কখনো কুর্চি পর্ব-১৩

0
51

কখনো কুর্চি (পর্ব ১৩)

একটা কথা কুর্চির জানতে খুব ইচ্ছা করল। জোড়া খুনের সাজা কি এক খুনের চাইতে বেশি হয়? যদি তেমন উনিশ বিশ নাহয় তবে ও আরিয়ান লুবনা দুজনকেই খুন করবে।
ফাজলামি হচ্ছে!
কাজ করবে সে আর “লুবনাও আমাদের সাথে থাকবে” করবে এরা!

আরিয়ানের কথার কোনো জবাব দিল না কুর্চি। উঠে দাঁড়িয়ে বলল
— শুচিকে নিয়ে আসতে হবে।
বলে আরিয়ানের অপেক্ষা না করেই ওয়েটিং এরিয়ায় বেরিয়ে এল। ওর পিছে কে এলো, কে এলো না, জানার দরকার নেই। এতোটাই রাগ লাগছে ওর। শুধু কি রাগ? আশাও কি ভঙ্গ হয়নি?
থামো! এনিয়ে আর একটা কথাও না। কেক খাওয়াখাওয়ির এখানেই শেষ। আর কখনো যেন না দেখি এসব। নিজেকে কঠিনভাবে বকল কুর্চি।

শুচি ওকে দেখে হাসিমুখে উঠে দাঁড়াল। ও শুধু কুর্চিকে চেনে, ওকে দেখে হাসল, বাকি দুজনকে চেনেও না। কুর্চি পরিচয় করিয়ে দিল
— এ আমার সহ ইন্টার্ভিউয়ার, আরিয়ান। আর ও হচ্ছে লুবনা। সেও আমাদের সাথে থাকবে আজ।
ওর পরিচয় দেবার বহর শুনে বাকি দুজনের চোখ কপালে উঠে গেল। কুর্চি গ্রাহ্য করল না। আজ ও কাউকে ছাড়বে না। সব কয়টা বিশ্বাসঘাতককে একেবারে ধুয়ে দেবে।
তাতে ওর চাকরি থাকল কি গেল, ফিরেও দেখবে না।

সবাই রেকর্ডিং স্টুডিওতে গিয়ে গোল টেবিলে বসল। রুবেল ইঙ্গিত করল শুরু করতে।
ওপেনিং সাধারণত আরিয়ানই করে। আজকেও শুরু করল।
— হাই লিসেনার্স, আরিয়ান বলছি। আমার সাথে বরাবরের মতো রয়েছে আমার কোহোস্ট কুর্চি। সাথে আরেকজন সারপ্রাইজ হোস্ট রয়েছে। বলতে পারবে কার কথা বলছি? যে বলতে পারবে তাকে এক কপি “প্রেম নেই জীবনে” গিফট করা হবে। প্লিজ লিসেনার্স, তোমরা কমেন্ট করো।

কমেন্টের হিড়িক পড়ে গেল, অনেকে অনেক নাম লিখল কিন্তু লুবনার নাম কেউ লিখল না। কুর্চি আশ্চর্য হয়ে দেখল এ একমাসে সবাই লুবনার নাম ভুলেই গেছে। এদিকে নিজের নাম দেখতে না পেয়ে লুবনা মুখ কালো করে বসে রইল।
— হল না, লিসেনার্স, তোমাদের মধ্যে কেউ সঠিক উত্তরটা দিতে পারোনি। আজ আমাদের সাথে কো কোহোস্ট হিসাবে রয়েছে ড্রিমজ রেডিওর ড্রিমার আমাদের অতিপ্রিয় লুবনা। লিসেনার্স, ব্যক্তিগত কারণে লুবনা কিছুদিনের জন্য হোস্টিং থেকে দূরে সরে গেছিল। কিন্তু আর না, আমরা আজ থেকে আবারো ফিরে পাচ্ছি আমাদের প্রিয় লুবনাকে।

কুর্চি আর সহ্য করতে পারল না। পনের মিনিট পার হয়ে গেছে। আরিয়ানের লুবনা গাঁথা এখনো শেষই হল না।
মেকি হাসি হাসল কুর্চি। আরিয়ানের মুখের কথা ছিনিয়ে নিয়ে বলতে আরম্ভ করল
— আরিয়ান, লুবনাকে নিয়ে এতক্ষণ সময় নষ্ট করা ঠিক হচ্ছে না হয়ত। আমাদের আসল গেস্টের সাথে এখনো সবাইকে পরিচয়ই করিয়ে দেয়া হল না। যারজন্য আমি, তুমি, আমাদের লিসেনার্স সবাই অধীর আগ্রহে বসে রয়েছি। তো শোনো লিসেনার্স, আজকের গেস্ট হচ্ছে আমারি ইউনিভার্সিটির একজন স্টুডেন্ট। তবে স্টুডেন্ট হলেও সে একজন লেখক। সম্প্রতি তার বই, “প্রেম নেই জীবনে” প্রকাশিত হয়েছে। শুধু প্রকাশিত বলছি কেন, তরুণ তরুণীর মাঝে ভালো সাড়া ফেলে দিয়েছে। তোমাদের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি আজকের আসল গেস্টের সাথে— শুচি।
“আসল” কথাটার ওপরে জোর দিয়ে ওপেনিং স্টেটমেন্ট শেষ করে আরিয়ানের দিকে তাকালো কুর্চি। দেখে আরিয়ানের মুখ থমথমে, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওরদিকে তাকিয়ে রয়েছে। হঠাত করে যেন বুঝে ফেলল কিছু। কুর্চি বুঝে নিল আরিয়ান বুঝেছে কুর্চি ওদের সবকথা শুনেছে।
বুঝুক গে। ওর কিছু এসে যায় না।

এদিকে আরিয়ান আর কুর্চি পরস্পরের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে দেখে শুচি খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে বসে রইল। ও কি কিছু বলবে নাকি বলবে না বুঝে পেল না।
হাল ধরল লুবনা
— হাই লিসেনার্স, লুবনা হিয়ার। আমার কথা নিশ্চয় ভুলে যাওনি সবাই? তবে আমি নিজের কথা না বলে আমাদের গেস্ট শুচির সাথে কথা আরম্ভ করি। আচ্ছা শুচি, তোমার বইটা নিয়ে একটু বলবে আমাদের?
শুচি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল
— নিশ্চয় বলব। আমার প্রেম নেই জীবনে বইটা মূলত খুব কাছে থেকে দেখা এক ত্রিভুজ প্রেমের গল্প। এখানে নায়ক নায়িকা একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ওদেরমাঝে একসময়ে ঘটে গেল প্রেম। কিন্তু নির্ঝঞ্ঝাট প্রেম আর হল না কারণ মাঝখানে ঢুকে পড়ে আরেকজন নারী।

কুর্চি খোঁচা না মেরে থাকতে পারল না
— সে নারী নিশ্চয় বিবাহিত?
— না।
— নায়কের পূর্ব প্রেমিকা?
— না।
— নায়িকার শত্রু?

লুবনা কথার মাঝে ঢুকে গেল। শ্লেষের সাথে বলল
— শুচিকে বলবার চান্স দিলেই বোঝা যাবে সে কে? তাকে যদি কথা বলতেই না দেয়া হয়…
গোমড়ামুখে কুর্চি জবাব দিল
— এখানে বোঝার কি আছে? নায়ক নায়িকার মধ্যে যে ঢুকে পড়ে সে সাধারণত হয় বিবাহিত নাহয় নায়কের পূর্ব প্রেমিকাই হয়। এদের তো খেয়েদেয়ে আর কাজ নাই। অন্যের প্রেম ধ্বংস করা, অন্যের ক্যারিয়ার ধ্বংস করাই এদের জীবনের একমাত্র লক্ষ। এইম ইন লাইফ।
আরিয়ান হতবাক হয়ে ইন্টার্ভিউ এর গতিপথ দেখছিল। এবারে ধমকে উঠল
— তাদের এইম ইন লাইফ কী, সেটা নাহয় আমরা শুচির মুখ থেকেই শুনি। তুমি যেদিন বই বের করবে, সেদিন শুনব তোমার গল্প।

শুচি নিজেও এতক্ষণ হাঁ করে সবার কথা গিলছিল। মুখ দেখে মনে হয় ওর ইন্টার্ভিউ দেবার শখ শেষ হয়ে গেছে। তারপরেও খাঁটি প্রফেশনালের মতোই আচরণ করল
— আসলে তৃতীয় জন জীবনের এক অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। একসময়ে জড়িয়ে পড়ল নায়কের সাথে। তার আসলে দোষ ছিল না। পরিস্থিতির শিকার।
গায়ে গরম পানির ছিটা পড়ার মতো চিড়বিড়িয়ে উঠল কুর্চি
— হুহ! পরিস্থিতির শিকার! এসব সবাই বলে। এসব বলে যাখুশি তাই করার লাইসেন্স পেয়ে যায়।
এতে লুবনা খুবি অফেন্ডেড হল
— তুমি জানো তার জীবনে কী চলছে? হুট করে একটা জাজমেন্ট পাস করে দিলেই হল নাকি?
গোঁয়ারের মতো বলল কুর্চি
— খুব ভালো করেই জানি। সব নষ্টের গোড়া এরা। সবজায়গায় ড্যামসেল ইন ডিস্ট্রেস সেজে সহানুভূতি কুড়ানোর জন্যই এদের জন্ম।

এবারে শুচি একটু শক্তভাবে নিজের দিকে এটেনশান ফিরিয়ে আনল
— আসলে সেকেন্ড যে নায়িকা তাকে আমি ড্যামসেল ইন ডিসট্রেস বানানোর চেষ্টা করিনি। চরিত্রের দিক দিয়ে সে বেশ মজবুত, শুধু পরিস্থিতি ওর আয়ত্তে নেই আরকি। নায়কও পড়েছে বিপাকে। সে মেইন নায়িকাকে সব খুলে বলতে পারছে না, এদিকে সেকেন্ড নায়িকার প্রতি একধরণের দায়িত্ববোধও ফিল করছে।
— তারমানে নায়কটা একটা লুচ্চা। দুই নায়িকাকে নাচাচ্ছে।

মুখ লাল হয়ে গেল আরিয়ানের। ভালুকের মতো গাঁকগাঁক করে উঠল
— মোটেই সে লুচ্চা না। মানুষের জীবনে এমন পরিস্থিতি আসতেই পারে।
পাথর চোখ নিয়ে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে রইল কুর্চি
— আচ্ছা আরিয়ান, তোমাকে একটা প্রশ্ন করি। তুমি তো ছেলে, তাই না?
— সন্দেহ আছে কোনো?
— সেটা প্রশ্নের উত্তরই বলে দিবে। আচ্ছা, তোমরা ছেলেরা নিজেদের কী ভাবো বলো তো? মেয়েদের জন্য একটা বিরাট কিছু? দুইটা মেয়েকে নাচাতে খুব ভালো লাগে, তাই না?
ভয়ংকর খেপল আরিয়ান। চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দিল
— এ প্রশ্নের উত্তর আমি দিব না কারণ প্রশ্নের সাথে আমাদের আজকের ইন্টার্ভিউয়ের কোনো সম্পর্ক নাই।
— অবশ্যই আছে। শুচি নিজেই বলেছে ওর নায়ক দুই নায়িকাকে নাচাচ্ছে।

— ইয়ে কুর্চি, আমি আসলে এমন কথা বলিনি। আমার বইয়ের নাম প্রেম নেই জীবনে দিয়েছি এক বিশেষ কারণে। সবার জীবনে প্রেম আসে না। এখানে তিনজনের মধ্যে একজনের জীবনে প্রেম আসেনি। তবে সেটা কে, আমি জানাবো না। তাহলে স্পয়লার হয়ে যাবে।
আজ কুর্চির মুখের জবাব একেবারে তৈরি, বুলেটের মতো বের হচ্ছে শুধু। বলল
— সে যে কে, সে তো বোঝাই যাচ্ছে। আসল নায়িকার জীবনে প্রেম নাই, সব প্রেম ঝরে ঝরে পড়ছে নায়কের জীবন থেকে!
আরিয়ান ক্ষিপ্তভাবে উত্তর দিল
— নায়কের জীবনে প্রেম না এলেই সবচাইতে ভালো কারণ প্রেমের মতো জঘন্য জিনিস আর নাই।
কুর্চির প্রতিউত্তরও রেডি ছিল
— মেইন নায়িকার জীবনেও দরকার নাই। বরং সব প্রেম সাইড নায়িকার জীবনেই আসুক। প্রেমের সাগরে ডুবে মরুক সে!
আতংকিত দেখালো শুচিকে
— প্লিজ, আমার বইয়ের স্পয়লার দিও না কেউ।

রুবেল এতক্ষণ মাথায় হাত দিয়ে কথোপকথন শুনছিল। ধীরে ধীরে আসল ব্যপারটা ওর কাছে স্পষ্ট হচ্ছিল। এখন শুচিকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে বলল
— চিন্তার কোনো কারণ নেই, শুচি। তোমার বইয়ের সেল সাংঘাতিকভাবে বেড়ে গেছে এইমাত্র খবর পেলাম। আজকের প্রোগ্রাম শুনে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বইটা কিনতে।

কান থেকে হেডফোন খুলে টেবিলের ওপরে ছুঁড়ে ফেলল কুর্চি
— তাহলে তো উদ্দেশ্য সফল হয়েই গেল। অভিনন্দন তোমাকে, শুচি। আর এরসাথেই শেষ হল আজকের ইন্টার্ভিউ।
কুর্চি উঠে দাঁড়িয়ে গটগট করে হেঁটে বের হয়ে গেল অফিস থেকে।
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে