কনে দেখা আলো পর্ব-২৭ এবং শেষ পর্ব

0
350

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_সাতাশ_শেষ_পর্ব

পুলিশ স্টেশনে পা দিয়েই মনে হলো, মাছের হাট বসেছে। কে কাকে ধমকাচ্ছে, কে কাকে সাপের পাঁচ পা দেখাচ্ছে… কিছুই পরিষ্কার না। রেজা আর দুজন স্টাফ তাদের সামলাতে ব্যর্থ হয়ে অন্য কাজে মন দিয়েছে। জামান শিকদার একবার হাজত সেল দুটোতে নজর দিয়ে নিজের রুমে গিয়ে বসল। আজ খুব কর্মব্যস্ত একটা দিন গিয়েছে। রাতটাও যাবে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু একেবারে একটু ঘুমাতে না পারলে কালকের দিনটা সামাল দেওয়া যাবে না। বোঝাই যাচ্ছে আগামিকাল আরেকটা বিগ ডে আসতে চলেছে। সম্ভবত এতদিনের সব অজানা প্রশ্নের উত্তরগুলো আগামিকালই পাওয়া যাবে।

রেজাকে রুমে ডেকে জামান শিকদার বলল, ‘চেয়ারম্যান সাহেবকে যে খবর দিতে বললাম! দাওনি?’
রেজা নিজের ব্যর্থতাকে চাপা না দিয়ে ক্ষেদের সঙ্গে বলল, ‘স্যার বলছিলাম তো! চেয়ারম্যান সাহেব বইলা পাঠাইছেন তিনি আজ এত রাইতে পুলিশ স্টেশনে যাইতে পারবেন না। তার ছেলেরে পুলিশ যা যা জিজ্ঞেস করব করুক। তিনি এইসবের মধ্যে নাই!’
‘রেজা! তুমি পুলিশের চাকরিতে টিকবে কীভাবে আমি বুঝতে পারছি না! আমি কি তোমাকে পাশের বাসার খালাম্মাকে একটু ডেকে আনতে বলেছি? তুমি চেয়ারম্যান সাহেবকে গিয়ে বলবে… আপনাকে পুলিশস্টেশনে যেতে হবে! এটা শোনার পরে সে তোমার কথা না শুনে থাকে কীভাবে?’
রেজা গাঁইগুই করতে থাকে। জামান শিকদার আর কিছু বলে না। রেজার অক্ষমতা যে সে বুঝতে পারছে না তা তো নয়। এসব থানা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানরা সামান্য কনস্টেবলের কথাতে নড়ে চড়ে না। সে নিজে গেলেও আজ চেয়ারম্যানকে আনতে পারত কী না বলা মুশকিল। আর এনে এখন তাকে কীই বা খাতিরদারি করা হবে? তার চাইতে বরং আগামিকালই আসুক। কমিশনার সাহেব এলে না এসে কে কোথায় থাকে দেখা যাবে!
প্রসঙ্গ পাল্টে জামান শিকদার বলল, ‘রেজা, শোনো আজকের রাতটা আমাদের স্টেশনেই কাটাতে হবে। তুমি আর আমি পালাক্রমে রাত জাগব। একটু ঘুমিয়ে নিলাম ফাঁকে ফাঁকে। কিন্তু পুরো রাত পুরো ঘুমে কাটানো যাবে না। ভয়ানক সব অপরাধীদের আসর বসেছে।
আচ্ছা একটা কথা এই বাবুলের কেসটা কী বলো দেখি? আমি তো তাকে এতদিন চেয়ারম্যান সাহেবের ডান হাত বলেই জানতাম! সে হঠাৎ চেয়ারম্যানের ছেলের বিপক্ষে অবস্থান নিলো কেন বুঝতে পারছি না! আর চেয়ারম্যানের ভাইয়ের খুনির সঙ্গে তার এত মিলমিশ হলো কেমন করে?’
‘আমিও তো এই কথাই ভাবতাছি স্যার! শমসেররে সবাই এত আঁতিপাঁতি কইরা খুঁজল। চেয়ারম্যান খুঁজল তার লোকজন খুঁজল! আর এইদিকে দেখা যাইতাছে সরিষার মইধ্যেই ভূত!’
‘কিছু বলেছে বাবুল? মানে হাজতে ঢোকানোর পরে মুখ খুলেছে কিছু বলার জন্য?’
‘না স্যার সে তো এমনিতেই কথাবার্তা তেমন একটা কয় না। আর আইজ তো মুখে একেবারে কুলুপ আঁটছে!’
‘আচ্ছা থাক। যে যা বলার আগামিকালই বলুক!’

পরিকল্পনামাফিক কেউ ঘুমে কেউ জেগে, সবাই এভাবে ডিউটি করেই রাতটা কাটিয়ে দিলো তারা। সকাল থেকেই শুরু হয়ে গেল অন্যরকম তোড়জোড়। ইতোমধ্যে কমিশনার সাহেব টেলিফোনে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি অন দ্য ওয়ে! এসপি সাহেবও রওয়ানা দিয়েছেন। সম্ভবত তারা দুজনে একই সঙ্গে কদমপুর পুলিশ স্টেশনে এসে কদম রাখবেন। বসের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এতদিন অনেক লাভ খেয়েছেন এসপি সাহেব। সেই লাভের গুড় এবারে বুঝি পিঁপড়ার পেটে যায়! তাই যতটা সম্ভব কমপেনসেট করার চেষ্টায় আছেন তিনি।
রওয়ানা দেওয়ার আগে এসপি একবার জামান শিকদারের মোবাইলে ফোন দিয়েছিলেন। সেই ফোন ধরে কিছু গালিগালাজ হজম করতে হয়েছে জামান শিকদারকে। ঔষধ মনে করে সেগুলোকে গিলে নিয়েছে সে। এভাবে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেলে ঘোড়া তো একটু মাইন্ড করবেই! চিবিয়ে চিবিয়ে এসপি সাহেব বলেছেন,
‘চাকরির কত বছর হলো? জয়েন করেই হিরো হওয়ার শখ হয়েছে? আমাকে জানালেই পারতা! হিরো বানায়ে দিতাম! আমাকে রিপোর্ট না করে সোজা একেবারে কমিশনার অফিসে জানায়ে বসে আছ? তোমার আগে কত ওসি এলো গেল, তারা কেউ হিরো হয়ে যেতে পারল না… তুমি ধরেই নিয়েছ স্ট্রাটেজি পাল্টে হিরো হয়ে যাবে?’
জামান শিকদার একটা কথারও কোনো উত্তর দেয়নি। উত্তর যে তার কাছে ছিল না এমন তো নয়! সে বলতে পারত, ‘আপনি যদি আপনার কাজটুকু ঠিকঠাকমতো করতেন তাহলে কোনোকিছুই পাল্টাতে হতো না স্যার!’ কিন্তু অধস্তন অফিসারের উচিত কথা বলারও অনুমতি নেই। এটাই মুশকিল!

কমিশনার সাহেব এবং এসপি সাহেব আসার আগেই জামান শিকদারের একবার ভেতরের ঘটনাটা জানার ইচ্ছে হচ্ছিল। তারা আসার পরে তো জবানবন্দি আকারেই সবকিছু শোনা হবে। কিন্তু আন অফিসিয়ালি ঘটনা জানার একটা মজা আছে।
শমসের আর বাবুলকে যে হাজতসেলে ঢোকানো হয়েছিল, সেটার সামনে গিয়ে হাজির হলো জামান শিকদার। বাবুল মেঝেতে শুয়ে ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু শমসের ছেলেটা ঘুমহীন চোখে ঠাঁয় বসে ছিল। জামান শিকদার গিয়ে সেলে একটা ঠোকা দিতেই দুজনেই সচকিত হয়ে উঠল। বাবুল শোয়া থেকে উঠে বসল। পরিষ্কার চোখ মেলে সে জামান শিকদারের চোখের দিকে তাকাল। এই ছেলেটার চোখের মধ্যে কী জানি একটা আছে। যতবার এর দিকে তাকিয়েছে, জামান শিকদারের অস্বস্তি কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। ছেলেটা যেন একেবারে ভেতর অব্দি দেখে নেয়।
সেই অস্বস্তি কাটাতেই যেন জামান শিকদারও এবারে তার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘তারপর ঘটনা কী বলো দেখি বাবুল, তুমি তো চেয়ারম্যানের দলের লোক। তুমি তার ছেলের পিছে লাগলা কেন?’

বাবুল স্পষ্ট গলায় উত্তর দিলো, ‘চেয়ারম্যান সাব বেবাক কিছু জাইনাও আমারে দিয়া তার পোলার তাঁবেদারি করাইতে চাইছিল। কিন্তু আমি বাবুইল্যা কারো বাপেরডা খাই না। চেয়ারম্যানরে ভালা মনে কইরা তার হুকুম মানতাম। কিন্তু যেইদিন দ্যাখলাম চেয়ারম্যান আসল ঘটনা জাইনা শুইনা নিজের রক্তের মান বাঁচাইতাছে, সেইদিন আর চুপ থাকিনি! যা করা ঠিক মনে হইছে তাই করছি!’
‘কী করছে চেয়ারম্যান? কী জেনে গেছিল?’
‘জাইনা গেছিল তার ভাইয়েরে আসলে কেডায় মারছে!’
‘এই শমসের মারেনি চেয়ারম্যানের ভাইকে?’
‘জে না! শমসের মারব কী! শমসের তো তার পোলা আছিল। পোলা বাপেরে মারব ক্যান?’
এই কথায় ঘরে যেন বাজ পড়ল। শমসের হতবুদ্ধি হয়ে বাবুলের মুখের দিকে তাকাল। তার মুখভঙ্গিই বলে দিচ্ছে, এই সত্যটা তার অজানা ছিল। বাবুল সেদিকে তাকিয়ে কৈফিয়তের সুরে বলে, ‘হ, আমি এই কথা তর কাছ থেইকা লুকাইছিলাম। কারণ আমার কাছে মনে হইছিল, এইডা জানবার পারলে তুই আব্দুল রফিক সাহেবরে ভুল বুইঝা চইলা যাইবি! আমি এইসব ম্যালা আগে থেইকাই জানি।’

শমশের কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘কী জানেন আপনে? তিনি আমার বাপ হইতে যাবেন ক্যান? তিনি আমার বাপ হইলে আমি জানতাম না? আমার মায়ে আমারে মিছা কতা কইত?’
‘তর মায়ের কুনো দোষ আছিল না শমসের। তর মায়েরও দোষ আছিল না, আব্দুল রফিক সাহেবেরও কুনো দোষ আছিল না। তিনি তর মায়েরে বিয়া করছিলেন। বাড়িত আইসা ভাইয়ের কাছে বিয়ার কথাও কইছিলেন। তখন চেয়ারম্যান সাব কইছিলেন, ‘শহরে কারে না কারে বিয়া কইরা আইছস। অখনই এই বিয়ার কথা কাউরে কওনের দরকার নাই।’ ক্যান বিয়ার কথা কইতে নিষেধ করছিলেন এইডা সোজা সরল আব্দুল রফিক সাব বুঝতে পারেন নাই। চেয়ারম্যানের মগজে তখন সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারার চিন্তা আছিল। কারণ তার বাপে উইল কইরা গেছিল যদি তার ছোট পোলা বিয়া করে তাইলে সম্পত্তি সমান দুইভাগে ভাগ হইব। কিন্তু যদি বিয়া না করে তাইলে বেশিরভাগ সম্পত্তিই পাইব আব্দুল লতিফ মানে আমাগো চেয়ারম্যান সাব!’

জামান শিকদার এবারে প্রশ্ন করল, ‘এমন অদ্ভুত শর্তের কারণ কী?’
‘কারণ হইতাছে, আব্দুল রফিক সাব তার বাপে বাঁইচা থাকতে বিয়া করবার চান নাই। তাই পোলারে বিয়া দেওনের লাইগা তার বাপে এই বুদ্ধি কইরা গেছিলেন। আর এদিকে চেয়ারম্যান সাবের ঘরে দুই পোলা। বড় পোলার বড় সংসার। ম্যালা পুষ্যি। এত লোকের দেখভালের ভার চেয়ারম্যানের ওপর। তাই ভাই বিয়া করেনি এইটাতে চেয়ারম্যান সাব খুশিই আছিলেন।
কিন্তু যেইদিন আব্দুল রফিক সাব বিয়ার কথা ভাইয়ের কাছ কইয়া দিলেন সেইদিন তার মাথায় আকাশ ভাইঙ্গা পড়ল। ভাইরে উল্টাপাল্টা বুঝাইলেন যে অখন যদি তার বিয়ার কথা গেরামের লোকে জানতে পারে তাইলে তারা তার বউরে মন্দ কইব। নানান হাবিজাবি বুঝ দিয়া তার মাথায় একেবারে সিল মাইরা দিলেন। আব্দুল রফিক সাব শহরে গিয়া বউরে কইলেন তাগো বিয়ার কথা গোপন রাখতে। শমসেরের মায়ে সেই কথা রাখতেই শমসেরের কাছেও কুনোদিন তার বাপের পরিচয় দ্যায়নি।
কিন্তু যেইদিন শমসেরের মায়ে অসুখে মইরা গ্যালো, শমসেরের মাথার ওপরে কুনো ছায়া থাকল না সেইদিন তিনি শমসেররে গেরামে আইনা নিজের ব্যবসার কামে লাগাইয়া দিলেন।’

জামান শিকদার আবার মাঝখানে প্রশ্ন করল, ‘তুমি এতকিছু কীভাবে জানলা?’
‘তাগো দুইভাইয়ের মইধ্যে মাঝে মাঝেই বড় বড় ঝগড়া বাঁধত। সেই ঝগড়ার সময় সেই জায়গায় কেউ থাকত না। কিন্তু চেয়ারম্যান সাব আমারে কাছ ছাড়া করতেন না। তার ভয় আছিল, ছোট ভাইরে ভুজুং ভাজুং বুঝাইয়া রাখছেন এদ্দিন। কুনদিন জানি ছোট ভাই বেবাক কিছুর শোধ তুলে!’
‘খুনটাও কি তাহলে চেয়ারম্যান সাহেবই করিয়েছিল?’ জামান শিকদার উত্তেজনা অনুভব করে।
‘জে না। খুন খারাবি চেয়ারম্যান করেনি। চেয়ারম্যান সাব সম্পত্তির বেলায় পাই পাই হিসাব করলেও তার অন্য দোষ আছিল না। ভাইরে তিনি ভালাও বাসতেন। ভাই মইরা যাওনের পরে বহুত কান্নাকাটি করছেন। এইসব মিছা আছিল না। কিন্তু যেইদিন তিনি সত্যটা জানতে পারছেন সেইদিন তিনি অপরাধীরে পুলিশের কাছে ধরায় দ্যান নাই। উল্টা সেইডারে চাপা দেওনের লাইগা শমসেরের খোঁজ করাইছেন। পুলিশের কাছে শমসেরের নামে বারবার নালিশ দিছেন! এইডা জানতে পাইরা আমি গোপনে দল বদলাইছি। চেয়ারম্যানের লগে থাইকা বেবাক কিছু জাইনা নিয়া শমসেররে জিন্দা রাখছি। ওরে ছাইড়া দিলে চেয়ারম্যান সাব ওরে পুলিশে ধরায় দিত। আমি সেইডা হইতে দেই নাই!’
‘তাহলে কে খুন করেছে আব্দুল লতিফকে?’
‘কেডায় আবার? ঐ বজ্জাত রুবেল… চেয়ারম্যানের ছোট পোলা!’
‘রুবেল খুন করেছে? কে এই ঘটনার সাক্ষী?’
‘ঐ বাড়ির বেবাকেই সাক্ষী! চেয়ারম্যানের শালা মুজিবর গোপনে গোপনে রুবেলের লগে কাম করত। এই খুনের বেবাক আলামত সেই সরাইছে! চেয়ারম্যান সাব এইসবের ব্যাপারে জানত না। বাড়ির বেবাকে তার কাছ থেইকা চাইপা গ্যাছিল। সে জানছে পরে। তদ্দিনে রুবেল সব আলামত গায়েব কইরা দিয়া ব্যবসা বাণিজ্য নিয়া জাঁকাইয়া বইছে। চেয়ারম্যান সাব কিছু করবার গ্যালে রুবেলই নিজের বাপরে শ্যাষ কইরা দিত! এক নাম্বারের হারামজাদা বদ ঐ ছোড়া! মাইয়ামানুষের নেশায় কাড়ি কাড়ি ট্যাকা নষ্ট করে। গঞ্জে গিয়া বেশ্যা মাগিগো পেছনে খরচ কইরা আসে! তাও বিয়া করে না!’
‘রুবেল কেন তার চাচাকে খুন করেছে?’
‘যেইদিন জানতে পারছে চাচা বিয়া করছে আর তার একজন পোলা আছে, সেইদিন থেইকাই তার মাথা খারাপ হইয়া গেছিল। তয় শমসেরই যে সেই পোলা এইডা সে জানত না। জানলে হয়ত শমসেররেও মাইরা ফেলত। আর আরেকটা কারণে সে তার চাচারে সহ্য করতে পারত না!
‘কী সেই কারণ?’
‘আব্দুল রফিক আগর গাছের ব্যাপারটা জাইনা গেছিলেন। এইটা জাইনা তিনি ভাইয়ের কাছে বিচার দিতে আইছিলেন। কিন্তু সেইদিন চেয়ারম্যান সাব বাড়িত ছিলেন না। রুবেল জানতে পাইরা চাচারে গুলি করে। আর মুজিবর সেই বন্দুক নিয়া গিয়া লুকাইয়া ফ্যালে! পরে শমসের আইসা দেখে তার মনিব মাটিতে পইড়া আছে। তখন সবাই মিইলা রটাইয়া দেয় যে শমসের খুন করছে। প্রত্থমে চেয়ারম্যান সাবও এইটাই বিশ্বাস করছিলেন। পরে তিনি সত্যিটা জানতে পারছেন।’
‘আর আগরগাছের ব্যাপারটা কি চেয়ারম্যান জানতেন?’
‘হ এইটাও তিনি জানতেন। রুবেলের লাইগা তিনি কিছু করতেও পারতেন না!’
অর্থাৎ ছেলের জন্য তার হাত পা বাঁধা ছিল?’
‘হ! সেইটাই কারণ!’
বাবুল থামে। পাশে নিথর হয়ে বসে থাকে শমসের। তার চোখ দিয়ে হয়ত নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়তে থাকে অশ্রু। এমনই অভাগা এক সন্তান সে, নিজের পিতার সাথে দিনরাত থেকেও তাকে পিতা বলে ডাকার সৌভাগ্য হয়নি তার!

চাঞ্চল্যকর এত খবর জানার পরে জামান শিকদার রীতিমত রোমাঞ্চিত হয়ে বসে থাকে। সব নাটের গুরু তাহলে রুবেল!
অন্য সেলটির দিকে আলগোছে একবার নজর বুলায় জামান শিকদার। রুবেল পায়ের ওপরে পা তুলে চোখ দুটো বুজে আধাশোয়া হয়ে আছে। অপরাধের ছিটাফোঁটা গ্লানিও তার চোখেমুখে নাই। জামান শিকদারের পুরো শরীর রি রি করে উঠল। একেই বুঝি বলে জাত অপরাধী! অপরাধ করবে কিন্তু তার আঁচ লাগবে না শরীরে!

জামান শিকদার বাবুলকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘যা কিছু বললে এইসব জবানবন্দি দিতে পারবে তো কোর্টে? ভয় পাবে না তো?’
বাবুল বাঁকা হাসি হাসে। বলে, ‘ভয় আমি পাই না ওসি সাব! ভয় পাইলে চেয়ারম্যানের কোলের মধ্যেই সান্ধাইয়া থাকতাম! আপনে নিশ্চিত থাকতে পারেন! বাঁইচা যদি থাকি, কোর্টে আমারে পাইবেন।’
বাবুলের চোখের দৃষ্টি এখনো একদম স্থির। জামান শিকদার নিজের অজান্তেই চোখ সরিয়ে নিলো।

জামান শিকদারের অনুমানই ঠিক হলো। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে কমিশনার সাহেব এলেন। এসপি সাহেব এলেন তার প্রায় সাথে সাথেই। দেখে মনে হতে পারে, তিনি বুঝি রাস্তায় কোথাও ঘাপটি মেরে বসে ছিলেন। কমিশনার সাহেবের গাড়ির দেখা পেয়ে আস্তে ধীরে পিছে পিছে এসেছেন। চেয়ারম্যান সাহেবও তার আগমনের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশস্টেশনে চলে এলেন। তাদের মধ্যে যে পারষ্পারিক ভালো বোঝাপড়া আছে, সেটা আবারো নিজেরাই প্রমাণ করে দিলেন।
জামান শিকদার কমিশনারের কাছে পুরো ঘটনার আদ্যোপান্ত রিপোর্ট করলেন। একেবারে শুরু থেকে যা যা ঘটেছে সবকিছুই খুলে বললেন। চেয়ারম্যান সাহেব এবং তার শ্যালক মুজিবরের বিরুদ্ধেও চার্জশীট দেওয়া হলো। কমিশনারের নির্দেশে দুজনকেই হাজতে ঢোকানো হলো।
আগরগাছের সন্ধানে পশ্চিমের জঙ্গল পরিদর্শন করে আসা হলো। সেই এলাকার আগরগাছ যে এতদিন ধরে কেটে ফেলা হচ্ছে, এই ব্যাপারে এতদিনেও কেন কোনোরকম রিপোর্ট তার কাছে আসেনি…এটা জানতে চেয়ে কমিশনার সাহেব এসপির কাছে মৌখিক কারণ তলব করলেন। জানিয়ে দিলেন শিগগিরই তার কাছে লিখিত শোকজ নোটিশ চলে যাবে।
শুরু থেকেই সবকিছু নিজের দখলে নেওয়ার একটা জোর প্রচেষ্টা ছিল এসপি সাহেবের। কিন্তু পরিস্থিতি যে অনেক আগেই তার হাতের মুঠো গলে বেরিয়ে গেছে, এটা শেষমেশ হাড়ে হাড়ে টের পেলেন। কমিশনার সাহেব তার সঙ্গে ঠিকমত কথা পর্যন্ত বললেন না।
চেয়ারম্যানের শ্যালক মুজিবরের মাধ্যমে মার্ডার উয়েপনও খুঁজে বের করা হলো। মুজিবরের বিরুদ্ধে হত্যার আলামত গায়েব, অপহরণসহ একাধিক অভিযোগ। জামান শিকদার বাদি হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করল। শমসেরকে আপাতত পুলিশ কাস্টডিতে রাখা হলো। জামান শিকদার তাকে আশ্বস্ত করল সে নিজে উদ্যোগী হয়ে তার জন্য ভালো উকিলের ব্যবস্থা করবে। আর তাছাড়া মার্ডার উয়েপন যখন খুঁজে পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করতে সময় লাগবে না।
সবকিছু শেষ হতে হতে বিকেল গড়ালো। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত জামান শিকদার সন্ধ্যায় নিজের আস্তানায় যাওয়ার সুযোগ পেল। সবকিছু যে এত ভালোভাবে সামাল দেওয়া গেছে, এটাই দিন শেষের পরিতৃপ্তি!

পরিশিষ্ট
ফুলি আর ফুলির মা হাসুবিবি অনেকক্ষণ ধরে সুফিয়াদের ঘরের দাওয়ায় বসে আছে। ফুলির কোলে তার সন্তান। সুফিয়া আর জুলেখা কচু শাক তুলে আনতে বাড়ির পাশের ক্ষেতে গেছে। সুফিয়ার মা চুলায় তরকারি বসিয়ে মশলা পিষছে। বাড়িতে আগত দুজনের দিকে তার বিশেষ মনোযোগ নাই। ফুলির মা বারকয়েক ডাকাডাকি করে এখন বসে আছে জুলেখার জন্য। সে এলে যদি কথাবার্তা একটু আগায়!

হনুফা বেগমের মন এখন আগের চাইতে অনেক শান্ত। মাথাটাও বেশ ঠাণ্ডা আছে। কয়েক মাস আগে যেদিন পুলিশের বড় অফিসারেরা তার বাড়িতে এসে সুফিয়ার মাথায় হাত দিয়ে বলেছে, ‘তোমার সাহসের কাছে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট কৃতজ্ঞ’… সেদিন গর্বে হনুফা বেগমের বুক ভরে উঠেছে। বড় অফিসারেরা যাওয়ার আগে তাকে বারবার করে বলে গিয়েছে, ‘মেয়েকে পড়ালেখা করাবেন। আপনার মেয়ে বড় হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। দুম করে বিয়েশাদী দিয়ে ফেলেন না। মেয়েকে বোঝা না বানিয়ে সম্পদ করে গড়ে তুলুন।’
এত কঠিন কঠিন কথাবার্তা সব সে ভালোমত বুঝতে পারেনি। কিন্তু এটুকু বুঝেছে যে সুফিয়ার বুদ্ধি আর সাহসের সবাই খুব প্রশংসা করেছে। বিয়ে না দিয়ে পড়ালেখা করাতে বলেছে।
হনুফা বেগম সুফিয়ার জন্য পাত্র খোঁজা বন্ধ করেছে। ওসি সাব মাঝে মাঝে এসে খোঁজ নিয়ে যায়। বলে, ‘মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে হবে না আপনার। আপনার মেয়ের জন্যই পাত্রের বাবা লাইন দিবে একদিন!’

জুলেখার প্রতিও তার মনটা নরম হয়েছে এখন। সুফিয়া তাকে অনেক বুঝিয়েছে। সুফিয়ার বাবাও কম বোঝায়নি। হনুফা বেগম বুঝিয়েছে নিজের মনকে। তাই তো! জুলেখার তো কিছুই নাই! সে তো একটুখানি ভালোবাসার কাঙ্গাল। সে কেন তাদের পর মনে করবে? সুফিয়া এত ভালোবাসে জুলেখাকে! জুলেখার ভালোবাসার গুণেই তো এমন ভালোবাসা পেয়েছে সে। এতদিন পরে এসে হনুফা বেগম আর জুলেখার সম্পর্কটা একটু সহজ হয়েছে।

হাসুবিবি উশখুশ করতে করতে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘হনুফা বু, জুলেখা গো কি দেরি হইব?’
হনুফা বেগম ভাতের মাড় গালতে গালতে অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, ‘কইবার পারি না!’
হাসুবিবি আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল এবারে হনুফা বেগম নিজে থেকেই বলে, ‘আপনে এমুন কইরা বারবার আইসেন না। আমরা কিছু করবার পারুম না। আমার সুফিয়ারে আপনের জামাই উঠাই নিয়া গেছিল। এইটা তো ভুল না। জুলেখা নিজে সাক্ষী দিছে। আপনে তো আমার কথা বিশ্বাস না করেন, জুলেখার কথা তো করেন। তাইলে বারবার আইসা কী করবার চাইতাছেন কন তো?’
‘হনুফাবু, আমার নাতিনটা কেবল হইল। বাপের চেহারাটাও দেখে নাই। অখন যদি জেল হইয়া যায়… আল্লাহয় জানে কবে বাইরাইতে পারব। আপনেরা এই কেস যদি তুইলা নিতেন…’
‘ক্যা কেস তুলুম ক্যা? আমার মাইয়ার যে পেরেশানিটা হইছে সেইডা কিছু না? আর কেস তো পুলিশ করছে! আমরা তো করি নাই!’
আরো দুই চার কথার পরে নিরাশ হয়েই হাসুবিবি আর ফুলি তাদের বাড়ির পথ ধরল। সামনের অনিশ্চিত পথ কীভাবে পাড়ি দিবে এই চিন্তায় মা মেয়ে দুজনেই উদ্বিগ্ন।

জামান শিকদার ইদানিং প্রায়ই এটা সেটা কাজে সুফিয়াদের গ্রামে আসা যাওয়া করে। গ্রামে নাকি ইদানিং চোর ডাকাতের উপদ্রব বেড়ে গেছে। তাই পুলিশের ঘন ঘন এসব জায়গা ঘুরে গেলে ভালো। এতে সবাই একটু টাইট থাকে।
গাড়ি নিয়ে ফেরার পথে জামান শিকদার দেখতে পেল, দূরে সুফিয়া আর তার বোন জুলেখা শাক তুলছে। মোতালেবকে গাড়ি দাঁড় করাতে বলে জামান শিকদার গাড়ি থেকে নেমে এলো। সুফিয়া মুখ তুলে জামান শিকদারকে এগিয়ে আসতে দেখেই এক গাল হেসে বোনের কনুইয়ে একটা খোঁচা দিলো। জুলেখা সামনে তাকিয়ে ওসি সাহেবকে দেখেই অপ্রস্তুত হয়ে মাথায় কাপড় দিতে গেল। জামান শিকদার সেদিকে এক নজর তাকিয়ে সুফিয়াকে বলল, ‘কী স্কুল নাই? শাক তুলছ বসে বসে?’
‘ইশকুল আইজ বন্ধ। আপনে এইদিকে কই আইছিলেন?’
‘আসছিলাম। একটু কাজ ছিল। তা… সুফিয়া তোমার বোন কি কারো সঙ্গে কথা বলে না?’
‘কয় না আবার? তয় অখন আমি থাকলে কইব না। আমি এট্টু ঐদিকের শাক তুইলা আনি। ও বু, কথা কও!’

জুলেখাকে চরম বিপদে ফেলে সুফিয়া সত্যি সত্যিই একটু দূরের ক্ষেতের দিকে এগিয়ে গেল।
জামান শিকদার জুলেখাকে বলল, ‘সেদিন তো অনেক কথা বলেছিলে। এখন এত লজ্জা পাও কেন?’
জুলেখা অধোমুখী হলো। জামান শিকদার মনে মনে ঠিক করে, এবারে মাকে একবার কদমপুর থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে যাবে। মাও অনেকদিন ধরে তাড়া দেয়। তারও বয়স ঘোড়দৌড় লাগিয়েছে। এবারে দুটোকেই বাগে আনতে হবে।
জুলেখার রঙটা একটু চাপা। কিন্তু সেই নিয়ে চিন্তা নেই জামান শিকদারের। কোনো এক কনে দেখা আলোতে যে অপূর্ব আলোকচ্ছটা এসে পড়েছিল জুলেখার মুখে, তা যেন তার ভেতরের সৌন্দর্যটাকেও তার কাছে দৃশ্যমান করে তুলেছে। বাইরের এই চাপা রঙের আড়ালে চাপা পড়া সেই সোনারঙ্গা মুখ জামান শিকদারের মানসপটে আঁকা হয়ে গিয়েছে।

ওদিকে বসে বসে দিনে দুপুরে মশার কামড় খাচ্ছিল মোতালেব। পথচলতি এক পথিক পুলিশের গাড়িকে বসে থাকতে দেখে বলে, ‘কী হইছে? পুলিশ আইছে ক্যান?’
মোতাবেল বিরক্ত মুখে বলে, ‘তুমাগো গেরামে নাকি চোরের উৎপাতে টেকা যাইতাছে না! এত চোর কই থেইকা পয়দা হইল? ওসি সাব তো চোররে ডর দেখাইতেই রোজ আইতাছেন!’
পথিক কিছু বুঝতে না পেরে হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘চোর মনে হয় ওসি সাবের নিজেগো লোক! আমরা তো কিছু ট্যার পাইলাম না!’
পথিক ফোকলা দাঁতে হেসে নিজের পথ ধরে। মোতালেব গাল চুলকাতে চুলকাতে বলে, ‘আমিও তাই কই! সেইডাই হইব!’

(সমাপ্ত)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে