#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_এক
‘ওই সুফিয়া, ইদিকে আয়…দ্যাখ দ্যাখ কী সুন্দোর আলো! দ্যাখছস?’
যাকে বলা হলো সেই সুফিয়া এদিক সেদিকে তাকিয়ে কোনো আলোর দেখা পেল না। ভ্যাবলার মতো ওপর নীচেও মাথাটাকে কয়েকবার ঘুরিয়ে আনলো। পাশে দাঁড়ানো জুলেখা তার ঘাড় ধরে মাথাটাকে সোজা বরাবর লাগিয়ে দিয়ে জোরের সাথে বললো,
‘এইবার দ্যাখছস?’
বিকেল প্রায় অস্তমিত হতে চলেছে। আকাশ আর দিগন্তরেখার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে শেষ বিকেলের ম্লান বিমোহিত আলো। সম্মূখের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠজুড়ে সোনারঙা ফসলের গায়ে গায়ে লেপ্টে আছে সেই আলোর মোহনীয় মায়াজাদু। একটু পরেই মিলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তখনো এসে গ্রাস করতে পারেনি তাকে। সুফিয়া নিস্পৃহ সুরে উত্তর দিল,
‘হ দ্যাখলাম। রোইজই তো দেখি! এ্যার মইধ্যে দ্যাখোনের কী আছে?’
জুলেখা তখনো উত্তেজিত। একটু পরেই হারিয়ে যাবে এই অপূর্ব আলো, এই আশঙ্কা তাকে এর মধ্যেই ঘিরে ধরেছে। মুহূর্তটাকে সে এক্ষুনি প্রাণভরে উপভোগ করে নিতে চায়। সুফিয়ার নিস্পৃহতাকে পাত্তা না দিয়ে সেই আলোর দিকে মুখ করে সে দ্বিগুণ উত্তেজনা নিয়ে বলল,
‘এইবার আমার দিকে চাইয়া ক’তো দ্যাখি…আমারে কেমুন দ্যাখা যায়?’
‘ও বাবা! তর কী হইলো রে বুবু?’
‘আহ! তুই ক না!’
সুফিয়া মুখটাকে ভেটকি মাছের মতো করে জুলেখার দিকে অনিচ্ছাসূচক একটা দৃষ্টিপাত করেই একেবারে হাঁ হয়ে গেল। তাইতো! জুলেখাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছে কীভাবে? জুলেখার গায়ের রঙ যেন হলুদের ছোঁয়া পেয়ে জ্বলজ্বল করছে। শ্যামলাবরণী জুলেখা’র অনুজ্জ্বল লুকিয়ে থাকা চাপা সৌন্দর্য একেবারে আগুনের শিখার মতো ধিক ধিক করে জ্বলছে।
সুফিয়ার হাঁ করে থাকা মুখটা দেখেই জুলেখা জেনে গেল, যা সে জানতে চাইছিল। মুহূর্তেই মনটা খুশি খুশি হয়ে উঠল। সুফিয়াকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গদগদ মুখে বলল,
‘ল চল ওহন, বাড়িত যাই! আর বেশি দেরি হইলে মায়ের প্যাঁচালে মাথা ধইরা যাইব।’
সুফিয়ার গলায় অনাগ্রহ। এখনই ঘরে ফিরতে তার তীব্র অনিহা। মাথা নেড়ে বলল,
‘আরেকটু বইয়া লই না গো বু! এত জলদি কীসের?’
‘তোর আর কীয়ের জলদি! জলদি তো আমার। আমার তো আর তোর লাগান রাজরানীর কপাল না! ঘরে সৎ মা, উঠতে বইতে খোঁটা। তুই বাড়িত যাইয়া মায়ের লগে পুটুরপুটুর কইরা গল্প করবি। মায়ে তোর মাথাত তেল দিয়া বেণী কইরা দিব। আর আমার…’
শেষের দিকে গলার স্বর ভারি হয়ে আসে জুলেখার। চেনা দুঃখে আর কত কান্না আসে? তবু কেন যে গলা ধরে আসে বার বার, কে বলতে পারে!
সুফিয়া তবু নিশ্চল বসে থাকে। তার সত্যিই এখুনি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। একটু আগে দেখা জুলেখার মুখের অপূর্ব ছায়া তখনো তার মনকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। সে মুখ তুলে আবার তাকাল জুলেখার দিকে। জুলেখাকে এখনো সেইরকমই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। হঠাৎ কী মনে হতেই সুফিয়া খুশি মনে বলল,
‘বুবু, আমারে দ্যাখো তো কেমুন দ্যাখা যায়!’
জুলেখার মুখেও খুশির ঝিলিক খেলে গেল। স্বচ্ছ সুন্দর হাসিতে চারদিক উদ্ভাষিত করে বলল,
‘তুই তো এমনিতেই সুন্দোর! তোরে দ্যাখতে কি এ্যাই সময়ের লাইগা খাইড়া থাওন লাগে? আমি তো কাইলা কাক। এই আলো আইয়া আমার মুখের উপরে পড়লে আমারে ধলা লাগে। আমি জানি। ছুডোবেলায় মায়ের মুখে হুনছি।’
সুফিয়া নির্ভেজাল কৌতুহলে জিজ্ঞেস করে,
‘বুবু, তুমি তো ম্যালা ছুডো আছিলা যহন তুমার মায়ে মরছে। এত কথা ক্যামনে মনে আছে?’
জুলেখার মুখের হাসি তখনো অমলিন। মায়ের কথা মনে হলে সে কোন জগতে যেন চলে যায়! সেই আদর, সেই স্নেহভরা দৃষ্টি মাখানো দুটি চোখ…আহা! আজ অবধি কেউ ওমন করে জুলেখার দিকে চেয়ে দেখেনি! হয়ত আর কখনো চাইবেও না! নিজের মনটাকে বহুকষ্টে বর্তমানে ফিরিয়ে এনে জুলেখা উত্তর দেয়,
‘খুব বেশি কি আর ছুডো আছিলাম! সাত বছরের লাগান তো হইছিলামই! মনে থাকব না ক্যা? মায় মরার পরের মাসেই বাজান আবার বিয়া বইল। তার পরের বছর তুই হইলি!’
খিক খিক করে হেসে উঠে সুফিয়া। ‘বাপরে! কেমুন হিসাব কইরা মনে রাখছ বেবাক কিছু!’
আর কিছু বলে না জুলেখা। তাকিয়ে থাকে তার সৎবোনের দিকে। অবশ্য সুফিয়াকে তার মোটেও সৎবোন বলে মনে হয় না। মনে হয়, যেন ওর মায়ের পেটেরই বোন। মায়ের পরে যে মানুষটার কাছ থেকে সে কিছু একটু ভালোবাসা পেয়েছে, তা এই সুফিয়া। ও ছিল বলেই জুলেখার দিনরাত্রিগুলো আঁধার কালো রাতে হারিয়ে যায়নি।
‘বুবু, তুমি কিন্তু ঠিক ঠিক কইরা কও নাই অহনো আমারে কেমুন দ্যাখা যাইতাছে! তুমার লাগান সুন্দোর লাগতাছে না, তাই না?’ সুফিয়া মুখ ভার করে কপট অভিমানী গলায় বলে।
‘তর যা খুশি তাই ভাইবা নে গা যা! সুন্দোর মাইনষের এগুলান সব ঢঙ্গের কথা!’
সুফিয়া হেসে কুটি কুটি হয়। সে জানত এই কথা বললেই জুলেখা তেতে আগুন হবে।
সুফিয়া বয়সে জুলেখার চেয়ে আট বছরের ছোট। তার গায়ের রঙ বেশ ফর্সা। গ্রামাঞ্চলে এমন উজ্জ্বল গায়ের রঙ তেমন একটা চোখে পড়ে না। নাক মুখের গড়ন খুব যে সুন্দর, তা নয়। নাকটা একটু চাপা, বোঁচা বললেও ভুল বলা হয় না। চোখ দুটি অবশ্য বেশ বড়। কিন্তু সুফিয়ার নিজের ভাষায় ওর চোখজোড়া হলো গরুর চোখ। গরুর যেমন বেশ বড় বড় চোখ থাকে কিন্তু সেই বড় চোখে কোনো আকর্ষণ থাকে না, ঠিক তেমনি ওর নিজের চোখও নাকি সেইরকম। শুধু গঠনগত ভাবেই তা বড়। ঠোঁটের ছাঁদেও সেই একই বস্তুর অনুপস্থিতি, আকর্ষণ। কিন্তু তাতে কী! গায়ের রঙ দেখেই লোকে তাকে সুন্দরী হিসেবে গণ্য করে। যে শাড়িই পরে, সেটাই তার ধবল বরণের জন্য সুন্দরভাবে শরীরের সাথে মানিয়ে যায়।
সুফিয়ার বয়স পনেরো ছাড়িয়েছে। হাতে পায়ে সে বেশ বেড়েও উঠেছে। তাই আশপাশ থেকে ইতোমধ্যেই তার জন্য প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে। সেদিকে অবশ্য সুফিয়ার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। সে লেখাপড়া করতে চায়। গ্রামের প্রাইমারী স্কুল থেকে ক্লাস ফাইভ পাস করে সে বেশ অনেকটা দূরের হাইস্কুলে পড়তে যায়। এই বছরে ক্লাস সেভেনে উঠেছে। বিয়ে করার কোনো চিন্তা ভাবনা আপাতত তার মাথাতে নেই।
সুফিয়ার মা অবশ্য অন্য ভাবনা ভাবছেন। তিনি এর মধ্যেই সুফিয়ার জন্য আসা সব প্রস্তাব দেখে শুনে যাচাই বাছাই করাও শুরু করে দিয়েছেন। যেসব বেশি মনে ধরছে, সেগুলোকে আলাদা করে বিবেচনায় রাখছেন।
সামনে শুধু একটাই ফাঁড়া। পোড়ারমুখীকে কোনোমতে একবার বিদায় করতে পারলেই সুফিয়ার বিয়ে নিয়ে একটু শান্তিমত ভাবনাচিন্তা শুরু করা যাবে। তার মৃতা সতীন কী যে এক আপদ ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছে তার ঘাড়ে! এটাকে ভালোয় ভালোয় বিদায় করতে পারলেই সুফিয়ার পথের কাঁটা তার দূর হয়!
কিন্তু পোড়ারমুখীকে বিদায়টা করবেন কীভাবে? মেঘে মেঘে বেলা তো কিছু কম হয়নি। গ্রামদেশে বাইশ তেইশ বছর মানে অনেক বয়স। এত বয়সে কোনো মেয়ের বিয়ে না হলে তার আর বিয়ে হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা থাকে না। সেকথা সুফিয়ার মা তার স্বামীকে অনেকভাবেই বুঝিয়েছেন।
‘দ্যাখো, তুমার মাইয়ার লাইগা আমি আমার মাইয়ারে ভাসাইয়া দিবার পারুম না। হ্যারে কেউ বিয়া না করবার চাইলে বটগাছের লগে বিয়া দিয়া দাও। আমি আমার মাইয়ারে বসাইয়া রাখবার পারুম না। এত্ত ভালা ভালা প্রস্তাব আসে চারদিক থাইকা। আর বেশি দেরি করলে আমার মাইয়ার কপালডাও পুড়বো, এই আমি কইয়া রাখলাম। হেইডা কইলাম আমি মাইনা লমু না!’
জুলেখার বাবা মিনমিন করে হাল্কা প্রতিবাদের সুরে বলেছেন,
‘আর কয়টা দিন দেখি বউ। তেমুন হইলে তো যাহোক একটা কিছু কইরা বিদায় করনই লাগবো। এ্যাদ্দিন দ্যাখলা…আর কয়টা দিন একটু কষ্ট করো। মা মরা মাইয়া, এক্কেরে ত আর পানিত ভাসাইয়া দিবার পারি না! আর বড় মাইয়া থুইয়া ছোটটারে বিয়া দিলে মানুষজন কী কইবো?’
জুলেখার গায়ের রঙ কালো। বড় ঘরের মেয়েরা এই বর্ণধারী হলে তাদেরকে আদর করে শ্যামলা বলে ডাকা হয়। কিন্তু গরীবের মেয়েকে কেউ আহলাদ করে শ্যামলা বলে না। তাকে কালো বলেই পরিচিতি পেতে হয়।
কিন্তু কালো হলে কী হবে, জুলেখার নাক চোখ মুখের গড়ন অপূর্ব। একেবারে কাটা কাটা। সুফিয়ার চোখ যদি হয় গরুর মতো, জুলেখা তবে হরিণনয়না। হরিণের মতোই টানাটানা দুটি চোখ। খাড়া টিকোলো নাক আর তার নীচে কমলার কোয়ার মতো পাতলা দুটি ঠোঁট। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও তাকে অসুন্দরের তকমা গায়ে লাগিয়ে চলতে হয়। লোকে তো আগে বরণখানিই দেখে। পরে না বিস্তারিত এতকিছু চোখে পড়ে! সেই বরণ দেখেই পাত্রপক্ষের মুখও কালো হয়ে যায়। তাই এই এত বয়সেও আজ অব্দি জুলেখার পাত্র জোটেনি।
জুলেখার বাবা তার এই বড়মেয়ের জন্য যৌতুকেরও ব্যবস্থা করে রেখেছেন। কালো মেয়েকে বিদায় করতে কিছু তো টাকা পয়সা খসাতেই হবে! সেটুকু গচ্চা দিতে রাজি আছেন তিনি। তবু মেয়েটার একটা কিছু যদি হিল্লে হয়ে যেত! সেটুকুই আর হয় না! গায়ের রঙের কাছে লোভও হার মেনে যায়। পাত্রপক্ষ মুখ অন্ধকার করে বলে, ‘নাতিপুতির কথাও তো ভাবতে হইবো গো মিয়া! ছোট মাইয়ারে বিয়া দিবার রাজি থাকলে কও, ভাইবা দেখি!’
একটা একটা করে সন্মন্ধ ভেঙে যায় আর জুলেখা প্রতিদিন আরো একটু একটু করে কালো হতে থাকে। গ্রামে লোকজনের কাছে অনাদর বাড়ে, বাড়িতে বিরক্তি অবহেলা সীমা ছাড়ায়, শরীরের অবহেলিত যৌবন প্রতিবাদের ভাষা খোঁজে… জুলেখার চারপাশে কোনো আলোই আর ভিড়তে পারে না।
বিকেলের আলো এখন একেবারেই কমে এসেছে। গ্রামে সন্ধ্যা নেমে আসে ঝুপ করে। চারদিকে তাকিয়ে এবার বেশ জোরের সাথেই তাড়া দেয় জুলেখা, ‘তুই তাইলে এইহানেই বইয়া থাক। আমি বাড়িত গেলাম। বাড়িত গিয়া মায়েরে কমু তরে ভূতে ধরছে।’
সুফিয়ার মুখে আবার খিলখিল হাসি। বয়সের দোষেই কী না কে জানে, সে কিছু একটুতেই হেসে কুটিপাটি হয়। হাসতে হাসতেই বললো, ‘তুমার সাহস থাকলে কইও। মায়ে আগে তুমার ভূত ছাড়াইয়া দিবনি! হি হি হি…’
‘বড় বুনের লগে কেমুন কইরা কতা কয় দেহ! আবার জিগাইতাছি, তুই যাবি কী না ক!’
‘এ কতা ও কতা…দে মা এট্টু এ্যালাপাতা। যাইতাছি লও! ইস! বাড়িত গিয়া না জানি কী হাতি ঘোড়া হইবো!’
দুইবোনে যখন ঝোপঝাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো, তখন চারপাশে অন্ধকার বেশ ভালোমতোই নেমে এসেছে। ওরা আজ অনেকদূরে চলে এসেছে। এখন পা চালিয়ে হাঁটলেও বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিশ পঁচিশ মিনিটের মতো লেগে যাবে।
জুলেখা মনে মনে তিরষ্কার করলো নিজেকে। সুফিয়া না হয় ছেলেমানুষ, বোঝে কম। তার নিজের বুদ্ধি বিবেচনা কই হারিয়ে গিয়েছিল? এত দূরে দুজন সোমত্ত মেয়েমানুষের এভাবে একা একা চলে আসাটা মোটেও কোনো ভাল কাজ হয়নি। গ্রামে আজকাল আজেবাজে অনেক ঘটনা ঘটে। কিছু ঘটনা সামনে আসে, সবাই জানতে পারে। আবার অনেক ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়, কেউ কিছু জানতেও পারে না। (ক্রমশ)
#ফাহ্মিদা_বারী