#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_আঠার
সুফিয়া আর জুলেখা যখন ফুলিদের বাড়িতে পা দিলো, তখন ওদের বাড়িতে বেশ একটা সাজ সাজ রব। ফুলির মা হাসুবিবি রান্নাঘরে হিমশিম খাচ্ছে। তার দুই তিনজন সহকারীও তার সঙ্গে পেরে উঠছে না। তাদেরকে আশেপাশের বাড়ি থেকে বলে কয়ে আনা হয়েছে। নইলে হাসুবিবির একার পক্ষে আজ এই অল্পসময়ে এত কিছুর ব্যবস্থা করা কিছুতেই সম্ভব হতো না।
তরকারির হাঁড়ি চুলা থেকে নামিয়েই বাটিতে বাটিতে পরিবেশন চলছে। সেই বাটিগুলো আবার কয়েকদফা ভালোমত দেখেশুনে নেওয়া হচ্ছে সেগুলোতে কোনো ময়লা লেগে আছে কী না। দেখে শুনে মনমতো হওয়ার পরেই সেসব বাটিতে তরকারী ঢালা হচ্ছে।
এই হুলুস্থুল আয়োজন দেখে দুই বোনের আর বুঝতে বাকি রইল না বাড়িতে বিশেষ কোনো মেহমান এসেছে। জুলেখাদের দেখে হাসু বিবি একবার মুখ তুলেই সহাস্যে বলে উঠল, ‘ওহ আল্লাহ! তরা দুই বুইনে বাইছা বাইছা আইজকার দিনটাই খুঁইজা পাইলি আওনের লাইগা? কদ্দিন মনে মনে কইছি, জুলেখা আর সুফিয়া একবার একটু ভুলকি মাইরাও আমগো বাড়িত আহে না! তোগো মা তো ঠিকই একদিন আইছিল। তরা আইবার পারিস নাই?’
জুলেখা কর্মনিপুণা মানুষ বলেই হয়ত কোথাও কেউ কাজে হিমশিম খাচ্ছে দেখলে তার সঙ্গে হাত না মিলিয়ে থাকতে পারে না। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা চুলা থেকে তরকারির কড়াইটা নামাতে যাচ্ছিল হাসুবিবি। জুলেখা একরকম ছোঁ মেরে তার হাত থেকে লুচনি নিয়ে বলল, ‘সইরা বসো খালা। আমি নামাইতাছি। ঘাইমা তো এক্কেরে জবজব করতাছো!’
হাসু বিবি জুলেখার এই আন্তরিকতায় মনে মনে খুব খুশি হলো। মেয়েটা এমনই মায়াকাড়া, একে কেউ ভালো না বেসে থাকতেই পারে না! তবু মুখে বলল, ‘ও মা, তরা আইছস এট্টু গপসপ করোনের লাইগা! তুই ক্যান আমার কাম কইরা দিবি রে মা?’
জুলেখা সেই কথার উত্তর দেওয়ার দরকার মনে করল না। সুফিয়া উঠানে দাঁড়িয়ে উশখুশ করছিল। তার জুলেখার মতো এত কাজকর্ম করার শখ নাই। বুবুর এই আদিখ্যেতা দেখে সে মনে মনে ফুঁসতে লাগল। সব জায়গায় আগ বাড়িয়ে কাজ কাঁধে নেয়। কেন বাবা, এখানেও তাকে কাজ করতে হবে কেন? নিজের বাবার বাড়িতে দিনরাত ঝি গিরি করেও কি পোষাচ্ছে না?
জুলেখা ভাতের মাড় গালতে গালতে বলল, ‘কিন্তু খালা, তুমি এমুন রাজভোগের জোগাড়যন্ত্র করবার লাগছ কিয়ের লাইগা? কেউ আইছে নাকি?’
হাসু বিবি একটু লজ্জা পেয়ে বলল, ‘আর কীই বা আয়োজন করবার পারছি! জামাই আইজ কদ্দিন পরে আইলো! এট্টু ভালামন্দ খাওয়াইবার না পারলে কি হয়? তাও গরীব মানুষ, সাধ্য কতটুকুন আমাগো!’
‘দুরু খালা কী কও? ম্যালা কিছু করছ! তা ফুলির জামাই কি কয়দিন থাকব?’
‘আরে না! আইজ সকালে আইছিল। এট্টু পরেই চইলা যাইব। ভাত দিতে দিতে দুপুর গড়াইছে আমার!’
ওদিকে সুফিয়ার মনের মধ্যে চিলিক দিয়ে উঠেছে ফুলির জামাই আসার কথা শুনে। সে তো মনে মনে এই ইচ্ছা নিয়েই এসেছে যে ফুলির কাছ থেকে তার স্বামীর ব্যাপারে একটু খোঁজখবর করবে। শ্বশুরবাড়ির কথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করবে। ফুলিটা এমন গাধী! একটু ভালোমত চেপে ধরলেই গড় গড় করে পেটের কথা সব বের করে ফেলবে! আর এদিকে তো দেখা যাচ্ছে, ফুলির জামাইও এখানেই মজুদ আছে। ভালোই হলো। একেবারে সোনায় সোহাগা!
সুফিয়া হাসুবিবিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ও খালা, ফুলির লগে কি এট্টু দেখা করবার পারুম?’
‘ও মা ক্যান পারবি না? ওই তো ঘরেই বইয়া আছে। জামাইও আছে। যা না দেখা কইরা আয়! তুই হইতাছস ফুলির ইশকুলের বান্ধবী। ছোটবেলার সই। তুই লজ্জা করছ ক্যান?’
সুফিয়া তবু একটু দোনোমোনো করতে লাগল। সে অবিবাহিত একটি মেয়ে। নারী পুরুষের প্রেম ভালোবাসার মুহূর্তগুলোতে বাইরের কেউ এসে পড়লে তারা নাকি খুব বিরক্ত হয়। জামাই বউ দুইজনেই ঘরের মধ্যে খিল এঁটে বসে আছে। প্রেমালাপ করছে কী না কে জানে! এই অবস্থায় সে ভেতরে ঢোকে কীভাবে?
জুলেখা কাজ করতে করতে সুফিয়ার দিকে আড়চোখে তাকাল। সুফিয়ার ইতস্তত মুখের ভাব দেখে তার খুব মজা লাগল। যাক, দুদ্দাড় উতপটাং কাজে অভ্যস্ত তার বোনের তবে একটু হলেও বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। দুম করে ফুলির ঘরে ঢুকতে সে সঙ্কোচ বোধ করছে। জুলেখা একটু সহজ করার জন্য বলল, ‘ও সুফিয়া, তুই উঠান থেইকা ফুলির নাম ধইরা ডাক দে না! ফুলি বাড়াইয়া আইব তাইলে!’
ভালো বুদ্ধি! সুফিয়া নিজের মাথায় মনে মনে একটা রাম চাপাটি দিলো। তার বুবুটার এমনিতে বুদ্ধিশুদ্ধি না থাকলে কী হবে, এইসব ঘরসংসারের বুদ্ধিতে মাথাটা একেবারে গিজগিজ করছে!
সুফিয়া একটু এগিয়ে গিয়ে জুলেখার কথামতো চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল। জামাই বউ শুধু যে ঘরের মধ্যেই ঢুকে বসে আছে তাই না, বেহায়ার মতো মায়ের উপস্থিতিতে ঘরের দরজাটাও বন্ধ করে দিয়েছে! ছাগল মার্কা মানুষ হলে যা হয়! বিয়ের পরে একেবারে লাজ শরমের মাথা খেয়ে ফেলতে হয় যেন!
সুফিয়ার হাঁকডাকে ঘরের দোর দুম করে খুলে গেল। তারপর সুফিয়াকে দেখেই ফুলির মুখে এক পশলা বৃষ্টির মতোই হাসি খেলে গেল। ইয়া বড় পেট নিয়ে সে থপ থপ করে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, ‘ওরে আল্লাহ! সুফিয়া তুই আইছস! কতদিন মায়েরে কইছি, ও মা আমি এট্টু সুফিয়ার লগে দ্যাখা কইরা আসি। ঐ ছেমড়ি তো আমার কাছে আসোনের সময়ই পায় না! আমিই গিয়া দ্যাখা দিয়া আসি! আইছস তো ম্যালা ভালা দিনে আইছস। তর দুলাভাই আইছে। আয় তর লগে আলাপ করাইয়া দেই!’
সুফিয়া মনে মনে বলল, ‘হ, এইবার একটা ভালা কথা কইছস!’ মুখে বলল, ‘আলাপ তো করুমই, কিন্তু তার আগে তরে এট্টু দেইখা লই। মা গো মা, এত্ত বড় প্যাট বানাইছস! এই প্যাট নিয়া হাঁটাচলাও তো করবার পারতাছস না! এইডা আর কিছুদিন পরে বানাইলে কি ম্যালা ক্ষতি হইয়া যাইত নাকি?’
ফুলি লাজনম্র মুখে বলল, ‘আমি তো আর কয়েকডা দিন পরেই চাইছিলাম লইতে। তেনার তো সবুর সইল না!’
সুফিয়া মনে মনে আরেকবার বলল, ‘বেহায়া ছেমড়ি!’
ফুলির স্বামী মুজিবর চিকনা পটকা গোছের একজন মানুষ। মাথার চুলগুলো বিশেষ কায়দায় ব্যাক ব্রাশ করা। গায়ে একটা ফুলতোলা সুতির পাঞ্জাবি। সেই পাঞ্জাবির গলার কাছে একটা সানগ্লাস ঝুলিয়ে রাখা। ফুলি সুফিয়াকে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই সে পকেট থেকে একটা চিরুনি বের করে চুলগুলো একবার আঁচড়ে নিলো। সানগ্লাসটাকে শুধু শুধু গলার কাছ থেকে নামিয়ে একবার ভাপ দিয়ে মুছে নিলো। তারপর একটা বিশেষ এঙ্গেলে বউয়ের বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে নিজের বউকে বলল, ‘কেডা?’
‘আমার বান্ধবী সুফিয়া। ওর কথা তুমারে আগেই কইছি। মনে কইরা দ্যাখো। মাগো মা! এমুন অংকের বেরেন! তুমি যদি দ্যাখতা!’
ফুলির স্বামী মুখেচোখে ব্যাপক ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘আইচ্ছা অংকে ভালা? ঠিক আছে, আলাপ পরিচয় করি আগে। এরপর আমি অংকের পরীক্ষা লমু। দেখুম তুমার বান্ধবী অংকে কেমুন ভালা!’
ফুলি এই কথা শুনে পরম প্রশান্তি নিয়ে সুফিয়ার দিকে চাইল। ভাবখানা এই, ‘আমার জামাইয়ের পরীক্ষায় পাশ না করলে তরে কইলাম আমি আর গোণায় ধরুম না!’
ওদিকে সুফিয়া ফুলির জামাইয়ের ভাবসাব দেখে হাসি ঠেকায়ে রাখতে পারছে না। মনে মনে বলল, ‘ব্যাটা গাড়ল! আইছে আমার পরীক্ষা নিবার! হুহ! ক্লাস থ্রি পাশ করছে বইলাই তো মনে হয় না, হেয় নাকি আমার অংকের পরীক্ষা নিব!’
সুফিয়া ওসব কথার পাশ কাটিয়ে ফুলির স্বামীর সঙ্গে অন্য আলাপ দিয়ে ভাব জমাল।
‘দুলাভাই, আপনেরে সেই বিয়ার সময়ে দেখছিলাম, আর এই আবার আইলেন! মাঝে মাঝে এট্টু শ্বশুরবাড়িতে আইলে না আমরাও চেয়ারম্যানের বাড়ির লোকের দেখা সাক্ষাত পাই!’
মুজিবর এই কথা শুনে কিছু বলল না। শুধু তার ভাবসাব আরেকটু বেড়ে গেল। ফুলি পাশ থেকে উত্তর দিলো, ‘তুই চেনোস চেয়ারম্যানরে?’
ফুলি গাল উল্টিয়ে বলল, ‘চেয়ারম্যানরে কেডায় চেনে না? তিনি আমাগো মাথার ওপরে ছায়া হইয়া আছেন! দুলাভাই… চেয়ারম্যানগো ম্যালা খাটাখাটনি করোন লাগে তাই না? তারা নাকি দম ফেলনেরই ফুরসত পায় না!’ সুফিয়া একটু কৌশলি হওয়ার চেষ্টা করল।
এবারে ফুলির স্বামী মুজিবর কথা বলল। ‘চেয়ারম্যানের আসল কামকাজ তো তার লগের লোকজনরাই কইরা ফালায়। এই যেমন আমারে তিনি খুব ভালাবাসেন। তার বেবাক রকম আসল আসল কামকাজ আমি কইরা দেই। ফাই ফরমাশ আর ছুটকা মুটকা কামকাজ করোনের লাইগা আলাদা লোকজন আছে।’
‘ওহ! তাই কন। আমি তো চিন্তা কইরাই কূল পাইতাম না তিনি একা মানুষ এতদিকে ক্যামনে সামলান! আচ্ছা… একটা কথা। তেনার ভাই নাকি খুন হইছেন?’
আবার ফুলিই প্রথম কথা বলল, ‘তুই এইডা কার কাছ থেইকা শুনছস? ওহ… আচ্ছা মনে পড়ছে। সেইদিন হনুফা চাচি আইছিল। চাচিরে আমিই কইছি। হ… ভালামানুষ আছিল!’
মুজিবর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘আশেপাশে আজেবাজে মানুষজন থুইলে খুন তো হইবই!’
‘কার কথা কইতাছেন দুলাভাই?’ সুফিয়া সূত্রের সন্ধান পেয়ে উৎসুক হয়ে ওঠে।
‘কার কথা আবার? যেই ছেমড়া খুন করছে! ঐ যে শমসের। পুলিশ তো তারে গরু খোঁজা খুঁজতাছে সেই কবে থাইকা। হারামজাদা কই যে পলাইয়া আছে!’
‘ঐ ছেমড়া খুন করল ক্যান?’
‘ক্যান আবার? হয়ত লেনদেন লইয়া বচসা লাগছিল। দুলাভাইয়ের ভাইয়ের মাথাডা তো তার ঐ সাগরেদেই চিবাইতাছিল। খুন কইরা পলাইয়া গ্যাছে হারামজাদা!’
‘আপনের কী মনে হয়? কই পলাইতে পারে? পুলিশ এত খুঁইজাও পাইতাছে না!’
‘দুরু সুফিয়া… কী সব ঘোড়ার ডিমের প্যাঁচাল জুড়লি! কদ্দিন পরে তরে দ্যাখলাম! ইট্টু তর ইশকুলের গপসপ কর। আমি কেমুন সংসার করতাছি হেইডাও তো জিগাইলি না! আর তর দুলাভাইয়ের লগে গপ করন লাগব না।’ আবারও ফুলি কথার মাঝখানে বাগড়া দিলো। সুফিয়া মনে মনে খিঁচে একটা গালি দিলো ফুলিকে।
‘গাধি ছেমড়ি মাঝখানে না সান্ধাইলে মন ভরে না! তর সংসারের খবর জানোনের লাইগা ত আমার ঘুম আইতাছে না!’ মুখে কিছু বলতে পারল না। সমাজে বাস করার এই হচ্ছে ঝামেলা। শুধু একটা হাসি দিয়ে মুজিবরের দিকে তাকালো। মুজিবর একটা অবজ্ঞার হাসি দিয়ে বলল, ‘হ ফুলি তো ঠিকই কইছে! তোমরা দুই সই ঘর সংসার সেলাই ফোঁড়াই রান্নাবান্না এইসব নিয়া গল্প করবা। অংক খুন এইগুলান ভারি ভারি জিনিস তোমাগো পাতলা মাথায় ঢুকাইলে তো দুইদিনেই পাগল হইয়া যাইবা! হাহ হা হা…’
ওদিকে হাসুবিবি তখন জামাইকে খেতে বসানোর জন্য জোর হাতে কাজ করে যাচ্ছে। সঙ্গে জুলেখাও সমানতালে কাজ করছে। হনুফা বিবির এবারে একটু অপরাধবোধ হলো। বলল, ‘তোরা আইছস দুইটা কথা কওনের লাইগা। আমি তরে কামে লাগাইয়া দিছি!’
‘খালা আপনে আমারে কই কামে লাগাইছেন? আমি নিজেই তো করতাছি!’
‘জুলেখা তর মায়ে আইছিল সেইদিন। দুনিয়ার এইদিক সেইদিকের প্যাঁচাল! সুফিয়ার লাইগা চেয়ারম্যানের ছোট পোলার খোঁজ করতাছে! ঐদিকে তুই যে অখনো বিয়ার মাইয়া বইসা আছোস সেইডা দেখে না?’
জুলেখা কাজ করতে করতে বলল, ‘খালা আমার লাইগা কি সুফিয়ার বিয়া আটকাইয়া থোওন লাগব? আমি হইলাম পাতিলের কালি! আমারে কেডায় বিয়া করব? কিন্তু সুফিয়া কত সুন্দর দ্যাখতে। কত ভালা ভালা প্রস্তাব আসে ওর! আমার বিয়ার লাইগা তো ম্যালাদিনই দ্যাখছে! আর কত?’
‘তুই পাতিলের কালি? নিজেই নিজেরে নাম দিয়া দিলি? গায়ের রঙখান এট্টু মাজা, এইডারে পাতিলের কালি কয় নাকি? আর তর মুখের ছিরি ছাঁদ কি কম সুন্দোর? তর মায়েও দ্যাখতে এইরাম সুন্দোর আছিল। তর তো মনে নাই অখন। আমরা দ্যাখছি। মনে আছে!’
মায়ের কথায় জুলেখার মনে কুল কুল নদীর সেই কলতানটা আবার ভেসে এলো যেন। আহারে! মা! কতদিন ঐ প্রিয় মুখটা দেখেনি সে!
তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে জুলেখা বলল, ‘হ খালা! আপনে আমারে ভালা পান এর লাইগা সুন্দোর দ্যাখেন। আপনের চোখ দিয়া দ্যাখলে কবেই আমার বিয়াশাদী হইয়া…’
‘ও মা ওর নাকি দেরি হইয়া যাইতাছে! খাওন দিবা না?’ ফুলি বারান্দা থেকে হাঁক দিলো। হাসুবিবি শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, ‘এই যে মা, অক্ষুনি দিতাছি!’ বলেই জুলেখার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ও মা আমারে আরেকটু আগাইয়া পাড়াইয়া দে! তুই না থাকলে আইজ তো খাওনই দিবার পারতাম না! ও মা, তুই আর সুফিয়া কিন্তু আজ এইখান থেইকা খাইয়া যাইবি! না খাইয়া যাইবার পারবি না!’
‘মায়ে তো চিন্তা করব খালা!’
‘হ! তর মায়ের তো তর চিন্তায় ঘুমই আহে না…’ (ক্রমশ)
#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_উনিশ
খাবার টেবিলে বসে ফুলির স্বামী আর অন্যদিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করল না। সামনে পরিবেশিত খাবার আর তার হাত এবং মুখ, এই তিনটি জিনিস ছাড়া তখন সে কাউকেই চেনে না!
মুজিবরকে খেতে বসিয়ে তার শাশুড়ি, বউ, জুলেখা আর সুফিয়া প্রত্যেকেই তদারকিতে নেমে পড়ল। ফুলি একপাশে বসে নিজের ঐ হাঁসফাঁস শরীর নিয়েই পাখা ঘুরিয়ে যেতে লাগল। শাশুড়ি একের পর এক আইটেম জামাই বাবাজির সামনে পরিবেশন করে যেতে লাগল। সুফিয়া আর জুলেখা একটু দূরে দাঁড়িয়ে এই তামাশা দেখতে লাগল। মাঝে মাঝে জুলেখা হাসুবিবিকে এটা সেটা এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করতে লাগল।
যেভাবে হাপুস হুপুস করে ফুলির বর খেতে লাগল, দেখে সুফিয়া কিছুতেই নিজের হাসি সামাল দিতে পারছিল না। জুলেখা বারকয়েক সুফিয়ার দিকে তাকিয়ে ইশারায় হাসতে বারণ করেছে। বারণ করেছে ঠিকই, কিন্তু নিজে মুখ নিচু করে আঁচলের নিচে হাসি চাপা দিয়েছে। ছেলেটা সত্যিই একেবারে হাভাতের মতো খাচ্ছে। আরে খাওয়াদাওয়া তো পালায়ে যাচ্ছে না! একটু আস্তে আস্তে খা! দেখে মনে হচ্ছে যেন কতদিন ভালোমন্দ কিছু খায়নি!
ওদিকে সুফিয়া মনে মনে ভাবছে, ‘আহারে চেয়ারম্যান সাবের এসিস্টেন্টের খাওয়ন দেখো! চেয়ারম্যান হ্যারে ছাড়া নড়বার পারে না, আর ঐদিকে বেচারারে না খাওয়াইয়া রাখে! ইশ রে!’
ঐদিকে ফুলি ক্রমাগত তার মাকে বলতে লাগল, ‘ও মা, থোড়ের বড়া মোটে দুইটা দিলা ক্যান? আরো দুইটা দাও না? আর কে খাইব? … ডাউল পরে দাও! তরকারি না দিয়াই আগে ডাউল দিলা? খাওনডাই ত নষ্ট কইরা দিলা!’
সুফিয়া আরেকবার মনে মনে ফুলিকে ‘গাধী’ বলে সম্বোধন করে বলল, ‘বিয়ার আগে যেইটুক বুদ্ধি আছিল বিয়ার পরে সেইডাও গ্যাছে! আগে ছিল ছাগলী, অখন হইছে গাধী!’
জুলেখা এর আগে ফুলির স্বামীকে দেখেনি। সে একটু দূর থেকে ভালো করে তাকেই দেখছিল। কিন্তু কেন জানি, ছেলেটাকে দেখে জুলেখার কিছুতেই ভালো লাগল না। মেয়েদের একটা তৃতীয় নয়ন থাকে। সেই নয়নে যা ধরা পড়ে, তা অন্য দুই চোখ দেখতে পায় না।
বেচারা হাসু খালা গরমে ঘেমে নেয়ে এতক্ষণ ধরে জামাইয়ের জন্য রান্নাবান্না করেছে। অথচ ছেলেটা খেতে বসে একবারের জন্যও বলল না, ‘আম্মা আপনে এই গরমে খাড়াইয়া আছেন ক্যান? আপনেও আমার লগে খাইতে বসেন!’ খেতে বসতে না বলুক, বসতে তো বলতে পারে! আর ফুলিও বিয়ের পরে কেমন জামাইপাগলা হয়ে গেছে। জামাইকে ঠেসে ঠেসে খাওয়ানোর দিকেই তার পুরো মনোযোগ। মায়ের দিকে ভ্রুক্ষেপও করছে না!
জুলেখা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার বিয়েশাদী হয়নি অথবা হবেও না কোনোদিন, আর তার মাও বেঁচে নেই। কিন্তু স্বামীর জন্য যদি মায়ের সঙ্গে এরকম আচরণ করতে হতো, তাহলে সে ইচ্ছে করেই বিয়ে করতে চাইত না কখনো।
মুজিবর খেতে খেতে কয়েকবার নিজের ঘড়ি উল্টিয়ে দেখেছে। হাসুবিবি এটা দেখে বলে ফেলল, ‘বাবার কি কুনো তাড়া আছে কুনোখানে যাওনের? এট্টু আরাম কইরা আস্তেধীরে খাও বাবা। বেশি জোরে খাইলে এই গরমে খাওনদাওন হজম হইবার চাইব না!’
মুজিবর মুখচোখে একটা অবজ্ঞার ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘আমার তো আম্মা বইসা থাকোনের কুনো উপায় নাই! চেয়ারম্যান সাব আমারে আবার চক্ষে হারান। দুই তিনজন আকাইম্মার ঢেঁকী আছে তার দুনোধারে। একটা করতে কইলে আরেকটা কইরা বইসা থাকে। তাগো ভরসায় কি তিনি থাকতে পারেন? খাওন দিতে দিতে এট্টু বেশি দেরি কইরা ফালাইছেন আম্মা! অখন খাইয়া দাইয়া রওয়ানা দিতে দিতে আন্ধার হইয়া যাইব!’
হাসুবিবির মুখ কালো হয়ে যায়। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে জুলেখার নিজের চোখেই প্রায় পানি চলে আসে। কেমন অপদার্থ জামাই! এইভাবে শাশুড়িকে বলে!
ফুলি গাল ফুলিয়ে বলে, ‘আমি মায়েরে সেই কুন বিয়ান বেলা থেইকা কইছি, জলদি জলদি পাকসাফের ব্যবস্থা করতে! মায়ের বেবাক কাজেই খালি ঢিলাঢালা দেওয়া!’
সুফিয়া এই দৃশ্য দেখে আর চুপ করে থাকতে পারল না। সে কোথায় আছে, তার পরিচয় কী… সব কথাই সে নিমেষেই ভুলে গেল। সাপের মতো ফোঁস করে বলে উঠল, ‘খালার কি দশটা হাত নাকি ফুলি? তুই নিজে তো ইয়াব্বড় একখান পেট বানাইয়া বইসা আছোস! বেবাক কাম খালার একা করোন লাগছে! কইলেই কি সাথে সাথে খাওন রেডি কইরা ফালান যায়? আর দুলাভাই… একদিন না হয় চেয়ারম্যান সাব আপনারে ছাড়াই কাম চালাইয়া লইল। এট্টু শ্বশুরবাড়ির আলোবাতাস ভালা কইরা খাইয়া যান!’
মুজিবর এই কথা শুনে ভ্রুটাকে সরু করে সুফিয়ার দিকে তাকাল। মনে মনে ভাবল, এই ছেমড়ি তো বহুত সেয়ানা! সব কিছুতেই বাঁও হাত সান্ধাইয়া দেয়!
ফুলির চোখেও অবাক চাহনি। বান্ধবীর এই জায়গায় হস্তক্ষেপ তার একেবারেই ভালো লাগল না। হাসুবিবিও একটু অপ্রস্তুত হয়ে কথাটাকে সেখানেই চাপা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। আর জুলেখা কটমট করে সুফিয়ার দিকে তাকাল। সেই চাহনির অর্থ হচ্ছে, ‘তুই খালি বাড়িত চ! তরে আমি আইজ দেখুমনে! বেবাক কথার লগে কথা কওয়া তর ছুটাইতাছি!’
মুজিবর কিন্তু চাহনি দিয়েই ক্ষ্যান্ত হলো না। একটা তীব্র শ্লেষভরা গলায় বলল, ‘আদার ব্যাপারীর কি জাহাজের খবরাখবর রাখলে চলে? তার আদা লইয়াই খুশি থাকোন ভালা গো শালি! বুঝলা?’
এসব কথাবার্তার মধ্যেই জুলেখার চোখ পড়ে যায় মুজিবরের পায়ের দিকে। এই প্রচণ্ড গরমে সে মোজা পরে বসে আছে। তাও আবার দুই পায়ে দুই মোজা। এক পায়ে কালো আরেক পায়ে লাল চকরাবকরা নকশার মোজা। জুলেখার হঠাৎ সুফিয়ার রোগ ধরল। বহু কষ্টে হাসি সামলাতে গিয়ে সে বারকয়েক হিঁচকি তুলে ফেলল। সুফিয়া কাছে এসে মাথায় থাবাড় দিয়ে বলল, ‘আরে কী হইল? হিঁচকি শুরু হইল ক্যান? ও বু!’
খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকতে চুকতে বিকেল গড়ালো। হাসু বিবি এই অসময়ে সুফিয়া আর জুলেখাকেও জোর করে খাইয়ে দিলো।
ঐদিকে এত হম্বিতম্বি আর কাজের ব্যস্ততা দেখিয়েও ফুলির স্বামী কিন্তু যাওয়ার নাম মুখে নিলো না। সে বেশ আয়েশ করে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে শাশুড়ির সাজিয়ে দেওয়া পান মুখে দিয়ে চিবুতে লাগল। সুফিয়ার মুখ চুলকাতে লাগল। বোনের বজ্রচাহনি উপেক্ষা করেই সে বলল, ‘ও দুলাভাই, আপনের চেয়ারম্যানে মনে হয় অখন দিনদুনিয়া আন্ধার দ্যাখতাছে!’
মুজিবর কিছু বুঝতে না পেরে ভ্যাবলার মতো তাকালো। সুফিয়া যোগ করল, ‘এই যে আপনে অখনো যাইতে পারেন নাই!’
জুলেখা একটা রাম চিমটি কাটল সুফিয়ার কোমরে। সুফিয়া চেঁচিয়ে উঠল… ওহ মাগো!
সুফিয়ার খোঁচা খেয়েই হোক অথবা অন্য যে কারণেই হোক, মুজিবর এরপর আর না উঠে পারল না। ফুলির মুখচোখ অন্ধকার হলো। না থাকতে পেরে হাসুবিবিও বলে ফেলল, ‘মা সুফিয়া, বেবাক কথায় মুখ নাড়াইতে হয় না। দুইদিন পরে তরও বিয়াশাদী হইব। এইগুলান না বুঝলে শ্বশুরবাড়িতে তিষ্টাইতে পারবি না মা! দুনিয়া এত সোজা না!’
সুফিয়া এই কথারও উত্তর দিলো। ‘হ হেইডা ত জুলেখাবুরে দেইখা রোইজই বুঝতাছি! শ্বশুরবাড়ি লাগব না, নিজের মায়ে না থাকলেই দুনিয়ার কেউই চেনে না!’
উপস্থিত সকলেই বুঝতে পারল, যাকে তারা নাদান মনে করে দিন দুনিয়ার জ্ঞান দিচ্ছেন সে তাদের কারো চাইতে কোনোকিছুই কম বোঝে না। বরং সবার চাইতে আরো কয়েক কাঠি বেশি বোঝে!
মুজিবর চলে যাওয়ার পরে হাসুবিবি সুফিয়া আর জুলেখাকে যেতে দিতে চাইল না। জুলেখার মায়ের সঙ্গে হাসু বিবির অনেক সখ্য ছিল একসময়। তার মেয়েটাকেও হাসু বিবি খুব স্নেহ করে। সৎ মায়ের সংসারে জুলেখার যে অনাদর হয়, কমবেশি গ্রামের সবাই তা জানে। আর জুলেখার মায়ের বন্ধু হওয়ার কারণে হাসুবিবির তার প্রতি আলাদা একটা পক্ষপাতিত্ব কাজ করে। জুলেখাকে বারবার থাকার জন্য অনুরোধ করতে থাকে হাসুবিবি।
‘ও জুলেখা আইজ কদ্দিন পরে আইলি আমারে দ্যাখতে! তর মায়ে বাঁইচা থাকলে কি এদ্দিন পরে আইতি? তর লগে কত গল্প করবার মন চায়। আইজ এমুন সময়ে আইলি যে দুইডা কথাও ভালামত কইবার পারলাম না! আরেকটু থাক না! এট্টু পরে যাইস!’
‘নাগো চাচি! ম্যালা দেরি হইয়া গ্যাছে। মায়ে এতক্ষণ বাড়িত চইলা আইছে। আমাগো না দেইখা অস্থির হইয়া যাইব!’
‘তর মায়ের কথা থুইয়া দে! বেবাকই তার মন মর্জি!’
শেষমেশ আরো প্রায় কুড়ি মিনিট পরে জুলেখা আর সুফিয়া ছাড়া পেল। যাওয়ার আগে হাসু বিবি কিছু পিঠাও বেঁধে দিলো তাদেরকে। জুলেখাকে কানে কানে বলল, ‘তুই এট্টু আলাদা কইরা খাইশ! বেবাকটাই সৎ মায়েরে খাওয়াস না!’
জুলেখার মুখ চাপা হাসিতে উদ্ভাসিত হলো। মা চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু মা নিজের বন্ধুর কাছে কিছুটা স্নেহের পরশ তার জন্য ছেড়ে গেছে।
এদিকে মুজিবর যেতে যেতেই একটা ফোন পেল। ফোনদাতার নাম দেখেই তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। এই সময়ে ইনার ফোন! কোনো দুঃসংবাদ নয় তো? দুঃসংবাদ তো আর কারো না, তার নিজেরই দুঃসংবাদ হয়ত! পরের বাড়িতে আশ্রিত থাকে। পান থেকে চুন খসার ভয় করে সারাক্ষণ। কোথায় যে কখন ভুলভাল হয়ে যায় কে জানে!
‘এই যে কেমুন আছেন আপনে?’
‘হ ভালা আছি! আপনে হঠাৎ আমারে ফোন দিছেন এই সময়ে?’
‘জি দিছি। আপনে কোথায় এখন? বাড়িত আছেন নাকি শশুরবাড়িত হাওয়া খাইতে গ্যাছেন?’
‘এট্টু আইছিলাম আর কী বউয়ের বাড়ি, নোয়াহাটি। অখনই ফিরতাছি!’
‘আইচ্ছা তাইলে তো ভালা সময়েই ফোন দিছি। শুনেন, আপনে যে অখন আপনার শ্বশুরবাড়িতে মণ্ডা মিঠাই খাইতাছেন সেইডা আমি ভালা কইরাই জানি। হের লাইগাই আমার একজন লোকেরে আপনার শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি দাঁড় করাইয়া রাখছি। সে দাঁড়াইয়া আছে আপনার শ্বশুরবাড়ি থেইকা এট্টু দূরে বিলের পাশে যে বট গাছটা আছে, সেইটার নিচে। আপনে তো খুব করিতকর্মা মানুষ, তাই এই কাজ একা আপনের দ্বারা নাও হইবার পারে!’
‘জি কী করতে হইব একবার খালি কইয়া দ্যাখেন! জান দিয়া করুম!’
‘আপনের জান দিয়া আমার কী কাম? ঐটা নিজের কাছেই থুইয়া দ্যান। আপনার শ্বশুরবাড়ির গ্রামে একডা মাইয়া আছে, নাম হইতাছে সুফিয়া। এই মাইয়াডারে তুইলা আনোন লাগব! মাইয়ার খুব লম্বা পাখনা গজাইছে!’
নামটা শোনামাত্রই মুজিবরের মনের মধ্যে বিরাট একটা বজ্রপাত হলো। সুফিয়া! তার বউ ফুলির ঐ বাচাল বান্ধবী! কী করছে এই মাইয়া? গ্রামে এত মানুষ থাকতে এই মাইয়ারে ক্যান উঠানোর দরকার পড়ল!
‘কী খুব চিন্তায় পইড়া গ্যালেন মনে হইতাছে! এই মাইয়া কী করছে এইটা জানলে আপনের পিলা চমকাইয়া যাইব! বহুত ঘাউড়া মাইয়া! আপনের বউয়ের বান্ধবী! বেবাক খবর নিছি আমি। বেশি দেরি কইরা কামে ডিসটার্ব কইরেন না। যদি বেশিদূর চইলা গিয়া থাকেন তাইলে আবার উল্টা ঘুরানি দ্যান। আমার লোকরে খুঁইজা বাইর কইরা নিজের কাম শ্যাষ করেন!’
মুজিবর ফোন রেখে দিয়েই সত্যি সত্যি উল্টা হাঁটা দিলো। নির্দেশ মোতাবেক কাজ না করলে তার নিজেরই অস্তিত্ব নাই হয়ে যাবে। দুইটা হুকুম তালিম করেই তো ঘাড়টা এখনো একটু শক্ত রেখেছে। নইলে এই ফুটানি কবেই ফুটা গ্যাস বেলুন হয়ে ফুস হয়ে যেত!
যেতে যেতে সুফিয়ার কথাই ভাবছিল মুজিবর। এত কামিয়াব মেয়ে যে এত হাই লেভেলে তার খবর পৌঁছে যায়! কী করেছে শুনলে নাকি পিলে চমকে যাবে! আর মুজিবর কী না এই মেয়েকে অবজ্ঞা করছিল!
বটগাছের কাছাকাছি যেতেই লোকটা বেরিয়ে এলো। চোখেমুখে একটা বড় কাপড়কে মাফলারের মতো করে পেঁচিয়ে ঢেকে রেখেছে। চেহারা বোঝার কোনোই উপায় নাই। কাছাকাছি আসতেই মুজিবর বলল, ‘ভাই আপনে কি আমার চেনা পরিচিত?’
লোকটা রোবটের মতো গলায় বলল, ‘সেইটা দিয়া কী করবেন? শশুরবাড়িত নিয়া জিয়াফত খাওয়াইবেন? কাম বুইঝা লইছেন না? হুম… লন এইবার হাঁটা দ্যান! ওহ আচ্ছা… খাড়ান! এই কাপড়টা দিয়া নিজের মুখ চোখ ভালামতো ঢাইকা নেন! খবরদার চেহারা যাতে এট্টুও না বোঝান যায়।’
মুজিবর নির্দেশ পালন করল। লোকটা বলল, ‘লন এইবার মাইয়ার বাড়ির দিকে যাই। আমি যেমুন যেমুন বলুম সেই রকম কইরা কাম করবেন। বেশি কাম করবার যাইয়েন না!’
মুজিবর মিনমিন করে বলল, ‘কিন্তু আমি তো মাইয়ার বাড়ি চিনি না! মানে সুফিয়ার বাড়ি!’
‘এই যে একটা বেশি কথা কইয়া ফালাইলেন! আমি কইছি না, বেশি কথা কইবেন না? মাইয়ার বাড়ি আপনারে চিনতে হইব এইটা কইছি আমি? আপনে খালি আমার পিছে পিছে আসেন!’
মুজিবর আর কিছু বলল না। একটু আগেই যে সুফিয়া ফুলিদের বাড়িতে এসেছিল এবং সম্ভবত এখনো সেই বাড়িতেই আছে, এই কথাটাও চেপে গেল। এই ব্যাটা যখন এত সবজান্তার ভাব দেখাচ্ছে তখন সেই তাকে খুঁজে বের করুক!
ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। তারা যখন বটগাছের সীমানা ছাড়িয়ে ক্ষেতের আলে গিয়ে নেমেছে, তখনই দেখতে পেল শুনশান পথ দিয়ে দুটো মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। দেখামাত্রই মুজিবর চিনে ফেলল তারা কারা। নির্দেশ অমান্য করে আবার সে বলে উঠল, ‘ঐ যে সুফিয়া! লগে ওর বইনও আছে!’ (ক্রমশ)
#ফাহ্মিদা_বারী