়নি। ভাবছি ঘরোয়া একটা অনুষ্ঠান করবো। ছেলেটা আমাদের বাড়িতে কিছুদিন থাকবে।
অধরা হতবাক হয়ে সামনে বসা যুবকের দিকে তাঁকালো। লোকটার চোখেমুখে খুশির ঝলক কেমন জানি চকচক করছে। অধরা দ্রুত দাদুর দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো। কি হচ্ছে এখানে মাথা আবারও ঘুরছে। এই বাড়ির মেয়েদের তো বিয়ে হয়না। মানব নিষিদ্ধ তাহলে এসব কি? কথাগুলো ভেবে হঠাৎ ওর শরীর খারাপ হচ্ছে। জুবায়ের রান্নাঘরে ছিল। রান্না শেষে কাজের মেয়েকে দিয়ে খাবার রুমে পাঠিয়ে অধরা পাশে এসে বসলো। দাদু জুবায়েরের দিকে তাঁকিয়ে বলল,
> ওকে কক্ষে নিয়ে যাও। মেয়েটার শরীর খারাপ লাগছে। এই সময় এতটা টেনশন শরীরের জন্য ভালো না।
জুবায়ের ভ্রু কুচকে অধরাকে জিঞ্জাসা করলো,
> তুমি ঠিক আছো? রুমে যাবে?
অধরা কিছু বলতে পারলো না। জুবায়ের দ্রুত ওকে কোলে তুলে নিয়ে কক্ষের দিকে এগিয়ে আসলো। ওকে বিছানায় রেখে পানি খেতে দিলো। অধরা ঢকঢক করে পানিটা গলাই ঢেলে নিয়ে বলল,
> এসব কি হচ্ছে সব মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। আপনার বোনের বিয়ে হয়ে গেলো আপনি জানতেন কিছু? তাছাড়া বড় বোনের বিয়ে না দিয়ে মেজোটার মানে কি?
জুবায়ের কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল,
> ডাইরীর প্রতিটা পাতায় রহস্য লুকিয়ে আছে তুমি ধরতে পারোনি। ডাইরিটা আবারও পড়বে। তাহলে বুঝতে পারবে। অধরা আমাদের মেয়েটার জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে। ওর পরিণতি কি এমন হবে? মানুষ হয়ে কিভাবে ও এসব শয়তানের সঙ্গে সংসার করবে? অধরা চলো আমরা এই বাচ্চাটাকে এবোর্ট করি। দরকার নেই ওকে পৃথিবীর আলো দেখানোর। ওর কষ্টে আমার মরে যেতে মন চাইবে। বোনদের জন্য কিছু করতে পারিনি কিন্তু ওর জন্য এইটুকু তো পারবো। প্লিজ চলো।
জুবায়েরের কথা শুনে অধরা ভয় পেলো। ছেলেটা এমন ভুলভাল বকছে কেনো? বাচ্চাটাকে মেরে ফেলবে বললেই হলো। কখনও না। দরকার হলে অধরা নিজে মরে যাবে তবুও কহিনুরকে আসতে হবে। এতগুলো মানুষের প্রাণের দাম মিটিয়ে দিতে হবে। হোক সে অশুভ খারাপ কিছু তবুও দিতে হবে। এত বছরের অভিশাপ কাটিয়ে দিতে হবে সুলতান বংশের উপর থেকে। সুলতানা কহিনুর ফারুকী চন্দ্রের করা পাপ নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও মিটিয়ে দিয়ে যাবে। ওর র*ক্তে দিয়ে যদি সকল অভিশাপ কেটে যায় তবে তাইহোক। শেষ চেষ্টা অধরা করবে। কথাগুলো ভেবে ও মুখ খুলল,
> আপনি টেনশন করবেন না। এমন কিছু হওয়ার আগেই আমরা ঠিক একটা ব্যবস্থা করে ফেলবো। আমাদের একটা কাজ করতে হবে। এই বাড়ি থেকে ওসব আজেবাজে কাজকর্ম বন্ধ করতে হবে। কালো যাদুর বইটা উদ্ধার করে পুড়িয়ে দিতে হবে। মোটকথা এই বাড়িতে আর কোনো শয়তানের উপাসনা হবে না। মুসলিম তো দূর পৃথিবীর কোনো ধর্মেই নেই শয়তানের উপাসনা করা ভালো কিছু। এসব খারাপ কাজ। খোঁজ নিয়ে দেখুন কোন ব্যাক্তি এই পাপের সঙ্গে জড়িত আছে।
জুবায়েরের অধরার মুখে খাবার তুলে দিয়ে বলল,
> খেয়ে শান্ত হয়ে বসো। খোঁজ নিবো তবে তুমি একা কোনো ঝামেলায় জড়াবেনা। আমাকে সঙ্গে নিবে। সারারাত আমার দম আটকে আসছিল। চলো ফিরে যায়। এখানে ভালো লাগছে না।
> ভালো লাগাতে হবে। হাট গুটিয়ে বসে থাকার কোনো মানে হয়না। আপনার বোনের বিয়েটা আটকাতে পারলাম না। ওই শয়তানটাকে তো আমি দেখে নিবো। কিভাবে এই বাড়িতে থাকে সেটাও দেখবো।
জুবায়েরের অধরার মুখের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল,
> এমন কেনো তুমি? ভয় পেয়েও পিছিয়ে আসো না। অন্য মেয়ে হলে ঠিক পালিয়ে যেতো।
অধরা ভাব নিয়ে বলল,
> আমি সুলতান জুবায়ের ফারুকীর স্ত্রী। ক্লাবের মেয়েদের ক্রাশের বউ। একটু তো সাহস হতেই হয়।
জুবায়ের তৃপ্তি নিয়ে হাসলো। দিনগুলো ভয়ংকর ভাবে কাটছে তবে খারাপ যাচ্ছে না। ভালো খারাপ মিলিয়ে হিসেবে করলো মেয়েটার সঙ্গে সঙ্গ দিয়ে সব দিক থেকে দারুণ লাগছে। সুখ দুঃখ মিলেই জীবন। খাওয়া শেষ করে অধরা ডাইরী নিয়ে ছুটলো দাদুর কক্ষে।ভয় হচ্ছে নিষেধ সত্ত্বেও এটা ও জুবায়েরকে পড়তে দিয়েছিল। তবে লোকটা যদি ঠিক ধরতে পারে তবে বুঝতে হবে এই লোকটার মধ্যে কিছু একটা আছে। আর না বুঝতে পারলে স্বাভাবিক। দাদু কি বুঝতে পারবে অধরা জুবায়েরকে ডাইরীটা দেখিয়েছে?
চলবে