কনে_দেখা_আলো পর্ব-১১

0
234

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_এগার

মুখ কাঁচুমাচু করে অগত্যা সুফিয়াকে পুলিশের জিপে উঠতে হলো। জামান শিকদার সামনে বসে বলল, ‘তুমি ডিরেকশন দিয়ে নিয়ে যাও। তোমাকে বাসায় রেখে তারপর আমরা আমাদের কাজে যাব।’
সুফিয়া মুখ লটকে বসে থাকল। আজ আর নিস্তার নাই! হয়ত তার এই জঙ্গলে ঘোরাঘুরির আজ থেকেই ইতি ঘটে যাবে। মা শুধু যদি একবার জানতে পারে যে সে একা একা যখন তখন জঙ্গলে গিয়ে ঘোরাঘুরি করে, তাহলে হয়ত তার পড়ালেখাও বন্ধ করে দিতে পারে। এটা করতে মাকে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়ে বলবে, ‘হয় সুফিয়া ইশকুল যাওন বন্ধ করব, নয় আমি না খাইয়া মরুম। যেইটা তোমাগো ইচ্ছা সেইডাই হইব!’
ব্যস, এই কথা শুনেই বাবা অস্থির হয়ে যাবে। সুফিয়াকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলবে… ‘মারে পড়ালেখা না করলে কি আর মইরা যাবি রে মা? কিন্তু মা হারাইলে আর কই পাবি?…’
**
‘তুমি কোন ক্লাসে পড় খুকি?’
‘ক্লাস সেভেনে। কিন্তু আপনে আমারে খুকি কইতাছেন ক্যান? আমি কি খুকি নাকি? বড় হইছি না?’
‘বাহ হাইস্কুলে পড়ো? তাহলে তো বড়ই হয়েছ! খুকি বলা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু হাইস্কুল… সেটা তো এই গাঁয়ে না। এই গাঁ থেকেও আরো কয়েক ক্রোশ পথ। এত দূরে পড়তে যাও? এই গাঁয়ের আর কোনো মেয়ে পড়ে ঐ স্কুলে?’
‘নাহ, আর কেউ পড়ে না। কারো পড়তে ভালা লাগে না। সক্কলের খালি বিয়া করতে ভালা লাগে!’
জামান শিকদারের মুখে হাসি খেলে গেল। মেয়েটা দেখা যাচ্ছে বেশ রসিকা। জামান শিকদারও রসিকতা করে বলল, ‘তোমার কি বিয়ে করার ইচ্ছা নাই?’
‘না নাই। আমি পড়ুম। ম্যালাদূর পড়ুম। ইশকুল পাশ দিয়া কলেজ যামু তারপর ইউনিভার্সিটি।’
‘বাহ বেশ তো। খুব ভালো কথা! পড়াশুনা করার ইচ্ছা থাকলে কেন পড়বা না?’
সুফিয়া একটু বেজার মুখে বলল, ‘মা পড়বার দিবার চায় না। খালি আমার লাইগা পাত্র খোঁজে। ভালা পাত্র পাইলেই জোর কইরা বিয়া দিয়া দিব।’
‘নাহ তুমি ঠেকাবা। জোর করে কোনো কাজ করলে সেই কাজ কখনোই ভালো হয় না। যা করবা মন থেকে করবা। তা… তোমার কোন বিষয় পড়তে বেশি ভালো লাগে?’
‘অংক। অংকের মতন মজার আর কিছুই নাই!’

জামান শিকদার চমৎকৃত হলো। মেয়েটার বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখ দেখে বোঝা গেল, সে যা বলছে মন থেকেই বলছে। বুদ্ধিমতী মেয়ে। এবারে একটু প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে তিনি জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা তুমি যে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে, সেখানে কিছু দেখতে পাওনি?’
সুফিয়ার একবার মনে হলো, সে আজকে যা দেখেছে সেটার কথাই হয়ত ইনি জিজ্ঞেস করছেন। কিন্তু ভুল ভাঙল পরের প্রশ্নে।
‘মানে, কেউ কেউ বলে সেখানে নাকি অশুভ কিছু আছে! জঙ্গলে কেউ গেলে তাকে ভয় দেখায়। তুমি ভয় পাওনি?’
‘ওহ আপনেও এইডা বিশ্বাস করেন? হায় আল্লাহ্‌!’ সুফিয়া সবিস্ময়ে বলল।
‘কেন? বিশ্বাস করার কথা না?’
‘আরে দূর! জঙ্গলে দেউ আছে, এইডা তো লোকে গপ্পো বানাইছে যাতে কেউ জঙ্গলে না যায়!’
জামান শিকদার সুফিয়ার বুদ্ধিমত্তা ও সাহসে আরো একবার চমৎকৃত হলো। এই দিকটা তো ভেবে দেখা হয়নি! মেয়েটা তো খুব দামি একটা পয়েন্ট বের করেছে চিন্তা করে! আরেকটু বাজিয়ে নেওয়ার জন্য জামান শিকদার জিজ্ঞেস করল, ‘কেন কেন? এই কথা কেন বলছ? জঙ্গলে অন্যরা গেলে কার কীসের ক্ষতি?’
‘ক্ষতি তো আছেই! জঙ্গলে এত গাছ! কত ফলপাকুড়! আমাগো ইশকুলের মাস্টার সাব কইছে, গাছের ম্যালা দাম। গাছ তো আমাগো জীবন বাঁচায় এইডা ঠিক আছে, কিন্তু গাছ দিয়া ম্যালাকিছু বানানও যায়! কে কইবার পারে, ঐ জঙ্গলের গাছগুলান কাটনের লাইগা কেউ এই ভুয়া কথা কইতাছে কী না!’
জামান শিকদার কয়েক সেকেন্ডের জন্য বিহ্বল হয়ে গেল। মোতালেবও গাড়ি চালাতে চালাতে চকিতে একবার সুফিয়ার মুখের দিকে তাকাল। এই এত বুদ্ধিমতী মেয়েটাকে একবার না দেখে নিলেই যেন নয়!

‘সুফিয়া, তুমি একটা কথা বলো তো আমাকে। তুমি তো মনে হচ্ছে এর আগেও জঙ্গলে গিয়েছ। তুমি কি জঙ্গলে সেরকম কিছু দেখতে পেয়েছ?’
সুফিয়ার একবার মনে হলো, মন্দিরে মানুষ থাকার যে প্রমাণ সে আজকে আবিষ্কার করেছে সেটা এই পুলিশ স্যারকে বলে দেয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে নিজেকে সামলে নিলো। না ওটা আগেই বলা যাবে না। আগে সে পুরো জিনিসটা নিজে খুঁজে বের করবে তারপর যা করার করবে।
‘ন…না আমি কিছু দেখি নাই। কিন্তু ধরেন এমুন তো হইবার পারে তাই না?’
জামান শিকদারের কাছে একবার মনে হলো, মেয়েটা কিছু একটা গোপন করল তার কাছে। খুব খুব বুদ্ধিমতী এই মেয়ে। একে একটু চোখে চোখে রাখা দরকার, মনে মনে ভাবল জামান শিকদার।

সুফিয়াদের বাসার কাছাকাছি চলে এসেছিল তারা। সুফিয়া এবারে মিনতি জানাল, ‘স্যার আমি এইখানে নাইমা যাই? আমার মায়ে আমারে পুলিশের গাড়িতে দ্যাখলে আমার পড়ালেখা বন্ধ কইরা দিব!’
‘তাই? কিন্তু আমি তো তাদেরকে একটু সাবধান করে যেতে চাচ্ছিলাম। তোমাকে যাতে একটু চোখে চোখে রাখেন তারা। এভাবে একা একা বনে জঙ্গলে ঘুরঘুর করলে কখন কোন বিপদে পড়বা জানো?’
‘না না না স্যার। আপনি হেইডা করলে আমার পড়ালেখা এইখানেই শ্যাষ! মায়েরে আর কিছুই বুঝান যাইব না!’
‘আচ্ছা… ঠিক আছে। তুমি খুব বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে, তাই তোমাকে নিশ্চয়ই বেশিকিছু বলার দরকার নেই। তুমি জানো না মেয়েদের কতরকম খারাপ শত্রু থাকে?’
সুফিয়া মাথা উপর নিচে নামায়, অর্থাৎ সে জানে।
‘সেই শত্রুদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলা খুব কঠিন। এজন্য খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হয় বুঝেছ? আর কখনো এভাবে একা একা বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়ো না। মনে থাকবে তো?’
সুফিয়া এবারে ঘাড়সমেত মাথাটাকে একপাশে হেলিয়ে দেয়। জামান শিকদার হাসতে হাসতে বলে, ‘শুধু মাথা নাড়ালেই চলবে না। কথাগুলো মাথায় ভালোমতো ঢুকিয়ে নিতে হবে। আচ্ছা তুমি এখানেই নেমে পড়ো তাহলে। কোনো দরকার হলে পুলিশষ্টেশনের দরজা খোলা। আর মন দিয়ে পড়ালেখা কোরো। তুমি চাইলে অবশ্যই একদিন ইউনিভার্সিটিতে যেতে পারবে। তোমার অনেক সাহস। কে জানে হয়ত একদিন তুমি আমার কলিগও হয়ে যেতে পারো! অবশ্য আমি হয়ত ততদিনে রিটায়ারমেন্টে চলে যাব!’
সুফিয়া উজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে থাকে। তার কাছে এত ভালো লাগে কথাগুলো শুনে! সত্যি সত্যিই যদি সে পুলিশ হতে পারত! সব চোর ছ্যাঁচড়ের দলকে ঠেঙিয়ে সোজা করে দিত!

জামান শিকদার মোতালেবকে গাড়ি ঘুরাতে বলে। বিকেলের আলো প্রায় ফুরিয়ে আসছে। এখন আর জঙ্গলের দিকে গিয়ে কাজ নেই। আগামিকাল সময় করে একবার আসতে হবে।
গাড়ির মুখ ঘুরতে গাড়িতে উঠতে যায় জামান শিকদার। একবার পেছন ফিরে তাকায়। সুফিয়া তখনো সেখানে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখেচোখে অদ্ভুত প্রশান্তি। সুফিয়ার পেছনে বেশ খানিকটা দূরে একটা লতানো গাছের মাচান দেওয়া জায়গা চোখে পড়ল তার। সেখানে শাড়িপরা একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। দূরত্বটা অনেক বেশি না। মেয়েটাকে পরিষ্কারই দেখা যাচ্ছে।
গাড়িতে ওঠার জন্য এক পা বাড়িয়েছিল জামান শিকদার। পা টা নিজের অজান্তেই মাটিতে নেমে এলো। মেয়েটাও স্থিরচোখে এদিকেই তাকিয়ে আছে। সেই মুখে একটু বুঝি বিভ্রান্তের চাহনি।
মেয়েটার এক মাথা এলোচুল কোমর ছাপিয়ে নিচে নেমে এসেছে। পরনের কাঁঠালিচাপা রঙের শাড়ির আঁচলটা কোমরে গোঁজা। মেয়েটার হাতে একটা কাস্তে মতো কিছু। এই শেষ বিকেলে সে লাউ তুলতে এসেছে।

জামান শিকদারের চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে এবারে সুফিয়াও তাকালো পেছন দিকে। একটু ভয়ে ভয়েই তাকিয়েছিল সে। মনে হয়েছিল পেছন ফিরেই বুঝি মাকে দেখতে পাবে। কিন্তু পেছনে লাউয়ের মাচানের নিচে বোন জুলেখাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুফিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠল। সামনে তাকিয়ে পুলিশ অফিসার জামান শিকদারের চোখেমুখেও একটা আগ্রহী ছাপ দেখে সুফিয়ার মনে বিদ্যুৎ চমকালো। শেষ বিকেলের অবশিষ্ট রক্তিমাভাটুকুকে সে মনে মনে ধন্যবাদ জানাল।
‘আমার বুবু। লাউ পাড়তাছে মনে হয়। বুবু রোজ রাইতে রান্না করে। দিনের বেলায় ঘরের কামকাজ করে আর রাইতে রান্না করে। বুবুর খালি সব উল্টাপাল্টা কাম!’
‘উম…হুউম… ওহ আচ্ছা… ঠিক আছে খুকি। চলি তাহলে! ভালো থেকো!’

চেষ্টা করেও নিজের অন্যমনস্কতাকে এড়াতে পারল না জামান শিকদার। পুলিশ হয়েও সে আজ চোরের মতো এক বুদ্ধিমতী বালিকার কাছে ধরা পড়ে গেছে। ছি ছি! কী ভীষণ লজ্জার কথা!
স্নিগ্ধ মায়াময় এক সাধারণ গ্রাম্য নারীকে দেখে এতটা উতলা হওয়া সত্যিই বাড়াবাড়ি! মনে মনে নিজেকে খুব একচোট ধমকাল জামান শিকদার।

সুফিয়া গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে লাফিয়ে লাফিয়ে অতিক্রম করল তার আর জুলেখার মাঝের দূরত্বটুকু। কাছাকাছি চলে আসতেই জুলেখা হাঁক দিলো তাকে, ‘সুফিয়া… ঐ সুফিয়া তুই আইজকা আবার কই গেছিলি? আর তোরে পুলিশ ধরছিল ক্যান? কী করছিস তুই? জুলেখার মুখেচোখে উদ্বেগ আর আশঙ্কা। তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে সুফিয়া নির্ঘাত একটা কোনো অঘটন ঘটিয়েছে।
সুফিয়া হাসতে হাসতে বলল, ‘পুলিশ আমারে ধরে নাই গো বু! পুলিশ তো আমারে খাতির কইরা বাড়িত নামাইয়া দিয়া গ্যালো! ইস্পেশাল খাতির কইরা! তয় অহন বুঝতাছি এই খাতিরের দরকার আছিল। মনে হইতাছে সামনে আরো ম্যালা খাতির পামু!’
জুলেখা এই হেঁয়ালিভরা কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে বলল, ‘কী কইতাছস খুইলা ক! এত ধুঁয়া দিয়া কথা কইলে বুঝুম ক্যামনে?’
‘বুঝন লাগব না তুমার! লও বাড়িত চল। আর আল্লাহ্‌র দোহাই লাগে, মুখডারে একটু চাইপা রাইখ। মায়ে য্যান কিছুই জানবার না পারে!’
তারপর জুলেখার দিকে তাকিয়ে চাপাহাসিতে উদ্ভাসিত মুখে বলল, ‘বুবু আল্লাহ্‌য় আজ বেবাক কিছু মিলাইয়া দিছে। তুমি কী সুন্দর কাঁঠালিচাঁপা শাড়িটা পিন্ধছ! এক্কেরে সিনেমার সিনের লাগান ঠিক সময়মত মাচানের কাছে গ্যাছ! আমার যে কী খুশি লাগতাছে বু!’
জুলেখা বোনের কথায় ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তরে কি আজ হাছাই ভূতে ধরছে? এগুলান কী কইতাছস?’
‘ভূতে না বু! খুশিতে ধরছে! আইজ আমার বুয়ের প্রত্থম দ্যাখা হইয়া গ্যালো। খাড়াও, পাকা দ্যাখাটাও জলদি জলদিই করাইয়া দিমু!’ (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে