কহিনুর পর্ব-১১+১২

0
990

#কহিনুর
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১১+১২

পশ্চিম আকাশে চাঁদ বাঁকা হয়ে কিরণ দিচ্ছে। বাড়ির ডান সাইডে থাকা আলোর ছিটা গেট পযর্ন্ত ছড়িয়ে আছে। অধরা ক্রমাগত পিছিয়ে আসছে। সামনের মানবটার দৃষ্টি ওর মাথা থেকে পা অবধি পর্যবেক্ষণ করছে। অধরা পেছনে ফিরে দৌঁড় দিবে সেই সময় লোকটা ওকে থামিয়ে দিলো। বলে উঠলো
> থামো মেয়ে, আমি তোমার ক্ষতি করতে আসিনি। কিছু বলতে এসেছি।
অধরা থমকে গিয়ে ভয়ে ভয়ে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল,
> শুনতে চাই না আপনার কথা। ধবংস করতে চাইছেন তো আমাকে? আমি এমনিতেই ধবংস হয়ে গেছি।

অধরার কথা শুনে লোকটা হাসলো। ঠোঁট কামড়ে বলল,
> সন্দেহ করে দোষারোপ করা কি উচিৎ হচ্ছে? আমি খারাপ কিছু করেছি দেখেছো আজ অবধি? ভিত্তিহীন বিষয় নিয়ে তুমি খামাখা আমাকে ভয় পাচ্ছো। আমি ছোট থেকেই আলোতে যেতে পারিনা কারণ সূর্যের আলোতে আমার সমস্যা হয়। শরীর লাল হয়ে ফুলে উঠে। ডাক্তার দেখানো হয়েছে। এটা এক ধরনের রোগ। তুমি এই বিষয় নিয়ে সন্দেহ করছো? আর কহিনুরের বিষয়টা ওটা ড‍্যাড দাদুর থেকে পেয়েছে। দাদু কি সব আজেবাজে কথাবার্তা বলে উনার মাথা খারাপ করে দিয়েছেন। তুমি অযথাই ভয় পাচ্ছো। আমি তোমাকে পছন্দ করি। তোমার ক্ষতি কেনো চাইবো আমি, বলো?
অধরা ঘনঘন নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। শাশুড়ির শেষ কথাটা বারবার কানের মধ্যে প্রতিধ্বনি করছে। কাউকে বিশ্বাস করা উচিৎ হবে না। তবুও কিছু বলা দরকার তাই বলল,
> আমার কোনো অভিযোগ নেই। আমার স্বামী চেয়েছেন তাই এখানে আছি। এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কিছু নেই। আপনি কি এগুলো বলতেই এসেছেন?
লোকটা এক’পা দু’পা করে একদম অধরার সামনে এসে থামলো। দৃষ্টি ওর মুখের দিকে। অধরার অস্বস্তি হচ্ছে। লোকটা হেসে বলল,
> বিশ্বাস করছো না জানি। তবুও আমি চাই তোমরা ফিরে আসো। ভূল ধারনা নিয়ে বসে থেকে কি হবে বলো? নিজের চোখে না দেখলে সেটা নিয়ে চিন্তা করে কি হবে?
অধরা লোকটার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো। মনে হলো চিৎকার করে সবটা বলতে কিন্তু পারলো না। কিছু বলতে চাইলো তাঁর আগেই অধরার পেছন থেকে জুবায়ের বলে উঠলো,
> ও এখানেই থাকবে আমার সঙ্গে। বাড়িতে নিতে পারলে আমাকে খুন করে আমার স্ত্রী সন্তানকে নিজের কব্জায় নিতে খুব সুবিধা হবে জানি। কিন্তু কি বলতো আমি আপাতত সেটা চাইছি না। পৃথিবীর সবাই স্বার্থপর। সবাই নিজের কথা ভাবে আমিও তাঁই ভেবেছি। কহিনুরকে না পেলে তোদের সমস্যা, আমার তো না? তাহলে আমি কেনো তোদের জন্য নিজের স্ত্রী ক‍ন‍্যাকে ত‍্যাগ করবো? কোন সুখ পাবো মিস্টার জামসেদ ফারুকী? ভালো করে শুনে নিন আপনার আর আপনার ড‍্যাডের কোনো পরিকল্পনা সফল হচ্ছে না।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। সামনে ওর ভাই জামসেদ ফারুকী হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখেমুখে বিস্ময় খেলা করছে। হয়তো জুবায়েরের থেকে এসব আশা করেনি। জুবায়ের অধার হাতের কব্জি ধরে ফিসফিস করে বলল,

> ভেতরে যাও শীত পড়ছে। আমি কথা বলে আসছি।

অধরা কি করবে বুঝতে পারছে না। থাকা উচিত নাকি চলে যাওয়া উচিৎ? দুই ভাইয়ের মধ্যে কথা হচ্ছে ওর থাকা শোভা পাচ্ছে না কিন্তু না থাকলে যদি এরা দু’ভাই ওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তখন? জুবায়ের ওর সঙ্গে একবার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। দ্বিতীয়বার করবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। করতেই পারে। তাছাড়া ও ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। স্বামী বলে তাঁকে কারণ ছাড়া বিশ্বাস করে ঠকার মনে হয়না। জুবায়েরকে ও আপাতত সন্দেহভাজনের তালিকায় রেখেছে। অধরাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জুবায়ের আবারও বলে উঠলো,
> কি হচ্ছে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? বিশ্বাস করতে পারো শেষবারের মতো।
অধরা কিছু বললো না। চুপচাপ ভেতরে চলে গেলো। জুবায়ের একবার পেছনে তাঁকিয়ে সামনে দৃষ্টি ফিরালো। জামসেদ তখনো চুপচাপ ছিল। অধরাকে যেতে দেখে চাপা কন্ঠে বলল,
> ভাই তুই আমাকে অবিশ্বাস করছিস? শোন আমি কিন্তু ইনোসেন্ট। যা হচ্ছে তাঁর বিন্দুমাত্র আমার হাত নেই। জানিস তো ড‍্যাড কেমন? দাদু উনার মাথায় আজেবাজে সব ঢুকিয়েছে। তাছাড়া তোর যদি অধরাকে নিয়ে আমাদের এই বাড়িতে থাকতে অসুবিধা হয় তাহলে ওকে নিয়ে তুই দাদুর কাছে চল। ওখানে থাকবি। ওখানে দাদু দাদিমা সবাই আছে।
> এখানে থাকলে কি অসুবিধা? তাছাড়া তুই কেনো মাথা ঘামাচ্ছিস? আমার স্ত্রী কোথায় থাকবে সেটা না হয় আমি ভাববো। ড‍্যাডকে বলিস এসব কু কর্ম ছেড়ে ভালো হয়ে যেতে। আধুনিক যুগে বসবাস করে সেই আদিকালের মতো ফালতু জিনিস নিয়ে উনি পড়ে আছেন। তাছাড়া আমি তো এখন তোদের পথের কাঁটা। উপড়ে ফেলার চেষ্টা করা হলো কিন্তু হলো না। ভাই অযথা সময় নষ্ট করিস না। এবার যা আমি আসছি।
জুবায়ের কথা শেষ করে এক মূহুর্ত আর অপেক্ষা করলো না। হাটতে শুরু করলো। ওকে পেছন থেকে বহুবার ডাকা হলো। জুবায়ের ভেতরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে অধরার পাশে গিয়ে বসলো। মেয়েটা চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে। শরীর আগের চেয়ে হালকা ফোলা ফোলা লাগছে। পেটের আকৃতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। শরীরের উজ্জ্বলতা ফিরে এসেছে। মেয়েটাকে এতোদিন কেনো যে এভাবে দেখা হলো না এখন বেশ আফসোস হচ্ছে। তখন তো জুহি আর আরমান ফারুকীর জন্য চোখে পট্টি বাঁধা ছিল। জুবায়ের একমনে এসব ভেবে চলেছে। হঠাৎ অধরার কথা শুনে ওর ধ‍্যান ভাঙলো। অধরা চোখ বন্ধ করেই বলে উঠলো,
> দেখা শেষ হয়ে থাকলে বলুন উনি সত্যি সত্যি কোনো রোগে আক্রান্ত কিনা?
জুবায়ের থতমত খেয়ে বলল,
> আমি জানিনা। মাম্মা বলেন ও ছোট থেকেই এমন। ওর সুবিধার জন্য লুকিয়ে ঘর তৈরি করা হয়েছে।
> লুকিয়ে কেনো? লোকজন উনার অস্তিত্ব জানলে অসুবিধা কি হতো? নাকি অন‍্যকিছু। ধরুন ওর কাছে এমন কোনো পাওয়ার আছে যেটা আপনার কাছে নেই। আপনাকে খু*ন করে ওকে আপনার জায়গাই প্রতিষ্ঠা করবেন আপনার বাবা। আপনাকে হত্যার পেছনে আরও কিছু রহস্য লুকিয়ে আছে সেটার খোঁজ করুন। এখানে বসে থেকে কিছু হবে না। চলুন এমন কোথাও যায় সেখানে গিয়ে পুরোপুরি রহস্যের সমাধান জেনে নিতে পারবো। আমাকে নিয়ে টেনশন নেই। বাচ্চা হতে এখনো অনেকটা সময় আছে। ততদিন আমাকে কিছু করবে না। বিপদ আপনাকে নিয়ে। জুবায়ের বসে থাকলে সমস্যা বৃদ্ধি হবে। বুদ্ধি নেই কেনো আপনার?
জুবায়ের অধরার মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে। এই মেয়েটার বুদ্ধি সত্যিই চমৎকার। ওর ভালো লাগছে অধরা ওকে নিয়ে চিন্তা করছে কিন্তু ওকি আদো মেয়েটার ভরসার যোগ্য? জুবায়ের কিছু একটা ভেবে বলল,
> ওই বাড়িতে পা রাখলেই আমি নিজের মধ্যে থাকি না। জানিনা কি হয় তোমাকে দেখতে পারিনা। রাগ হয় অশান্তি লাগে। আমি না চাইতে তোমার উপরে টর্চার করি। কিছু একটা আছে আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখে। বোঝাতে পারবো না তোমাকে।
অধরা আগ্রহ নিয়ে বলল,
> আপনি তখন নিজের মধ্যে সত্যি থাকেন না। সম্মোহন করা হয়। কারো হাতের পুতুলের মতো আচরণ করেন। যাইহোক এসব নিয়ে ভাবলে চলবে না। আমি বুদ্ধি বের করছি। আপনি আমাদের যাওয়ার কথা ভাবুন। এখানে ফিরবো একেবারে সব রহস্য জেনে তারপর।
> আমাদের আরেকটি বাড়ি আছে তুমি জানো? সেখানে দাদু আছেন। ভাই বলছিলো ড‍্যাড এসব দাদুর কথায় করছেন। তুমি যাবে সেখানে?
অধরা একটুও চমকালো না। বাড়ি থাকতেই পারে। কারণ আরমান ফারুকী স্ত্রীকে নিয়ে বেশিরভাগ সময় সেখানে থাকেন। কিন্তু সেই বাড়িতে কে কে আছে এটা ওর জানা নেই। কখনও বলতে শোনেনি। অধরা সোফায় হেলান দিয়ে বলল,
> যাওয়ার ব‍্যবস্থা করুন। আর আপনার ভাইকে একটু বলবেন ভাতৃবধুকে বোনের নজরে দেখলে ভালো হয়। হারাম জিনিসের প্রতি উনার একটু বেশিই আগ্রহ। আমি যতই নিজেকে আড়ালে রাখি উনি সামনে চলে আসছেন।
জুবায়েরের খারাপ লাগছে,রাগ হচ্ছে। হাতের মুঠো শক্ত করে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
> সরি। তোমার সন্ধান কিন্তু ওই দিয়েছিল। আমাকে বলেছিল শুধু বিয়ের পরে একটা বাচ্চা হলে তোমাকে ছেড়ে জুহিকে বিয়ে করে নেওয়ার কথা। তাছাড়া তখন আমি ড‍্যাডের বাধ‍্য ছিলাম। ভাইবোনদের কথা ভেবেছিলাম।
অধরা ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,
> বউরা সব সময় খারাপ হয়না। আপনাদের মতো পুরুষের বিয়ে করা সাজে না। ভাইবোনদের ভালো করতে নিষেধ করছি না তাইবলে নিজের সন্তানকে তাঁদের হাতে তুলে দিবেন এটা কেমন কথা? আপনি জানেন ঘরের শান্তি হচ্ছে স্ত্রী সন্তান। যাইহোক বুঝতে হবে না। রহস্যের সমাধান করে আমাকে ছেড়ে দিয়েন। জুহি তো নেই আত্না ফাত্তা থাকলে ডেকে নিয়ে বিয়ে করে নিয়েন। আমি মেয়েকে নিয়ে থাকবো। তারপর যদি ভালো কাউকে পাই তখন বিয়ে নিয়ে ভাববো। আমি যথেষ্ট সুন্দরী । ছেলের অভাব হবে না। তাছাড়া আপনার ভাই আছেন তো। উনি বারবার আমাকে কু ইঙ্গিত….
অধরা বাকীটা বলতে পারলো না। জুবায়ের ওকে মুখ চপে ধরে রাগে ফুলছে। ভ্রু কুচকে বলল,
> বিশ্বাস ভেঙেছি শাস্তি হিসেবে সারাজীবন এক কক্ষে দুটো বিছানা তৈরী করে ঘুমাবো তবুও চোখের সামনে থাকা চাই। আমি খারাপ মানুষ সারাজীবন খারাপ থাকবো। মারামারি জোরজবরদস্তি সব আমার কাজ। ভালো হতেও চাইছি না। তুমি যদি এসব ফালতু চিন্তা করে থাকো আমিও খারাপ হবো। ভালোবাসা বাসির দিন শেষ। আমাকে দেখতে না চাইলে চোখ বন্ধ করে আমার সামনে ঘুরবে সমস্যা নাই।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে ওকে কোলে তুলে নিয়ে রুমে চলে গেলো। অধরা জানতো এমন কিছুই হবে। জুবায়েরকে চিনতে ওর বাকি নিই। একটু চেতিয়ে দিলেই কাজ হয়েছে। যে ঝামেলায় নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে সেখানে এই মাথা মোটা লোকটাকে নিয়ে গিয়ে বিপদ হবে কি কে জানে।
☆☆☆☆☆☆☆☆
গাড়ি চলছে জুবায়েরের দাদুর বাড়িতে। সকাল সকাল আঙ্কেল আন্টির থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়েছে অধরা। সঙ্গে আয়াত এসেছে। অধরা ওকে নিতে চাইনি কিন্তু ছেলেটা শুনছে না। যদি কোনো ঝামেলা হয় তাই জোর করে এসেছে। কাজের মেয়েটা আর মারিয়াও আছে। জুবায়ের মারিয়াকে রেখে কোথাও যায়না। বোনকে সঙ্গে রাখে। মেয়েটার মধ্যে কিছু ঝামেলা আছে। আরমান ফারুকী জানলে ঠিকই মেয়েকে নিজের কাজে লাগিয়ে দিবে। সকলের ছোট বোনটাকে ওর বাকী বোনদের থেকে আলাদা রাখে। ওরা বোবা বধির হতে পারে কিন্তু কিভাবে জানি মানুষের সব কথা বুঝে যায়। রাতের আধরে সব পার্টিতেও যায়। কোনো রাত মিস করে না। দীর্ঘ চার ঘন্টা পর গাড়ি থামলো বিশাল এক অট্টালিকার সামনে। বাড়িটার ধুসর রঙের। অধরা গাড়ি থেকে পা নামাতেই মনে হলো পুরো শরীর কেঁপে উঠে পড়ে যাবে। জুবায়ের ওকে ধরে ফেলল। দীর্ঘসময় গাড়িতে থাকার ফলে এমন হচ্ছে। মারিয়া এসে ওর হাত ধরে ইশারা করলো ভেতরে যাওয়ার জন্য। গেটের সামনে কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে ওদেরকে বরণ করে নিতে। বাড়ির ভেতরটাতে ছোটখাট একটা বাগান দেখা গেলো। আচার্যের বিষয় এখানে কোনো ফুল নেই। অধরাকে রাণীর মতো বরণ করা হচ্ছে এটাই ওকে ভাবাচ্ছে। কয়েকজন মিলে ওকে ভেতরে নিয়ে বসতে দিলো। অধরা বসতেই সিঁড়ি দিয়ে একজন সাদা চুলের বৃদ্ধ লোক নেমে আসলো। অধরা লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো।

চলবে

#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব: ১২

আলো ঝলমলে শীতের দুপুর। ধুসর রঙের অট্টালিকার ভেতরটা মোটেও ধুসর রঙের না সাদা রঙের। কেমন অদ্ভুত সব কিছু। ভেতরে দামিদামি আসবাবপত্রের ছড়াছড়ি। অধরার পাশে আয়াত চুপচাপ বসে আছে। ছেলেটা এদের অতিথি সেবায় মুগ্ধ, যেটা ওর চোখেমুখে প্রকাশ পাচ্ছে। জুবায়ের ওদেরকে বসিয়ে দিয়ে কোথায় একটা ঘাপটি মেরেছে। অধরা অনবরত ঢোক গিলছে। জুবায়েরের দাদুর দৃষ্টিটা কেমন কু-ইঙ্গিত দিচ্ছে। কেমন জানি অদ্ভুত রকম। লোকটার চোখের পাপড়ি গুলো তুলনামূলক ভাবে বেশ বড় আর সাদা রঙের। সাদা পাঞ্জাবীর সঙ্গে লোকটা সাদা রঙের লুঙ্গি পরেছে। ভদ্রলোক যে বাঙালি সেটা উনার পোশাক দেখে বোঝা যাবে কথা বলার দরকার হবে না। অধরার ধ‍্যান ভাঙলো ভদ্রলোকের কথা শুনে। চমৎকার করে হেসে বলে উঠলেন,
> দাদুভাই কেমন আছো? আমার শরীর ঠিক ছিল না তাই বাংলাদেশ গিয়েছিলাম তাই তোমার সঙ্গে আলাপচারিতার সুযোগ হয়নি। তবে কিন্তু তোমাকে আমার কাছেই থাকতে হবে দাদুভাই। কাছ ছাড়া করছি না।
অধরা জোর করে ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,
> আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি দাদুভাই। আপনার কথা আমি জানতাম না। জুবায়ের কখনও বলেননি আপনার কথা। আপনাকে আমার থেকে লুকিয়ে রেখেছিল কেনো দাদুভাই?
ভদ্রলোক যেনো কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন এমন প্রশ্ন শুনে তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে কাকে একটা ডেকে ওদেরকে ফ্রেস হতে কক্ষে নিয়ে যেতে বললেন। জুবায়েরের একটা ফুপি আম্মা আছেন তার এক ছেলে দুই মেয়ে। সবাই এখানে থাকে। মেয়ে দুটো কথা বলতে পারে কি বুঝতে পারলো না। কারণ এখনো পযর্ন্ত ওদের কোনো কথা শোনা যায়নি। জুবায়ের যে মাঝেমাঝেই গায়েব হয়ে যেতো এটাই তাঁর রহস্য। এখানে এসে থাকতো। অধরা ভাবতো অফিসের কাজ বিজি আছেন। আয়াতকে ফুপির ছেলেটা এসে নিয়ে গেলো। অধরা সেদিকে তাঁকিয়ে একটু টেনশন করলো ছেলেটার আবার কোনো ক্ষতি না হয়ে যায়। অধরা আসার সময় লুকিয়ে ফোন নিয়ে এসেছে যেটা জুবায়ের জানেনা। অধরা ফোনটা নিজের সঙ্গে সঙ্গে রাখবে। যখনই বিপদের ঈঙ্গিত পাবে পুলিশে ফোন করবে। তাছাড়া শাশুড়ির দেওয়া জিনিসপত্রগুলোকে সঙ্গে নিয়েছে। খালি হাতে যুদ্ধে নেমে হেরে যাওয়ার মানে হয়না। এবার যা করবে বুদ্ধি দিয়ে। অধরাকে ওর ফুপি শাশুড়ি রুমে নিয়ে গেলো। একটু পরে কাজের মেয়েটা লাগেজ দিয়ে গেলো। বেশ বড়সড় সাজানো গোছানো কক্ষ। দেয়ালে টাঙানো জুবায়েরের বড় একটা ফ্রেম বন্দি ছবি টাঙানো আছে। অধরা আশেপাশে ঘুরে ঘুরে দেখলো। হঠাৎ জুবায়েরের কন্ঠ শুনে ও চমকে উঠে পেছনে তাকালো। জুবায়ের দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
> ম‍্যামের পদধুলিতে আমার কক্ষটা ধণ্য হলো। এবার বলুন কেমন লাগছে! পছন্দ হয়েছে?
অধরা মুখে হাত রেখে চিন্তিত হয়ে বলল,
> সব ঠিকঠাক, তবে একটাই সমস্যা সেটা হচ্ছে বেলকনি। এখানে কোনো বেলকনি নেই কেনো? মন খারাপ হলে আমি কোথায় গিয়ে কান্নাকাটি করবো? বাইরের দৃশ্য দেখবো কিভাবে? বেলকনির অবদান আমার জীবনে প্রচুর। এই বেলকনি ছিল বলেই না বর আর বরের গার্লফ্রেন্ড রোমান্টিক সিনটা দেখতে পেয়েছিলাম। এই জানতো জঘন্য খারাপ রুম আপনার।
অধরা হাতের টাওয়েল টা জুবায়েরের দিক ছুড়ে দিয়ে বসে পড়ে পড়লো। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। জুবায়ের হতভম্ব হয়ে গেছে অধরার কথা শুনে। মান ইজ্জতের ছিটেফোঁটা অবশিষ্ট থাকলো না। কোনরকম মাথা চুলকে বলল,
> সরি আসলে জুহি তখন জোর করছিলো। আমি না করতে পারিনি।
অধরা বিরক্ত হয়ে বলল,
> হয়েছে হয়েছে, সরি বলতে হবে না। জানি প্রেম ট্রেম করলে এসব হয়ে থাকে। আমিও করবো। ইউনিভার্সিটির একটা ছেলে আমাকে পছন্দ করতো। ছেলেটা এখনো সিঙ্গেল। ভাবছি ঝামেলা শেষ হলে ওর সঙ্গে প্রথমে প্রেম করে তারপর বিয়ে করবো। আমি বেশ ক্লান্ত আছি ঘুমাবো।

জুবায়েরের মেজাজ খারাপ হলো। ছেলেদের সঙ্গে কি মেয়েদের তুলনা চলে? জীবনে প্রথমবার ভুল করেছিল তাও আবার বউয়ের চোখের সামনে। জীবনদশাতে কতবার যে খোঁটা শুনতে হবে আল্লাহ্ ভালো জানে। যে যাইহোক যত ইচ্ছা বলুন সমস্যা নেই কিন্তু তাই বলে আরেক ছেলের সঙ্গে বিয়ে করবে আবার চুমুও খাবে এটা অতিরিক্ত। জুবায়ের একদম মানবে না। ও দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> যা খাওয়ার আমার সঙ্গে খেতে পারো বাইরের লোকদের দরকার কি। ছেলের নাম ঠিকানা দাও। আমি বের হবো। একদম খু*ন করে ফেলবো ।
অধরা বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে হামি ছেড়ে বলল,
> পুরাতন জিনিসের প্রতি আমার আবার আগ্রহ কম। এই জানতো আমি একটু ঘুমাবো। বহুকাজ আছে। বাইরে যাবেন বললেই তো হয়ে যাবে না। এই যে আপনি আর আপনার ভাই টুইন অথচ আপনার সঙ্গে উনার কতো পার্থক্য। উনি রাতে ঘুরাঘুরি করেন দিনে মাটির নিচে।উনার সমস্যাগুলো আপনার হলো না কেনো? দ্রুত খোঁজ নিন। বিষয়টা ডাক্তারের সঙ্গে আলোচনা করে দরকার হলে ডি এন এ টেস্ট করুন।
জুবায়ের মুখ ভার করলো অধরার কথা শুনে। ও যতই মেয়েটাকে অধিকার দেখিয়ে কথা বলছে মেয়েটা ওকে তত ইগনোর করছে। কাছাকাছি আসার কোনো সুযোগ নেই। মেয়েরা বুঝি এমনিই হয়। ভালোবাসলে মন দিয়ে বাসে আবার ঘৃণা করলে মনেপ্রাণ ভরে ঘৃণা করে। জুবায়ের দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। চুপচাপ ফ্রেস হয়ে টাওয়েল রেখে বলল,
> আমি যাচ্ছি কোনো দরকার হলে মারিয়াকে বলবে। নিজের বদ বুদ্ধি খরচ করে কিছু করতে যাবে না। তোমাকে নিয়ে আমার চিন্তার শেষ নেই।
অধরা উত্তর দিলো না। ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। জুবায়ের হতাশ হলো। কম্বলটা ওর গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বেরিয়ে আসলো। এতদিন প্রশ্নটা যে ওর মনে আসেনি এমনটা না। কিন্তু কখনও জানার চেষ্টা করেনি। এবার করতে হবে।
☆☆☆☆
সন্ধ্যার আগ মূহুর্তে ঘুম ভাঙলো অধরার। দুবার কেউ ডেকেছিল কিন্তু এখন সেটা মনে পড়ছে না। অধরা দ্রুত ফ্রেস হয়ে ট্রি টেবিলে রাখা খাবারটা খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে আসলো। লম্বা বারান্দা দিয়ে হাটতে হাটতে সামনে গিয়ে বারান্দার শেষ প্রান্ত দেখতে পেলো। পশ্চিম দিকে জঙ্গলটা দৃশ্যমান। হঠাৎ সাদা পোশাকে একজন লোকটাকে ও জঙ্গলের ভেতরে ঢুকতে দেখলো। লোকটা চোরের মতো ডানে বামে তাকাচ্ছে। অধরার সন্দেহ হলো তাই ফট করে পেছনের দরজা দিয়ে নেমে আসলো আর লোকটার পিছু নিলো। চার‍দিকে যে সন্ধ্যা নেমেছে কিছুক্ষণের মধ্যে সূর্যমামা পৃথিবী থেকে বিদায় নিবে এটা ওর খেয়াল হলো না। জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেলো। কিছুদূর এসে লোকটাকে আর পেলো না। দূরে ‍একটা আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। গাছের ফোকর দিয়ে আলো এসে এখানে ওখানে অন্ধকার কেটে আলো তৈরী করছে। অধরার পা চলছে না। মাঝেমধ্যে হোচট খেলো তবুও হাটা থামলো না। আলোর কাছাকাছি আসতেই দেখলো লোকটা হামু হয়ে কিছু একটা খাচ্ছে। অধরা নিজেকে একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে ফেলল। লোকটা পেছনে ঘুরে ছিল এবার সামনে ঘুরলো। অধরার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। এই লোকটাকে ও ওই বাড়িতে দেখেছিল। সে যাইহোক লোকটার মুখে আর সাদা পোশাকে র*ক্তের ছোপ ছোপ দাঁগ। সামনে কাচা মাংস আর হাড্ডি চিবিয়ে চিবিয়ে খাচ্ছে। অধরা দৃশ্যটা দেখে বমি করে ফেলল। কি জঘন্য লাগছে। শীতের মধ্যেও কুলকুল করে ঘামছে। হঠাৎ পেছন থেকে ঠান্ডা একটা হাত ওর কাঁধ স্পর্শ করলো। অধরা কেপে উঠে পেছনে তাঁকিয়ে হতভম্ব। জুবায়ের ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দৃষ্টিও সামনের লোকটার দিকে। হয়তো এরকম অবিশ্বাস্য দৃশ্য বিশ্বাস করতে পারছে না। অধরা কথা বলতে চাইলো কিন্তু তাঁর আগেই জুবায়ের ধুপ করে হাটু ভেঙে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারালো। অধরা বিপদ ভূলে গিয়ে জুবায়েরের পাশে গিয়ে বসে পড়লো। ফিসফিস করে বলল,
> এই যে শুনছেন? কি হলো আপনার? কথা বলুন। আরে ভয় পাচ্ছেন কেনো আমি আছি তো।
অধরা একদমে কথাগুলো বলে থামলো।জুবায়ের কথা বলতে পারলো না। অধরার কান্না পাচ্ছে। কি একটা বর জুটেছে কপালে। সারাক্ষণ খু*ন করবো এটা করবো ওটা করবো ডাইলগ মারে এখন কাজের বেলা ভীমড়ি খেয়ে বিপদ আরও বাড়িয়ে দিলো। মেজাজ খারাপ সঙ্গে টেনশন। কিভাবে একে বাড়িতে নিয়ে যাবে ভাবতেই বুক কাঁপছে। এদিকে আধার নেমে এসেছে। জুবায়েরের মাথা নিজের কোলে নিয়ে কেঁদে ফেলল ভয়ে। বিড়বিড় করলো বর না বর্বর। কোথায় বউকে সাহায্য করবে তানা নিজেই ভয়ে অজ্ঞান হয়েছে। আশেপাশের কোথাও পানি থাকলে ঝামেলা ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ পর জুবায়েরের জ্ঞান ফিরলো। অধরা গাছের ফোকর দিয়ে সামনে তাঁকিয়ে দেখলো সেখানে থাকা লোকটা নেই। এমনকি সেখানে কোনো তাঁর চিহ্ন পযর্ন্ত নেই। জুবায়েরের মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসলো। মাথা ভার ভার লাগছে। অধরা ভ্রু কুচকে বলল,
> আপনি ঠিক আছেন?
জুবায়ের ঠোঁট উল্টে বলল,
> সরি আমি এরকম দৃশ্য কখনও দেখিনি । বাসা থেকে তোমার পিছু পিছু এসেছি। কতবার ডাকলাম তুমি শুনলে না। তারপর এখানে এসে দেখি এই দৃশ্য। আসলে হঠাৎ দেখেছি তো তাঁই সহ‍্য হয়নি। সারাদিন খালি পেটে।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। অধরা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বলল,
> এবার থেকে চাপাবাজি কম করবেন। আমি আপনাকে হিরো ভাবতাম এখন দেখি আপনি জিরো। হিরো না হয়ে ভিলেন হতেন তাঁতেও আমি গর্ববোধ করতাম। বাড়িতে চলুন আর একটু হলে লোকটাকে হাতেনাতে ধরতে পারতাম। পরেরবার যদি দেখিনা আমার পিছু নিয়ে ঝামেলা করেছেন তো খু*ন করে ফেলবো। হাঁটতে পারবেন নাকি কোলে নিতে হবে।

জুবায়েরের মুখটা দেখার মতো হলো। কিভাবে কি হয়েছিল কিছুই বুঝতে পারেনি। জীবনে যা কিছু লজ্জাজনক প্রথমবার ঘটছে সবটা বউয়ের সামনে ঘটতে হচ্ছে। আফসোসের শেষ নেই।এমন বেদনা ভরা জীবন নিয়ে সামনে এগোতে হবে কি দুঃখ! জুবায়েরের ধ‍্যান ভাঙলো অধরার কথা শুনে,
> আসুন কোলে নিচ্ছি। মাটিতে আর কতক্ষণ লুটিয়ে পড়ে থাকবেন?
জুবায়ের দ্রুত উঠে অধরাকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির পথে হাটা ধরলো। অধরা হতভম্ব হয়ে জুবায়েরের কাজকর্ম দেখছে। ভ্রু কুচকে বলল,
> হঠাৎ জ্ঞান হারালেন কেনো বলুন তো? ভয়ে নাকি কোনো রহস্য আছে?
> কিসের রহস্য? কোনো রহস্য নেই। শরীর খারাপ নিয়ে বর তোমাকে কোলে নিয়ে হাঁটছে কোথায় একটু আদর করবে, রোমান্টিক কথাবার্তা বলবে তানা জেরা করছো মেয়ে? আমি সত্যি বলছি জানিনা তখন কি হলো। চোখ আপনা আপনি বন্ধ হয়ে আসলো। তোমার কথা মতো হাসপাতালে গিয়েছিলাম। আগামীকাল রিপোর্ট আসবে। তাছাড়া একটা ঝামেলা হয়েছে তোমাকে বলার সুযোগ পাইনি। আমার উপরে আবারও আক্রমণ করা হয়েছিল। গাড়ি চাপা দেওয়ার চেষ্টা। তেমন কিছু হয়নি। পায়ে আর হাতে লেগেছে। হাসপাতালে দুঘন্টা অচেতন ছিলাম।
জুবায়েরের কথা শুনে অধরা উতলা হয়ে উঠলো। জোর করে কোল থেকে নামতে চাইলো কিন্তু জুবায়ের নামালো না। অধরা বিরক্ত হয়ে বলল,
> বাচ্চাদের মতো বুদ্ধি নিয়ে আপনি গোয়েন্দা হবেন? বলেছিলাম নিজের খেয়াল রাখবেন কিন্তু না সব উল্টে দিয়েছেন। আগামীকাল থেকে কাছে সব সময় ক‍্যামেরা রাখবেন। আমি আপনার পোশাকে ক‍্যামেরা লুকিয়ে দিবো। আর আশেপাশে গার্ড রাখবেন। আপনি তো আমার কথায় শুনছেন না।
> বুঝতে পারিনি হঠাৎ এরকম ঝামেলা হবে। যাইহোক আগামীকাল থেকে সর্তক থাকবো। শুনো রাতে স্টোর রুম চেক করতে হবে। শরীর খারাপ বা ভয় পেলে কিন্তু সব খতম।
> জানিনা আপনাদের স্টোর রুমে আবার কোন রহস্য লুকিয়ে আছে। নামিয়ে দিন আমি হাঁটতে পারবো। আপনার শরীর খারাপ। সুস্থ হয়ে উঠুন তারপর না হয় আপনার কোলে চড়েই বিশ্ব ভ্রমণে বের হবো। এখন নামবো।
জুবায়ের ওকে নামালো না। পেছনের দরজা দিয়ে কক্ষে ফিরে একে বিছানায় রেখে নিজেও বসে পড়লো। আঘাত পাওয়া জায়গা থেকে র*ক্ত বের হচ্ছে। অধরা সেটা পরিস্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিলো। টেনশন হচ্ছে সামনে কি অপেক্ষা করছে কে জানে।

(চলবে )

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে