কনে_দেখা_আলো পর্ব-২০+২১

0
204

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_কুড়ি

‘কই?’ এইবারে কিন্তু মুজিবরের সহকারী লোকটা ধমক দিলো না। কারণ চোখ দুটো পিট পিট করে সেও তখন সুফিয়া আর তার বোনকে চিনে ফেলেছে। না চেনার কারণই নেই!

আজ যখন থেকে সে এই কাজের জন্য নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছে, তখন থেকেই সুফিয়ার বাড়ির সঙ্গেই সে একরকম সেঁটে আছে। এই মেয়ে বাড়িতে এসেছে ম্যালা বেলা করে। পুলিশের গাড়ি তাকে তার বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূরে নামিয়ে দিয়ে গেছে। একেবারে ভিআইপি ব্যবস্থা। নামিয়ে দিয়েই গাড়ি হাঁকিয়ে ওসি চলে গেছে। তখনই আরাম করে সে তার কাজ করে ফেলতে পারত। খামাখা এত বেলা অব্দি বসে থাকার কোনো দরকারই ছিল না। কিন্তু দিনের বেলা কাজ করার হুকুম ছিল না। আর তাছাড়া একাও কাজ করার ব্যাপারে নিষেধ করা আছে। তাকে বটগাছের নিচের বাঁশের বেঞ্চিতে বসে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। সেটাই সে করছিল। যথাসময়েই এই বান্দা হাজির হয়েছে।

‘হ! আপনে তো ঠিকই কইছেন এইবার! এইডা তো ঐ মাইয়াই! লগে এইডা তার বইন! দুইজনে কই গেছিল?’
মুজিবরের গলা চুলকাতে লাগল। ফস করে বলে দিতে ইচ্ছে করছিল, ‘আমার শ্বশুরবাড়িতেই গেছিল! এতক্ষণ আমি এগো লগে গপসপ করতাছিলাম!’ কিন্তু এইবারেও সে নিজেকে বহুকষ্টে সম্বরণ করে ফেলল।

‘লন কাজে নাইমা পড়ি। আবার কইতাছি বেশি কাম করবার যাইবেন না! আপনে গিয়া মাইয়ার হাত দুইডা পিছমোড়া কইরা চাইপা ধরবেন। আমি তার নাকের কাছে রুমাল ধরুম। ব্যস! আর কিচ্ছু করোন লাগব না! বহুত তেজি মাইয়া। হাত দুইটা বাইন্ধা না লইলে ফসকাইয়া যাইতে পারে! আপনের মুখচোখ বান্ধছেন তো ঠিকমত? হ ঠিক আছে। আপনেরে জানি কেউ চিনবার না পারে।’
মুজিবর যেতে যেতেই বলল, ‘আর মাইয়াডার বইন? ও যদি চিৎকার মারে?’
‘মারলে মারব! এই শুনশান জায়গায় ওর চিৎকার শুইনা কেউ আইব না! আচ্ছা… ঠিক আছে। কইতাছেন যখন! মাইডারে অজ্ঞান কইরা ওর বইনের একটা ব্যবস্থা করোন যায় কী না দেখন লাগব!’

দুজনের কাছাকাছি চলে আসতেই মুজিবরের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। এমনিতে যতই মুখে মুখে হাতিঘোড়া মারুক না কেন, সাহস করে সে একটা তেলাপোকাও মারতে পারে না। তবে শয়তানি বুদ্ধিতে তার জুড়ি মেলা ভার।
এদিকে হঠাৎ সোজাসুজি দুজন মানুষকে নিজেদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে জুলেখার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে। সুফিয়াকে হাতের কনুই দিয়ে একটা গুঁতা মারতে যাবে ঠিক এমন সময় প্রায় চিতাবাঘের গতিতে মুজিবরের সঙ্গের লোকটা সুফিয়ার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুজিবর পৌঁছানোর আগেই সে সুফিয়ার নাকের কাছে ক্লোরোফর্ম মাখানো রুমাল স্পর্শ করিয়ে দেয়। প্রায় সাথে সাথেই অচেতন হয়ে পড়ে সুফিয়া। লোকটা এক মুহূর্ত দেরি না করে সুফিয়ার হাল্কা পাতলা অচেতন শরীরটাকে দুই হাত দিয়ে নিজের ঘাড়ের ওপরে উঠিয়ে ফেলে।

কয়েকটা মুহূর্তেই এত সব ঘটনা ঘটে যায়। জুলেখা একটা চিৎকার করারও সময় পায় না। এদিকে মুজিবরও তার সঙ্গীর ক্ষিপ্রতায় বাকরুদ্ধ। বাক ফিরে পেতেই সে দেখে জুলেখা চিৎকার দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঠিক তখনই সে এক মুহূর্তও আর অপেক্ষা না করে নিজের সামান্য ভূমিকাটুকু পালন করে ফেলে। চট করে এগিয়ে গিয়ে জুলেখার মুখে হাত চাপা দেয়। তারপর ধীরে সুস্থে একখণ্ড রশি দিয়ে জুলেখার হাত বেঁধে ফেলার চেষ্টা করে।

সুফিয়াকে নিয়ে লোকটা তখন বেশ কিছুটা দূরে চলে গিয়েছিল। পেছন ফিরে মুজিবরের কায়দা কসরত দেখে সে মহা বিরক্ত হয়। হাতে ধরে রাখা ক্লোরোফর্মের রুমালটা দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারে মুজিবরের দিকে। এদিকে জুলেখার হাত বাঁধতে গিয়ে সে তুমুল বাঁধার মুখোমুখি হয়। এক পর্যায়ে বুঝতে পারে, কাজটা তার দ্বারা করা সম্ভব নয়। নিজের বোনকে এভাবে ভয়ানক বিপদে পড়তে দেখে জুলেখার শরীরে যেন অসুর এসে ভর করেছে। সে তার সর্বশক্তি দিয়ে মুজিবরের মোকাবেলা করে চলেছিল।

সঙ্গীর ছুঁড়ে দেওয়া রুমালটা পেয়ে মুজিবর হঠাৎ যেন দিশা খুঁজে পায়। দেই দলা পাকানো রুমালটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে সে মেলে ধরে জুলেখার নাক বরাবর।
এদিকে বিকেল থেকেই আবহাওয়াটা ছিল একটু কেমন জানি গুমোট। ফুলিদের বাসা থেকে ওরা দুই বোন যখন বের হয়েছে, আকাশ তখন ঘন কালো হয়ে বৃষ্টি ঝরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। জুলেখা অচেতন হয়ে ওঠার আগ মুহূর্তে আকাশে হঠাৎ বুঝি একটু বিদ্যুৎ খেলে যায়। সেই হাল্কা বিদ্যুৎ শিখায় হঠাৎ আগত এই দস্যুদের হাত থেকে বাঁচতে মরিয়া জুলেখার চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে একটা পরিচিত দৃশ্য। তাকে আক্রমণকারী লোকটার দুই পায়ে দুই রঙের মোজা! একটা কালো আর একটা লাল চকরাবকরা!

কোথায় যেন দেখেছে দৃশ্যটা? ভাবতে ভাবতেই নিয়তির হাতে নিজেকে ছেড়ে দেয় জুলেখা। নিয়তিও শেষ মুহূর্তে তাকে মনে করিয়ে দেয় দৃশ্যটা সে কোথায় দেখেছে! একটু আগে ফুলির জামাইয়ের অদ্ভুত সাজপোশাক দেখে মনে মনে হাসি চাপাচ্ছিল সে। কিন্তু সেই দৃশ্য এখানে কেন? কী আশ্চর্য!

জুলেখা অচেতন হয়ে পড়তেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে মুজিবর। বাপরে! গ্রামের একটা মেয়ের শরীরে এত জোর! কোথায় পায় এত জোর?
সামনে থেকে সুফিয়াকে বহনকারী লোকটা হাঁক ছাড়ে, ‘কী জ্ঞান হারাইছে নাকি অখনো চাইয়া আছে আপনের দিকে? একটা মাইয়া মাইনষেরে শায়েস্তা করতে এত সময় লাগে, আচ্ছা পুরুষ মানুষ আপনে! এইবার হ্যারে ছাইড়া জলদি জলদি চইলা আসেন। অনেকটা পথ যাওন লাগব। পথের মধ্যে মানুষজন পিছে লাগলে কিন্তু দৌড় মারোন লাগব! পারবেন দৌড়াইতে?’

মুজিবেরের বুকে চাপ দিচ্ছিল অনেকক্ষণ থেকেই। একটু আগেই সে শ্বশুরবাড়িতে ভুরিভোজ করে এসেছে। এখন যদি এই ভরা পেট নিয়ে দৌড় দিতে হয় তাহলে তো সে দম আটকে মরেই পড়ে থাকবে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, ‘ও ভাই, একটা ভ্যানগাড়ির ব্যবস্থা করোন যায় না?’
‘হ যায়! তারপর সেই ভ্যানআলা আপনেরে খাতির কইরা পুলিশের কাছে ধরাইয়া দিয়া আইব। কন রাজি?’
‘কিন্তু এতখানি পথ এই মাইয়াডারে এমুন কইরা নিয়া যাইতে পারবেন? আপনে নিজেই তো কাহিল হইয়া যাইবেন!’

‘আমার চিন্তা ছাইড়া দেন। আপনের মতো আরাম আয়েশে দিন কাটানের কপাল লইয়া তো আসি নাই! অখন কথা বাদ দিয়া জলদি জলদি পা চালান! নইলে কইলাম বিপদ আইতে সময় লাগব না! তাছাড়া ঝড়বৃষ্টিও আইতাছে।’ কথাটা বলেই লোকটা প্রায় দৌড়াতে শুরু করল। এত বড় একটা বোঝা যে সে কাঁধে নিয়ে চলছে, এটা তাকে দেখে এখন আর বোঝারই উপায় নাই! তার পিছে পিছে তাল রাখতে গিয়ে মুজিবর তৃষ্ণার্ত কুকুরের মতো হাঁপাতে লাগল। মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা বুঝি ছিটকেই চলে আসবে বাইরে।

ওদিকে সন্ধ্যা হয়েছে সেই কখন, অথচ জুলেখা আর সুফিয়া এখনো বাসায় আসছে না দেখে হনুফা বেগমের এতক্ষণে টনক নড়েছে। জুলেখা না ফেরে না ফিরুক, পোড়ারমুখী বিলের কাছের বটগাছটার সাথে দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ুক! পোড়ারমুখী পাতিলের কালির জন্য তার চাঁদবরণী মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে না! কবে যে ঐটারে বিদায় করতে পারবে!
দুপুরের পর থেকেই প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। সন্ধ্যার পর থেকে মেঘ করে বৃষ্টি নেমেছে। এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও মেয়েটা এখনো ফিরল না দেখে হনুফা বেগম একটু অস্থিরই হয়ে পড়ল। কিন্তু এই রাতের বেলা বৃষ্টির মধ্যে সে একা মেয়েমানুষ কোথায় গিয়ে খোঁজ খবর করবে? আচ্ছা বিপদে পড়া গেল তো!

ভাগ্য ভালো একটু পরেই সুফিয়া জুলেখার বাবা নেয়ামত উল্লাহ ভিজতে ভিজতে বাড়িতে এলো। বাড়ির উঠানে পা দিয়েই সে চেঁচিয়ে ডাকাডাকি জুড়ে দিলো, ‘জুলেখা… ও মা জুলেখা… আমার হাতের জিনিসগুলান একটু ধর দেখি মা। এট্টু চাউল ডাউল আনছিলাম, বেবাক সদাইপাতি বৃষ্টিতে ভিইজা গ্যালো! যেমুন গরমডা পড়ছিল, তেমুনই বৃষ্টি নামছে! জুলেখা, ও মা আইলি না অখনো?’

বউকে কখনো এভাবে ডাকাডাকি করে না নেয়ামত উল্লাহ। তার বদমেজাজি বউ কখন কোন কথায় কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, বলা মুশকিল। সুফিয়ার মেজাজ মর্জিরও ঠিকঠিকানা নাই। এই ঝড় তো এই মেঘ! আর সে নিজেই তো একটা দমকা বাতাস। কখন বাড়িতে থাকে কক্ষন থাকে না কেউ তার খবর জানে না! মেয়েটাকে নিয়ে মাঝে মাঝে খুব চিন্তা হয় নেয়ামত উল্লাহর।

চিন্তার কথাটা সে কারো কাছে বলে না। মুখে না বললেও সুফিয়ার ডানপিটে স্বভাবটাকে তার খুব ভয় লাগে। এমন মেয়েরা পদে পদে বিপদে পড়ে। সমাজ এদেরকে সোজা চোখে দেখে না। এটা সেটা ঘটনা ঘটিয়ে এরা এদের জীবনের পথটাকে নিজেরাই জটিল করে তোলে।
বাড়িতে শুধু জুলেখার সঙ্গেই নেয়ামত উল্লাহ দুই দণ্ড কথা বলে আরাম পায়। তার শ্যামলছায়ার মতো নরমশরম মেয়েটা যেন তীব্র দাবদাহ শেষে এক পশলা বৃষ্টি। সৎ মায়ের সংসারে মেয়েটা এক কণাও শান্তি পায় না, তবু মুখের হাসি কখনো তার ফুরায় না!

‘কারে ডাকতাছেন? আপনের আদরের দুলালী আইজ অহনতুরী বাড়িত আসেনি। দুপুরে এট্টু বাইরে থেইকা আইসা দেখি ঘরদোর খুইলা রাইখা আপনের আদরের কন্যা পাড়া বেড়াইতে গ্যাছে। গ্যাছে ভালা কথা! গ্যাছে তো গ্যাছেই! ফেরার আর নামগন্ধ নাই!’
‘জুলেখা ওহনতরি বাড়িত আসে নাই? কী কও? এমুন তো জুলেখা কখনোই করে না! সুফিয়া আছে নাকি বাড়িত?’
‘নাহ! সুফিয়ারে মনে হয় ফুসলাইয়া ফাসলাইয়া আপনের বড় মাইয়া লগে নিয়া গ্যাছে। আমার মাইয়াডা তো বোকার হদ্দ। যে যেমুন কইরা চালায় সেও আগপাশ ভাবনা চিন্তা না কইরা সেই রাস্তাতেই চলে!’

নেয়ামত উল্লাহ কিছু বলল না। সব কথার জবাব দিতে নাই। কিন্তু মেয়েদুটো এই ঝড় বাদলের রাতে এখনো বাড়ির বাইরে আছে, এই কথা শুনে তার ভালো লাগল না। মনের মধ্যে কীসের যেন কুডাক ডাকতে লাগল। হনুফা বেগমের মনে তো সবসময় মন্দ ভাবনা ঘোরে! মাতৃত্বের স্বাভাবিক অনুভূতিটুকুও তার কাজ করে না সবসময়। যদি করত তাহলে সে বুঝতে পারত মেয়েদের এত রাতে বাড়ি না ফেরাটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়!

সদাইপাতিগুলো নিজেই বারান্দার চৌকিতে রেখে দিয়ে নেয়ামত উল্লাহ ছাতাটা নিয়ে আবার বাইরে যেতে উদ্যত হলো। স্বামী যে তাকে ঘরসংসারের কাজকর্মের ব্যাপারে কিছুই বলে টলে না, এটা হনুফা বিবি ঠিকই বুঝতে পারে। সব কাজের জন্যই মেয়েকে খোঁজে কিন্তু বউকে না। হনুফার বুকের ভেতরটা দিনরাত জ্বলতে থাকে। এই সংসারের সবার প্রতিই তার অজস্র ক্ষোভ জমে আছে। মনে হয়, সবাই মিলেই যেন তার জীবনটাকে নরক বানিয়ে ছেড়েছে। এখন তার মেয়েটাকেও কেউ ভালো একটা জীবন উপভোগ করতে দিবে না। এত সুন্দর দেখতে তার মেয়েটা! ওর তো রাজরানী হওয়ার কপাল ছিল! কিন্তু এই লোকের পাল্লায় পড়ে ঠিকই তার মেয়েটারও জীবন ধ্যাদ্ধেরে গোবিন্দপুর হয়ে যাবে! এ্যাহ বড় মেয়ের বিয়ে না দিয়ে ছোট মেয়েকে বিয়ে দিবে না! বড় মেয়ের ঐ বদন দেখেই তো লোকে পালায়! তার আবার বিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে!
নেয়ামত উল্লাহকে আবার বেরুতে দেখে পেছন থেকে হনুফা বেগম বলে ওঠে, ‘কী হইছে আবার কই যাইতাছ?’
‘মাইয়া দুইটা কই গ্যালো এট্টু দ্যাখতে হইব না?’

নেয়ামত উল্লাহ বাড়ির বাইরে পা দিতে পারল না, তার আগেই পাড়ার এক ছেলে এসে খবর দিলো, জুলেখা বিলের মাঠটার পাশে অচেতন হয়ে পড়ে ছিল। কে একজন দেখতে পেয়ে তাকে উঠে বসিয়েছে। হুঁশ ফিরতেই সে প্রথমেই যে কথা বলেছে তা হলো, ‘সুফিয়ারে উঠাইয়া নিয়া গ্যাছে! ওরে কেউ বাঁচাও! আমার বোনটারে বাঁচাও!’
এই কথা শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছাতা ফেলেই নেয়ামত উল্লাহ ছুট লাগাল। পেছনে হনুফা বেগম তখনো যেন কথাটা ঠিকমতো আত্মস্থ করে উঠতে পারেনি।
ভালোমত বোঝার পরে সে হাত পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে পড়ে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে চেঁচাতে শুরু করল, ‘ওহ আল্লাহ! এইডা আমি কী শুনলাম গো আল্লাহ! হায় আল্লাহ! তুমি আমারে এই খবর শোনানোর আগে ক্যান উঠাইয়া নিলা না? আমার সুফিয়ার কেডায় এমুন ক্ষতি করল আল্লাহ!’

বলতে বলতে হঠাৎ সে সোজা হয়ে বসে। তারপর কী যেন খেলে যায় তার মাথার মধ্যে। আচমকা সুর পরিবর্তন করে এবারে সে বলতে শুরু করে, ‘বুঝছি আমি বেবাক কিছু বুঝছি! এই সবই হইতাছে ঐ হারামজাদি জুলেখার কারসাজি। প্রত্থমে ফুসলাইয়া ফাসলাইয়া আমার মাইয়াডারে বাড়ির বাইর করছে তারপর কাউরে তার পিছে লাগাইয়া দিছে! হ এইবার বুঝছি আমি! ও আল্লাহ তুমি এইডার বিচার কইরো! ঐ হারামজাদি জানি আইজকা বাড়িত না আইবার পারে! আইজ ঐখানেই জানি ওর দুনিয়ার লীলাখেলা শ্যাষ হয়…!’
অবিরাম অভিশাপবর্ষণে বুঝি তখন প্রকৃতিও স্তব্ধ হয়ে থমথমে মুখে এই মাঝবয়সী কটুভাষিণী মহিলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। (ক্রমশ)

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_একুশ

‘ও মা, মারে কী হইছে? তুই এইভাবে পইড়া আছশ ক্যা? সুফিয়া কই রে মা?’
‘বাজান, বাজান গো… সর্বনাশ হইয়া গ্যাছে! এইডা কী হইল বাজান? আমি লগে থাইকাও কিছুই করবার পারলাম না! আমার চোখের সামনে দিয়াই সুফিয়ারে তুইলা নিয়া গ্যালো! আমি চাইয়া চাইয়া দ্যাখলাম খালি!’

বৃষ্টি যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি হঠাৎ করেই থেমে গেছে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ানক পরিস্থিতিতে মানুষের পাশাপাশি প্রকৃতিও যেন শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছে।
এই কদমপুর নোয়াহাটি সহ আশেপাশের গ্রামের মানুষদের জীবনে আগে কখনোই এমন ঘন ঘন বিপদ আপদ আসেনি। কিন্তু এখন প্রায়ই খুন, ধর্ষণ, অপহরণ… এসব ঘটনার কথা শোনা যায়। গ্রামে বুঝি সর্বনাশা কোনো প্রেতাত্মা এসে ভর করেছে!
এক কান দুই কান করতে করতে একসময় গ্রামের সবাই প্রায় জেনে গেল যে, জুলেখা আর সুফিয়াকে অচেতন করে দুজন লোক সুফিয়াকে তুলে নিয়ে গেছে আর জুলেখাকে ফেলে গেছে। মুহূর্তের মধ্যেই সেই বিলের পাশের জায়গাটা অনেক মানুষের কলরবে মুখরিত হয়ে উঠল। একেকজন একেকরকম কথা বলতে লাগল। সম্ভাব্যতা অসম্ভাব্যতাকে মিলিয়ে মিশিয়ে কল্পনাতেই সবাই যেন ঘটনার আদ্যোপান্ত বুঝে গেল!
দুই একজন বলল, ‘খারাপ কাজের লাইগা নিলে তো দুইজনরেই নেওনের কথা! জুলেখারে ফালাইয়া যাইব ক্যান?’
এর ব্যাখ্যাও কারো কারো কাছে প্রস্তুতই ছিল। ‘হয়ত জুলেখা কালা বইলাই তারে নেয়নি! সুফিয়ারে ধলা দেইখা নিয়া গ্যাছে!’
কেউ কেউ একটু অন্যরকম ব্যাখ্যাও দিলো। একটু আগেই তাদের অনেকে সুফিয়ার মায়ের শাপ শাপান্ত বিলাপ প্রলাপ শুনেই এদিকে এসেছে। তারা সেই কথার সুরে সুর মিলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল, ‘সৎ মায়ের অত্যাচারে জান পেরেশান হইয়া আছিল। বিয়াও হইতাছিল না ম্যালাদিন ধইরা। কে জানে, মাইনষের মন! হিংসা থেইকাই এই কাম করাইছে কী না কেডায় কইতে পারব?’

ভাগ্য ভালো, এই শেষোক্ত বক্তব্য দেওয়া মানুষগুলো সংখ্যায় খুব বেশি নয়। তাদের কথাকে অনেকেই ধর্তব্যের মধ্যেই গণ্য করল না। জূলেখা ওইরকম মেয়েই নয়। হনুফা বেগম যা বলে বলুক, জুলেখা নিজের জান দিয়ে হলেও বোনকে রক্ষা করতে চাইবে। হয়ত ঘটনা এসবের কোনোটাই না। সুফিয়ার যে ডানপিটে স্বভাব! অনেকেই তাকে ভেতরে ভেতরে সহ্য করতে পারে না। কে জানে কার কোন পাকা ধানের গোলায় ঐ মেয়ে আগুন দিয়েছে!

জুলেখা তখনো মাটিতে বসে আহাজারি করছিল। নেয়ামত উল্লাহও মেয়ের পাশে বসে বুক চাপড়াচ্ছে। দৃশ্যটা সহ্য করার মতো নয়। গ্রামের দুই একজন মুরুব্বি এবারে এগিয়ে এসে বলল, ‘নেয়ামত উল্লাহ, উঠো। এইভাবে বইয়া বইয়া কান্নাকাটি কইরা কিছু হইব না। মাইয়ারে খুঁইজা বাইর করোন লাগব। মা জুলেখা, তুমি কি কাউরে দ্যাখবার পারছ? চিনছ কাউরে? এই কাম কি আমাগো গেরামের কারো নাকি অন্য কেউ এইডার পিছে আছে?’
জুলেখার মনে বিদ্যুতঝলকের মতোই সবকিছু ঝিলিক দিয়ে উঠল। এই কাজ যে করেছে, সে তাকে চিনেছে। ঐ তো সামনেই ফুলির বাবা আফসার খালুজানও দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে তার জামাইয়ের নাম ভুলেও উচ্চারণ করা যাবে না। চরম বিপদের মাঝেও কে যেন জুলেখার কানে কানে এসে বুদ্ধি দিয়ে গেল, ‘যা করার ভাইবাচিন্তা করোন লাগব। এইখানে বেফাঁস কিছু কইলে ঝামেলা বাড়তে পারে!’
কাঁদতে কাঁদতে জুলেখা বলল, ‘আমি কাউরেই চিনি নাই। তারা মুখ বাইন্ধা আইছিল। চেনোন যায়নি!’
‘ওহ তাইলে তো পুলিশের কাছে যাওন ছাড়া উপায় নাই! নেয়ামত উল্লাহ খামাখা আর এইখানে বইসা কান্দাকাটি কইরা সময় নষ্ট কইরো না। একটা ভ্যান লইয়া পুলিশ ইস্টেশনের দিকে রওয়ানা দাও। শুনছি আমাগো নতুন ওসি সাব নাকি ভালামানুষ। তিনি কিছু করলেও করবার পারেন!’

পুলিশের কথায় নেয়ামত উল্লাহর মনে কোনো আশা জাগল না, কিন্তু জুলেখার মনে আবার বিদ্যুতের ঝটকা লাগল। সুফিয়া তাদের থানায় নতুন ওসি সাহেবের কথা বলছিল। খুব নাকি ভালো মানুষ। সুফিয়াকে তিনি চেনেনও ভালোমত। একবার সেখানে গেলে ক্ষতির তো কিছু নাই, লাভ হলেও হতে পারে।
জুলেখা চোখের পানি মুছে বাবাকে বলল, ‘বাজান লও, পুলিশ ইস্টেশনেই চলো। সন্ধ্যা হইয়া গ্যাছে। বেশি দেরি হইলে ওসি সাবের লগে দেখা করোন যাইব না। একটা ভ্যান লইতে হইব।’
‘পুলিশের কাছে যাবি মা? আমাগো তো কপাল পুড়ছেই! অখন দশজনে জানাজানি হইব হুদাই!’
‘বাজান, কী কইতাছ এইসব? তুমার কাছে সুফিয়া বড় হইল নাকি ঐ দশজন বড় হইল? সুফিয়ারে বাঁচাইতে হইব। না জানি কী বিপদের মধ্যে পড়ছে আমার বইন! আর তুমি লোক জানাজানির ভয় করতাছ বাজান!’ বলতে বলতে জুলেখা আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল।

গ্রামে সন্ধ্যা নামে ঝুপ করে। সন্ধ্যা নামা মানেই দিন ফুরিয়ে যাওয়া। রাতের আলাদা কোনো আয়োজন থাকে না গ্রামে। শহরের মতো এখানে স্ট্রিটলাইটের বাহারি সজ্জা নেই। দোকানপাট নানা পসরা সাজিয়ে আলোকিত হয়ে ওঠে না। রাস্তাঘাটেও লোক চলাচল থাকে না বললেই চলে। শুধু নিতান্তই ঠ্যাকায় পড়ে যাদের পথে নামতে হয়, তাদের কথা আলাদা। তাই এখানকার পুলিশস্টেশনগুলোতেও লোকজন কুচে বসা মুরগির মতো ঝিমাতে থাকে। কদাচিৎ কেউ নালিশ জানাতে গেলে তাদের চোখ ডলে ঝিমুনি কাটিয়ে কাজে নামতে হয়। বিরক্তির ছাপ ফুটে ওঠে মুখেচোখে।
তাই জুলেখার তাড়া খেয়ে হতাশা নিয়েই নেয়ামত উল্লাহ উঠে দাঁড়ায়। উৎসুক জনতা উপচে পড়ছে তাদের চারপাশে। ভ্যানের ব্যবস্থা হয়ে যায় সাথে সাথেই। বাপ মেয়ে যাত্রা শুরু করে অনিশ্চিতের পথে।

নিকষ কালো অন্ধকারে পথঘাট চেনা যায় না। ভ্যানওয়ালা অভ্যস্ত চেনা পথে তার বাহন হাঁকিয়ে চলে। একটা পাঁচ ব্যাটারির ছোট টর্চ হেডলাইটের মতো ভ্যানের সামনে তাক করে লাগানো আছে। সেটার আলোতেই সে এই নিকষ কালো আঁধারেই দিব্যি সরসরিয়ে পথ চলতে থাকে।
ভ্যানওয়ালা ভ্যান চালাতে চালাতে উশখুশ করতে থাকে। তার ঘটনার বিস্তারিত সবকিছু জানতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু ভ্যানে বসা দুজন মানুষের কারো মুখেই কথা নাই। থেকে থেকে জুলেখার দিক থেকে একটা হিঁচকি ওঠার মতো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তার মনে তখন ঝড় উঠেছে। সেই ঝড়ের তাণ্ডবে তার মনের ভেতরের সবকিছু চুরমার হয়ে যাচ্ছে।
গত দুইদিন ধরেই জুলেখা বায়না করছিল ফুলিকে দেখতে যাওয়ার জন্য। সুফিয়াই কী নিয়ে যেন ভীষণ ব্যস্ত ছিল। সময় দিতে পারছিল না। আজ যদিও সুফিয়াই নিজে থেকে ফুলিদের বাসায় ঘুরে আসতে চেয়েছে, কিন্তু সেটাও জুলেখার আবদার মেটাতেই। ফুলিদের বাড়িতে না গেলে হয়ত তার বোনটার আজ এই ভয়ানক বিপদ হতো না! সবকিছু জুলেখার দোষেই হলো!

আজ বিকেলের পর থেকে যা যা ঘটেছে, সেগুলো মনের মধ্যে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ঘটে যাচ্ছিল।
সুফিয়ার ভেতরে কীসের যেন একটা খৈ ফুটছিল কিছুদিন ধরে। জন্মের পর থেকেই একরকম তার হাতেই মানুষ, জুলেখা সুফিয়ার ভেতরটা স্বচ্ছ কাঁচের মতোই পড়তে পারত একসময়। যে কথা সুফিয়া বলত আর যে কথা গোপন রাখত, জুলেখা তার সবটুকুই পড়ে ফেলত গড়গড়িয়ে। সুফিয়া এই নিয়ে কতদিন অনুযোগ জানিয়ে বলেছে, ‘ও বু, তুমি ক্যামনে সবকিছু আগে থেইকা বুইঝা ফালাও?’
অথচ গত বেশ কিছুদিন ধরেই সে তার আদরের বোনটাকে একেবারেই যেন চিনতে পারছিল না। এই বোন যেন জুলেখার সেই চিরচেনা বোনই না! আজ বিকেলে ফুলিদের বাড়িতে যেতে যেতে সে বলেছিল, ‘বুবু, তুমারে বেবাক কথা খুইলা কমু। আমারে আর দুইটা দিন সময় দাও! তুমার বোনে কুনো খারাপ কিছু করতাছে না!’ কিন্তু কিছু বলারই তো সময় পেল না তার বোনটা! তার
আগেই তো কী থেকে কী হয়ে গেল…

এদিকে জুলেখার মনে বারবার ভেসে উঠছিল সেই দুই পায়ে দুই রঙের মোজার ছবি! দুজন লোকের একজন কি তাহলে ফুলির স্বামীই ছিল? জুলেখার মন ভুল হতেই পারে না। ফুলির স্বামী মুজিবরের চোখেমুখে সে যে ছাপ দেখেছে সেটা তাকে স্বস্তি পেতে দেয়নি। কেন জানি মনে হচ্ছিল, ফুলি সুখি হতে পারেনি। নিজের মাকে বাইরের দুজন মানুষের সামনে এভাবে বারবার হেনস্থা করা, স্বামীকে এটা সেটা তুলে দেওয়ার জন্য তাড়া লাগানো, সময়মত খাবার না দিতে পারার জন্য খোঁটা দেওয়া… এসব কিছুতেই একজন সুখি মেয়ের আচরণ হতে পারে না। যত স্বামীপাগলা মেয়েই হোক, মাকে এভাবে অপদস্থ করার মধ্য দিয়ে ফুলি যেন নিজের ভেতরের অসুখী ব্যক্তিটাকেই বারবার সামনে বের করে ফেলছিল।
জুলেখা গ্রামের মেয়ে হলেও মানুষের মনের এইসব ভাবগতিক ভালোই বুঝতে পারে। হয়ত দুঃখের সাথেই জীবন গড়ে নিয়েছে দেখে দুঃখ তাকে মানুষ চিনতে শিখিয়েছে।

‘বাজান, মায়ে শুনছে? সুফিয়ার কথা?’
‘হ মা, শুনছে।’
‘মায়ে কি আমারে দোষ দিতাছে বাজান?’
‘তর মায়ের কথা ছাইড়া দে মা! তুই কি কুনোদিন তর মায়ের কথা নিয়া পইড়া ছিলি যে আজ থাকবি? তার মাথাটা কুনোকালেই ঠিক আছিল না!’
জুলেখা যেন সেই কথা শুনতেই পায়নি এমনভাবে বলল, ‘বাজান তুমি কি আমারে দোষ দিতাছ? তুমিও কি আমারে অবিশ্বাস করো বাজান? তুমি কি এইডা মনে করো যে আমি ইচ্ছা কইরা সুফিয়ারে ধরাইয়া দিছি?’
‘এইডা কী কইতাছোস মা? আমি মইরা গ্যালেও এই কথা বিশ্বাস করুম না! তর জান দিয়া হইলেও সুফিয়ারে তুই বাঁচানোর চেষ্টা করতি!’
‘কিন্তু মাইনষে সেইটা মানব না বাজান! সক্কলে মনে করতাছে আমিই সুফিয়ারে ধরাইয়া দিছি! আমি হইলাম গিয়া সৎ বোন! আমি কি ওর ভালা চাইতে পারি? আমি সুফিয়ার কেউ না!’ জুলেখা আর পারল না। ঝরঝর করে কাঁদতে লাগল। নেয়ামত উল্লাহ সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পায় না। জুলেখার দিকে সরে এসে তার মাথায় হাত দেয়। ভিড়ের মধ্যে দুই একজন লোকের এমন উতপটাং কথাবার্তা তার কানেও এসেছে। মানুষ কারো ক্ষতে মলম দিতে না পারুক, সেই ক্ষতটাকে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করতে পারে ভালোমত!

প্রায় আধাঘণ্টা পর পুলিশস্টেশনের গেটের সামনে ভ্যানগাড়ি এসে দাঁড়াল। গেটে প্রায় ঘুমন্ত একজন চৌকিদার বসে বসে ঢুলছিল। নেয়ামত উল্লাহ তাকে কিছু বলতে যাবে এমন সময় জুলেখা হনহন করে কোনোদিকে না তাকিয়েই ভেতরে ঢুকে গেল।
কনস্টবেল রেজা এবং শরফুদ্দিন দুজনেই তখনো নিজেদের ডেস্কে বসে কাজ করছিল। ওসি নিজেও আজ সারাদিন কাজ করেছে, তাদেরকেও নিজেদের ডেস্ক থেকে সরতে দেয়নি। শোনা যাচ্ছে আগামিকাল নাকি কমিশনার সাহেব এখানে আসবেন। কমিশনার আসা মানে এসপি সাহেব তো আসবেনই! পুরো পুলিশস্টেশনে সেটারই আয়োজন চলছে, তবে গোপনে গোপনে।
সারাদিন ধরে পুলিশস্টেশনের ফাইলপত্র ঘাটাঘাটি চলেছে। সবকিছু আপডেট আছে কী না জানার জন্য দশ বিশ বছর এবং তারও আগের ফাইল প্রায় গর্ত থেকে টেনে বের করা হচ্ছে। ওসি সাহেব নিজে যেহেতু হাত লাগিয়ে সব কাজ করছে, কাজেই তাদেরও হাত গুটিয়ে বসে থাকার উপায় নাই। কনস্টেবল রেজা চুপচাপ নিজের কাজ করে গেছে সারাদিন। কিন্তু শরফুদ্দিন ভেতরে ভেতরে ফুঁসে মরছিল। ওসি সাহেব যে আজ সারাদিন তার সঙ্গে শুধু বিদ্রূপ আর কটাক্ষই করে গেছে তাই নয়, অন্য স্টাফদের সামনে রীতিমত তাকে হেয় করেছে।
শরফুদ্দিনের আর তর সইছে না। খুব তাড়াতাড়ি সে এসবের শেষ দেখতে চায়। তারপর এই ওসি হারামজাদাকে সে এমন ঘোল খাওয়াবে যে আজীবন সেটাকে যেন শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখতে পারে। যতই কমিশনার আসুক আর তার বাপ আসুক, কেউই কিছু করতে পারবে না। এসপি সাহেব জায়গামত কলকাঠি ধরে টান দিলেই সব একদিনে সোজা হয়ে যাবে! জামান শিকদার টের পায়নি সে কার সঙ্গে খেলতে এসেছে!
শরফুদ্দিন মনে মনে নীলনকশা আঁকতে থাকে। ফাঁদে পা পড়ামাত্রই ওসিকে নিয়ে সে কী করবে, কেমন হিল্লি দিল্লি ঘুরাবে সেটা ভেবেই তার অশান্ত মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে।

‘আরে আরে…! কেডা আপনে? এমুন কইরা পুলিশ ইস্টিশনে ঢুইকা পড়তাছেন ক্যান?’
আচমকা একটা শব্দ শুনে শরফুদ্দিন আর রেজা হকচকিয়ে সামনে তাকিয়েই দেখতে পায় একজন তরুণী আলুথালু বেশে কাঁদতে কাঁদতে ভেতরে ঢুকে পড়েছে এবং তার পেছনে পেছনে স্টেশনের গার্ড লাঠি হাতে নিয়ে মেয়েটিকে আটকানোর চেষ্টা করছে। পেছনে একজন মাঝবয়সী মানুষকে দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত মেয়েটির বাবা।
‘আরে! এ কী! পুলিশষ্টেশন কি চিড়িয়াখানা হইয়া গেল নাকি? যখন তখন যার ইচ্ছা সেই ঢুইকা পড়ে! মকবুল ঐ ব্যাটা মকবুল, বইসা বইসা ঘুমাইতাছিলি তাই না? আরেকজন আইসা পড়ছে! সকালের একজনের ঝাল অহনো চিপা চিপা বাইর হইতাছে! নতুন আরেকজন আইসা হাজির হইল!’ (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে