#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_তিন
সুফিয়ার মা হনুফা বেগম ছোটখাট চেহারার একজন মানুষ। বয়স চৌত্রিশ পঁয়ত্রিশের আশেপাশে। তার বেশি হবে না। সুফিয়ার যখন জন্ম হয়, তখন সে আঠারো কী উনিশের এক অল্পবয়সী মেয়ে।
তার বাপের বাড়িতে ছিল মেয়ে সন্তানের ছড়াছড়ি। বাপ চাচা এক বাড়িতেই থাকতো। হাঁড়ি আলাদা করেনি কখনো। চাচার আবার ছিল দুইটা সংসার। সেই দুই সংসারে নয়টি মেয়ে সন্তান জন্মেছিল। দুই স্ত্রীর একজনও তাকে একটি পুত্র সন্তানের মুখ দেখাতে পারেনি। এই পুত্র সন্তান পাওয়ার আশাতেই চাচা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল। আর সেদিক দিয়ে হনুফা বেগমের বাবার অবস্থাও খুব বেশি ভালো ছিল না। তার ঘরে ছিল পাঁচ মেয়ে এক ছেলে। অর্থাৎ পুরো বাড়িতে ছিল মাত্র একজন ছেলে।
সেই একমাত্র ছেলে অর্থাৎ হনুফা বেগমের ভাইয়ের আদর আহলাদের কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না। রাজপুত্রের মতো আদরে বড় হচ্ছিলো সে। পরিবারের একমাত্র চেরাগ। এই চেরাগের কিছু হলে পরিবারটি অন্ধকারে ডুবে যাবে। আলো দেখানোরই কেউ থাকবে না।
আর অন্যদিকে মেয়েদের অবস্থা ছিল সেইরকমই নিদারুণ। পঙ্গপালের মতো এতগুলো মেয়েকে জন্ম দিতে গিয়ে বাড়ির বউদের দুর্দশাও কিছু কম ছিল না। একে তো শরীর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছিল, তার ওপরে মনে ছিল না শান্তি। দিনরাত স্বামী- স্ত্রী, জায়ে জায়ে খিটিমিটি লেগে থাকতো। সংসারের শান্তি বলে কিছু ছিল না।
স্বামীদের কাছে দুই বউয়েরই মান-সম্মান বলতে কিছুই ছিল না। সামান্য কিছু হলেই তাদের খোঁটা দেওয়া হতো এই বলে, ‘আর কী পারবা, পারবা তো খালি গণ্ডায় গণ্ডায় মাইয়া বিয়াইতে! ঐ এক কাম করবার লাইগাই তো আইছো!’
আসলে তাদের স্বামীদেরও দোষ দেওয়া যায় না। কীভাবে কোনদিক দিয়ে এতগুলো মেয়েকে তারা পার করবে, সেই চিন্তাতে দুইভাইয়ের কারোরই রাতে ঘুম আসতো না।
হনুফা বেগমদের বাড়ির অবস্থা এমনিতে খারাপ ছিল না। তার বাবা ছিল মাছের ব্যবসায়ী, চাচাও এটা সেটার খুচরো ব্যবসা করত। কিন্তু এতগুলো মেয়েকে পার করতে গিয়ে তাদের অবস্থা হয়ে পড়েছিল বেহাল। গ্রামদেশে যৌতুক ছাড়া মেয়েদের বিয়ে দেওয়া যায় না। তার ওপরে সবগুলো মেয়েই আবার ছিল পিঠেপিঠি। একজনের বিয়ে দিয়ে আরেকজনকে যে বেশ কিছুদিন বসিয়ে রাখবে তার উপায় ছিল না কোনো। ফলে তারা একরকম চোখ কান বন্ধ করে যেমন তেমন করেই সবগুলো মেয়েকে পার করেছে।
হনুফা’র বড় দু’বোনের বিয়ে হয়েছিল এক ভ্যানচালক আর এক রাজমিস্ত্রির সাথে। সেই দুই বিয়ে দিতেও হনুফার বাবাকে মোটা অঙ্কের যৌতুক গুনতে হয়েছে। তার ওপরে ছিল আরো তিন মেয়ের চিন্তা। অবশ্য তার মনে আশার আলো ছিল। মনে মনে দিন গুনছিল কবে ছেলের বিয়ে দিতে পারবে। এক ছেলের বিয়ে দিয়ে আগের সব ক্ষয় ক্ষতি পুষিয়ে দেবে, এমনটাই ইচ্ছে ছিল তার। হনুফার বিয়ে দিতে গিয়ে দেখা গেল, হাতের টাকা পয়সা একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আর তার ভাইয়ের অবস্থা তো আরো করুণ। এদিকে মেয়ের বিয়ের বয়সও যায় যায়। হনুফার বাবা চিন্তা করে দেখলো, হনুফার বিয়ে দিতে আর বেশি দেরি করলে মহা প্যাঁচে পড়ে যাবে। কারণ দুই বছরের ছোট আরেকজন ইতিমধ্যেই সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে আছে।
সেই কঠিন সময়েই পাশের গ্রামের নেয়ামত উল্লাহর খোঁজ পেয়ে গেল হনুফার বাবা। একেবারে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো।
অল্প কিছুদিন হলো নেয়ামত উল্লাহর বউ মরেছে। সেই ঘরে বছর সাতেকের একটা মেয়েও আছে। এটুকু বাদে আর সবকিছুই ভালো। নেয়ামত কাঠের কাজ করে। কাঠ কেটে নানারকম আসবাবপত্র তৈরি করে। রোজগার পাতি বেশ ভালো। কারণ তার গ্রামে সে ছাড়া আর কোনো কাঠের মিস্ত্রী নেই। এসব বাদেও আরো ভালো খবর হচ্ছে, নেয়ামত উল্লাহ কোনো যৌতুক চায় না। সে শুধু তার মা মরা মেয়েটার দেখাশোনার জন্য বিয়ে করতে আগ্রহী।
হনুফার বাবা দোটানায় পড়ে গেল। একে তো ছেলে দোজবর, তার ওপরে ছোট বাচ্চাও আছে। বিষয়টাতে তার মনের মধ্যে যে একটু খুঁতখুঁত করছিল না তা নয়। কিন্তু যৌতুকবিহীন বিয়ের এত বড় সুযোগটা হাতাছাড়া করতেও তার মন সায় দিচ্ছিলো না।
প্রস্তাবটা বাড়িতে আনতেই হনুফা আর তার মা দুজনেই মহা গ্যাঞ্জাম শুরু করে দিল। হনুফা পুরোপুরি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিল। গলায় ফাঁস দিয়ে মরারও হুমকি দিল। হনুফার মা চিৎকার দিয়ে বাড়ি মাথায় তুললো,
‘এদ্দিন ম্যালা কিছু কইছেন, কানে তুলিনি। মাইয়া বিয়াইছি, মহা পাপ করছি। আইজ না কইয়া যামু না। আমার মাইয়াটারে পানিত ভাসাইয়া দিবেন? দুজবরে বিয়া দিবেন?’
হনুফার বাবা ভীষণ বিরক্ত হলো। মেয়েমানুষ না জেনেবুঝে বেশি কথা বলে। তারা শুধু আগাটাই দেখে লাফালাফি করে। গোড়ার মিষ্টিটা কখনো এদের চোখে পড়ে না। তবু মাথা ঠান্ডা রেখে শান্তভাবে স্ত্রী কন্যাকে বোঝাতে থাকে সে।
‘দ্যাখো হনুফার মা, হনুফা কি আমার মাইয়া না? দুজবরে বিয়া দিলেই কি পানিত ফালাইয়া দ্যাওয়া হয়? তুমার বড় দুই মাইয়ারে ভ্যানআলা আর রাজমিস্ত্রীর লগে বিয়া দিলাম। তাগো আয় রোজগার ভালা না। তখন ত কিছু কইলা না! খালি দুজবর হইলেই খারাপ হইয়া গেল! আমি খুঁজ নিছি। নেয়ামত পোলাডা বড় ভালা। এক ট্যাকাও যৌতুক চায় না। বয়সও তেমুন বেশি না। আজেবাজে নেশা করে না। স্বভাব চরিত্র বড় ভালা। খালি তার মা মরা মাইয়াটারে একটু দেইখা শুইনা রাখবো এমুন একটা বউ চায়। চাওয়াটা তো খুব বেশি না, তাই না? অহন চিল্লাচিল্লি বন্ধ কইরা মাইয়ারে বুঝাও।’
হনুফা বেগম কম হুজ্জোত করেনি সেদিন। দড়ি কলস নিয়ে পুকুরে ঝাঁপও দিয়েছিল। লোকজন দিয়ে তাকে পানি থেকে ওঠানোর পরেও তার ফোঁসফাঁস কমেনি। তার ঐ এক কথা, সে মরবে তবু নেয়ামত উল্লাহকে কিছুতেই বিয়ে করবে না! একে তো দোজবর, তার ওপরে সতিনের মেয়েকে দেখতে হবে। তার বোনদের গরীবের বাড়িতে বিয়ে হলেও এসব ঝামেলা তো কারো ছিল না! সব ঝামেলা কেন তার ঘাড়েই এসে পড়বে?
শেষমেষ অবশ্য তার সব প্রতিরোধই ব্যর্থ হয়েছিল। আসলে তার বাবার আর ক্ষমতাও ছিল না। মোটা অঙ্কের যৌতুক দিয়ে অবিবাহিত কাউকে খুঁজে নিয়ে আসা তার দরিদ্র পিতার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাধ্য হয়েই নেয়ামত উল্লাহকে বিয়ে করে হনুফা বেগম। এই মেনে নেওয়া সমঝোতার জীবনে তার আক্ষেপের কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না।
এমনিতে তার স্বামী নেয়ামত উল্লাহ নিতান্তই সাদাসিধা গোবেচারা প্রকৃতির মানুষ। মেয়েটাও শান্ত বাছুরছানা ধাঁচের। নিজে থেকেই বাড়ির সব কাজে হাত লাগায়। সৎ মায়ের মন রক্ষা করে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু হনুফা বেগমের তাতে মন ভরে না। নিজেকে তার বড় প্রতারিত মনে হয়। সে তো দেখতে তার অন্য বোনদের চেয়ে কিছু কম সুন্দর ছিল না! তাহলে তার ভাগ্যই এমন ফুটো হবে কেন?
এদিকে নেয়ামত উল্লাহর মনেও সুখ ছিল না। যে উদ্দেশ্য নিয়ে সে বিয়ে করেছিল, তা পুরোপুরিই মাঠে মারা গেছে। নতুন বউ তার মেয়ে জুলেখাকে দু’চোখে দেখতে পারে না। কচি মেয়েটা সৎ মায়ের মন জয় করার জন্য সব কাজের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। তবু সৎ মায়ের মন পায় না সে।
নেয়ামত উল্লাহ নিজেও হনুফা বেগমের সামনে মেয়েটাকে একটু আদর করতে পারে না। জুলেখার সাথে একটু নরম সুরে কথা বললেও হনুফা বেগম হিসহিসিয়ে ওঠে, ‘বাপ-বেটির সোহাগ দেখবার লাইগাই তো আইছি এই বাড়িত। আমি দুনিয়ার কামকাইজ কইরা মরি। আর তুমরা বইয়া বইয়া হাউশ করো!’
অবাক লাগে নেয়ামতের। মেয়ে মানুষ নাকি মায়ের জাত। তাহলে মায়ের জাত এক নারী কীভাবে সাত বছরের এক শিশুর প্রতি এতটা নির্দয় হতে পারে? মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। কী করতে গিয়ে কী হয়ে গেল!
জুলেখার মা’র সাথে কাটানো সেই নয়টি বছর ঘুরে ফিরেই তার মনের মধ্যে ফিরে ফিরে আসে। তার প্রথম বউটি ছিল খুব নরম সরম, বোকা সোকা। একেবারে জুলেখার মতোই। সাত চড় দিলেও রা করতো কী না সন্দেহ। অবশ্য চড় মারার মতো মানুষ কখনোই ছিল না নেয়ামত। সে তার বউকে মাথায় তুলেই রেখেছিল। এক সন্তানকে নিয়ে সংসারে তার কোনোরকম অশান্তি ছিল না। তবু কীসের এক সামান্য জ্বরে তার শান্তশিষ্ট ভালোমানুষ বউটি পরপারে চলে গেল।
মেয়ে আর মেয়ের বাপের খাওয়া দাওয়ার অসুবিধা হবে ভেবে তার বউ কখনো বাপের বাড়িতে পর্যন্ত যেতে চাইত না। অথচ সেই মেয়ে আর স্বামীকে এভাবে একলা অসহায় রেখে সে কোন অজানা দুনিয়ায় একা একা পাড়ি জমালো!
নেয়ামত নিজের কথা ভাবেনি কোনোদিন। সে সামান্য কিছু একটু পেলেই খুশিমনে খেয়ে নেয়। একটুখানি ভাত ডাল তরকারি সে নিজেই রান্না করে নিতে পারে। শরীরের জৈবিক চাহিদাও কখনোই খুব বড় কিছু হয়ে সামনে আসেনি তার। শুধু মেয়েটাকে নিয়েই মনোকষ্টে ভুগতো সে। কতই বা বয়স তার মেয়েটার! এই বয়সে মায়ের কথা মনে পড়লে দুনিয়া দু’ভাগ হয়ে যায়। ইচ্ছে করে মায়ের হাতে মাখা গ্রাস খেয়ে, মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে গল্প শুনতে।
তার প্রথম বউটি ছিল কালো। কিন্তু ভারী মায়াকাড়া মুখের গড়ন। জুলেখার মুখটিতে যেন তার মায়ের মুখখানাই কেটে বসানো হয়েছে। সেই মুখের দিকে চেয়ে নেয়ামত উল্লাহর বুকটা হু হু করে উঠতো। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল মনে, এমন মায়াকাড়া শিশুকে কোনো নারীই না ভালোবেসে পারবে না। সে বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে শুরু করে আবার। বিয়ে করে জুলেখার জন্য নতুন মা আনবে।
সবকিছুই হলো, শুধু জুলেখার মা হয়ে কেউ এলো না এই বাড়িতে। অভাগিনী মা’হারা জুলেখা আর কোনোদিনই মায়ের আদর ফিরে পেল না।
মাঝখান থেকে লাভের মধ্যে এই লাভ হলো, নেয়ামত এখন জুলেখার জন্য একটা টাকাও খরচ করতে পারে না। আগে জুলেখাকে সে শখ করে কিছু একটা কিনে দিতে পারতো। এখন প্রতিটি পাই পয়সার হিসাব বউ হনুফার কাছে জমা রাখতে হয়। কোন টাকা কীভাবে খরচ হচ্ছে সবকিছুরই কড়ায় গণ্ডায় হিসাব রাখে হনুফা।
বিয়ের পরের বছর সুফিয়ার জন্মের পরে থেকে হনুফা বেগমের এই হিসাব নিকাশ কয়েকগুণ বেড়েছে। নারীজাতি মায়ের জাত ঠিকই, তবে সব শিশুর জন্য সে মা নয়। যে নারী জুলেখাকে নিজের সন্তান ভাবা তো দূর সামান্য স্নেহ দিতেও নারাজ, সেই নারীই সুফিয়ার জন্য স্নেহের সাগর। তবে হনুফার মেজাজের হালচাল এতটা খারাপ হতে শুরু করেছে সুফিয়ার জন্মের তিন চার বছর পরে থেকে। এর আগে হনুফা রাগী প্রকৃতির থাকলেও এতটা বদমেজাজী ছিল না।
সুফিয়ার যখন তিন কী চার বছর বয়স, তখন হনুফার একদিন প্রচণ্ড পেটে ব্যথা আরম্ভ হয়। সেই সাথে তীব্র রক্তপাত। তাড়াতাড়ি সদরের হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করাতে হয় হনুফাকে।
সুফিয়ার দেখাশোনার ভার ছিল জুলেখার ওপরেই। সুফিয়াকে খাওয়ানো, গোছল করানো, কোলে পিঠে রাখা…সব কাজই সেই একরত্তি জুলেখাই করতো। এতে তার মোটেও আপত্তি ছিল না। বরং সে এতে ভীষণ আনন্দিত ছিল। সুফিয়া তার কাছে ছিল এক জ্যন্ত পুতুল। এগারো বছরের জুলেখা সেই তিন বছরের জ্যন্ত পুতুল দিয়ে দিনরাত খেলায় মেতে থাকতো।
কঠিন অসুখ ধরা পড়ে হনুফার। শরীরের একটা অঙ্গ ফেলে দিতে হয়। গর্ভাশয়…যা না থাকলে কোনো মেয়ে মা হতে পারে না কখনো।
হনুফার খুব শখ ছিল পুত্র সন্তানের জননী হওয়ার। যে মেয়ে সন্তান হয়ে জন্মানোর কারণে তাকে তার বাবার বাড়িতে এত অবজ্ঞার শিকার হতে হয়েছে, সেই মেয়ে সন্তানই যে পুত্রের জন্ম দেয়, সেটা তার সবাইকে দেখিয়ে দেওয়ার সাধ ছিল। ছেলে কোলে নিয়ে বাপের বাড়ি নাইওর যাওয়ার সুপ্ত বাসনা ছিল তার মনে।
আর তাছাড়া, মনে মনে একটা তীব্র ভয়ও কাজ করতো হনুফার। জুলেখার প্রতি নেয়ামত উল্লাহর চোরা টানটা সে ঠিকই বুঝতে পারতো। ঐ কালো মেয়েকে পরের বাড়ি পার করতে গিয়ে যদি সব জমানো টাকা পয়সা শেষ করে ফেলে তার স্বামী… এই ভয় তাকে শান্তি পেতে দিত না কখনো।
হনুফার স্বামী তার সামনে মেয়েকে আহলাদ দেখায় না ঠিকই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে জুলেখার প্রতিই যে টানটা তার বেশি এটা হনুফা ভালোই টের পায়। তার নিজের একটা ছেলে থাকলে আর চিন্তা ছিল না। সবকিছুর মালিক হতো সেই ছেলে। কিন্তু সে নিজেও তো এক মেয়ে সন্তানেরই জননী। সেই মেয়ে যে সবকিছুর বেশি ভাগ পাবে, এমনটা কি আর হতে দেবে হনুফার স্বামী?
আর কখনোই মা হতে পারবে না, এই সত্যিটাকে বুঝতে পারার পর থেকেই হনুফা একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে। সে যেন এখন এক হিংস্র বাঘিনী যে প্রতি মুহূর্তে তার বাচ্চাকে বাঁচানোর চিন্তায় ব্যগ্র হয়ে আছে।
যার জন্য এতকিছু সেই সুফিয়া কিন্তু মোটেও তার মায়ের ধাঁচ পায়নি। সে হয়েছে একেবারে দুনিয়ার অন্যরকম। কারো সাথেই তার আচার আচরণে মিল নেই। ডাকাবুকো, ভয় ডর নাই বললেই চলে। মায়ের শাসনের সে ভয় করে না। আবার বাবার স্নেহেরও সে কাঙ্গাল নয়। প্রচণ্ড জেদি, একরোখা…আবার সেই সাথে চরম প্রতিবাদী। অথচ কারো প্রতি মায়াদয়াও কিছু কম নেই তার মনে। একেবারেই বিপরীতমূখী চরিত্রের এক মানুষ এই সুফিয়া।
ছোটবেলা থেকে যে সৎবোন তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে, তার প্রতি মায়ের দুর্ব্যবহারে সে বোনের প্রতি আরো প্রগাঢ় মমতা বোধ করে। অসহায় ভালোমানুষ বোনটাকে সে সবকিছু থেকে আগলিয়ে রাখে, যেমন ভাবে বোন তাকে তার ছোটবেলায় আগলে রেখেছে। নেয়ামত উল্লাহ দূর থেকে দুই বোনের মাখামাখি ভরা ভালবাসা দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মনে মনে ভাবে,
‘পোড়াকপালী! তাও তো কিছু একটা ভাগ্য নিয়া আইছিলি! সৎবুইনের ভালোবাসা পাওয়া থাইকা আল্লাহ্ তোরে ফিরাইয়া রাখেনি।’ (ক্রমশ)
#ফাহ্মিদা_বারী