কখনো বা দেখা হবে পর্ব-০৪

0
2304

#কখনো_বা_দেখা_হবে
#পর্বঃ৪
#লেখিকাঃদিশা_মনি

ক্লাস শেষ হলে সিনথিয়া বেরিয়ে আসে। তার সাথে সদ্য পরিচয় হওয়া ঝর্ণা নামের মেয়েটাও সিনথিয়ার পিছু পিছু চলে আসে। মেয়েটা বড্ড বেশি মিশুক হয়তো। সিনথিয়া কারো সাথে সহজে মিশতে পারে না জন্য তার অস্বস্তি হচ্ছিল। ঝর্ণা সিনথিয়াকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে। নিজের সম্পর্কেও অনেক কিছু বলছে। সিনথিয়া শুধু শ্রোতা হয়ে শুনছে সব। কথা বলার আগ্রহ তার মধ্যে খুব একটা নেই। ঝর্ণার যেন সেসবে কোন ভাবাবেগ নেই। সে নিজের মতো বকবক করেই চলেছে।

সিনথিয়া ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। ঝর্ণা আচমকা তার হাত টেনে বলে,
‘চলে যাচ্ছ কেন? ক্যান্টিনে চলো কিছু খাই।’

সিনথিয়া বেশ অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কারণ তার কাছে তো টাকা নেই। খুব ক্ষিধেও পেয়েছে। বাড়ির যা পরিস্থিতি দেখল আজ খাবার জুটবে বলে মনে হয়না। সিনথিয়া কয়েকটা টিউশনি করিয়ে নিজের খরচ চালায়। ভার্সিটি থেকে ফিরেই তাকে টিউশনি করাতে যেতে হবে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে হাটতেও পারছে না। কিন্তু এখন তো বিনা পয়সায় কিছু খেতেও পারবে না। তাই সিনথিয়া ঝর্ণার উদ্দেশ্যে বলল,
‘আমার বাড়িতে খুব জরুরি কাজ আছে। তাই আমার হাতে খুব বেশি সময় নেই। আমাকে যেতে হবে।’

ঝর্ণা কোন কথাই যেন শুনল না। সিনথিয়াকে একপ্রকার জোর করে ক্যান্টিনের দিকে টেনে নিয়ে গেল। অতঃপর সিনথিয়াকে নিজের পাশে বসিয়ে দিল। সিনথিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলে,
‘তুমি আজ থেকে আমার ফ্রেন্ড। আর আমার একটা রুলস আছে। যারা আমার নতুন ফ্রেন্ড হয় তাদের আমি ট্রিট দেই৷ সেই অনুযায়ী আজ তুমি আমার থেকে ট্রিট ডিজার্ভ করো। বলো কি খাবে তুমি?’

সিনথিয়া না করতে যেয়েও পারল না৷ জীবনে এমন আন্তরিকতা অনেক দিন থেকে পায়না সিনথিয়া৷ মায়ের মৃত্যুর পর কেউ সেভাবে সিনথিয়ার খেয়াল রাখেনি, কিংবা তাকে নিয়ে ভাবেনি। তাই ঝর্ণার এমন আন্তরিক আবেদন ফেলতে পারল না সে। বললো,
‘আপনি যেহেতু আমায় ট্রিট দেবেন তাই আপনার যা মন চায় দিন।’

সিনথিয়ার কথা শুনে ভ্রু কুচকালো ঝর্ণা। বলল,
‘আপনি আবার কি? আমরা না ফ্রেন্ড। ফ্রেন্ডদের আবার কে আপনি বলে? আমাকে তুমি করে বলবা। নাহলে তোমার সাথে কিন্তু আর কথা বলব না।’

সিনথিয়া খানিকটা থতমত খেলো। সামাজিকতার বড্ড অভাব তার মধ্যে। খুব মেপে কথা বলে। তবুও ঝর্ণার মন রাখতে বলল,
‘আচ্ছা। তুমি করেই বলব।’

ঝর্ণা নিজের পছন্দসই খাবার অর্ডার করল। অতঃপর দুই জনে মিলে খাবার খেলো।

৭.
ক্যান্টিন থেকে খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঝর্ণার সাথে ভার্সিটি থেকে বাইরে আসল সিনথিয়া। আচমকা তাদের সামনে এসে একটি বাইক থামলো। রাজীব এসেছে তার বাইক নিয়ে। সিনথিয়ার সামনে এসে তার দিকে হেলমেট বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘এটা পড়ে তাড়াতাড়ি উঠে আসো।’

সিনথিয়া আপত্তি করবে কিনা ভাবছিল এমন সময় ঝর্ণা তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
‘এটা কে? তোমার বয়ফ্রেন্ড? বাবাহ্ তোমার বয়ফ্রেন্ডও আছে।’

সিনথিয়া থতমত খেয়ে বলল,
‘না না তেমনটা নয়।’

‘আরে এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। মানুষের তো বয়ফ্রেন্ড থাকতেই পারে। এতে লজ্জার কি আছে? আমার নিজেরও তো বয়ফ্রেন্ড আছে। সে এই ভার্সিটিতেই পড়াশোনা করে। একদিন তোমার সাথেকে দেখা করিয়ে দিবো। এখন তুমি তোমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে যাও। গুড বাই।’

সিনথিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ঝর্ণা চলে যায়। সিনথিয়াও বেশি কিছু না ভেবে হেলমেট পড়ে রাজীবের বাইকে উঠে পড়ে। কারণ সে চেনে রাজীবকে। তাকে হাজার বারণ করেও কোন লাভ নেই। তাই খামোখা প্যাঁচালে না জড়ানোই শ্রেয় মনে করলো সিনথিয়া।

রাজীব সিনথিয়াকে তার বাড়ির ঠিক সামনে এসে নামিয়ে দিল। সিনথিয়া আজও তাড়াহুড়োয় রাজীবকে ধন্যবাদ না দিয়ে চলে যাচ্ছিল। তখন পিছন থেকে রাজীব বলে ওঠে,
‘যেচে উপকার করেছি জন্য কি সামান্য ধন্যবাদ টুকুও পাবো না!’

সিনথিয়া বিব্রতবোধ করে। পিছনে ফিরে রাজীবকে ধন্যবাদ জানায়। রাজীব মৃদু হেসে সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। খুব একটা সৌন্দর্য নেই এই মেয়ের মধ্যে। গায়ের রংটা বেশ চাপা, চেহারাতেও সেরকম লাবণ্য নেই। তবুও রাজীবের কেন জানি এই মেয়েটাকে খুব ভালো লাগে। যাকে বলে মন থেকে ভালো লাগা। তবে রাজীব দেখতে যথেষ্ট সুন্দর।

সিনথিয়া আর বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকে না। বাড়ির ভেতরে চলে যায়। অতঃপর রাজীবও প্রস্থান নেয়।

বাড়িতে প্রবেশ করতেই নতুন করে অশান্তির মুখোমুখি হয় সিনথিয়া। লুবনা আক্তার ছাদে ছিলেন। সেখান থেকে তিনি দেখেছেন রাজীব সিনথিয়াকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে। এই নিয়েই অশান্তির সূত্রপাত। লুবনা আক্তার উচ্চস্বরে বলছিলেন,
‘বে’হায়া মেয়ে। না’গরের সাথে ঢং করতে খুব ভালো লাগে। শুধু কাজের বেলাতেই যতো ভুল। সকালে কত দামী প্লেটগুলো ভেঙে দিল। শোন তোর ঢং আমি বের করছি। তোর বাবার সাথে কথা হয়েছে যত দ্রুত সম্ভব তোকে বিয়ে দিয়ে এই বাড়ি থেকে দূর করব। আবার দেখিস যে না’গর জুটিয়েছিস তার সাথে আবার ভে’গেটেগে যাস না।’

দাড়িয়ে দাড়িয়ে এত বাজে কথা শুনতে খুব খারাপ লাগছিল সিনথিয়ার। তাই সে দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল। প্রতিবাদ করলে যেখানে সমস্যা বাড়ে সেখানে প্রতিবাদ না করাই শ্রেয় মনে করে সিনথিয়া। রুমে এসে ফুপিয়ে কাদতে থাকে। সেলিনা আক্তারের ছবির সামনে দাড়িয়ে কান্নাভেজা গলায় বলে,
‘তুমি আমায় কেন ছেড়ে গেলে আম্মু? তুমি যাওয়ার পর যে আমাকে কেউ ভালোবাসে না। আমি যে আর পারছি না। আমাকে তুমি নিজের সাথে নিয়ে যাচ্ছ না কেন?’

৮.
দুটো টিউশনি করিয়ে বাড়ি ফিরতে বেশ সময় লেগে গেল সিনথিয়ার। নিজের মুঠো ফোন বের করে দেখল প্রায় সন্ধ্যা ৭ঃ৩০ টা বেজে গেছে। সামনে তার এক স্টুডেন্টের এনুয়াল এক্সাম। তাই বেশি বেশি করাতে হচ্ছে। এরজন্য অবশ্য অতিরিক্ত বেতনও পাবে। তবে সিনথিয়ার খুব ভয় লাগছিল। রাতের আধারে কয়েকটা গলি তাকে হেটেই পার করতে হবে। সিনথিয়া দোয়া দরুদ পড়ে যাচ্ছিল। আচমকা একটা গলির ভেতরে কয়েক জন ছেলেকে ক্যারাম বোর্ড খেলতে দেখতে পায়। সিনথিয়ার বুক ভয়ে কাপতে থাকে। মনে সাহসের সঞ্চার করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল সিনথিয়া। সিনথিয়াকে উদ্দ্যেশ্য করে ইতিমধ্যেই একটা ছেলে বাজে কথা ছু’ড়ে দিয়েছে। বলেছে,
‘এত রাতে চিড়িয়া যাচ্ছে কোথায়?’

সিনথিয়া সেসব কথাকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যাচ্ছিল। আচমকা একটি ছেলে এসে তার হাত টেনে ধরে। সিনথিয়ার দিকে তাকিয়ে বিশ্রী হাসি দিয়ে বলে,
‘এসেই যখন পড়েছ তখন আমাদের সাথে কিছু সময় থেকে যাও।’

ভয়ে স্থির হয়ে গেল সিনথিয়া। লক্ষ্য করল তার পুরো শরীর ঘামছে। এরকম পরিস্থিতিতে পড়বে জানলে কখনোই অতিরিক্ত সময় টিউশনি পড়াতে রাজি হতো না।

একে একে অনেকগুলো ছেলে সিনথিয়ার সামনে এলো। তাদের মধ্যে কয়েকজন নাক ছিটকিয়ে বলল,
‘এই মেয়েটা তো দেখতে একদমই ভালো না। একে দিয়ে কি করব আমরা?’

তখন যেই ছেলেটি সিনথিয়ার হাত ধরে ছিল সে বলে,
‘আরে মেয়ে তো মেয়েই হয়। সুন্দরী, কম সুন্দরবনে বড় কথা নয়। নাই মামার থেকে কা’না মামাই ভালো। আজ যখন একে পেয়েছি তখন একে দিয়েই কাজ চালিয়ে নেই।’

সিনথিয়ার এই মুহুর্তে রাজীবের কথা খুব মনে পড়ছিল। রাজীব থাকলে কিছু করতে পারত। সিনথিয়াকে রক্ষার কাজটা বেশ ভালোভাবেই করত।

সিনথিয়া একটা সুযোগ খুজছিল পালাবার। কিন্তু ছেলেগুলো এমন ভাবে তাকে ঘিরে ধরেছিল যে তাদের থেকে পালানো সম্ভব ছিল না।

সিনথিয়া আশা ছেড়ে দিল৷ ভাবলো আজ তার সর্বনাশ আর কেউ আটকাতে পারবে না। এমন সময় পুলিশের গাড়ির সাইরেন শোনা গেল। সাথে সাথেই ছেলেগুলো সব ভয়ে পালিয়ে গেল। ভাবল হয়তো পুলিশ এসেছে।

সিনথিয়ার কাছে সবটা স্বপ্ন লাগছিল। আজ যে এভাবে রক্ষা পাবে সেটা ভাবতেও পারেনি। সে সামনে এগিয়ে গেল কিন্তু পুলিশের গাড়ি দেখতে পেল না। সিনথিয়া বেশ অবাক হলো। সাথে সাথেই কেউ তার সামনে থেকে বলল,
‘পুলিশ আসে নি। আমি ফোনের মাধ্যমে পুলিশের গাড়ির সাইরেন শুনিয়েছি।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে