কখনো বা দেখা হবে পর্ব-০৩

0
2608

#কখনো_বা_দেখা_হবে
#পর্বঃ৩
#লেখিকাঃদিশা_মনি

রাজীব নিজের বাইকে করে সিনথিয়াকে তার ভার্সিটির সামনে এসে নামিয়ে দিল। তারপর চলে গেলো নিজের মতো৷ সিনথিয়া সামান্য ধন্যবাদটুকু দেওয়ার সময় পেলো না। সিনথিয়া ভাবল, আজ অব্দি রাজীব তাকে কতবার সাহায্য করেছে কিন্তু সে কখনো তাকে ধন্যবাদ বলতে পারে নি। কখনো বলতে চায়নি, কখনো বলার আগেই রাজীব চলে গেছে। এসব ভেবেই সামান্য হাসে সিনথিয়া।

রাজীব এমন একজন মানুষ যাকে সে ঘৃণায় করতে পারে না আবার ভালোও বাসতে পারে না।

এসব নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে করতেই ভার্সিটিতে ঢুকল সিনথিয়া। সাথে সাথে কয়েকজন মেয়ে এসে তাকে ঘিরে ধরল। সিনথিয়া ব্যাপারটা বুঝতে পারল না কিছুই। একজন মেয়ে সিনথিয়াকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
‘তুমি সেই মেয়ে না যে গতকাল আহিয়ান চৌধুরী অভিকে থা’প্পর দিয়েছিলে?’

আরেকজন বলল,
‘হ্যা এই মেয়েটাই তো। ভিডিওতে তো এই সেলোয়ার-কামিজ দেখা গেছে। তার মানে এই সেই মেয়ে যে অভিকে থা’প্পর দিয়েছিল। একে তো আজ আমি,, ‘

মেয়েগুলোর কথার বিন্দুমাত্র কিছু বুঝতে পারল না সিনথিয়া। যতটুকু বুঝল এখানে কোন ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। কারণ সে তো কাউকে থা’প্পর মা’রেনি। থা’প্পর তো দূর আজ অব্দি কারো সাথে উচু গলায় কথা বলেছে কিনা সন্দেহ। সেই মেয়ের উপর কিনা এমন অভিযোগ আনা হচ্ছে!

সিনথিয়া মেয়েগুলোকে উদ্দ্যেশ্য করে বলল,
‘আপনারা আমায় ভুল বুঝছেন। আমি কাউকে থা’প্পর দেই নি।’

‘ধরা পড়ে গেলে এমন মিথ্যা সবাই বলে। এখন এসব নাটক করে কোন লাভ হবে না। চলো সবাই এই মেয়েটাকে নিয়ে অভির কাছে নিয়ে যাই। অভি বিচার করুক এই মেয়েটার।’

সিনথিয়াকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টানতে টানতে তাকে নিয়ে যাচ্ছিল সবাই। সিনথিয়া এতগুলো মেয়ের সাথে গায়ের জোরে পারল না। তাই কিছু করতে পারছিল না। মেয়েগুলো সিনথিয়াকে ভার্সিটির পেছনের দিকে নিয়ে গেল৷ সেখানে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দাড়িয়ে আছে একটি ছেলে। তার পরণে কালো শার্ট ও প্যান্ট। তবে তার গায়ের রং অনেক ফর্সা।

মেয়েগুলো সিনথিয়াকে যখন ছেলেটির সামনে নিয়ে গেল তখন সেই ছেলেটি নিজের চোখের কালো সানগ্লাস খুলল। মেয়েগুলোর মধ্যে একজন বলল,
‘এই সেই মেয়ে যে গতকাল আপনাকে থা’প্পর মে’রেছিল।’

সিনথিয়া বুঝল এই ছেলেটিই হয়তো সেই অভি। যাকে থা’প্পর মা’রার অভিযোগে সিনথিয়াকে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে।

অভি সিনথিয়াকে ভালো করে পরখ করে নিল। তারপর মৃদু স্বরে বলল,
‘কালো জিনিস বরাবরই আমার পছন্দ। কিন্তু এই কালো মেয়েটিকে আমার ভালো লাগল না। আমাকে থা’প্পর মা’রে এত দুঃসাহস।’

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে কোন কিছু বিবেচনা না করেই সজোরে থা’প্পর বসিয়ে দিল সিনথিয়ার গালে।

৫.
সিনথিয়া সবার সামনে এমন অপমানিত হয়েও প্রতিবাদ করার সাহস পেল না৷ মেয়েটা যে বরাবরই এমন। তবে ন্যাকাকান্নাও করল না। সে শুধু নির্বাক চাহনিতে তাকিয়ে রইল অভি নামের অতিব সুদর্শন ছেলেটির দিকে। মনে মনে ভাবল,
‘লোকটা দেখতে যত সুন্দর এর মন ঠিক ততোটাই কুৎসিত।’

ভীড়ের মাঝে আচমকা একটি ছেলে আরেকটি মেয়েকে টেনে নিয়ে আসলো। ছেলেটিকে দেখে অভি বলল,
‘মিরাজ তুই এসে গেছিস। দেখ এই সেই মেয়ে যে গতকাল আমাকে থা’প্পর দিয়েছিল। আজ আমি রিভেঞ্জ নিয়ে নিলাম।’

মিরাজ নামের ছেলেটা ভড়কালো। তার জোড়া ভ্রুযুগল কুচকে গেল। সে হতবাক নয়নে তাকিয়ে বলল,
‘এসব কি বলছিস তুই? কোন মেয়ের উপর রিভেঞ্জ নিলি? এই দেখ আমি যেই মেয়েটাকে সাথে করে নিয়ে এসেছি সে তোকে থা’প্পর মে’রেছিল। মনে নেই কয়েকদিন আগে এই মেয়েটা তোকে প্রপোজ করেছিল। তুই রিজেক্ট করে দিয়েছিলি। তার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মুখে মাস্ক পড়ে তোকে থা’প্পর মে’রে পালিয়েছিল। কিন্তু ও জানে না মিরাজের চোখকে ফাকি দেওয়া এত ইজি নয়।’

মিরাজের কথা শুনে সবার মুখ থমথমে হয়ে গেল। সিনথিয়া সাহস করে এবার বলল,
‘আমাকে যদি যথেষ্ট অপমান করা হয়ে থাকে তাহলে আমি আসি।’

বরাবরই ঝামেলার থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলতে পছন্দ করে সিনথিয়া। তাই নিজের প্র‍তি হওয়া এই অন্যায়ের কোন প্রতিবাদ করতে তার মন চাইল না। কি হবে প্রতিবাদ করে? সেই তো দিনশেষে এসব নিয়ে ঝামেলা বাড়বে। বাড়িতে সৎমা আর বাবার অত্যাচারের থেকে ভার্সিটিতে এসেই যা একটু শান্তি পায়। এখন যদি সেই শান্তিটাও না থাকে তাহলে তার জীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠবে।

মিরাজ নামের ছেলেটা এবার বলল,
‘আমি যদি কোন ভুল না করে থাকি তাহলে অভি, তুই বোধহয় এই মেয়েটাকে সন্দেহ করে তাকে শাস্তি দিয়েছিস। বাট এটা তো ঠিক হয়নি। মেয়েটা তো ইনোসেন্ট ছিল। তোর ওকে সরি বলা উচিৎ।’

অভি অহংকারী ভাব নিয়ে বলল,
‘আমি কাউকে সরি বলি না। ভুল তো হতেই পারে। প্রয়োজনে সেই ভুলের জন্য আমি ক্ষতিপূরণও দেব।’

কথাটা বলে নিজের পকেট থেকে দশ হাজার টাকা বের করে সিনথিয়ার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
‘এই নিন আপনার ক্ষতিপূরণ। আশা করি একটা থা’প্পরের বদলে এটা যথেষ্টই আছে।’

সিনথিয়া টাকাটা নিল না। প্রতিবাদ না করলেও তার আত্মসম্মান বোধ তো আর শুণ্য নয়৷ তাই টাকা না নিয়েই চলে গেল নিজের ক্লাসের দিকে।

অভি সকলের উদ্দ্যেশ্যে,
‘আমাকে কি মেয়েটা এটিটিউড দেখিয়ে গেল? হোয়াট এভার, ওকে নিয়ে পরে ভাবা যাবে। আগে এই মেয়েটার ব্যবস্থা করি। আমাকে আহিয়ান চৌধুরী অভিকে থা’প্পর মা’রা। আর তোমাদের(যেই মেয়েগুলো সিনথিয়াকে ধরে এনেছিল তাদের দিকে ইশারা করে) কেও শাস্তি পেতে হবে ভুল মানুষকে নিয়ে আসার জন্য। জাস্ট ওয়েট।’

৬.
সিনথিয়া ক্লাসে এসে নিজের মতো একটি সিটে বসে পড়েছে। এই ভার্সিটিতে তার তেমন কোন বন্ধু নেই। কারো সাথে সহজে মিশতেও পারে না সিনথিয়া। ছোটবেলা থেকেই সে এমন। নিজেকে নিয়েই ভাবে সবসময়। কারো সাথে বেশি কথাও বলে না। তাই সিনথিয়ার ছোট থেকেই তেমন কোন ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধব ছিল না।

আজ ক্লাসে সিনথিয়া একেবারে শেষের দিকের ডেস্কে বসেছে। এমনিতে সে সামনেই বসে। তবে আজ যা কাণ্ড হলো তাই তার আসতে দেরি হয়ে গেছে। যার ফলে সামনের ডেস্কগুলো সব ভর্তি হয়ে গেছে। অগত্যা সিনথিয়াকে বাধ্য হয়ে পেছনের দিকেই বসতে হলো।

ক্লাসে লেকচারার প্রবেশ করল। সিনথিয়া ক্লাসে মনযোগ দিল। ক্লাস শুরুর ঠিক পাচ মিনিট পর একটি মেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ক্লাসরুমের সামনে এসে বলল,
‘মে আই কাম ইন স্যার।’

লেকচারার বিরক্ত হয়ে ঘড়ির দিকে তাকালেন। খানিকটা রাগী গলায় বললেন,
‘ক্লাস শুরু হয়েছে পাচ মিনিট আগে। এত লেইট হলে চলবে? তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করবে। নেক্সট টাইম থেকে যেন দেরি না হয়।’

মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। লেকচারারের অনুমতি পেয়ে ভেতরে আসল। কোন সিট ফাকা না পেয়ে সিনথিয়ার পাশেই বসে পড়ল মেয়েটি। সিনথিয়া একপলক তাকালো মেয়েটির দিকে। তাকে কেমন যেন খুশি খুশি লাগছে। সিনথিয়া ভ্রু কুচকালো। এক্ষুনি লেকচারারের বকা খেলো আর এখন এত খুশি দেখাচ্ছে। সিনথিয়া এ বিষয়ে বেশি কিছু না ভেবে পড়ায় মন দিল।

একটু পর লেকচারার জন্য নোট করতে বলল তখন মেয়েটি সিনথিয়াকে বলল,
‘আমি আজ পেন আনতে ভুলে গেছি। তোমার কাছে কি এক্সট্রা পেন হবে?’

অজানা একটি মেয়ে তুমি বলে ডাকায় বেশ অস্বস্তি বোধ করল সিনথিয়া। তবে তার কাছে অতিরিক্ত কলম ছিল৷ তাই দিয়ে দিলো। মেয়েটার দিকে কলম বাড়িয়ে দিতেই সে মৃদু হেসে কলমটা নিয়ে কৃতজ্ঞতার সাথে সিনথিয়াকে বলল,
‘থ্যাংকস। আমি ঝর্ণা। তোমার নাম কি?’

সিনথিয়া জোরপূর্বক হেসে বলল,
‘আমার নাম সিনথিয়া আক্তার।’

‘নাইস নেইম। আচ্ছা তুমি কি এই ভার্সিটিতে নতুন। আগে তো তোমায় খেয়াল করিনি।’

সিনথিয়া অবাক হলো না। কারণ ধুলোবালিতে এলার্জি থাকার জন্যে সে রোজ মাস্ক পড়ে ভার্সিটিতে আসে। কেউ সেভাবে তার চেহারা দেখেনি। আজ তাড়াহুড়ায় মাস্ক না পড়েই এসেছে। তবে ক্লাস চলাকালীন কথা বাড়াতে চায়না জন্য বলল,
‘ক্লাস শেষের পর কথা বলি।’

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে