কখনো কুর্চি পর্ব-১২

0
7

কখনো কুর্চি (পর্ব ১২)

শুক্রবারে একটু আগেই গিয়ে পৌছাল কুর্চি। এ ওর অভ্যাস। সময়ের আগে গিয়ে নিজেকে একটু গুছিয়ে নেয়, স্টুডিওটাও ফিটফাট করে নেয়, তারপরে গেস্টের জন্য অপেক্ষা করে। এরমধ্যে আরিয়ান, রুবেল, মিলন এসে পড়ে, ওরা একসাথে চা খেতে খেতে কথা বলে। তারপর গেস্ট এলে ইন্টার্ভিউ শুরু করে দেয়।

আজকে গেস্ট হিসাবে আসবে শুচি। পদবী রাখেনি, শুচি নামেই লেখক হিসাবে পরিচিত হতে চায় ও। সেদিন ইউনিতে গিয়ে শুচির নাম্বার জোগাড় করে ওরসাথে কথা বলে নিয়েছিল কুর্চি। শুনে শুচিও খুব আগ্রহ দেখিয়েছে, তখুনি দেখা করতে চলে এসেছে, বইও উপহার দিয়েছে ওকে। ওর বইটার কয়েক পাতা পড়ে দেখেছে কুর্চি। বেশ সাবলীল লেখা, ইউনিভার্সিটির বন্ধুদের নিয়ে লেখা, এজন্যই তরুণদের মাঝে সাড়া ফেলে দিয়েছে।
বইটা পড়ার সাথেসাথে কী কী প্রশ্ন করলে ইনটার্ভিউটা সুন্দর হয় সেটার একটা লিস্ট করে আরিয়ানকে পাঠিয়ে দিয়েছিল ও। আরিয়ান নিজেও কিছু প্রশ্ন সাজেস্ট করেছিল। দুটো মিলিয়ে ফাইনাল প্রশ্নের লিস্ট করে দুই কপি সাথে নিয়ে এনেছে। এসব আসলে মিলনের করার কথা। কিন্তু মিলন যেহেতু আর নাই তাই ও নিজেই করে এনেছে।

অফিসে ঢুকে একটু আশ্চর্য হল কুর্চি। খালি অফিস। রিসেপশান ডেস্কে সিঁথি নাই। ওয়েটিং এরিয়াও ফাঁকা। আজকে কি রাকীব স্যার আসেননি? যারজন্য ওয়েটিং এরিয়াতে কেউ অপেক্ষা করে নাই? উনি না এলেও সিঁথিই বা গেল কোথায়? অসুস্থ নাকি? কাজে আসেনি?
সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে রেকর্ডিং স্টুডিওর দিকে এগিয়ে গিয়ে দরজার নবে হাত দিবে, আশপাশের কোথাও গলার আওয়াজ শোনা গেল।
কেউ কথা বলছে? নাকি কাঁদছে?
কান খাড়া করল কুর্চি।
আজব তো। সত্যি মনেহয় কেউ কাঁদছে। শব্দটা ভেতর থেকেই আসছে।

রেকর্ডিং এ না ঢুকে কোরিডোর ধরে এগিয়ে গেল কুর্চি। কোরিডোরের শেষ মাথায় পরপর দুইটা রুম। শেষের রুমটা রাকীব স্যারের। তার আগের রুমটা মিটিং রুম হিসাবে উনি ব্যবহার করেন মাঝেমাঝে। এমনিতে ফাঁকাই পড়ে থাকে। সেখান থেকেই শব্দটা আসছে। কুর্চি দ্রুতপায়ে এগিয়ে যেতেই কানে এলো
— কুর্চিকে চলে যেতে হবে, আরিয়ান।
কুর্চি থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
লুবনা!
কান্নামেশানো গলায় আরিয়ানের সাথে কথা বলছে।
— কী বলছ তুমি, লুবনা?

কুর্চি এমনই আশ্চর্য হয়েছে যে গলা দিয়ে অজান্তেই আর্তনাদ বেরিয়ে আসছিল। কোনোমতে মুখে হাত চাপা দিয়ে সেটা বন্ধ করল। একবার ভাবল ফিরে যায়। আড়িপাতা কোনো ভালো কাজ না। এতে ভালো কিছু শোনবার আশা নাই। কিন্তু পরক্ষণেই মত বদলালো। ওকে শুনতে হবে। ও জানপ্রাণ দিয়ে খাটবে আর এরা তলেতলে ওকেই ফিনিশ করে দেবার মতলব করবে আর ও বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকবে, সেটি হচ্ছে না!
সাহস থাকলে সামনে আয়। দেখ লেঙ্গে!
শেষের কথাটি আরিয়ানের উদ্দেশ্যেই বলল অবশ্য।
আরিয়ান সারা সপ্তাহ ধরে ওকে গাধার খাটুনি খাটিয়েছে। নাকের ডগায় ফাইনাল নিয়ে কুর্চি আরিয়ানের কথামতো কাজ করতে গিয়ে মাথাকাটা মুর্গীর মতো চারিদিকে দৌড়ে বেড়িয়েছে। এখন এদিকে ন্যাকামি করে “কী বলছ তুমি, লুবনা!” করা হচ্ছে।

আচ্ছা, সেও দেখে নেবে!
যদি আর কোনোদিন ও স্বপ্নেও আরিয়ানের হাত থেকে কেক খেয়েছে তো নিজের নাম বদলে রাখবে।
কেক কেন, পেস্ট্রি, চকোলেট, একলেয়ার, পাই কিছুই খাবে না কখনো!
লাঠি বিস্কুটও না!
প্রেমও করবে না ওরসাথে!! কঠিন শপথ নিল কুর্চি।

করিডরের দিকের দেয়ালে কাচের জানালা রয়েছে, সেটার কোণে পাম ট্রি সাজানো ছিল। কুর্চি গিয়ে পাম ট্রির আড়ালে লুকিয়ে শুনতে থাকল।
লুবনা টিস্যু দিয়ে চোখের পানি মুছল
— ঠিকই বলছি আমি, আরিয়ান। মিলন তো চলেই গেছে। ওর জায়গাটা ফাঁকা হয়েছে। যেটার জন্য কুর্চিকে আনা হয়েছিল। এখন কুর্চি তাই করবে।
— গতদিন রাকীব স্যারের সাথে আবার আমি কথা বলেছি, লুবনা। রাকীব স্যার…
— আমি কিছু শুনব না, আরিয়ান। ড্যাডি আমাকে স্টুডিওতেই আসতে মানা করে দিয়েছে।
— সেটা উনার রাগের কথা, লুবনা।
— না, ড্যাডিকে তুমি চেন না। আমাকে বারবার মানা করেছিল রাফাতকে বিয়ে না করতে। রাগ করে আমি পালিয়ে বিয়ে করলাম, সে এখন শোধ তুলছে।
— আরে পাগল নাকি? উনি তোমার বাবা, শোধ তুলবেন কেন?
— ড্যাডি এবারে সত্যি রাগ করেছে আমার ওপরে। তার কথা শুনিনি, তার অমতে পালিয়ে থাইল্যান্ড চলে গেলাম। কিন্তু এখন বুঝছি কেন বারবার এমন করে মানা করছিল।
— কেন?
— রাফাত একটা ভ্যাগাবন্ড। সপ্তাহখানেকের মধ্যে টের পেলাম ও ড্রাগ এডিক্টও। ও আমাকে সোনার ডিম পাড়া হাঁস ভেবে বিয়ে করেছে। চালচুলা কিছু নাই। আমাকে যা বলেছিল সব মিথ্যা।
— সে কি! তুমি টের পাওনি?
— কিছুই টের পাইনি, আরিয়ান। এত অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু হয়ে গেছিল যে পরিস্কার মাথায় চিন্তাও করবার সুযোগ পাইনি। ড্যাডির সাথে জেদ করে বিয়েটা লুকিয়ে করলাম। রাফাত আমাকে ইম্প্রেস করতে এমন এমন সব খরচ করত, এত সারপ্রাইজ দিত, আমি পুরাই পাগলে গেছিলাম। বিয়ের পর জানতে পারলাম ধার করে করেছে এসব।
— তাহলে থাইল্যান্ড…
— সম্পূর্ণ সময় আমি খরচ করেছি। ওরকাছে ফুটা পয়সাও নাই। এনাফ ইজ এনাফ। এই জগদ্দল পাথরকে বয়ে বেড়ানোর কোনো ইচ্ছা আমার নাই। আমার জীবনের ওয়ার্স্ট ডিসিশান হচ্ছে রাফাত। ভুল করেছি আমি কিন্তু ভুল শুধরেও ফেলব।
— তুমি কি…
— হ্যাঁ আরিয়ান। ভুল করে অনর্থক মাশুল দেবার মতো মধ্যবিত্ত মেন্টালিটি আমার নাই। মাই ম্যারিজ ইজ নট ওয়ার্কিং আউট। এখন রাফাতকে ডিভোর্স দিব। দিয়ে আবার আগের মতোই ব্যস্ত হয়ে পড়ব। ড্যাডিকে বোঝাতে হবে আমাকে। তুমিও আমাকে হেল্প করো না প্লিজ।

আরিয়ানের দিকে জলভরা চোখ তুলে তাকালো লুবনা। ওর বড় বড় চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।
হঠাত করে রেগে গেল আরিয়ান। তিক্তস্বরে বলল
— তোমার এই এক অভ্যাস, লুবনা। বারবার ভুল করবে আর রাকীব স্যারের কাছে দৌড়াবে। ইউনিতেও এমন করেছিলে। মনে আছে সেই ছেলেটার কথা? আরেকটু হলে সে তোমাকে হয়ত কিডন্যাপই করে ফেলত। ভাগ্যিস তখন রাকীব স্যারের ড্রাইভার লোকজন জড়ো করে তাকে রাম ধোলাই দিয়েছিল। নাহলে সেদিন একটা যা তা ব্যপার হত।
এবারে তো কেউ জানতেও পারেনি। প্রতিবার তুমি ভুল করবে, বাবার কাছে দৌড়ে যাবে আর আশা করবে তিনি তোমাকে উদ্ধার করবেন। এভাবে জীবন চলে, লুবনা? তুমি একজাক্টলি কী চাও? কেন এভাবে নিজের জীবনটা বাজে খরচ করছ? রাকিব স্যার যে এবারে একদম বেঁকে বসেছেন, আমি তাকে খুব একটা দোষ দিতে পারছি না।
টেবিলের ওপর বসেছিল লুবনা, আরিয়ান সামনে দাঁড়িয়েছিল। এখন ওর কথার মাঝেই লুবনা লাফ দিয়ে টেবিল থেকে নেমে পড়ল। তারপর দুহাতে আরিয়ানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকল
—এখন ড্যাডিও আমার কথা শুনছে না, আরিয়ান। একমাত্র তুমিই আছ যে আমার কথা শুনবে। আমি সব আবার আগের মতো চাই। তুমি আমি একসাথে কাজ করব। কুর্চিকে সরিয়ে দাও। প্লিজ, প্লিজ আরিয়ান! হেল্প মি। দুজনে মিলে ড্যাডিকে বললে সে রাজি হয়ে যাবে। সে তোমার কথাকে আমার চাইতে বেশি ইম্পর্ট্যান্স দেয়।

কুর্চি এদের কথার মাঝে এমনভাবে ডুবে গেছিল যে কখন শরীরের পুরা ভর ছোট পাম গাছটার ওপরে দিয়ে ফেলেছিল, টেরও পায়নি। এখন পাম গাছটা ভার নিতে না পেরে সশব্দে টবশুদ্ধ উলটে পড়তেই প্যানিক করে ছুটে গিয়ে স্টুডিওতে ঢুকে পড়ল ও। এর কিছুক্ষণের মধ্যে সিঁথি এসে খবর দিল যে শুচি এসেছে।
— আরিয়ানকে ডাকো।
কুর্চির থমথমে মুখ দেখে ভুরু উঠিয়ে সিঁথি জানতে চাইল কী হয়েছে। কুর্চি জবাব দিল না। দরজা দিয়ে ঢুকল রুবেল। তার কিছুক্ষণের মধ্যে সিঁথি আরিয়ানকে ডেকে আনল। সাথে লুবনা।
আরিয়ান টেবিলে বসতেই কুর্চি স্মরণ করিয়ে দিল
— শুচি এসে অপেক্ষা করছে কিন্তু।
— জানি। শোনো কুর্চি। কথা আছে তোমার সাথে।
পাথর মুখে জবাব দিল কুর্চি
— বলো।
— আজ আমাদের সাথে লুবনাও থাকবে, কেমন? মানে আমরা তিনজনে মিলে শুচির ইন্টার্ভিউ নিব!
(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে