কনে_দেখা_আলো পর্ব-০৬

0
236

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_ছয়

কদমপুর থানার ওসি জামান সিকদার মাস তিনেক হলো এই থানায় বদলি হয়ে এসেছে। এসেই এক মারাত্মক জটিল কেসে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। সেই কেসে এত ডালপালা আর এত প্যাঁচগোচ যে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে এখানে না এলেই বুঝি ভালো ছিল।
এমনিতেই পুলিশের চাকরি করতে তার তেমন একটা ভালো লাগে না। নেহায়েত পেটের দায়ে করতে হয় বলেই করা। ঠিকমত কেসের সুরাহা না করতে পারলে পাবলিকের কাছে হেনস্থা হতে হয়। আড়ালে আবডালে প্রচুর গালমন্দ হজম করতে হয়। সেসব গালমন্দ যে পুলিশের কান অব্দিও চলে আসে, পাবলিক অনেক সময়েই তার খবর রাখে না। আবার সবসময় বেশি মন লাগিয়ে বসে থাকলেও কিছু করা যায় না। ওপরওয়ালার চাপ থাকে। কেউকেটা কেউ জড়িত থাকলে তো হয়েই গেল! কেস থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয়।

জামান সিকদারের বয়স বেশি না। এখনো পঁয়ত্রিশ পুরো হয়নি। একেবারে ফুরফুরে মেজাজে ঘুরেফিরে বেড়ানোর বয়স না এটা। আবার ‘সব দেখে ফেলেছি’ বলার জন্যও বয়সটা ঠিক যুতসই নয়। কাজ নিয়ে মেতে থাকলে ঠিক আছে। নইলে গায়ে আরামের মেদ জমতেও সময় লাগে না। খুব বেশি অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে না হলে আরাম আয়েশের অভ্যাস হয়ে যায় এই বয়সে। তার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। এতদিন বেশ আয়েশে আয়েশেই দিন কেটেছে। তাই খুব বেশি ঝামেলা দেখলে এখন মাথার মধ্যে চিড়বিড় করে। ইচ্ছে করে দূরে কোথাও গিয়ে আরাম করে ঘুম দিতে। ইদানিং তার ভয় হচ্ছে, অবস্থা এইরকম চলতে থাকলে পুলিশ ডিপার্টমেন্টেই বুঝি আর চাকরি করা হয়ে উঠবে না।

তার এই আরাম আয়েশের অভ্যস্ততার পেছনে দায়ী আগের দুটো পোস্টিং। পুলিশের চাকরিতে ঢুকেই একটা ভাব থাকে যে, কিছু করে ফাটিয়ে ফেলে দিব। দেশ থেকে অন্যায় দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে ছাড়ব। দু’দিন যেতে না যেতেই সেই ভাববোধে আগাছা জন্মাতে শুরু করে। দু’দশটা চোর বাটপারের গায়ে চড় থাপ্পর মারার পরেই মূলোৎপাটন করার ইচ্ছেটা আস্তে আস্তে ভেতরেই শুকিয়ে যায়।

এর আগে পোস্টিং ছিল মোটামুটি শান্ত এলেবেলে গোছের দুটি থানাতে। নানা জাতের চোর ছ্যাঁচড় নিয়ে বেশ ভালোই অভিজ্ঞতা হয়েছে সেসব জায়গায়। ছিঁচকে চোর, সিঁধেল চোর, তেলা চোর, লম্বু চোর, বাট্টু চোর…চোরেদের স্বর্গরাজ্য ছিল যাকে বলে। কিছুদিন যেতে না যেতেই তিনি চোর ধরাতে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠলেন। আর প্রথম দিকে কাজটাতে বেশ একটা থ্রিল থ্রিল ভাবও জাগত। তারপরে যত দিন যেতে লাগল, তত আগ্রহে ভাটা পড়তে শুরু করল। একপর্যায়ে এমন অবস্থা দাঁড়াল, কোথাও চুরির খবর শুনলেও তিনি আর নড়তেন না। তার কনস্টেবলকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে পত্রপত্রিকা পড়ায় মন দিতেন।
পর পর দুটি থানাতেই একই রকম অভিজ্ঞতা হওয়ার পরে জামান শিকদার ধরেই নিয়েছিল যে, চাকরি জীবনটা বুঝি এভাবেই কেটে যাবে। চোর বাটপার ধরা ছাড়া পুলিশ ডিপার্টমেন্টের আর বুঝি তেমন কোনও কাজ নেই।

কিন্তু এই কদমপুর থানাতে বদলি হয়ে এসেই বেশ অন্যরকম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে। তিনি আসার অল্প কিছুদিন আগেই ঘটনা ঘটেছে। আগের জনকে এই ঘটনার জন্যই চলে যেতে হয়েছে কী না বলা মুশকিল। তার সঙ্গে একবার সময় করে যোগাযোগ করা দরকার। বলা যায় না, কোনো সূত্র পেলেও পেয়ে যেতে পারেন। ঝামেলার জন্য সেটাও করতে পারছেন না। তাই গোড়া থেকেই তাকে মাঠে নামতে হয়েছে।
এই কেসের আগামাথা এখনো ভালোমত বুঝেই উঠতে পারছেন না তিনি। খুন হয়েছে কদমপুরের চেয়ারম্যানের সহকারী কাম ছোটভাই আব্দুল রফিক, আর খুনের দায়ে পলাতক হয়ে আছে সেই ভাইয়ের সাগরেদ শমসের, যে নাকি ছিল তার ডান হাত। খুনের দিন সকালে চেয়ারম্যানের ভাই আর তার সাগরেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছে। এই ঘটনার সাক্ষী আছে চেয়ারম্যানের বাড়ির সবাই।

অথচ বাড়ির কাজের লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় জানা গেছে, আব্দুল রফিক সাহেব এমনিতে সচরাচর তার সাগরেদকে নিয়ে ভাইয়ের বাসায় তেমন একটা আসা যাওয়া করতেন না। তার সাগরেদটি নাকি খুব চুপচাপ প্রকৃতির ছেলে ছিল। প্রচণ্ড ঠান্ডা স্বভাবের। তাকে কেউ জোরে কথা বলা তো দূর, বেশি একটা কথাই বলতে শোনেনি কখনো। আব্দুল রফিক সাহেব তাকে যা কিছু বলতেন, সে চুপ করে মাথা নীচু করে শুধু শুনে যেত। এইরকম ঠান্ডা প্রকৃতির প্রভু ভক্ত একটা ছেলে কেন আচমকা তার প্রভুকে খুন করে পালিয়ে যাবে বিষয়টা খুব বেশি পরিষ্কার নয়।

আবার চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ তার ছেলেদের চেয়ে ভাইকেই বেশি বিশ্বাস করতেন। নিজের ছেলেদেরকে ব্যবসার অংশীদার না বানিয়ে তিনি তার ভাইকেই বেশি যোগ্য মনে করেছিলেন। যদিও তার দু’ছেলেই পরিণত বয়সের। চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফের বক্তব্য অবশ্য পরিষ্কার। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ভাইয়ের ব্যবসায়িক বুদ্ধির ওপরে তার আস্থা অনেক বেশি ছিল।

তার বড় ছেলে অকর্মন্য প্রকৃতির। সে কাজকর্ম তেমন কিছু একটা করে না। বসে বসে বাবার টাকা ভোগ করে আসছে এতদিন। মাদক আর মেয়েমানুষের নেশাও আছে তার। সেই নেশার জোগানও তার বাবার টাকা থেকেই হয়ে আসছে। ছেলের মতি ফেরানোর আশায় চেয়ারম্যান সাহেব তার বিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু ছেলের মতি তাতে ফেরেনি। সে এখনো মদ, মেয়েমানুষ এসব নিয়েই মেতে আছে। লাভের মধ্যে লাভ হয়েছে এই, ছেলের বউ আর সন্তানদের দায়িত্বও চেয়ারম্যানেরই ঘাড়ে এসে জুটেছে। ছেলের শ্বশুরবাড়ির লোকজন ছেলের চরিত্র নিয়ে নানারকম বদনাম আর কানাঘুষা করছে। এতে আগামি ইলেকশনে নিজের দলে কিছু শত্রু জড়ো হওয়াও বিচিত্র ব্যাপার না!

ছোট ছেলে তুলনামূলকভাবে কিছুটা সুমতি সম্পন্ন। অল্প বিস্তর লেখাপড়াও করেছে সে। তবে তার ওপরেও আব্দুল লতিফ সাহেবের তেমন আস্থা নেই। লেখাপড়া করার সময়ে তারও কিছু অসৎসঙ্গ লাভ হয়েছে। কাজেই তার ওপরে ব্যবসার দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত ছিল না। আর তাছাড়া ব্যবসার কাজে কিছুটা অভিজ্ঞতা আর বয়সের প্রয়োজন আছে যা তার ছোট ছেলের এখনো হয়নি বলে মনে করেন তিনি। ব্যবসার কাজে সে এখনো আনাড়িই বলা চলে। এখন ঠেকায় পড়ে একটু আধটু শিখছে। কিন্তু দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার জন্য সে এখনো উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। তাই চেয়ারম্যান সাহেব ভাই আব্দুল রফিককেই এই ব্যাপারে সুযোগ্য সহকারী হিসেবে মনে করতেন।

দুই ভাই একই বাড়িতে থাকতেন না। আব্দুল রফিক ভাইয়ের বাড়ি থেকে কিছু দূরে বাড়ি বানিয়েছিলেন। তিনি বিয়ে থা কিছু করেননি। এক ঠিকা ঝি তার রান্নাবান্না আর বাসার কাজকর্ম করে দিত। শমসেরকে তিনি কাছে কাছেই রাখতেন। সেই বাড়িতেই শমসের আর তিনি অনেকটা নিঃসঙ্গ একাকী জীবন যাপন করতেন। কাজেই শমসেরের সাথে যদি আব্দুল রফিক সাহেবের কিছু একটা ঝামেলা হয়েও থাকে, তাহলে সেই বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যেই সেটা হতে পারত। ভাইয়ের বাড়িতে নিজেদের ঝামেলা বয়ে আনার তো কোনো দরকার ছিল না!

খুন যে বন্দুক দিয়ে করা হয়েছে, সেটাকেও অকুস্থলে পাওয়া যায়নি। সেটা পাওয়া গেলেও হয়ত কেসের কিছু একটা সূত্র পাওয়া গেলেও যেতে পারত। অন্তত বলা যেত যে মার্ডার উইপেন মিলে গেছে। আসামিকেও দ্রুতই ধরে ফেলা হবে। আব্দুল লতিফের বাড়ির লোকজন বলছে, বন্দুক নিয়েই গা ঢাকা দিয়েছে শমসের। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রত্যেকে এতটাই বিমূঢ় হয়ে গেছে যে, তার পিছু ধাওয়া করার চিন্তাটাও সময়মত মাথায় আসেনি কারো!

শমসেরকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে চেয়ারম্যান সাহেব সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। সহযোগিতা করেছেনও তিনি। সম্ভাব্য সব জায়গার হদিস দিয়েছেন যেখানে শমসেরের দেখা মিলতে পারে। কিন্তু আজব এক ভোজবাজির মতোই গায়েব হয়ে গিয়েছে ছেলেটা। আশেপাশের গ্রামের কেউই তার কোনোরকম সন্ধান দিতে পারেনি। অবশ্য জামান সিকদারও একেবারে জান বাজি করে ছেলেটার পিছু নেয়নি। ওপর থেকে চাপ নেই। গ্রামের লোকজনেরও কিছুই আসে যায় না খুনি ধরা পড়ল কী পড়ল না সেটা নিয়ে। আব্দুল লতিফ সাহেব একা আর কয়দিন ভাইয়ের খুনির পিছে লেগে থাকবেন? তার তো অন্য কাজকর্ম আছে! হাত গুটিয়ে তো দিনের পর দিন বসে থাকা যায় না!
খুনের জোরালো কোনো মোটিভও খুঁজে পাওয়া যায়নি। শমসের ছেলেটা নীরব প্রভুভক্ত হিসেবেই পরিচিত ছিল। হঠাৎ কী এমন ঘটনা ঘটল যে একেবারে খুন করে বসল! হয়ত ক্ষনিকের মাথা গরম থেকেই ঘটনাটা ঘটে গেছে। চালচুলোহীন ছেলে। কারো সাথে তেমন একটা মিশত টিশত না। আব্দুল রফিকই তার মা-বাপ ছিল। আগেপিছে কেউ নেই যে তার সূত্র ধরে ওর কাছাকাছি যাওয়া যাবে। এক মা ছিল, সেও মরে গেছে। আত্মীয় স্বজন কারো খোঁজ জানা নেই। হারিয়ে গেলে কারো কিছু আসবে যাবে না। কাজেই এমন একটা ছেলেকে খুঁজে বের করা খুব বেশি সহজ কাজ না। তাছাড়া এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলের অপ্রতুল সুযোগসুবিধাও একটা কারণ। একটা পুলিশস্টেশন নামেমাত্র আছে এই যা! লোকবল নাই, কিছু নাই। কাজেই শুধু শুধু এই ছেলের পেছনে ঘুরে নিজের আয়ুক্ষয় করাটাকে বিশেষ সুবিবেচনার কাজ মনে হয়নি জামান শিকদারের।

এছাড়া এখানে শুরু থেকেই কিছু ব্যাপারে রহস্যের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। এখানে কিছু একটা আছে, অশুভ কিছু। আর পুরো অঞ্চলে তার একটা অশুভ ছায়া আছে।
এই কদমপুর আর তার পাশের গ্রাম নোয়াহাটিকে জুড়ে আছে প্রায় দুইশত একরের এক বিশাল জঙ্গল। দুই গ্রামের মানুষের মনে এই জঙ্গলকে ঘিরে অনেক আজব গল্পগাঁথা প্রচলিত আছে। সন্ধ্যার পরে কেউই এই জঙ্গলের আশপাশ দিয়ে যাওয়া আসা করে না। কোনকালে এক কালীমূর্তির বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এখানে। এলাকার হিন্দুদের বিশ্বাস, সেই বিগ্রহ অতি জাগ্রত। একসময় তাকে নরবলি দিতে হতো। নির্দিষ্ট সময় পরে পরে নরবলি দেওয়া না হলে বিগ্রহ অসন্তুষ্ট হতো। সেই নরবলি প্রথা কালের বিবর্তনে উঠে গেছে ঠিকই, কিন্তু বিগ্রহ তার নিজস্ব মৌনতায় বাগড়া দেওয়া পছন্দ করে না। তাই এই জঙ্গল আর তার আশেপাশের নিস্তরঙ্গতাকে কেউ ঘাঁটাতে যায় না।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রোত্থিত এই বিশ্বাস কীভাবে কীভাবে যেন অন্যদের মগজেও আমূল গেঁথে গেছে। এই থানাতে বদলি হয়ে আসার পরে থেকেই জামান শিকদার সাহেব এসব গল্পগাঁথা শুনে আসছেন। এসব গল্প একবার চালু হয়ে গেলে মানুষের মগজটাকে একেবারে আচ্ছামতন ওয়াশ করে ফেলে। কিছুতেই মাথা থেকে তাড়ানো যায় না। মানুষ কেন যেন এইসব গল্পগাঁথাকে খুব সহজেই বিশ্বাস করে ফেলে। সত্যি মিথ্যা যাচাই করারও প্রয়োজন দেখে না। হুট করে এসবের বিপক্ষে কিছু বলতে গেলে উলটে তাদের বিরাগভাজন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

এমনকি এলাকার চেয়ারম্যান সাহেবও এই গল্পগাঁথাকে বিশেষ পাত্তা দিয়ে থাকেন। এখানে আসার পর তিনি নিজে অনেক সময় নিয়ে ভেঙ্গেচুরে এই জঙ্গলের রহস্যময়তার গল্প করেছেন। এমন একটা রহস্যময় জঙ্গল যে এই এলাকাতে আছে, এটাতে ভেতরে ভেতরে কেমন একটা গোপন গর্বের ছায়াও ফুটে উঠতে দেখেছে তার মুখেচোখে।

যেন প্রকৃতি অনেক দয়াপরবশ হয়েই তার রহস্যময়তা দেখানোর জন্য এই জায়গাটাকেই বেছে নিয়েছে। এখানকার মানুষদেরও সেই রহস্যের মর্যাদা রক্ষা করে চলাটা দায়িত্ব! আর সবাই সেটাই করে থাকে। বিনা দরকারে কেউ এর রহস্যময়টাকে ভাঙতে যায় না। জঙ্গল পড়ে আছে নিজের আভিজাত্য নিয়ে।
জামান শিকদার বুদ্ধি খরচ করে চুপ থাকাটাকেই নিরাপদ ভেবেছে। নতুন জায়গায় এসে জনবিশ্বাসে আঘাত দিয়ে শত্রু বৃদ্ধি করাটাকে বুদ্ধিমানের কাজ মনে হয়নি তার কাছে। (ক্রমশ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে