কনে_দেখা_আলো পর্ব-০৫

0
228

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_পাঁচ

মনের কুচিন্তা দূরে সরিয়ে রেখে সে মিহি গলায় ফুলিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ও মা ফুলি…তর শশুর বাড়িত কেডা কেডা আছে? শাশুড়ি আছেনি?’
এসব গল্প তার মোটামুটি মুখস্থ। বহুবার বহুরকম জিজ্ঞাসাবাদ করে আর দিনমান চোখকান খুলে রেখে প্রায় সবকিছুই এখন হনুফার নখদর্পণে। ফুলির যে শশুর শাশুড়ি কেউ নেই, সে যে তার ননাস-নন্দাই এর বাড়িতে একরকম আশ্রিতের মতো আছে… এগুলো খুব ভালোমতই জানে হনুফা বেগম। তবু এসব কথা বার বার জিজ্ঞেস করে সে ফুলিকে তার অবস্থানটা প্রতিবার মনে করিয়ে দিতে চায়। চেয়ারম্যানের বাড়িতে আশ্রিত থাকা আর সেই বাড়ির বউ হয়ে যাওয়া যে এক জিনিস নয় এটা বোঝানোই তার উদ্দেশ্য।
ফুলি বিরস মুখে উত্তর দিল, ‘চাচি এক কতা আর কত জিগাইবেন? আপনে তো জানেনই আমার শশুর শাশুড়ি কেউ বাঁইচা নাই। আমার ননাস আর নন্দাই আমাগো থাকবার দিছে। আর কী জিগাইবেন তাড়াতাড়ি জিগান। ঘরেত গিয়া শুইয়া থাকমু।’

হনুফা বেগম খানিক অপ্রস্তুত হলো। এক কথা বারে বারে বলাটা আসলেই ভুল হয়ে গেছে। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। তার চাই খবর। আর এই খবরের মাধ্যম বানাতে হবে ফুলিকে। তাই ফুলিকে রাগালে চলবে না।
যেন খুব ভুল হয়ে গেছে এমনভাবে হনুফা বেগম তাড়াতাড়ি বলল, ‘ওহ হো, তাই তো! আইজকাল সগল কথা আর মনে থাকে না। সকালে শুনলে বিকালে ভুইলা যাই…তা ফুলি, চেয়ারম্যানের ছুডো পোলার বয়স কত? কামকাইজ কিছু করে?’
ফুলি আর হাসুবিবি চোখ চাওয়াচাওয়ি করলো। এতক্ষণে তারা আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। মনে মনে হাসুবিবি স্বীকার না করে পারল না, হনুফা বেগমের জেদ আছে বটে। একবার যা সে ধরে একেবারে কচ্ছপের কামড় দিয়েই ধরে।

ফুলি গলা নামিয়ে বলল, ‘চেয়ারম্যানের পোলার কি বইয়া থাকলে চলে চাচি? কাইমকাজ করে। তয়…’
কিছু একটা বলতে গিয়েও ফুলি থেমে গেল। হনুফা বেগম টের পেল, মায়ের ইশারাতেই কথা থামিয়ে দিয়েছে ফুলি। কিন্তু হনুফা বেগমের তো সব খবর জানা চাইই চাই! এই মাঝপথে থেমে থাকলে তো তার চলবে না! ব্যগ্র উৎসুক কণ্ঠে সে বলল, ‘তয় কী? পোলা দ্যাখতে শুনতে ভালা না?’
‘না না…দ্যাখতে শুনতে তো ভালাই। তয় তাগো বাড়িত একটা ক্যাচাল বাঁধছে।’
ফুলি কথাটা বলে ফেলেই ভয়ে ভয়ে তার মা হাসুবিবির মুখের দিকে তাকায়। হাসুবিবি যতই আকারে ইঙ্গিতে মেয়েকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, মেয়ে তা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। আর এদিকে হনুফা বেগম তো গল্পের সুতা ঠিকঠাকমত ধরে ফেলেছে। এবারে কি আর সে সুতা ছাড়ে? আস্তে আস্তে সেই সুতাকে নিজের দিকে টানতে থাকে হনুফা।
‘কী ক্যাঁচাল বাঁধছে?’
ফুলি বুঝল, আর থেমে থাকার চেষ্টা করে লাভ নেই। সেও ভুলে মুখ খুলে ফেলেছে আর এখন হনুফা চাচিও তার সেই খোলা মুখ থেকে পুরো কথা বের করে তবেই ছাড়বে।

মিনমিনিয়ে ফুলি যা বললো তার অর্থ এই, চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ আর তার ভাই আব্দুল রফিক দুজনে মিলে এটা সেটা নানারকম ব্যবসা করে আসছিল এতদিন। তাদের টাকা পয়সার মূল জোগান এই ব্যবসা থেকেই আসতো। চেয়ারম্যানের সব ব্যবসাতেই সমান অংশীদার ছিল তার এই ভাই।
চেয়ারম্যানের ভাই আব্দুল রফিকের একজন সাগরেদ ছিল শমসের নামে, যে চব্বিশ ঘণ্টা তার সাথে সাথেই থাকতো। এই ছেলেটাকে যে আব্দুল রফিক কোথা থেকে এনেছিল তা ঠিকমত কেউ বলতে পারত না। কারণ ছেলেটি সবসময় চুপচাপ থাকত। কেউ কেউ বলত সে নাকি লেখাপড়া জানা ছেলে। শহরে পড়ালেখাও করেছে। দেখতে শুনতে বেশ ভালো। যেটুকু কথা বলত শুদ্ধ ভাষায় বলত। লোকমুখে চালু আছে যে, ছেলেটা তার মায়ের সঙ্গে শহরে থাকত। তার পড়ালেখার খরচ নাকি আব্দুল লতিফই যোগাত। এটা একটা রহস্য বটে। কেন তিনি এই ছেলের পড়ালেখার খরচ যোগাবেন, এটা মানুষের মাথায় আসেনি। কেউ কেউ বলত, ভেতরে হয়ত কোনো গল্প আছে। কারণ ছেলেটার বাপের কথা জানা যায়নি। আবার কেউ কেউ বলত, বড়লোকের খেয়াল। হয়ত দেখে কখনো ভালো লেগেছে। নিজের ছেলের মতো দেখভাল করেছে। তবে মানুষজন দুই নাম্বারির গল্প পেলেই তা বেশি শুঁকে দেখে। তাই প্রথম ধারণাটাকেই তাদের কাছে সঠিক বলে মনে হয়।
ছেলেটার মা অসুখে ভুগে মারা যাওয়ার পরে আব্দুল রফিক তাকে গ্রামে নিয়ে এসেছে। তার সাথে থেকে ব্যবসা বাণিজ্যের কাজকর্ম শেখার জন্য।
বছরখানেক আগে আব্দুল রফিকের সাথে তার এই সাগরেদের কী নিয়ে যেন প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডা হয়। সেই ছেলেটি তাকে একপর্যায়ে খুন করে পালিয়ে যায়। তাকে ধরার জন্য চেয়ারম্যান পুরষ্কার ঘোষণা করেছে। যে সেই শমসের ছেলেটাকে ধরে আনতে পারবে সে মোটা অঙ্কের অর্থ পুরষ্কার পাবে। পুলিশও তাকে হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

হনুফা বেগম এই ক্যাঁচালের বিবরণে খুব বেশি আহ্লাদিত হলো না। সে এসব জেনে কী করবে? কোথাকার চালচুলোহীন এক ছেলে চেয়ারম্যানের ভাইকে মেরে পালিয়েছে। সেই খবর দিয়ে তার কী? কিছুটা অসহিষ্ণু গলায় হনুফা জিজ্ঞেস করল, ‘হেই পোলায় যদি খুন করে তাইলে আইজ না হোক কাইল ধরা তো পড়বোই। পলাইয়া কই যাইব? এই ক্যাঁচালও বেশি দিন টিকব না। কিন্তু… চেয়ারম্যান সাব ভাইয়ের লাইগা বেবাক কামকাইজ বন্ধ কইরা বইয়া থাগব ক্যা? হ্যায় কি তার পোলার লাইগা মাইয়া খোঁজ করে না? বিয়াশাদি দেওন লাগব না?’
হাসুবিবির এই পর্যায়ে খুব হাসি পেয়ে গেল। সে মুখ লুকিয়ে হাসতে গিয়ে বিষম খেলো। বিষয়টা হনুফা বেগমের কাছে গোপন রইল না। ভেতরে ভেতরে একটু অপমানিত বোধ করলেও সে তা হজম করে নিল। যত পারে হেসে নিক। চেয়ারম্যানের পোষ্যর সাথে বিয়ে দিয়েই এত ফুটানি দেখাচ্ছে! তার সুফিয়ার সাথে আগে চেয়ারম্যানের ছেলের বিয়েটা হোক না! তারপরে দেখবে, কে কত হাসতে পারে!

ফুলিদের বাড়ি থেকে বের হতে হতে হনুফা বেগমের বেশ দেরিই হয়ে গেল। পশ্চিমের পাড়া থেকে তাদের পাড়ায় যেতে ভালোই সময় লাগে। তার ওপরে যেতে হয় পশ্চিমের জঙ্গলের পাশ দিয়ে। এই জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেমন যেন সারা শরীর হিম হয়ে যায় হনুফা বেগমের। বিয়ের পরে থেকেই সে এই জঙ্গলের নানারকম গল্প শুনে এসেছে।
হিন্দুরা বিশ্বাস করে, এই জঙ্গলে যে কালি মুর্তি আছে সেটা নাকি এখনো জাগ্রত। আগে তাকে নরবলি দিয়ে শান্ত রাখতে হতো। নিয়মিত নরবলি না হলে সে অশান্ত হয়ে গাঁয়ে নানা অনর্থ ঘটাত। কখনো কারো ওপরে ভর করেও সে তার অপশক্তির প্রয়োগ করত।
সবই শোনা গল্প। তবু শুনলেই কেমন যেন গা ঝিম ঝিম করে। এই জঙ্গলের পাশ দিয়ে রাত বিরেতে কেউই বলতে গেলে তেমন একটা আসা যাওয়া করে না। নীরব নিস্তব্ধ জঙ্গলটা যেন জুজুবুড়ির মতো পুরো গাঁয়ের মানুষকে বশ করে রেখেছে। হনুফা বেগমের ভীষণ ভয় ভয় করতে লাগল। গল্পে গল্পে যে এতটা দেরি হয়ে গেছে, সে একেবারেই বুঝতে পারেনি।

যখন জঙ্গলের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, তখন একটা বিচিত্র জিনিস তার চোখে পড়ল।
অবিকল সুফিয়া আর জুলেখার মতো বেশবাসের দুজন মেয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে গল্প করতে করতে সেই জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। দুজনের পরনেই শাড়ি। আর তাদের দেহের আকার আকৃতি সব কিছুই হুবহু সুফিয়া আর জুলেখার মতো। কিন্তু এই ভর সন্ধ্যায় জঙ্গলের ভেতর থেকে তাদের দু’জনের বেরিয়ে আসা রীতিমত অসম্ভব ব্যাপার। এ কিছুতেই সত্য হতে পারে না।
মুহূর্তেই হনুফা বেগমের কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। এ নিশ্চয়ই কোনো অশুভ ছায়া, সুফিয়া আর জুলেখার বেশ ধরে এসে তাকে ভয় দেখাচ্ছে। অথবা আরো খারাপ কোনোকিছু। পরিচিত কারো বেশ ধরে এভাবে দেখা দেওয়ার একটাই মানে দাঁড়াতে পারে। অশুভ কোনো কিছুর নজর পড়েছে হনুফার দিকে। তাকে কাছে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এই বেশ ধরেছে সে!
হনুফা বেগম চোখ বন্ধ করে সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ছোটবেলা থেকে যত দোয়া দরুদ মুখস্থ করেছে, সব মনে মনে আওড়ে যেতে লাগল। এক পাও সামনে এগুতে পারল না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, যদি একবার এই বিপদ থেকে রেহাই পায়, তাহলে জীবনে আর কোনোদিন কারো পিছে লাগবে না। এখন থেকে জুলেখাকে মায়ের নজরে দেখবে। ফুলির দিকে হিংসার নজর লাগাবে না। যত ভালো ভালো কাজ আছে, এখন থেকে সব সে করবে। শুধু একবার এই অশুভ বস্তুর ছায়া তার সামনে থেকে যেন সরে যায়।
দীর্ঘসময় পরে সভয়ে চোখ খুলে পিটপিট করে এদিক সেদিকে চাইল। এবার আর সামনে কাউকে দেখতে পেল না।
আর এক মুহূর্ত দেরি না করে হনুফা বেগম প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতেই পশ্চিমের পাড়া ছাড়িয়ে এলো। আগের প্রতিজ্ঞার কথা এর মধ্যেই সে একটু একটু ভুলেই গেছে। নতুন করে আরেকটা প্রতিজ্ঞা করল, আর কোনোদিন বিকেলের পরে সেই জঙ্গলের পাশ দিয়ে আসবে না।
আজ বলতে গেলে একটুর জন্যই সে প্রাণে বেঁচে গেছে। (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে