#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_দুই
তেমনই এক ঘটনা গত বছর ঘটেছিল, গ্রামের কৃষক হাফিজুদ্দিনের মেয়ে রেহানার সাথে।
ঘটনা যে কবে ঘটেছিল আর কীই বা ঘটেছিল কেউই আগেভাগে কিছু জানতেও পারেনি। সবকিছুই চলছিল ঠিকঠাক। জানতে পারলো সেদিন, যেদিন সামনে এলো যে রেহানা অন্তঃসত্তা। তারপরে একে একে বেরিয়ে এলো সেদিন কী কী ঘটেছিল তার সাথে। ধর্ষিতা হওয়ার পরেও বাঁচতে পেরেছিল রেহানা। কতই বা বয়স তার! কতটুকুই সে দেখেছে জীবনের! এত তাড়াতাড়ি কেন অন্যের পাপে সে তার জীবনাবসান ঘটাবে?
কিন্তু ঘটনা সামনে আসার পরের লজ্জা সে আর নিতে পারেনি। গাঁয়ের লোক হাজার অকথা কুকথা শুনিয়ে তার জীবন জেরবার করে দিয়েছে। যারা তাকে ধর্ষণ করেছে, তাদের শাস্তি দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তারা। কিন্তু সব দোষ রেহানার দুর্বল কাঁধে চাপাতে বিন্দুমাত্র পিছপা হয়নি। লজ্জায় অপমানে রেহানারও আর বাঁচা হয়নি। ক্ষেতের মাঝখানে এক বড় আমগাছের ডালের সাথে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছে সে।
সেই গাছটি দাঁড়িয়ে আছে ওদের গ্রামের একেবারে মাঝখানে। সেই রাস্তা দিয়েই গ্রামের প্রতিটি মানুষ আসা যাওয়া করে। রেহানা প্রতিটি চোখের সামনে নিজেকে ঝুলিয়ে রেখে সবাইকে অপরাধী বানিয়ে গেছে।
অল্প কিছুদিন এটা নিয়ে গ্রামে একটা হৈ চৈ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ধামাচাপা পড়ে যেতেও সময় লাগেনি। প্রতিদিন কত অজস্র ঘটনা ঘটে! একটা ঘটনা নিয়ে বসে থাকলে তো আর দিন চলে না। মানুষ তাই কোনোকিছুই বেশিদিন মনে রাখতে চায় না। শুধু যার যায়, একা একা তাকেই সে শোক সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়।
এই ভর সন্ধ্যাবেলায় কুলক্ষণের মতোই সেই ঘটনাটি মনে পড়ে গেল জুলেখার। রাগ রাগ চোখে সুফিয়ার দিকে তাকালো সে। সুফিয়ার ভাবভঙ্গি কিন্তু নির্বিকার। উদাসীন দৃষ্টি মেলে চারপাশে দেখতে দেখতে হাঁটছে সে। গুনগুন করে আবার কীসের যেন সুরও ভাঁজছে। তাকে একটা কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো জুলেখা। তার নিজের ভয়টা আর সুফিয়ার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে মন চাইলো না।
আজ সকাল থেকেই জুলেখাকে বলে রেখেছিল সুফিয়া। ‘বুবু, আইজ একবার পশ্চিমের ঝাড়ের ঐদিকটায় যামু। তুমি আর আমি। ঐদিকটাত না ম্যালা লটকন, করমচা ধইরা আছে। এই এত্ত এত্ত! ঝোপের মইধ্যে। কেউ জানেও না!’
সুফিয়ার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়েছিল জুলেখা।
সুফিয়া জানে, বুবু তার কোনো কথাই ঠেলতে পারবে না। তার ছেলেমানুষি আহলাদ গুলো সবসময়ই আলাদা প্রশ্রয় পায় জুলেখার কাছে। সুফিয়ার জন্য তার মনের ভেতরে কুলকুল বয়ে চলা শীতল পানির ধারাটা কখনোই শুষ্ক হয় না। জুলেখার কাছে পুরো পৃথিবী যদি দাঁড়িয়ে থাকে একদিকে, তবে সুফিয়া আরেকদিকে।
আর কেউ তো জুলেখার খাওয়ার সময় কাছে এসে কখনো জিজ্ঞেস করে না,
‘ও বুবু, এক টুকরা মাছ আইনা দিই? চিন্তা কইরো না, পাতিল থাইকা আনুম না। আমি রাইখা দিছি, তুমার লাইগা!’
জুলেখার হাজার নিষেধেও সুফিয়া কথা শোনে না। তার আদরের বুবুকে সে সবসময় চোখে চোখে রাখে। তার মা, বুবুকে দু চক্ষে দেখতে পারে না। দিনরাত গালমন্দ করে। পান থেকে চুন খসার জো নেই। সারাদিন ঘরের সব কাজ বুবুকে দিয়ে করিয়ে নিয়েও মায়ের শান্তি হয় না কোনো। কীসের যেন তীব্র আক্রোশে জ্বলে পুড়ে মরে সারাক্ষণ।
মায়ের বকাঝকার মাঝপথে সুফিয়া বেমক্কা কিছু একটা বলে বসে বোনকে বাঁচিয়ে দেয়। এমনটা সে অনেকদিন করেছে। প্রথমদিকে সুফিয়ার মা মেয়ের এই চালাকি ধরতে পারতো না। এখন জুলেখাকে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তার মা সুফিয়াকে সাবধান করে দেয়, ‘খবরদার কইছি, কতার মাইঝখানে যদি সান্ধাইছোস তয় ভুইলা যামু তুই আমার প্যাটের মাইয়া!’
সাবধান বাণীতে বিশেষ একটা কাজ হয় না। সুফিয়া নিত্য নতুন ফন্দি এঁটে তার মাকে ভালোমতই পরাস্ত করে ফেলে। তার মাকে সে মোটেও সুবিধা করতে দেয় না।
জুলেখা তার বোনের এইসব ছলচাতুরি বুঝতে পেরে মুখ টিপে হাসে। সৎ মায়ের বকাঝকা তখন আর একটুও গায়ে লাগে না। সেই মুখ টিপে হাসি দেখে তার সৎ মায়ের গনগনে রাগ আরো তেতে ওঠে। ঝাঁঝিয়ে ওঠে দ্বিগুণ ক্ষোভে, ‘পোড়ারমুখী! নিজের মায়েরে খাইছস, আমার সংসারের শান্তি নষ্ট করছস…ওহন আইছস আমার মাইয়ার জীবন নষ্ট করতে! আমার নিজের প্যাটের মাইয়ারে তাবিজ করছস! তুই কী ভাবছোস আমি বুঝি না কিছু?’
এমন সময়ে সুফিয়া কঁকিয়ে ওঠে, ‘ও মা গো, ওরে আল্লাহ গো! প্যাট ব্যথায় মইরা গ্যালাম। মনে হয়, তাবিজের আছর। গ্যালাম গা প্যাট ব্যথায় শ্যাষ হইয়া গ্যালাম। ও বু, তাবিজ করছো যহন…অহন শ্যাক দিয়া ব্যথা ভালা কইরা দাও। ওরে বাবারে…মইরা গ্যালাম…
মুহূর্তেই থেমে যায় সৎ মায়ের মুখের মেশিন। সাথে সাথে ব্যস্ত হয়ে ওঠে মেয়ের শুশ্রুষায়,
‘কী হইছে রে মা, প্যাট কি হাছাই বেশি ব্যতা করতাছে?’
‘হাছা না তো কি মিছা কতা কইলাম? শ্যাক দিবার কও। খাড়াইয়া থাগবার পারতাছি না!’
জুলেখার দিকে তাকিয়ে আবার চিৎকার দেয় তার সৎ মা, ‘ওহনো খাড়াইয়া আছোস? হুনলি না?’
ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণের জন্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল জুলেখা। বোকার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, সত্যি সত্যিই কি সে কোনো জাদুটোনা করলো নাকি সুফিয়ার ওপরে?
সৎ মায়ের ধমক শুনে বোনের দিকে চাইতেই জুলেখা এক মুহূর্তেই সব বুঝে গেল। পটপটিয়ে বার কয়েক চোখ মেরে সুফিয়া মটকা মেরে মেঝেতে পড়ে রইলো। জুলেখা প্রাণপনে হাসি চেপে হারিকেন জ্বালাতে যায় স্যাক দেবার জন্য। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে তার হাসি একান ওকান হয়। কী পাজি মেয়েরে বাবা! পেটে পেটে এত বুদ্ধি!
সেই বোন কিছু একটা আবদার জানালে যত দুঃসাধ্যই হোক, জুলেখার তা রাখা চাইই চাই। যদিও কপট শাসন টুকুও করতে হয়।
অত দূরে যাওয়ার প্রস্তাবে সে মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘খ্যাপছোস তুই? ওদ্দুরে যাবি! আর ঐ জঙ্গলে? তুই জানস না সেই জঙ্গলের গপ! কেউ যায় হেইখানে? মায়ে জানবার পারলে দুইজনের কারোরই হাড়হাড্ডি আস্ত থুইবো না!’
‘মাইনষে যায় না আজাইরা ডরে। তুমি ডরাও এইসব হুদার গপে? আরে মায়ে জানবার পারলে তো!’ তারপরেই ঠোঁট ফুলিয়ে বলেছিল, ‘তুমি যাইবা নাকি কও! নাইলে কইলাম আমি একাই যামু!’
এরপরে আর ওজর আপত্তি চলে না। কারণ, জুলেখা জানে সে রাজি না হলে সুফিয়া সত্যি সত্যিই একা একাই চলে যাবে। এই মেয়ে যেন কেমন হয়েছে! ভয়ডর বলে কিচ্ছু নেই। আর ভীষণ জেদ। যা করতে চায় আজ হোক অথবা কাল, সেটা সে করেই ছাড়ে। পড়াশুনা করে, মাথার বুদ্ধিশুদ্ধিও পরিষ্কার। বাড়ির আর কেউ তার সাথে বুদ্ধিতে এঁটে উঠতে পারে না।
এটা ওটা নানান কথা বলে সুফিয়া তার বোনকে বুঝিয়েই ছাড়ে যে, জঙ্গলে মোটেও ভয়ের কিছু নেই। এগুলো সব গাঁয়ের লোকের মিথ্যে কুসংস্কার। জুলেখা বোকা সোকা নরম মনের মেয়ে। সুফিয়ার যুক্তির কাছে সে অতি সহজেই পরাস্ত হয়।
তাই দুপুরের একটু পরেই দু’বোনে চলে এসেছিল পশ্চিমের ঝাড়ে।
ঘন ঝোপঝাড় আর বড় বড় গাছ গাছালিতে ঢাকা এই জায়গাটি তাদের গ্রামের একেবারে শেষ মাথায়। অনেক গাছপালা থাকা সত্ত্বেও এদিকটাতে কেউ তেমন একটা আসে না। সাপ খোপের আখড়া জায়গাটা।
জঙ্গলের ভেতরে অনেক পুরনো একটা কালী মন্দির আছে। সেখানে একটা বিগ্রহও বসানো আছে। কেউ অবশ্য এখন আর পুজো আর্চা করতে আসে না। ছোট বাচ্চাদের মধ্যে এদিকটাতে ভূতের গল্পও চালু আছে। সেজন্যই চোর ছ্যাচড় ছাড়া এই ঘন জঙ্গলে কারোরই পায়ের ছাপ পড়ে না বলতে গেলে।
ঘন জঙ্গল ছেয়ে আছে নানারকম গাছপালায়। ফলের গাছই যে আছে কত রকম! সেসব গাছে ফল ধরে পেকে টসটসে হয়ে থাকে। পাখি খেয়ে শেষ করতে পারে না। বাদুড়, কাঠবেড়ালী, বানর…সবাই মিলেমিশে খায়। নীচে পড়ে থাকে এত্ত এত্ত। তবু কেউ সেসব ফল ছিঁড়তে আসে না। কালী মন্দিরটাকে লোকে খুব ভয় পায়। এক কালে নাকি এখানে নরবলি হতো।
সেসব অবশ্য অনেক পুরনো কথা। গাঁয়ের বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে মুখে প্রচলিত সেসব গল্পগাঁথা শুনে শুনে বড় হয়ে ওঠা তরুণ, প্রৌঢ়রাও আর এই পথ তেমন একটা মাড়ায় না। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা ফাগুন সব ঋতুতেই এই ঘন জঙ্গল পড়ে থাকে একা একা…তার অদ্ভুত রহস্যময়তাকে সঙ্গী করে।
সুফিয়ার কথা শুনে জুলেখা এসেছে ঠিকই, কিন্তু জঙ্গলে পা দিয়েই তার বুক দুরুদুরু কাঁপতে শুরু করে দিল। ছোটবেলা থেকেই এই কালীমন্দিরের কত যে গল্পগাঁথা শুনেছে সে! প্রতি ছ’মাসে নাকি এই মন্দিরে একটা করে নরবলি না হলে গাঁয়ের লোক শান্তিতে থাকতে পারতো না। একটা কিছু না কিছু অনর্থ লেগেই থাকতো গ্রামে। প্রচলিত আছে, সেই কালী নাকি এখনো জাগ্রত। দীর্ঘদিন নরমুণ্ডু না পাওয়ার আক্রোশ সে এখনো ভোলেনি। সেই জঙ্গলের ভেতরে কাউকে দেখতে পেলে এখনো সে যেকোন সময় তার বিধ্বংসী রূপ নিয়ে দেখা দিতে পারে।
কালের পরিক্রমায় গাঁয়ে হিন্দু বসতি কমে গিয়েছে। দেশভাগের পরে অনেক হিন্দুই বাক্স পেঁটরা নিয়ে পার্শবর্তী দেশে চলে গিয়েছে। এখন দু’একটি বাদে গাঁয়ে আর কোনো হিন্দু বাড়ি নেই বললেই চলে। ধর্মীয় বিশ্বাসের সেই জায়গাটা হারিয়ে গেলেও গল্পগুলো এখনো লোকের মুখে মুখে ফেরে। শোনা সেসব গল্পের সত্য মিথ্যা যাচাই করে দেখবার মতো সাহসী লোকের গাঁয়ে বড়ই অভাব। কেউই সেই জঙ্গলে যাওয়ার তেমন একটা প্রয়োজন দেখে না।
জুলেখা একবার ভেবেছিল ফিরে যাবে। দরকার নেই এই জঙ্গলের ভেতরে ঢোকার। ওরা দু’বোন হারিয়ে গেলে কেউ কোনদিন জানতেও পারবে না। বার কয়েক ঢোক গিলে সুফিয়াকে বলেছিলও সে, ‘ও সুফিয়া, চল চইলা যাই বইন। কাইজ নাই এই জঙ্গলে ঢুইকা!’
সুফিয়ার চোখেমুখে তখন ঝিকমিক করছে কৌতুহল আর আগ্রহ। ফিরে যাওয়ার জন্য সে মোটেও আসেনি। জুলেখার কথায় তাই কটমট চোখে তাকিয়ে বলেছে, ‘তুমি কেমুন মানুষ গো বুবু! আজাইরা ভয় পাও। গাঁয়ের মাইনষের আক্কেল বুদ্ধি কম, তাই এমুন জায়গায় পা দেয় না। দেখছো কত ফল পাকুড় ধইরা আছে! আইজ আঁচল বাইন্ধা লইয়া যামু।’
তা অবশ্য ভুল কথা নয়। ফলফলারী ধরে আছে প্রচুর। গাছগুলো ফলের ভারে একেবারে নুয়ে পড়েছে। লটকন, করমচা, জলপাই, চালতা, পেয়ারা, বাতাবী লেবু…কীসের গাছ নেই এখানে? সুফিয়া চুক চুক করে বললো, ‘বেজায় ভুল হইয়া গ্যাছে! একটা থইলা নিয়া আসোন লাগতো! খালি কোঁচড়ে ভইরা কয়টা লইয়া যামু?’
জুলেখার ভয় তখনো কাটতে চায় না। অন্য ভয় না থাকুক, সাপ খোপ যে এই জঙ্গলে অগুনতি আছে তা তো আর বলে দিতে হয় না। ফল পাড়তে এসে শেষমেষ বেঘোরে প্রাণটা না যায়! আর তাছাড়া আসল ভয় তো আছেই! তার সৎ মা’র ভয়। দুইবোনের এই পশ্চিমের ঝাড়ে এসে ফল পাড়ার খবর বাড়িতে চাওড় হলেই আর দেখতে হবে না। তারা যদি সুস্থ শরীরে সব হাত পা অক্ষত রেখে ফিরতেও পারে, তবু বাড়িতে গিয়ে কী জবাব দেবে কে জানে! খড়গটা তো এসে পড়বে জুলেখার ঘাড়েই।
তবু জঙ্গলের ভেতরে এমন শুনশান নিস্তব্ধতার মাঝে এসে সম্পূর্ণ ভিন্নরকম একটা ভালোলাগা এসেও আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল জুলেখার মনকে। কত সারি সারি গাছ এখানে! কী লম্বা সেসব গাছের ডালপালা! যেন আকাশ ছুঁতে চায়। সেসব গাছের ফাঁক গলে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে শেষ বিকেলের আলো।
যদি সত্যিই এখানে ভয়ের কিছু না থাকে, তাহলে গাঁয়ের লোক এমন একটা গাছগাছালি ভর্তি জঙ্গল পেয়েও কেন এভাবে ফেলে রেখেছে? কেন সেটাকে নিজেদের কাজে লাগাচ্ছে না? এসব গাছের খুচরো ডালপালা আর ফলফলারি বিক্রি করেই তো কত লোকের ভাগ্য খুলে যেতে পারে! স্রেফ ভয়ের কারণেই এমন একটা জায়গাকে সবাই দূরে সরিয়ে রেখেছে? গ্রাম্য কুসংস্কার বড় সাংঘাতিক বস্তু। একবার যদি এটা ছড়াতে থাকে, তাহলে তার গতি রোধ করা সত্যিই মুশকিল।
বনে ঘুরতে গিয়ে দুজন ক্লান্ত হয়ে পড়লো। বন জঙ্গলের পথঘাট তো আর ঘাসে ঢাকা মসৃণ নয়! গাছ গাছালির কাঁটাওয়ালা ডাল আর ইট পাথর কাঁকড় নুড়িতে চারপাশ ভরা। দু’বোনের কারোর পায়েই স্যাণ্ডেল নেই। গ্রামের পথঘাটে তারা খালি পায়েই চলাফেরা করে। জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে দু’জনেরই পায়ের নীচটা কেটে ছিঁড়ে একসা হলো।
গাছ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে ফল পাকুড় পেড়ে আর ইচ্ছেমত কোঁচড় বোঝাই করতে গিয়ে শরীরের শক্তিও প্রায় ফুরিয়ে গেল। সুফিয়া গাছের নীচে বসে পড়লো হাত পা ছড়িয়ে। জুলেখা ততক্ষণে ভয়কে জয় করে জঙ্গলের সৌন্দর্য আস্বাদনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পাতার ফাঁক গলে শেষ বিকেলের আলো এসে তখন ঘিরে নিয়েছে চারপাশ। সেই অপূর্ব দৃশ্যটা তখনই চোখে পড়ে যায় জুলেখার।
জঙ্গলের শেষপ্রান্তে এসে সে দেখতে পায়, সামনে ধু ধু ফসলের মাঠ। সোনা রঙা ফসলের চাদরে মুড়ে আছে পুরোটা মাঠ। পশ্চিমের আকাশে টকটকে লাল সূর্যটা নেমে এসেছে অনেকটা নীচে। চারদিকে মায়াবী শেষ বিকেলের স্নেহভরা আলোর আলিঙ্গন।
এই আলোর পরশ পেলেই জুলেখার মনে হয় যেন মা এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেল তাকে। চোখেমুখে সে যেন মায়ের আদরমাখা পরশকে অনুভব করতে পারে।
জঙ্গল থেকে বেরিয়েই সব দুর্ভাবনা পালা করে ছেঁকে ধরছিল জুলেখাকে। আজ বোনের সাথে সাথে ওকেও বুঝি ভূতে পেয়েছিল। এখন ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরতে পারলে হয়! চোখ কান খোলা রেখে সামনে পেছনে ডানে বাঁয়ে দেখতে দেখতে দ্রুত পায়ে হাঁটছিল সে। দু’বোনের কোঁচড় ভরা লটকন, জলপাই, জামরুল আর করমচা। সেগুলো সামলে নিয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটতে বেশ ভালোই বেগ পেতে হচ্ছিলো ওদের। হঠাৎ কী মনে হতেই জুলেখা সন্দেহসূচক চোখে তাকায় সুফিয়ার দিকে। রাগ রাগ গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘হাছা কইরা ক দেখি, তুই এইহানে আগেও আইছস ঠিক না?’
সুফিয়া ধরা পড়া গলায় তোতলাতে তোতলাতে বলে, ‘এ…এইটা তু…তুমার ক্যান মনে হইলো?’
‘এইটা আমার এইজন্যিই মনে হইলো যে, বাইরে থ্যাইক্যা এই জঙ্গলের ফলপাকুড় দ্যাখন যায় না। তুই আইজ বাড়িত চল। একা একা এই জঙ্গলে তুই কুন সাহসে আশোস হেইডা আমার জানতে হইবো।’
সুফিয়া মনে মনে প্রমাদ গুনলো। ভয় জিনিসটা তার চিরদিনই কম। কোথা থেকে যে সে এত সাহস পায় নিজেও জানে না। প্রকৃতির সান্নিধ্য তার সবসময়ই বড় ভালো লাগে। যাকে বলে গেছো মেয়ে, সুফিয়া ঠিক তাই। গাছে চড়তে তার খুব ভালো লাগে। সাপ খোপের ভয়ও তেমন একটা করে না।
ওদের স্কুলে ক্লাসরুমের ভেতরে একবার একটা সাপ ঢুকে পড়েছিল। শঙ্খচূড় সাপ! স্কুলের চারপাশে যে ঝোপঝাড় আছে তা থেকেই চলে এসেছে হয়ত। গরমের দিনে অনেকসময়ই সাপ গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। সাপটি ক্লাসরুমে ঢুকে শান্তভাবে জানালার কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে ছিল। ছেলেপুলের সে কী ভয়! এক মেয়ের তো ভয়ে মুখ দিয়ে ফেনা উঠতে শুরু করে দিল। সুফিয়া ভেবে পায় না এত ভীতু কেন চারপাশের সবাই? গ্রামের ছেলেমেয়ের এত ভীতু হলে চলে?
একটা ছেলেকে সাথে নিয়ে সুফিয়া নিজে লাঠি দিয়ে সেই সাপ ধরেছে। তারপরে বাইরে গিয়ে আবার ঝোপের মধ্যে ছেড়ে দিয়েছে। স্কুলের সবাই সুফিয়ার সাহসে রীতিমত বিস্মিত হয়ে গিয়েছে। এরপরে থেকে সব ক্লাসরুমে কার্বলিক এসিডের বোতল রেখে দেওয়া হয়েছে, যাতে আশেপাশে সাপ ভিড়তে না পারে।
সুফিয়া এই জঙ্গল নিয়ে গাঁয়ের লোকের ওসব উদ্ভট গল্পগাঁথায় কখনোই বিশ্বাস করেনি। একা একা অনেকদিন সে এই জঙ্গলে এসেছে। ফলমূল পেড়ে খেয়েছে। নির্জন জঙ্গলে একা একা ঘুরে ঘুরে দেখেছে সবকিছু। এমনকি সেই কালী মন্দিরেও উঁকি মেরে দেখেছে সে। রহস্যের কিছুই খুঁজে পায়নি।
পুরনো এক কালীমূর্তি ইয়াবড় জিভ বের করে দাঁড়িয়ে আছে। সময়ের আঁচড়ে মূর্তির গায়ে অনেক চড়াই উতরাই। মূর্তির এক হাতের অনেকটা অংশ ভাঙ্গা। তবে একটা জিনিস দেখে সে খানিকটা অবাক না হয়ে পারেনি। মন্দিরের ভেতরটা কিন্তু বেশ সাফসুতরো। দেখে মনে হয়, কেউ বুঝি সেটাকে নিয়মিত পরিষ্কার করে রাখে। এই ব্যাপারটা সুফিয়ার মনের মধ্যে একটা খটকা লাগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওর যুক্তিবাদী মন কোনো লোকগড়া মতামতকে মানতে নারাজ। নিশ্চয়ই কেউ এই মন্দিরে থাকে। কে থাকে, কেন থাকে সেটা জানার চেষ্টাও করেছে আরো কয়েকদিন এসে। বের করতে পারেনি। কাউকেই চোখে পড়েনি তার।
কিন্তু সেসব কথা এখন জুলেখাকে বলা যাবে না। পরে একসময় আস্তে ধীরে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলতে হবে। এই মুহূর্তে বোনকে বুঝ মানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সুফিয়া।
‘ও বু, সেইসব কথা পরে হইবো। আগে চলো, বাড়িত যাই। মায়ে মনে হয় লাঠি নিয়া খাড়াইয়া আছে!’
‘হ, হেইডা ত ঠিকই! তয় হেই লাঠি ত আমার মাথায় ভাঙবো, তুমার ত চুলের আগাও ছুঁইবার পারবো না!’
‘ওমা, আমি থাকতে তুমার মাথায় কেডা লাঠি ভাঙবো! দ্যাখবোনি হুহহ!’
গল্পকথা আর নিজেদের ভেতরের উত্তেজনায় দুজনের কেউই জানতে পারলো না, পেছন থেকে একজোড়া সাবধানী উৎসুক চোখ এক উঁচু গাছের ডাল থেকে তাকিয়ে আছে তাদেরই দিকে।
যত দ্রুত পারা যায়, পা চালাতে লাগলো দু’বোন। প্রায় দশমিনিটের মতো দুজনের কেউই আর একটাও কথা বললো না। যখন খোলা মাঠটা ছাড়িয়ে গ্রামের সীমানায় ভালোমত পৌঁছে গেল, তখন মুখ খুললো সুফিয়া।
‘ও বুবু, একটা কথা কইতাম!’
‘ক, তর মুখ কেডা চিপা ধরছে?’
‘না মানে, রাগ করবা না কও আগে!’
জুলেখা পা থামিয়ে দিয়ে আগুন চোখে তাকালো সুফিয়ার দিকে। রাগী গলায় বললো,
‘আবার কী চাস তুই? সক্কাল বেলায় এক হাউশ কইরা বইলি। সেই হাউশ মিটাইবার গিয়া ওহনতরি বাড়িত যাইবার পারলাম না! এই মাইঝ রাস্তায় আবার নতুন কী চ্যারা মাথার মইধ্যে কামড়াইতাছে তর?’
‘তুমি কিছু না শুইনাই মায়ের লাগান মেশিন চালাইয়া দিলা বুবু? আগে শুনো কী কই! দ্যাখলা ত পশ্চিমের জঙ্গলটা। এক্কেরে সুন্দোর, কোনো জিন ভূত কিচ্ছু নাই! তাইলে এই গেরামের মাইনষে কীয়ের লাইগ্যা এত ডরায় বু?
জুলেখা মাথা নেড়ে অনিশ্চিত গলায় বললো, ‘হেইডা আমি কেমনে কমু? আছে হয়ত কিছু একটা…হেই লাইগাই ডরায়।’
‘তুমি দ্যাখলা?’
‘না দ্যাখি নাই। তয় বেবাক জিনিস কী এক সময়েই দ্যাখন যায়? কুনো সময় যায় কুনো সময় যায় না।’
সুফিয়া অস্থিরভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘উহ্ বুবু! আবার হেই এক প্যাঁচাল…আছে একটা কিছু! তুমার কি এত্ত বয়সেও আক্কেল হয় নাই বুবু? এগুলান সব মাইনষের চাল…কেউ যাতে হেই জঙ্গলে ঢুকবার না পারে এর লাইগাই এইসব গপ চালু কইরা দিছে। আমার মনে কয়, ঐ জঙ্গলের মইধ্যে কেউ থাহে!’
জুলেখা হাঁটার গতি থামিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। যত দিন যাচ্ছে সুফিয়া যেন আরো রহস্যময়ী হয়ে উঠছে। কীসের এক জঙ্গল, কেউ যেখানে আসা যাওয়াই করে না.. সেই জঙ্গলে কেন লোকে আসা যাওয়া করে না, এটা জানার জন্য এই মেয়ের এত কীসের উদ্বেগ? আর এই মেয়ের ভয়ডর একেবারেই নাই হয়ে গেল কেন? গ্রামদেশের অল্পবয়সী মেয়ের ভূত জীনের ভয় থাকবে না, এটা কেমন কথা?
জুলেখা মনে মনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। বেশি ডাকাবুকো মেয়েদের কেউ বিয়ে করতে চায় না। শেষে তার সৎ মায়ের আশঙ্কাই না সত্যি হয়! সুফিয়ারও যদি তার মতো পোড়া কপাল হয়? নাহ্, এই মেয়ে বেশি বাড়ছে! একে খুব তাড়াতাড়িই সাইজ করতে হবে।
জুলেখা আবার পা চালাতে চালাতে বললো, ‘তরে কেডায় কইলো কেউ থাহে?’
সুফিয়া সতর্ক হলো। আপাতত সবকিছু খুলে বলার দরকার নেই। পরে আস্তে আস্তে বলবে। তাই কথাটা হাল্কা করে দিয়ে বললো, ‘এমনি, আমার মনে হইলো।’
‘দ্যাখ সুফিয়া, এইসব আজাইরা চিন্তা ভাবনা না করনই ভালা বুঝলি? বেশি চিন্তা করলে তরও আমার লাগান কপাল পুড়বো কইলাম!’
‘আচ্ছা বুবু, তুমিও কি মায়ের লাগান এইডা মনে কর যে তুমার কপাল পুড়া?’
‘মনে করুম না ক্যা? এতখানি বয়স হইলো…ওহনো বাপের কান্ধে চইড়া আছি। নিজের সংসার হইলো না…পোলাপান হইলো না…আমার ত কপাল পুড়াই! পাতিলের কালির লাগান পুড়া!’
‘আমার হেইডা মনে হয় না বুবু। দ্যাইখো তুমি, তুমার কপাল একটুও পুড়া না। আর খালি বিয়া হইলো না বইলাই কপাল পুড়া হইবো ক্যা…’
সুফিয়ার কথা শুনতে শুনতে জুলেখা সামনের সম্ভাব্য বিপদের কথাই ভুলে গেল। সুফিয়া নানারকম যুক্তি তর্ক দিয়ে তাকে বোঝাতে লাগলো যে, নিজেকে পোড়াকপালী ভাবার কোনো কারণই নেই। কারণ, জীবনে কার কী ঘটবে কেউ বলতে পারে না।
জুলেখা মুখ টিপে হাসতে লাগলো। তার একটুও মনে থাকলো না যে, বাড়িতে গিয়েই কী ভীষণ জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হবে! সেটার জন্য কোনো প্রস্তুতি তাদের আদৌ আছে কী না।
সব ভাবনা চিন্তা ভুলে সন্ধ্যার অন্ধকারে ডুবে থাকা নিস্তব্ধ গ্রামের পথে দুই বোন গল্প করতে করতে হেঁটে চললো।
যখন তারা বাড়িতে পৌঁছলো, পশ্চিম আকাশের শেষ লালিমাটুকুও তখন পুরোপুরি মুছে গিয়েছে। (ক্রমশ)