কহিনুর পর্ব-০১+০২

0
1562

#কহিনুর
কলমে : লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১+২

শাশুড়িকে খু*ন করে স্বামীর গায়ে হাত তুলছো এতো সাহস তোর কে দিয়েছে? বাইরে এখনো আমার মায়ের লাশ পড়ে আছে। কেনো করলি বলো? ‘দু’টাকার মেয়ে, তোকে খু*ন করে গুম করতে আমার দু সেকেন্ডও লাগবে না।

স্বামীর মুখে এধরনের কথা শুনতে হবে অধরা কল্পণাও করেনি। লোকটা শান্ত আর ভদ্রলোক। কখনও দরকার ছাড়া অধরার সঙ্গে গত এক বছরে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি। যখন যা চেয়েছে পেয়েছে। এই বাড়ির সবাইকে ও নিজের মনে করে। তাছাড়া পাঁচ পাঁচটা ননদদের মধ্যে ও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। ওরা ভূলেও অধরার আশেপাশে ঘেঁষে না শুধু শাশুড়ি মা ছাড়া। সেই শাশুড়িকে ও কিভাবে মারতে পারে অধরার মাথায় আসছে না। আজ সন্ধ্যায় শাশুড়িমা ওকে ছাদে ডেকেছিল। কেনো ডেকেছিল সেগুলো ও কাউকে বলতে পারবে না। শাশুড়ি মা ওর হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বলেছিল,
> এটা ধরো। এর চাইতে বেশি কিছু বলার অধিকার আমার নেই। এটা গোপন রাখবে। এই বাড়ির কাউকে বিশ্বাস করবে না এমনকি নিজের স্বামীকেও না। নিজের আর তোমার মধ্যে থাকা মহামূল্যবান রত্নের খেয়াল রাখবে। পারলে দ্রুত পালিয়ে যাও। আমার আলমারির ড্রয়ারে কিছু দরকারি জিনিস আছে তোমার কাজে লাগবে। এখন নিচে যাও!দ্রুত।

অধরা কিছু বলতে চেয়েছিল কিন্তু হলো না তাঁর আগেই উনি ধমক দিয়ে ওকে নিচে পাঠিয়ে দিলেন। অধরা নিচে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাইরে হৈচৈ পড়ে গেলো। অধরা দৌড়ে গিয়ে দেখলো ওর শাশুড়ি নিচে পড়ে আছে। চার‍দিকে রক্তের ছড়াছড়ি। কি ভয়ংকর দৃশ্য। অধরা সেখানেই জ্ঞান হারালো। যখন জ্ঞান ফিরলো দেখতে পেলে ও রুমে শুয়ে আছে আর ওর স্বামী জুবায়ের ফারুকী ওর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছে। ওর চোখ খুঁলতে দেরি হলো কিন্তু লোকটার ওর উপরে ঝাপিয়ে পড়তে দেরি হলো না। গলা আটকে ধরলো। অধরার মনে হলো এখুনি বুঝি মারা যাবে। তাই উপায়ন্তর না পেয়ে লাথি বসিয়ে দিয়েছিল স্বামী নামক লোকটার বুকে। শক্তিশালী জুবায়েরের সঙ্গে ও পারবে কিভাবে। লোকটা পড়ে গিয়েও আবার উঠে আসলো। অধরা ওই সুযোগ দ্রুত বিছানা থেকে নেমে পড়লো কিন্তু জুবায়ের ওকে টেনে দেয়ালের সঙ্গে আটকে ধরে গাল চেপে ধরলো। অধরা বহুকষ্টে বলল,
> আমি এরকম করিনি বিশ্বাস করুন।আপনার মাকে আমি নিজের মা ভেবেছি। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।ছেড়ে দিন।
জুবায়ের হুঙ্কার ছেড়ে বলল,
> ছেঁড়ে দেওয়ার হলে বহু আগেই ছেড়ে দিতাম। তোর ভাগ্য ভালো তোকে দরকার আমার। খুব দরকার। প্রয়োজন শেষ হলে এই পৃথিবী থেকে তোর নাম নিশানা আমি চিরকালের জন্য মুছে দিবো। তুই সুলতান জুবায়ের ফারুকীর নখের যোগ্যও না।
কথাটা বলে জুবায়ের ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে দরজা ধপাস করে বন্ধ করে চলে গেলো। অধরা তাল সামলাতে না পেরে ছুটে গিয়ে ফ্লরে পড়লো। খাটের কোনা লেগে কপালের কিছু অংশ কেঁটে গেলো। অধরা কপালে হাত রেখে উঠে বসলো। ব‍্যাথা আজ শরীরে না মনে লাগছে। শাশুড়ির মৃত্যুর পরে ওর দুনিয়াটা কেমন বদলে গেলো। এতদিন তো ভালোই ছিল। বিয়েটা হয়েছিল পরিবারিক ভাবে। বিয়ের এক মাসের মাথায় সড়ক দুর্ঘটনাতে ওর বাবা মা মা*রা গিয়েছিল। অধরা বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ার দরুণ অন্তিম যাত্রার সাক্ষী হতে পারলেও আর কখনও সেখানে ওর পা রাখতে পারেনি। বাবা মাকে ভেবে ও কাঁদবে কষ্ট হবে ভেবে শাশুড়ি ওকে যেতে মানা করতো। আগলে রেখেছিল। যখন যা লেগেছে পেয়েছে। বাড়ির বাইরে যাওয়ার দরকার হয়নি। সুলতান জুবায়ের ফারুকী একজন ভালো ব‍্যবসায়ী আর বেশ প্রভাবশালী লোক। বাড়িতে কাজের লোকের অভাব নেই কিন্তু সবাই কেমন চুপচাপ। দরকার ছাড়া এই বাড়িতে কোনো শব্দ উচ্চারণ হয়না। পাঁচটা নন্দন সবগুলো বিবাহ উপযুক্ত,এক কথায় আগুন সুন্দরী। যাদের দেখলে মানুষ না ভেবে সবাই পরি ভেবে ভূল করবে। কিন্তু চাঁদেরও কলঙ্ক আছে। এই মেয়েগুলোও তেমনি একটা অভিশাপ বহন করে। এরা বোবা কথা বলতে পারেনা। আধুনিক পোশাক আর চলন ভঙ্গিতে এদের জুড়িমেলা ভার। অধরা এদের রূপের কাছে কিছুই না। কথাগুলো ভেবে অধরা দ্রুত নিজের শাড়ির আচলে থাকা কাগজটা বের করে চোখের সামনে ধরলো। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা আছে,

“বধির বোবা বলবে বাক‍্য ঝরবে তখন লাল র*ক্ত। ঊষা কালে খুঁলবে দুয়ার শান্ত হবে তিমির দুয়ার”।

একটা ধাঁধা কিন্তু এর মানে কি হতে পারে অধরার জানা নেই। শাশুড়ি মায়ের মুখটা ওর ভীষণ মনে পড়ছে। অধরা কাগজটা দ্রুত লুকিয়ে বেরিয়ে আসলো। এর মধ্যে লা*শ দাফনের সব কাজকর্ম শুরু হয়ে গেছে। বাড়িতে সবাই সাদা পোশাক পরেছে। মেয়েরা মায়ের চারপাশে চুপচাপ বসে আছে। কিন্তু সবাই খুব স্বাভাবিক কারো চেখে কোনো পানি নেই। জুবায়ে বাইরে আছে। পুলিশ এসেছে ঘটনার তদন্ত করতে কিন্তু জুবায়ের দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দিলো। বেশ কিছু টাকা পুলিশের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ওদেরকে বিদায় জানিয়ে ভেতরে আসলো। অধরা চুপচাপ শাশুড়ির মাথার কাছে গিয়ে বসলো। ছাঁদ থেকে কিভাবে উনি পড়ে গেলেন বিষয়টা নিয়ে ওর চিন্তা হচ্ছে। হঠাৎ মনে হলে উনি ইচ্ছে করে লাফ দিয়েছেন। সুইসাইড করবেন ভেবে ওকে ডেকে এতগুলো কথা বলে গেলেন। কিন্তু সুইসাইড করার কারণটা কি ছিল? কিছুক্ষণের মধ্যে অধরার শশুর এক ভদ্রমহিলাকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। ভদ্রলোকের দুজন স্ত্রী। উনি ছোট বউয়ের সঙ্গে থাকেন। উনি হন্তদন্ত হয়ে মৃত বউয়ের পাশে বসলেন তারপর অধরার দিকে শীতল নজরে তাঁকালেন। অধরা ভয়ে শিউরে উঠলো। জুবায়ের ওর বাবাকে হয়তো সবটা বলে দিয়েছে। সবাই ওকে ভুল বুঝেছে কিন্তু পুলিশে দিচ্ছে না কেনো? এদের কি দরকারে ও লাগতে পারে? অধরার মনে হাজারো প্রশ্ন ঘুরছে। একমাত্র শাশুড়ি মা ভরসা ছিল যে ওকে সাহায্য করতে পারতো। গভীর কোনো রহস্যের অতলে ও তলিয়ে যাচ্ছে। মাথায় যন্ত্রণা করছে। শাশুড়ি মা শেষবারের মতো বলেছিল ওর মধ্যে কোনো রত্ন আছে কিন্তু রত্নটা কী? এই রত্নটার জন‍্যই ওকে হয়তো পুলিশে দেওয়া হচ্ছে না। বাড়িতে সিসি ক‍্যামেরা আছে। যদি খু*ন বলে পুলিশকে জানানো হয় তবে অধরা অনায়াসে ফেঁসে যাবে। জেল বা ফাঁসি নিশ্চিত।
বাবা মা সেই সঙ্গে প্রিয় শাশুড়ি মায়ের এই রহস্যময় মৃত্যু ওকে সম্পূর্ণ একা করে দিলো। অধরা নিজেকে সামলাতে পারছে না। এই নিস্তব্ধ বাড়িতে শব্দ করে কাঁদার মতো অধিকার ওর নেই। কান্নাতে গলা আটকে আসছে। অধরা দ্বিতীয়বারের ন‍্যায় আবার জ্ঞান হারালো।
__________
মধ্য রাতে আধরার জ্ঞান ফিরলো। মুখের উপরে কারো দীর্ঘ উষ্ণ নিশ্বাস পড়ছে। ভয় ওক আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। আধরা হুট করে চোখ খুলে দেখলো জুবায়ের ওর মুখের উপরে ঝুকে আছে। রুমে আবছা আলো বিরাজ করছে। লোকটার দৃষ্টিতে কোনো রাগ নেই না আছে ঘৃণা। অধরা ডান হাতটা জুবায়ের মুখে রাখতে যেতেই ছেলেটা খপ করে হাতটা ধরে নিয়ে বলল,
> সরি তখন মাথাই কাজ করছিল না।কি বলতে কি বলেছি মনে রেখো না। মৃত্যুতে কারো হাত থাকে না। মায়ের মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে মেনে নিয়ে আগে মতো হয়ে যাও।
অধরা ভ্রু কুচকে ফেলল লোকটার কথা শুনে। একজন সন্তান কিভাবে এতো তাড়াতাড়ি নিজের মাকে ভূলে যেতে পারে? অধরা প্রশ্ন করতে চাইলো কিন্তু পারলো না। জুবায়ের ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো নিজের সঙ্গে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো,
> আমাদের ঘরে খুব তাড়াতাড়ি এক টুকরো রত্ন আসতে চলেছে। আমি ওকে কহিনুর বলে ডাকবো। তুমি কি কিছুই বুঝতে পারছো না? এতো আয়োজন শুধু ওর জন্য।
অধরা চোখ বন্ধ করে কিছু ভাবলো। বিষয়টা সুখের কি দুখের ওর ঠিক মাথায় আসছে না। যেখানে ও মা হয়ে নিজের সন্তানের উপস্থিতি অনুভব করতে পরলো না সেখানে জুবায়ের বাবা হয়ে কিভাবে সব বুঝে গেলো? আর শাশুড়ি মা সেও কিভাবে জানলো? এই গোলক ধাঁধা কিভাবে কাঁটবে কে জানে। জুবায়ের আধা ঘন্টার মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। অধরা সাবধানে উঠে বললো। শাশুড়ির আলমারিটা চেক কার দরকার। কি আছে সেখানে? অধরা সাবধানে উঠে আসলো।পা টিপে টিপে শাশুড়ির রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। সারা বাড়িটা শুনশান নিরব। অধরা সময় নষ্ট করলো না দ্রুত ভেতরে গিয়ে ড্রয়ার চেক করলো। লাল রঙের একটা কাপড়ের মধ্যে কিছু রাখা আছে ও সেটা তুলে নিয়ে দ্রুত নিজের রুমে ফিরে আসলো। সেটা লুকিয়ে জুবায়েরের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। জুবায়ের ঘুমের মধ্যে পাশ ঘুরে অধরাকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> পালানোর চেষ্টা করছো বুঝি? এসব করে সময় নষ্ট করোনা। সময় হলে ঠিক মুক্তি পাবে।
অধরার ঢোক গিলল। মনে প্রশ্ন জাগলো জুবায়ের কি সব জেনে গেল?

চলবে,,

#কহিনুর
কলমে: লাবন্য ইয়াসমিন
পর্ব:২

ভোরবেলা চোখ খুঁলে নিজেকে বিছানায় একা আবিস্কার করলো অধরা। জুবায়ের নেই হয়তো উঠে গেছে। গতকাল রাতে ওরকম একটা অদ্ভুত কথা বলে লোকটা আর সাড়াশব্দ করেনি। চুপচাপ ঘুমিয়েছে। এই চুপ থাকাটা অধরার কাছে আরও বিরক্তিকর মনে হয়েছে। কথা বললে অন্তত কিছুটা হলেও জানা যাবে। ধাঁধার মানে হলো কাপড়ের ভাজে রাখা জিনিসপত্রগুলো দেখা দরকার। এই বাড়িতে যতগুলো কাজের লোক আছে তাঁর থেকে দ্বিগুণ রয়েছে সিসি ক‍্যামেরা। বেডরুমে ক‍‍্যামেরা থাকার সম্ভাবনা থাকার কথা না কিন্তু সাবধানের মার নেই। কথাগুলো ভেবে ও আশেপাশে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখে নিলো। পরনে আছে মায়ের দেওয়া কালো রঙের সুতি সিল্কের শাড়ি। যদিও অধরা শাড়ি পরে না গতকাল মায়ের কথা প্রচণ্ড মনে হওয়ার দরুন শাড়ি পরেছিল।জুবায়ের কখনও স্ত্রীর রূপের প্রশংসা করে না। ওর জন্য সাজার দরকার হয়না। অধরার বাবা মা ছিলেন বাঙ্গালী। এটা জার্মানির একটা শহর। অধরার জন্ম হয়েছে জার্মানিতে আসার পরে। ওর বাবা নওশাদ বারি ছিলেন প্রচণ্ড মেধাবী একজন মানুষ। পড়াশোনার খাতিরে পাড়ি জমিয়েছিলেন বাংলাদেশ থেকে সুদূর জার্মানিতে। এখনে এসে স্বদেশি সহপাঠীর প্রেমে পড়ে তাঁকে বিয়ে করে ফেলেন। পড়াশোনা শেষে এখানেই থেকে গেলেন। উনি পেশায় ছিলেন একজন প্রফেসর। অধরা বাবা মায়ের থেকে ভালো বাংলা বলতে শিখেছিল। লেখাপড়া শেষ হওয়ার আগেই একদিন সুলতান পরিবার থেকে বিয়ের প্রস্তাব গেলো বাড়িতে। তাছাড়া অধরার বাবা চেয়েছিলেন মেয়ের বিয়ে যেনো কোনো বাঙ্গালী পরিবারে হয়। সুলতান জুবায়ের ফারুকীর পরিবার বাংলাদেশ থেকে এই শহরে বহুকাল আগে এসেছে। ওরা এখানকার স্থানীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে। বোঝা কঠিন ওরা আগে বাঙ্গালী ছিল। এই অর্থসম্পদের পাহাড় এরা কিভাবে রপ্ত করেছে এটা সকলের অজানা। ভালো পরিবার থেকে প্রস্তাব পেয়ে প্রফেসর সাহেব আর অপেক্ষা করলেন না। বিয়ে পড়িয়ে দিলেন। আয়নার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবছিল মেয়েটা। গতকাল জুবায়ের বলেছিল ও দু’টাকার মেয়ে। ওর সঙ্গে জুবায়ের ফারুকীর যায় না। স্বামীর থেকে এতবড় কথাটা শোনার পর শক্ত থাকা কঠিন। তবুও ওর তেমন রাগ হচ্ছে না। মনের মধ্যে শাশুড়ি মায়ের মৃত্যু নিয়ে নানারকম কথা ঘুরপাক খাচ্ছে। আধরা অনমনে আয়নায় নিজের হাতটা রেখে চমকে উঠে হাত ফিরিয়ে নিলো। আবারও হাত ছোঁয়ালো। প্রচণ্ড ঘৃণাতে ওর বমি আসছে। একজন লোক কতটা নিকৃষ্ট হলে নিজের বেডরুমের আয়নায় মধ্যে ক‍্যামেরা লুকিয়ে রাখতে পারে ওর জানা নেই। প্রায় ও এই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ড্রেস ঠিকঠাক করে আবার কখনও চেঞ্জও করেছে। ড্রেসিং টেবিল থেকে বেড খুব ভালো করে দেখা যায়। অধরা দ্রুত বাথরুমে গিয়ে মুখে কয়েকবার পানির ঝাপটা দিয়ে আবারও চেক করতে আয়নায় হাত রাখলো। এখানে কিছু নেই ভেবে স্বস্তি পেলো। ভাবলো লোকটার মাথায় কি চলছে কে জানে। বাবা মা আর শাশুড়ির জন্য ওর প্রাণ কাঁদছে কিন্তু ওকে দুর্বল করছে না। ও যথেষ্ট শক্ত ধাচের মেয়ে। শুধু ফ‍্যাচ ফ‍্যাচ করে কাঁদলে সব সমস্যার সমাধান হবে না। এই বাড়ির রহস্য আর শাশুড়ির এভাবে সুইসাইডের কারণ ওকে বের করতে হবে। কথাগুলো ভেবে ও দ্রুত বেরিয়ে পড়লো। পূনরায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখার সাহস ওর হলো না। হঠাৎ মনে হলো প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে। গতকাল দুপুরে শাশুড়ি মায়ের হাতে খেয়েছিল কথাটা ভেবেই ওর চোখ ভিজে উঠলো। আহা ভালো মানুষগুলোর সঙ্গেই বুঝি এমন হয়। অধরা বাইরে বের হতে গেলো কিন্তু হলো না ঝড়ের গতিতে জুবায়ের প্রবেশ করলো। আর ওকে টেনে নিয়ে বিছানায় ফেলে দিয়ে ওর উপরে ঝাপিয়ে পড়লো। অধরা ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। জুবায়ের ওর ডান গালে হাত রেখে কুটিল হেঁসে বলল,

> শেষবারের মতো তোমাকে স্পর্শ করছি। সত্যি কি জানো? তোমাকে স্পর্শ করতে আমার কেমন জানি অস্বস্তি আর ঘৃণা লাগে। তবুও এটা আমাকে করতে হয়েছে। মনের উপরে জোরজবরদস্তি করে তোমার সঙ্গে থেকেছি কতটা যন্ত্রণা হয়েছে সেটা শুধু আমি আর আমার হৃদয় জানে। তুমি তো কষ্ট পাওনি বরং বেশ উপভোগ করেছো। আমার ঐশ্বর্য আমার ভালোবাসা সবটা। এগুলো তোমার জন্য ছিল না। সবটা ছিল কহিনুরের জন্য।

জুবায়ের একদমে কথাগুলো বলে থামলো। অধরা বিস্মিত হয়ে লোকটার দিকে তাঁকিয়ে আছে। অপমান বোধ ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না এই লোকটা ওকে শুধু ব‍্যবহার করেছে। অধরা দ্রুত শপথ নিলো এদের পরিকল্পনা ও কিছুতেই সফল হতে দিবে না। দরকার হলে নিজেকে শেষ করে ফেলবে। কথাটা ভেবে ও জুবায়েরকে নিজের উপর থেকে সরানো চেষ্টা করলো যখন পারলো না তখন নাকমুখ কুচকে বিরক্তি নিয়ে বলল,

> আমি বোকার মতো ভাবতাম আপনি বুঝি কম কথা বলেন। স্ত্রী হিসেবে আমাকে আপনার ভেবেই কাছে টেনেছেন। কিন্তু না এসব তাহলে মুখোশ ছিল। মুখোশ উন্মোচন হচ্ছে আর মুখ দিয়ে খৈই ফুটছে। আমার প্রাণ থাকতে আমি আপনার কোনো পরিকল্পনা সফল হতে দিচ্ছি না। মনে রাখবেন আমি অবলা না।

জুবায়ের এক দৃষ্টিতে অধরার দিকে তাঁকিয়ে ছিল এতক্ষণ। স্ত্রীর চোখে নিজের প্রতি ঘৃণা দেখে মুখটা সরল করে বলল,
> তুমি সত্যিই বোকা। আমি এতক্ষণ মজা করছিলাম। গতকাল এতকিছু বলেছি তাই ভাবলাম তোমাকে আরও একটু ঘাবড়ে দিয়ে মজা করি। আর আম্মা সুইসাইড করেছে বাবার উপরে রাগ করে। আসলে বাবা দু সপ্তাহ ধরে ছোট মায়ের কাছে আছেন এটা উনি মানতে পারছিলেন না। তুমি ওসব ভূলে যাও। ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করো। আমার কহিনুরের যেনো কোনো কষ্ট না হয়।
জুবায়ের কথাগুলো একদমে বলে অধরার কপালে চুমু দিয়ে উঠে বসলো। অধরা এই লোকটার মতিগতি বুঝতে হিমশিম খাচ্ছে। এই ভালো তো এই খারাপ। জুবায়ের ওকে সুযোগ দিলো না দ্রুত কোলে তুলে বেরিয়ে গেলো। ডাইনিং টেবিলে নানারকম সুস্বাদু খাবার আর ফলের সমাহার।গতকাল থেকে জুবায়েরের বাবা আর উনার দ্বিতীয় স্ত্রী এই বাড়িতে আছেন। ভদ্রমহিলা এখানকার স্থানীয়। ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিক আর উন্মুক্ত ড্রেস বড্ড বেশি বেমানান লাগলেও কেউ বিষয়টা পাত্তা দিচ্ছে না। জুবায়ের ওকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পড়লো। কেউ কারো দিয়ে তাঁকাচ্ছে না। নিরবে খাচ্ছে। জুবায়েরের বাবা আরমান ফারুকীর বয়সটা নিয়ে বেশ ঘাপলা আছে। তিরিশ বললেও মানা যায় আবার চল্লিশ বা পঞ্চাশ বললেও ভূল হবে না। লোকটা যথেষ্ট ইয়াং। অধরা সেদিকে বেশ ভালো করে লক্ষ করলো। একজন মানুষ গতকাল মারা গেছে কিন্তু এদের মধ্যে কোনো অনুতাপ বা দুঃখ নেই। অধরা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল। জুবায়ের ওর মুখে খাবার তুলে ধরতেই ও আবারও চমকে উঠলো। গত এক বছরে এই প্রথমবার লোকটা ওর কাছাকাছি থেকে যত্ন নিচ্ছে। রাত ছাড়া তো লোকটাকে পাওয়া যায় না। মাঝেমাঝে রাতেও বাড়িতে ফিরে না। ওকে চমকে যেতে দেখে জুবায়ের ওষ্ঠে হাসি নিয়ে ভ্রু নাচিয়ে ইশারা করলো খেতে। অধরা দ্রুত খেয়ে নিলো। স্বামীর থেকে প্রাপ্ত এইটুকু সুখ হাতছাড়া করা বোকামি হবে। তাছাড়া পৃথিবীর সব স্ত্রী চাই তাঁর স্বামী তাঁকে কেয়ার করুক পাশে থেকে সাপোর্ট করুক। অধরা দ্বিধা ভূলে খাবার খেয়ে নিলো। জুবায়ের আবারও ওকে পূর্বের ন‍্যায় রুমে নিয়ে গিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল,
> আজ থেকে তুমি রুমের বাইরে যাবে না। যদি অসাবধানতাবশত পড়ে যাও বা তোমার কোনো ক্ষতি হয়েছে তাহলে আমার কহিনুর কষ্ট পাবে। তুমি মা হয়ে সেটা কি সহ‍্য করতে পারবে?
অধরা মাথা নাড়িয়ে না বলল। জুবায়ের হাসি দিয়ে বলল,
> চুপচাপ ঘুমিয়ে যাও। আমি অফিসে যাচ্ছি। যখন যা দরকার হবে শুধু উচ্চারণ করবে সঙ্গে সঙ্গে হাজির হয়ে যাবে। ভালো থেকো।
জুবায়ের আর অপেক্ষা করলো না দ্রুত বেরিয়ে গেলো। অধরা শুয়ে ছিল ও যেতেই উঠে বসলো। শাশুড়ি মায়ের দেওয়া ধাঁধার মানে বের করতে হবে। বারবার কাগজ দেখা বিপদ ভেবে লাইনগুলো মনে রেখেছিল। আধরা ঠোঁট নাড়িয়ে শব্দহীন ভাবে উচ্চারণ করলো,
“বধির বোবা বলবে বাক‍্য ঝরবে তখন লাল র*ক্ত। ঊষা কালে খুঁলবে দুয়ার শান্ত হবে তিমির দুয়ার”।

প্রশ্ন জাগলো, বধির বোবা এই বাড়িতে ওর পাঁচটা ননদ আছে ওদেরকে মিন করে লেখা নাতো? এমতো হতে পারে এই বোবো মেয়েগুলো যখন কথা বলবে তখন অন‍্য কারো রক্ত ঝরবে? আর ঊষাকাল বলতে ভোরবেলা বুঝিয়েছে। অধরা লাফিয়ে উঠলো। ধাঁধার মানে সবটা না বুঝলেও শেষেই লাইনটা বুঝেছে। এই বাড়ির দরজা ভোরবেলায় খোঁলা থাকে যখন সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। মানে শাশুড়িমা ওকে এই বাড়ি থেকে পালানোর রাস্তা বলে গেছে। প্রথম লাইনটার মানে খুব জটিল। যারা জন্ম থেকে বোবা তাঁরা কিভাবে কথা বলবে? যদিওবা বলে তবে রক্ত কেনো ঝরবে? অধরা আর ভাবতে পারলো না। কাপড়ের ভাজে রাখা পুটলিটা বের করতে হলে সিসি ক‍্যামেরাটা বন্ধ করা জরুরি। কিভাবে সম্ভব কথাটা ভেবে ও ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। এলোমেলো ভেবে উঠে বসলো। চুপচাপ পড়ে থাকা মতো মেয়ে ও না। এলোমেলো কিছু ভেবে দ্রুত গোসল করতে বাথরুম চলে গেলো। গোসল শেষ করে টাওয়েল জড়িয়ে বেরিয়ে আসলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বাঁকা হাসলো। আজ ও খানেই চেঞ্জ করবে। পোশাক কয়েকটা বেশি এনেছে সেটা রাখার উত্তম জায়গা হিসেবে ড্রেসিং টেবিলের উপরে ঝুলিয়ে দিয়ে দ্রুত নিচে বসে পড়লো। তাড়াতাড়ি লাল পুটলিটা বের করে দেখে নিলো। সেখানে বেশ কিছু টাকা একটা লকেট দেওয়া চেইন। তাঁতে সুন্দর করে খোঁদাই করা কহিনুর। এক পাশে রাখা আছে ওর পাসপোর্ট। শাশুড়ি আম্মা যে আগে থেকেই পরিকল্পনা করেছিল বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। অধরার হাত পা থরথর করে কাঁপছে। চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। বারবার ধরা পড়ার ভয় করছে। ও আর বাকীটা দেখতে পারলো না। দ্রুত সেটা লুকিয়ে উঠে দাড়ালো। বাইরে থেকে ঠকঠক আওয়াজ আসছে। ওর দেরী দেখে জুবায়ের ভেতরে এসে ভ্রু কুচকে ফেলল। টাওয়েল পরে মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে দেখে ওর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। এতক্ষণ লাগে কারো ড্রেস পরতে? তাছাড়া বাথরুম রেখে এখানে কেনো ড্রেস রাখতে হবে। জুবায়ের অফিসে ছিল। গাড়ি নিয়ে ছুটে এসেছে। আয়নার মধ্যে ক‍্যামেরা আছে মেয়েটা কোনরকম ঠিক পেয়েছে কি বুঝতে পারছে না। অধরা নিজের মতো লোশন নিয়ে হাত পায়ে ম‍াসেজ করতে ব‍্যস্ত। বুঝতে পেরেছে জুবায়ের ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অধরার ভয় করছে কিন্তু যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখে হঠাৎ পাশ ফিরে চমকে উঠার ছলে নিজেকে দুহাতে আবৃত করে বলল,
> আপনি হুট করে চলে আসলে কেনো? আমি চেঞ্জ করবো তো।
জুবায়ের কথা বলল না। দ্রুত ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে বাথরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে ড্রেসগুলো এর মুখের উপরে ছুড়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলল,
> এধরনের কাজকর্ম আমি পছন্দ করি না। দ্বিতীয়বার যেনো না দেখি। দ্রুত চেঞ্জ করে আসো খেতে হবে।

জুবায়ের ধাক্কা দিয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে বসে পড়লো। মেয়েটা যথেষ্ট চালাক বুঝতে ওর বাকী নেই কিন্তু ও কি করতে চাইছে বোঝতে পারছে না।আর গতকাল মায়ের সঙ্গে ওর কি নিয়ে কথা হয়েছে জানা দরকার। না জানা পযর্ন্ত শান্ত হওয়া মুশকিল। এর মধ্যেই কাজের মেয়েটা খাবার দিয়ে গেলো। অধরা বাইরে আসতেই জুবায়ের চুপচাপ ওকে খেতে দিয়ে বের হলো। অধরা চুপচাপ খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। এই বাড়িতে ওর কোনো কাজ নেই। এতদিন শাশুড়ি সঙ্গে ছিল। একাকিত্ব অনুভব হয়নি। আজ হচ্ছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে ও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। সারাদিন ধরে ঘুমিয়ে বসে দিন পার করলো। জুবায়ের আর আসেনি। সন্ধ্যার পরে ওর ঘুম ভাঙলো। চুপচাপ ফ্রেস হয়ে বাইরে উঁকি দিলো। ননদগুলোর সঙ্গে কথা বলবে ভেবে বাইরে আসতেই সিঁড়িতে কাজের মেয়েটা ওকে বাঁধা দিয়ে বলল,
> আপনার বাইরে যাওয়া নিষেধ। চলুন ঘরে যায়।
অধরার কথা মেয়েটা শুনলো না। এক প্রকার জোরজবরদস্তি করে রুমে এনে রেখে গেলো। কি অদ্ভুত।ওর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। বাড়ির সকলের সঙ্গে মেলামেশা না করলে বুঝতে কিভাবে কার মনে কি চলছে।
☆☆☆☆☆☆
নিস্তব্ধ হলরুম চার‍দিকে অবছা অন্ধকার। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে অধরা। খুব সাবধানে নামতে হচ্ছে। বিস্তির্ণ হলরুমে কয়েকজন মানুষের চাপা কান্নার আওয়াজ হচ্ছে। অধরা দ্রুত পায়ে নিচে নেমে আসলো। এতক্ষণ অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকলেও সামান্য আলোর ছিটা এসে সবটা পরিস্কার হয়েগেলো। অধরা চোখ বন্ধ করে খুঁলে একটা ঝটকা খেলো। সামনে ওর বাবা মা আর শাশুড়ি সেই সঙ্গে ওর শশুর মশাই বসে আছে। পায়ে লম্বা করে সিকল পরানো। তাদের শরীর থেকে র*ক্ত গড়িয়ে ফ্লোরে ছোটখাটো একটা স্রোতের সৃষ্টি হয়েছে। অসহায় ভাবে ওরা অধরার দিকে তাঁকিয়ে আছে। মনে হলো সবটা ওর মনের ভূল। সামনে থাকা তিনজন মারা গেছে কিন্তু ওর শশুর তো জীবিত। জীবিত লোক কিভাবে মৃত লোকদের সঙ্গে বন্দি থাকবে? অধরা ভাবতে পারলো না। রাতে ঘুমিয়েছিল হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলো। ফিসফিস আওয়াজ শুনে বাইরের চুপচাপ উঠে এসেছে। ওর ধ‍্যান ভাঙলো একটা আওয়াজ শুনে। বারবার উচ্চারিত হচ্ছে, পালিয়ে যাও। অধরা কান ধরে বাবা মায়ের দিকে ছুটে আসলো। কিন্তু ছুতে পারলো না। সিঁকল টেনে কেউ একজন সবাইকে নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো। অধরা চিৎকার করে জ্ঞান হারালো।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে