#কখনো_বা_দেখা_হবে
#পর্বঃ২
#লেখিকাঃদিশা_মনি
সিনথিয়াকে তার বাড়িতে নিয়ে আসল রাজীব। সিনথিয়াকে সোজা পৌছে দিল তার রুমের দিকে। সিনথিয়ার খুব ভয় হতে লাগল। যদি আবার তারা সিনথিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এই নিয়েই সিনথিয়ার যত চিন্তা। রাজীব বুঝল সিনথিয়ার মনের কথা। তাই সিনথিয়াকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
‘তুমি একদম ভয় পাবা না৷ ওরা কেউ তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারবে না। কেউ তোমাকে কিছু বললে তুমি সেটা আমাকে এসে বলবে। নিজে তো প্রতিবাদ করা শিখো নি। তাই আমাকে তোমার হয়ে কথা বলতে হবে।’
সিনথিয়ার এই মুহুর্তে কি বলা উচিৎ সেটা সে ভেবে পেল না। রাজীব তাকে খোটা দিয়ে বললেও খুব একটা ভুল কথা বলে নি। আসলেই সিনথিয়া একটুও প্রতিবাদ করে না। তাই তো তার সৎমা এবং বাবা এত বেশি সাহস পেয়েছে।
রাজীব বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে লাগল। সিনথিয়া ভাবল একবার যে ধন্যবাদ বলবে। কিন্তু বলল না। কেন জানি এই রাজীব ছেলেটাকে তার একদম ভালো লাগে না। যদিও ছেলেটি সিনথিয়ার মা সেলিনার অনেক প্রিয় ছিল। সিনথিয়া তার মায়ের কাছে শুনেছিল, ১৮ বছর পার হওয়ার পর অনাথ আশ্রম থেকে রাজীবকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। তখন রাজীব কি করবে কি করবে না সেটাই বুঝতে পারছিল না। পেটের খাবার জোগাতে চুরি ডাকাতি শুরু করে। তবে একদিন মিসেস সেলিনা যখন রাস্তায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় তখন এই রাজীবই তাকে উদ্ধার করে এনেছিল। তখন থেকেই তাদের মধ্যে অনেক ভালো সম্পর্ক।
মিসেস সেলিনা বেচে থাকতে রাজীবকে অনেক সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। তার সাহায্যেই রাজীব এই এলাকায় একটি মুদি দোকান দিয়েছে। তবে রাজীবের স্বভাব এখনো বদলায় নি। আগের মতোই বখাটে রয়ে গেছে। সবসময় মা’রামারিতে তাকে পাওয়া যায়। যদিও অহেতুক ঝামেলা করে না সে। কোন অন্যায় দেখলে তার প্রতিবাদ করে।
সিনথিয়া ছোট থেকেই শান্তিতে বিশ্বাসী। কারো সাথে ঝামেলায় জড়াতে চায়না কখনো। সিনথিয়ার বিশ্বাস চুপ থাকলেই সবকিছুর সমাধান হয়ে যায়। প্রতিবাদ করে কোন লাভ হয়না। বরং কথায় কথা বাড়ে। শান্তিপ্রিয় সিনথিয়া তাই বরাবরই নিজের এই স্বভাবের জন্য অনেক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। তবুও নিজেকে বদলানোর চেষ্টা করে নি।
নিজের শান্তিপ্রিয় স্বভাবের কারণেই নিজের বিপরীতমুখী স্বভাবের রাজীবকে তার সহ্য হয়না। তার উপর যখন থেকে জানতে পেরেছে রাজীব তাকে পছন্দ করে তখন থেকে আরো বেশি দূরে দূরে থাকে। যদিও রাজীব কখনো সিনথিয়ার থেকে জোর করে ভালোবাসা আদায় করে নিতে চায়নি। শুধু সিনথিয়ার ব্যাপারে অনেক বেশি নাক গলায়। যা সিনথিয়ার পছন্দ নয়।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে নিজের রুমে চলে আসে সিনথিয়া।
৩.
লুবনা আক্তার সোফায় বসে বসে রাগে ফুসছেন। সিরাজুল হক তার পাশেই বসে আছে। লুবনা আক্তার বেশ রাগী গলায় বললেন,
‘তোমার সামনে একটা বাইরের ছেলে আমার সাথে এত খারাপ ব্যবহার করার সাহস কই পায়?’
‘আমি তো তোমার হয়ে কথা বললাম।’
‘থাক। এসব বলে লাভ নেই। আমি তোমার ঐ মেয়েকে আর সহ্য করতে পারছি না। ওকে তাড়াতাড়ি বের করে দেও তো।’
‘আমি তো এটাই বুঝতে পারি না তুমি ওকে সহ্য করতে পারো না কেন। আমাদের তো কোন সন্তান নেই।’
‘তোমাকে আমি আগেও বলেছিলাম আমি কখনো মা হতে পারব না। এটা জেনেও তো তুমি আমাকে ভালোবেসেছ।’
সিরাজুল ইসলাম মনে মনে বলেন,
‘তখন কি আর জানতাম আমাদের সম্পর্কের কথা সেলিনা এভাবে জেনে যাবে, আর তোমাকে বিয়ে করতে হবে। ‘
লুবনা আক্তার বলল,
‘ঐ মেয়েকে দেখলেই আমার তোমার প্রথম স্ত্রীর কথা মনে পড়ে। তাই ওকে আমি সহ্য করতে পারি না৷ তুমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে বিয়ে দিয়ে দাও। যা বুঝলাম ঐ রাজীব ছেলেটা থাকতে এমনি এমনি ওকে বিদায় করা যাবে না। বিয়ে দিলে তো আর কিছু করতে পারবে না।’
‘আচ্ছা দেখছি। কিভাবে কি করা যায়।’
✨
রাজীব নিজের বাসায় আছে। সিনথিয়াদের মহল্লাতেই একটি ভাড়া বাড়িতে থাকে রাজীব। খুব ছোট একটা ঘর। এই ঘরের নিজের জীবন সাজিয়ে নিয়েছে রাজীব। বাসায় এসে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিনথিয়ার ছবি দেখছিল রাজীব। আর ভাবছিল,
‘তোমাকে কিভাবে বোঝাবো কতো ভালোবাসি তোমায়। আমার ভালোবাসা কি তুমি কখনো বুঝবে না?’
রাজীবের মনে পড়ে যায়, এক ঝড়বৃষ্টির দিনে প্রথম যেদিন সে সিনথিয়াকে দেখছিল। সিনথিয়া তখন স্কুলে পড়ত। প্রথম দেখাতেই রাজীবের মনে দাগ কে’টে যায় সে। রাজীব আজও ভুলতে পারেনি বৃষ্টিভেজা সিনথিয়াকে। সেই থেকেই সিনথিয়া রাজত্ব করছে তার মনে। রাজীব কখনো চায়না জোরপূর্বক সিনথিয়াকে আদায় করে নিতে। বরং চায় সিনথিয়া যেন নিজে থেকে এসে তার কাছে ধরা দেয়। সিনথিয়ার জন্য তার যে অনুভূতি, সেই একইরকম অনুভূতির জন্ম হোক রাজীবের মনে। রাজীব জানে না কখনো তার এই চাওয়া পূর্ণ হবে কিনা। তবে সে খুব করে আল্লাহর কাছে চায়, আল্লাহ যেন তার এই ইচ্ছাটা পূরণ করে।
৪.
সিনথিয়া ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই ফজরের নামাজ আদায় করে নিল। গতকালের ঘটনার পর সিনথিয়া আজ আর কোন ঝুকি নিতে চায়না। তাই নামাজ আদায় করে বাড়ির সব কাজ করা শুরু করে দিল। বাড়ি ঝাড়ু দেওয়া শেষ করে রান্নাঘরে চলে এলো।
লুবনা আক্তার সকালে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠেন। রান্নাঘরে এসে সিনথিয়াকে দেখে মুখ বাকিয়ে বলেন,
‘আর ঢং করতে হবে না মহারাণী। তুই কেমন কাল বুঝে গেছি। খুব তো না’গর জুটিয়েছিস। বাড়ি এসে আমাকে অপমান করে যায়।’
কথাগুলো শুনে সিনথিয়ার গা গুলিয়ে আসে। কারো চিন্তাভাবনা এত নিচ কিভাবে হতে পারে সেটা ভেবে পায়না সিনথিয়া। আজ তার খুব করে ইচ্ছা করছে প্রতিবাদ করার। কিন্তু তখনই তার মনে পড়ে যায় গতকালের ঘটনা। এখন কিছু বললে যদি লুবনা আক্তার আবার তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয় তাহলে কোথায় যাবে সিনথিয়া? তার তিনকুলে যে কেউ নেই। সিনথিয়ার মা তার পরিবারের অমতে সিরাজুল হককে বিয়ে করেছিল৷ তখনই পরিবারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছিল সেলিনার। তাই নিজের মামার বাড়ির সাথে কোন যোগাযোগ নেই সিনথিয়ার।
বাকি রইল বাবার পরিবার। সিরাজুল হকের দুই বোন বিদেশে থাকে৷ সেখানে যাওয়াও সম্ভব না সিনথিয়ার কাছে। তাই নিজের এই অসহায়ত্বের জন্য চুপ থাকাই ঠিক মনে করে সিনথিয়া।
রান্নাবান্না শেষ করতে অনেক সময় পেরিয়ে যায়। সিরাজুল হক ও লুবনা আক্তার ব্রেকফাস্টের টেবিলে বসে আছে।
সিনথিয়া তাড়াহুড়ো করে খাবার আনতে গিয়ে হাত থেকে সেগুলো পড়ে যায়। লুবনা আক্তার রেগে গিয়ে বলেন,
‘দেখলে তো নিজের মেয়ের কান্ড। এমনি তো একে বাড়ি থেকে বের করে দিতে চাইনা।’
সিনথিয়া ভয় পেয়ে গেল। সিরাজুল হক উঠে বললেন,
‘আমার চেনাজানা একটা ছেলে আছে। ছেলেটা নতুন নতুন উকিল হয়েছে। ভাবছি ওর সাথে সিনথিয়ার বিয়ের ব্যাপারে কথা বলব।’
লুবনা আক্তার ভাবলেশহীন ভাবে বলেন,
‘উকিল হোক আর মুচি হোক। যাকে পাও ধরে বিয়ে করিয়ে দাও। এই মেয়ে বিদায় হলেই আমার হয়।’
সিনথিয়ার মনে আঘাত লাগল কথাগুলো শুনে। তাকে যে লুবনা আক্তার কতোটা বোঝা মনে করছে সেটা উপলব্ধি করতে পারছে সিনথিয়া। শুধু লুবনা আক্তার কেন সিনথিয়ার বাবাও তাকে বোঝাই যাবে। অথচ সিনথিয়ার মা বেচে থাকতে সবকিছু কতটা ভিন্ন ছিল। মা-বাবার রাজকন্যা ছিল সিনথিয়া। এই কয়েক বছরে চোখের নিমেষেই সব বদলে গেছে।
সিনথিয়ার চোখের সামনেই তার বাবা কতোটা বদলে গেল। আর নিজেকে সামলাতে পারছিল না সিনথিয়া। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। ভার্সিটির সময় প্রায় হয়ে এসেছে তাই দ্রুত পা চালাতে লাগল। টাকা না থাকায় ৩০ মিনিটের পথ হেটেই যেতে হয় তাকে।
আচমকা রাজীব নিজের বাইক নিয়ে এসে থামালো সিনথিয়ার সামনে। বলল,
‘উঠে পড়ো আমি তোমাকে দ্রুত ভার্সিটি পৌছে দেব।’
‘আমি একাই,,,’
‘যা বলছি চুপচাপ মেনে নাও।’
সিনথিয়া আর কথা না বাড়িয়ে রাজীবের বাইকের পেছনে উঠে বসল। রাজীব বলল,
‘আমাকে শক্ত করে ধরো। আমি কিন্তু খুব দ্রুত চালাই।’
সিনথিয়া রাজীবকে বেশ শক্ত করে ধরল। রাজীব ভীষণ খুশি হলো। খুশি মনে বাইক চালানো শুরু করল। তার মনে এখন এই গানটি বাজছে, ❝এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো তো।❞
চলবে ইনশাআল্লাহ ✨