#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_চব্বিশ
(আজকের পর্বের কিছু বর্ণনা একটু অস্বস্তিকর। তবে আমি ১৮+ ট্যাগ লাগাচ্ছি না। কারণ ১৮ বছর বয়সের নিচের কেউ পড়ছে বলে আশা করছি না। আর অল্পবয়সী মেয়েদের কিছু ব্যাপারে সতর্ক থাকারও দরকার আছে। তারা পড়লে ক্ষতির কিছু নাই। উত্তেজনা সৃষ্টিতে রগরগে বর্ণনা আমি কখনোই দিই না।)
‘কই দেখি তো কেমুন তেজি মুরগি ধইরা নিয়া আইছস? খুব নাকি তেজ মাইয়ার! মাইয়া মাইনষের তেজ না থাকলে কি মানায় নাকি? দেখি দেখি… ঘোমটা খোলো… ঘোমটা খোলো… দেখি গো! ওহহো! ঘোমটাই তো নাই! এইডা কেমুন কথা হইল? ঐ তরা একটা ঘোমটার ব্যবস্থা করবার পারিস নাই? এইরাম কইরা শুভদৃষ্টি হইল?’
ওস্তাদের কথা শুনে তার আস্তানার বিশেষ আয়োজনে উপস্থিত সবাই খুব একচোট হেসে নিলো। মাঝে মাঝে ওস্তাদ এমন মজার মজার সব কথা বলে!
জ্ঞান ফেরার পর থেকে সুফিয়া নিজেকে এখানে আবিষ্কার করছে। জায়গাটা বেশ বড়সড়। চারপাশে গাদাগাদি করে অনেক গাছের খণ্ড স্তূপ করে রাখা। কিছু জায়গায় সেগুলো দিয়ে সিঁড়ির মতো তৈরি করা হয়েছে। সেই সিঁড়ি নানাকাজে ব্যবহার হচ্ছে। ওপরে টিনের ছাদ। সিলিঙয়ের ওপর থেকে দড়ির মতো কিছু জিনিস দিয়ে বড় বড় বাল্ব ঝোলানো আছে। এরপর প্রায় নয় দশটা কী তারও বেশি বাল্ব পুরো ঘরটাতে। সেগুলোর আলোয় জায়গাটা যথেষ্ট আলোকিত। পায়ের নিচে কাদামাটি। কিছু জায়গা শুকনোও আছে। চারপাশের প্রশস্ততা দেখে বোঝা যায়, এটা কিছুতেই লোকজনের চোখের আড়ালে থাকার মতো কোনো জায়গা না। কিন্তু সুফিয়া এরকম জায়গা কোথাও দেখেছে বলে মনে করতে পারল না।
জ্ঞান ফেরার পরে বেশ অনেকটা সময় সুফিয়ার মাথাটা ঝিম মেরে ছিল। চোখের সামনে তখনো সর্ষে ফুল দেখছে সে। চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। সুফিয়া চেঁচামেচি না করে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখছিল। সে এখানে এলো কেমন করে? এখন কয়টা বাজে? এই বিশাল জায়গাটা আলোকিত হয়ে থাকলেও জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকার ঠিকই চোখে পড়ছে। তার মানে এখন রাত! এত রাতে সে এখানে কীভাবে এসেছে?
ধীরে ধীরে অনেক কিছু মনে পড়ে গেল। সুফিয়া আজ গিয়েছিল তার বান্ধবী ফুলির বাসায়। সে একা যায়নি, জুলেখাবুও গিয়েছিল। ফুলির জামাইয়ের ছাগলামি আর ফুলির সেই ছাগল জামাইকে নিয়ে আদিখ্যেতা দেখতে দেখতে মনে মনে ভাবছিল, জীবনে কোনোদিনও বিয়ে করবে না। আসার পথে জুলেখাবুকে সেই কথাটাই বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময় … কী জানি একটা হলো! আচমকা কী একটা যেন ছুটে এলো তার দিকে… তারপর… আর কিছু মনে নাই। জ্ঞান ফেরার পরে দেখছে সে এখানে!
তাহলে কি কেউ তাকে উঠিয়ে এনেছে? কী জন্যে উঠিয়ে এনেছে? খারাপ উদ্দেশ্যে? কী সর্বনাশের কথা!
যে জায়গাটা দিয়ে তারা আসছিল সেই বিলের কাছে এর আগেও এরকম ঘটনা ঘটেছে। জুলেখাবু কখনোই ঐ রাস্তা দিয়ে রাতে কোথায় যাওয়া আসা করতে চায় না। সুফিয়াই তাকে আশ্বাস দেয়, ‘তুমার খালি আজাইরা ভয় বু! এইডা আমাগো গেরাম! এইখানে আমাগো ক্ষতি করব এইরাম কেউ আছে নাকি?’
কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, তার ধারণাটা ঠিক ছিল না। ক্ষতি করার মানুষ কখন কোথা থেকে এসে যে হাজির হয়ে যায়, কেউ বলতে পারে না!
জ্ঞান ফেরার পরে সে ভয়ে ভয়ে নিজের শরীরের দিকে তাকায়। কেউ কি এর মধ্যেই তার ক্ষতি করে গেছে? মন আশ্বস্ত করে, সে ঠিক আছে। কিন্তু কতক্ষণ ঠিক থাকবে কে জানে! জীবনে ভয়ডর শব্দগুলোর সাথে ওর সেভাবে আলাপ পরিচয় ছিল না। একা একা জঙ্গলে বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। দেউ, বুনো জন্তু এমনকি মানুষ… কাউকেই ভয় করেনি কখনো। কেউ ‘ভয় পাস না?’ বললে ওর হাসি পেত। মাঝে মাঝে বিরক্তও লাগত। ভয় কীভাবে পায় কে জানে! মানুষ এই ভয়ের কথা ছাড়া আর কিছুই কেন জিজ্ঞেস করতে পারে না কতদিন ভেবেছে সুফিয়া!
কিন্তু এই প্রথম সে বুঝতে পারছে ভয় কাকে বলে! ভয় মনের মধ্যে কীভাবে ঘুরপাক পায়! কেমন করেই বা সেটা ছড়িয়ে পড়ে!
কয়েকটা ষণ্ডামতো চেহারার লোক ঘরের মধ্যে আছে। সংখ্যায় তিন চারজন হবে। সকলেই এক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। চোখের দৃষ্টি কেমন জানি অস্পষ্ট। সেখানে খারাপ কিছু আছে হয়ত, কিন্তু সেটা খুব বেশি স্পষ্ট না। লোকগুলোকে দেখতে দেখতে নিজের হাতের দিকে তাকালো সুফিয়া। কী আশ্চর্য! ওর হাতদুটো খুলে রাখা। শরীরের কোথাও কোনো বাঁধন নাই। যারা ওকে আটকে রেখেছে, তারা হয়ত ভালোমতোই জানে, এখান থেকে সে কিছুতেই পালাতে পারবে না। তাই আলাদা ব্যবস্থা নেয়নি।
সুফিয়াকে নিজের হাতের দিকে তাকাতে দেখে লোকগুলোর একজন বলে, ‘ঐ ব্যাটা ছেমড়ির হাত খুইলা রাখছস ক্যা?’
‘ওস্তাদ বান্ধতে মানা করছে। খুইলা থুইলেই কী না থুইলেই কী! ওর এই দুইনার খেল খতম! নড়ন চড়ন হাউশ মাউশ বেবাক শ্যাষ!’
সুফিয়ার পিঠের ওপর দিয়ে কুল কুল করে কীসের যেন শীতল ধারা নেমে গেল। কী বলছে এরা? কী বোঝাতে চাইছে? ওকে কি মেরে ফেলবে? কিন্তু কেন?
‘ছেমড়ি কী করছে?’
‘বহুত গ্যাঞ্জাম করছে। আমাগো রুটিরুজির দিকে হাত বাড়াইছে! এমুন সাহস ছেমড়ির! পুলিশরে গিয়া কইয়া দিছে আমরা আগরগাছ কাটতাছি!’
‘জানল ক্যামনে? আগরগাছের কথা তো গেরামের মানুষে জানে না!’
‘কী জানি! ছেমড়ি মনে হয় জাদুটোনা জানে!’
ওহ আচ্ছা! এই লোকগুলোই তাহলে আগরগাছ কেটে আনে। কেটে এনে এখানে স্তূপ করে রাখে। পরে অন্য জায়গায় পাচার করে। কিন্তু এদের মাথা কে? এত বড় জায়গা এরা গ্রামের মধ্যে কীভাবে জোগাড় করল? অবশ্য গ্রামে জায়গা জোগাড় করা তো কোনো ব্যাপার না! কিন্তু যেটা ব্যাপার তা হলো, এদের এই জায়গার কথা আগে কেউ জানেনি কেন?
ভয় ভুলে থাকার জন্য সুফিয়া নানাভাবে মাথাটাকে খেলানোর চেষ্টা করে। লোকগুলোর কথাই ঠিক। সে এখান থেকে হাজার চেষ্টা করলেও পালাতে পারবে না। এই বিশাল জায়গার চারপাশে এদের লোকজন ছড়িয়ে আছে। এত বড় ব্যবসা ফেঁদে রেখেছে, এটা নিশ্চয়ই এই মাত্র তিন চারজনের কাজ না!
বেশিদূর ভাবতে পারল না, তার আগেই বাইরে গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। আর তার পরপরই ‘দেখি তো কেমন তেজি মুরগি’ বলতে বলতে এই লোক এসে হাজির হয়েছে।
ভয়ে সুফিয়ার গলা পুরোপুরি শুকিয়ে এসেছে। লোক না বলে ছেলে বললেই ভালো হয়। ছেলেটা দেখতে শুনতে ভদ্রঘরেরই মনে হচ্ছে। অথচ কী নোংরা ভাষায় কথা বলছে! কী বিশ্রী চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছে!
ছেলেটা কি এখন ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে? কী করবে সুফিয়া তখন? বিনা বাঁধায় নিজেকে এর হাতে ছেড়ে দিবে? না না এটা কেমন করে হয়! প্রাণপনে ভাবতে চেষ্টা করে সুফিয়া। কিছুই কি নাই? নিজেকে একটুখানি বাঁচানোর কোনো হাতিয়ার?
কোমরের কাছে হাত দিয়ে কী যেন বাধে তার হাতে। বড় সেফটিপিন! শাড়ি সামলে রাখতে পারে না দেখে জুলেখাবু জোর করে ওর শাড়িতে সেফটিপিন গুঁজে দিয়ে শক্ত করে আটকে দেয়। ছোট সেফটিপিন খুলে আসে দেখে নিজে হাটে গিয়ে বড় দেখে সেফটিপিন কিনে এনেছে জুলেখা।
মিশমিশে অন্ধকারে সেই সেফটিপিনটাকেই মনে হয় একমাত্র আলোর দিশা। সুফিয়া আলগোছে সেফটিপিনটাকে খুলে নিজের হাতের মুঠোয় লুকিয়ে রাখে।
‘কী গো মাইয়া কথা কও না ক্যান? রাগ করছ? ওহ হো, এত লোকের মইধ্যেখানে ভয় পাইতাছ? ঐ ব্যাটারা রাম শাম যদু মধু… যারা যারা আছোস সব বিদায় হ এইখান থেইকা! দেখতাছোস না আমি একটা তেজি মুরগির লগে ইশক করতাছি? তরা চোখ দিয়া বইসা থাকলে কি তেজি মুরগিরে পোষ মানাইতে পারুম? ঘাড় ঘুরাইয়া উড়ান দিব না? আর শোন, কনস্টেবল শরফুদ্দিন ব্যাটা আইতে পারে। হারামজাদার তেজি মুরগির ঝাল মাংস খাওনের শখ হইছে। আইলে কইবি খাঁড়ায় থাকতে। আগে আমি তো খাইয়া লই!’
একটা হাসির হিল্লোল তুলে অন্য লোকগুলো বিদায় নিলো। হয়ত আশেপাশেই অবস্থান নিলো। একবারে তো চলে যাওয়ার কথা না!
কনস্টেবল শরফুদ্দিনের নাম শুনেই সুফিয়ার মাথায় হাজার বিদ্যুতের ভোল্ট চলে গেল। পুলিশস্টেশনে গিয়ে শরফুদ্দিনকে দেখার পর থেকেই তার বারবার মনে হচ্ছিল, এই লোকটা সুবিধার না। কেমন করে জানি তাকায়, কেমন জঘন্য ভাষায় কথা বলে! শরফুদ্দিনের ভাবসাব দেখে সুফিয়ার মনে হচ্ছিল, সে পুলিশকে খবরটা দিয়েছে দেখে শরফুদ্দিন কেমন জানি সেটাকে ভালোভাবে নেয়নি! এই সহজ ব্যাপারটা সুফিয়ার মতো একটা এলেবেলে গ্রামের মেয়ে বুঝতে পারল, আর ওসি সাহেব বুঝতে পারল না? সুফিয়ার দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন আর এসব ভেবে কী হবে? সবকিছুই তো শেষ হয়ে যাবে এই হয়ত আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই!
ছেলেটা এগিয়ে এসেছে খুব কাছে। সুফিয়া তার নিঃশ্বাসের গন্ধ পাচ্ছে। ওয়াক থু! গন্ধে বমি এসে যাচ্ছে তার! ছেলেটা মদ খায়! সুন্দর পোশাক পরা একটা ছেলে। অথচ কী বদখত স্বভাব!
‘কী গো মাইয়া! আমার তেজি মুরগি! দূরে দূরে সইরা থাইকা কি বাঁচতে পারবা? আইজ তুমারে এট্টু আদর সোহাগ কইরা দিই। জীবনে আর পাও কী না পাও…’
খুব কাছে থেকেই মিলিত হাসির আওয়াজ ভেসে এলো। সেই সঙ্গে অশ্লীল কিছু কথাবার্তা। ‘ওস্তাদ, মাল নতুন। একটু আস্তে কইরেন যা করোনের! খিক খিক খিক…’
‘এ্যাই চুপ থাক শালারা! খালি ডিস্টার্ব করোস কামের সময়! আসল কাম এই লড়কী কইরা দিলো, আর তরা বইসা বইসা দুদু খাইলি!’
ছেলেটা আরো কাছে এগিয়ে আসছে। এবারে তার হাতদুটোও ক্ষিপ্রগতিতে ওঠানামা করতে শুরু করেছে সুফিয়ার শরীরে। সুফিয়া তার হাতে শক্ত করে চেপে ধরে আছে সেফটিপিনটা। সুফিয়ার চোখের দৃষ্টি সরাসরি ছেলেটার চোখের দিকে। নিজেকে বাঁচাতে হয়ত পারবে না, কিন্তু এই শয়তানের কোনো ক্ষতি না করে সে নিজের এতটুকু ক্ষতি হতে দিবে না!
নিজেকে বাঁচানোর ক্ষীণ আশা থেকেই সে আচমকা একটু বুদ্ধি করল। ছেলেটার মনোযোগ একটু অন্যদিকে সরানোর ইচ্ছে নিয়ে বলল, ‘শরফুদ্দিন বইলা কার কথা কইতাছিলেন? পুলিশে চাকরি করে?’
ছেলেটা একটু যেন থামল। কৌতুকপূর্ণ চোখে তাকালো সুফিয়ার দিকে। চেহারাতে একটা বিস্ময়সূচক হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল, ‘বাব্বাহ তুমি তো মাইয়া আসলেই তেজি মুরগি! এইরকম অবস্থায়ও মাথা খ্যালতাছে! হাহা হা… নাহ তুমারে আর দশটা মাইয়ার মতো একইরকম ভাবে ট্রিট করোন যাইব না! তুমি হইলা গিয়া স্পেশাল জিনিস! তুমারে আলাদা মশলা দিয়া রান্ধতে হইব! খাঁড়াও, তুমারে আগে এই জায়গা থেইকা ভালা কুনো জায়গায় নিয়া যাওনের ব্যবস্থা করি। শাড়িকাপড়ও তো ময়লা হইয়া আছে! অবশ্য কাপড়চোপড়ের আর দরকার কী ওহন! হি হি হি… যাই হোক তাও তুমারে একটু আলাদা খাতির দেওন দরকার! খাঁড়াও আইতাছি…’
বলেই ছেলেটা সরে গেল সুফিয়ার কাছ থেকে। এক ঝলক মুক্ত বাতাসে আবার নাক টেনে শ্বাস নিলো সুফিয়া। আহ! কিছুটা সময় পাওয়া গেছে। একটু একটু করে আরেকটু সময় পেলে যদি কিছু হয়? কেউ কি ওকে বাঁচাতে আসবে না? ওসি জামান শিকদার? কেউ কি তাকে একটু খবর দেয়নি? জুলেখাবুরে তো এই নামটা বলেছিল সে! বুবু কি ভুলে গেছে নাকি মনে আছে? মনে থাকলে বুবু জান দিয়ে হলেও তাকে খবর দিবে এটা জানে সুফিয়া!
কেন যেন আরেকজন মানুষের কথাও মনে পড়ছে। কিন্তু সেই মানুষটার পক্ষে তো আর এখানে আসতে পারা সম্ভব না। কে তাকে খবর দিবে? আর দিলেই বা কী? তার নিজের জান নিয়েই টানাটানি! সে কীভাবে তাকে বাঁচাতে আসবে?
পুলিশের গাড়ি জুলেখাকে তাদের গাঁয়ে নামিয়ে দিয়েই দ্রুত আবার পুলিশস্টেশনে ফিরে গেল।
বাড়ির কাছাকাছি এসে জুলেখার পা আর চলতে চাইছে না। তাদের বাড়ির উঠান থেকে একটা হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে প্রচুর মানুষ এসে ভিড় করেছে সেখানে। তার সৎ মায়ের চিৎকার আর বিলাপ এতদূর থেকেই কানে ভেসে আসছে। জুলেখা ভয়ার্তচোখে বাবার দিকে তাকালো। নেয়ামত উল্লাহ নিজেও শক্ত সমর্থ মানুষ না। শক্ত মানুষ হলে নিজের চোখের সামনে তার ভালোমানুষ অসহায় মেয়েটার ওপরে তার স্ত্রীর এত অত্যাচার সে দেখেও না দেখার ভান করে পড়ে থাকত না। কীসের জানি একটা অজানা আতঙ্ক তাকে তার সঠিক কাজটা করতে দিত না কখনো।
কিন্তু আজ পুলিশ স্টেশনে জুলেখার আত্মবিশ্বাস আর সাহস দেখে নেয়ামত উল্লাহর মনের মধ্যে এক অন্যরকম সাহসের জোয়ার এসেছে। এরকম পরিস্থিতিতেও জুলেখা এত শক্ত থাকতে পারল কেমন করে? যে মেয়ে একটা চড় খেয়ে আরেক গাল বাড়িয়ে দেয়, সেই মেয়ে কেমন কনস্টেবলের সামনে নিজের জেদ বজায় রাখল!
নেয়ামত উল্লাহ জুলেখার হাতটা ধরে বলল ‘তুই আয় আমার লগে। একদম ভয় পাইবি না। তর বাপজান আছে। কেউ তরে কিছু কইতে পারব না!’
জুলেখা তার বাবার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা আশ্বাস পেল। মনে হলো, বাপজান যা বলছে তা ভুল বলছে না। আজ সত্যিই কেউ সত্যিই তার কিছু করতে পারবে না!
বাপ মেয়েকে একা একা আসতে দেখে হনুফা বেগম সাপের মতো হিসহিস করে উঠল, ‘আইছে! ঐ যে আইছে! আমার মাইয়াডারে কাগো হাতে জানি তুইলা দিয়া হারামজাদি মাগি শ্যাওড়া গাছের পেত্নি আইছে দ্যাখো! মাগি আমার মাইয়ারে বেইচা দিছে। ওর শাড়ির কোঁচড় খুঁইজা দ্যাখো! টাকার বাণ্ডিল খুঁইজা পাইবা…’
‘চুপ করো হনুফা! খবরদার আমার মাইয়ারে যদি আরেকটা খারাপ কথা কইছ তাইলে আইজ এই বাড়িত থেইকা আমি তুমারে খেদাই দিমু! মুখে যা না তাই কইবা আর সবাই দিনের পর দিন মুখ বুইজা সইব … কী ভাবছ তুমি? এ্যাঁ? জানো আমার মাইয়াডা আইজ সুফিয়ারে বাঁচনের লাইগা কী কী করছে? আন্ধা মাইয়ামানুষ! তুমার চক্ষে তো আল্লাহ্য় জন্ম পট্টি লাগাইয়া দিছে! তুমি কিছু দ্যাখবা ক্যামনে?’
স্বামীর মুখে এসব কথা শুনে হনুফা বেগম রা করতে ভুলে গেল কিছুক্ষণের জন্য। তারপর আচমকা হাত পা ছড়িয়ে গগনবিদারী চিৎকারে কান্নাকাটি জুড়ে দিলো।
যারা এতক্ষণ উঠানে দাঁড়িয়ে হনুফাকে নানারকম বুদ্ধি পরামর্শ দিচ্ছিল আর তার মুখের অকথা কুকথা শুনে হু হা করে সায় দিচ্ছিল, তারা এবারে একটু দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ল। থাকবে নাকি চলে যাবে, ঠিক যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না তারা!
তাদেরকে উদ্দেশ্য করে নেয়ামত উল্লাহ বলল, ‘আপনাগো ছেনেমা শ্যাষ হইছে? এইবার যার যার বাড়িত গিয়া ঘুম দ্যান!’
এই কথার পরে আর থাকা যায় না। যেতে যেতে কেউ কেউ মন্তব্য করল, ‘মাইয়ার শোকে জুলেখার বাপের মাথাডাও খারাপ হইয়া গ্যাছে!’ (ক্রমশ)
#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_পঁচিশ
ওসি জামান শিকদার তার জিপে উঠতে উঠতে রেজাকে বলল, ‘কে ফোন করেছে? কী বলেছে বলো দেখি!’
‘স্যার নাম পরিচয় দ্যায় নাই। খালি বলছে… আপনারা আব্দুল রফিক সাহেবের গুদামের দিকে যান। সব প্রশ্নের জবাব পাইবেন!’
‘আব্দুল রফিকের গুদাম? মানে কাপড়ের গুদাম?’
‘তা বলতে পারি না স্যার!’
‘কেন বলতে পারবা না? আব্দুল রফিক তো বারোয়ারি ব্যবসা করত না। কাপড়ের ব্যবসা করত বলেই জানি। সেখানে তো কাপড়ই থাকার কথা! আর কে না কে ফোন করল, তুমি নাম শুনবা না?’
‘স্যার সে বলল তার পরিচয় জানোনের চাইতে এখন আমাদের সেই গুদামে যাওয়াটা বেশি জরুরি। আর বেশি কথা বলতে পারি নাই স্যার। লাইনটা কাইটা দিছে এই কথার পরপরই।’
‘এক কাজ করো। তার নাম্বারটা সেভ করে রাখো। আর একবার ফোন দাও তো সেই নাম্বারে। দেখা যাক, আরেকটু কথা বলা যায় কী না!’
কনস্টেবল রেজা একটু যেন অনিচ্ছা নিয়েই সেই অচেনা নাম্বারে ফোন দিলো। নাম্বারটা বন্ধ দেখাচ্ছে। সে প্রথমবার কথা বলেই বুঝতে পেরেছে লোকটা তার নাম পরিচয় দিতে ইচ্ছুক না। ওসি সাহেব কেন যে শুধু শুধু এটার পেছনেই পড়ে আছেন কে জানে! তার চেয়ে বরং সুফিয়ার সন্ধানে দ্রুত যাওয়া দরকার। লোকটা সেই কথা বারবার বলে দিয়েছে। বলেছে, ‘দেরি করলে ক্ষতি হইয়া যাইতে পারে! পরে সবকিছুই পাওন যাইব, এই ক্ষতি পুরাইব না!’
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আব্দুল রফিকের গুদামটা কনস্টেবল রেজা ভালোমতোই চেনে। জামান শিকদারও খুনের তদন্ত শুরু করার পরে একবার মাত্র গিয়েছিল। চারপাশে অনেক গাছ গাছড়া আছে। জায়গাটা গ্রামের একটু নির্জন কোণেই। সুফিয়াকে কি এইখানেই রাখা হয়েছে? জামান শিকদার বলল, ‘কিন্তু রেজা আমরা কি একটু রিস্ক নিয়ে ফেলছি না?’
‘বুঝলাম না স্যার!’
‘সুফিয়াকে যদি এখানে রাখা হয়, তাহলে এখানে সশস্ত্র পাহারাদারও থাকতে পারে। যদিও পুলিশের দিকে গুলি ছোঁড়ার মতো সাহস পাবে না কেউ। নাটক সিনেমা হলে পেত। কিন্তু তারপরেও আরো কয়েকজনকে সঙ্গে আনা গেলে ভালো হতো!’
‘স্যার আপনি ফোন কইরা দ্যান। যারা স্টেশনে আছে, জিপ নিয়া চইলা আসুক।’
আরেকটা জিপ নিয়ে কয়েকজন পুলিশকে আসতে বলে ফোনটা রাখতে না রাখতেই একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল জামান শিকদারের। আব্দুল রফিকের গুদামের কাছাকাছি চলে এসেছে তারা। যদিও আশেপাশের অন্ধকারে সবকিছু ভালোমত ঠাহর হয় না, কিন্তু এই জিনিসটা চিনতে ভুল হলো না তার। গুদামের সামনে একটা পুলিশের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। আর সেই গাড়ির দরজা ধরে শরীরের অর্ধেকটা বাইরে আর অর্ধেকটা ভেতরে রেখে খুব কায়দামতো দাঁড়িয়ে আছে তারই একান্ত বিশ্বস্ত কনস্টেবল শরফুদ্দিন!
জামান শিকদার রেজাকে ইশারা করল, ‘সামনে তাকাও। দেখো আমাদের একজন স্বজাতি আমাদের কত আগেই পৌঁছে গেছে! তুমি আর আমি লেট লতিফই হয়ে থাকলাম রেজা!’
রেজা সামনে তাকিয়ে চোখ পিট পিট করে বলল, ‘স্যার! দ্যাখছেন কাণ্ড! শরফুদ্দিন ভাই আগেই আইসা হাজির!’
‘হুম তাই তো বলছি! কী মনে হয় তোমার সে কি সব ক্রেডিট একা একাই নিয়ে যেতে চলে এসেছে নাকি তার মতলব ভিন্ন কিছু?’
‘শেষেরটাই তো মনে হইতাছে স্যার!’
জামান শিকদার জিপটাকে অন্ধকারে আড়াল করতে বলে গাড়িতে বসে বসে সামনের দিকে চোখ লাগিয়ে রাখে। পুলিশের অন্য গাড়িটা চলে এলেই তারা নেমে পড়বে। রেজাকে একটু উশখুশ করতে দেখে জামান শিকদার জিজ্ঞেস করে, ‘কী ব্যাপার রেজা? তুমি এমন অস্থির হয়ে আছ কেন?’
‘স্যার মাইয়াটার জন্য ভয় করতাছে। ওর কোনো ক্ষতি না হয়!’
‘তোমার চেয়ে আমার টেনশন কিছু কম না রেজা। সুফিয়া মেয়েটাকে আমি খুব স্নেহ করি। খুব সাহসী একটা মেয়ে। এমন মেয়ে হরহামেশা দেখা যায় না। আমাদের ছোটবেলায় ক্লাস ফাইভে একটা গল্প ছিল, নাম ‘বুদ্ধিমতী’। সেখানে গ্রামের একটা কিশোরীর গল্প বলা হয়েছিল। শহর থেকে আসা একটা দলকে মেয়েটি কীভাবে তার বুদ্ধিমত্তার জাদু দেখিয়ে তাক লাগিয়ে ফেলে, সেটি নিয়েই গল্প। আমরা ছোটবেলায় খুব আনন্দ নিয়ে গল্পটি পড়েছিলাম।
সুফিয়ার বুদ্ধিমত্তাও সেই কিশোরীর চাইতে কোনো অংশে কম না। বরং বেশি। আর যে সাহসের সে পরিচয় দিয়েছে, তা রীতিমত অবিশ্বাস্য। এই মেয়ের কোনোরকম ক্ষতি হলে আমি কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। তুমি মনে মনে কুড়ি পর্যন্ত গোনো। এর মধ্যেই আমাদের অন্য গাড়িটা চলে আসবে।’ রেজার মনটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যই জামান শিকদার তার কথাকে লম্বা করে।
রেজা সত্যি সত্যি চোখ বন্ধ করে ওসি স্যারের কথামত গুনতে শুরু করে। বুকের ভেতরে অদ্ভুত একটা টেনশন হচ্ছে। তারা এখানে চুপচাপ অপেক্ষা করছে, আর ওদিকে না জানি একটা বাচ্চা মেয়ের ওপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে! পুলিশের চাকরি করতে এসে দেখতে হয় মাঝে মাঝে, পুরুষ মাঝে মাঝে নারীর প্রতি কত পৈশাচিক আচরণ করে! একটা বাচ্চা মেয়ে থেকে শুরু করে বৃদ্ধা পর্যন্ত কেউ এদের হাত থেকে রেহাই পায় না।
রেজার চাকরির অভিজ্ঞতা বেশিদিনের না। মনটা এখনো নরম। এই চাকরিতে যেসব ব্যাপারস্যাপার সে নিয়মিত দেখছে, হয়ত বেশিদিন চাকরিটা করতে পারবে না। মাঝে মাঝেই ভাবে, ঢাকায় গিয়ে অন্যকিছু করা যায় কী না চেষ্টা করে দেখবে। কিন্তু এই কাজটা সাহস করে করা মুশকিল। কথায় আছে, ‘হাতের লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলতে নেই।’ রেডিমেড একটা চাকরি হুট করে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাবে কেউই সম্মতি দিবে না।
সত্যি সত্যিই কুড়ি গোণার আগেই পুলিশের আরেকটা গাড়ি এসে হাজির হয়। জামান শিকদার তার ড্রাইভার মোতালেবকে বলে, ‘সামনে আগাও। একেবারে সোজা গুদামঘরের দরজার কাছে গিয়ে গাড়ি থামাবে!’
মোতালেব এই এ্যাডভেঞ্চারে উত্তেজিত। সে অত্যুৎসাহে বলল, ‘স্যার, দরজার ভিতর দিয়া গুদামের ভেতরে গাড়ি সান্ধাইয়া দেই?’
‘না ঠিক আছে। অত দরকার নাই। তাছাড়া শরফুদ্দিন স্যারের সঙ্গে একটু দেখা করবা না? আমরা ভেতরে ঢুকে গেলেই সে একটু পরে এসে পুরো অভিযানের ক্রেডিটটা নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিবে!’
কথামত মোতালেব এক টানে জিপ এনে দাঁড় করায় আব্দুল রফিকের গুদামের সামনে।
সাঁই করে দরজা খুলে নেমে আসে জামান শিকদার ও কনস্টেবল রেজা। শরফুদ্দিন তখন একটু পরের ঝাল ঝাল তেজি মুরগির মাংস খাওয়ার আশায় মশগুল হয়ে আছে। আচমকা ওসি স্যারের গাড়িকে সামনে আসতে দেখে সে একেবারে ভূত দেখার মতো চমকে যায়। তৎক্ষণাৎ টান টান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা স্যালুট ঠুকে বলে, ‘স্যার, আপনে ছুটি দিলেন কিন্তু বাড়িতে গেলাম না। খবর পাইলাম সুফিয়ারে নিয়া আইছে এইখানে। তাই দেরি না কইরা চইলা আইছি!’
জামান শিকদার পাথরের মতো মুখ করে শরফুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রেজাকে নির্দেশ দিলো, ‘একে হাতকড়া পরিয়ে গাড়ির সঙ্গে বেঁধে রাখো। সাবধান, কিছুতেই যেন ছুটতে না পারে! এ যদি ছুটে তো তোমার হাতেও হাতকড়া পরাব রেজা। কথাটা যেন মনে থাকে!’
শরফুদ্দিন কিছু বোঝার আগেই রেজা তার ওসি স্যারের নির্দেশ পালন করে ফেলে। শরফুদ্দিন ঘটনা কী ঘটছে বোঝামাত্রই হইচই শুরু করে দেয়, ‘স্যার, কাজটা কইলাম ঠিক করলেন না! নিজের ভালা যদি চান, তাইলে আমার হাতকড়া খুইলা দ্যান! আপনের চাকরি তো যাইবই, জান নিয়া টানাটানি পইড়া যাইব স্যার… ঐ শালা মাদারচোত রেজার বাচ্চা, আস্তে কইরা বান্ধ! ওসির লগে থাইকা খুব হিরোগিরি দ্যাখাইতাছোস তাই না? ইন্সপেক্টর সিনহাম! থু মারি তোগো সিনহামের মুখে! দুই পয়সার ওসি! কার লগে লাগতে আইছে হুঁশ পাইতাছে না!’
রেজা হাতকড়া বাঁধতে বাঁধতে বলল, ‘স্যার অখনো সময় আছে ওসি স্যারের পা ধইরা বইসা পড়েন। চাকরিটা বাঁচলেও বাঁচতে পারে! আইজকার পরে আর কোনো আশাই থাকব না স্যার!’
‘চুপ শালা মাদারচোত আমারে চাকরি বাঁচানের বুদ্ধি দ্যায়…’
ফোর্স নিয়ে গুদামে প্রবেশ করল জামান শিকদার। তার অনুমানই ঠিক হয়েছে। গুদামে উপস্থিত একজন মানুষও তাদেরকে ঠেকাতে এগিয়ে এলো না। জামান শিকদার তবু একটু ভয় জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করল। ফাঁকা গুলি ছুড়ল দুই তিনটা। তারপর ভারি গমগমে গলায় বলল, ‘খবরদার কেউ যদি সামনে এগিয়ে আসার চেষ্টা করে, তার লাশ ফেলে দিব একেবারে! তোদের ওস্তাদ কই? সামনে আসতে বল!’
ওদিকে সুফিয়ার বুদ্ধিতে তার ইজ্জতে হামলা করতে এগিয়ে আসা ছেলেটা কিছু সময়ের বিরতি দিয়েছে তাকে। সুফিয়ার সাহস দেখে তার মনে হয়েছে, মেয়েটাকে এই গুদামে রাখাটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু বাসায় নিয়ে গেলেও তো বিপদ! বাপ খ্যাঁচ খ্যাঁচ করবে। মা যেখানকার জিনিস সেখানে রেখে আসতে বলবে। বিয়েশাদী সময়মত না করার এই এক মুশকিল। চরিত্রটা ঠিক রাখা মুশকিল হয়ে যায়।
এতদিন যাদের সঙ্গে আপোষে এসব কাজ করেছে তারা সব মন্দ পাড়ার মেয়ে। নিজেরাই আগ বাড়িয়ে ছেনালি করে। কিন্তু আজকের মেয়েটা তাদের মধ্যে অন্যরকম। যদিও এই মেয়ের ওপরে শুরুতে খুব রাগ হয়েছিল। মনে হয়েছিল দেখামাত্রই নোংরা করে ছুঁড়ে ফেলে দিবে। তারপর কত পুলিশের কাছে যাইতে মন চায় যাক! কিন্তু মেয়েটার সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলেই মনে হচ্ছে এর এরকম অনাদর করাটা উচিত হচ্ছে না।
ফোন করে সুফিয়ার জন্য ভালো শাড়ি কাপড় আনা হচ্ছে। সুফিয়ার কাছাকাছিই বসে আছে সে। টেলিফোনে কাকে যেন নির্দেশ দিয়ে বলছে, ‘বাজারের বেস্ট শাড়িটা লাগব আমার! হ বেস্ট জিনিসের গায়ে বেস্ট কাপড়। সেন্ট ফেন্ট আছে নাকি তুমার দোকানে? না থাকলে আশেপাশের দোকানে খোঁজ করো মিয়া। চাই চাই আইজই চাই!
আচমকা জামান শিকদারের গমগমে আওয়াজ কানে আসতেই ফোন ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল সে। হারামজাদা ওসি! এই জায়গার খোঁজ পেল কেমন করে? পকেট থেকে নিজের পিস্তলটা বের করে সে। লাইসেন্স আছে এটার। বেশি তেড়িবেড়ি করলে একেবারে সোজা ঠুকে দিবে! লোড করা আছে!
ওদিকে ওসির গলার আওয়াজ কানে আসতেই খুশিতে মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সুফিয়ার। এতক্ষণ সে সব আশাভরসা ছেড়ে দিয়ে বসেছিল। অসভ্য ইতর ছেলেটা তাকে তারিয়ে তারিয়ে দেখছে। মুখ দিয়ে বাজে সব ভঙ্গি করছে। সুফিয়া ধরেই নিয়েছে, এই জীবন যদি টিকেও যায়, কাউকেই এই মুখ আর দেখাতে পারবে না সে। জুলেখাবু, বাবা, মা… সবার কথা মনে পড়ছিল। এই মানুষগুলোর সামনে কি আর কোনোদিন সে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে? জুলেখাবু কত আগলে রেখেছে তাকে সবসময়! সেই বু যখন জানবে…
ভাবতে ভাবতেই আওয়াজটা কানে আসে। পর পর কয়েকবার গুলির আওয়াজ। এসেছে! ওসি সাব এসেছে! তাকে বাঁচাতে চলে এসেছে! এই বাজে ছেলেটার হাত থেকে ঠিক তাকে বাঁচিয়ে ফেলবে ওসি সাব! আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতায় চোখ বুজে আসে সুফিয়ার।
ততক্ষণে ছেলেটা ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিশানা তাক করছে। সুফিয়ার দিকে তাকিয়ে কটমট করে বলল, ‘এ্যাই মাইয়া খবরদার যদি এদিক সেদিক দৌড় দিছ, এক্কেরে গুলি কইরা দিমু বুঝবার পারছ? যেইখানে আছ সেইখানেই বইসা থাকো! এট্টুও নড়বা না কইলাম!’
সুফিয়া কিছু বলল না। মনে মনে বলল, ‘হ আমি বইসাই আছি। আপনে খাড়াইয়া থাকেন অখন! দেখি আপনের পায়ে কেমুন জোর!’
ছেলেটা একটা বড় থামের আড়ালে গিয়ে লুকালো। জামান শিকদারের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ‘দেখো, তুমি বা তোমরা যারাই হও এভাবে লুকোচুরি খেলে লাভ হবে না কিছুই। পুলিশ তোমাদের গুদাম ঘিরে ফেলেছে। পালানোর রাস্তা নাই। শুধু শুধু গোলাগুলি করলে সময়ই নষ্ট হবে! বের হয়ে আসো! মেয়েটিকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছ, আমাদের হাতে সোপর্দ করে দাও। খবরদার ওর কোনোরকম ক্ষতি করার চেষ্টা করলে এই গুদাম একেবারে উড়িয়ে দিব!’
ততক্ষণে শরফুদ্দিনের হাতে হাতকড়া পরিয়ে হাতকড়ার এক প্রান্ত গাড়ির হাতলের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হয়েছে। রেজা সেই কাজ শেষ করে জামান শিকদারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার ভীষণ একটা থ্রিলিং ফিল হচ্ছে। একেবারে সিনেমাতে যেমন গুণ্ডাদের আস্তানাতে গিয়ে নায়ক গোলাগুলি করে নায়িকাকে উদ্ধার করে এটাও অনেকটা সেইরকম ব্যাপার।
শুধু সমস্যা হচ্ছে প্রতিপক্ষ একটু বেশি ম্যান্দামারা। তারা গোলাগুলি করার হ্যাপাতে যাচ্ছে না। আর সুফিয়া মেয়েটাকেও জামান শিকদারের নায়িকা বলার কোনো সুযোগ নাই। নেহায়েত বাচ্চা একটা মেয়ে। স্যারও তাকে বিশেষ স্নেহ করেন!
কনস্টেবল রেজার এসব ফ্যান্টাসি ভাবনার মাঝেই হঠাৎ গুম করে গর্জে উঠল পিস্তল। রেজা চকিতে জামান শিকদারের দিকে তাকায়। না এটা তার পিস্তলের আওয়াজ না, এসেছে সামনে থেকে। ফাঁকা আওয়াজ, কিন্তু সতর্কতার জন্য এর বেশি আওয়াজের দরকার পড়ে না।
জামান শিকদার আর রেজা গুদামের দুই প্রান্তে অবস্থান নিলো। জামান শিকদার বলল, ‘এসব করে লাভ হবে না। আমি আমার ফোর্সকে ভেতরে ঢুকতে বললেই কিন্তু বের হয়ে আসতে হবে। খামাখা সময় নষ্ট করা ঠিক হচ্ছে কি?’
এবারে ছেলেটা কথা বলল, ‘ওসি, তোমার দলবল নিয়া চইলা যাও। আমার কথা না শুনলে কিন্তু ভালা কিছু হইব না। শুধু শুধু এই মাইয়াটার বেঘোরে জানটা যাইব! আমি কিছুতেই ধরা দিমু না। তুমি খবরদার আর এক পা আগাইবা না!’
গলাটা চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু এখন সেটা নিয়ে ভাবার সময় নাই। জামান শিকদারের ভ্রু কুঁচকে গেল। এ কী জ্বালাতন! এখন এই একজনকে ধরতেই কি গোলাগুলি করতে হবে নাকি? নাটের গুরু তো একটাকেই মনে হচ্ছে। জামান শিকদার রেজাকে নিজের কাছে ডেকে আস্তে আস্তে বলল, ‘তুমি একটু বুদ্ধি করে পেছনে কোনো রাস্তা আছে নাকি দেখতে পারবে?’
‘স্যার দেখতে যাইতে পারি। কিন্তু আপনে তো তাইলে এইখানে একা হইয়া যাইবেন!’
‘আমি সামলাতে পারব। চিন্তা করো না!’
‘স্যার গুদামে কিন্তু জনা সাতেক লোক আছে। হঠাৎ কইরা এরা আক্রমণ কইরা বসলে…’
‘পুলিশকে কিছু করতে পারবে না, ভয় পেয়ো না অযথা!’
‘এ্যাদের মতিগতি উলটাইয়া যাইতে সময় লাগব না স্যার। আর শরফুদ্দিন ভাই ঐখান থেইকা কী কলকাঠি নাড়ব কে জানে! মানুষের মাথায় শয়তানি বুদ্ধি থাকলে শয়তানে কখন কী লাড়াচাড়া দেয় কে কইতে পারে স্যার!’
‘হুম… কথা তো এমনিতে ভুল বলোনি… আরে! ঐটা কীসের আওয়াজ হলো?’ আচমকা একটা ধরপাকড়ের আওয়াজ শোনা যেতে লাগল ঠিক তাদের সামনে থেকে… যেখান থেকে একটু আগে ঐ কণ্ঠস্বরটা ভেসে আসছিল!
জামান শিকদার তার কনস্টেবলকে বলল, ‘এখন আর অপেক্ষা করার সুযোগ নাই রেজা! ওপাশে যে আছে সে কারো সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে। চলো দ্রুত আগানো যাক!’ (ক্রমশ)
#ফাহ্মিদা_বারী