কনে বদল
পার্ট-১০( শেষ পর্ব)
# Taslima Munni
সময় এমন এক ঔষধ যা ধীরে ধীরে সব সহজ করে দেয়, ভুলিয়ে দেয়। শিখার না থাকার দুঃখও একটা সময় ভুলে যাবে সবাই।
অনিবার্য পরিণতি কঠিন, কিন্তু সেটাই সময়ের সাথে স্বাভাবিক হয়ে যায়। সন্তানের মৃত্যু হলেও মা-বাবা বুকে পাথর চেপে বেঁচে থাকেন। পিতামাতার মৃত্যুর শোক সহ্য করে সন্তান ও বেঁচে থাকে!
দুনিয়া টা কঠিন।
এতোটাই কঠিন যে একটা সময় চোখের জলও শুকিয়ে যায়।এতো আপনজনের মৃত্যুর বর্ননা অনায়াসে করা যায়!!
শিখাও জানে একদিন এমনই হবে।
অবশেষে মাহিরের বাড়ি থেকে শিখা বিদায় নিলো এই কঠিন সত্যি টা মেনে। একটা তাসের ঘর অথবা খেলাঘর বেঁধে ছিলো শিখা,তার শেষ হয়তো এভাবেই হবার ছিলো।
শিখা ফিরে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ওর ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে কি একটা ভার চেপে আছে যেন। কি যেন ফেলে যাচ্ছে এখানে, অথচ ওর ফেলে যাবার মতো কিছু ছিলো না।
এ বাড়ির মানুষদের প্রতি শিখার অনেক মায়া পড়ে গেছে। এজন্যই হয়তো যাবার সময় কিছুটা খারাপ লাগছে।
শিখা বাড়িতে এসেছে প্রায় একমাস। এর মধ্যে রুম থেকে বেরিয়ে বাইরে যাওয়া হয়না।দু-একদিন শশী আর শিখার মা ওকে বারান্দায় নিয়ে এসেছিলো। বারান্দায় বসে খোলা আকাশ দেখে মনের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
শিখার শ্বশুর -শ্বাশুড়ি এসেছিলো ওকে নিয়ে যেতে।
কিন্তু শিখা অসুস্থতার অযুহাতে যায়নি।তারপর আরেকদিন শিখার শ্বশুর, শ্বাশুড়ি, ইভা,মাহিন সবাই এসে দেখে গেছে।
উনারা অনেক চেয়েছিলেন শিখাকে বাড়ি নিয়ে যেতে, কিন্তু শিখাকে নিয়ে যাবার মতো অবস্থা ছিলো না।
মাহিরও এসেছিলো দু-তিনবার। এসে চুপচাপ শিখার পাশে বসে ছিলো। শিখা ঘুম থেকে জাগার পরে দেখে মাহির বসে আছে!
– আপনি এসেছেন?!!
– কেমন আছো তুমি??
– ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
– আমিও ভালো আছি।
– অনেক শুকিয়ে গেছেন আপনি!
– তাই?
– হুম
এরকম টুকটাক কথা চলে দুজনের মধ্যে।
মাহির অনেক সময় থেকে তারপর চলে যায়।যখনই আসে সাথে করে শিখার ঔষধপত্র যাবতীয় সবকিছু নিয়ে আসে।কত কিছু নিয়ে আসে শিখার জন্য, কত ধরনের ফলমূল; কিন্তু শিখা তো….
বাড়িতে মাহিরের একদন্ড মন টিকছে না।ভেতরে কেমন আনচান আনচান করে। এক অদ্ভুত শূন্যতা ঘিরে থাকে।।
শিখার অভাব দিন দিন তীব্র অনুভব করছে।কিন্তু এতো দূর! প্রতিদিন যাওয়া সম্ভব হয় না।
তার উপর অফিস তো আছেই। মাহিরের ইচ্ছে করে শিখার কাছে যেতে।একদিন হুট করেই চলে আসে।
তারপর সেই টুকটাক কথোপকথন চলে দুজনের মধ্যে।
শিখা খুব একটা কথা বলতে পারে না। তাই মাহির বেশি কিছু বলে না,কারণ তাতে শিখা কথা বলার চেষ্টা করে। কথা বলতে খুব কষ্ট হয় শিখার।
চোখ বন্ধ হয়ে আসে।মনে হয় ঘুম ওর চোখে,তারপরও তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করে। কারণ মাহির সামনে বসে আছে!
মাহির বুঝতে পেরে বলে
– ঘুমাও।আমি তোমার পাশে বসে আছি। আস্তে করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
শরীরের ধকল সইতে না পেরে ঘুমিয়ে পড়ে শিখা।
সকালের সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় শিখার।
চোখ খুলতে পারছে না। কিন্তু মাহির জানালা খুলে দিয়েছে।
– আর ঘুমাতে হবে না। এখন উঠে পড়ো।
কত বেলা হয়ে গেছে!
– আমি কিভাবে উঠবো? নিজে নিজে বসতে পারি নাকি?
– কে বলেছে পারো না? তুমি কি এখন আগের মতো অসুস্থ নাকি? ! তুমি তো অনেক সুস্থ হয়ে গেছো। চেষ্টা করে দেখো,নিজেই উঠে বসতে পারবে।
শিখা মাহিরের কথা শুনে হাত-পা নাড়াচাড়া করে দেখছে।
আসলেই তো! আগের থেকে শরীর কেমন ফুরফুরে লাগছে।
– কই? উঠে বসো এবার।
শিখা উঠে বসার চেষ্টা করছে, প্রথম দুবার একটু উঠেও বসতে পারেনি। তৃতীয় বার উঠে বসে গেছে।
– কি আশ্চর্য! আমি নিজে নিজেই বসতে পারছি?
– বলেছিলাম না ঠিক পারবে।
– কিন্তু… কিভাবে সম্ভব?
– মনের জোর থাকলে আর ভালোবাসা থাকলে সব সম্ভব।
এবার তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও।নাস্তা করতে হবে।
– আজ সকাল এতো সুন্দর কেন?
– ওমা! সেটাও জানো না?
– না! আপনি জানেন?
– হুম, জানি তো।
– কেন?
– আজ আমরা নতুন করে জীবন শুরু করবো তাই!
– নতুন করে জীবন শুরু মানে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না!
– মানে হচ্ছে তুমি আজকে আমার সাথে বাড়ি ফিরে যাচ্ছো।বুঝতে পেরেছো?
– আমি? কিন্তু…
– কিন্তু কি?
– আমি যে অসুস্থ! আমার যে খুব বেশি সময় নেই।
– কে বলেছে? ওসব ভুল ছিলো, ডাক্তারের ভুল ছিলো। তোমার অন্য একটা অসুখ ছিলো। এখন তুমি অনেক সুস্থ হয়ে গেছো। আরও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে।
– কি বলছেন এসব!?
সত্যিই আমি??..
শিখা উত্তেজনায় বিছানা থেকে নেমে মাহিরের কাছে পায়ে ছুটে গিয়েই ওর হাত ধরলো।
– আমি বাঁচবো! আমি বাঁচতে পারবো? আমার কিছু হয়নি!
– হা।তুমি বাঁচবে। তোমাকে যে বাঁচতে হবে শিখা। আমার জন্য!
– আপনার জন্য??
– হা।আমার জীবন টা এলোমেলো করে দিয়েছিলে,এখন সেটা কে গুছাবে শুনি?
– আমি গুছাবো!
– হা।তুমি।।
সব কিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা…
আমি সুস্থ হয়ে গেছি…!! আমি বাঁচবো…!!
আমার কিছু হয়নি…!!
– শিখা…. এই শিখা…. তুমি কাঁদছো কেন?
-কই!! আমি কাঁদছিনা তো…. আজ আমার অনেক খুশি। খুশিতে চোখে পানি চলে এসেছে।
– আচ্ছা… তুমি তৈরি হয়ে নাও.. আমি এক্ষুনি আসছি। এসে তোমাকে নিয়ে যাবো।
– কোথায় যাচ্ছো তুমি??
মাহির রুম থেকে বেরিয়ে গেছে। শিখা পিছন থেকে জিজ্ঞেস করছে
– কোথায় যাচ্ছো? মাহির? আমাকে নিয়ে যাবেনা?
আমাকে নিয়ে যাবে কখন?
.
.
.
মাহির যত দূরে যাচ্ছে শিখা তত জোরে ডাকছে কিন্তু মাহির যেন বধির হয়ে গেছে। কিছু শুনতে পাচ্ছে না। এতো চিৎকার করে শিখা ডাকছে কিন্তু এসব কিছু মাহিরের কান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছেনা!
– আমি তৈরি হয়ে থাকবো… তুমি কখন আসবে মাহির…? কখন আসবে?
ধীরে ধীরে শিখার কণ্ঠস্বর নিচু হয়ে আসছে।শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে!!
– আপু? আপু? তোমার বেশি খারাপ লাগছে?
শিখাপু? ও আপু…. তুমি এমন করছো কেন?
শিখা তাকিয়ে দেখে শশী ওর পাশে বসে কাঁদছে!
– মাহির কই?
– আপু? তোমার এখন কেমন লাগছে?
– মাহির আসেনি?
– মাহির ভাইয়া আজকেই আসবে। তুমি একটু ঘুমাও আপু।
শিখার মা তাড়াহুড়ো করে রুমে আসে।
– মা , আপু কি জানি সব বলে! এখন চোখ খুলে মাহির ভাইকে খুঁজছে।
– আল্লাহ… আল্লাহ তুমি সহায় হও…আমার মেয়েটাকে উদ্ধার করো। ছেলেটা কালকেই ভালো দেখে গেলো!
– মা, আপুর অবস্থা কি বেশি খারাপ?
– কাল থেকে কিছু বুঝতে পারছি না। ও বাড়ির তারা আজকেই আসবে,রাস্তায় আছে। আমার মাথা কাজ করছে না আর!
কখনো অচেতন হয়ে পড়ে,কখনো জ্ঞান ফিরে।
তখন ভর দুপুর। শিখা শশীকে জিজ্ঞেস করলো
– শশী?
– আপু…
– মা কই? আমার পাশে একটু বসতে বল।
– আমি এক্ষুনি বলছি…
মা..মা… তুমি আপুর পাশে বসো।
– মাহির আসেনি? আসবে না আর?
– আসবে আপু… একটু পরেই…আসবে
আরও আধাঘন্টা কেটে গেছে। শিখা আবার জিজ্ঞেস করলো
– মাহির এসেছে?
মা আমাকে একটু পানি দাও…
পানি খাবো।
শিখার মা চামচে করে পানি দেয় দুচামচ পানি খায় শিখা…
তৃতীয় চামচ আর মুখে তুলতে পারেনি।
শিখার চোখে সেই অস্তমিত সূর্যটার দৃশ্য ।
ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে…
শিখাও… নিভে গেলো ধীরে,…. কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে!!
সব মায়াজাল ছিন্ন করে শিখার আলো নিভে গিয়ে গাঢ় অন্ধকার নেমে এলো!!
– সমাপ্ত –
# অনেকেই ” প্রেমে পড়া বারণ ” সিজন ২ চেয়েছিলেন। কিন্ত সিজন ২ কখনো লেখা হয় না। প্রত্যেকটা গল্প আলাদা আলাদা, তাই একই নামে ২ টি করতে ইচ্ছুক নই।তবুও আপনাদের আগ্রহ থাকলে অবশ্যই করার চেষ্টা করবো।?
ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য। ❤❤