#কহিনুর
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:৯+১০
নিস্তব্ধ নির্জন কক্ষ, দেয়াল ঘড়িটা খসখস আওয়াজ করে ঘুরছে। দুজন মানুষের ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। জানালা ভেদ করে চাঁদের আলো ভেতরে প্রবেশ করে কক্ষের মধ্যে থাকা আধারটা আবছা আলোতে রূপান্তরিত করেছে। জানালার ওপাশে ঘন জঙ্গল। হঠাৎ খুট করে আওয়াজ হয়ে দরজাটা আস্তে করে খুঁলে গেলো। অধরা ঘুমিয়ে ছিল হঠাৎ আওয়াজ পেয়ে দ্রুত চোখ খুঁলে থাকালো। একটা ছায়া ধীরস্থির ভাবে পা ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। হুডি চাপানো লোকটার হাতে ঝকঝকে খঞ্জর, আলোতে চকচক করছে। অধরার বুক ধুকপুক করছে। ভাবলো লোকটার উদ্দেশ্য কি? ওকে মারতে চাইছে! কিন্তু কেনো? পাশে জুবায়ের ঘুমিয়ে আছে। অধরা নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছে। লোকটা যখনই ওর দিকে আক্রমণ করবে ও দ্রুত সরে গিয়ে লাইট জ্বালিয়ে দিবে। একে হাতেনাতে ধঁরা চাই। উত্তেজনাতে ওর হাত পা কাঁপছে। কিন্তু লোকটা ওর দিকে না গিয়ে সোজাসুজি বাম সাইডে জুবায়েরের দিকে এগিয়ে গেলো। এমনতো না যে আধারের জন্য ওকে চিনতে পারছে না। বেশ ভালো করে চেনা যাচ্ছে। টার্গেট ও নয় জুবায়ের।বিষয়টা খেয়াল হলো ততক্ষণে লোকটা খঞ্জর উঠিয়ে জুবায়েরের বুকে আঘাত করতে গেলো। অধরা তড়িৎ বেগে উঠে বসলো। লোকটার হাত সমেতো খঞ্জরটা ধরে ফেললো। প্রচণ্ড ধস্তাধস্তি শুরু হলো। অধরার কাটা হাত আরও কিছুটা কেটে গেলো। ব্যাথায় টনটন করছে কিন্তু ও হাত ছাড়লো না। পাশে জুবায়েরের গায়ে ধাক্কা দিয়ে চিৎকার করে বলল,
> জুবায়ের দ্রুত উঠুন।
জুবায়ের পিটপিট করে চোখ খুঁলে হতভম্ব হয়ে গেলো। ওর বুকের উপরে দুজন ছুরি নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। অধরা পারছে না লোকটার শক্তির কাছে। হিমশিম খাচ্ছে। জুবায়ের অপেক্ষা করলো না পা তুলে লোকটার বুক বরাবর লাথি বসিয়ে দিলো। অচেনা লোকটা ছিটকে গিয়ে মেঝেতে পড়লো। অধরা বিছানায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেলো। জুবায়ের ওকে সরিয়ে দিয়ে বিছানা থেকে নামতে নামতে লোকটা হাওয়ার গতিতে বেরিয়ে গেলো। অধরা নিজের সামলে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ওদের পিছু নিলো। বাড়ির বাইরের গেট খোঁলা। অগন্তুক যেভাবে এসেছিল সেভাবেই বেরিয়ে গেছে। লোকটা আসার সময় সব রাস্তা তৈরী করে এসেছিল। শীতের রাত কেউ একবার রুমে ঢুকলে বাইরে বের হবে না এই ভরসাতে লোকটা এভাবে ভেতরে এসেছে। জুবায়ের লোকটাকে ধরতে না পেরে ফিরে আসলো। গেটের কাছাকাছি অধরার সঙ্গে দেখা হলো। মেয়েটার চোখেমুখে ভয় নেই আছে বিরক্তি। জুবায়েরকে এভাবে তাঁকিয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন ছুড়লো,
> ধরতে পারলেন না,ফিরে আসলেন কেনো? শুনুন ওই কিলারকে আমার চাই। যেভাবেই হোক। বাইরে সিসি ক্যামেরা আছে। এখানকার প্রতিটা বাড়ির সামনে আপনি ক্যামেরা পাবেন। আমি সবগুলো ফুটেজ দেখতে চাই আপনি ব্যবস্তা করুন। ওকে কে পাঠিয়েছে জানা দরকার।
অধরা একদমে কথাগুলো বলে থামলো। জুবায়ের সেসব পাত্তা না দিয়ে অধরার হাতটা ধরে বিস্মিত হয়ে বলল,
> তোমার হাত কেটেছে? র*ক্ত বন্ধ করতে হবে। তুমি আগে কেনো ডাকলে না?
জুবায়ের হন্তদন্ত হয়ে ওর হাত ধরে ভেতরে ছুটলো। অধরা বিরক্ত হচ্ছে জুবায়েরের উপরে। লোকটা নিজে যখন কষ্ট দিবে তখন কিছু না। এইটুকু কেটেছে তাঁর জন্য উতলা হচ্ছে। কাজের কাজ নেই অকাজের গুণ বেশি। ও জুবায়েরকে মানা কারলো কিন্তু শুনলো না। সকালে আয়াতের সঙ্গে এসেছে ওরা। পাশাপাপাশি দুটো বাড়ি। অধরার ইচ্ছে হয়েছিল বাবা মায়ের স্মৃতিবিজড়িত বাড়িতে রাতে ঘুমানোর তাই এই বাড়িতে আছে। বাকিরা আয়াতদের বাড়িতে । অধরা ওদেরকে আনতে চেয়েছিল কিন্তু বহুদিন বাড়িটা পড়েছিল তাই ধুলাবালিতে পূর্ণ হয়ে আছে। পরিস্কার করার সময় ছিল না। একপ্রকার বাধ্য হয়ে জুবায়ের ওকে নিয়ে এই বাড়িতে থাকতে এসেছে। জুবায়ের খুব যত্ন নিয়ে অধরার হাতটা ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বলল,
> লোকটা কালো হুড়ি চাপিয়ে ছিল। মুখটা দেখতে পেলে ভালো হতো।
অধরা রাগে ফুলে উঠলো। নাকমুখ কুচকে বলল,
> সব আপনার দোষ। কে বলেছিল লাথি বসাতে?। চুপচাপ উঠে লোকটাকে ঝাপটে ধরা যেতো। শুধু আপনার জন্য। মাথায় কিছু নেই আপনার। পুষ্টিজনিত সমস্যা আছে। টুইন বেবি তো সব আপনার ভাইয়ের মাথায় চলে গেছে। এবার বলুন আপনার এমন কোনো শত্রু আছে যে আপনাকে হত্যা করতে চাইতে পারে?
জুবায়ের বিস্মিত হলো অধরার কথা শুনে। ওকে মারতে চাইবে এরকম লোক এখানে কে থাকবে। তাছাড়া ও যতই ঘাড় ত্যাড়া হোক বাইরের লোকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে না। একটু জেদি কিন্তু খারাপ না। সবাই ওকে পছন্দ করে। ও এতক্ষণ ভেবেছিল লোকটা অধরাকে মারতে এসেছিল। কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন করলো,
> মানে কি আমাকে মারতে চাইবে কেনো?
> লোকটা আপনাকে মারতে চেয়েছিল। দেখুন রুমে সামান্য হলেও আলো ছিল। তাছাড়া আমাকে মারতে চাইলে ডান সাইডে এসে আঘাত করতো কিন্তু না। আমি দেখেছি লোকটা দরজা থেকে সোজা আপনার দিকে নজর করে এগিয়ে এসেছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম আমাকে মারবে কিন্তু টোটালি মিথ্যা হলো। জুবায়ের আপনার অগোচরে বাজে একটা খেলা চলছে। আপনাকে ওই লোকটার পযর্ন্ত পৌঁছতে হবে।
জুবায়ের মলিন হাসলো ভয় পেলো না। অধরা না থাকলে এতক্ষণে প্রাণপাখি উড়াল দিতো সন্দেহ নেই। কিন্তু কে করতে পারে এসব?ডানে বামে সন্দেহ হয় কেউ নেই। নিজেকে নিয়ে ওর ভয় নেই। জুবায়ের সেসব পাত্তা দিলো না। খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল,
> আমাকে মারতে চাইবে কেনো তোমার অনুমান ঠিক নেই। দেখো তোমার বাবার কোনো শত্রু ছিল ওরাই প্রতিশোধের জন্য এসেছিল। আমি মৃত্যু দেখে ভয় পাই না। মারতে চাইলে মারবে চলো ঘুমাবে। তোমার শরীর ঠিক থাকা দরকার।
অধরা জ্বলে উঠলো জুবায়েরের এরকম আজেবাজে যুক্তি শুনে। মেজাজ খারাপ হচ্ছে। ও ঝট করে জুবায়েরের কলার ধরে টেনে নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> ফালতু কথা বলবেন না। আমি আপনাকে একটুও পছন্দ করি না। রাগ হয় আপনাকে দেখলে। আমার রাগের পরিমাণটা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। শুনুন আমি আমার ভবিষ্যৎ বুঝে গেছি। আমার জীবন সংকটে আছে। জানি সামনে আমার মৃত্যু অনিবার্য কিন্তু আপনাকে মরলে চলবে না। আমার বাচ্চাটাকে আপনাকে বাঁচাতে হবে। আমার সঙ্গে যে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন তার জন্য ক্ষমা পাবেন শুধু কহিনুর কে রক্ষা করলে। আমি মরে যায়, চলে যায়, যা ইচ্ছা তাই হয়ে যায় কিন্তু আপনাকে বাঁচতে হবে। আমি শপথ নিয়েছি শেষ দেখে ছাড়বো। আপনি আমাকে আটকে রাখতে পারবেন না।
অধরা একদমে কথাগুলো বলে ওকে ছেড়ে দিয়ে কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলো। জুবায়ের হতভম্ব হয়ে ভাবছে ওর বলা কথাগুলো। বাবা মা ওকে শুধু উত্তরাধিকার দিতে বলেছিল। বলেছিল এই বাচ্চাটা আসলে বাড়ির সব বিপদ কেটে যাবে। ভাই আলোতে আসতে পারবে। বোনদের বিয়ে হবে কিন্তু বাচ্চাটার ক্ষতি করবে বলেনি। একটা ছোট্ট বাচ্চা তার ক্ষতি কেনো করবেন উনারা? কি রহস্য চলছে ওর অজান্তে? জুবায়ের অপেক্ষা করলো না দ্রুত কক্ষে ফিরে গিয়ে ফোন নিয়ে বেরিয়ে আসলো। কাকে একটা ফোন করলো। রাস্তার পাশের সব গুলো সিসি ক্যামেরা চেক করা জরুরি। লোকটার মুখ দেখতে না পারলেও কোথা থেকে এসেছে এটা জানা যাবে। গাড়ি করে আসলে গাড়ির রঙ বা নাম্বার পাওয়া যাবে। জুবায়ের লোক লাগিয়ে দিলো। যাওয়ার আগে পাশের বাসাতে খবর দিলো অধরাকে নিয়ে যেতে।
☆☆☆☆☆
অধরাকে সামনে নিয়ে বসে আছে বাড়ির বাকিরা। সকলের চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। অয়াতের বাবা শেখর ইসলাম খুব ভয় পেয়েছেন। অধরা চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিয়ে ছিল। হঠাৎ কি একটা ভেবে বলল,
> আঙ্কেল বাবা মায়ের ময়নাতদন্তের রিপোর্ট এসেছিল ওটা দেখানো যাবে? দুর্ঘটনার সময় যে গাড়িতে বাবার গাড়িটা ধাক্কা দিয়েছিল ওটার মালিক কোথায় আঙ্কেল? এই শহরে গাড়ি দুর্ঘটনা হলো আর যে লোকটা দুই দুটো মানুষের প্রাণ নিয়ে নিলো তাঁকে ছেড়ে দিলো পুলিশ। তোমার সন্দেহ হলো না? তুমি কেস রিঅপেন করতে বলো। আমি এখানে যতদিন বা যতটা সময় আছি এর মধ্যে সবটা জানাতে চাই আপনি ব্যবস্থা করুণ। সন্দেহের উপরে না উপযুক্ত প্রমাণ নিয়ে শত্রুর সামনে দাঁড়িয়ে মোকাবেলা করতে চাই আমি।
শেখর ইসলাম কিছুই বুঝতে পারলেন না। পুলিশ বলেছে দুর্ঘটনার সময় গাড়িতে কোনো লোক ছিল না। এমনকি গাড়িটাও কারো নামে রেজিস্ট্রি ছিল না বিধায় আসল লোককে পাওয়া যায়নি। এর পেছনে কোনো ঘটনা আছে বলে উনার সন্দেহ হচ্ছে না। উনি ভ্রু কুচকে বললেন,
> মা এটা সাধারণ দুর্ঘটনা বৈকি কিছুই না। তুমি খামাখা টেনশন করছো।
অধরা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। বলল,
> আঙ্কেল আমি সন্দেহ করছি না আমি সিউর এটা হত্যা। আপনি প্লিজ সাহায্য করুন। আমি শেষটা দেখতে চাই। চোখের দেখার মধ্যে মাঝেমাঝে ভূল থেকে যায়।
অধরা কথা শেষ করে কক্ষে ফিরে আসলো। মারিয়া ওর খেয়াল রাখছে। কাজের মেয়েটা খাবার নিয়ে ওদের পেছনে পেছনে ছুটছে। জুবায়ের গায়েব। অধরা জানে জুবায়ের রেগে গেছে। এই লোকটাকে একটু রাগিয়ে দিতে পারলে কাজ হার হামেশা হয়ে যাবে। মাথামোটা লোক বুদ্ধি জ্ঞান নেই। অধরা বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। কয়েকবার ফোন করেছে কিন্তু রিসিভ করছে না।। সারাদিন পার করে গভীর রাতে বাড়ি ফিরলো জুবায়ের। ক্লান্ত শরীর। কক্ষে প্রবেশ করতে লেট হলো কিন্তু বিছানায় শুয়ে পড়তে লেট হলো না। অধরা এতক্ষণ ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। জুবায়ের সেসব পাত্তা দিলো না। অধরা দ্রুত গিয়ে জুবায়ের হাত টেনে বলল,
> অকর্মা, কুম্ভকর্ণ,খারাপ মানুষ আপনি। সারাদিন কোথায় ছিলেন? একটা কাজ দিয়েছি ঠিকঠাক পারেননি। আবার কথায় কথায় হুমকি ধামকি দিতে উস্তাদ। মানছি কাজটা কঠিন তাইবলে ফোন রিসিভ করলেন না কেনো? উত্তর দিন তাড়াতাড়ি।
জুবায়ের চোখ বন্ধ রেখেই মলিন হাসলো। ওর কথা পাত্তা না দিয়ে বলল,
> খেয়েছো তুমি? আসার সময় তোমার দরকারি জিনিসপত্র সব গুছিয়ে এনেছিলে?না আনলে লিস্ট করে রাখো আমি আগামীকাল নিয়ে আসবো। তোমার ড্যাডের বাড়িটা আমি আগামীকাল লোকজন দিয়ে পরিস্কার করে নিবো চিন্তা করো না।
অধরা হতবাক জুবায়েরের কথা শুনে। হঠাৎ পরিবর্তন কেনো বুঝতে পারছে না। ও চোখমুখ কুচকে বলল,
> কি হয়েছে আপনার? আমরাতো দুদিন পরেই ফিরে যাচ্ছি তাহলে এসব করে কি হবে?
> ও বাড়িতে আমরা আর ফিরছি না। প্রশ্ন করে আমাকে বিব্রত করোনা উত্তর দিতে পারবো না। তোমার বাবা মায়ের খুনি বা আমার উপরে আক্রমণকারীর ঠিকানা নিয়েও ঝামেলা করো না। আল্লাহর উপরে ছেড়ে দাও। সৃষ্টিকর্তার রহমত থাকলে আমি তোমাকে রক্ষা করতে যা যা দরকার হয় করবো। জানি আমি ভালো না। বিশ্বাসঘাতকতা করেছি। না ঠকলে সত্যিই বোঝা যায় না কতটা কষ্ট হয়। এখন ঘুমিয়ে যাও।
জুবায়ের বালিশে উপুর হয়ে শুয়ে পড়লো। কম্বলটা টেনে মাথা অবধি ঢেকে নিয়ে। অধরা ওর পাশে বসে আছে। যতটুকু জ্ঞান আছে বুঝে নিলো জুবায়ের সবটা জেনে গেছে কিন্তু বলছে না। হয়তো নিজের পরিবারের উপরে আঙুল উঠেছে তাই মানতে পারছে না। অধরা জানে আরমান ফারুকী সহজে ওদেরকে এভাবে ছাড়বে না। খুব তাড়াতাড়ি একটা উপাই বের করে অধরাকে নিয়ে যাবেন। সেদিন জুবায়ের ছিল বলে ও আসতে পেরেছিল নয়তো কখনও পারতো না। সব জায়গাই একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। লোকটা নিজের আপন ভাইকে মেরে সম্পত্তি দখল করেছিল। এবার কি নিজের ছেলেকে মারবেন? কি লাভ এতে?
চলবে
#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:১০
সকল প্রকার খারাপ পরিস্থিতি বা অশুভ কোনো সময়ের মধ্যেও ভালো কিছু সময় থাকে যেটা স্মৃতির পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকে। তাছাড়া আধার পেরিয়ে আসে রাঙা প্রভাত। কালো রঙ মিলিয়ে গিয়ে সোনালী সূর্য নিয়ে আসে আলো ঝলমলে সকাল। প্রভাতফেরির গানে মুখোমুখি হয়ে যায় পৃথিবী। অধরা ঘুম থেকে উঠে হতভম্ব হয়ে গেছে। গতকাল অনেক রাতে ঘুমানোর ফলে উঠতে লেট হয়েছে। বাইরে থেকে আওয়াজ আসছে। অধরা দ্রুত জানালা দিয়ে নিজেদের বাড়ির দিকে উঁকি দিতেই চোখ ছানাবড়া। জুবায়ের লোকজন লাগিয়ে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করছে। বাড়ির সামনে কয়েকজন গান হাতে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটার মতলোব কি কে জানে। জুবায়ের সত্যি সত্যি এসব করবে ওর ধারণা ছিল না। ভেবেছিল ঘুমের মধ্যে সব ভূলে যাবে। ও আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত বেরিয়ে পড়লো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দেখা হলো আয়াতের সঙ্গে। ছেলেটা মুখ ভাব করে আছে ওকে দেখে ঠোঁট উল্টে বলল,
> আপু তোমার বরের মাথা পুরোপুরি গেছে। কতবার বললাম আমাদের সঙ্গে থাকার কথা কিন্তু শুনলো না। সেই তোমাদের বাড়িটা পরিস্কার করতে উঠেপড়ে লেগে গেলো। হয়েছে টা কি বলবে? হঠাৎ পরিবর্তনটা কেমন জানি মানতে কষ্ট হচ্ছে।
অধরা মলিন হেসে আয়াতের কাধে হাত রেখে বলল,
> চিন্তা করিস না আমি সামলে নিবো। মারিয়া কোথায়?
আয়াত মাথা চুলকে বলল,
> তোমার ননদ আমাকে দেখলে পালিয়ে যায়। তোমাদের বাড়িতে আছেন।
> ওর থেকে দূরে থাক ভাই। আমি চাইনা কোনো ঝামেলা হোক। ওরা আমাদের মতো নরমাল না। জানিনা কি রহস্যের ওদের আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে আছে। দূরে থাক তোর ভালো হবে। আমার মতো তোকে কষ্ট পেতে দিতে চাইছি না।
> কিন্তু…
> কোনো কিন্তু না। আমি যাচ্ছি।
অধরা কথাটা বলে অপেক্ষা করলো না। দ্রুত নিজেদের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল। বাড়িতে পৌঁছাতে ওর কয়েক মিনিট সময় লাগলো। সোফা থেকে শুরু করে জানালার পর্দা পযর্ন্ত পরিবর্তন করা হয়েছে। একদম ঝকঝকে করে ফেলেছে। অধরা ঘুরে ঘুরে সবটা দেখলো। মনে হচ্ছে সব কালো ছায়া জীবন থেকে দূর হয়ে গেছে। কাজের মেয়েটা টেবিলে খাবার পরিবেশন করছে। মারিয়া ওকে সাহায্য করছে। অধরাকে দেখে মারিয়া চমৎকার করে হাসলো। ইশারা করলো সবটা কেমন লাগছে। অধরা বিনিময়ে মিষ্টি করে হেঁসে বলল,
> দারুন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই জুবায়ের এসে হাজির। সঙ্গে একগাদা শপিং ব্যাগ। পেছনে পেছনে দুজন লোক এসে আরও কিছু প্যাকেট দিয়ে বেরিয়ে গেলো। জুবায়ের সেসব নিয়ে কক্ষে রেখে এসে ধপ করে চেয়ার টেনে বসে পড়লো। সামনে রাখা আপেলের টুকরোতে কামড় বসিয়ে বললো,
> মোটামুটি সব ঠিকঠাক। দরকারি জিনিসপত্র কেনাকাটা হয়ে গেছে। আরও লাগলে বলবে।
অধরা ভ্রু কুচকে বলল,
> আপনি তাহলে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছেন এখানে থাকবেন? ফিরে না গেলে আপনার ড্যাড মানবেন তো? দেখুন ঝামেলা করে কি লাভ তারচেয়ে চলুন ফিরে যায়।
জুবায়ের বিরক্ত হলো অধরার কথা শুনে। মেয়টা এতোদিন এখানে আসার জন্য ঝামেলা করছিল এখন এখানে থাকতে চাইছে না। এর মতলব কি কে জানে। কৌতূহল দমিয়ে রেখে উত্তর দিলো,
> ওখানে থাকলে তোমার মাথায় আজেবাজে চিন্তা ঘুরঘুর করে। বাচ্চার জন্য এসব ভালো না। অতিরিক্ত টেনশনে যদি আমার বাচ্চার কোনো ক্ষতি হয় তখন? যে আসছে সে একটা মানুষের বাচ্চা কোনো ভূতের বাচ্চা না যে সমস্যা হবে না।। ও বাড়ির নাম নিবে না। চুপচাপ খাও আর সকলের সঙ্গে আড্ডা দাও। বাকীটা আমি দেখবো।
জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। অধরা আর ঝামেলা করলো না। এই লোকটার যে তার ছেড়া মাথায় ছিট আছে এটা ওর অজানা নেই। জীবনে তাঁর ভুলের শেষ নেই। মাথা গরম করে আজ পযর্ন্ত যা যা সিদ্ধান্তটা নিয়েছে আজ অবধি সেটা সাকসেস হয়নি। ক্ষেপাটে টাইপের মানুষ। অধরা চুপচাপ খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে গিয়ে বসলো। বাবা মায়ের রুমটা তালা লাগানো আছে। অধরা কিছু একটা ভেবে চাবিটা তুলে নিয়ে বাবা মায়ের রুমের তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। আগের মতোই সাজানো গোছানো আছে। তবে প্রচুর ধুলাবালি। অধরা আলমারির ভেতর থেকে বাবা মায়ের ছবিটা বের করে দেখে নিলো। চিৎকার করে কাঁদতে মন চাইছে। অধরার চোখে পানিতে ছলছল করছে। কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়েও পড়লো। খুনীকে ধরতে পারলে ও তাঁর থেকে জিঞ্জাসা করবে ওকে এতিম করে লোকটার কি এমন লাভ হয়েছে। অধরা ছবিটা রেখে বেশ কিছু জিনিসপত্র ঘাটাঘাটি করলো। ওর বাবা মায়ের ফোন দুটো বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। এক বছর অন করা হয়নি। চার্জও নেই নাকি নষ্ট হয়ে বন্ধ অধরা বুঝতে পারলো না। দ্রুত সেগুলো চার্জ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ওর বাবার ফোনের গ্লাস ঠিক নেই। অধরা মায়ের একটা শাড়ি নিয়ে বেরিয়ে আসলো। পরে আবারও আসবে ভাবলো। রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে মায়ের লাল রঙের শাড়িটা সুন্দর করে পরে নিলো। ভাবলো আজ সারাদিন বাবা মায়ের ছবিটা সামনে নিয়ে বন্ধ রুমে বসে থাকবে। মায়ের শাড়ি থেকে মা মা গন্ধ আসছে। অধরা ভাবনা অনুযায়ী মায়ের শাড়ি পরে ছবির ফ্রেম বুকে নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। অনেকক্ষণ কান্নাকাটির পরে বাবা আয়ের ছবিটা বুকে নিয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।
☆☆☆☆☆☆
ঘন জঙ্গলের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল এক পাহাড়ের টিলা। চারদিকে সবুজের সমারোহ। অধরা নিচে দাঁড়িয়ে ওই টিলার দিকে তাঁকিয়ে আছে। গায়ে শক্তি পাচ্ছে না। টিলা থেকে বাচ্চার আওয়াজ ভেসে আসছে। অধরার মন আনচান করছে বাচ্চাটাকে দেখার জন্য। কিন্তু উপরে কিভাবে উঠবে বুঝতে পারছে। বহুকষ্টে থেমে থেমে ও উপরে উঠে গেলো। হাঁপাতে হাঁপাতে আশপাশে তাকিয়ে দেখলো। দূরে একটা বাচ্চা খেলছে। ওর হাসির শব্দে সারা বনজুড়ে ঝঙ্কার তুলেছে। অধরা আর অপেক্ষা না করে ছুটে গিয়ে বাচটাকে ধরতে গেলো কিন্তু পারলো না। তাঁর আগেই একটা মুখোশধারি লোক ওর সামনে গিয়ে দাড়িয়ে পড়লো। মূহুর্ত্তের মধ্যে পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়ে গেলো। কোথা থেকে জুবায়ের এসে হাজির হলো। ও বাচ্চাটাকে নিজের কোলে তুলে নিয়ে বাঁকা হাসলো। অধরা খেয়াল করলো ওর হাতে ধারালো খঞ্জর। অধরা মনে হলো ওর মতিগতি বুঝতে পেরেছে তাই চিৎকার করে বলল,
> ওকে মারবেন না প্লিজ। জুবায়ের ওকে ছেড়ে দিয়ে আমাকে যা ইচ্ছা করুন প্লিজ।
জুবায়ের শুনলো না। বাচ্চাটার গলাতে টান দিতে গেলো তখনই জুবায়েরের রূপি আরেকজনের আগমন ঘটলো। ও দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে কেড়ে নিতে চাইলো। অধরা ততক্ষণে ছুটে গেলো কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। পেছনে থেকে অধরাকে চুরি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। যেটা ওর কোমরে গিয়ে বিধেছে। অধরা চিনতে পারছে না কোনটা জুবায়ের আর কোনটা ওর ভাই। হঠাৎ ওদের চোখের দিকে তাঁকিয়ে বুঝলো। এতক্ষণ জুবায়ের ভেবে ভূল করছিল ওটা জুবায়ের না। ওর ভাই। লোকটা জুবায়েরের বুকে ছুরি বসিয়ে দিয়ে লাথি দিয়ে ছুটিতে দিলো। জুবায়ের ছিটকে পড়েছে তবে হাতে এনেছে বাচ্চাটাকে। একদম পাহাড়ের ধারে গিয়ে ও দাঁড়িয়ে আছে। অধরা ঝাপসা চোখে চিৎকার করে বলল,
> আপনি পড়ে যাবেন পিছিয়ে যাবেন না। পড়লে ওকে বাঁচানো যাবে না।
জুবায়ের সেসব পাত্তা দিলো না শুধু মলিন হাসলো। আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে উচ্চারণ করলো
> আমি না থাকলেও ও থাকবে। ও আমার অংশ, আমার আত্না। আমার স্ত্রীর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার ক্ষমা পাওয়ার অবলম্বন। ও বাঁচবে তুমি চিন্তা করোনা।
জুবায়ের ধুপ করে বাচ্চাটাকে নিয়ে পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়লো। অধরা চিৎকার দিয়ে উঠে বসলো। সেদিনের সেই স্বপ্নটা ঘুরেফিরে এক দৃশ্য। একটু পরিবর্তন তবে শেষ পরিণতি তো এক। কি ইঙ্গিত দিচ্ছে এই স্বপ্নটাতে? অধরা প্রচণ্ড ভয় পাচ্ছে। সামনে খারাপ দিন আসতে চলেছে বুঝতে পারছে। ভাবলো এটাইকি আমার নিয়তি? এই মূহুর্তে ওর জুবায়েরের কথা খুব মনে পড়ছে । দ্রুত উঠে বসলো। হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে। ঘনঘন নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার যথাযথ চেষ্টা করলো কিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারলো না। ঘর থেকে এক প্রকার ছুটে বেরিয়ে গেলো। কাজের মেয়েটা খাবার রেডি করছে। মারিয়া বই পড়ছে। অধরা সোজাসুজি মারিয়াকে জিঞ্জাসা করলো,
> তোমার ভাইয়া কোথায়?
মারিয়া বাইরে ঈঙ্গিত করতেই অধরা ছুটলো বাইরে। জুবায়ের বাইরে টেবিল চেয়ার দিয়ে সাজিয়েছে। শীতের সকল বা বিকেলে বসে আড্ডা দেওয়ার জন্য। ও সেসব সাজিয়ে গার্ডের সঙ্গে আলাপ করছিল। অধরা ছুটে গিয়ে জুবায়েরকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। মনে হলো এটাই হয়তো শেষবার জুবায়েরকে জড়িয়ে ধরা। এর পরে আর সুযোগ আসবে না। অন্যদিকে জুবায়ের হতভম্ব মেয়েটার এমন আচরণ দেখে। এক বছর বিবাহিত সংসার জীবনে আগে কখনও জড়িয়ে ধরা বা বউকে বুকে নিয়ে ঘুমানো এসব হয়নি। জুবায়ের ইচ্ছে করে ওকে ইগনোর করতো। কিন্তু আজ কিভাবে কি করবে বুঝতে পারছে না। পাশের লোকদেরকে ইশারা করলো সরে যেতে। ওরা আদেশ মাত্র চলে গেলো। অধরা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। জুবায়ের কাঁপা কাঁপা হাতে মেয়েটার মাথায় হাত রেখে ওষ্ঠে হাসি এনে বলল,
> আরে কাঁদছো কেনো? শরীর খারাপ লাগছে বলো? ডাক্তার ডাকবো?
অধরা কথা বললো না। নির্বিকারভাবে কাঁদছে। জুবায়ের ওকে জোর করে সামনে টেনে আনলো। মুখটা নিজের দু’হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
> কি হয়েছে না বললে বঝবো কিভাবে? বাঘীনির চোখে পানি আমার মানতে কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ সবটা বলো।
অধরা ফুপিয়ে উঠে বলল,
> আমাদের ফিউচার আমি দেখে নিয়েছি বোধহয়। সময় খুব কম। ক্ষমা করবেন আমার ব্যবহারে কষ্ট পেলে। খুব সরি।
অধরা দ্রুত জুবায়েরকে ছেড়ে দিয়ে যেভাবে দৌড়ে এসেছিল সেভাবেই দৌড়ে চলে গেলো। জুবায়ের কিছু সময় তাঁকিয়ে ওর পিছু ছুটলো। অধরা সোজা গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। জুবায়ের বহুবার দরজা ধাক্কা দিয়েও কাজ হলো না। মেয়েটা দরজা খুললো না। জুবায়ের বাধ্য হয়ে নিচে গিয়ে সোফায় বসলো। সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করলো। অধরা সন্ধ্যায় খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দরজা খুলে নেমে আসলো। মনে হলো কিছুই হয়নি। জুবায়ের জিঞ্জাসা করলো কিন্তু ও বলল না। হাসিখুশি মুখে পাশের বাড়িতে আন্টির কাছে চলে গেলো। জুবায়ের কিছু বুঝতে পারলো না তবে উতলা হলো। মেয়েটার জন্য হঠাৎ করেই আজ কেমন টেনশন হচ্ছে। ভালোলাগা কাজ করছে।
☆☆☆☆☆
অধরা আজ নিজের বাড়িতে ফিরে যায়নি। আয়াতদের বাড়িতে আছে। আন্টির সঙ্গে ঘুমাবে বলে রাতে থেকে গেছে। জুবায়ের কয়েকবার এসেছে শেষমেষ নিজেও থেকে গেছে। ও উশখুশ করছে কি হয়েছিল শোনার জন্য। কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। জুবায়ের হতাশ হলো। মেয়েটার মাথায় কি ঘুরছে কে জানে। অধরা চুপচাপ খেয়ে রুমে গিয়ে শরীর এলিয়ে দিলো। আন্টির সঙ্গে খোশমেজাজে গল্প করে শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়লো। ভোররাতের আগে হঠাৎ খুটখাট আওয়াজে ওর ঘুম ভাঙলো। দ্রুত উঠে বসলো। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসলো। সেদিনের ঝামেলার পর থেকে রুমের বাইরে আলো জ্বালানো থাকে। অধরা দরজা দিতে বেরিয়ে আসলো। চুপচাপ মেইন দরজা খুলতেই দেখলো খোলা গেটের সামনে জুবায়ের দাঁড়িয়ে আছে। নীল রঙের হুড়ি চাপিয়ে গেটে হেলান দিয়ে হাতদুটো ভাজ করে আছে। অধরা একপা দুপা করে লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী হয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> শীতের মধ্যে এখানে কি করছেন?
অধরা দ্বিতীয়বার জিঞ্জাসা করতে গিয়ে থমকে গেলো।ওর চোখের দিকে তাঁকিয়ে পিছিয়ে আসলো। এটা কিছুতেই জুবায়ের না। স্বপ্নের কথা ভেবে ও ঢোক গিলল। লোকটা ক্রমশ ওর দিকে এগিয়ে আসছে।
চলবে