#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_আট
গ্রামের রাস্তায় জিপ নিয়ে চলাচল করা বড় হুজ্জোত। এবড়োথেবড়ো মাটির রাস্তা। জায়গায় জায়গায় খানাখন্দ। বেশিরভাগ পথই আবার সরু। বর্ষাকাল শেষে সেই পথের অবস্থা হয়েছে দুর্বিষহ। তার ওপরে সামনে থেকে যদি কোনো ভ্যান বা গরুরগাড়ি আসে তাহলে তো হয়েই গেল! সারাদিনেও আর গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হয় না।
আজকেও পথের অবস্থা দেখে জামান শিকদার বিরক্তির চুড়ান্ত হলো। একবার ইচ্ছে করল গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা দেয়। জিপগাড়ির আগেই পৌছাতে পারবে!
ড্রাইভার একটা খন্দের মধ্যে পড়ে হা পিত্যেশ করছিল। জামান শিকদার বিরক্ত মুখে দরজা খুলতে যেতেই সামনে থেকে আসা গাড়িটাকে দেখতে পেল। আরেকটি মোটর গাড়ি এই রাস্তাতে উঠে এসেছে। এখন খন্দ থেকে বের হতে পারলেও এই গাড়িকে রাস্তা দিতে গিয়ে আবার আরেক খন্দে পড়তে হবে। এই পাড়াগাঁয়ে একজন বান্দাই মোটরগাড়ি হাঁকাতে পারে। তিনি হচ্ছেন চেয়ারম্যান স্বয়ং। মনে মনে খুশিই হলো জামান শিকদার। অত দূরে আর যেতে হলো না। রাস্তাতেই দেখা হয়ে গেল!
জামান শিকদার গাড়ি থেকে বের হতেই ওপাশের জনও গাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো।
না, চেয়ারম্যান না। এ হচ্ছে চেয়ারম্যানের ছোট ছেলে রুবেল। বছর পঁচিশ ছাব্বিশেক বয়স হবে। চেয়ারম্যানের ডান হাত। ভাইয়ের মৃত্যুর পরে চেয়ারম্যানের যাবতীয় ব্যবসা বাণিজ্য এখন এই রুবেলের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। অল্প বয়সেই বিশাল দায়িত্বের বোঝা কাঁধে আসাতে ছেলেটা খুব গম্ভীর হয়ে গেছে। খুব একটা কথাবার্তা বলে না। এর আগে যতবার দেখা হয়েছে সালাম দিয়েই সরে পড়েছে। আজ কিন্তু রুবেল তাকে দেখে সরে গেল না। হাসিমুখে সালাম দিয়ে বলল, ‘আরে ওসি সাহেব, আপনি? বাবার কাছে আসছিলেন নাকি?’
জামান শিকদার পূর্ণচোখে রুবেলের দিকে তাকাল। ছেলেটাকে হাসলে তো বেশ সুন্দর লাগে! সবসময় মুখ গোমড়া করে রাখে দেখে আজ আরো বেশি ভালো দেখাচ্ছে। পরনে মেরুন রঙের খদ্দরের পাঞ্জাবি আর জিন্স। মাথার চুল উস্কোখুস্কো। ছেলেটা ভালোই লম্বা হবে। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। বেশ সুদর্শন ছেলে বলতে হবে। এই কিছুদিন আগেও চেয়ারম্যান সাহেব এই ছেলের বিয়ের ব্যাপারে তার সাথে কথা বলছিল।
‘বুঝলেন জামান সাহেব…ছোট ছেলেটারও তো ভালোই বয়স হইলো। একটা বিয়াশাদী দেওয়ন দরকার। সময়ের কাম সময়ে না করালে ম্যালা অনর্থ হয় বুঝলেন তো? আপনার কাছে কি কোনো ভালা মাইয়ার সন্ধান আছে?’
জামান শিকদার মুচকি হেসেছিল। সেই হাসি দেখেই চেয়ারম্যান সাহেবের টনক নড়ে গিয়েছিল। হৈ হৈ করে বলেছিল, ‘আরে! আমিও যে বেয়াক্কল! মায়ের কাছে নানীবাড়ির গল্প করবার বইছি! আপনি নিজেও তো অখনো বিয়াশাদী না কইরা বইসা আছেন! আপনার তুলনায় তো আমার ছেলেটা অনেক কম বয়সীই হইব!’
লজ্জা পেয়েছিল জামান শিকদার। মেঘে মেঘে বেলা যে ভালোই হয়ে গেছে, এই কথা উঠতে বসতে অনেকেই মনে করিয়ে দেয়। আজ চেয়ারম্যান সাহেবও সেই কথাই তুলল! আসলে করি করব করছি করে করেও বিয়েটা করা হয়ে উঠল না আজতক। অথচ বিয়ের পাত্র হিসেবে সে নিজেও কম আকর্ষণীয় নয়। আজ থেকে পাঁচ ছয় বছর আগে তো যথেষ্ট সুদর্শন ছিল! এখনও কেউ তাকে কুদর্শন কিছু বলবে না। কিন্তু বয়স কি আর বসে থাকার জিনিস? সে তার নিজের রাস্তায় ঠিকই চলতে থাকে। মাথা ভর্তি ঘন কালো চুলগুলোতে এখন হেমন্তের ধুসরিমা লাগি লাগি করছে। কিছু চুল রণে ভঙ্গ দিয়ে ময়দান ফাঁকা করার ফন্দিফিকির করছে। কিন্তু এখনও যতগুলো অবশিষ্ট আছে, তারাও দলগতভাবে বেশ ঘনত্ব নিয়েই বাস করছে।
সামনে দাঁড়ানো এই সুদর্শন যুবকের মতো এতটা না হলেও এখনও তিনি বেশ যোগ্য পাত্রই বলতে হবে। বয়স এই নভেম্বরে পঁয়ত্রিশ হবে। বিয়ের বয়স এখনও একেবারে চলে যায়নি। দেশের বাড়ি থেকে মা নিত্যই তাগাদা দিয়ে চলেছে। ‘ও বাজান, এইবার একটা বিয়াশাদী কিছু কর! আমি নাতিনাতনীর মুখ দেইখা মরি!’
বিয়ের কথা একেবারেই যে মাথায় আসেনি কখনও তা নয়। কিন্তু কেন যেন শুভ কাজটা করা হয়ে উঠছে না। বিয়েশাদী নাকি ভাগ্যের ব্যাপার। তিনি হয়ত এখনও ভাগ্যের গ্রীন সিগন্যাল পাননি!
রুবেল এখনও তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সচকিত হয়ে উঠল জামান শিকদার। নিজেও মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘আরে এই যে ছোট সাহেব! কোথায় চললেন আপনি? হ্যাঁ আমি তো আপনার বাবার কাছেই যাচ্ছিলাম। উনি বাড়িতে আছেন তো? নাকি কোথাও গিয়েছেন?’
‘বাবাকে তো বাড়িতেই দেখলাম! কোনো দরকার?’
‘আঁ…তা একটু দরকার ছিল বটে! সেটা উনার সাথেই আলাপ করি। আপনি কোথায় চললেন?’
‘যাচ্ছিলাম একটু চাচার আড়তে। বোঝেনই তো, চাচা নাই…এখন সবকিছু বাবাকেই দেখেশুনে রাখতে হচ্ছে। দুদিন ধরে বাবার একটু ঠান্ডা লেগেছে। তাই বাড়ির বাইরে তেমন একটা যাচ্ছে টাচ্ছে না। এই ফাঁকেই নাকি দুজন কর্মচারীর মধ্যে গ্যাঞ্জাম লেগেছে। বাবা আমাকে পাঠালো মিটমাট করে দেওয়ার জন্য। চাচার এইসব আড়ত আর কাপড়ের দোকানের কী যে করব আমরা সেটাই ভাবছি। নিজেদের কাজকর্ম সামলেই সময় বের করতে পারি না! এর মধ্যে আরও কত উটকো উপদ্রব!’
জামান শিকদার মুগ্ধতা নিয়েই রুবেলের কথা শুনছিল। ছেলেটা পড়ালেখা তেমন একটা করেনি। তবু কথাবার্তায় একেবারে চোশত! গেঁয়ো ভাষায় কথা বলে না। একেবারে শুদ্ধ বাংলা বলছে। আর খুব স্মার্ট তার কথা বলার ভঙ্গিটা। এই ছেলে পড়ালেখা কেন করেনি কে জানে!
পড়ালেখা করতে চাইলে তো বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না। কিন্তু নিজের চেয়ে বড় বাধা আর কে আছে সংসারে? গ্রামের ছেলে। যদিও বাপে চেয়ারম্যান, কিন্তু অল্পবয়স থেকেই টাকা পয়সা দেখেশুনে বড় হতে গিয়ে হয়ত পড়ালেখার দিকে আর মন দিতে ইচ্ছে করেনি। সদরের একটা কলেজ থেকে নাকি আইএ পাশ করেছে। তবে লোক মারফত খবর আছে যে, সেই বছর নকলের সুবিশেষ সুবিধা পাওয়া গিয়েছিল। একদিন ক্লাস না করেও চেয়ারম্যানের ছেলের পাশাপাশি তার সকল সাঙ্গপাঙ্গ সদলবলে সেই বছর পাশ করে গেছে। একেবারে চরম ঔদার্য যাকে বলে!
এসবই শোনা কথা অবশ্য। তবে নানারকম উৎস থেকে আসা এইসব খবর ভুয়া হওয়ার সম্ভাবনা খুবই সামান্য।
রুবেল চলে যেতেই জামান শিকদার আবার নিজের জিপে উঠে বসল। বিরক্তিকে জয় করে একটা সিগারেট ধরাল। মাথাটা মাঝে মাঝে জট পাকিয়ে যায়। একটু সিগারেট খেয়ে মাথাটাকে ক্লিয়ার রাখা প্রয়োজন।
আব্দুল রফিকের কোনো উত্তরাধিকারি নেই। তার ভাই আর দুই ভাস্তেই তার যাবতীয় সয়সম্মত্তির উত্তরাধিকারি এখন। ধানচালের ব্যবসা করেছে। সেই সাথে কয়েক গ্রাম মিলিয়ে প্রায় একচেটিয়াভাবেই পাইকারি কাপড়ের ব্যবসা করেছে। টাকা কড়ি কম কিছু কামায়নি জীবনে। শমসের ছেলেটাকে নাকি নিজের হাতে কাজ শিখিয়েছিল। ছেলেটা ব্যবসাও বুঝত ভালোই। এসবও অনেকটা শোনা কথাই। তবে যেখানে এরাই মূল সাক্ষী সাবুদ সেখানে শোনা কথার ওপরেই আস্থা রাখা ছাড়া উপায় কী?
শমসের ছেলেটা এই ব্যবসার ভাগ নেওয়ার জন্যই আব্দুল রফিককে খুন করেনি তো? কারণ সে জানত, যতই তার মালিক তাকে স্নেহ করুক না কেন…সম্পত্তির অংশীদার কখনোই বানাবে না তাকে। সেখান থেকেই হয়ত বিবাদের সূচনা…আর তারপর খুন।
যেতে যেতে পথের দু’পাশের অবারিত ক্ষেতের শোভা উপভোগ করছিল জামান শিকদার। পাকা গমের অপূর্ব হলুদ রঙে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। কে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে পুরোটা ক্ষেত জুড়ে। জামান শিকদার নিজেও গ্রামেরই ছেলে। স্কুল পর্যন্ত গাঁয়েই পড়ালেখা করেছে। তারপর শহরে গিয়ে আইএ বিএ পাশ করে ভাগ্যের জোরে সরকারী চাকরিটা পেয়ে গেছে।
আজ মনে তার মিশ্র অনুভূতির জোয়ার নেমেছে। একটু আগেই আব্দুল রফিকের খুনের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিল জামান শিকদার। এখন আবার হুট করেই পুরনো চাপা দুঃখবোধটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। জীবনের রঙিন বসন্তগুলো এলোমেলো দমকা বাতাসের মতোই দ্রুতলয়ে বয়ে চলেছে। দেখতে দেখতে শীত এসে যাবে। জরার কবলে পড়বে সবুজ অরণ্য। সময় কি থেমে থাকবে কোনোকিছুর জন্য? এখনও মা আছে বলে কাজ থেকে অবসর মিললে বাড়ি যাওয়ার তাড়া অনুভব করে। যেদিন সেই আশ্রয়টুকুও নাই হয়ে যাবে, সেদিন কোথায় যাবে সে? কাজ আর বিশ্রাম এই দুইয়ের মধ্যেই বেঁধে নিয়েছে জীবনের সমস্ত আলাপন। কিন্তু ঘর মন সংসার ঘরণী…এসব কি আজীবন অধরাই থেকে যাবে জীবনে?
এখন অব্দি বিয়ে না করার পেছনে অনেকগুলো কারণ দায়ী। নিজের মাকে আকারে ইঙ্গিতে নানাভাবে বুঝিয়েছে, তার জন্য মেয়ে পছন্দ করতে। কারণ কত জায়গায় কত মেয়েই তো দেখা হলো! কাউকেই কেন যেন মনে ধরে না তার!
আজকালকার মেয়েগুলো বড় নখরাবাজ! কী গ্রাম কী শহর… হিন্দি সিনেমা আর ডিশের কল্যাণে মেয়েগুলোর মধ্যে থেকে সভ্যতা ভব্যতা কেমন জানি নাই হয়ে গেছে। এত ছোট ছোট সালোয়ার কামিজ পরে আর এত রঙ ঢং করে চুল বাঁধে, চোখেমুখে হাবিজাবি কত রঙ লাগায়…যে তার একেবারে অভক্তি ধরে যায় দেখে!
বাঙালি সতেজ কমনীয়তা সে খুঁজে পায় না কোনো নারীর মধ্যেই। কোনো নারীকে দেখেই আজ অব্দি মনে হয়নি একদম ভোরের শিশিরের মতো পবিত্র, অস্পর্শা… প্রথম ছোঁয়াটুকু পেলেই যে টুপ করে ঝরে পড়ে যাবে! অথবা লাজনম্র লজ্জাবতীর মতো সঙ্কোচে কুঁকড়ে যাবে নিজেকে দ্রুত সামলাতে সামলাতে!
সেই সতেজ স্নিগ্ধ নারী কি কোথাও অপেক্ষা করে আছে তার জন্য? নাকি একটা জীবন পারই হয়ে যাবে তার পথের পানে তাকিয়ে তাকিয়ে? (ক্রমশ)
#ফাহ্মিদা_বারী