#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_চার
দিনের বেলা ঘুমানোর অভ্যাস নেই হনুফা বেগমের।
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে সে গিয়েছিল পশ্চিমের পাড়ায় বেড়াতে। সেখানে হাসুবিবির মেয়ে ফুলি পোয়াতি হয়েছে। সে তার বাপের বাড়ি নাইওর এসেছে। ফুলির অনেক বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে। ওদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাহেবের শ্যালকের সাথে বিয়ে হয়েছে ফুলির।
ফুলির বাপ সামান্য মুদি দোকানদার। সে এত বড় ঘরে মেয়ের বিয়ে দিতে পেরে একেবারে বর্তে গেছে। খুশিতে সারা গাঁ দাওয়াত দিয়েছিল নিয়াজ উদ্দীন। মেয়ের এই অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্য সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না। তাদের গ্রামের বড় আড়তদার রফিক উদ্দীন সেই বিয়ের দাওয়াতে এসে ফুলিকে গলার আর কানের সোনার সেট উপহার দিয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেব তার বন্ধু মানুষ। তার শ্যালক বউকে কি যেমন তেমন উপহার দেওয়া যায়?
ফুলির এত ভালো ঘরে সন্মন্ধ আসায় হনুফা বেগম স্বামীর সাথে গাল ফুলিয়ে বসে ছিল। তিনদিন ভাত খায়নি সে। তার মেয়ে সুফিয়া আর ফুলি প্রায় পিঠাপিঠি বয়সের। সুফিয়ার বয়স কয়েকমাস বেশিই হবে। ফুলি দেখতে এমন কিছু আহামরি নয়। পাশাপাশি দাঁড় করালে সুফিয়াকেই বেশি ধলা দেখায়। অথচ ফুলির কত বড় ঘরে বিয়ে হয়ে গেল। আর এদিকে সুফিয়ার বিয়ে নিয়ে তার বাপ নেয়ামত উল্লাহর কোনো মাথাব্যথাই নেই। নেয়ামত উল্লাহ বউকে অনেক কিছু বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠান্ডা করার চেষ্টা করেছে।
‘ফুলির তো বিয়া হইছে চেয়ারম্যানের শালার লগে। চেয়ারম্যানের পোলার লগে তো আর হয়নি! হের শালা তিনবার মেট্রিক পরীক্ষায় ফেল করছে। দুলাভাইয়ের বাড়িত থাইকা খায় দায়। কাম কাইজ কিছুই করে না। তুমি কি হের লগে তুমার মাইয়ার বিয়া দিতা? তুমার মাইয়ার মাথায় এত বুদ্ধি!’
হনুফা বেগম মুখ ঝাংটানি দিয়ে বলে, ‘রাখেন আপনার বুদ্ধি! ঐ বুদ্ধি ধুইয়া কি হেই পানি খাইবোনি? ভালা বিয়া না হইলে ঐ বুদ্ধি কুনো কামেই আইবো না!’
নেয়ামত উল্লাহ্ আর জুলেখার প্রসঙ্গ টানে না। এই সময়ে জুলেখার কথা শুনলেই হনুফা বেগম রাগে উন্মাদ হয়ে যাবে। জুলেখার বিয়ের জন্য আর একদিনও অপেক্ষা করতে রাজি নয় হনুফা। ঐ কালো মেয়ের জন্য তার সুফিয়ার এত ভালো ভালো প্রস্তাব সব ফসকে গেছে। ভালো ছেলে কি এত দিন অপেক্ষা করে নাকি? তাদের জন্য মেয়ের বাপেরা সব লাইন দিয়ে রাখে। এক জায়গায় না হলেই আরেক জায়গায় ঠিকঠাক হয়ে যেতে সময় লাগে না।
হনুফা বেগমও এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। বড় ঘরে সে তার মেয়ের বিয়ে দিয়েই ছাড়বে! এজন্য যত কাঠখড় পোড়ানোর প্রয়োজন হয়, সে পোড়াতে রাজি আছে। তবু যেনতেন ভাবে মেয়ের বিয়ে দিবে না। নিজের বাপে তাকে দোজবরে বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব চুকিয়ে দিয়েছে। সে তার মেয়েকে রাজার ঘরে বিয়ে দিয়ে এর প্রতিশোধ নেবে।
ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ সাহেবের দুই ছেলে। বড় ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছোটটা এখনো অবিবাহিত। হনুফা বেগমের মনে মনে তীব্র ইচ্ছা, চেয়ারম্যানের এই ছোট ছেলের সাথে তার মেয়ে সুফিয়ার বিয়ে দেওয়ার। তার মেয়ের মতো গায়ের রঙ ক’জন মেয়ের আছে? সুফিয়াকে যে ই একবার দেখে, সেই তাকে পছন্দ করে ফেলে। তার স্বামী সামান্য কাঠমিস্ত্রী, এটাই যা একটু বাধা। তবু একবার যদি চেয়ারম্যানের ছেলে তার মেয়েকে পছন্দ করে ফেলে তাহলেই কাজ হয়ে যাবে, এই ব্যাপারে হনুফা মোটামুটি নিশ্চিত।
ফুলির বাপের বাড়ি নাইওর আসার খবর পেয়ে সেজন্যই হনুফা বেগম তাড়াতাড়ি তাকে দেখতে এসেছে। খালি হাতে আসেনি, একটু পায়েস রান্না করে নিয়ে এসেছে। ফুলিকে হাতে রাখা দরকার। সে চেয়ারম্যানের শ্যালক বউ। থাকেও ঐ বাড়িতেই। কাজেই ফুলিকে সন্তুষ্ট রেখে এগুতে পারলে অর্ধেক কাজ হয়ে যায়।
ফুলির মা হাসুবিবি কুমড়োর বিচি ছাড়িয়ে কুচোচ্ছিল। তার মেয়ে ফুলি কুমড়ো ডালের বড়ি খেতে খুব ভালোবাসে। রুই মাছের পাতলা ঝোলের সাথে কুমড়ো বড়ি আর টমেটো শিম নতুন আলুর তরকারি। বাপের বাড়িতে পা দিয়েই সে মায়ের কাছে কুমড়ো বড়ি খাওয়ার আবদার করেছে।
হনুফা বেগমকে আসতে দেখেই হাসুবিবি মনে মনে বিরক্তি গোপন করলো। মেয়েটাকে এখন আর শান্তিতে তিষ্টোতে দেবে না। এসেই দুনিয়ার হাজার প্যাঁচাল আর প্রশ্ন দিয়ে ছ্যাড়াব্যাড়া করে মারবে। আলগা আদরের বান ডাকবে। অথচ ফুলির বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে থেকেই হনুফা বেগমের মনের সুখ উধাও হয়ে গেছে। এটা সে গোপন করার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত আর গোপন থাকেনি। হনুফা বেগম এই বিয়েতে ভাংচিও দিতে চেয়েছিল। ফুলির স্বভাব চরিত্র ভালো না, দেখতে অসুন্দর এমন নানারকম কথা সে প্রচার করে বেড়াত।
তার মেয়েটার সুখ দুইচোখে দেখতে পারে না এই হনুফা। ফুলির এত বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। আজ মেয়েটা পোয়াতি হয়ে বাপের বাড়ি এসেছে। না জানি এখন আবার সে কোন মতলবে এই বাড়িতে এসেছে!
হনুফা বেগম আড়চোখে একবার ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে একগাল হাসি নিয়ে এগিয়ে গেল হাসুবিবির দিকে।
‘ও বু, ডাইলের বড়ি বানাইবা নি?’
‘হুম। তুমি এই অসময়ে, কী ব্যাপার? কুনো কামে আইছ?’
‘শুনলাম ফুলি আইছে, তাই দ্যাখবার আইলাম।’
হাসুবিবি মনে মনে টিটকারি মারলো, ‘দ্যাখবার আইলা…নাকি অন্য কুনো মতলবে আইলা!’
মুখে বললো, ‘ভালা করছো। তুমার মাইয়াগো খবর কী? বিয়া শাদি ঠিকঠাক হইলো কিছু?’
এই প্রশ্নে হনুফা বেগমের মুখ কালো হয়ে গেল। প্রশ্নটা ঠিক প্রশ্ন বলে মনে হলো না। একটু যেন খোঁচা মারার মতো মনে হলো। তবে এখন তপ্ত হলে চলবে না। এখন সে যথাসম্ভব ভাব বজায় রেখে চলতে চায়। মুখটাতে কষ্টের ছায়া ফুটিয়ে তুলে বললো, ‘নাগো বু, বিয়া ঠিক হইলে তো জানবারই পারতা! আমার মাইয়ার বিয়া তো আমি আইজই দিবার পারি। ঐ যে পোড়ারমুখি হাড় জ্বালানী আমার মাইয়ার সুখের পথে কাঁটা…খাড়াইয়া আছে না? হ্যারে আগে বিয়া না দিয়া তো আর মাইয়ার বিয়া দিবার পারি না!’
হাসুবিবির জুলেখার মায়ের কথা মনে পড়লো। জুলেখার মাকে এই গ্রামের সবাই খুব পছন্দ করতো। একেবারে পানির মতো ঠান্ডা নিরীহ প্রকৃতির এক মানুষ ছিল সে। তার মেয়েটাও হয়েছে পুরোপুরি মায়ের মতোই। অথচ এমনই দুর্ভাগ্য! পড়েছে কী না হনুফা বেগমের মতো এক খাণ্ডারনীর কবলে! ঐ মেয়েটার কপালে আর সুখ জুটবে কী না কে জানে!
হনুফা বেগম উশখুশ করে বলে, ‘ও বু, ফুলির শশুরবাড়ির মাইনষে কেমুন? ফুলিরে কি আদর যত্ন করে?’
‘ফুলি তো কয় করে। সুময়মতো বাপের বাড়ি নাইওর আইবার দিছে। হগগলে তো আর দেয় না! তাই না? কী কও তুমি?’
‘হ, তা তো ঠিকই!’
তারপরে উচ্ছ্বাসমাখা গলায় বলে, ‘ফুলির লাইগা এট্টু পায়েস আনছিলাম। তুমার মাইয়া না পায়েস খাইতে ভালাবাসে…কইছিলা একদিন!’
কবে এই কথা বলেছিল সে, তা হাসুবিবির মনে পড়লো না। তবে সে পায়েসের ডিব্বাটা হাত বাড়িয়ে নিল। যার যা কিছুই মতলব থাকুক না কেন, ভালোবাসার সামান্যতম নিদর্শনও পায়ে দলতে নেই। এটা সে তার নিজের জীবন দিয়ে টের পেয়েছে। ফুলিকে ডাক দিয়ে বললো, ‘ও ফুলি, মা এট্টু উঠানে আইয়া বয়। তর হনুফা চাচি আইছে। পায়েস আনছে তর লাইগা।’
মায়ের ডাক শুনে ফুলি বহুকষ্টে শরীরটাকে একরকম টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। গর্ভবতী হয়ে সে বেশ মোটা হয়েছে। দিনরাত শুধু খেতে ইচ্ছে করে। অনেকে নাকি এই সময়ে একেবারেই খেতে পারে না। রুচি কমে যায়। তার হয়েছে উলটো। রুচি যেন ধাই ধাই করে বেড়ে গিয়েছে। হাতের কাছে খাবার দাবার কিছু না থাকলে গাছের পাতা ছিঁড়ে কচ কচ করে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।
হনুফা চাচিকে দেখে সেও মনে মনে শঙ্কিত হলো। মতলব ছাড়া হনুফা চাচির তার কাছে আসার কথা নয়। এই মহিলার কারণে শশুর বাড়িতে প্রথম দিকে সে ভালোই হুজ্জোত সামলিয়েছে। তার স্বভাব চরিত্র নিয়ে কম আজেবাজে কথা রটায়নি এই হনুফা চাচি। সেটার কারণও তাদের গ্রামের সবাই জানত। কিন্তু শশুরবাড়ির লোকজনেরা কি এতকিছু জানে? নাকি বোঝে? তাই তারা প্রথমদিকে ফুলিকে খুব চোখে চোখে রাখত। সবকিছুতে সন্দেহ করত।
ফুলি আর হনুফা চাচির মেয়ে সুফিয়া ছোটবেলা থেকে একসাথেই বড় হয়েছে। দুই সখী ছিল তারা। তবে নয় দশ বছর বয়স হওয়ার পরে থেকেই দুজনের পথ অনেকটা অন্যরকম হয়ে গেছে।
ফুলি মোটেও লেখাপড়া করতে চাইত না। আর সুফিয়া ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় খুব ভালো। গ্রামের মেয়ে যে অঙ্কে এত ভালো হতে পারে, তা সুফিয়াকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করত না। যেকোন অঙ্কই সে ঘসঘস করে কষে ফেলে। কীভাবে এত অঙ্ক পারে এই প্রশ্ন করলে সুফিয়া বলত, ‘আমি কচু শাক খাইতে ভালাবাসি। তাই অঙ্কের মাথা ভালা। হি হি হি…’
একসময় ওদেরও বিশ্বাস জন্মে গেল, নিশ্চয়ই এটাই তবে কারণ! কচুশাক খাওয়ার কারণেই সুফিয়া এত ভালো অঙ্ক পারে।
ওদের অঙ্কের স্যার তো বলতেনই সেই কথা, ‘তরা সবাই সুফিয়ার কাছে অঙ্ক শিখবি। আর ওর মতো কচুশাক খাইবি!’
সুফিয়ার অনেক পড়ালেখা করার ইচ্ছা। সে কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চায়। বড় চাকরি বাকরি করতে চায়। ফুলি জানে, সুফিয়া যা বলছে তা সে করে ছাড়বেই। ওর মতো জেদি মেয়ের পক্ষে সবই সম্ভব।
ওরা গ্রামের মেয়েরা যেসব ভাবনা চিন্তা নিয়ে মেতে থাকে, সুফিয়াকে সেগুলো একেবারেই আকর্ষণ করে না। বিয়েশাদি নিয়ে সুফিয়ার নিজের যে কোনোরকমের মাথাব্যথাই নেই, এটা ফুলি ভালোমতই জানে। ভালো কোনো প্রস্তাব এলেও সুফিয়াকে কিছুতেই বিয়েতে রাজি করানো যাবে না। অথচ সুফিয়ার মা, মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য রীতিমত অস্থির হয়ে উঠেছে। অন্যের ভালো বিয়ে হতে দেখলেই ঝামেলা পাকানোর তালে থাকে।
হনুফা বেগমকে দেখে বিরক্ত হলেও পায়েশ দেখে খুবই খুশি হয়ে উঠল ফুলি। অন্যসময় পায়েশ দেখলে সে ছুঁয়ে দেখত কী না সন্দেহ। কারণ দুধের কোনো খাবার সে একেবারেই পছন্দ করে না। কিন্তু এখনকার কথা আলাদা। আগে যা কখনো খেতেই পারত না, এখন সেইসব খাবারদাবারই অমৃতের মতো লাগছে! পেটে কি রাক্ষস বেড়ে উঠছে কী না কে জানে!
ফুলি চামচ না এনে হাত দিয়েই হাপুসহুপুস করে পায়েশ খেতে শুরু করে দিল।
হাসুবিবি মেয়ের এই আদেখলাপনায় একটু বিরক্ত হলো। মেয়েটা কেমন যেন হাভাতের মতো করে খাচ্ছে। এত বেশি খেতে থাকলে তো পেটের বাচ্চা বেশি বড় হয়ে যাবে। শেষে প্রসবে কষ্ট হবে। অবশ্য এখন তো ঘরে ঘরে যেসব স্বাস্থ্যকর্মীরা আসে, তারা ভিন্ন কথা বলে। এসময় নাকি যত খাওয়া যায়, ততই গর্ভের বাচ্চার জন্য ভালো। অথচ তাদের মা- শাশুড়িরা তো তাদের বাচ্চা বড় হওয়ার ভয়ে ঠিকমত খেতেই দিতে চাইত না। দিনকাল বদলে গেছে। তারা যা বিশ্বাস করত, এখন সেসব আর ধোপে টেকে না!
ফুলির খাওয়াতে তার আপত্তি নেই। কিন্তু যেভাবে ফেলেছেড়ে খাচ্ছে মেয়েটা, দেখতে কেমন যেন অরুচিকর লাগছে। আর খাচ্ছে তো খাচ্ছে…সেটাও আবার হনুফা বেগমের সামনে! এটা নিয়ে সে আবার কী কথা বলে বেড়াবে বাইরে, কে বলতে পারে!
হাসুবিবি মেয়েকে মৃদু ভৎসনা মাখা গলায় বলল, ‘ঐ ফুলি আইস্তে খা। এমনে খাস ক্যা?’
হনুফা বেগম গলায় আলগা কপট স্নেহের ঢেউ তুলে বলল, ‘আহা, খাউক না বু। অহনই তো খাইব! আমরা খাইছি না এই সুমোয়ে! কয় মাস হইলো বু?’
‘ছয় মাসে পড়ছে।’
হনুফা বেগম সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল ফুলির পেটের দিকে। এই পেটকে তো ছয় মাসের পেট বলে মনে হচ্ছে না! দেখে মনে হচ্ছে সামনের মাসেই বিয়োবে। (ক্রমশ)
#ফাহ্মিদা_বারী