#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:৫+৬
অধরা দু’পা পিছিয়ে গেলো। কক্ষের ভেতরটা কেমন গুমট আর ধুলাবালিতে পূর্ণ। দুদিন আগেও বেশ পরিস্কার ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কত বছর এখানে কেউ আসেনি। বাড়িতে এতগুলো কাজের লোক অথচ শাশুড়ির এই রুমটা নোংরা হয়ে আছে। তাছাড়া এখানে মানুষের খু*লি কিভাবে আসলো? অধরা ভয়ে ভয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। রুমের মধ্যে বৃত্ত এঁকে খুলিটা তার মধ্যে রাখা হয়েছে। ফোঁটা ফোঁটা র*ক্ত খুলির উপরে ছড়ানো। অধরা ভয় পাচ্ছে প্রচণ্ড। জীবনে প্রথমবার এমন দৃশ্য চোখে পড়েছে। এই বাড়িতে কোনো যাদু বিদ্যা বা কালো যাদু চর্চা হয় কি মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অধরা দ্রুত সবটা পর্যবেক্ষণ করলো। ওয়াশরুমের ট্যাপ থেকে পানি পড়ছে। অধরা দ্রুত পানি বন্ধ করতে ওয়াশরুমে গিয়ে দেখলো ট্যাপ বন্ধ আছে। ও বেরিয়ে আসলো। চুপচাপ আলমারির ড্রয়ার চেক করে নিলো। সেখানে সন্দেহ হয় এমন কিছু খুঁজে পাওয়া গেলো না। সবগুলো কাপড় আর জুয়েলারি দিয়ে ভর্তি। অবশিষ্ট আছে বিছানার চাদর। অধরা বিছানা উল্টাপাল্টা করে দেখার সময় হঠাৎ ওর মনে হলো ওর পেছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। অধরার ঘাড়ে তাঁর উষ্ণ নিশ্বাস পড়ছে। অধরা জমে গেলো। পুরো শরীর ফ্রিজ হয়ে গেছে। মৃদু মৃদু পা কাঁপছে । পিছনে ঘুরে তাঁকানোর শক্তি নেই। আড়চোখে দেখার চেষ্টা করলো তাঁতে আবছা কারো আবয়ব দেখে যাচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে ওটা কোনো মেয়ে আবার মনে হচ্ছে ছেলে। অধরা এবার দ্রুত পেছনে ফিরলো কিন্তু কক্ষ শূন্য কেউ নেই। অধরা আর অপেক্ষা করলো না দৌড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলো। কি ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। ঢকঢক করে পানি গলাই ঢেলে নিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। গতকাল ঝামেলার পর থেকে জুবায়ের এই রুমে আর আসেনি। বিষয়টা খারাপ না মোটামুটি ভালো বলা চলে। সকাল দশটা বাঁজতে চলেছে অথচ এই রুমে এখনো খাবার আসেনি এমনটা আজকে নতুন। কেনো আসেনি ওর জানা নেই নাকি এরা ওকে খাবার না দিয়ে মারার চিন্তা করছে আল্লাহ্ ভালো জানে। কথাগুলো ভেবে ও আবারও বাইরে পা বাড়ালো। দোতলা থেকে নিচে তাঁকিয়ে চমকে উঠলো। আবারও সকলে সাদা পোশাক পরেছে নিশ্চয়ই কেউ মারা গেছে। কিন্তু কে?ভয়ে গলা শুকিয়ে আসলো। ডাইনিং রুমের সোফায় শাশুড়ি শশুর আর ননদেরা চুপচাপ বসে আছে। কাজের মেয়েগুলো টেবিলে খাবার সাজাতে বাস্ত। একজন ভৃত্য খাবার নিয়ে উপরে উঠে আসছে। অধরা মেয়েটার আসার অপেক্ষা করলো। মেয়েটা ওর কাছাকাছি আসতেই প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
> আজ এতো লেট কেনো করলে? খাবার দিতে মানা করেছে?
মেয়েটার মুখে কোনো হাসি নেই। মুখটা স্বাভাবিক রেখে যেতে যেতে উত্তর দিলো,
> জুহি ম্যাম মামা গেছেন। বাড়িতে শোক চলছে। স্যার অসুস্থ।
কথাটা শুনে অধরার চোখ কপাল থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। জুহির মৃত্যু কিভাবে সম্ভব? আহারে জুবায়ের!ওর জন্য অধরার এবার কষ্ট হলো। ভাবলো যার জন্য এতকিছু করলো সেই থাকলো না। দুদিনের দুনিয়া তবুও মানুষ এমন কেনো করে বুঝি না। ভাগ্য বিধাতা কাউকে ছাড় দেননা এটা না বুঝেই মানুষ জঘন্য পাপ কাজে লিপ্ত হয়। কথাগুলো এলোমেলো ভেবে অধরার মনে প্রশ্ন জাগলো সুস্থ সবল মানুষ হঠাৎ মারা গেলো কীভাবে? কথাটা ভেবে ও প্রশ্ন করলো,
> হঠাৎ কি হয়েছিল জানো?
> মেবি খুন ম্যাম। গতকাল উনার বয়ফ্রেন্ডের বাসা থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সঙ্গে উনার বয়ফ্রেন্ড ছিল। সুইমিংপুলে গলা টিপে মারা হয়েছে। লাশ পানিতে ভাসছিল।
অধরা চোখ বড়বড় করে বলল,
> জুবায়ের ছাড়াও মেয়েটার বয়ফ্রেন্ড ছিল? একজন মেয়ের একাধিক বয়ফেন্ড, জঘন্য বিষয়। আমার কি মনে হয় জানো? জেলাসি করে জুবায়ের ওদেরকে খু*ন করেছে। নয়তো হঠাৎ করে কে ওদেরকে খু*ন করবে বলো?
> সরি ম্যাম জুবায়ের স্যার রাতে বাড়িতে ছিলেন। আপনার পাশের রুমে। সকালে খবর শুনে উনারা গেছেন দেখতে। লা*শ দেখে স্যার অসুস্থ।
অধরা কিছু একটা ভেবে বলল,
> আচ্ছা তুমি কি এই বাড়িতে অদ্ভুত কিছু লক্ষ্য করেছো? যেমন ধরো ভূতুড়ে কিছু যেগুলো আমরা মুভিতে দেখি। আত্মা বা জ্বীন এসব?
মেয়েটা টেবিলে খাবার রাখছিল হঠাৎ ওর এধরনের প্রশ্ন শুনে চমকে গিয়ে বলল,
> না না ম্যাম এসব দেখিনি। আপনার মনের ভূল। আপনি খেয়ে নিন আমার যেতে হবে।
অধরা চামচ উঠিয়ে নিয়ে খাবার মুখে দিয়ে বলল,
> আমার জন্য এসব অখাদ্য কে আনতে বলেছে রুশি? তোমার স্যারকে বলবে আমি এসব খাবো না। ডিম না এনে তুমি নুডুলস আনবে। ফলের জুস আমি পছন্দ করছি না।
অধরার কন্ঠ দিয়ে একরাশ বিরক্তি ঝরে পড়লো। ভ্রু কুচকে খাওয়া শেষ করলো। মনের মধ্যে ভয় থাকলেও কেনো জানি জুবায়েরের কথা ভেবে শান্তি লাগছে। লোকটার উচিৎ শিক্ষা হয়েছে। তবে মেয়েটার মৃত্যু নিয়ে বেশ চিন্তা হচ্ছে। একজনের পাপের শাস্তি আরেকজন কেনো পাবে এটা ঠিক হলো না।
☆☆☆☆☆☆☆☆☆
গত এক ঘন্টা জুবায়েরের নিথর শরীর বিছানায় লেপ্টে আছে,অজ্ঞান অবস্থায়। একদিকে বিশ্বাস ভেঙেছে অন্যদিকে প্রিয় মানুষের অকাল মৃত্যু। জুহি ওকে মিথ্যা বলেছিল। পূর্বের বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ওর যোগাযোগ নেই বলেছিল কিন্তু এরকম না। বরং ওর থেকেও সেই ছেলেটার সঙ্গে জুহির বেশি ঘনিষ্ঠতা বেশি রয়েছে। ছেলেটার সঙ্গে জুহি প্রায় ওদের বাসাই যাওয়া আসা করতো। যেটা জানার পরে জুবায়ের হৃদয় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে। সেই সঙ্গে হতাশা। মেয়েটা ওকে কিভাবে ঠকাতে পারলো মাথায় আসছে না। এতো এতো ভালোবাসার পরেও মানুষ আবারও কিসের নেশায় আরেকজনের কাছে ছুটে যায় কে জানে। এসব বেঁচে থাকতে জানলে মেয়েটার কপালে দুঃখ ছিল। ঠকানো কাকে বলে থাপ্পড় দিয়ে শিখিয়ে দিতো। বারবার অধরার কথা মনে পড়েছে। জুবায়ের সেই দুঃখে জ্ঞান হারিয়েছে। দুঃখের থেকে রাগ আর অপমানবোধ ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। অধরার সামনে দাঁড়ানোর মুখ নেই। মেয়েটাকে ঠকানোর জন্য হয়তো আল্লাহ্ ওকে এরকম শাস্তি দিয়েছে। ডাক্তার এসে দেখে গেছে কিছুক্ষণের মধ্যে ওর জ্ঞান ফিরবে। তবে আপাতত ঘুমানোর দরকার ভেবে ওষুধ দিয়ে গেছেন। মারিয়া ভাইয়ের পাশে মলিন মুখে বসে আছে। ভাইকে ও খুব ভালোবাসে। বোনদের মধ্যে মারিয়ার চেহারাটা বেশি মায়াবী। ছোট হওয়ার দরুন বাবা মা ভাই সবাই ওকে ভালোবাসে। কথা বলতে না পারলেও ওর একটা সিক্রেট বিষয় আছে যেটা শুধু জুবায়ের জানে আর কেউ জানেনা। না জানার কারণ আছে। এই বাড়ির পাঁচ মেয়ের মধ্যে ও জন্ম নিয়েছিল সিঙ্গেল। জুবায়ের ছোট থেকে বোনকে আগলে আগলে বড় করেছে। বিষয়টা যতদিন ওর নজরে আসে ও দ্রুত বোনকে শিখিয়ে নিয়েছে এসব কাউকে না বলতে। বোনটাও ভাইয়ের প্রচণ্ড ভক্ত। ভাই যা বলে অক্ষরে অক্ষরে পালন করা চাই। গতকাল রাতে ভাইয়ের হুকুমে অধরার খাবার আর ওষুধ দিয়ে এসেছে। এই বাড়িতে ও ছাড়া সবাই জমজ। পরিচিতরা এটা নিয়ে বেশ মজা করে তবে এই বাড়ির লোকজন সেটা গায়ে মাখেনা। জুবায়েরের বড় বোন পসরা ফারুকীর বয়ফ্রেন্ড ছিল বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকিও হয়েছিল কিন্তু কপাল গুণে বিয়ের দুদিন আগে সে মারা গেছে।তারপর সব থমকে গেছে। বাকীদের বিয়ের বয়স হয়েছে কিন্তু কি এক অজানা কারণে তাদের বিয়ের বিষয় নিয়ে এই বাড়িতে কেউ আলোচনা করে না। বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া হয়। মানুষ দূর থেকে এই রূপ শুধু অবলোকন করতে পারে ছুঁয়ে দেখার সাধ্য কারো নেই। জুবায়ের পড়াশোনা শেষ করে বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করছে। চেহারা মায়ের মতো বিলেতি। তবে বেশ মেজাজি। কথায় কথায় হুমকি দিতে উস্তাদ। রেগে গিয়ে ভুল করতে দুবার ভাবেনা। আরমান ফারুকী ছেলের থেকে বেশি কিছু পাওয়ার আশা করেন না। উনি এই ছেলেকে দিয়ে জীবনের একটা মাত্র গুরুত্বপূর্ণ কাজ করিয়ে নিবেন। এর চাইতে বেশি দরকার হবে না।
__________________
সারাদিন ঘরে বসে বসে দিন পার হলো অধরার। মন মেজাজ প্রচণ্ড খারাপ। পাশের রুমে জুবায়ের ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ করে সে গার্লফ্রেন্ডর শোকে অসুস্থ। অধরার কাছে এসব নেকামি বলে মনে হচ্ছে। মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি। মায়ের মতো চাচি মারা গেছে হেলদোল নেই। এদিকে কোথাকার কোন মেয়ে মারা গেছে সেই শোকে বেডা ভিমড়ি খেয়েছে। বিরক্তিতে অধরার চোখমুখ কুচকে আছে। কাজের মেয়েটা বারবার খাবার দিয়ে যাচ্ছে। দেখাশোনা করছে। ঘরের বাইরে যাওয়া নিষেধ করেছে। অধরা পাত্তা দিলো না। শাশুড়ি মায়ের লাল রঙের পুটলিটা দেখার ইচ্ছে জাগলো। ভাবলো জুবায়ের পাট হয়ে পড়ে আছে তারমানে ক্যামেরা চললেও চেক করতে দুদিন সময় লাগবে। যা হবে পরে দেখা যাবে ভেবে কৌশলে আবারও কাপড় চেঞ্জ করার বাহানা দেখিয়ে পুটলিটা নিয়ে বসে পড়লো। লকেট সেই সঙ্গে বাংলাদেশ যাওয়ার পাসপোর্ট ভিসা বেশ কিছু টাকা। টাকার নিচে একটা চিত্র।। অধরা চিত্রটাতে পাশাপাপাশি জুবায়েরের দুটো ছবি দেখতে পেলো। একটাতে ওর চোখ খুব স্বাভাবিক লাগছে অন্যটাতে রক্তিম। অধরা বুঝলো না কিছু। যেমন ছিল ঠিক তেমনিভাবে রেখে দিলো। রুমের চাবি আছে ওর কাছে। বাড়ির বাকী রুমগুলোতে তল্লাশি করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি এই বন্দি দশা থেকে মুক্তি নিতে হবে। দেরী হলে ঝামেলা আছে। হাটতে চলত কষ্ট হবে। অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়াতে হবে। মাথার উপরে ছায়া নেই। যে ওকে আগলে রাখবে। কথাগুলো ভেবে ও দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। সময় রাত দশটা বেজে আঠারো মিনিট। কিছুক্ষণের মধ্যে খাবার দিতে আসবে কাজের মেয়েটা। অধরা অধীর হয়ে অপেক্ষা করলো কিন্তু কাজের মেয়ের পরিবর্তনে মারিয়া আসলো। মেয়েটার মুখে সব সময় মিষ্টি হাসি লেগেই থাকে। অধরা আফসোস করে খাবার শেষ করলো। চুপচাপ মেয়েটা সব গুছিয়ে নিয়ে চলে যেতেই অধরা দরজা সামান্য খুলে তাঁকিয়ে থাকলো। ওকে সবার শেষে খাবার দেওয়া হয়েছে। অধরাকে নিয়মকানুন মেনে খাওয়ানো হচ্ছে। টাইম দু টাইম। বাইরে চুপচাপ দেখে ও চুপিচুপি বেরিয়ে আসলো। আজ মিশন চলবে নিচের রুমগুলোতে। কথাটা ভেবে ও লম্বা লম্বা পা ফেলে নেমে আসলো। ডাইনিং রুমে কত দিন আসা হয়না ভেবে আশেপাশে ভালো করে লক্ষ্য করল। সিঁড়ির পাশের রুম থেকে আওয়াজ আসছে। মৃদু মৃদু হাসি আর কথাবার্তা হচ্ছে। অধরা চুপিচুপি রুমের জানালা থেকে উঁকি দিয়ে চমকে উঠলো। জুবায়ের বোনদের নিয়ে মনের সুখে গল্প জুড়েছে সেই সঙ্গে মদ গিলছে। পাশাপাশি চার বোন আর ওর বাবা মা আছে।সবগুলো শয়তান এখানে জড় হয়েছে। অধরার কপালে ভাজ পড়লো। জুবায়ের সারাদিন প্রেমিকার বিরহে অজ্ঞান ছিল সবটা ওর ভন্ডামি ছিল। প্রচণ্ড রাগে ওর শরীর জ্বলে উঠলো। হঠাৎ জুবায়ের আশেপাশে তাঁকিয়ে কি একটা ইশারা করলো। আরমার ফারুকী কি বুঝলো জানা সেই উনি বলে উঠলেন,
> আরে কেউ নেই। এখানে নজর কে দিবে অদ্ভুত? টেনশন করোনা।
অধরার বুক কেঁপে উঠলো। ধরা খেয়ে গেলে ঝামেলা হবে। জুবায়ের উঠতে উঠতে ও দৌড়ে উপরে চলল। নিজের রুমে ঢুকতে যাওয়ার আগে পাশের রুম টপকাতে গিয়ে খোঁলা দরজা দিয়ে ঘুমন্ত জুবায়ের মুখ ওর চোখে পড়লো। ছেলেটা ঘুমিয়ে আছে। অধরা থমকে গেলো। পা চলছে না। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকলো। লোকটার দীর্ঘ নিশ্বাস জানান দিচ্ছে ঘুমটা কতটা গভীর। কিন্তু কিছুক্ষণ আগে ও নিচে জুবায়েরকে দেখে এসেছে । ওর আগে ছেলেটা কিভাবে উপরে আসতে পারে, সম্ভব না। প্রশ্ন জাগলো ছেলেটার কি কোনো অলৌকিক শক্তি আছে নাকি দৃষ্টির অগোচরে এই বাড়িতে দুজন জুবায়েরের বসবাস?
(চলবে)
#কহিনুর
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:৬
ঘন নিঃশ্বাসের সঙ্গে ঠকঠক করে কাঁপছে অধরা। একজোড়া সীতল দৃষ্টি ওর দিকে তাঁকিয়ে আছে। ওই দৃষ্টিতে বুঝি ওর মৃ*ত্যু লেখা আছে। কালো থাইকাচ ভেদ করে সূর্যের রশ্মি ভেতরে প্রবেশ করেছনা ঠিক তবে আলো ছড়াতে জুড়ি মেলা ভার। অধরার সামনে জুবায়ের ফারুকী দাঁড়িয়ে আছে। পূর্বের ন্যায় চোখমুখ শক্ত করে নেই তবে চোখে আছে হাজারো অভিযোগ অভিশাপ নাকি ঘৃণা বোঝা মুশকিল। অধরা গতকাল রাতের দৃশ্যটা দেখার পরে চুপচাপ রুমে চলে এসেছে। সারারাত ভেবেছে কিন্তু উত্তর পাইনি। জুবায়েরের যে জমজ ভাই আছে এটা ওকে কখনও বলা হয়নি। এই বাড়িতে সবাইকে দেখেছে কিন্তু ওই লোকটাকে অধরা কখনও দেখেনি। এক বাড়িতে থেকে একটা লোক কিভাবে নিজেকে আড়ালে রাখতে পারে চমকে যাওয়ার মতোই কথা। সারারাত আজেবাজে চিন্তা করে ভোররাতে ঘুমিয়েছিল হঠাৎ জুবায়েরের এসে ওকে জোরজবরদস্তি করে উঠিয়ে দিয়েছে। অধরা ভয় পাচ্ছে এটা ভেবে যে সামনে দাঁড়িয়ে এটা জুবায়ের নাকি ওর মতো দেখতে সেই ছেলেটা। অন্যদিকে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার মতোভাব বোঝার মতো সামর্থ্য ওর নেই। হঠাৎ আক্রমণে অধরার ধ্যান ভাঙলো। জুবায়ের ওর দু’বাহু শক্ত করে ধরে নাড়িয়ে দিয়ে বলল,
> তুমি অভিশাপ দিয়েছিলে না? সব তোমার জন্য হয়েছে। কখনও ক্ষমা কবো না তোমাকে। তোমার জন্য আমার মা আর জুহিকে প্রাণ দিতে হলো।
জুবায়েরের কথা শুনে অধরা হতবাক। লোকটা ছ্যাকা খেয়ে রোগে শোকে দুঃখে পাগল হয়ে গেলো নাকি কে জানে। খু*ন করা বা মা*রার হলে ও প্রথমে জুবায়েরের কথা ভাবতো। লোকটার একটা কেনো একশোটা গার্লফ্রেন্ড থাকুক অধরা সেসব পরোয়া করে না। করবেই বা কেনো?অধরা মুখটা কঠিন করে নিজেকে এক ঝটকায় জুবায়েরের থেকে ছাড়িয়ে নিলো। ভ্রু কুচকে বলল,
> ঠকাতে পারেন আর ঠকতে পারবেন না এটাতো ঠিক না। থাপ্পড় দিবেন অথচ থাপ্পড়ের স্বাদ নিবেন না তাতো হতে দেওয়া যায় না। কেমন লাগছে সুলতান জুবায়ের ফারুকী?
অধরার কন্ঠ থেকে আক্রশ ঝরে পড়ছে। ইচ্ছে করছে লোকটার উপরে ঝাপিয়ে পড়ে গলা টিপে দিতে কিন্তু ও পারবে না। শক্তিশালী পুরুষটার গলাতে হাত রাখলে ওর এইটুকু হাতে অনায়াসে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। জুবায়ের যথাযথ শান্ত থাকার চেষ্টা করলো কিন্তু হলো না। অধরাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে ওর গালটা দুহাতে দুমড়ে নিয়ে বলল,
> আমি সুখ না পেলে কাউকে সুখী হতে দিবো না। এতে কেউ আমাকে স্বার্থপর ভাবলেও কিছু যাবে আসবে না। আমাকে দেখে তুমি কটাক্ষ করবে!মজা নিবে আমি সহ্য করবো না।
অধরার মুখে প্রচণ্ড ব্যাথা লাগলো। মনে হলো মুখের হাড় ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়বে। চোখ দিয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। বহু কষ্টে আওয়াজ দিলো,
> মৃত গার্লফ্রেন্ডর রাগটা বুঝি বউয়ের উপরে তুলছেন জুবায়ের ফারুকী? কাপুরুষ কাকে বলে জানেন নিশ্চয়ই? নাকি ব্যাখা করে জানিয়ে দিব।
জুবায়ের খপ করে ওকে ছেড়ে দিলো। মেয়েটা কি ইঙ্গিত করছে বুঝতে সময় লাগলোনা।অযথাই রাগ হচ্ছে শুধু। মনের মধ্যে ভয়ানক জিদ চেপেছে। ইচ্ছে করছে জুহির লা*শ তুলে ইচ্ছে মরো পিটাতে। বদজাত মেয়ে জীবনে ক্ষমা করবে না জুবায়ের ওকে। ওর জন্য এখন কথা শুনতে হচ্ছে। জুবায়ের লাথি দিয়ে সামনে থাকা ট্রি টেবিলটা সরিয়ে দিলো। হুঙ্কার দিয়ে বলল,
> গলা টিপে দিবো আর একটা শব্দ উচ্চারণ করলে। আমাকে রাগাবে না। জুহির জন্য তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম কিন্তু এখন তো সে নেই। আমার তোমার উপরে আর কোনো দায়বদ্ধতা রইল না। সো চুপচাপ থাকবে।
> জানি দায়বদ্ধতা নেই। কিন্তু আপনার রক্ত তার উপরেও কি আপনার দায়বদ্ধতা নেই? বাচ্চাটা কিন্তু আপনার সেটা তো স্বীকার করেন? আপনার সম্মুখীন যদি কেউ আপনার বাচ্চার ক্ষতি করে সেটা মানতে পারবেন তো? ধরুন কহিনুরকে কেউ হত্যা করলো ওর র*ক্ত
অধরা বাকী কথাটা শেষ করতে পারলো না জুবায়ের ওর গলা চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
> আমার মেয়েকে নিয়ে একদম বাজে কথা বলবে না। বারবার বাক্য দ্বারা আঘাত করে আমার স্পর্শ নিতে চাইছো তুমি? রাগলে আমার স্পর্শ কিন্তু তোমার জন্য একদম ভালো হবে না। ভেবোনা কহিনুরের জন্য তোমাকে ছেড়ে দিব। জানিনা ড্যাড ওকে কেনো চেয়েছে কিন্তু এই মূহুর্ত থেকে ওকে আমার নিজের জন্য চাই। আমার মেয়ে আমার কাছে থাকবে।
জুবায়ের ওকে ছেড়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। তারপর কি একটা ভেবে আবারও ফিরে এসে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল
>আমার কাউকে দরকার নেই। কহিনুরকে দরকার নেই আমার। ড্যাড যা বলেছে তাই হবে।
জুবায়ের পূর্বের ন্যায় গটগট করে বেরিয়ে গেলো। অধরা বালিশে মুখ ডুবিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদলো। ভেবেছিল জুবায়েরকে নিয়ে আর ভাববে না নিজের মতো সবটা উদ্ধার করবে কিন্তু লোকটা যে ওকে একটুও শান্তি দিচ্ছে না। ওর মধ্যে যে অশান্তি চলছে সেটা অধরার উপরে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। অধরা কান্নাকাটির পর্ব শেষ করে রাগে ফুলে উঠলো। ভয়ানক ভাষায় দু’টো গালি দিলো একদম আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে। ভাব দেখালো মিররে মলিন বদন খানি দেখার প্রচেষ্টা করছিল। জুবায়েরকে ও জীবনে ছাড়বে না। শাশুড়ি আম্মা ঠিক বলেছিল কাউকে বিশ্বাস না করতে।
☆☆☆☆☆☆☆☆☆
জুবায়ের অধরার উপরে রেগে গিয়ে কাঠকাঠ গলাই বাবার সামনে জানিয়ে দিলো ওই মেয়েটাকে ওর এখন আর দরকার নেই। আরমান ফারুকী ছেলের মুখটা দেখে ভয়ানক চটে আছেন দেখে বোঝা যাচ্ছে কিন্তু প্রকাশ করছেন না। এই ছেলেকে দিয়ে উনার কিছুই হবে না বুঝতে বাকি নেই। থাপ্পর দিতে পারলে শান্তি লাগতো কিন্তু পারবেন না। যেভাবেই হোক হাতে পায়ে ধরতে হবে। বড় কোনো স্বার্থের জন্য এরকম ছোট ছোট ত্যাগ স্বীকার করাই যায়। উনি মুখটা মলিন করার যথাযথ চেষ্টা চালিয়ে গেলেন এবং শেষমেশ সফল হলেন। ছলছল চোখে বললেন,
> বাবা জুবায়ের তোমার ড্যাড আজ পযর্ন্ত তোমার থেকে কিছু চেয়েছে বলো? যখন যা চেয়েছো আমি সবটা দিয়ে তোমার আবদার পূরণের চেষ্টা করেছি তাহলে আজ কেনো ড্যাডের কথা ভেবে দশটা মাস অপেক্ষা করছো না। আমি কি ভেবে নিবো আমি পৃথিবীর সব চাইতে হতভাগ্য পিতা?
জোবায়েরর রাগ পড়ে গেলো। সত্যিই তো বাবার জন্য ও এইটুকু পারবে না? নিশ্চয়ই পারবে। সন্তান পিতার ইচ্ছে পূরণ করবে এখানে দোষের কি। তাছাড়া সবটা যে সুখের হবে এমনটা না। পরিবারের কথা ভেবে এসব করাই যায়। তবে কৌতূহলী হয়ে জিঞ্জাসা করলো,
> কহিনুরকে নিয়ে তুমি কি করতে চাইছো বলবে? বেবি ছেলে না মেয়ে হবে আগেই তুমি জানলে কিভাবে? পৃথিবীতে এতো এতো নাম থাকতে ওর নাম কহিনুর কেনো রাখলে?
জুবায়ের একসঙ্গে বেশ কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিলো আরমান ফারুকীর দিকে। উনি অবস্থা বেগতিক দেখে খুকখুক করে কেশে বললেন,
> সবটা তোমার না জানলেও চলবে। সুলতান বংশের মূল্যবান রত্ন সে। তাকে কহিনুর ডাকতে অসুবিধা কিসের? আমার মন বলেছে তোমার মেয়ে হবে ।তুমি কি আমাকে সন্দেহ করছো?
জুবায়ের উত্তর দিলো না। চুপচাপ চলে আসলো নিজের রুমে। বড় মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে। জুবায়ের চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল। পরক্ষণেই ঠান্ডা হাতের স্পর্শে চোখ খুলল। পাশে মারিয়া বসে আছে। জুবায়ের ওষ্ঠে হাসি ফুটিয়ে বলল,
> ও ঘরে খোঁজ নিয়েছিস? আমাকে ও ইচ্ছা করে রাগিয়েছে।
মারিয়া হাতের ফোনের নোটবুকে লিখে ওর দিকে ধরলো। লেখা আছে,
> ভাবিকে কষ্ট দিচ্ছো কেনো? ছেড়ে দাও ড্যাডকে না বলে। আমার কষ্ট হচ্ছে ভাইয়া।
জুবায়ের চোখ বন্ধ করে বলল,
> ওকে যেতে দিলে অন্যকেউ বন্দী করবে। এখানে আছে ভালো আছে। আমি কি করবো কিছু বুঝতে পারছি না। যা হচ্ছে হতে দে। ড্যাড আমাদের ভালো চান।
মারিয়া কথা বাড়ালো না। চুপচাপ স্থান ত্যাগ করলো। একে বোঝানোর ক্ষমতা ওর নেই। এই বাড়ান যে ভয়াবহ কিছু ঘটতে চলেছে। বহু বছরের পুরাতন ইতিহাস পূনরায় ফিরে আসতে চলেছে। থমথমে পরিবেশ তার জানান দিচ্ছে।
☆☆☆☆☆
জুবায়েরর এসব পাগলাটে আচরণে অধরা বেশ কষ্ট পেয়েছে। বারবার শুধু বাবা মায়ের মুখটা মনে পড়ছিল তাই মায়ের দেওয়া কালো রঙের শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে অধরা। বাবা মায়ের অন্তিম যাত্রার সময় নিজের বাড়িতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ওর। মায়ের সুটকেসটা নিয়ে এসেছে। বাবা মায়ের স্মৃতি হিসেবে। কয়েকটা কাপড় আছে। যখনই মাকে মনে পড়ে তখনই একটা শাড়ি ঝটপট পরে নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। শাড়ি বের করার সময় হঠাৎ একটা পুরাতন ডাইরি পেয়েছে সেটাই নিয়ে পড়তে বসেছে অধরা। এটা মূলত ওর মায়ের না বাবার ডাইরি। গোটা গোটা অক্ষরে প্রথম পেজে লেখা আছে” কহিনুর ”
নিজের বাবার ডাইরিতে এই নামটা দেখে ও চমকে উঠেছে। আগ্রহ নিয়ে পরবর্তী পৃষ্ঠা উল্টাতেই পেলো,
” আমি প্রফেসর নওশাদ বারি, বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ার দরুণ প্রচন্ড ভালোবাসা পেয়ে ছোট থেকে বড় হয়েছি। সেই আমি কখনও কল্পণাও করিনি বাবা মায়ের থেকে দূরে চলে আসবো। কিন্তু ভাগ্য আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। বাবার অর্থসম্পদের অভাব ছিল না। যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। আমাদের কতগুলো জমি আর কি পরিমাণ অর্থ আছে সেটা আমি কখনও হিসাব করিনি। বাবা সেসব দেখাশোনা করতেন। আমি লেখাপড়া আর বন্ধুদের নিয়ে সময় কাটাতাম। আমার এই অর্থসম্পদের পাহাড় আমার বাবার নিজের হাতে তৈরী করেছিলেন। কিভাবে করেছেন তা আমার অজানা ছিল জেনেছি পরে। দাঁদা ছিলেন ধর্মপ্রাণ মানুষ। তাঁর আয়ে টুকটাক সংসার চালানোর এবিলিটি ছিল। এটা নিয়ে তাঁর আফসোস ছিল না। আমি উনাকে খুব ভালোবাসতাম। তাঁর মৃত্যুতে আমি ভেঙে পরি।আমি যখন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম তাঁর কয়েক মাস পরের ঘটনা, এক কঠিন সত্যি আমার সামনে এসে উপস্থিত হয়। যেটা জানার পরে আমার মাথায় কাজ করছিল না। একজন মানুষ কিভাবে এতটা জঘন্য হতে পারে আমার জানা ছিল না। বৃদ্ধ মানুষটা ধুকে ধুকে মা*রা গিয়েছিল শুধু আমার বাবার জন্য। সে স্বার্থের লোভে এই মানুষটার সুখ চিরতরে কেড়ে নিতে দুবার ভাবেনি। আমার দাদিজান জোছনা বিবি কে দাদাজান খুব ভালোবাসেন। বাবা ছিলেন দাদাজানের প্রথম সন্তান। বাবার বয়স যখন আঠারোর উপরে তখন দাঁদিজান জানতে পারেন উনার কোল জুড়ে আবারও কোনো চাঁদের দেখা মিলতে চলছে। দাঁদাজান খুশী হলেন। আল্লাহ্ কাছে শুকরিয়া জানালেন কিন্তু আমার বাবা সবটা উল্টে দিলো। উনি গ্রামের মোড়লের মেয়েকে পছন্দ করতেন। মোড়ল কিছুতেই বাবার সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে মানতে চাইলেন না। কারণ বাবার অবস্থা তখন ভালো ছিল না। বাবা হতাশ হলেন তবে হাল ছাড়লেন না। বাড়িতে আসা কমিয়ে দিলেন। খারাপ বন্ধুদের সঙ্গে এখানে সেখানে ঘুরাঘুরি নেশা করতেন। কোন এক রাত্রিকালে নেশায় বুদ হয়ে ফিরছিলেন তিনি। ঘন অন্ধকার রাত। খোলা মাঠ পেরিয়ে যখন বিলের রাস্তায় হাটা ধরেছেন ঠিক সেই সময় একটা খোলা জমিতে বসা একজন মানুষের দেখা পেলেন। উনি বাবার নাম ধরে ডেকে সামনে বসতে বললেন। বাবা কৌতুহলবশত বসে পড়লেন। লোকটা বাবাকে শর্টকাট অর্থসম্পদের মালিক হওয়ার বুদ্ধি দিলেন। যার জন্য উনাকে করতে হবে কালো জাদুর বা পিশাচ সাধনা। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। সাধনার জন্য গর্ভবতী মহিলার জীবন বলি দিতে হবে। সেটা পর কেউ হলে চলবে না। নিজের আপনজনকেই দিতে হবে। বাবার চোখ তখন চকচক করে উঠলো। উনি এক কথায় রাজি। সারারাত দিন লাগিয়ে সাধনা করলেন। হঠাৎ একদিন বাড়িতে দাদিজানের প্রাণ গেলো তবুও ফিরলেন না। গভীর রাতে কেউ একজন দাঁদিজানের কবর খুড়ে খুলি চুরি করলো সেটাও জানলেন না। উনি ফিরলেন সফল হয়ে। তারপর হঠাৎ করে কিভাবে জানি এই বিশাল সম্পদ পেলেন। সঙ্গে পেলেন আমার মাকে। কিন্তু দাদাজন পেলেন সঙ্গী হারানোর হাহাকার। বাকী জীবন মরার মতো বেঁচে ছিলেন। করো সঙ্গে কথা বলতেন না। চুপচাপ ঘরে পড়ে থাকতেন। দাঁদাজানের মৃত্যুর আগের দিন উনি আমাকে সবটা বলে গেলেন।। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। চিরতরে চলে আসার সব ব্যবস্থা করে ফেললাম।কথায় বলে পাপ ছাড়ে না বাপকে ঠিক তেমনই হলো। আমি আসার দুদিন আগে হঠাৎ বাবা আমাকে কাছে ডাকলেন। সীমাহীন ভয় নিয়ে আমার সামনে এক পাথর বের করে ধরলেন। বর্ণনা করলেন সেই পাথরের কাহিনি। ওটা ছিল এই ধনসম্পদের আসল হাতিয়ার। সাধনা শেষে সেই লোকটা বাবাকে এটা দিয়েছিলেন। যতদিন ওটা বাবার কাছে থাকবে ততদিন উনার সম্পদ বাড়তেই থাকবে। আমি ভয়ানক একটা সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই অনুযায়ী বাবার পাথর চুরি করে দেশ ছাড়লাম। যেই পাথরের জন্য উনি দাদাজনকে কষ্ট দিয়েছেন আমি সেই পাথর উনার থেকে কেড়ে নিলাম। এখানে আসার পর বাড়িতে যোগাযোগ বন্ধ করে দিলাম। পড়াশোনার সঙ্গে ছোটখাট চাকরি করে আমার ভালোই দিন যাচ্ছিলো। হঠাৎ সহপাঠীর প্রেমে পড়ে ওকে বিয়ে করে জমিয়ে সংসার করতে লাগলাম। ততদিনে আমার লেখাপড়া পাট চুকে গেছে। প্রফেসর হিসেবে জয়েন করেছি । দিনকাল ভালো যাচ্ছিলো কিন্তু হতাশা পিছু ছাড়লো না। বহুকাল অপেক্ষা করলাম সন্তানের মুখ দর্শন করা ভাগ্যে ছিল না বোধহয়। হতাশার মূহুর্তে মানুষ একটা ক্ষীণ আসার দেখা পেলেও বুকবাঁধে। আমিও তাই করলাম। পাথরটা বের করলাম। জানিনা কিছুই শুধু মনে মনে বিড়বিড় করলাম কিন্তু মন মানলো না। সেটা লুকিয়ে ফেললাম। ভাবলাম ওটা আর বের করবো না। কিন্তু হঠাৎ একদিন স্বপ্ন দেখলাম। দাঁদিজানকে যাকে আমি কখনও দেখিনি। ওটা স্বপ্ন নাকি ছিল কল্পণা তাও জানিনা। দাঁদিজান বললেন,নওশাদ ওসব পাথর টাথর ফেলো।আমি নিজেই তোমার মেয়ে হয়ে তোমার কোলে আসবো। আমাকে কিন্তু পূর্বের মতো বলি হতে দিওনা। ওই পাথর তুমি নষ্ট করে দাও। ওর জন্য আমরা সবাই কষ্ট পেলাম। দাঁদিজানের কথার মানে না বুঝেই আমি পাথরটা মসজিদের পাশে থাকা দানবক্সে ফেলে আসলাম। মনে হলো আমার উপর থেকে বোঝা নেমে গেলো। দাঁদিজানের স্বপ্নটা আমি ততটা আমলে নেয়নি কিন্তু সত্যি সত্যি মাস খানেক পরে জানতে পারলাম আমি বাবা হবো। মনটা খুশীতে নেচে উঠলো। কি এক অনুভূতি । আমার আধার কালো সাদামাটা জীবনে ছোট্ট একটা বাবু আসছে। আমি নামও ঠিক করলাম। অধরা যার মধ্যে নাকি আমার দাদিজানের আদলের মিশ্রণ থাকবে। জানিনা দাদিজান কেমন ছিলেন। পাথরের চিন্তা বাদ দিয়ে দিলাম। পৃথিবী আলোকিত করে আমার ছোট্ট পরি আসলো। পরীকে ঘিরে আমাদের ছোট্ট সংসার । কিন্তু আমার অধরা যখন একটু একটু করে বড় হচ্ছিলো সেই সঙ্গে বাড়ছিল ভয়।। একরাতে আবারও স্বপ্ন দেখলাম দাদিজান বলছেন, নওশাদ পাপ তো পিছু ছাড়লো না রে। তোর মেয়ের মধ্যে কহিনুরের শক্তি প্রবেশ করেছে। ওকে বিয়ে দিয়ে দে। সন্তান আসুক কহিনুরের শক্তি নিয়ে তাঁর জন্মহোক।
(চলবে)